অনুভবে তুমি সিজন ২ শেষ পর্ব
লিজা মনি
ডার্ক স্টিল বাঁকানো চেয়ারে বসে আছে তিনজন যুবক। তাদের তিন জনের মুখেই মাক্স লাগানো। পড়নে কালো হুডি। তাদের সামনেই বাঁধা অবস্থায় আছে তিন জন ব্যক্তি। শরীরের ভিবিন্ন অংশে পচন ধরে ক্ষয়ে ক্ষয়ে পড়ছে। চোখ গুলো কোটরে বসে গিয়ে কেমন ভয়ংকার দেখা যাচ্ছে। পাঁচ বর্ষব্যাপী পাষাণ-নিষ্ঠুর নির্যাতনের যজ্ঞে দেহ তিনটি রূপান্তরিত হয়েছে এক জড়সড়, ক্ষতবিক্ষত, জীর্ণ-বিক্ষিপ্ত শবের ছায়াপথে। চামড়ার স্বাভাবিক উজ্জ্বলতা লুপ্ত হয়ে গিয়েছে অনেক আগেই। এখন ঘন পীতাভ ধূসরতায় নিপতিত। দীর্ঘ অনাহার ও অনিদ্রার ক্যানভাসে আঁকা মৃত্যুর নৈঃশব্দ্যচিত্র। প্রতিটি অস্থিসন্ধিতে জমে আছে বেদনার নৈরাজ্য। কঙ্কালের আকৃতি সুস্পষ্ট হয়ে উদ্ঘাটিত প্রতিটি নড়াচড়ায় বেজে ওঠে এক দুঃসহ করুণ রাগ। চোখদ্বয় পূর্বের দীপ্তি হারিয়ে গভীর কোটরে লুকানো নিস্পন্দ। চোখে সর্বদা আতঙ্কিত যেন সর্বক্ষণ মৃত্যুর প্রহর গুনছে। ঠোঁট শুকনো, পলিত, আর ফাটলধরা, তাতে রক্ত জমে জমে এক অবর্ণনীয় গল্প লিখেছে। শরীরজুড়ে অসংখ্য পুড়ে যাওয়া দাগ, বিদ্যুৎ-শক ও ধারালো অস্ত্রের খোঁচায় সৃষ্ট ক্ষতের অসংখ্য মানচিত্র। এইটি এক উপহাসময় দুঃস্বপ্নের নকশা।
শরীরের ভঙ্গিমা টালমাটাল। মেরুদণ্ড বেঁকে গেছে নৈরাশ্যের ভারে। হাতের নখগুলো হয়তো জোরপূর্বক উপড়ে ফেলা হয়েছিল। কিছু এখন বিকৃত ও কিছু গায়েব। দাঁতের অর্ধেক নেই, বাকিগুলো কালচে ও নড়বড়ে। মুখের প্রতিটি শব্দে যেন রক্তমাখা ইতিহাস চুঁইয়ে পড়ে। ত্বক কেমন রক্তাক্ত খসখসে হয়ে আছে। সাধারন মানুষ এদের দেখলে যে কোনো সময় জ্ঞান হারিয়ে ফেলবে। বর্তমানে কোনো মানুষ নয় যেন অত্যাচারে আবদ্ধ থেকে এক অর্ধ মৃত রক্তাক্ত কঙ্গালে পরিনত হয়েছে। মুখে – চোখে মেরে ফেলার আকুতি। কথা বলতে পারে না স্বর চলে গিয়েছে যেন।
এরপর ও একজন অস্ফুর্ত আওয়াজ তুলে ,
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
” মেরে ফেলো। মেরো ফেলো! সহ্য হচ্ছে না।
শব্দটা কানে আসতেই মাফিয়া বস ঠোঁট বাঁকায়। চেয়ারে ক্রিং ক্রিং শব্দ করে গম্ভীরতা টেনে বলে,
” আজ মারব। একদম কষ্ট ছাড়া রুহটা আলাদা করব। পাঁচ বছরে অনেক সহ্য করেছিস তরা বাপ বেটা। এইবার মুক্তি দিয়ে যাব।
অগ্নির কথাটা শুনে যেন তারা খুশিতে আত্নহারা। এই কষ্ট, এই অত্যাচার আর সহ্য হচ্ছে না। পাগল কুকুরের মত ছটফট করতে থাকে,,
” মারো! দ্রুত মেরে ফেলো।
অগ্নি ভ্রুঁ নাচিয়ে তাকায় তাদের দিকে। ইউভি বাঁকা হেসে আতিকের দিকে তাকিয়ে বলে,
” মারব ভাই। অবশ্যই মারব। তদের পচনশীল শরীরটাও আর দেখতে চাই না। বমি চলে আসছে।
রায়ান – তবে শত্রুতার কারন জেনে মরলে ভালো। পাঁচ বছর ধরে তো ছটফট করছিস কেনো তদের উপর এত অত্যাচার আর জুলুম। তাহলে আজ না হয় জানিয়ে দেয়।
রানবীর আর আতিক এক চোখে তাকায় তাদের দিকে। তাদের একটা চোখ রেখে অগ্নি, যাতে তাদের করুন অবস্থা দেখতে পারে। আরেকটা চোখ প্রত্যেকের তুলে নেওয়া হয়েছে। রানবীর ভাঙ্গা গলায় কোনোমতে আওড়ায়,
” কি সত্যি?
ইউভি ঠোঁট চেপে বলে,
” মনে পড়ে একদিন একটা বিজন্যাস পার্টি চলছিলো। তখন অনেক গুলো পরিবার তাদের বাচ্চাদের নিয়ে সেই পার্টি সেলিব্রেট করছিলো। ঠিক তখন তদের আগমন ঘটে। মেরেছিস আমার বাবা কে। আগুনে পুড়িয়ে দিয়েছিলি পুরো বাংলো। শুধু আমাদের বাবা – মাকেই মারিস নি জীবনের সবচেয়ে বড় অপরাধ তো সেদিন করে এসেছিলি।
— আমার কাকিয়াকে রে**প করে।
রায়ান তাকায় অগ্নির দিকে। অগ্নির চোখ লাল হয়ে আছে। কিছুক্ষন নিচের ঠোঁট কামড়ে ধরে বলে,
” আমার চোখের সামনে, প্রতিটি লোকের সামনে তরা দুই ভাই মিলে আমার মা সমতুল্য কাকিয়াকে রে*প করেছিলি। বাঁচার আকুতি, কাকা- কাকিয়ার আর্ত চিৎকার ওইদিন পৌরষত্বের আনন্দ পাচ্ছিলি। কাপুরুষের বাচ্চা! আমি সাজিদ চৌধুরি আর শিখা চৌধুরির নিজের সন্তান নয়। এডাপ্ট করা সন্তান ছিলাম। আমার কাকিয়া আর কাকা যতটা ভালোবাসত পৃথিবীর বুকে এমন ভালোবাসা পাওয়া খুব কষ্টের ছিলো। কিন্তু আফসোস তাদেরকে আমার চোখের সামনে তিলে তিলে মারলি। এরপর মনে পড়ে সেখান থেকে একটা ছেলে বাচ্চাকে তুলে নিয়েছিলি পাচার করবি বলে?
আতিক আর রানবীর তাকায় অগ্নির লাল হয়ে যাওয়া হিংস্র চোখ দুটির দিকে। ধীরে ধীরে তাদের সব কাহিনী মনে পড়তে থাকে। আতিক মাথা নাড়ায়।
অগ্নি বঁকা হেসে বলে,
” সেই ছেলেটাকে পাচার ও করে দিয়েছিলি অনেক টাকার বিনিময়ে। কিন্তু জানিস সে ছেলেটা কে?
রানবীর মাথা নাড়ায়। যার অর্থ সে জানে না। অগ্নি এইবার দুই হাত মেলে ঘাড় কাৎ করে তাদের দিকে তাকিয়ে বলে,
” আমি ছিলাম! পাচার হয়েছি। বাবা – মা সবাইকে হারিয়েছি। পাচার কেন্দ্রের অত্যাচার সহ্য করতে না পেরে দুইজনকে খুন করে পালালাম। এরপর ধীরে ধীরে নিজের ক্ষমতা জাহির করতে শুরু করলাম। তদের নজরে আমি আবার ও পড়ি। বাট চিনতে পারিস নি আমি সেই ছেলেটা, যাকে তুই পাচার করেছিলি। আমার ক্ষমতা আর শক্তি দেখে লোভে পড়ে আমাকে লালন- পালন করতে শুরু করলি। ধীরে ধীরে তদের হাত ধরেই আন্ডাগ্রাউন্ডের মাফিয়া লিডার হয়ে উঠলাম। কিন্তু এইটা কি জানতি আমার প্রতিটা পদক্ষেপে তদের ধ্বংসের ফাঁদ পেতে রাখতাম। কবে তদের নিজ হাতে তিলে তিলে খুন করব সেই প্রহর গননা করেছি। নিয়তি দেখ, যাকে তুই এই পর্যায়ে আসতে সাহায্য করলি কোনোদিন জানতেই পারলি না সেই তদের সবচেয়ে বড় শত্রু ছিলো।
আতিক আর রানবীর একে অপরের দিকে তাকায়। তাদের অসহায়ত্ব ফুটে উঠেছে। তবে কথা বলার মত ও শক্তি নেই। শুধু এইটুকু বলতে চাইছে, মেরে ফেলো। আর কত অত্যাচার করবে।
আতিক নিচে তাকিয়ে বলে ,
” সবচেয়ে বড় ভুল ছিলো তকে লালন – পালন করা।
জানতাম না তুই বিষ দাঁত পুষে রেখেছিস মনের মধ্যে। আমার ছেলেটাকেও মেরেছিস নির্মমভাবে।
অগ্নি উচ্চস্বরে হেসে উঠে। তবে সেই হাসি চিরস্থায়ী হয় না । মুহূর্তেই মুখের ভাব পরিবর্তন করে রাগে চিবিয়ে চিবিয়ে বলে,
” তার চেয়ে বড় ভুল ছিলো সেদিন আমাদেরকে সমুদ্রে আ্যটাক করা। তদের কারনে আমার স্ত্রী যে চিৎকার করেছিলো সেই চিৎকার গুলো অগ্নি চৌধুরির কাছে মৃত্যু সমতুল্য ছিলো।
অগ্নি ঘাড় ঘুরিয়ে রায়হানের দিকে তাকায়। রায়হানের করুন অবস্থা। সে কথা বলা বা শুনার পরিস্থিতিতে নেই। অগ্নি আর কিছু বলে না। দুইটা রিভলভার ইউভি আর রায়ানের হাতে তুলে দিয়ে বাঁকা হেসে বলে,
“শ্যুট দোজ সন্স অব পিগস কুইকলি! তদের বাবা- মায়ের মৃত্যুর প্রতিশোধ নে। আমি আমারটা পুষিয়ে নিয়েছি এই পাঁচ বছরে। বাট… বাট রায়হানকে আমি মারব। কারন ও আমার শিকার। সে আমার ইয়ানাকে কষ্ট দিয়েছে। আর… সে কোনো একজনের প্রান নিয়েছে।
ইউভি তরিৎ গতিতে তাকিয়ে বলে,
” কে? ঝর্না!
অগ্নি অদ্ভুতভাবে তাকায় ইউভির দিকে। যার দৃষ্টিতে ছিলো হ্যা শব্দ। ইউভি ফুঁশ করে শ্বাস টানে। ইউভি রিভলভারটা তাক করে আতিকের দিকে। রায়ান রানবীরের দিকে তাক করে রাখে। চোখে ভেসে উঠে কিভাবে তার বাবার বুকে ছুঁরি চালিয়ে ছিলো। কিভাবে পুরো বাঙলো দাঁউ দাঁউ করে আগুনে ঝলসে যাচ্ছিলো, সাথে আপন জনেরাও। মাত্র এক মিনিট বিরতি এরপর এই বিকট শব্দে থমথমে যায় চারপাশ। পর পর অনেক গুলো বুলেটের শব্দে পুরো টর্চার সেল যেন চুপ হয়ে যায়। দেয়ালগুলো ও যেন ভয়ে গুটিয়ে নিয়েছে নিজেকে। দীর্ঘ পাঁচ বছর পর পৈশাচিক নির্যাতন থেকে মুক্ত পেয়েছে আতিক, রানবীর আর রায়হান। রক্ত নেই শরীরে, তবুও রক্তে ভেসে গেছে মেঝে। চোখ বন্ধ করে ফেলে। মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে খুব দ্রুত। আর কত অত্যাচার সহ্য করবে? ?মাত্র কয়েকটা বুলেটের ব্যাবধানে বুক ঝাঁঝরা হয়ে মৃত্যুকে গ্রহন করে নেয়।
এক মাসের মত কেটে যায়। তারা সবাই বাংলাদেশে চৌধুরি ভিলাতে। রুহান আর আহিয়ার রিং বদল আজ। অনেক দিনের অভিমান – প্রেম সব শেষে তারাও আজ নতুন জীবন বাঁধতে চলেছে। আহিয়া রুহানকে মনে – প্রানে ভালোবাসত। রুহান এড়িয়ে যায় সব অনুভুতি থেকে। আহিয়া ভেঙ্গে গিয়ে নিজেকে সামলাতে পারলেও শিখা চৌধুরির দৃষ্টি থেকে নিজেকে সামলাতে পারে নি। একসময় আহিয়ার অনুভুতিটা জানাজানি হলে সাজিদ চৌধুরি নিজ দায়িত্বে রুহানের সাথে দেখা করে। আর শেষ সুযোগ দিয়ে প্রশ্ন করেছিলো,
” তুমি ও কি আমার মেয়ে আহিয়াকে পছন্দ করো?
রুহান নিজের অনুভুতিটাকে আটকে রাখতে পারে নি। ভয় নিয়ে ও সে বলে ফেলেছিলো,
” হ্যা পছন্দ করি আমি আহিয়াকে।
সাজিদ চৌধুরি গভীর নিশ্বাস ফেলে বলে,
” কয়েক বছরের সময় দিলাম আমি তোমাকে। এই কয়েক বছরের ভিতরে পড়াশুনা শেষ করে নিজের বাবার ব্যবসার হাল ধরবে। যেদিন প্রতিষ্ঠিত হবে সেদিন আমি আমার এক মাত্র মেয়েকে তোমার হাতে তুলে দিব। কিন্তু শর্ত একটাই…
— ক.. কি শর্ত আঙ্কেল?
— এখন ওর সাথে কোনো যোগাযোগ করবে না। যথাসম্ভব এড়িয়ে চলবে। তবে বিশ্বাস রেখো তোমার সাথেই আমার মেয়ে বিয়ে হবে। এখন আলাদা করার কারন আছে। আমার মেয়ের বয়স কম, অবুঝ অনেকটা। বিয়ে, স্বামী সংসার সামলানোর মত বয়স এখনও তার হয় নি। যখন ওর বয়স হবে সেদিন নিজে দাঁড়িয়ে থেকে তোমাদের বিয়ে দিব।
রুহানের কষ্ট হলেও সাজিদ চৌধুরির কথাটা মেনে নেয়। অপেক্ষা করলে সমস্যা কোথায়, যদি সমাপ্তিতে আহিয়াকে পেয়ে যায়।
— মেনে নিলাম আপনার শর্ত। কিন্তু মনে রাখবেন সর্বশেষ যাতে আমি আমার আহিয়াকে পায়।
— সাজিদ চৌধুরি কোনো কথা দিলে সেটা রাখতে জানে মাই সান।
রুহান বিষন্ন হাসে। সাজিদ চৌধুরি গাড়িতে উঠে তার চোখের সামনে দিয়ে চলে যায়। রুহান তাকিয়ে থাকে কিছুক্ষন। এরপর শুরু হয় পড়াশুনা শেষ করে জীবন প্রতিষ্ঠিত করা। বাবার ব্যবসায় হাল ধরে সে ও আজ একজন সফল ব্যবসায়ী। দীর্ঘ পাঁচ বছর সে আহিয়ার সাথে কোনো যোগাযোগ করে নি। আহিয়া বার বার গিয়েছে রুহানের কাছে কিন্তু সে বরাবর এড়িয়ে গেছে ব্যাপারটা। রুহান ইউকে থেকে এসেছে মাত্র এক সপ্তাহ হলো। এই এক সপ্তাহ আহিয়ার সাথে অনেক বার কথা বলার চেষ্টা করেছে বাট সফল হয় নি। সাজিদ চৌধুরি নিজের কথা রেখেছে। আজ তাদের ইঙ্গেজমেন্ট পার্টি। রুহানের বাবা- মা তারাও সবাই উপস্থিত।
চৌধুরি বাড়িতে খুশির আমেজ। অনেক দিন পর হল্লা পার্টি সবাই একত্রিত হয়েছে। এখন আর আগের ঠিক বাচ্চামোগুলো নেই। আকাশ আর অবনীর কোল জুড়ে একটা ফুটফুটে রাজকুমার। বয়স মাত্র এক বছর হবে আনুমানিক। সবাই এখন ছেলে থেকে বাবায় পরিনত হয়েছে। শুধু হতে পারছে না বেচারা ইউভি। কিন্তু সেও এখন হয়ে যাবে আর অপেক্ষা করা যাবে না। পরে বাচ্চা স্কুলে নিয়ে গেলে সবাই বাচ্চার দাদা বানিয়ে দিবে। এমন সাঙ্ঘাতিক রিস্ক সে আর নিবে না। আজ রাতেই সে বাচ্চা আসার প্রসেসিং শুরু করবে।
ইয়ানা বাড়ির কাজে ব্যস্ত। হাজার হাজার স্টাফ আর মেইড থাকলেই কোথাও যেন একটা খামতি দেখা যায়। নিজের কাজ নিজেকে সামলে নিতে হয়। শিখা চৌধুরি অনেকবার রাগও দেখিয়েছে ইয়ানাকে কাজ করার জন্য। কিন্তু ইয়ানা মুচকি হাসি দিয়ে এড়িয়ে যায়। শিখা চৌধুরি হতাশ হয়ে বাচ্চাদের সাথে খেলতে শুরু করেন। এখন উনার বড় ছেলে যদি এসে দেখে বউ কাজ করছে তাহলে পুরো বাড়িতে ধ্বংস লীলা লাগিয়ে দিব। ইয়াজ একটা ফোন নিয়ে গেইম খেলছে। মুখে গম্ভীরতা স্পষ্ট। ঠিক তখন ওই রাহা ছোট ছোট পায়ে ইয়াজের কাছে এগিয়ে আসে। ইয়াজের উড়ুর উপর হাত রেখে মিষ্টি সুরে বলে,
” পিঁয়াজ ভাইয়া? পিঁয়াজ ভাইয়া!
নিজের এত সুন্দর নামটার এমন করুন পরিনতি দেখে ইয়াজ কিছুটা রাগ দেখিয়ে তাকায় রাহার দিকে। ইয়াজের এমন চেহারা দেখে মেয়েটা কিছু ভয় পেয়ে যায়। ইয়াজ ভালোভাবে না তাকিয়ে আবার ফোন চোখ রাখে। ফোন চোখ রাখা অবস্থায় বলে,
” পিঁয়াজ নয় ইয়াজ ডাকবি।
ইয়াজের কথাটা যেন ছোট রাহা বুঝে নি। আবার ও আদো আদো গলায় বলে,
” সুন্দর লাদছে আমাকে ভাইয়া?
ইয়াজ বিরক্তি নিয়ে তাকায় রাহার দিকে। কিন্তু রাহার হাসিমুখা মুখটা দেখে নিজের বিরক্তি সরে যায়। রাহাকের ভালোভাবে স্ক্যান করে অন্য দিকে চোখ ঘুরিয়ে বলে,
” ইন্টারেস্টিং !
রাহা বোকার মত তাকিয়ে আছে ইয়াজের দিকে। ইয়াজের উড়ুর উপর হাত ঘেষেই যাচ্ছে। ইয়াজ রাহার হাত ধরে বলে,
” খুব সুন্দর লাগছে। তবে আজকে প্রশংসা করেছি তবে আর কোনোদিন করব না।
ইয়াজের কথা শেষ হতেই আনায়া দৌঁড়ে আসে। আনায়া ইয়াজের সমান। বাট ইয়াজ আনায়ার তুলনায় সব দিক দিয়ে বড় হয়ে গিয়েছে। তাই ইয়ানা ইয়াজকে স্কুলে ভর্তি করিয়ে দিয়েছে। আনায়াকে বাড়িতে পড়ানো হয় সামনের বছর তাকেও স্কুলে পাঠানো হবে।
আনায়ার শরীরে একটা পিন্ক কালারের গাউন। পায়ে একজুড়া সাদা জুতা। ইয়াজ নিজের বোনকে দেখে মুচকি হাসি দেয়। ভাইয়ের হাসি দেখে আনায়াও খিল খিল করে হেসে উঠে । ইয়াজ আনায়া আর রাহাকে চোখের ইশারা দিয়ে নিজের কাছে ডাকে। তারা ইশারা পেয়ে দুইজন’ই ইয়াজের কাছে যায়। ইয়াজ মোবাইলটার ক্যামেরা অন করে কিছু মিষ্টি মুহূর্তের ছবি তুলে নেয়। একজন তার বোন আরেকজন হয়ত ভবিষ্যতের রানী। রাহা আর আনায়ার দৌঁড়া- দৌঁড়িতে মুখরিত চারপাশ। এর মধ্যে সুমু অনেক বার চোখ রাঙ্গিয়েছে ধীরে ধীরে হাটার জন্য। কিন্তু কে শুনে কার কথা? যেখানে তারা নিজেরাই বাবার রাজকন্যা তখন কার ক্ষমতা আছে কিছু বলার।
সাজিদ চৌধুরির সাথে কিছুক্ষন খুনশুটি করে চলে আসে লিভিং রুমে। ঠিক তখন ওই শুনা যায় ইয়ানার সতর্কবানী,
” মেয়েরা ধীরে ধীরে হাঁটো। পড়ে গিয়ে ব্যাথা পাবে যে কোনো সময়।
সুমু — ব্যাথা তো ওরা পাবে। কিন্তু বাপের হাতে মাইর খাওয়াবে আমাদের।
ইয়ানার চোখে- মুখে চিন্তার ছাপ ফুটে উঠে। রাইট! ব্যাথা পেলে তো তারা মাইর খাবে। মাইর খাওয়ার আগে বাচ্চা সামলানো জরুরি। কাজ পরেও করা যাবে। কিন্তু এমন দানব মার্কা থাপ্পর খাওয়া যাবে না কিছুতেই। ইয়ানা কাজ রেখেই কিচেন রুম থেকে বেরিয়ে আসে। আর ঠিক তখন ওই আগমন ঘটে তিন মহা পুরুষের। অগ্নি, ইউভি আর রায়ান করিডর পেরিয়ে ভেতরে প্রবেশ করে। বাবাদেরকে দেখে রাহা আর আনায়া প্রতিবারের মত নিজ নিজ বাবার কোলে উঠে যায়। পিছন থেকে অরিদ আর আরিফ এসে ডিভানে ক্লান্ত হয়ে বসে পড়ে। রায়ান আর অগ্নি সাবধানে নিজের রাজকন্যাদের আগলে নেয়।
ইউভি সেদিকে তাকিয়ে ভোঁতা মুখে বলে,
” ভাই আমাকে একটা হাওলাত দে।
অগ্নি মেয়ের মাথায় চুমু খেয়ে বলে,
” নিজে কষ্ট করে ডাউনলোড করে নে। নিজের কষ্টের ফসল তকে কেনো দিব?
ইউভি কষ্ট নিয়ে তাকায় নিজের পাষান বন্ধুদের দিকে। কিভাবে কষ্টের কাহিনী আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে!
ইউভি মিনমিন সুরে বলে,
” সামান্য কষ্ট করে এমন ভাব দেখানোর কি আছে? সেইতো বেচারীকে অজ্ঞান করে ফেলতি। আমার বোন বলে তর ভাত খেয়েছে নাহলে অন্য কেউ হলে এমন উন্মাদের কপালে ডিভোর্স ঠুকে দিয়ে যেত।
— তর বোনের শরীরে শক্তি না থাকলে আমি কি করব। আমি কি বলে দিয়েছিলাম নাকি অজ্ঞান হওয়ার জন্য?
ততক্ষনে তিনজন ডিভানে বসে পড়েছিলো। ইয়ানা সামান্য ঠান্ডা,পানীয় নিয়ে আসে তাদের জন্য। অগ্নির কথাটা কানে আসতেই কপাল কুচকে বলে,
” কে অজ্ঞান হয়েছে? অসুস্থ নাকি কেউ?
অগ্নি গ্লাসে মুখ রাখা অবস্থায় ইয়ানার দিকে তাকায়। ইয়ানা একটা সাদা পাথরের ডিজাইন করা শাড়ি পড়েছে। কাল রাতেই শিখা চৌধুরি প্রতিটি বউকে উপহার হিসেবে গিফট করেছেন। আর বলে দিয়েছেন আজ যাতে পড়ে। তাই তারা সবাই শাড়ি পড়েছে। ইয়ানা উৎসুক হয়ে তাকিয়ে আছে। অগ্নি গম্ভীরতা নিয়ে নিজের চোখ সরিয়ে নেয়। ইয়ানা অবাক হয়ে যায় অগ্নির ব্যবহারে। এইভাবে রেগে গেলো কেনো?
রায়ান সামান্য হাসি দিয়ে বলে,
” ত.. তেমন কোনো ব্যাপার নয়।
অগ্নি মেয়েকে ডিভানে বসিয়ে দেয়। ইয়ানা কৃত্রিম হাসি দিয়ে আহিয়ার কাছে যাওয়ার জন্য পা বাড়ায়। সব মেয়েরা বর্তমানে তার কাছেই আছে। সিঁড়ির কাছে আসতেই নিজের হাতে কারোর রুক্ষ্ণ স্পর্শ অনুভব করে। ইয়ানা নাক- মুখ কুচকে পাশে তাকিয়ে ভড়কে যায়। অগ্নি তাকে জোর করে নিজের রুমে নিয়ে যায়। ইয়ানা কিছুটা রাগ দেখিয়ে বলে,
” এইভাবে টেনে নিয়ে এসেছেন কেনো? একটু পর অনুষ্ঠান শুরু। পথ ছাড়ুন, আর যেতে দিন।
ইয়ানা কথা বলা শেষ করতে পারে নি। ঠিক তখন’ই উন্মুক্ত পিঠ আর পেট ছুঁয়ে যায় এক শীতল স্পর্শ। মাদকতা মিশ্রিত কন্ঠ ভেসে আসে,
” শাড়ি কেনো পড়েছো? কি চাচ্ছো আমি অনুষ্ঠানে জয়েন না হয়? অর্ধেক মাতাল করে দিয়ে চোখের সামনে ঘুর ঘুর করবে আর আমি ছন্নছাড়া হয়ে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখে যাব শুধু? দুই মিনিটের মধ্যে শাড়ি চেইঞ্জ করে আসবে। নাহলে এই বন্ধ দরজা খুলবে ঠিক আমার মর্জি অনুযায়ী।
ইয়ানা কাঁদো- কাঁদো চোখে তাকায় অগ্নির দিকে। অগ্নি ঠোঁট কামড়ে ইয়ানার ঠোঁটে সময় নিয়ে চুমু খেয়ে বলে,
” চেইঞ্জ করে নে জান, নাহলে নিজেকে সামলানো কঠিন হয়ে যাবে।
আহিয়া আর রুহানের রিং বদল শেষ হয়ে গিয়েছে। তাদেরকে পাশা- পাশি বসানো হয়। ইয়ানার শরীরে থ্রি-পিছ দেখে সবাই প্রশ্ন করেছে,
” শাড়ি কেনো খোলে ফেললে?
ইয়ানা হাসি দিয়ে উত্তর দেয়,
” মেয়েকে নিয়ে সামলাতে পারছিলাম না তাই চেইঞ্জ করে ফেলেছি।
আহিয়া বিষন্ন মুখে বসে আছে। এই অনুষ্ঠান, রিং বদল এইসব নিয়ে তার কোনো অনুভুতি নেয়। প্রতিটা সময় থমথমে মুখে ছিলো, ছিলো না কোনো উত্তেজনা। নিজেকে আর ধমিয়ে রাখতে না পেরে আহিয়া শিখা চৌধুরির দিকে তাকিয়ে বলে,
” বড় আম্মু অসুস্থ ফিল করছি। আমি কি এখন নিজের রুমে যেতে পারি?
ইয়ানা প্রথম থেকেই আহিয়ার বিষন্ন মুখটা খেয়াল করছে। নিজেদের মধ্যে কোনো মলমালিন্য হয়েছে ভেবে বিষয়টা নিয়ে আর ঘাটাঘাটি করে নি। কিন্তু এখন আহিয়াকে নিয়ে সত্যি সন্দেহ লাগছে। সে তো জানে আহিয়া রুহানকে ঠিক কতটা ভালোবাসত, ঠিক কতটুকু পাগলামো করেছে। সব ঘটনায় শিখা চৌধুরি ইয়ানাকে ফোনের মাধ্যমে বলেছে। কিন্তু সেই মেয়েটা বিয়ে নিয়ে এত বিষন্ন! আহিয়ার কি এখন আর বিয়েতে ইন্টারেস্ট নেই?
শিখা চৌধুরি আহিয়ার আবদারে না করে পারলেন না। হয়ত সত্যি অসুস্থ ফিল করছে। মুখটাও কেমন বিষন্ন দেখা যাচ্ছে।মাতৃত্ব মন আহিয়াকে যাওয়ার জন্য অনুমতি দিয়ে দিলেন। শিখা চৌধুরির অনুমতি পেয়ে আহিয়া আর এক মিনিট ও দাঁড়ায় নি। গাউনের উপরের অংশ ধরে দ্রুত প্রস্থান করে নিজের রুমের দিকে। রুমে গিয়ে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে চোখের পানি ছেড়ে দেয়। মাথা থেকে মুকুটটা খুলে রাগে ছুঁড়ে ফেলে দেয় মেঝেতে। চুড়িগুলো একটানে খুলে ফেলে। এইভাবে বেপরোয়াভাবে খোলার কারনে হাত দিয়ে সামান্য রক্ত ও বেরিয়ে আসে। আয়নার সামনে নিজের অবয়ব দেখে চমকে যায় , পিছনে কোনো একজনকে দেখে। আহিয়া ঘন ঘন নিশ্বাস নিয়ে রুক্ষ ভাবে বলে,
” একটা মেয়ের রুমে ডুকার জন্য অনুমতি নিতে হয় মি, রুহান শেখ ।
— আর সে মেয়েটা যদি আমার স্ত্রী হয় তাহলে?
আহিয়া তাচ্ছিল্য হেসে বলে,
” স্ত্রী! এখনও বিয়ে হয় নি। জানি না আমার বড় আব্বু আপনার সাথে বিয়ে করার জন্য কেনো ফোর্স করছে বাট আমি আপনাকে বিয়ে করতে চায় না। আর হবেও না এই বিয়ে।
— সব ইন্টারেস্ট শেষ ? সব ভালোলাগা – ভালোবাসা শেষ? মাত্র পাঁচ বছর অপেক্ষা করতে পারলে না?
আহিয়া ঘুরে তাকায় রুহানের দিকে । চোখে পানি টুইটুম্বুর। রুহান চোখ ভরে দেখে নেয় নিজের প্রেয়সীকে। আগের মত বাচ্চা আর নেই সে। অনেকটা বড় হয়ে গিয়েছে। রুহানের নিশ্বাস ঘন হয়ে আসে । আহিয়া শক্ত গলায় বলে,
” অপেক্ষা তার জন্য করে যে অপেক্ষার মুল্য দিতে জানে। আপনার জন্য কেনো আমি অপেক্ষা করব শুনি? কে আপনি?
— তোমার ভালোবাসা। তোমার প্রথম ভালোবাসা আমি।
— ভুল। তখন আমি ছেলে- মানুষী করেছি। ভুল সময়ে ভুল একজনকে পছন্দ করেছিলাম। যে আমাকে সবসময় এড়িয়ে চলত। আমার ভালোবাসাটাকে হেসে উড়িয়ে দিত। কিন্তু এখন আমি বড় হয়েছি। বুঝতে শিখেছি, জানতে শিখেছি। আগের সপ্ন নিয়ে আর বসে থাকবেন না রুহান। কারন এই বিয়েটা হবে না।
রুহান আচমকা আহিয়ার কোমরে হাত রেখে নিজের কাছে নিয়ে আসে। এরপর অপরাধী গলায় আওড়ায়,,
— সরি! কি শাস্থি দিতে চাও আমাকে সব মাথা পেত নিব। ট্রাস্ট মি তোমাকে ছাড়া বাঁচত পারব না। সব শাস্তি সহ্য করব কিন্তু ছেড়ে চলে যাওয়ার মত শাস্তি সহ্য করার ক্ষমতা আমার নেই।
রুয়ানার স্পর্শ পেতেই আহিয়া ঠান্ডা হয়ে যায়। এরপর মনে পড়ে যায় রুহানের অবহেলা, দেশ ছেড়ে চলে যাওয়া, তার সাথে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করা। আহিয়া রেগে ছটফট করে উঠে,
” হাউ ডিয়ার ইউ মি, রুহান শেখ? আপনার সাহস কি করে হলো আমাকে স্পর্শ করার? ছাড়ুন আমাকে নাহলে এর জন্য শাস্তি পেতে হবে।
— সব শাস্তি মঞ্জুর করলাম। আগে আমাকে আমার কথা শেষ করতে দাও। যেভাবে চেপে রেখেছি সেভাবেই থাকবে। নড়াচড়া করলে কন্ট্রোলল্যাস হব।
আহিয়া জমে যায় রুহানের অসভ্য মার্কা কথায়। রাগে গিজগিজ করে উঠে পুরো শরীরে। এই মুহূর্তে সে রুহানকে সহ্য করতে পারছে না।
রুহান সামান্য কেশে ধীরে ধীরে সাজিদ চৌধুরি আর নিজের হওয়া চুক্তির কথা বলতে থাকে। আহিয়া প্রথমে ছটফট করলে করলেও পুরো ঘটনা নিশ্চুপে শুনে যায়।
রুহান কথা শেষ করে বলে,
” নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করে যদি তোমাকে পাওয়া যায় তাহলে পাঁচটা বছর অপেক্ষা করা কি এমন বড় কাজ। পাঁচ বছরের অপেক্ষার ফল হিসেবে তো তোমাকে পেলাম। এখন তুমি নিজেই চোখ ঘুরিয়ে নিচ্ছো? কি করব আমি?
— পাঁচ বছর ছাড় দিলাম। এর আগে যে আমাকে এড়িয়ে চলতেন সেটা?
– আহিয়া তখন আমি আমার ফিলিংস নিয়ে নিজেই সিউর ছিলাম না। তখন তোমার সাথে কিভাবে প্রেম করবো বলো? তখন তো তুমি নিজেও ছোট ছিলে? কিন্তু বিশ্বাস করো এই পাঁচ বছর আমি যে ছটফট করেছি তার কোনো পরিমান হয় না। খুব ভালোবাসি আমি তোমাকে।
শেষ! সব অভিমান রাগ শেষ হয়ে যায় ভালোবাসার মানুষটার সামান্য কয়েকটা সত্য বানীতে। কিন্ত সে এত সহজে হার মানবে না। আহিয়া আগের ভঙ্গিমায় বলে,
” বিয়ে করব আপনাকে। তবে আগের আহিয়াকে আর পাবেন না। আর কোনোদিন ভালো ও বাসব না।
রুহান এইবার কেঁদে দিবে ভাব। আহিয়া শক্ত চোখে তাকায় রুহানের দিকে। রুহান বিষন্ন কন্ঠে বলে,
” বিয়ে করলে, ভালোবাসা – বাসিও হয়ে যাবে।
— উহুম একদম নয়। আমাকে যেভাবে পাঁচ বছর অপেক্ষায় রেখেছে সেভাবে আপনাকে ও রাখব। না স্পর্শ করতে পারবেন আর না ভালোবাসতে পারবেন। আজীবনের দুরত্ব বজায় রেখে চলব।
— মরে যাব আমি।
— সমস্যা নেই।
— এতটা নির্দয় কিভাবে হলে?
— আপনি নিজেই বানিয়েছেন।
— সরি বলেছিতো।
— পাঁচ বছর পর এক্সেপ্ট করব।
— তাই না?
— হুম।
রুহান আহিয়ার মুখের দিকে তাকিয়ে কপাল কুচকে ফেলে। আহিয়া যে মনে মনে হাসছে সেটা চোখ এড়ায় নি। সে আহিয়াকে ছেড়ে দেয়। আহিয়া ছাড়া পেয়ে অন্য পাশে চলে যেতে যাবে এমন সময় পা জোড়া থমকে যায়। চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে থাকে সামনের দিকে। নিজের সাথে কি হচ্ছে ঠিক বোধগাম্য হচ্ছে না। শুধু বুঝতে পারছে নিজের মেদহীন কোমরে কারোর হাতের অবাধ্য বিচরন চলছে আর ঠোঁটে নরম স্পর্শে। আহিয়া এখনও স্তব্দ হয়ে আছে। নড়া-চড়া করার শক্তিটা ও পর্যন্ত নেই। রুহান চোখ বন্ধ করে আবেশের সাথে আহিয়ার ঠোঁটে চুমু খেয়ে যাচ্ছে। অবধ্য হাতটা ও ঠিক নেই। আহিয়া নিজের জ্ঞানে ফিরলেই ছটফট শুরু করে দেয়। ঠিক তখন ওই চোখ যায় সামনের দিকে। রুয়ানা ডেব ডেব করে তাকিয়ে আছে সামনের দিকে। আহিয়া দরজার সামনে রুয়ানাকে তাকিয়ে থাকতে দেখে নিজের সর্ব শক্তি দিয়ে ধাক্কা দিয়ে রুহানকে সরিয়ে দেয়। রুহান সরে যেতেই আহিয়া লজ্জায় ওয়াশরুমে ডুকে পড়ে। রুহান মুচকি হেসে আহিয়ার যাওয়ার দিকে তাকিয়ে পিছনে ফিরতেই থমথমে খেয়ে যায়। দরজার সামনে রুয়ানাকে দেখে সামান্য কেঁশে উঠে। রুয়ানা কপাল কুচকে তাকিয়ে আছে।
রুহান আমতা আমতা করে বলে,
” ক.. কি হয়েছে? এইভাবে তাকিয়ে আছিস কেনো?
— ভাইয়া কি করছিলে?
— কি করছিলাম?
— চুমু খাচ্ছিলে?
রুহান চোখ পাকিয়ে তাকায় রুয়ানার দিকে। রুয়ানা উচ্চস্বরে হেসে উঠে,
” আমি দেখেছি ভাইয়া সবটা। তুমি কিভাবে আহিয়াকে চুমু খাচ্ছিলে। আমার ভাই এত রোমান্টিক জানা ছিলো না।
রুহান আশ্চর্য বনে যায় রুয়ানার এমন উচ্চস্বরে কথা বলা দেখে। এই মেয়ে প্রথম দিনেই ওর মান – ইজ্জত শেষ করে দিবে। রুহান সামনে এগিয়ে যেতেই রুয়ানা ভোঁ দৌঁড়। এক দৌঁড়ে একদম নিজের রুমে গিয়ে থামে। বুকে ধরে বড় বড় শ্বাস নিয়ে মুচকি মুচকি হাসতে থাকে। ইউভি ড্রেস চেইঞ্জ করে শাওয়ার নিয়ে মাত্র বের হয়েছিলো।
রুয়ানাকে এইভাবে হাসতে দেখে ভ্রুঁ কিঞ্চিত কুচকে প্রশ্ন করে,
” এইভাবে হাসছো কেনো?
ইউভির কন্ঠ শুনে রুয়ানার হাসি থেমে যায়। নিজেকে স্বাভাবিক করে বলে,
” কই হাসছিলাম?
— স্পষ্ট দেখেছি।
— ভুল দেখেছেন।
— শ্বাসটাও আমি উপলব্দি করতে পারি। সত্যিটা বলো।
রুয়ানা অসহায় হয়ে তাকায় ইউভির দিকে । এরপর নিজেকে ধাতস্ত করে বলে,
” রুহান ভাইয়া আহিয়াকে চুমু খাচ্ছিলো। আমি গিয়ে দেখে ফেলেছি।
— সেখানে কেনো গিয়েছিলে?
— আপু পাঠিয়েছিলো দেখার জন্য আহিয়া কি করছে। গিয়ে দেখি তারা রোমান্স করছে। আমিও আগ্রহ নিয়ে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সবটা দেখলাম। এত সুন্দর দৃশ্য মিস করা যায় বলুন?
ইউভি অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে রুয়ানার দিকে।
— তাই বলে তুমি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখবে?
— ইচ্ছে হয়েছিলো। বাট আহিয়া আমাকে দেখে ফেলে। তাই ভাইয়াকে ধাক্কা মেরে লজ্জায় ওয়াশরুমে চলে যায়। আরেকটু থাকলে কি এমন হত? আমি ও আরেকটু দেখতে পারতাম।
ইউভি হতাশ এই মেয়েকে নিয়ে। বাহিরে যেতে হবে তাই দ্রুত নিজেকে তৈরি করে নেয়। রুয়ানার কথা ভেবে দীর্ঘশ্বাস ফেলে। আরেকজন চুমু খাচ্ছিলো সেটা পুরোটা দেখতে পারি নি বলে এখন মন খারাপ করছে। ইউভি এগিয়ে আসে রুয়ানার দিকে। এরপর সামান্য ঝুঁকে বলে,
” বাকিটা না হয় আমি’ই করে পুষিয়ে দেব।
রুয়ানা বুঝতে না পেরে তাকায় ইউভির দিকে।
— শাড়ি কেনো পড়ো নি?
— শাড়ি সামলাতে পারি না। তাই পড়ি নি। আপুও বারন করেছে পড়ার দরকার নেই।
— গুড। তবে রাতে পড়ে থেকো।
— কেনো?
— দেখব।
রুয়ানা সাথে সাথে লজ্জায় মাথা নিচু করে ফেলে। লজ্জায় গাল লাল হয়ে যায়। ইউভি সেদিকে তাকিয়ে সামান্য হেসে বলে,
” লজ্জাটা রাতের জন্য রেখে দিও। আজ রাত পুরোটা আমার।
কালো মার্সিডিজ গাড়িটা রাতের অন্ধকারে শাঁ শাঁ করে এগিয়ে যাচ্ছে। ইয়ানা সিটে হেলান দিয়ে বিষন্ন মুখে চোখ বন্ধ করে রাখে। আচমকা গাড়িটা থেমে যায় একটা কবরস্থানের সামনে। ইয়ানা চোখ তোলে তাকায় কবরস্থানের দিকে। তাদের বাবা- মায়ের কবর এখানে। ইয়ানা নিরবতা ভেদ করে গাড়ি থেকে নেমে কবরস্থানের কাছে যায়। হাটু ভেঙ্গে দশ মিনিট বসে থাকে। কিছু দোয়া – পাঠ করে চোখের পানি মুছে এগিয়ে আসে অগ্নির কাছে। ইয়ানা নিজের কান্না কন্ট্রোল রাখার জন্য কিছুক্ষন ঠোঁট চেপে রাখে। তবে আদ’ ও কি কান্না আটকে রাখা যায়। অতীতের স্মৃতিগুলো বার বার চোখে ভেসে উঠছে। গাড়িতে ডুকে নিজেকে আর আটকে রাখতে না পেরে অগ্নির বুকে হামলে পড়ে। কি আশ্চর্য ব্যাপার তাই না? যে তাকে শর্ত দিয়ে এখানে এনেছে, এক ফোটা চোখের পানিও ফেলা যাবে না। আর এখন তার বুকেই চোখের পানি ফেলছে।
ইয়ানা অগ্নির শার্ট খামচে ধরে বলে,
” খুব কষ্ট হচ্ছ মি, চৌধুরি। খুব মিস করছি আব্বু – আম্মুকে। তারাও নিশ্চয় ইয়াজ আর আনায়াকে দেখে খুব খুশি হত। এত দ্রুত কেনো চলে গেলো? কেউ কি আব্বু- আম্মুকে বাঁচাতে পারত না।
অগ্নির মুখ গম্ভীর হয়ে উঠে। কপাল ঘেষে বিরবির করে আওড়ায়,
” শান্ত হও। যে চলে যাওয়ার সে চলে যাবে, এইটাই স্বাভাবিক।
ইয়ানা শান্ত হয় তবে অগ্নির বুক থেকে মাথা তুলে না। একইভাবে শুয়ে থাকে নিজের নিরাপদ স্থানে। অগ্নিও কপালে কয়েকটা চুমু খেয়ে ইয়ানাকে নিজের সাথে ভালোভাবে আগলে নেয়। সাবধানতার সাথে ড্রাইভ করতে থাকে।
— অগ্নি চৌধুরি।
– হুম জান।
– কোথায় যাচ্ছেন?.
– কোথায় যেতে চাও?
– উহুম যাব না কোথাও। আনায়া আমাকে পাশে না পেলে কান্না করে উঠবে।
– আজ’ও আমার মেয়ের সাথে মিরা আর রুয়ানা আছে।
— না প্লিজ! আজ অন্তত কোনো সারপ্রাইজ চাই না।
— কি ইঙ্গিত করছো? আমি কিন্তু তেমন কিছু ভাবি নি।
তার মানে তুমি এইসব ভেবে নিয়েছো?
ইয়ানা আচমকা অগ্নির বুক থেকে মাথা তুলে। রাগে ফুঁশফুঁশ করে উঠে। ইয়ানাকে রাগতে দেখে অগ্নি ঠোঁট কামড়ে হেসে বলে,
” যা হবার বেড রুমে হবে। গাড়িতে, রাস্তাঘাটে কিছু হলে তোমার চিৎকারের আওয়াজে মরা মানুষ পর্যন্ত জীবিত হয়ে যাবে। প্রচুর ছটফটে তুমি।
ইয়ানা নাকের পাটা ফুলিয়ে গজগজ করতে থাকে।
— গাড়ি ঘুরিয়ে বাড়িতে নিয়ে চলুন। আমি বাড়িতে যাব।
— বেড রুমে যেতে চাও।
ইয়ানা আশ্চর্য হয়ে তাকায় এমন বেহায়া ইঙ্গিতে। অগ্নি ঠোঁট কামড়ে হেসে আচমকা গাড়িটা একটা ব্রিজের পাশে থামিয়ে দেয়। এরপর ইয়ানার দিকে তাকিয়ে বলে,
” এইভাবে গাল ফুলিয়ে তাকিয়ে থাকলে সত্যি বলছি গাড়িতেই অঘটন ঘটিয়ে ফেলব।
— দিন দিন আরও অশ্লিল হয়ে যাচ্ছেন। দুই বাচ্চার বাপ হয়েছেন সে খবর আছে?
— কেনো থাকবে না। তোমাকে হারানোর ভয় না থাকলে এতদিনে একটা ক্রিকেট টিম বানিয়ে ফেলতাম।
ইয়ানা অসহায় হয়ে তাকায় অগ্নির দিকে। আর সহ্য করতে পারছে না এইসব বেহায়া কথা। কিন্তু হঠাৎ মস্তিষ্কে একটা প্রশ্ন কাজ করে। অগ্নির দিকে তাকিয়ে বলে,
” অগ্নি চৌধুরি।
— হুম জান।
– আপনি ডেলিভারি কিভাবে করিয়েছিলেন? মানে আপনি তো এইসব জানেন না বা চিনেন না।
–তোমার কেনো মনে হলো আমি এইসব জানি না বা চিনি না?
— আপনি সামাজিক পরিবেশ থেকে দুরে ছিলেন। বাচ্চাকে কিভাবে কোলে নিতে হয় সেটাও ইউটিউব দেখে শিখেছেন। এরপর আনায়া আর ইয়াজকে কোলে নিয়েছেন। তাহলে বাচ্চা কিভাবে প্রসব করায় সেটা জানলেন কিভাবে?
অগ্নি গম্ভীর শ্বাস ফেলে বলে,
” জানি না। তখন এইটা ছাড়া আর উপায় ছিলো না। সাহস রেখেছিলাম পারব আর হাত বাড়িয়ে দিলাম এমন এক কঠিন কাজে। আল্লাহ সহায় ছিলো তাই হয়ত আমি পেরে গিয়েছি।
ইয়ানা অবাক হয়ে বলে,
” সত্যি বলছেন?
অগ্নি ইয়ানার দিকে তাকিয়ে নিজের নিচের ঠোঁট কামড়ে বলে,
” গুগলে দেখেছিলাম।
— মানে?
— এইসব নিয়ে তো আমার ধারনা নেই। তাই গুগলে জানতে চেয়েছিলাম কিভাবে বাচ্চা ডেলিভারি করায়। পর পর অনেক ভিডিও দেখেছি। সেই সিন গুলো মনে করেই সেদিন মাফিয়া থেকে ডাক্তারে পরিনত হয়েছিলাম।
— ইতিহাসে আপনি মনে হয় প্রথম বাবা যে বাচ্চা হওয়া থেকে শুরু করা বাচ্চা কোলে নেওয়া পর্যন্ত ইউটিউব দেখে শিখেছে। আর হ্যা এক মাসের বাচ্চার জন্য ফলের রস নিয়ে এসেছিলো। নিজের বাচ্চাদের খাওবে বলে।
ইয়ানা সামান্য হেসে উঠে। অগ্নি গাড়ি থেমে নেমে ব্রিজের রেলিং ধরে দাঁড়ায়। ইয়ানা নিজের হাসিটাকে থামিয়ে অগ্নির পাশা- পাশব হয়ে তাকায়। আকাশে অনেকগুলো তাঁরা। ইয়ানা অগ্নির দিকে তাকিয়ে আবদার করে বলে,
” ভালোবাসি শব্দটা আবার বলবেন?
অগ্নি কিছু বলে না। গম্ভীর হয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকে। ইয়ানা বিষন্ন মনে বলে,
” বিয়ের আট বছর পর ভালোবাসি শব্দটা শুনেছি। জানি না আবার কত বছর পর সেই কপাল হবে আমার।
— ভালোবাসি। তার থেকে বেশি তুই আমার অনুভব। যার অবস্থান আমার রক্তে মিশে আছে।
ইয়ানা চোখ তুলে তাকায় অগ্নির দিকে। একজন স্ত্রীর কাছে আর কি চাই। ইয়ানা মুচকি হেসে তাকিয়ে থাকে অগ্নির দিকে। অগ্নি ইয়ানার দিকে দৃষ্টি নিয়ে নিজের সাথে মিশিয়ে নেয়। চুলগুলো সরিয়ে বলে,
” তুই বাস্তব পৃথিবীর কেউ হয়েও এক রহস্যময় এক বহুমাত্রিক জগৎ। আর আমি প্রেমে ডুবে গিয়ে নিজের সব গণ্ডি হারানো মাত্রাহীন এক সত্তা। ভালোবাসা বললে ভুল হবে তুই তো আমার অনুভব। আমার অভ্যাস। যার হাসি ছাড়া জীবন ঠিক চলে না।
অগ্নি থামে। ইয়ানার সাথে আরও ঘনিষ্ট হয়ে ফিসফস করে বলে,
” আমার ভালোবাসা মানেই হচ্ছে আগুন। আমি জ্বালাব আর তুই ক্ষনে ক্ষনে জ্বলবে। আমি কিন্তু ভিলেন হয়ে ভালোবেসে যাব। যাকে বলে রক্তাক্ত ভালোবাসা।
— উহুম। মঞ্জুর করলাম আপনার সেই রক্তাক্ত ভালোবাসা। ভিলেনের ভালোবাসা খুব সুন্দর হয়। আপনার থেকে শিখেছি,
” ভিলেনের ভালোবাসা ফুল দিয়ে গড়া হয় না তা গড়া হয় বিষ, আগুন আর প্রতিজ্ঞার অদৃশ্য ছুরি দিয়ে। যাকে একবার নিজের বলে জানে, তার জন্য নিজের নরককেও আলিঙ্গন করতে প্রস্তুত সে।
ইয়ানা থেমে আবার ও বলে,
” আপনি যদি আগুন জ্বালান তাহলে সেই আগুনে আপনি নিজেই জ্বলবেন। আপনি মাফিয়া সম্রাজ্যের রাজা হলে আমি সেই সম্রাজ্যের রানী। তার চেয়ে বড় সত্য আমি আপনার ঘরের রানী। আপনার সন্তানদের মা আমি। পুরো সম্রাজ্য আপনার শষনে চলবে, আপনার কথায় ভয়ে চুপসে যাবে, থমকে যাবে পরিস্থিতি। কিন্তু আপনাকে থমকানোর জন্য আমার ঠোঁটের স্পর্শ’ই যথেষ্ট।
অগ্নি ঠোঁট কামড়ে হেসে। আগলে নেয় ইয়ানার ঠোঁট। আকাশ, চাঁদ তাঁরাকে সাক্ষী রেখে দুইজনে চম্বনে মিলিত হয়। এক সুন্দর মুহূর্ত দিয়ে ঘেরা ভালোবাসায় হারিয়ে যায় দুইজন।
অগ্নি ইয়ানার মাথটা বুকের সাথে চেপে ধরে বলে,
অনুভবে তুমি সিজন ২ পর্ব ৬৬
~তুমি ছিলে আলো আর আমি ছিলাম ছায়া।
তুমি ছিলে না শান্তি, ছিলে সংকল্প।
অস্ত্র ফেলে যে ভালোবাসা তা আমি শুধু তোমার জন্যই জেনেছি। আমার অন্ধকারের একমাত্র প্রদীপ তুমি। তোমার একফোঁটা চাহনিতে আমি বারবার ধ্বংস হয়েও পূর্ণ।
। অনুভবে তুমি আমার। ~
