অনুরাগে তুই দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ গল্পের লিংক || সাদিয়া শওকত বাবলি

অনুরাগে তুই দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ পর্ব ১
সাদিয়া শওকত বাবলি

“আপনাকে মুক্ত করে দিয়ে অবশেষে আমি হারিয়ে গেলাম। আমাদের আর কখনো দেখা না হোক, একে অপরের সান্নিধ্যে আর আসা না হোক।”
আবার সেই মেসেজ, আবার সেই শক্ত বানী। মধ্যরাতে শীর্ষ গভীর নিদ্রায় আচ্ছন্ন থাকাকালীন আবারও তার স্বপ্নে ভেসে উঠল সেই যন্ত্রণাদায়ক বাক্যগুলো। ঘুম ভেঙে গেল শীর্ষের। দিশেহারা হয়ে উঠে বসল বিছানায়। উন্মুক্ত তার শরীরের উপরিভাগ। শরীরে ঘাম দিয়েছে। পেটানো ন’গ্ন বক্ষ আর ললাট জুড়ে দেখা দিয়েছে মুক্ত দানার ন্যায় বিন্দু বিন্দু ঘামের। হৃদয়ের অবস্থাও নাজুক। এ অবশ্য শীর্ষের জন্য নতুন কিছু নয়।

গত ছয় মাস ধরে প্রায় রাতেই শীর্ষের স্বপ্নে ত্রয়ীর ক্রন্দনরত মুখটা আর এই যন্ত্রণাদায়ক মেসেজটা ভেসে ওঠে। হ্যা, ত্রয়ী চলে যাওয়ার ছয় মাস কেটে গেছে। অথচ শীর্ষ এখনো কোনো খোঁজ পায়নি মেয়েটির। সেই ত্রয়ীর চলে যাওয়ার পর থেকে শীর্ষ রোজ নিয়ম করে ত্রয়ীর গ্রামে খোঁজ-খবর নেয় যে মেয়েটি সেখানে গিয়েছে কিনা। রিমা ত্রয়ীকে গ্রামের বাসে উঠিয়ে দিয়ে এলেও আজ অবধি সে গ্রামে পৌঁছায়নি। ঐ বাস স্টেশন থেকে মেয়েটা কোথায় গেল, বেঁচে আছে নাকি ম’রে গেছে শীর্ষ কিচ্ছু জানে না, কিচ্ছু না। বুক চিরে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো তার। বিছানা ছেড়ে ঢুকলো ওয়াশ রুমে।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

ওয়াশ রুমে ঢুকতেই শীর্ষের নজর পড়লো আয়নার দিকে। গত ছয় মাস পূর্বেই সে নিজের বাড়ি ছেড়ে তার ফ্ল্যাটে উঠেছিল। ত্রয়ীকে খুঁজতে সেই যে বাড়ি থেকে বেরিয়েছিল তারপর আর ঐ বাড়িতে ফিরেনি সে। আর না আব্দুর রহমান খান ব্যতীত ঐ বাড়ির অন্য কারোর সাথে কোনো যোগাযোগ রেখেছে। বাবার সাথে যোগাযোগ তাও শুধু ব্যবসার খাতিরে। বাড়ি ছেড়ে দিলেও ব্যবসার কাজে যে নিযুক্ত হয়েছিল সেখান থেকে সরে আসেনি সে। এই সমাজে বেঁচে থাকতে হলে অর্থের প্রয়োজন আছে। শীর্ষ এগিয়ে গিয়ে দাঁড়াল আয়নার অভিমুখে। ছয় মাস আগের শীর্ষ আর এখনকার শীর্ষের মধ্যে বিস্তর ফারাক। আয়নার প্রতিবিম্বে তার শক্তপোক্ত পেটানো শরীরটা দৃশ্যমান। ছয় মাস পূর্বে সে নিয়মিত শারীরিক কসরত না করলেও এখন করে।

অন্তত নিজেকে ব্যস্ত রাখার জন্য, নিজের কষ্টগুলো ভুলে থাকার জন্যও সে এসবে ডুবে থেকে সময় কাটাতে চায়। শীর্ষ হাত উঁচিয়ে নিজের দাঁড়িতে হাত বুলালো। গালে স্থান পাওয়া কালো দাঁড়ি গুলো বৃদ্ধি পেয়ে প্রায় গলা অবধি ছুঁয়েছে। আগের তুলনায় মাথার চুলগুলোও বেশ বড়ো হয়েছে। দেখেই মনে হচ্ছে প্রিয় নারীকে হারানোর শোকে এ পুরুষ দেবদাসে পরিণত হয়েছে। শীর্ষ আয়নার সামনে থেকে একটি ছোট রাবার ব্যান্ড হাতে তুলে নিল। দুই হাত দ্বারা নিজের মাথার লম্বা চুলগুলো উপরে তুলে বেশ শক্তপোক্ত ভাবে একটি ঝুঁটি বাঁধলো। অতঃপর একটু ঝুঁকে গিয়ে পানির ছিটা দিলো চোখ মুখে। এখন আর ঘুম আসবে না। বাকি রাতটা এক মগ কফি হাতে নিয়ে ত্রয়ীর স্মৃতিচারণ করতে করতেই হয়তো কেটে যাবে।

শুভ্র রঙা তোয়ালে দ্বারা মুখ মুছতে মুছতে ওয়াশ রুম থেকে বেরিয়ে এলো শীর্ষ। কানে ভেসে এলো বিছানার উপরে পড়ে থাকা তার মোবাইলটা বাজছে। শীর্ষ তোয়ালেটা হাতে নিয়েই এগিয়ে গেল বিছানার দিকে।‌ মোবাইলটা হাতে নিয়ে দেখলো নয়ন কল করেছে। এত রাতে আবার এই ছেলে কল করেছে কেন? শীর্ষ কলটা ধরলো। কানের কাছে মোবাইলটা নিয়ে বলল,
“হ্যা, নয়ন বল।”
প্রায় সাথে সাথেই নয়ন কাঁদো কাঁদো কণ্ঠে বলল,
“স্যার, আমাকে বাঁচান। ওরা আমাকে মে’রে ফেলবে।”
শীর্ষ ভ্রু কোঁচকাল। থমথমে কণ্ঠে বলল,
“কেন কি হয়েছে তোর? আর ওরা কে?”

“আজ থেকে কয়েক মাস আগে এক লোককে কিছু টাকা ধার দিয়েছিলাম, স্যার। তারপর থেকে সে লাপাত্তা। আমার টাকা ফেরত দেওয়া তো দূরে থাক আমার সামনেই আসে না। আজ আবার একজনের কাছ থেকে তার খোঁজ পেলাম। ভেবেছিলাম এখানে এসে তাকে ধরে নিজের পাওনা টাকা উসুল করবো। কিন্তু এখানে এসে দেখি সে শুধু একা নয়, তার দলবলও আছে। তারা সবাই মিলে আমাকে আটকে রেখেছে। নিজের পাওনা টাকা আদায় তো করতেই পারলাম না, এবার মনে হয় আমার জানটাও যাবে।”
এই টুকু বলে থামল নয়ন। কণ্ঠ খাদে আবার বলল,
“আমি কোনো রকমে ওয়াশ রুমের অজুহাত দিয়ে আপনাকে কল করেছি। আপনি আমাকে বাঁচান স্যার।‌ নয়তো আমাকে ওরা সবাই মিলে উপরে পাঠিয়ে দিবে স্যার।”
“লোকেশন শেয়ার কর। আসছি আমি।”
শীর্ষ কল কেটে দিল। পরপর কল করল আলভী এবং রবিকে। তাদের আসতে বলে বেরিয়ে পড়লো বাড়ি থেকে।

শীর্ষদের খুব বেশি সময় লাগেনি নয়নের বলা স্থানে পৌঁছাতে। রাতের আঁধারে শহরের রাস্তাঘাট গুলো প্রায় ফাঁকা, আর জনমানবেরও দেখা নেই তেমন। অল্প সময়েই শীর্ষদের গাড়িটা এসে থামলো একটি নাইট ক্লাবের সামনে। গাড়ি থেকে একে একে নেমে দাঁড়াল শীর্ষ, রবি এবং আলভী। ধীরে ধীরে পশ্চিমা সংস্কৃতি গুলো যেন চুম্বকের ন্যায় গ্রাস করে নিচ্ছে সহজ-সরল বাঙালি সত্ত্বাকে। এই বাংলায় আগে এই নাইট ক্লাব, মা’দ’ক এসবের এত প্রচলন ছিল না। তবে এখন রাতের আঁধারে শহরের উন্নত এলাকা গুলো মেতে ওঠে নাইট ক্লাবের রঙে। সেখানে সমাজের উচ্চ শ্রেণীর মানুষদের রাতভর মজা, মস্তি, ম’দ, গা’জা, ই’য়া’বা সহ আরও নেশা জাতীয় দ্রব্যের খুব সহজ সেবন চলে। এখানে যে শুধু যুবসমাজকে খুঁজে পাওয়া যায় তা কিন্তু নয়, মধ্যবয়স্ক নারী পুরুষরাও আজ অনেকেই ঝুঁকে পড়েছে এদিকে।

শীর্ষ, আলভী এবং রবি পা চালিয়ে ঢুকলো নাইট ক্লাবের ভিতরে। চারদিকে লাল, নীল, হলুদ, সবুজ আলোর ঘনঘটা। যুবক যুবতীরা নাচে গানে মেতে উঠেছে। যুবতীদের বেশিরভাগই সংকীর্ণ পোশাকে আবৃত করেছে নিজেদের দেহ। তবে যুবকদের পোশাক সম্পূর্ণ। ক্লাবের এক ধারে দুই তিন জন আবার পানীয় বিক্রির তোরজোর চালাচ্ছে। এখানে যে শুধু নে’শা জাতীয় পানীয়ই পাওয়া যায় তেমন নয়, এখানে কোমল পানীয়ও পাওয়া যায়। রবি চারদিকটা দেখতে দেখতে হাঁটছিল শীর্ষদের সাথেই। হঠাৎ একটি মেয়েকে দেখে থমকে দাঁড়াল সে। মেয়েটি হাতে একটি গ্লাস ভর্তি পানীয় নিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে। পরনে সংকীর্ণ পোশাক। রবি হুট করেই মেয়েটির পানীয়র গ্লাসের মধ্যে ডান হাতের একটি আঙ্গুল ঢুকিয়ে দিল। হকচকিয়ে উঠল মেয়েটি। ব্যস্ত হয়ে বলল,

“একি আপনি আমার গ্লাসের মধ্যে হাত ঢুকিয়ে দিলেন কেন?”
রবি নিজের আঙ্গুলটা উঁচিয়ে ধরল। মেকি হেসে বলল,
“হাত না, আঙ্গুল দিয়েছি।”
রবির আঙ্গুলে এখনো গ্লাসে থাকা তরল লেগে আছে। সে আঙ্গুলটা মুখে পুরে নিল। সাথে সাথেই মুখাবয়বের বিকৃতি ঘটলো তার। থুথু দিয়ে ফেলে দেওয়ার চেষ্টা করল ঐ পানীয়। নাক ছিটকে বলল,
“এসব কি খাচ্ছেন? কেমন মোরগ পঁচা, মোরগ পঁচা গন্ধ আসছে। এই টুকু মুখে দিয়েই মনে হচ্ছে যেন পেটের নাড়ি ভুঁড়ি সব বেরিয়ে আসবে। কি গন্ধ যে মা’ই’রি। মানুষের রুচিতেও খরা লেগেছে।”
এই টুকু বলে থুথু ফেলতে ফেলতেই রবি চলে গেল। মেয়েটি নাক মুখ কোঁচকাল। রবির গমন পথের দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ রেখেই বলল,

“অসভ্য।”
শীর্ষ পা চালিয়ে ক্লাবের একদম শেষ প্রান্তে এসে দাঁড়াল। সেখানেই দেখা মিলল নয়নের। জনা তিনের তরুণ তাকে ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে। আর একজন চোখ মুখ শক্ত করে বলছে কিছু। শীর্ষ এগিয়ে গেল। গুরুগম্ভীর কণ্ঠে বলল,
“এখানে কি হচ্ছে?”
হঠাৎ অপরিচিত কারো কণ্ঠস্বর শুনে পাশ ফিরে তাকালো সবাই। নয়নের সাথে এতক্ষণ চোখ মুখ শক্ত করে কথা বলা ছেলেটা ক্রুদ্ধ কণ্ঠেই শুধাল,
“তুই কে?”
শীর্ষ জবাব দিলো না কোনো। নয়নের দিকে দৃষ্টি দিয়ে শুধাল,
“এত রাতে তুই নাইট ক্লাবে কি করছিস?”

নয়ন ভয়ার্ত দৃষ্টিতে তাকালো তার অভিমুখে দাঁড়ানো ছেলেটির দিকে, নাম সামিম। হ্যাংলা, পাতলা ছেলেটা। গালের চাপড়া ভাঙা। ওষ্ঠ দুটো কেমন কালচে রঙের। সি’গা’রে’ট খেতে খেতে হয়েছে বোধ হয়। নয়নের পাশের ফ্ল্যাটেই থাকতো ছেলেটি। সেখান থেকেই পরিচয়, এবং টাকা ধার চাওয়া। নয়ন সহজ সরল মানুষ। এতকিছু বোঝেনি বা ভাবেনি। একটা মানুষ বিপদে পড়ে তার কাছে টাকা চেয়েছে সেও দিয়ে দিয়েছে। মানুষই তো মানুষের জন্য করবে তাই না। কিন্তু টাকা ধার দেওয়ার পরদিন থেকেই দেখে সামিমের ফ্ল্যাটে তালা ঝুলছে। টাকা ফেরত দেওয়া তো দূরে থাক তার সামনেই আসে না। তারপর খোঁজ নিয়ে জানতে পারলো এই সামিম নামক ছেলেটা শুধু তার থেকেই নয়, আরও অনেকের থেকে টাকা ধার নিয়েছে। কিন্তু পরবর্তীতে আর কাউকেই তা ফেরত দেয়নি। তারপর সামিমকে খোঁজা শুরু করে নয়ন। একটা সময় জানতে পারে সে নাকি এই নাইট ক্লাবে প্রায় প্রতিদিন আসে। নয়ন ভেবেছিল আজ এখানে এসে সামিমকে ধরবে সে, তারপর ভালোভাবেই টাকা চাইবে। না দিলে তখন শীর্ষদের জানাবে। কিন্তু তার আগে নিজেই ফেঁ’সে গেল। এখন জীবন নিয়েই টানাটানি। নয়ন দৃষ্টি নুইয়ে নিল। মিনমিনে কণ্ঠে বলল,

“আপনাকে তো বলেছিলাম‌।”
শীর্ষ সামিমের পা থেকে মাথা অবধি চোখ বুলালো একবার। অতঃপর খুব স্বাভাবিক কণ্ঠেই বলল,
“এটাকে কি দেখে টাকা ধার দিয়েছিলি তুই? এটাকে দেখতেই তো কেমন চো’র চো’র লাগে। এর চেহারা দেখে যে কেউ বলে দিতে পারবে এ টাকা ফেরত দেওয়ার পাত্র নয়, বরং অন্যের টাকা মে’রে খাওয়ার পাত্র।”
“তখন বুঝিনি, স্যার।”
নয়ন মিনমিনে গলায় কথাটি বললেও সামিম ফুঁসে উঠল। শীর্ষর দিকে তেড়ে এসে বলল,
“কি বললি তুই? আমাকে দেখতে চো’র চো’র লাগে?”

“তোর ভাগ্য ভালো তোকে আমি চো’র চো’র দেখতে বলেছি। আমার জায়গায় অন্য কেউ হলে বলতো তোকে গুঁইসাপের মতো দেখতে। যে হাঁস মুরগির নিবাসের নিকট গিয়ে ঘাপটি মে’রে বসে থাকে। তারপর হাঁস মুরগি একটু দূরে সরলেই তাদের ডিম নিয়ে দৌড় দেয়।”
“তোর এত বড়ো সাহস আমাকে গুঁইসাপের সাথে তুলনা করছিস?”
সামিম রেখে মেগে একটা ঘুষি আঁকলো শীর্ষের দিকে। সাথে সাথেই সে হাতটা ধরে ফেললো। মুখ বাঁকিয়ে বলল,
“এই তো চেহারা। এই হ্যাংলা পাতলা দেহ নিয়ে এসেছিস আমাকে মা’র’তে? আমার এই ভুঁড়িহীন পেট দিয়ে একটা বারি মা’র’লে’ই তো উড়ে যাবি। অন্য সব অঙ্গ প্রত্যঙ্গের শক্তির কথা না হয় বাদই দিলাম।”
সামিম তবুও দমলো না। নিজের হাতটা শীর্ষের থেকে মুক্ত করার জন্য উঠে পড়ে লাগল। শীর্ষ হাতটা তো ছাড়লোই না, উলটো মুচড়ে ধরল। দাঁতে দাঁত পিষে বলল,

“ব্যাটা, বদমাইশ। অন্যের থেকে টাকা ধার করিস। আবার চাইতে এলে আটকিয়েও রাখিস।”
তীব্র ব্যথায় চ্যাচিয়ে উঠল সামিম। কণ্ঠে ব্যথাতুর ধ্বনির ছোঁয়া নিয়েই বলল,
“হাত ছাড়া বলছি।”
শীর্ষ আরও জোরে মুচড়ে ধরলো সামিমের হাত। সামিম দিশেহারা হয়ে তাকালো তার বন্ধুদের দিকে। তাড়া দিয়ে বলল,
“তোরা দাঁড়িয়ে আছিস কেন? আমার এর হাত থেকে ছাড়া।”
সামিমের বন্ধুরা এগিয়ে আসতেই তাদের পথ আগলে দাঁড়াল আলভী আর রবি। শীর্ষ একবার তাকালো সেদিকে। অতঃপর এক হাতে সামিমের হাত মুচড়ে ধরে রেখেই অন্য হাতে সজোরে একটা থা’প্প’ড় বসাল তার গালে। দাঁতে দাঁত পিষে বলল,

“নয়নের টাকা ফেরত দে।”
“দেব না। কি….”
বাকিটুকু আর শেষ করতে পারল না। তার আগেই আরেকটি থা’প্প’ড় বসাল সামিমের গালে। ফের দাঁতে দাঁত পিষে বলল,
“কি বললি আবার বল তো।”
“আমি….”
আবার থা’প্প’ড় পড়লো সামিমের গালে। ফের বলল,
“টাকা দিবি কিনা বল।”
“দেব, দেব।”
শীর্ষ এবার থা’প্প’ড় থামালো। বাঁকা হেসে বলল,
“দে তাহলে।”

থা’প্প’ড় খেতে খেতে সামিমের চোখ দুটো টলমল হয়ে উঠল। গালে হাত দিয়ে সে বলল,
“আমার কাছে এখন অতগুলো টাকা নেই।”
সামিমের কথা শেষ হতে না হতেই চোখ মুখের পরিবর্তন ঘটলো শীর্ষের। আবারও হাত উঁচিয়ে সে একটি থা’প্প’ড় হাঁকলো। সামিম ভয় পেল। দ্রুত বসে পড়লো নিচে। হড়বড় করে বলল,
“আমাকে একটু সময় দিন। আগামী কালকের মধ্যে আমি নয়ন ভাইয়ের সব টাকা ফেরত দিয়ে দেব।”
“ঠিক তো?”
“একদম।”

শীর্ষ একটু ঝুঁকলো। সামিমের থা’প্প’ড় দেওয়া গালে আলতোভাবে দুটো চাপড় দিয়ে বলল,
“যা বলেছিস মনে রাখিস। কালকের মধ্যে যেন টাকা পাই। নয়তো তোর এমন হাল করবো ভাবতেও পারবি না।”
কথাটা বলেই শীর্ষ সোজা হয়ে দাঁড়ালো। আলভী, রবি এবং নয়নকে ইশারা করে পা বাড়ালো পিছন ঘুরে। হাঁটতে হাঁটতেই পকেট থেকে একটি সিগারেট বের করে ধরালো। সিগারেট ফুঁকতে ফুঁকতে বেরিয়ে এলো ক্লাব থেকে।
জনমানবহীন নীরব শহর। রাতের ফাঁকা রাস্তা ধরে গাড়ি চালাচ্ছিল নয়ন। হঠাৎ একটা স্থানে এসে সে গাড়িটা থামিয়ে দিল। গাড়ির পিছনের সিটে বসে ছিল শীর্ষ এবং আলভী। শীর্ষ কপালে ভাঁজ ফেললো। ভ্রু কুঁচকে শুধাল,
“কি হলো গাড়ি থামালি কেন?”
“সামনে বোধহয় কিছু হয়েছে, স্যার।”

নয়নের কথা শুনে শীর্ষ, রবি এবং আলভী সামনের দিকে তাকালো। দেখা পেল আরেকটি গাড়ির। সাদা রঙের গাড়িটা রাস্তার পাশের একটি মোটাসোটা গাছের নিকট দাঁড়িয়ে আছে। সামনে এবং পিছনের লাইট জ্বলছে। কোনো দুর্ঘটনার কবলে পড়েছে বোধহয়। শীর্ষরা সব নিজেদের গাড়ি থেকে নেমে দাঁড়াল। দ্রুত ছুটে গেল সাদা রঙের গাড়িটার নিকটে। সে গাড়ির সম্মুখভাগ দুমড়ে মুচড়ে গেছে। আর ভিতরে ড্রাইভিং সিটে একজন যুবক অজ্ঞান হয়ে পড়ে রয়েছে। মাথা বেয়ে তার চুঁইয়ে চুঁইয়ে পড়ছে তাজা রক্ত বিন্দু। দুর্ঘটনাটা ঘটেছে বেশিক্ষণ হয়নি বোধ হয়। শীর্ষরা কোনো রকমে যুবকটিকে গাড়ির ভিতর থেকে টেনেটুনে বের করল। অতঃপর তাকে নিয়ে ছুটলো হাসপাতালে।

রাত গভীর। চারদিকটা নীরব নিস্তব্ধতায় ছেয়ে গেছে। শীর্ষ, রবি এবং আলভী বসে রয়েছে হাসপাতালের করিডোরে। তখন ঐ যুবকটিকে হাসপাতালে নিয়ে আসার সাথে সাথেই ডাক্তাররা তাকে নিয়ে ঢুকেছে অপারেশন কক্ষে। তারপর থেকে এখনো অবধি কোনো খোঁজ খবর পাওয়া যায়নি। ছেলেটা বেঁচে আছে নাকি ম’রে গেছে কে জানে! সকলের চিন্তা ভাবনার মধ্যেই একজন নার্স হন্তদন্ত হয়ে বেরিয়ে এলেন অপারেশন কক্ষের বাইরে। ব্যস্ত হয়ে বললেন,
“রোগীর অবস্থা আশঙ্কাজনক। রক্ত খরচ হয়েছে অনেক। এই মুহূর্তে তাকে পুনরায় রক্ত দিতে না পারলে বাঁচানো সম্ভব হবে না। আমাদের নিকট যতটা রক্ত ছিল দিয়েছি। এখন আপনারা ব্যবস্থা করুন।”
নার্সের কথায় আঁতকে উঠল রবি, নয়ন এবং আলভী। যতই লোকটা তাদের অপরিচিত হোক না কেন। তাদের চোখের সম্মুখে একটা লোক এভাবে রক্তের অভাবে ম’রে যাবে তা কিছুতেই তারা মেনে নিতে পারবে না। নয়ন ব্যস্ত হয়ে শুধাল,

“উনার রক্তের গ্রুপ কি?”
“এবি+।”
রবি, নয়ন এবং আলভী একে অপরের মুখ চাওয়াচাওয়ি শুরু করল। এবি+ তো তাদের কারোরই রক্তের গ্রুপ নয়। এখন তারা এই গ্রুপের রক্ত কোথায় পাবে? ঠিক তখনই শীর্ষ উঠে দাঁড়াল। নার্সের অভিমুখে দাঁড়িয়ে বলল,
“আমার রক্তের গ্রুপ এবি+। আমি দেব রক্ত।”
“আসুন আমার সাথে।”

পড়ন্ত বিকাল। আকাশের সূর্যটা তার তেজ কমিয়ে হেলে পড়েছে একদিকে। শীর্ষ হাতে একটি ফুলের তোড়া নিয়ে ঢুকলো হাসপাতালে। গত রাতে রক্ত দিয়ে সকালের দিকেই হাসপাতাল ছেড়ে বাড়িতে গিয়েছিল সে, তারপর অফিসে। তাই সারাদিনে আর হাসপাতালে আসা হয়নি। তবে আলভী, রবির থেকে খবর পেয়েছে লোকটার নাকি দুপুরের দিকে জ্ঞান ফিরেছে। শীর্ষ হাতে ফুলের তোড়া নিয়ে ঢুকলো গত রাতে তাদের হাসপাতালে আনা লোকটার কেবিনে। আলতো হেসে শুধাল,

“কি এখন কেমন আছেন?”
লোকটা হালকা ওষ্ঠ প্রসারিত করল। হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে থেকেই বলল,
“আলহামদুলিল্লাহ, মহান সৃষ্টিকর্তার কৃপায় এখন অনেকটা ভালো আছি। আপনি বোধহয় শীর্ষ?”
শীর্ষ হাসলো। মাথা নাড়িয়ে বলল,
“এর মধ্যে ওরা আমার নাম বলে দিয়েছে?”
“বলবে না কেন? আপনি আমার যা উপকার করলেন। আমি কিভাবে যে আপনার ঋণ শোধ করব জানি না।”
“ঋণ কিসের? আমি যেটা করেছি তা আমার কর্তব্য ছিল।”
“তবুও আপনি আমার জীবন বাঁচিয়েছেন।”

শীর্ষ এবং যুবকটির কথাপকথনের মধ্যেই হঠাৎ পাশের টেবিলের উপরে রাখা তার মোবাইলটা বেজে উঠল। এই মোবাইলটি গতরাতে ঐ যুবকটির পকেটে পেয়েছিল রবি। ভেবেছিল তার বাড়ির লোকদের খবর দিবে। কিন্তু লক খুলতে পারেনি কেউই। কি ধরণের লক দিয়েছিল কে জানে। সেই থেকে মোবাইলটা রবির নিকটেই ছিল। পরে যুবকটির জ্ঞান ফিরলে তার কাছে হস্তান্তর করেছে। শীর্ষ এমনি আশেপাশে চোখ ঘোরাতে ঘোরাতেই নজর পড়ল মোবাইলের স্ক্রীনে। একটা অক্ষর ‘ত্র’ চোখে পড়তেই যুবকটি হাত বাড়িয়ে মোবাইলটি হাতে নিল। কল রিসিভ করে কানের কাছে ধরে বলল,
“হ্যালো, আসসালামুয়ালাইকুম।”

অনুরাগে তুই দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ পর্ব ২