অনুরাগে তুই পর্ব ৪২

অনুরাগে তুই পর্ব ৪২
সাদিয়া শওকত বাবলি

পড়ন্ত বিকেল। আকাশের বুকে বিচরণকৃত সূর্যটি রক্তিম বর্ণ ধারণ করে পশ্চিমের দিগন্তে হেলে পড়েছে নিঃশব্দে। চারদিকটা কেমন থমথমে রূপ ধারণ করেছে এই ক্ষণে। খেচর শ্রেনীর প্রাণীরা তাদের খাবারের খোঁজের ইতি ঘটিয়েছে, তোড়জোড় শুরু করেছে নীড়ে ফেরার। এই থমথমে নীরব পরিবেশের বুক চিড়ে মেহেরদের বাড়ির অভিমুখে এসে দাঁড়াল আলভী। সেদিন সকালে মেহের আর তার মধ্যে মোবাইল নাম্বারের বিনিময় ঘটেছিল। তবে লজ্জা, সংকোচ এবং সংশয়ের দাপটে এখনো অব্দি মেয়েটিকে একটা কল করে উঠতে পারেনি সে। বারবার কল করতে গিয়েও ফিরে এসেছে এই ভেবে—মেয়েটি তাকে কি ভাববে, তার কল পেয়ে যদি মেয়েটি অপ্রস্তুত কিংবা বিরক্ত হয়! তবে এই লজ্জা সংকোচের ঘনঘটায় আলভী এবং মেহের দুজনের দেখা সাক্ষাৎ প্রায় বন্ধ হওয়ার পথেই বসেছিল। শেষে নিজেকে দমাতে না পেরে সংকোচকে উপেক্ষা করে আলভী ছুটে এসেছে এখানে। কিন্তু ভিতরে যেতে বা মেহেরকে ডাকতে কেমন দ্বিধা লাগছে তার। আলভী আরও কিছুটা সময় নিয়ে দাঁড়িয়ে রইল মেহেরদের বাড়ির সম্মুখে। অতঃপর পকেট থেকে মোবাইলটা বের করল। একটু সময় হেলায় ক্ষুয়িয়ে শেষে মেহেরের নাম্বারে কলটা করেই বসলো সে।

খুব বেশি সময় লাগলো না। দুই বার রিং হতেই কলটা ধরলো মেহের। ওপাশ থেকে নরম মিষ্টি স্বরে বলল,
“হ্যালো, আসসালামুয়ালাইকুম।”
আলভীর বুকের ভিতরটা ধুকপুক করে উঠল। এত দিন পরে মেহেরের কণ্ঠস্বর শ্রবণে হৃদয়ে একটু হলেও শীতলতা হানা দিলো তার। পরপর দুটো ফাঁকা ঢোক গিললো সে। অতঃপর বলল,
“ওয়ালাইকুমুস সালাম। আমি আলভী। চিনেছেন?”
মেহের আলতো হাসলো। মাথা নাড়িয়ে জবাব দিলো,
“হ্যা, আপনার নাম্বারটা সেভ করাই ছিল।”
“আচ্ছা।”
এই টুকু বলে থামলো আলভী। কিছুটা ইতস্তত করে বলল,
“আপনার বাসার সামনে এসেছিলাম।”
মেহের অবাক হলো। মোবাইল কানে নিয়েই ছুটে এলো তার কক্ষের জানালার নিকটে। বাইরের দিকে উঁকিঝুঁকি দিতে দিতে শুধাল,

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

“কই? কোথায়?”
“এই তো আপনাদের গেটের সামনেই।”
“আচ্ছা আপনি ওখানেই দাঁড়ান। আমি এক্ষুনি আসছি।”
মেহের কল কাটলো। হাতের মোবাইলটা নিয়েই ছুটে এলো গেটের নিকটে। আলভীকে দেখে দূর থেকেই প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলো,
“আপনি হঠাৎ এখানে? এদিকে কোনো কাজ ছিল বুঝি?”
আলভী ঠোঁট এলিয়ে দিলো। মেহেরের দিকে একটু এগিয়ে এসে জবাব দিলো,
“কাজ ঠিক না। পড়ন্ত বিকালে, রক্তিম সূর্যের আলোকে গায়ে মেখে একটু হাঁটতে বেরিয়েছিলাম আর কি।”
“ওহ, তা আপনি প্রতিদিনই এভাবে হাঁটতে বের হন নাকি?”
“প্রতিদিন বের হওয়ার সুযোগ হয় না। তবে মাঝে মাঝে বের হই।”
“একাই একাই বের হন নাকি সঙ্গী আছে কোনো?”
মেহেরের চোখে মুখে উৎকণ্ঠা, কিছু জানার তীব্র বাসনা। তবে আলভী তার প্রশ্নের সরাসরি জবাব দিলো না। উলটো প্রশ্ন করল,

“সঙ্গী পাবো কোথায়?”
“কেন নেই?”
আলভী আশেপাশে দৃষ্টি ঘুরালো। মাথা চুলকে বলল,
“আপাতত আপনি ছাড়া কেউ নেই।”
“আমি আপনার সঙ্গী?”
“কেন হতে কোনো সমস্যা রয়েছে?”
মেহেরের চোখে মুখে লাজুক আভা ছড়িয়ে পড়লো। দৃষ্টি নুইয়ে সে জবাব দিলো,
“না।”
আলভীর চোখ মুখ চকচক করে উঠল আনন্দে। হৃদয় আন্দোলিত হলো তীব্রবেগে। মেহেরের উত্তরে তার হৃদয়ে একটু হলেও আশার আলো ফুটেছে। একটু হলেও সে বুঝেছে যে তার পথে আর কোনো বাধা নেই। মেহের নিজেও তাকে পছন্দ করে, তাকে চায়। আলভী ওষ্ঠ প্রসারিত করল। মেহেরদের বাড়ির অভিমুখের রাস্তা ধরে পা বাড়াতে বাড়াতে বলল,
“চলুন তাহলে একটু হেঁটে আসি।”
মেহের দ্বিরুক্তি করল না। দৃষ্টি নুইয়ে হাঁটা শুরু করল আলভীর পাশে পাশে।

রাত্রি গভীর। চারপাশটা ঢাকা পড়ে গেছে নিস্তব্ধতার এক মোহময় আবরণে। শুধু মাঝেমধ্যে ভেসে আসছে নিশাচর প্রাণীদের ক্ষীণ কণ্ঠস্বর। ত্রয়ী শুয়ে আছে বিছানায়, বারবার পাশ বদলাচ্ছে। তবুও তার দুই চোখে ঘুম ধরা দিচ্ছে না কিছুতেই।
রাতে ত্রয়ীরা ঝর্ণাদের গৃহেই শুয়েছে। এমনি তাদের গৃহের যা অবস্থা, সেখানে এক রাত ঘুমানো তো দূরে থাক কিছুটা সময় বসে থাকাই দায়। নোংরা-মলিন বিছানার চাদর, ধুলো জমে থাকা আসবাবপত্র, স্যাঁতস্যাঁতে গন্ধ। যদিও ত্রয়ী কিছুটা পরিষ্কার করেছে তবে তাতেও সে গৃহে পুরো একটি রাত কাটানো দুষ্কর। কিন্তু মন কি আর সে কথা মানতে চায়? সেই শৈশব থেকে ঐ গৃহেই ত্রয়ীর বসবাস ছিল, তার কত স্মৃতি, কত হাসি-কান্না ছড়িয়ে রয়েছে ওখানে। আর আজ কিনা সে ঐ গৃহেরই এক অতিথি মাত্র। ত্রয়ী আরও কিছুটা সময় এপাশ ওপাশ করল। অতঃপর নিঃশব্দে বিছানা ছেড়ে বেরিয়ে এলো বাইরে।

আকাশে আজ চাঁদ তারার দেখা নেই। তবে বাড়ির উঠোনে জ্বলতে থাকা বৈদ্যুতিক আলোয় আলোকিত চারপাশ। ত্রয়ী সে আলোর সাহায্যেই এগিয়ে গিয়ে দাঁড়াল নিজ গৃহের অভিমুখে। ঘরটার দিকে তাকিয়ে হৃদয় আরও বিষন্ন হয়ে পড়লো তার। কতদিন পর নিজ গৃহে ফিরেছে সে। অথচ কালই চলে যেতে হবে আবার। বুক চিরে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো মেয়েটার। চোখ ঘুরিয়ে সে তাকালো আশেপাশে। হঠাৎ নজর পড়লো তাদের গৃহেরই পাশে। সেখানে কি যেন নড়ছে। ত্রয়ী দৃষ্টি গাঢ় করল। কেমন মানুষের মতো মনে হচ্ছে। বাড়ির কেউ কি বাহিরে বেরিয়েছে? কিন্তু এত রাতে বাহিরে কার কি কাজ? তাও আবার তাদের গৃহের নিকটেই? ত্রয়ীর কেমন ভয় লাগলো। হৃদয়ে সন্দেহ জন্মালো—কোনো চো’র ডা’কা’ত নয় তো। ত্রয়ী একবার ভাবলো চলে যাবে। তবে পরক্ষণেই আবার ভাবলো তার একবার দেখা উচিত ওখানে লোকটা কে। মেয়েটা একটু এগুলো। সাহস করে প্রশ্ন করল,

“কে? কে ওখানে?”
প্রশ্নটা শেষ হতে না হতেই অন্ধকার থেকে বেরিয়ে আলোতে এসে দাঁড়াল লোকটা। ত্রয়ী অবাক হলো। এ তো শীর্ষ। কিন্তু এ লোক এত রাতে ঘুম ছেড়ে বাহিরে কি করছে? ত্রয়ী চোখ বড়ো বড়ো করল। কণ্ঠে অবাকতা নিয়ে শুধাল,
“আপনি এত রাতে এখানে কি করছেন?”
শীর্ষ কপাল কুঁচকাল। বিরক্তি ভরা কণ্ঠে জবাব দিলো,
“মুত…”
এইটুকু বলেই থেমে গেল সে। ভদ্রতা বজায় রেখে বলল,
“প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিতে এসেছিলাম।”
ত্রয়ী কিঞ্চিৎ অপ্রস্তুত হলো। আমতা আমতা করে বলল,
“ওহ, আচ্ছা তাহলে আমি ঘরে যাচ্ছি।”
“তুই এত রাতে বাইরে এসেছিলি কেন?”
ত্রয়ী কেবলই গৃহের দিকে পা বাড়িয়েছিল। তবে শীর্ষের ছোড়া প্রশ্নের দাপটে সে থমকে দাঁড়াল। দৃষ্টি নুইয়ে জবাব দিলো,

“এমনি ঘুরতে বেরিয়েছিলাম।”
“এই রাতে ঘুরতে বেরিয়েছিলি! কেন শ’য়’তা’নে লাড়া দিয়েছিল?”
“না মানে…. আচ্ছা আমি ভিতরে যাই।”
“ভিতরে গিয়ে কি করবি?”
“ঘুমাবো।”
“ঘুমালে এখানে এলি কেন?”
ত্রয়ী বিরক্ত হলো। কিসব প্রশ্ন শুরু করেছে এ? শুধু কথা বাড়াচ্ছে এ ছাড়া আর কিছুই নয়। মেয়েটা বিরক্তিতে কপাল কুঁচকাল। আর কোনো জবাব না দিয়ে গৃহের দিকে পা বাড়ালো। শীর্ষ কপাল কুঁচকাল সাথে সাথে। ধমকে বলল,
“তোকে যেতে বলেছি আমি?”
ত্রয়ী দাঁড়াল। কণ্ঠে একরাশ বিরক্তি নিয়ে বলল,

“তাহলে এখানে থেকে কি করবো?”
“আমাকে দেখবি।”
“কেন আপনার কি রূপ বেরিয়েছে যে এত রাতে বাহিরে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে আপনাকে দেখতে হবে?”
শীর্ষ কিঞ্চিৎ অপমানিত বোধ করল ত্রয়ীর কথায়। থমথমে কণ্ঠে কিছু বলবে তার পূর্বেই নারী কণ্ঠে ভেসে এলো,
“কে? কে ওই খানে?”
শীর্ষ এবং ত্রয়ী বিষয়টি স্বাভাবিকভাবেই নিল। তারা তো এখানে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে শুধু কথাই বলছিল আর তো কিছু নয়। ত্রয়ী গলা বাড়িয়ে জবাব দিলো,
“আমরা।”

ত্রয়ীর জবাবের প্রায় সাথে সাথেই অর্ধ বয়স্ক একজন নারী এগিয়ে এলেন তাদের দিকে। নাজমা বেগম, ত্রয়ীদের ঘরের একটা ঘর পরেই তার ঘর। সম্পর্কে তিনি ত্রয়ীর চাচী হন। কিন্তু নাজমা বেগম নামক ঐ মহিলা কোনো কালেই ত্রয়ীকে পছন্দ করতেন না। মেয়েটি এতিম, অসহায় হওয়ার কারণে বাড়ির সবার স্নেহের পাত্রী হলেও তার চক্ষুশূল ছিল। কিছু কিছু মানুষ আছে যারা অন্যের ভালো দেখতে পারে না। কোনো কারণ ব্যতীতই হিং’সা করে। নাজমা বেগমের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যও ঠিক তেমন। তবে ত্রয়ীকে তার হিং’সার সবচেয়ে বড়ো কারণ ছিল মেয়েটির সৌন্দর্য। নাজমা বেগমেরও একটি মেয়ে রয়েছে। ত্রয়ীর বয়সীই সে। তবে সে ততটা সুন্দরী নয়। যার কারণে বাড়িতে কোনো বিয়ের প্রস্তাব এলে অধিকাংশই আসতো ত্রয়ীর জন্য। তারপর ত্রয়ীর দাদী মা’রা যাওয়ার পরে যখন আব্দুর রহমান খান মেয়েটাকে নিয়ে গেলেন তখন যেন এই মহিলার হিং’সা সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছে গেল।

ত্রয়ী ধনী পরিবারে বেড়ে উঠবে, সেখানে সুখে শান্তিতে থাকবে, শহরের বড়ো কলেজে পড়বে এ যেন কিছুতেই মেনে নিতে পারছিলেন না তিনি। তিনি আগেও অনেকবার ত্রয়ীর ক্ষতি করার চেষ্টা করেছেন, মেয়েটির নামে বদনাম রটিয়ে সকলের নিকট খারাপ প্রমাণিত করতে চেয়েছেন কিন্তু ত্রয়ীর দাদীর জন্য পারেননি। ঐ বৃদ্ধা মহিলা সব সময় ত্রয়ীকে আগলে রেখেছিলেন। তবে আজ যখন সে সুযোগ হেঁটে হেঁটে নাজমা বেগমের নিকট এসেছে তখন সেই সুযোগ তিনি হাত ছাড়া করবেন না। নাজমা বেগম কপাল টানটান করে তাকালেন ত্রয়ীর দিকে। কণ্ঠে কঠোরতা নিয়ে শুধালেন,
“এই রাইতে একটা পোলার লগে এই খানে কি করছিস তুই?”
“কিছুই না। উনি নিজের কাজে বাইরে বের হয়েছিলেন আর আমিও বের হয়েছিলাম।”
“হ আমারে বলদ বুঝাস? তোর কি মনে হয় একটা পোলা আর একটা মাইয়া রাইতের বেলা একা একা বাইরে কি করতে পারে আমি বুঝি না?”

ত্রয়ীর কলিজাটা ধক করে উঠল। নাজমা বেগম কি তবে তাকে এবং শীর্ষকে ঘিরে খারাপ কিছু ভেবে নিয়েছেন? তাই হয়তো হবে। নয়তো তিনি এমন কথা বলতেন না। ত্রয়ী ব্যস্ত হলো। হড়বড় করে বলল,
“আপনি ভুল ভাবছেন চাচী। সত্যিই আমরা এখানে কিছুই করছিলাম না। উনিও বাইরে বের হয়েছিলেন আর আমিও। তারপর আপনার সাথে যেভাবে দেখা হয়েছে উনার সাথেও সেভাবেই দেখা হয়েছে।”
“এসব অন্য কাউরে বুঝাস আমারে না। শহরে গিয়া লায়েক হয়ে গেছিস যে রাত বিরাতে ব্যাটা ছেলে নিয়ে ঘোরা শুরু করেছিস? এসব ন’ষ্টা’মি আমাদের বাড়িতে চলবে না।”
ত্রয়ী হতবাক হয়ে পড়লো। কি ঘটলো আর নাজমা বেগম কোথায় নিয়ে গেলেন। ত্রয়ী সহজ সরল মানুষ। তাই সে পুরো বিষয়টাকে সহজভাবেই নিয়েছিল। নাজমা বেগম তাদের দেখার পরও তারা না পালিয়ে সাবলীলভাবেই নিজেদের উপস্থিতি জানান দিয়েছিল। কিন্তু এই মহিলা এখন তো তাকে ন’ষ্টা উপাধি দিয়ে দিচ্ছেন। ত্রয়ীর কান্না পেল। ধরা গলায় সে বলল,

“আপনি ভুল করছেন চাচী। আপনি যা ভাবছেন তেমন কিছুই এখানে ঘটেনি।”
এ পর্যায়ে মুখ খুললো শীর্ষও। ছোটবেলা থেকে তার শহরে বসবাস। গ্রামে অল্পস্বল্প বিষয়কে বড়ো করে দেখা হয় বা নারী পুরুষকে একত্রে দেখলে খুব সহজেই রটনা রটানো হয় তা সে শুনেছিল। কিন্তু তাই বলে এই সামান্য বিষয়কে এত বড়ো পর্যায়ে নিয়ে যাবে? শীর্ষ কপালে ভাঁজ ফেললো। রুক্ষ কণ্ঠে বলল,
“মনগড়া কাহিনী বানাবেন না। আপনি আমাদের খারাপ কি করতে দেখেছেন যে বাজে কথা বলছেন?”
নাজমা বেগম পাত্তা দিলেন না শীর্ষের কথায়। তার পরিকল্পনা তো বদনাম রটানো, ত্রয়ীকে বিপদে ফেলা। সে পরিকল্পনা সফল হলেই হলো। নাজমা বেগম হাঁক ছাড়লেন। গলা বাড়িয়ে ডাকলেন,
“কই গো, কই তোমরা? এ বাড়িতে কি ন’ষ্টা’মি শুরু হয়েছে দেখে যাও। এ মেয়ে তো আর এ বাড়ির মান সম্মান রাখলো না।”

ত্রয়ীর হৃদয় কম্পিত হলো। এমন পরিস্থিতিতে কি করবে না করবে ভেবে পেল না সে। লজ্জা, অপমান এবং ভয়ে ডুকরে কেঁদে উঠল মেয়েটা। চটজলদি বসে পড়লো নাজমা বেগমের পায়ের নিকট। দুই হাতে তার দুই পা জড়িয়ে ধরে বলল,
“আমরা সত্যিই এখানে খারাপ কিছু করিনি চাচী। আপনি দয়া করে কাউকে ডাকবেন না। এমন বদনাম আমার নামে রটাবেন না।”
নাজমা বেগমের আর ডাকতেও হলো না কাউকে। প্রথমবারের ডাকেই অনেকে গৃহ ছেড়ে বেরিয়ে এলো। নাজমা বেগমের ওষ্ঠে বাঁকা হাসি ফুটে উঠল। সবাইকে ডেকে ডেকে সে বলতে শুরু করল,
“দেখে যাও, দেখে যাও, সবাই দেখে যাও এই ন’ষ্টা মেয়ে ছেলের কীর্তি। ঘরে জায়গা না পেয়ে রাত বিরাতে বাইরে নেমে বেলাল্লাপনা শুরু করেছে। আমি হাতে নাতে ধরেছি এদের।”
শীর্ষের মেজাজ বিগড়ালো এবার। সে এতদিন জানতো গ্রামের মানুষজন সহজ সরল হয়। কিন্তু এই মহিলা তো রীতিমত হিটলারের চাচাতো বোন। কি সুন্দর বানিয়ে বানিয়ে মিথ্যা বলছে তাদের নামে। আবার বলছে হাতে নাতে ধরেছে। শীর্ষ দাঁতে দাঁত চাপলো। গলা বাড়িয়ে বলল,

“মুখ সামলে কথা বলুন। মহিলা মানুষ এত খারাপ হয় আগে জানা ছিল না। আপনি কি হাতে নাতে ধরেছেন?”
নাজমা বেগম ফুঁসে উঠলেন যেন। ঝাঁঝালো কণ্ঠে বললেন,
“ছেলের সাহস দেখো। রাত বিরাতে বাইরে নেমে মেয়ে নিয়ে বেলাল্লাপনা করেছে আবার আমি দেখেছি বলে আমাকে চোখ রাঙাচ্ছে। একেই বলে চোরের মায়ের বড়ো গলা।”
ত্রয়ী ভীত হয়ে পড়লো আরও। সাথে তার কান্নার গতিও বাড়লো পূর্বের তুলনায়। সবাইকে বুঝানোর চেষ্টা করল তারা কিছুই করেনি। কিন্তু কেউ তার কথা বিশ্বাস করল না। সবাই বাছবিচার ব্যতীতই দোষারোপ শুরু করল তাদের উপরে।

রাত্রি বেড়েছে কিছুটা। চারদিকটা ঘুটঘুটে আঁধারে ছেয়ে গেছে। এই আঁধারের মাঝেই ঝর্ণাদের গৃহের অভিমুখের কক্ষে জমায়েত বসিয়েছে বাড়ির সকলে। ত্রয়ী সেই থেকে এক মনে কেঁদে যাচ্ছে। আর শীর্ষ বসে রয়েছে খাটের উপরে। কণ্ঠে কোনো বাক্য না তুলে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছে সকলকে। নয়ন সুযোগ বুঝে এগিয়ে গেল শীর্ষের নিকটে। তার পাশ ঘেঁষে দাঁড়িয়ে বলল,
“এত রাতে ম্যামের সাথে বাইরে গিয়েছিলেন কেন স্যার?”
“সাথে যাইনি। দুজন আলাদা আলাদাভাবে গিয়েছিলাম। পরে দেখা হয়েছিল।”
“সেই দেখা হবারই বা কি প্রয়োজন ছিল স্যার? এরা যা শুরু করেছে। আল্লাহ জানেন এখন কি হবে!”
এই টুকু বলে থামলো নয়ন। শীর্ষের দিকে একটু ঝুঁকে ফিসফিসিয়ে বলল,

“এমন পরিস্থিতিতে গ্রামের মানুষ সচরাচর ছেলে মেয়েকে জোর করে বিয়ে দিয়ে দেয়, স্যার।”
এই কথাটা যে শীর্ষ ভাবেনি তেমন নয়। সেও ভেবেছে। আর ভেবেছে বলেই না চুপ করে রয়েছে। সে তো চাইছে গ্রামবাসীরা জোর করে তার সাথে ত্রয়ীর বিয়ে দিয়ে দিক। এমনি তো মেয়েটা তাকে বিয়ে করতে চাইছে না। আব্দুর রহমান খানকে বলল তিনিও গুরুত্ব দিলেন না। তাও এই মহৎ কার্যটা যদি গ্রামবাসীরাই ঘটিয়ে ফেলে ভালো হয়। শীর্ষ একটু নড়েচড়ে বসলো। নয়নের মতো একইভাবে ফিসফিস করে বলল,
“তাহলে বল বিয়েটা তাড়াতাড়ি দিয়ে দিতে।”
নয়ন অবাক হলো। চোখ বড়ো বড়ো করে বলল,

অনুরাগে তুই পর্ব ৪১

“স্যার আপনি….”
এইটু বলতেই তাকে থামিয়ে দিলো শীর্ষ। ত্রয়ীর দিকে দৃষ্টি দিয়ে চিবিয়ে চিবিয়ে বলল,
“এই ক’ট খেয়ে বিয়ে ব্যতীত এই মেয়েকে বাগে আনতে পারবো বলে মনে হচ্ছে না।”

অনুরাগে তুই পর্ব ৪৩