অনুরাগে তুই পর্ব ২

অনুরাগে তুই পর্ব ২
সাদিয়া শওকত বাবলি

কিন্তু পুরোপুরি সামলে ওঠার পূর্বেই ভেসে এলো শক্তপোক্ত পুরুষালী এক কণ্ঠস্বর। গম্ভীর কণ্ঠে সে বলল,
“আমার শরীরটা নরম কোমল মাখনের মতো লাগছে? সারা জীবন এখানে এভাবে পড়ে থাকতে ইচ্ছে হচ্ছে নাকি?”
থামল লোকটা। দম নিয়ে ফের বলল,
“শরীর নাকি বালির বস্তা? পুরুষ মানুষের গায়ের ওপরে উলটে পড়ে তারপর উঠে দাঁড়াতে কষ্ট হয়?”
ত্রয়ী লজ্জা বোধ করল। লোকটা তাকে কি বলল? বালির বস্তা! সে তো খুব বেশি মোটা নয়। যতটুকু স্বাস্থ্য রয়েছে একদম ঠিকঠাক। আবার পুরুষ মানুষের গায়ে পড়া নিয়েও কিসব বলল। সে কি ইচ্ছে করে এই লোকের গায়ে পড়েছে নাকি? লোকটা হঠাৎ তার হাত ধরে টান দিলো বলেই তো পড়ল। দ্রুত মেয়েটা উঠে দাঁড়াল অপরিচিত পুরুষটার ওপর থেকে। এলোমেলো দৃষ্টি ফেলে দুঃখিত বা কিছু বলবে তার আগেই লোকটা হনহন করে হাঁটা ধরল নিচের দিকে। যেতে যেতে আবার গলা উঁচিয়ে বলল,

“মা, মা বাড়িতে এসব উদ্ভট প্রাণীদের ঢুকতে দিয়েছে কে? এরা নিজেরাও ম’র’বে অন্যদেরও মা’রবে।”
ত্রয়ী ঈষৎ ভরকালো। লোকটা কি উদ্ভট প্রণী তাকে বলল? কেন বলল? সে কি এমন করেছে? মনের মধ্যে প্রশ্ন গুলোর উদয় ঘটলেও ছাদে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে এসব ভেবে আর সময় নষ্ট করল না মেয়েটা। ছুট লাগাল নিচের দিকে।
নিচে বসার কক্ষে ইতোমধ্যে জমায়েত ঘটিয়েছে বাড়ির সবাই। ত্রয়ী গিয়ে কাচুমাচু হয়ে দাঁড়াল এক কোনে।
অপরিচিত লোকটা ত্রয়ীর দিকে আঙ্গুল তাক করল। রুক্ষ কণ্ঠে ফাহমিদা বেগমকে শুধাল,
“মা এই উদ্ভট প্রাণীটাকে আমাদের বাড়িতে কে ঢুকতে দিয়েছে? এটা এ বাড়িতে এলো কিভাবে?”
ফাহমিদা বেগম উত্তর দিবেন তার আগেই রহমান খান বললেন,
“ঠিক ভাবে কথা বলো শীর্ষ। সম্পর্কে ও তোমার বোন হয়।”
“বোন!”
“হ্যা, আমার মামাতো ভাইয়ের মেয়ে ও। বাবা-মা কেউ নেই তাই আমার সাথে নিয়ে এসেছি। ও এখন থেকে এখানেই থাকবে।”

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

শীর্ষ একবার তাকাল ত্রয়ীর দিকে। কপালে ভাঁজ ফেলে বলল,
“বাবা-মা নেই বলে নিজেও ছাদে ম’র’তে গিয়েছিলি নাকি?”
শীর্ষের কথা শুনে অবাক হলো সবাই। ত্রয়ী নিজেও অবাক হয়েছে। সে আবার কখন ছাদে ম’র’তে গেল? এতক্ষণে সে এই টুকু বুঝে গিয়েছে এই লোক রহমান খানের পুত্র। কিন্তু লোকটা কিসব বলছে। মাথা খারাপ হয়েছে নাকি? ত্রয়ীর অবাকতার মধ্যেই রহমান খান তাকালেন তার দিকে। নরম স্বরে বললেন,
“শীর্ষ কি বলছে? তুমি সত্যিই ছাদে এমন কিছু করতে গিয়েছে?”
“না চাচা।”
শীর্ষ চোখ ছোট ছোট করে তাকাল ত্রয়ীর দিকে। কপাল কুঁচকে শুধাল,
“তাহলে ছাদের কোনায় গিয়ে নিচে ঝুঁকে ঝুঁকে কি করছিলি?”
ত্রয়ী আমতা আমতা শুরু করল। মিনমিনে কণ্ঠে জবাব দিলো,
“নিচের গাড়িগুলো দেখছিলাম। গ্রামে একসাথে এত গাড়ি, এত মানুষ, এত বড়ো বড়ো বিল্ডিং কখনো দেখিনি তো তাই।”

শীর্ষ অবাক না হয়ে পারল না। আজকালকার সময়ে এমন কোনো মানুষ আছে যে গাড়ি, বড়ো বিল্ডিং দেখেনি? তারপর না হয় সে মেনে নিল এসব কিছুই এই মেয়েটা দেখেনি তাই বলে ওভাবে ঝুঁকে ঝুঁকে দেখবে? শীর্ষ কিছু বলতে গিয়েও থেমে গেল। এই মেয়ে ম’রু’ক না বাঁচুক তাতে তার কি? একবার মনে হয়েছে মেয়েটা ম’র’তে গিয়েছে সে বাঁচিয়ে নিয়েছে ব্যস তার কর্তব্য শেষ। এখন যা খুশি করুক তো। শীর্ষ পিছন ঘুরে নিজ কক্ষের দিকে পা বাড়াল। যেতে যেতে গলা উঁচিয়ে বলল,
“টেবিলে খাবার দাও মা। আমি ফ্রেশ হয়ে আসছি। দুপুরের খাবার এখনো খাওয়া হয়নি।”

মজলিস ভাঙলো ওখানেই। রহমান খান ত্রয়ীর মাথায় আলতোভাবে হাত বুলিয়ে চলে গেলেন নিজ কক্ষে। ফাহমিদা বেগম গেলেন ছেলের জন্য খাবারের ব্যবস্থা করছে আর পন্না ত্রয়ীর হাত টেনে আবারও পা বাড়াল ছাদের দিকে।
শীর্ষ এসে সোজা ঢুকল ওয়াশ রুমে। শরীরে জড়ানো জাম রঙা শার্টটা খুলে ফেলল মেঝেতে। মুহুর্তেই দৃশ্যমান হলো তার ফর্সা পেটানো দেহটা। হাত দ্বারা ঝর্নাটা ছেড়ে সে দাঁড়াল তার নিচে। প্রায় সাথে সাথেই বৃষ্টির ন্যায় ঝর্না থেকে আগত পানি বিন্দুরা স্পর্শ করল তার চুল, তারপর ঠোঁট, তারপর থুতনি বেয়ে নগ্ন দেহকে‌। ঝর্ণার পানির দাপটে শীর্ষের কিঞ্চিৎ লম্বা কালো চুলগুলো গড়িয়ে পড়ল তার ললাটে বেয়ে চোখের উপরে। বিরক্ত হলো সে। হাত উঁচিয়ে চুলগুলো ঠেলে দিল পিছনের দিকে। অতঃপর সেই হাতটাই দেওয়ালের উপরে রেখে কিছুটা কাঁধ বাঁকিয়ে দাঁড়াল। ফলস্বরূপ তার মেদহীন পেটে ভাঁজ পড়ল গুটি কয়েক। সেই ভাঁজকে কোমলভাবে স্পর্শ করে পানি বিন্দু গুলো গড়িয়ে পড়তে শুরু করল অঝোর ধারায়।
গোসল শেষে আগে থেকেই ওয়াশ রুমে থাকা শুভ্র রঙা তোয়ালেটা কোমড়ে জড়িয়ে নিলো শীর্ষ। ভেজা চুলগুলো ঝাড়তে ঝাড়তে বেরিয়ে এলো বাইরে। গিয়ে দাঁড়াল ড্রেসিং টেবিলের সামনে। হাত দ্বারাই মুখটা মুছতে গিয়ে চমকে উঠল সে। থুতনির কাছটায় ফুলে উঠেছে। হাত ছোঁয়ালে ব্যথাও লাগছে বেশ। এ নিশ্চই ঐ মেয়েটা যখন তার গায়ের উপরে পড়েছিল তখনকার ব্যথা। দাঁতে দাঁত চাপল শীর্ষ। বিরবিরিয়ে বলল,
“বালির বস্তা একটা‌।”

চারদিকে নীরব নিস্তব্ধতা বিরাজমান। ঘড়ির কাঁটায় টিক টিক ধ্বনি তুলে জানান দিচ্ছে রাত প্রায় একটা। খান বাড়ির সবাই বোধহয় এই মুহূর্তে নিদ্রার রাজ্যে পাড়ি জমিয়েছে সগৌরবে। আর শীর্ষ বাড়ি ফিরলো কেবল। নিজের কাছে থাকা বাড়ির ডুব্লিকেট চাবি দ্বারা দরজা খুলে ঢুকলো সে ভিতরে। ফের দরজাটা এটে দিয়ে পিছন ঘুরতেই প্যান্টের পকেটে থাকা মোবাইলটা বেজে উঠল। শীর্ষ পকেট থেকে মোবাইল বের করে নাম্বারটা দেখে নিল একবার। অতঃপর কলটা রিসিভ করে মোবাইলটা কানের কাছে ধরে বলল,
“হ্যা, আলভি বল।”
ওপাশ থেকে কি বলল শোনা গেল না। তবে শীর্ষ সামনের দিকে পা চালাতে চালাতে বলল,
“ওর দুই গালে মোট ছয়টা থাপ্পর লাগাবি, তারপর নাকটা টিপে ধরে রাখবি যতক্ষণ না ও নিঃশ্বাস নেওয়ার জন্য ছটফট করে। তারপরও যদি ও মুখ না খোলে তাহলে ওর মেইন পার্টের দিকে ব’ন্দু’ক তাক করে হুমকি দিবি ভবিষ্যত অন্ধকার করে দেওয়ার। আর এরপরেও যদি ও মুখ না খোলে তাহলে…”
থামল শীর্ষ। কটমট করে বলল,
“তাহলে আমি তোর ভবিষ্যত অন্ধকার করে দেব।”
কথাগুলো বলতে বলতে পা জোড়া থমকে গেল তার। আশপাশের কোথাও থেকে কান্নার শব্দ ভেসে এলো যেন। শীর্ষের কপালে ভাঁজ পড়ল। কিছুটা ব্যস্ত কণ্ঠে সে বলল,
“রাখ তো। তোর সাথে পরে কথা বলছি।”

কলটা কেটে দিলো শীর্ষ। তাকাল আশেপাশে। কান্নার শব্দ অনুসরণ করে গিয়ে দাঁড়াল একটি কক্ষের সম্মুখে। ভ্রু কুঁচকে এলো তার। এ কক্ষে আবার কে থাকে? রিমা আর পন্নার কক্ষ তো এটা নয়। তবে কি এখানে ঐ নতুন মেয়েটা থাকে? হবে হয়তো। কিন্তু সে এভাবে কাঁদছে কেন? কি হয়েছে তার? যা হয় হোক তো। চুলোয় যাক ঐ মেয়ে তাতে তার কি? শীর্ষ পা বাড়াল চলে যাওয়ার উদ্দেশ্যে। কিন্তু দুই কদম এগুতেই পা জোড়া থেমে গেল তার। মস্তিষ্ক এখান থেকে তাকে চলে যাওয়ার বার্তা দিলেও হৃদয় মানলো না তা। মানবতার খাতিরে হলেও তার জানা উচিৎ মেয়েটার কি হয়েছে। তপ্ত নিঃশ্বাস ফেলল শীর্ষ। আবার ফিরে এলো ত্রয়ীর কক্ষের সম্মুখে। হাত উঁচিয়ে টোকা দিলো বন্ধ দরজায়। সাথে আবার মৃদু কণ্ঠে ডাকল,
“এই বালির বস্তা দরজা খোল।”
স্বল্প সময়ের ব্যবধানেই দরজাটা খুলে গেল। শীর্ষ তাকাল ত্রয়ীর দিকে। গোলগাল চেহারার দারুণ এক কন্যা সে। গায়ের রংটা ফর্সা তবে তার মতো সাদা ফর্সা নয়, হলদেটে ফর্সা। স্বাস্থ্যের সাথে উচ্চতাটাও মানানসই। মেয়েটিকে দেখলে এক বাক্যে যে কেউ বলে দিবে সুন্দরী। চেহারাটাতেও কেমন একটা আলাদা মায়াবী ভাব বিদ্যমান। তবে এই মুহূর্তে কাঁদতে কাঁদতে মেয়েটির চোখ মুখ ফুলে নাকটা কেমন লাল হয়ে উঠেছে। ত্রয়ীর এই রূপ যেন আরও মায়াবী লাগল শীর্ষের নিকট। কেমন এক অনুভূতি হানা দিলো তার হৃদয় জুড়ে। বুকের ভিতরটায় কাঁপন ধরলো। অদ্ভুত অপরিচিত এক অনুভূতির আভাস পেল সে। শীর্ষ দৃষ্টি‌ নামিয়ে নিলো। থমথমে কণ্ঠে প্রশ্ন করল,

“কাঁদছিলি কেন?”
ত্রয়ী এলোমেলো দৃষ্টি ফেলল। আমতা আমতা করে বলল,
“এমনি।”
“এমনি এমনি কেউ কাঁদে?”
“না মানে দাদির কথা ভীষণ মনে পড়ছিল তাই।”
“ওহ আচ্ছা। তাহলে আবার গিয়ে কান্না শুরু কর। শুভকামনা রইল।”
কথাটা বলে পিছন ঘুরে পা বাড়াল শীর্ষ। ত্রয়ী একটু তাড়াহুড়ো করল। প্রায় সাথে সাথেই ডাকল,
“শুনছেন!”
শীর্ষ থমকে দাঁড়াল। ফের পিছন ঘুরে বলল,
“কিছু বলবি?”
ত্রয়ী দৃষ্টি নত করল। কিছুটা ইতস্তত করে বলল,
“আমি না একা ঘুমাতে পারি না। ভয় লাগে আমার। আসলে ছোট বেলা থেকে দাদির কাছে ঘুমিয়েছি তো।”
“তাহলে এখন কি করব আমি? তোর কাছে ঘুমাবো? আয় দুজন গলাগলি বেঁধে বিছানায় শুয়ে পড়ি। তারপর বাড়ির লোকের কাছে কট খেয়ে তোকে বিয়ে করে ফেলি। যতসব ভাঁওতাবাজি। যা গিয়ে আবার কান্না শুরু কর।”
ত্রয়ী হতবাক হয়ে তাকাল শীর্ষের দিকে। সে শুধু বলেছিল একা ঘুমাতে পারে না, ভয় লাগে তার। সে ভেবেছিল এই কথা বললে শীর্ষ হয়তো পন্নাকে বা কাউকে তার কাছে পাঠাবে। কিন্তু এই লোক তার কথাকে কোথায় নিয়ে গেল? বিয়ে, গলাগলি আবার কট খাওয়া! সে বলল ঢাকা আর এই লোক নিয়ে গেল দিল্লি। ত্রয়ীর ভাবনার মধ্যেই আবার মুখ খুলল শীর্ষ। কপালে ভাঁজ ফেলে শুধাল,

“তোর নাম কি?”
“ত্রয়ী।”
“তোরো…য়ী!”
অনেক কষ্টে নামটা উচ্চারণ করল শীর্ষ। নাক মুখ কুঁচকে বলল,
“এই বা*লে*র নাম কে রেখেছে তোর।”
বালের নাম! নিজের নাম সম্পর্কে এমন কুরুচিপূর্ণ মন্তব্য মানতে পারল না ত্রয়ী। হৃদয় বিদ্রোহ করল তার। কিন্তু সাহসের অভাবে সে বিদ্রোহ কণ্ঠে ধারণ করতে সক্ষম হলো না সে। বরং মিনমিন করে জবাব দিলো,
“বাবা রেখেছিল।”
“কি দাঁত ভাঙা নাম! তোর বাপ এটা খুঁজে পেয়েছিল কোথায়?”
“জানি না।”
“জানতেও হবে না আর। তোর নাম বালির বস্তাই ঠিক আছে।”
“কিন্তু…”
এই টুকু বলতেই তাকে থামিয়ে দিলো শীর্ষ। নিজের কক্ষের দিকে যেতে যেতে বলল,
“তুই মন খুলে কাঁদতে থাক। আমি ঘুমাই গিয়ে।”

অম্বরে সোনালী সূর্যটা উঁকি দিয়েছে। রাতের আঁধার কেটে উজ্জ্বল আলোয় ভরে উঠতে শুরু করেছে প্রকৃতি। ফাহমিদা বেগম এই ভোরে উঠেই নাস্তা তৈরির কাজে লেগে পড়েছেন। আগে একটা মেয়ে ছিল তাদের বাসায় কাজ করতো। এক দেড় মাস পূর্বে তার বিয়ে হয়ে যাওয়ায় কাজ ছেড়ে দিয়েছে। এখন একা হাতেই তাকে সবটা সামলাতে হয়। আটটার দিকেই আবার রহমান খান এবং শীর্ষ দু’জনেই বেরিয়ে পড়বে অফিসের জন্য। রহমান খানের নিজেরই ব্যবসা। শীর্ষও পড়াশোনা শেষ করে সেই ব্যবসার কাজেই যোগ দিয়েছে এবং দুই বাবা-ছেলে মিলে সংঘবদ্ধ প্রচেষ্টায় অল্প কিছুদিনের মধ্যে ব্যবসায় বেশ উন্নতিও ঘটিয়েছে। ফাহমিদা বেগমের নাস্তা তৈরির মধ্যেই ত্রয়ী এসে দাঁড়াল রান্নাঘরের দরজায়। নরম স্বরে বলল,

অনুরাগে তুই পর্ব ১

“আমি সাহায্য করব আন্টি?”
ফাহমিদা বেগম একবার তাকালেন দরজার দিকে। অতঃপর আবার নিজের কাজ করতে করতে বললেন,
“তুমি এত ভোরে! ঘুম ভালো হয়েছে তো?”
“হ্যা, আমার ভোরে ভোরেই ঘুম থেকে ওঠার অভ্যাস।”

অনুরাগে তুই পর্ব ৩