অনুরাগে তুই পর্ব ১৪
সাদিয়া শওকত বাবলি
তাই তো কথার মারপ্যাঁচে ফেলে গোল খাইয়ে কক্ষ থেকে বের করে দিলো শীর্ষকে। যাক এতক্ষণে অন্তত একটু শান্তি মিলেছে।
শীর্ষ চিত্তপটে নিগূঢ় বিতৃষ্ণা নিয়ে প্রবেশ করল নিজ কক্ষে। বিকট ধ্বনি তুলে আটকে দিলো কক্ষের দ্বার। ফ্ল্যাট থেকে যে ক্রোধ সে বয়ে নিয়ে এসেছিল তা এই মুহূর্তে পরিণত হয়েছে বিরক্তিকর এক অনুভূতিতে। শীর্ষ এসেছিল ত্রয়ীকে তার কথার অবাধ্য হওয়ার শাস্তি দিতে অথচ এখানে এসে কি এক ভাই ভাই ডাক নিয়ে চেতে উঠল। সম্পর্কের হিসেব নিকেসে যদি বসা হয় তবে শীর্ষ তো ত্রয়ীর ভাই ই হয়। তাহলে সেই ডাক নিয়ে এত প্রতিক্রিয়ার কি আছে? নিজে এতক্ষণ এই ডাক নিয়ে ক্রোধ প্রকাশ করে এখন নিজেই এর হেতু খুঁজে পাচ্ছে না শীর্ষ।
চারদিকে চঞ্চল কোলাহল। ছোট বড়ো গাড়ি গুলোর প্যা পো হর্ণের ধ্বনি কানে এসে লাগছে নির্বিঘ্নে। রিমা বসে রয়েছে কলেজ ক্যাম্পাসে। বন্ধু বান্ধবীদের নিয়ে আড্ডা দিচ্ছে। তার ক্লাস আরও কিছুক্ষণ পূর্বে শেষ হলেও বাড়িতে ফিরেনি এখনো। বান্ধবীদের সাথে আড্ডার মধ্যেই রিমা খেয়াল করল সাহেদ আসছে। এতক্ষণ এই লোকটির জন্যই তো তার অপেক্ষা। লোকটিকে প্রথম যেদিন এ কলেজে সে দেখেছিল সেদিনই মন দিয়ে বসেছিল। তারপর একটু খোঁজখবর নিতে গিয়ে জানতে পারল সাহেদ এ কলেজেরই প্রাক্তন ছাত্র এবং তার ভাইয়ের সাথেই পড়েছে। রিমা উঠে দাঁড়াল। চঞ্চল পায়ে গিয়ে মুখোমুখি হলো সাহেদের। নম্র স্বরে বলল,
“আসসালামুয়ালাইকুম স্যার। কেমন আছেন?”
সাহেদ চোখ তুলে দেখে নিলো রিমাকে। সৌজন্য হেসে জবাব দিলো,
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
“আলহামদুলিল্লাহ ভালো। তুমি?”
“জ্বী আলহামদুলিল্লাহ স্যার, আমিও ভালো। তা বাড়িতে যাচ্ছিলেন বুঝি?”
“হ্যা, কেন কিছু বলবে তুমি?”
রিমা ইতস্তত করল। হাত তুলে ললাটে এলোমেলোভাবে স্থান নেওয়া কাটা চুলগুলোকে কানের গোড়ায় গুঁজে দিয়ে বলল,
“না মানে তেমন কিছু না।”
সাহেদ হাত উঁচিয়ে হাত ঘড়িটার দিকে নজর বুলালো একবার। তাড়া দিয়ে বলল,
“আচ্ছা কিছু না বলার থাকলে আসছি আমি। আমার একটু তাড়া আছে।”
“কিন্তু স্যার…”
সাহেদ আর দাঁড়াল না, রিমার কথাও কানে নিলো না বোধ হয়। লম্বা লম্বা পায়ে প্রস্থান ঘটালো নিজের।
প্রকৃতি তার উজ্জ্বলতাকে বিদায় জানিয়ে ধীরে ধীরে পা বাড়াচ্ছে আঁধারের গহ্বরে। মৃদু শীতল বাতাস বইছে চারিধারে। ব্যস্ত শহরের আনাচে কানাচে তড়তড়িয়ে প্রজ্বলিত হচ্ছে অসংখ্য সোডিয়ামের আলো। প্রতিদিন এই সন্ধ্যার সময় খান বাড়ির বসার কক্ষে চায়ের আসর বসে। আজও তার ব্যতিক্রম ঘটেনি। আব্দুর রহমান খান, রিমা, পন্না, ত্রয়ী সবাই বসার কক্ষে বসে চা পান করছিলেন। শুধু নেই শীর্ষ। এই সময়ে বেশিরভাগই সে বাড়িতে থাকে না। তবে আজ আছে। ফাহমিদা বেগম রান্নাঘর থেকে এক মগ কফি হাতে এলেন বসার কক্ষে। মগটা পন্নার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বললেন,
“এটা শীর্ষকে দিয়ে আয় তো।”
পন্না তৎক্ষণাৎ চটপটে কণ্ঠে জবাব দিলো,
“আমি পারবো না। তুমি গিয়ে দিয়ে এসো।”
“তা পারবি কেন? সর্বক্ষণ আমাকে না খাটালে তো তোদের হয় না। বাপ, ভাই, বোন সবকটা মিলে আমার হাড় মাংস জ্বালিয়ে না খেলে তো তোদের শান্তি হবে না।”
ফাহমিদা বেগম নিগূঢ় রোষ নিয়ে পন্নাকে বকতে বকতে কফির মগটা এগিয়ে দিলেন ত্রয়ীর দিকে। গলার স্বর কিছুটা নরম করে বললেন,
“তুমি একটু যাও তো মা। শীর্ষকে কফিটা দিয়ে এসো।”
চা খেতে খেতে হঠাৎ বিষম খেল ত্রয়ী। কোনো মতে নিজেকে সামলে নিয়ে বলল,
“আমি!”
“হ্যা, দেখছোই তো পন্নাটা একদম কথা শুনছে না। তুমি একটু দিয়ে এসো মা।”
ত্রয়ীর ঢোক গিলল। এখন ঐ ভয়ংকর লোকের কক্ষে যেতে হবে তাকে? এমনি সে ভয় পায় ঐ লোকটাকে। তার উপর আজ আবার তার কথার অবাধ্য হয়ে কলেজে ক্লাস করেছে। দুপুরে তো সে বিষয়ে শাস্তি দিতে তার উপর চড়াও হয়েছিল শীর্ষ। তারপর কোনোমতে কথার জালে ফাঁসিয়ে ত্রয়ী বেঁচেছে। কিন্তু এখন বাঁচবে কিভাবে? এখন তো আরও নিজে যেতে বাঘের গুহায় যাচ্ছে। শীর্ষ তাকে পেলেই না খপ করে ঘাড়টা চেপে ধরে ভেঙে দেয় কে জানে! ফাহমিদা বেগমের মুখের উপর যে না বলবে তাও তো সম্ভব নয়। নিজের পরিবার পরিজন সব হারিয়ে যখন নিঃস্ব হয়ে পড়েছিল সে তখন এই মানুষগুলোই তাকে আশ্রয় দিয়েছে, ভালোবাসা দিয়েছে। যেখানে তার নিজের চাচারা তাকে বোঝা মনে করে ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছিল, নিজেদের সাথে নিতে অস্বীকার করেছিল সেখানে এই মানুষ গুলোই তার পাশে দাঁড়িয়েছে। সেই হিসেবে এই মানুষগুলোর প্রতিটি কাজে সাহায্য করা তার কর্তব্য। তপ্ত নিঃশ্বাস ফেলল ত্রয়ী। ফাহমিদা বেগমের হাত থেকে কফির মগটা হাতে নিয়ে পা বাড়ালো সামনে দিকে।
বদ্ধ দ্বার। ত্রয়ী দাঁড়িয়ে রয়েছে সে দ্বারের অভিমুখে। দ্বারে আঘাত করবে নাকি গলা বাড়িয়ে ডাকবে ভিতরের ভয়ংকর মানবকে সে নিয়ে দ্বিধায় জর্জরিত তার চিত্তপট। যদি ডাকেই তবে কি বলে ডাকবে? দুপুরে তো শীর্ষ তাকে শাসিয়ে বলে এসেছিল কিছু না বলে ডাকতে। এখন কিছু না বলে আবার কাউকে ডাকে কিভাবে? কিছু একটা বলে তো সম্বোধন করতে হবে? এদিকে কফি ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে। ত্রয়ী আর ভাবলো না। হাত উঁচিয়ে আঘাত করল বদ্ধ দ্বারে। প্রায় সাথে সাথেই ভিতর থেকে গম্ভীর কণ্ঠে ভেসে এলো,
“দরজা খোলা আছে।”
ত্রয়ী দরজা ঠেলে ভিতরে ঢুকল। এদিক ওদিক তাকিয়ে সম্মুখ পানে দৃষ্টি দিতেই স্থির হয়ে গেল তার দেহ খানা। হৃদস্পন্দন গাঢ় হলো পূর্বের তুলনায়। শীর্ষ উদম শরীরে তার দিকে পিঠ দিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে। পড়নে শুধু একটি কালো রঙা থ্রি কোয়ার্টার প্যান্ট। ফর্সা উদম পা জোড়া মেঝে ছুঁয়ে রয়েছে সগৌরবে। ত্রয়ী দৃষ্টি নুইয়ে নিল। ইতস্তত করে বলল,
“আপনার কফি।”
“টেবিলে রেখে যা।”
ত্রয়ী একটু এগিয়ে কফির মগটা রাখলো বিছানার পাশের টেবিলে। এরপর পিছু ঘুরতেই ধরফরিয়ে উঠল। শীর্ষ তার পিছনে এসে দাঁড়িয়েছে। লোকটা না একটু আগেই দূরে দাঁড়িয়ে ছিল? বুকে থুথু ছিটিয়ে সামনের দিকে তাকলো ত্রয়ী। ফের শীর্ষের ন’গ্ন মেদহীন দেহটা দৃশ্যমান হলো তার দৃষ্টি অভিমুখে। প্রসস্ত বক্ষস্থল যেন চিতিয়ে রেখেছে তারই দেখার জন্য। ত্রয়ীর ক্ষীণ হয়ে আসা হৃদস্পন্দন ফের বাড়লো তড়িঘড়ি করে। সাথে অজানা অদ্ভুত এক অনুভূতি হানা দিলো হৃদয় গহ্বরে। মেয়েটা দৃষ্টি নত করল। তৎক্ষণাৎ তার নজরে এলো শীর্ষের মেদহীন পেটের ভাঁজে একটি কাটা দাগ। ক্ষতটা পুরোনো নয়। মনে হচ্ছে যেন আজকালের মধ্যেই হয়েছে। ত্রয়ী আঁতকে উঠল। ব্যস্ত হয়ে বলল,
“একি এত খানি কাটালো কিভাবে আপনার?”
কথাটা বলেই ত্রয়ী তড়িঘড়ি করে হাত বাড়ালো শীর্ষের মেদহীন পেটের দিকে। শীর্ষ তৎক্ষণাৎ দুই কদম পিছিয়ে গেল। শান্ত অথচ গম্ভীর কণ্ঠে বলল,
“থেমে যা ওখানেই। আমাকে ছোঁয়ার দুঃসাহস করিস না মোটেই। জ্বলে পুড়ে যাবি।”
মেয়েটি আড়ষ্ট হলো। নিজের করা কর্মে নিজেই লজ্জিত হলো এবার। এভাবে তার শীর্ষের পেটের দিকে হাত বাড়ানো কিংবা ছোঁয়ার প্রয়াস চালানো কোনোটাই উচিত হয়নি। হঠাৎ আঘাতের চিহ্ন দেখে একটু বেশিই ভরকে গিয়েছিল বোধ হয়। তাই সকল বিবেচনাবোধ ক্ষুয়িয়ে বসেছিল কিয়ৎক্ষণের জন্য। ত্রয়ী প্রত্যুত্তর করল না শীর্ষের কথার। আড়ষ্ট ভঙ্গিতে পা বাড়ালো চলে যাওয়ার উদ্দেশে। শীর্ষও আর কথা বাড়ালো না। মেয়েটা সামনে থেকে সরতেই কফির মগটা হাতে তুলে নিল। প্রথমবার চুমুক বসিয়েই নাক মুখ কুঁচকে ফেলল। থমথমে কণ্ঠে ডাকল,
“দাঁড়া।”
ত্রয়ী দাঁড়িয়ে পড়লো। পিছু ঘুরে শুধাল,
“জ্বী, কিছু বলবেন?”
শীর্ষ পা চালিয়ে এসে দাঁড়াল মেয়েটার মুখোমুখি। হাতের কফির মগটার দিকে ইশারা করে বলল,
“এটা কি?”
“কফি।”
“এটা আগুন দিয়ে বানিয়েছিস নাকি বরফ দিয়ে।”
ত্রয়ী তৎক্ষণাৎ জবাব দিলো,
“কে জানে কি দিয়ে বানিয়েছে। আন্টি বানিয়ে দিয়েছে। আমি তো শুধু নিয়ে এসেছি।”
বিরক্তিতে কপালে ভাঁজ পড়লো শীর্ষের। এই হাদাটাকে তার জন্য কফি নিয়ে পাঠিয়েছে কেন কে জানে! এর বোকা বোকা কথা শুনলেই মেজাজটা বিগড়ে যায়। শীর্ষ হাতের কফির মগটা ধরিয়ে দিলো ত্রয়ীর হাতে। গমগমে স্বরে বলল,
“এখন গিয়ে আরেক মগ গরম কফি নিয়ে আসবি। এটার মতো যেন ঠান্ডা না হয়। তাহলে কিন্তু তোর কপালে দুঃখ আছে মনে রাখিস।”
ত্রয়ী মাথা নাড়ালো। মগটা হাতে নিয়ে ঝটপট ছুটলো নতুন করে কফি আনতে।
রান্নাঘরে আগে থেকেই কফি বানানো ছিল। তাই নতুন করে কফি আনতে খুব একটা সময় লাগলো না ত্রয়ীর। স্বল্প সময়েই সে কফি নিয়ে ছুটে এলো শীর্ষের কক্ষের অভিমুখে। এবার আর দরজায় কোনো আঘাত না করেই যত্রতত্র পায়ে ঢুকলো ভিতরে। শীর্ষ সেই উদম শরীরেই আধশোয়া হয়ে বসে রয়েছে বিছানায়। বসার দরুন মেদহীন পেট-টায় ভাঁজ পড়েছে গুটি কয়েক। শ্বাস-প্রশ্বাসের দাপটে বক্ষস্থল ফুলে ফেপে উঠছে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র সময়ের ব্যবধানে। ত্রয়ী এগিয়ে গিয়ে দাঁড়াল বিছানার পাশ ঘেঁষে। কফির মগটা বাড়িয়ে দিয়ে বলল,
“শার্টটা পড়ে নিতে পারতেন তো।”
শীর্ষ কফির মগটা নিতে নিতে শুধাল,
“কেন?”
ত্রয়ীর রাগ লাগলো। একটি মেয়ের সামনে এভাবে উদম শরীরে ঘোরাফেরা করছে আবার শার্ট পড়তে বলায় বলছে কেন? এর কি লাজ লজ্জা বলতে কিছু নেই? ত্রয়ী অন্য দিকে দৃষ্টি ঘুরালো। আমতা আমতা করে বলল,
“এভাবে আমার সামনে খালি গায়ে আছেন। কেমন একটা লাগছে!”
শীর্ষ কফির মগে চুমুক বসালো। ভাবলেশহীন ভাবে বলল,
“তোর রুমে গিয়ে খালি গায়ে হয়েছি?”
“না।”
“তাহলে তোর সমস্যা কি? আমার রুমে আমি শুধু শার্ট না প্রয়োজনে প্যান্ট ছাড়াও থাকবো। তোর কি?”
শীর্ষের কথার পিষ্ঠে আর কিছু বলার মতো খুঁজে পেল না ত্রয়ী। নতজানু হয়ে পিছন ঘুরলো সে। তবে দুই কদম সামনে এগিয়েই আবার থমকে দাঁড়াল। ফিরে এসে দাঁড়াল শীর্ষের মুখোমুখি। শীর্ষ কপাল কুঁচকাল। থমথমে কণ্ঠে শুধাল,
“আবার কি?”
ত্রয়ী ইতস্তত করে জবাব দিলো,
“আপনার পেটের কাটা অংশটায় বোধ হয় ঔষধ লাগানো প্রয়োজন। নয়তো ইনফেকশন হতে পারে।”
“হোক।”
“ব্যথা করছে না ওখানে?”
“ব্যথাই চড়ম উপভোগ্য।”
“ব্যথা আবার উপভোগ্য এই প্রথম শুনলাম।”
শীর্ষ হাত বাড়িয়ে ছুঁয়ে দিলো কাটা স্থানটা। আলতোভাবে হাত বুলাতে বুলাতে হুট করেই চেপে ধরল ক্ষতস্থানটা। সাথে সাথে আঁতকে উঠল ত্রয়ী। চ্যাচিয়ে উঠে বলল,
“কি করছেন কি? রক্ত বের হবে তো।”
শীর্ষ বাঁকা হাসলো। শীতল কণ্ঠে বলল,
“বের হতে দে। মাঝে মাঝে কিছু কলুষিত রক্ত বেরিয়ে যাওয়াও ভালো। মস্তিষ্ক ঠান্ডা হয়।”
ত্রয়ীর বলতে ইচ্ছে হলো,
অনুরাগে তুই পর্ব ১৩
“আপনি কি পাগল? কি সব বলছেন? ব্যথা নাকি উপভোগ্য আবার বলছেন রক্ত বের হলে মস্তিষ্ক ঠান্ডা হয়।”
মনে মনে ত্রয়ী কথাগুলো বললেও ঠোঁট নাড়িয়ে তা আর প্রকাশ করা হলো না। এ লোক তো পাগলই। তা নিয়ে আবার এত সংশয়ের কি আছে? মেয়েটা আর কথা বাড়ালো না। চুপচাপ বেরিয়ে গেল কক্ষ থেকে। ত্রয়ী বেরিয়ে যেতেই শীর্ষ কল লাগালো কাউকে। মোবাইলটা কানের কাছে নিয়ে গম্ভীর কণ্ঠে বলল,
“তোরা বের হ। আমি আসছি।”