অনুরাগে তুই পর্ব ৪১

অনুরাগে তুই পর্ব ৪১
সাদিয়া শওকত বাবলি

ভোরের আলো ফুটতে শুরু করেছে। পূর্ব দিগন্তের কিনার ঘেঁষে লাজুক সূর্যটা কেবলই উঁকি দিয়েছে। চারপাশের পরিবেশে এখনো নিস্তব্ধতা বিরাজমান—সবাই হয়তো ঘুমিয়ে আছে। এই নীরবতাকে গায়ে মেখেই বাড়ির অভিমুখে দাঁড়িয়ে রয়েছে শীর্ষ আর নয়ন। উদ্দেশ্য গ্রামে যাবে। নয়ন তৈরি হয়ে ভোরের আলো ফোটার পূর্বেই চলে এসেছে। শীর্ষও ভোরে ভোরে উঠে তৈরি হয়ে নিয়েছে। অথচ এই যাত্রার মূল ব্যক্তি—ত্রয়ী, তার দেখা নেই এখনো। শীর্ষ আসার সময় মেয়েটিকে ডেকে এসেছে। তখন তো বলেছিল ‘আসছি’ তাহলে এখনো আসছে না কেন? শীর্ষের কপালে ভাঁজ পড়লো। বাম হাতের কব্জিতে পরিহিত ঘড়িটার দিকে এক পলক তাকিয়ে বলল,

“তুই এখানে দাঁড়া নয়ন, আমি একটু আসছি।”
শীর্ষ গৃহের দিকে পা বাড়ালো। তবে ভিতর পর্যন্ত আর যেতে হলো না। সামনেই দেখা মিলল ত্রয়ীর।
কাঁধে ব্যাগ, ঢুলুঢুলু পায়ে ধীরে ধীরে এগিয়ে আসছে তাদের দিকেই। তার পিছনে আবার আব্দুর রহমান খান এবং ফাহমিদা বেগমও আসছেন। শীর্ষ ত্রয়ীর দিকে এগিয়ে গেল। ভ্রু কুঁচকে শুধাল,
“রাতে ঘুমাসনি নাকি? ওভাবে ঢুলে ঢুলে হাঁটছিস কেন?”
রাতে সত্যিই ত্রয়ীর ঘুম হয়নি। বহুদিন পরে নিজের জন্মস্থানে, নিজের চিরচেনা স্থান সেই গ্রামে ফেরার আশায় একটু বেশিই উত্তেজিত ছিল সে। কিন্তু ভোরের দিকে কিভাবে কিভাবে যেন চোখ দুটো একটু লেগে এসেছিল যার রেশ এখনো কাটেনি। তবে এর কিছুই ত্রয়ী বলল না, শীর্ষের ছোড়া প্রশ্নের কোনো উত্তর দিলো না। চুপচাপ পা চালিয়ে গিয়ে বসলো গাড়ির পিছনের সিটে। আব্দুর রহমান খান এবং ফাহমিদা বেগমও ইতোমধ্যে এসে দাঁড়িয়েছেন তাদের নিকটে। ফাহমিদা বেগম মস্তিষ্কে মাতৃসুলভ চিন্তা নিয়েই স্নিগ্ধ কণ্ঠে বললেন,

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

“সাবধানে গাড়ি চালাবি, আর পৌঁছে একটা কল করিস।”
স্ত্রীর কথা শেষ হতে না হতেই আব্দুর রহমান খান বললেন,
“সাবধানে যাবে। আর ত্রয়ীর খেয়াল রাখবে।”
শীর্ষ মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানালো বাবা-মায়ের কথায়। অতঃপর গিয়ে বসলো গাড়ির ড্রাইভিং সিটে। নয়নও আর কোনো বাক্যব্যয় না করে বসলো শীর্ষের পাশের সিটে।

কিছুটা সময় গড়ালো। শীর্ষরা কেবলই তাদের শহর ছাড়িয়ে ভিন্ন অঞ্চলে ঢুকেছে। হাইওয়ে ধরে গাড়ি চালাতে চালাতেই ঘাড় বাঁকিয়ে সে তাকালো পিছনের দিকে। ত্রয়ী চোখ বন্ধ করে সিটের সাথে হেলান দিয়ে রয়েছে। ঘুমিয়ে পড়েছে বোধ হয়। গাড়ির দুলুনিতে মাঝে মাঝেই সে দুলে উঠছে। মাথাটা হেলে পড়ছে এদিক ওদিক। শীর্ষ কপালে ভাঁজ ফেললো। হুট করেই থামিয়ে ফেললো গাড়িটা। আকস্মিক গাড়িটা থেমে যাওয়ায় ত্রয়ী সামনের দিকে একটু ঝুঁকে গেল।‌ সাথে সাথে ধরফরিয়ে উঠে বসলো সে। এদিক ওদিক দৃষ্টি ঘুরিয়ে হড়বড় করে বলল,
“একি কি হয়েছে? হঠাৎ গাড়ি থামালেন কেন?”
শীর্ষ উত্তর দিলো না ত্রয়ীর করা প্রশ্নের। সিটবেল্ট খুলতে খুলতে নয়নকে বলল,
“তুই চালা গাড়িটা। আমি পিছনে যাচ্ছি।”
শীর্ষ গাড়ি থেকে নামলো। পিছনের দরজাটা খুলতেই ত্রয়ী তার দিকে প্রশ্ন ছুড়ে দিলো,
“সামনে কি সমস্যা? পিছনে এলেন কেন?”

শীর্ষ এক ভ্রু উঁচালো। গাড়ির ভিতরে বসতে বসতে বলল,
“আমার গাড়ি আমার ইচ্ছে। তোকে কইফিয়ত দিতে হবে নাকি?”
ত্রয়ীর চোখ মুখ কুঁচকে এলো। সামান্য একটা প্রশ্ন করেছে। সুন্দরভাবে উত্তর দিলেই তো হয়। তা না রসকষহীন উত্তর। মেয়েটার মুখশ্রী থমথমে আকার ধারণ করল। বিরবির করে বলল,
“কথা না যেন কু’ত্তা’র পা’দ।”
শীর্ষ নিকটেই ছিল। ফলস্বরূপ শীর্ষ কথাটা শুনে নিল। গম্ভীর কণ্ঠে সে শুধাল,
“তুই কখনো কু’ত্তা’কে পা’দ দিতে দেখেছিস?”
ত্রয়ী থতমত খেয়ে গেল। এত আস্তে বলা কথাও শুনে নিল এই লোক? লজ্জা, অস্বস্তিরা ঘিরে ধরলো মেয়েটাকে। আমতা আমতা করে সে বলল,

“না মানে…..”
এই টুকু বলতেই তাকে থামিয়ে দিলো শীর্ষ। ফের গম্ভীর কণ্ঠেই শুধাল,
“তাহলে বললি কেন আমার কথা কু’ত্তা’র পা’দে’র মতো।”
“না মানে…. ভুলবশত, ভুলবশত মুখ ফসকে বেরিয়ে গেছে।”
“যা দেখিসনি তা মুখ থেকে বেরুবে কেন?”
ত্রয়ী ঢোক গিললো। দৃষ্টি নত করে জবাব দিলো,
“স্যরি, আর বেরুবে না।”
তবে সে মনে মনে বলল,
“বেরুবে, একশত বার বেরুবে। দেখি তুই কিভাবে আটকাস। ব্যাটা ধলা মূলা একটা।”
শীর্ষ আর কথা বাড়ালো না। সে দৃষ্টি ঘুরিয়ে তাকালো অভিমুখে। আদেশের স্বরে নয়নকে বলল,
“গাড়ি স্টার্ট কর।”

আদেশ পেয়ে নয়ন দেরি করল না আর। মুহুর্তেই গাড়ি নিয়ে সাঁই সাঁই করে ছুটলো সম্মুখ পানে।
কিছুটা সময় অতিবাহিত হতেই ত্রয়ী আবারও ঘুমিয়ে পড়লো। এমনিও তার গাড়িতে উঠলেই ঘুম পায়। তার উপরে আবার গতকাল রাতে ভালো ঘুম হয়নি। ঘুমের দাপটে এবং গাড়ির ঝাঁকুনিতে মেয়েটার মাথাটা একটু পর পর এদিক ওদিক হেলে যাচ্ছিল আর সেও ধরফরিয়ে উঠছিল। শীর্ষ ত্রয়ীর ঘুমের সুযোগ নিয়ে তার দিকে একটু চেপে বসলো। কাঁধ পেতে দিলো প্রেয়সীর মাথাটা নিজ কাঁধে নেওয়ার বাসনায়। এমনি সজাগ থাকলে তো আর কাঁধে মাথা দিবে না। তাও যদি ঘুমের ঘরে দেয়। তবে কিছু মুহূর্ত চলে গেলেও মেয়েটার মাথাটা শীর্ষের কাঁধ স্পর্শ করল না। আড় চোখে একবার তাকালো প্রেয়সীর দিকে। সেই পূর্বের ন্যায় মাথাটা তার এদিক ওদিকই হেলে যাচ্ছে, তবুও তার কাঁধে ঠাঁই নিচ্ছে না। শীর্ষ আর একটু চেপে বসলো মেয়েটির দিকে। বিরবির করে বলল,
“এদিক ওদিক না পড়ে আমার কাঁধে পড়।”
স্বল্প সময়! এর মধ্যেই হঠাৎ ত্রয়ীর মাথাটা শীর্ষের কাঁধ স্পর্শ করল। শীর্ষ প্রথমে একটু চমকালো । শিরশিরিয়ে উঠল তার পুরো শরীরটা। হৃদস্পন্দন গাঢ় হলো পূর্বের তুলনায়। হৃদয়ে এক সুখ সুখ অনুভূতি হানা দিলো তড়িঘড়ি করে। ওষ্ঠের কোন ঘেঁষে তার ফুটে উঠল বিশ্ব জয়ের হাসি। এ যেন প্রেয়সীর মাথা তার কাঁধ স্পর্শ করেনি, বরং সে পুরো বিশ্বটাকেই জয় করে ফেলেছে।

দুপুর গড়িয়ে প্রায় বিকেলের পথে। তবে সূর্যটা এখনো তার জ্বালার সুর নরম করেনি। বিস্তৃত তাপ নিয়ে সে আকাশের বুকে দাউ দাউ করে জ্বলে যাচ্ছে। ঠিক এমন এক সময়ে শীর্ষদের গাড়িটা এসে থামল ত্রয়ীদের গ্রামে—প্রিয় সেই প্রাঙ্গণে, তাদের বাড়িরই অভিমুখে। একে একে গাড়ি থেকে সবাই নেমে দাঁড়াল। বড়ো বড়ো গাছপালায় সমৃদ্ধ, বেশ ছায়াঘেরা গ্রামটা। ত্রয়ীদের বাড়িটাও ছায়ার আঁচলে আবৃত। তাদের এক বাড়িতেই সাতটি ঘর—মাঝখানে বিশাল উঠোন, আর সেই উঠোনের চারদিক ঘিরেই বৃত্তের মতো সাজানো ঘরগুলো, যেন নিপুণ কারিগরের নিখুঁত শিল্পকর্ম। একটিমাত্র ঘর বাদে বাকি সব ঘর কাঠ এবং টিনের সংমিশ্রণে তৈরি। ত্রয়ীদের নিজস্ব ঘরটিও তাই—কাঠ এবং টিনের সংমিশ্রণে তৈরি।

বাড়ির উঠোনে পা রাখতেই ত্রয়ীর চোখের সামনে ভেসে উঠল স্মৃতির পাতায় বাঁধা শৈশব-কৈশোরের দৃশ্যাবলি। এই ঘর, এই উঠোন, এই ছায়া ঘেরা গ্রামটাই তো তার অস্তিত্বের প্রথম পরিচয়। অথচ আজ, এই বাড়ি থেকে সে কত দূরে! এখানে আসতেও এখন অনুমতি লাগে, সঙ্গী লাগে। দীর্ঘশ্বাস ফেলল মেয়েটা। এগিয়ে গিয়ে দাঁড়াল তাদের ঘরটার অভিমুখে। ঘরের দরজায় বেশ বড়োসড়ো একটি তালা ঝুলছে। কাঁধে ঝুলানো ব্যাগ থেকে চাবি বের করে তালাটা খুললো ত্রয়ী। পা বাড়ালো গৃহের ভিতরে। গৃহের ভেতরে ঢুকতেই যেন থমকে গেল সে, হৃদয়ে হানা দিলো বিষন্নতা। মানুষের অভাবে এই স্বল্প সময়েই ঘরটা কেমন ভুতুড়ে হয়ে উঠেছে—চতুর্দিকে ধুলো জমেছে, মাকড়সারা আনন্দে জাল বুনেছে, এক ধরণের স্যাঁতস্যাঁতে গন্ধও কেমন নাকে লাগছে। অথচ এই ঘরটা একদিন হাসি, ঠাট্টা আর ভালোবাসায় পরিপূর্ণ ছিল।
ত্রয়ীদের ঘরটা তিন কক্ষ বিশিষ্ট—সম্মুখের কক্ষ, মাঝের কক্ষ, আর তার সাথে লাগোয়া পিছনের দিকে একটি বারান্দা। ত্রয়ী ধীরে ধীরে এগিয়ে গেল সামনের কক্ষের এক কোণে অবস্থানরত একটি টেবিলের দিকে। ফু দিয়ে টেবিলের উপরে জমে থাকা ধুলোর আস্তরণ সরিয়ে দিলো খানিক। কাঁধের ব্যাগটা নামিয়ে রাখলো সেখানে, তারপর শুরু করল ঘর গোছানোর কাজ। সে ঘর গোছানোর কাজ শুরু করতে না করতেই হঠাৎ তার পেছন থেকে দুটি ছোট্ট ছোট্ট হাত এসে জড়িয়ে ধরল কোমলতায়। মিষ্টি এক কণ্ঠে প্রশ্ন করল,

“তুমি এসেছো আন্নি?”
ত্রয়ী ঘুরে তাকাল। দেখা পেল ছোট্ট একটি বাচ্চা মেয়ের। সে হাঁটু গেঁড়ে বসে পড়লো বাচ্চা মেয়েটির অভিমুখে। হাত দ্বারা মেয়েটার নরম গাল টেনে দিয়ে বলল,
“হ্যাঁ, এসেছি তো‌। তুমি কেমন আছো বুড়ি?”
“খুব ভালো।”
ত্রয়ী এবং বাচ্চা মেয়েটির কথোপকথনের মাঝেই ঘরে প্রবেশ করল একজন তরুণী। তার শরীরে জড়ানো কমলা রঙের সাদামাটা একটি থ্রি পিস, মুখে সহজ সরলতার দীপ্তি। ত্রয়ী মিষ্টি হাসল। এগিয়ে এসে জড়িয়ে ধরলো তাকে। আবেগী কণ্ঠে বলল,
“কতদিন পর দেখা! কেমন আছো ঝর্ণা ভাবী?”
“এই তো ভালো। তুমি কেমন আছো?”
“এই আল্লাহ যেমন রেখেছেন।”
ঝর্ণা! সম্পর্কে তিনি ত্রয়ীর ভাবী এবং একটু আগে আসা বাচ্চা মেয়েটির মা। পাশের ঘরেই তাদের বসবাস। ঝর্ণা এবার নিজের থেকে সরিয়ে দিলো ত্রয়ীকে। তাড়া দিয়ে বলল,

“এসো, হাত মুখ ধুয়ে খেয়ে নিবে।”
ত্রয়ী হেসে বলল,
“তুমি যাও, আমি একটু ঘরটা গুছিয়ে আসছি।”
“আর ঘর গুছিয়ে কি করবে? আজ বাদে কালই তো আবার চলে যাবে।”
“তবুও….”
এই টুকু বলতেই তাকে থামিয়ে দিলো ঝর্ণা। হাত টেনে গৃহের বাহিরের দিকে যেতে যেতে বলল,
“কোনো তবুও টবুও নয় তো। তাড়াতাড়ি চলো হাত মুখ ধুয়ে খেয়ে নিবে। কতটা পথ জার্নি করে এসেছো। তোমার সাথে তো আরও দুজন এসেছে। তুমি না খেলে কি তারা খেতে চাইবে?”

ত্রয়ী আর দ্বিরুক্তি করল না। সত্যিই তো সে না খেলে শীর্ষ এবং নয়নও খেতে চাইবে না। তারা তো এখানকার কাউকেই চিনে না। নতুন এসেছে এ গ্রামে। তাহলে তারা কার ভরসায় কোথায় গিয়ে খাবে বা এক দন্ড বসবে?
খাওয়া দাওয়ার পাঠ চুকিয়ে ঝর্ণাদের ঘরেরই সামনের কক্ষের বিছানায় শুয়ে পড়লো শীর্ষ এবং নয়ন। একে তো তীব্র গরম, তার উপর এতটা পথ জার্নি। দুজনের শরীরকেই ক্লান্তি গ্রাস করে নিয়েছে। আর ত্রয়ী ঝর্ণার সাথে ভিতরের কক্ষে এসেছে। আসন কেটে বসে রয়েছে খাটের উপরে। ঝর্ণা কেমন বারবার দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে বারবার তাকাচ্ছে ত্রয়ীর দিকে। কিছু বলতে গিয়েও আবার ফিরে আসছে। ত্রয়ী হয়তো বুঝলো তার মনের কথা। নরম কণ্ঠেই শুধাল,
“কিছু বলবে ভাবী?”
ঝর্ণা কিছুটা সময় নিল। এরপর হুট করেই বলল,
“তোমার মা এসেছিল।”

মা! সবার কাছে এই শব্দটি ভীষণ আপন হলেও ত্রয়ীর কাছে না। মাকে শেষবার বোধ হয় সে তার ছোটবেলায় দেখেছিল তারপর আর দেখেনি। তার বাবার মৃত্যুর পর নিজের সুখের দিশা খুঁজতে গিয়ে সে এ বাড়িতেই ফেলে গিয়েছিল ছোট্ট ত্রয়ীকে। মেয়েটা তখন তেমন কিছু বুঝতো না। সারাদিন মা মা করে কাঁদতো। অথচ তার মা আর তার কাছে এলো না। আবার বিয়ে করল। নতুন সংসার পাতলো। অবশ্য সে ঠিকই করেছে। অল্প বয়সে স্বামী ম’রে’ছে। স্বামী রেখে যাওয়ার মধ্যে রেখে গিয়েছিল একটি বাচ্চা। সেই বাচ্চার জন্য সে নিজের জীবন যৌবন সব ক্ষুয়াবে কেন? বুক চিড়ে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো ত্রয়ীর। মলিন কণ্ঠে শুধাল,

“কবে এসেছিল?”
“তুমি গ্রাম থেকে চলে যাওয়ার পরপরই। তোমার দাদীর মৃ’ত্যু’র খবর শুনে এসেছিল। তোমাকেও নিজের সাথে নিয়ে যেতে চেয়েছিল।”
“এতকাল তো কখনো নিয়ে যেতে চায়নি তাহলে এখন হঠাৎ!”
“কে বলেছে নিয়ে যেতে চায়নি? তোমার মা তোমাকে আগেও বেশ কিছুবার নিতে এসেছিলেন। কিন্তু তোমার দাদী দেয়নি। এমনকি তোমার দাদী কখনো তাকে তোমার সাথে দেখাও করতে দেয়নি। তোমার দাদীর কথা ছিল তার বংশের মেয়েকে সে দিবে না। আর তাছাড়া তোমার দাদী তোমাকে ভীষণ ভালোবাসতো তো। তাই ভয় পেত মায়ের সাথে দেখা হলেই যদি তুমি তার সাথে চলে যেতে চাও।”

ত্রয়ী কিছুটা অবাক হলো। তার কর্ণে অনুরণিত হলো ঝর্ণার বলা কথাগুলো—তোমার মা আগেও এসেছিলেন, তোমাকে নিয়ে যেতে চেয়েছিলেন। ত্রয়ীর আগে এই কথাগুলো জানা ছিল না। সে জানতো তার মা সেই যে ছোটবেলায় তাকে ফেলে গেছে তারপর আর কখনো তার দিকে ফিরেও তাকায়নি। ত্রয়ীর হৃদয়ের গভীরে এক অভূতপূর্ব আবেগের ঢেউ উঠেও স্তব্ধ হয়ে গেলো। মা—যিনি একদিন ফেলে গিয়েছিলেন তাকে, আজ যদি শতবার ফিরেও আসে, তাকে সাথে করে নিয়েও যেতে চায় তবুও কি তার সেই অবহেলিত, অসহায় জীবন মুছে যায়? ত্রয়ীর স্মরণে এলো পুরনো কিছু ক্ষতচিহ্ন। তার বাবার যখন মৃত্যু ঘটে, তখন তার মা একজন অল্প বয়সী তরুণী। তার বাবার মৃ’ত্যু’র বছর খানেকের মধ্যেই তার নানা বাড়ির সকলে তৎপর হয় তার মাকে বিয়ে দেওয়ার জন্য। আর তার মা-ও রাজি হয়ে যায়। তবে তার মায়ের এই বিয়েতে সবচেয়ে বড়ো বাঁধা ছিল ত্রয়ী নিজে। কেউই বাচ্চাসহ বিয়ে করতে রাজি হচ্ছিল না। অবশ্য কে-ই বা চায় অন্যের ঝামেলা নিজের ঘাড়ে তুলতে? আর তার নানা মামারাও তাকে নিজেদের সাথে রাখতে অস্বীকৃতি জানায়।

ত্রয়ীর মা-ই তো তাদের মাথার উপর এক প্রকার বোঝা ছিল, আবার তাকে রাখবে কোথা থেকে? ফলস্বরূপ তারা সবাই মিলে একদিন তাকে রেখে যায় তার দাদীর কাছে। সবাই তাকে ফেলে দিলেও সেদিন তার দাদী তাকে ফেলে দেয়নি। অসহায় মেয়েটাকে নিজের সাথে আগলে নিয়েছিলেন। ত্রয়ীর এখনো স্মরণে আছে, যেদিন তার মা তাকে এ বাড়িতে দাদীর কাছে রেখে গিয়েছিল সেদিন সে ভীষণ কেঁদেছিল। মায়ের পিছু পিছু ছুটেছিল কিন্তু তার মা তার দিকে এক বারের জন্যও ফিরে তাকায়নি। ছুটে এসে তাকে কোলে তুলে নেয়নি। সেদিন তার মা যদি নিজের সুখের কথা ভেবে ওভাবে তাকে ফেলে না যেতো তাহলে বোধহয় এত দুর্দশাও তার জীবনে নেমে আসতো না। তার দাদীও তো চাইলে নিজের সুখের জন্য শহরে অন্য ছেলেদের বাড়িতে গিয়ে থাকতে পারতেন, বুড়ো বয়সে সুন্দর একটি জীবন অতিবাহিত করতে পারতেন। কিন্তু তিনি তা করেননি। তিনি নিজের সুখকে বিসর্জন দিয়ে ত্রয়ীর কথা ভেবেছেন। বুড়ো বয়সেও ত্রয়ীর সঙ্গ দিয়ে গেছেন‌। ত্রয়ীর ভাবনার মধ্যেই হঠাৎ ঝর্ণা তার মুঠোয় এক টুকরো কাগজ গুঁজে দিলো অতঃপর বলল,

অনুরাগে তুই পর্ব ৪০

“তোমার মা তার নাম্বার দিয়ে গেছেন। বলেছেন যোগাযোগ করতে।”
ত্রয়ী তাকালো কাগজটার দিকে। একবার ভাবলো কাগজটা ছুঁড়ে ফেলে দিবে তবে পরে আবার কি ভেবে যেন ফেললো না। শক্ত করে কাগজের টুকরোটা চেপে ধরলো নিজের হাতের মুঠোয়।

অনুরাগে তুই পর্ব ৪২