অনুরাগে তুই পর্ব ৫২
সাদিয়া শওকত বাবলি
ত্রয়ীর আকুতি, মিনতি, অনুরোধ, কান্নাকে উপেক্ষা করেই গাড়িটা সাঁই সাঁই করে ছুটলো অভিমুখে।
চিন্তায়, ভয়ে দিশেহারা হয়ে উঠল আরফা। এমন পরিস্থিতিতে তার কি করা উচিত ভেবে উঠতে পারলো না ঠিক। সে কি এখন শীর্ষকে কল করবে? কিন্তু শীর্ষের নাম্বার তো তার নিকট নেই। আরফা অস্থির দৃষ্টিতে তাকালো এদিক ওদিক। হঠাৎ খেয়ালে এলো রাকিবের কথা। শীর্ষ তো রাকিবের ভাইয়ের বন্ধু। ওর কাছে তার নাম্বার থাকতে পারে। না থাকলেও ওর ভাইয়ের কাছে নিশ্চয়ই আছে। আরফা দ্রুত তার কাঁধে ঝুলানো ব্যাগ ঘেটে মোবাইলটা বের করল। কল করল রাকিবকে। স্বল্প সময়ের মধ্যেই রাকিব কলটা রিসিভ করল। ওপাশ থেকে ভেসে এলো,
“হ্যা, আরফা বল।”
আরফা ইতি উতি করল না। সরাসরিই বলল,
“ত্রয়ীকে কায়সার তুলে নিয়ে গেছে। তুই যেভাবে হোক খবরটা শীর্ষ ভাইয়ের কাছে পৌঁছে দে।”
ত্রয়ীকে তুলে নিয়ে গেছে! রাকিবের মস্তিষ্ক বিক্ষিপ্ত হয়ে উঠল মুহুর্তেই, শরীরের তাজা রক্ত যেন টগবগ করে ফুটে উঠল। তেজস্বী কণ্ঠে সে বলল,
“ঐ হা’লা’র পু’তে’র সাহস অনেক বেড়ে গেছে। ওকে তো আজ আমি…..”
এইটুকু বলতেই তাকে থামিয়ে দিলো আরফা। ব্যস্ত কণ্ঠে বলল,
“ওকে যা করার করিস। আপাতত খবরটা শীর্ষ ভাইকে দে?”
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
রাকিব আর কথা বাড়ালো না। এই মুহূর্তে খুব বেশি কথা না বাড়ানোই উত্তম। তাদের যত দ্রুত সম্ভব ত্রয়ীর কাছে পৌঁছাতে হবে। মেয়েটাকে উদ্ধার করতে হবে। নয়তো যেকোনো সময় যেকোনো কিছু ঘটে যেতে পারে। আর কায়সারও যে খুব ভালো ছেলে তেমনও তো নয়। রাকিব কলটা কেটে দিলো। সময় না নিয়ে কল লাগালো শীর্ষের নাম্বারে।
কায়সার ত্রয়ীকে টেনে হিচড়ে নিয়ে এলো একটি বিল্ডিং এর তৃতীয় তলায়। নির্মাণাধীন বিল্ডিং টা। প্রত্যেক তলায় শুধু ছাদ দিয়ে রেখে দেওয়া হয়েছে।
ত্রয়ী এই স্থানটা চিনে না। তবে স্থানটা যে তার কলেজ থেকে খুব বেশি দূরে নয় তা বুঝেছে। কায়সারের সাথে আরও জন চারেক লোক এসেছিল। কায়সার তাদের মধ্যে একজন রোগা পটকা তরুণ ছেলের দিকে তাকিয়ে বলল,
“আব্বাস কাজী ডেকে আন এক্ষুনি।”
আদেশ পাওয়ার সাথে সাথে আব্বাস নামক ছেলেটা দৌড়ে চলে গেল। ত্রয়ীর কলিজাটা ধক করে উঠল। কায়সার কাজী ডাকতে কেন বলল? তবে কি এই লোক তাকে এক্ষুনি বিয়ে করার পরিকল্পনা করছে? না, না শীর্ষকে রেখে ত্রয়ী আর কাউকে বিয়ে করতে পারবে না। কিছুতেই না। ত্রয়ীর এক হাত তখনো কায়সারের মুঠোবন্দী। মেয়েটা কায়সারের হাতের বাঁধন থেকে নিজের হাত ছাড়ানোর জন্য মোচড়া মোচড়ি শুরু করল। ফুঁপিয়ে উঠে বলল,
“আপনি কেন আমার সাথে এমন করছেন? দয়া করে আমাকে ছেড়ে দিন।’
কায়সার ঘাড় বাঁকিয়ে তাকালো ত্রয়ীর দিকে। শক্ত কণ্ঠে বলল,
“তোমাকে ছেঁড়ে দেওয়ার জন্য এখানে আনিনি। এনেছি আমার করে নেওয়ার জন্য।”
“আমি বিবাহিত। আমার স্বামী আছে।”
“মিথ্য বলছো তুমি। আমাকে দূরে সরানোর জন্য মিথ্যা বলছো তুমি।”
“আমি সত্যি বলছি আমার বিয়ে হয়ে গেছে। কয়েকদিন আগে আমি আর শীর্ষ ভাই যখন আমাদের গ্রামে গিয়েছিলাম তখন আমাদের বিয়ে হয়েছে।”
কায়সারের হৃদয় জ্বলছে, মস্তিষ্কও বিক্ষিপ্ত। সে এবারে আর নিজেকে ধরে রাখতে পারলো না। গভীর ক্রোধে উন্মত্ত হয়ে ত্রয়ীকে এক প্রকার ছুঁড়ে ফেললো ইট কংক্রিটে গড়া মেঝেতে। মেঝেটা পুরোপুরি পাকা না হওয়ায় মেঝের ঘর্ষণে ত্রয়ীর হাত ছুঁলে গেল। লাল র’ক্তে’র দেখা মিললো সে স্থান থেকে। নিমেষেই কায়সারের সকল ক্রোধ হাওয়া হয়ে গেল। অস্থির হয়ে উঠল সে। ছুটে গিয়ে বসলো ত্রয়ীর নিকটে। তার হাতটা টেনে নিয়ে ক্ষতস্থানটা উলটে পালটে দেখতে দেখতে বলল,
“বেশি ব্যথা পেয়েছো? আমি তোমাকে ব্যথা দিতে চাইনি। রাগের মাথায় হয়ে গেছে। দয়া করে আমাকে ক্ষমা করে দাও।”
কথাগুলো কোনোমতে শেষ করেই কায়সার ফুঁ দিয়ে দিতে শুরু করল মেয়েটার হাতে। ত্রয়ীর দৃষ্টি শীতল হলো। নারী হৃদয় এমনিই কোমল হয়। কায়সারের জন্য তার ভীষণ মায়া লাগছে। কায়সার তো কোনো অন্যায় করেনি, শুধু ভালোবেসেছে। ত্রয়ী একটু সময় নিল। ধীর কণ্ঠে বলল,
“এমন পাগলামী কেন করছেন বলুন তো। আমি বিবাহিত। আমার পক্ষে সম্ভব নয় আপনাকে ভালোবাসা কিংবা আপনার হওয়া। কেন আমার পিছনে ঘুরে নিজের সময় নষ্ট করছেন? আপনার ভাষ্যমতে আপনার অর্থ – সম্পদ, চেহারা, ক্ষমতা সব আছে। আপনি চাইলেই আমার থেকেও সুন্দরী, শিক্ষিত এবং বংশমর্যাদা সম্পন্ন মেয়েকে বিয়ে করতে পারবেন। তাই বলছি কি দয়া করে আপনি আমার পিছনে ঘুরে পাগলামী করে সময় নষ্ট করবেন না। আমাকে ভুলে যান। নতুন করে কাউকে ভালোবাসুন। তাকে নিয়ে সুন্দরভাবে নিজের জীবনটা সাজান।”
কায়সার মৃদু হাসলো। ত্রয়ীর হাতটা নিজের হাতের ভাঁজের নিয়ে বলল,
“চাইলেই কি ভালোবাসার মানুষটাকে ভুলে যাওয়া সম্ভব? সত্যি বলতে তোমাকে আমি প্রথম থেকেই যে ভালোবাসতাম তেমন নয়। প্রথম যেদিন তোমাকে আমি দেখেছিলাম সেদিন তোমাকে আমার ভালো লেগেছিল তবে তা ভালোবাসা ছিল না। তারপর জানতে পারলাম শীর্ষ তোমাকে ভালোবেসে। আমার ভিতরে একটা জেদ চেপে বসলো ওর কাছ থেকে তোমাকে কেড়ে নেওয়ার, এই ভালোবাসা ভালোবাসা খেলায় ওকে হারানোর। সেই জেদ থেকেই আমি তোমার পিছু নেওয়া শুরু করলাম। কিন্তু পিছু নিতে নিতে কখন যে তোমাকে সত্যি সত্যি ভালোবেসে ফেললাম নিজেও জানি না। আমি মানুষটা খারাপ হতে পারি। কিন্তু তোমার প্রতি আমার অনুভূতি, ভালোবাসা কোনোটাই মিথ্যা নয়। তুমি বলছো আমাকে পাগলামী না করতে। আমিও তো পাগলামী করতে চাইছি না। কিন্তু কিভাবে কিভাবে যেন করে ফেলছি। তুমি অন্য কারো, অন্য কাউকে ভালোবাসো এটা যে আমার সহ্য হচ্ছে না। ভীষণ কষ্ট হচ্ছে। দম বন্ধ হয়ে যেতে চাইছে। বুকের মধ্যে মনে হচ্ছে আগুন জ্বলছে।”
কথাগুলো বলতে বলতে গলা ধরে এলো কায়সারের। একটু সময় নিয়ে নিজেকে সামলালো সে। দম নিয়ে শুধাল,
“শীর্ষের সাথে কি তোমার সত্যিই বিয়ে হয়ে গেছে?”
ত্রয়ী দৃষ্টি নুইয়ে নিল। ছোট করে জবাব দিলো,
“হুম।”
“ভালোবাসো ওকে?”
“হুম।”
কায়সারের আঁখিদ্বয় কেমন ভরে উঠল। গলা ধরে এলো। দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
“ওর সাথে বিয়ে না হলে তুমি ভালোবাসতে আমাকে?”
এই প্রশ্নের উত্তর ত্রয়ী কি দিবে ভেবে পেল না। শীর্ষ যদি তার জীবনে না আসতো, সেদিন গ্রামবাসীরা মিলে যদি তাদের বিয়ে না দিতো তবে আদৌও সে শীর্ষকে ভালোবাসতো কিনা তা তার জানা নেই। ত্রয়ী স্বাভাবিকভাবেই জবাব দিলো,
“জানি না।”
“জানো না?”
তাচ্ছিল্যের হাসি হাসলো কায়সার। ধরা গলায় বলল,
“আচ্ছা শীর্ষের জায়গায় যদি আমি হতাম, তুমি আমার হতে, আমায় ভালোবাসতে তাহলে কি খুব বেশি ক্ষতি হয়ে যেতো? তুমি কেন আমার হলে না ত্রয়ী? কেন আমায় ভালোবাসলে না?”
ত্রয়ীকে কায়সার তুলে নিয়ে গেছে প্রায় ঘন্টা দুই অতিবাহিত হয়েছে। শীর্ষ, আলভী, রবি, রাকিব, নয়ন এবং আরফা হন্যে হয়ে খুঁজছে মেয়েটাকে। আলভী, রবি আর নয়ন ত্রয়ীকে খুঁজতে গেছে একদিকে। শীর্ষ, আরফা এবং রবি খুঁজছে কলেজের আশেপাশের এলাকায়। তবে মেয়েটার কোনো খোঁজ এখনো অব্দি তারা কেউই পায়নি। ত্রয়ীকে কায়সার তুলে নিয়ে গেছে সংবাদটা শীর্ষের কানে পৌঁছাতেই দিশেহারা হয়ে উঠেছিল সে। এখন খুঁজে না পেয়ে নিজেকে কেমন পাগল পাগল লাগছে। কায়সারের প্রতি রাগও লাগছে, সাথে ত্রয়ীকে হারিয়ে ফেলার ভয়ও হচ্ছে। কায়সার তার শ’ত্রু। যদি শ’ত্রু’তা’র জের ধরে ত্রয়ীর কোনো ক্ষতি করে দেয় সে তাহলে শীর্ষের কি হবে? ত্রয়ীকে ব্যতীত সে কিভাবে বাঁচবে? শীর্ষের গলা শুকিয়ে এলো। অস্থির হলো হৃদয়। মনে হচ্ছে যেন দম বন্ধ হয়ে আসছে। শ্বাসকষ্ট উঠবে বোধহয়। শীর্ষের এমনি শ্বাসকষ্টের সমস্যা নেই। তবে মস্তিষ্কে অতিরিক্ত চাপ পড়লে, কোনো বিষয় নিয়ে অতিরিক্ত চিন্তা করলে এমন হয় মাঝে মাঝে। শীর্ষ এই অবস্থায় আর এগুলো পারলো না। বুক চেপে বসে পড়লো রাস্তার মধ্যে। শীর্ষকে বসে পড়তে দেখে ব্যস্ত হলো রাকিব এবং আরফা। তারা ছুটে গিয়ে ধরলো শীর্ষকে। রাকিব অস্থির হয়ে বলল,
“কি হয়েছে আপনার ভাই? বুকে ব্যথা করছে নাকি শরীর খারাপ লাগছে?”
শীর্ষ ঢোক গিললো। জোরে জোরে নিঃশ্বাস নিতে নিতে ডানে বামে মাথা নাড়লো। শীর্ষ নিজের কষ্টের কথা প্রকাশ না করলেও রাকিব এবং আরফা বুঝে নিল। রাকিব সোজা হয়ে দাঁড়াল। এক বোতল পানি কেনার উদ্দেশ্যে তাকালো আশেপাশে। হঠাৎ তার নজর আটকালো পাশেই একটা বিল্ডিংয়ের অভিমুখে। ওটা আব্বাস না? সাথে হুজুর ধাঁচের একটি লোকও আছে। আব্বাসকে চিনে নিতে খুব একটা কষ্ট হলো না রাকিবের। কায়সারের সাথে এই লোকটাকে বেশ অনেকবারই দেখেছে সে। রাকিব দ্রুত শীর্ষের দিকে তাকালো। তাড়াহুড়ো করে বলল,
“ভাই ওদিকে দেখেন আব্বাস। ঐ কায়সারের দলের লোক।”
শীর্ষ তাকালো অভিমুখে। নিজের অসুস্থতা, কষ্ট ভুলে সাথে সাথে দাঁড়িয়ে গেল সে। ছুটে গেল আব্বাসের দিকে। ঝড়ের বেগে তার কলারটা চেপে ধরলো। চ্যাচিয়ে বলল,
“আমার ত্রয়ী কোথায়? কায়সার ওকে কোথায় নিয়ে গেছে?”
আকস্মিক আক্রমণে হকচকিয়ে উঠল আব্বাস। শীর্ষকে দেখে ঘাবড়ে গেল ভীষণ। আমতা আমতা করে বলল,
“আআমি জানি না।”
শীর্ষ সাথে সাথে একটা ঘুষি বসালো আব্বাসের গাল বরাবর। বেচারা ছিটকে পড়লো নিচে। শীর্ষ ঝুঁকে বেচারার চুল ধরে টেনে তুললো। জোরে জোরে কয়েকটা নিঃশ্বাস নিয়ে ফের চ্যাচিয়ে শুধাল,
“ত্রয়ী কোথায়? শেষ বারের জন্য জিজ্ঞেস করছি বলে ত্রয়ী কোথায়?”
আব্বাস ঢোক গিললো। এলোমেলো দৃষ্টি ফেলে ফের বলল,
“আমি সত্যিই জানি না ত্রয়ী কোথায়।”
“জানিস না তাই না? তবে এবার জানবি।”
শীর্ষ বেশ জোরেশোরেই লাথি দিলো আব্বাসের পেটে। ব্যথাম বেচারা চিৎকার করে উঠল। শুয়ে পড়লো নিচে। শীর্ষ তবুও থামলো না। একের পর এক লাথি দিতে শুরু করল আব্বাসের শরীরে। সাথে উন্মাদের ন্যায় বারবার একই প্রশ্ন আওড়াতে লাগলো,
“ত্রয়ী কোথায়? বল ত্রয়ী কোথায়।”
আব্বাস মা’র খেল কতক্ষণ। সে কায়সারের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করতে চায়নি। কিন্তু এখন আর কোনো উপায় নেই। এখনো যদি সে মুখ না খোলে তাহলে হয়তো শীর্ষ তাকে মে’রে’ই ফেলবে। এই টুকু মা’রে’ই ব্যথায় শরীরটা অবশ হয়ে আসতে চাইছে। আব্বাস ব্যথায় কাতরাতে কাতরাতে বলল,
“বলছি, বলছি, আমি সব বলছি। তবুও আমাকে আর মা’র’বে’ন না দয়া করে।”
শীর্ষ থেমে গেল। আব্বাসের মাথার চুলগুলো শক্ত হাতে টেনে ধরে বলল,
“বল তাড়াতাড়ি।”
কায়সার এখনো আগের মতোই বসে রয়েছে ত্রয়ীর অভিমুখে তার হাত ধরে। ত্রয়ী বেশ অনেকবার নিজের হাতটা ছাড়িয়ে নেওয়ার চেষ্টা করেছে কায়সারের হাতের বাঁধন থেকে তবে তার পুরুষালি শক্তির সাথে পেরে ওঠেনি। ত্রয়ী অনেক বুঝিয়েছে লোকটাকে কিন্তু লোকটা যেন তার কোনো কথা মানতেই নারাজ। ক্রমেই কেমন উন্মাদ হয়ে উঠছে কায়সার। তার চোখের কোটর ঘেঁষে নোনাজলের চিকন স্রোতের দেখা মিলেছে। পুরুষ মানুষ নাকি সহজে কাঁদে না। কায়সারের আঁখিদ্বয়েও হয়তো কম কষ্টে অশ্রুবিন্দুরা জায়গা করে নেয়নি। ত্রয়ী বিশ্বাস করে কায়সারের ভালোবাসা মিথ্যা নয়। কিন্তু সেও বা কি করবে? সে বিবাহিত এবং স্বামীকে ভালোবাসে। তার স্বামীও তাকে ভালোবাসে। কায়সারের ভালোবাসা যতই সত্যি হোক না কেন সে ত্রয়ী এবং শীর্ষের মধ্যে তৃতীয় ব্যক্তি ব্যতীত আর কিছুই নয়। কায়সার এক হাতের উলটো পিঠে নিজের চোখের অশ্রু মুছলো। ভেজা গলায় বলল,
“তোমার একটা কেন পাঁচটা বিয়ে হোক। দশ বাচ্চার মা হলেও আমার তোমাকে মেনে নিতে কোনো সমস্যা নেই। তুমি শুধু একটাবার বলো, তুমি আমাকে ভালোবাসো। শীর্ষ কেন পুরো দুনিয়ার সাথে আমি লড়ে যাবো তোমার জন্য।”
শীর্ষ, রাকিবরা তখনই এসে উপস্থিত হলো সেখানে। শীর্ষ শুনলো সবটাই। সাথে সাথে মস্তিষ্ক বিক্ষিপ্ত হয়ে উঠল তার। গভীর ক্রোধে ফেটে পড়লো ভিতরটা। কত বড়ো সাহস এই কায়সারের। একে তো তার বউকে তুলে নিয়ে এসেছে তার উপর এখন ফুঁসলিয়ে তার থেকে কেড়ে নেওয়ার চেষ্টা করছে। শীর্ষ চোয়াল শক্ত করে এগিয়ে এলো কায়সারের দিকে। কেউ কিছু বুঝে ওঠার পূর্বেই লাথি বসালো কায়সারের এক পাশ থেকে। হুংকার ছেড়ে বলল,
“কু’ত্তা’র বাচ্চা, বা’ল পাকনা ডিসের লাইন। তুই কোন সাহসে আমার বউকে তুলে এনেছিস? তোকে বারবার আমি সাবধান করেছি, শুনিসনি। তোর জীবনের মায়া নেই হা’রাম’জা’দা? ম’রা’র জন্য খ্যাপেছিস?”
আকস্মিক আক্রমণের তাল সামলাতে পারল না কায়সার। সে কাত হয়ে পড়লো মেঝেতে। ঘাড় বাঁকিয়ে তাকালো পাশ ফিরে। তবে শীর্ষকে দেখে খুব একটা পরিবর্তন দেখা গেল না তার ভিতরে। বরং বেশ শান্ত ভঙ্গিতেই উঠে দাঁড়াল সে। ওষ্ঠ বাঁকিয়ে বলল,
“জানতাম তুমি আসবি। তবে এত তাড়াতাড়ি আসবি ভাবিনি।”
পরপর কায়সার তার চোখ মুখ শক্ত করে তুললো। আদেশের সুরে তার সাথে আসা লোকদের বলল,
“ধর হা’রা’মি’র বাচ্চাকে। ওকে আজ আমি শেষ করে তবেই ক্ষান্ত হবো।”
কায়সারের আদেশ পাওয়ার সাথে সাথে তিনজন ব্যক্তি তিন দিক থেকে চেপে ধরলো শীর্ষকে। শীর্ষের শরীর এমনিই কিছুটা অসুস্থ, গতকালকের ক্ষতগুলো এখনো তাজা। সে পেরে উঠল না তিনজন পুরুষের শক্তির সাথে। তবুও নিজেকে মুক্ত করার বেশ চেষ্টা চালালো। কটমট করে বলল,
“আমাকে ছাড় বলছি। নয়তো তোদের জন্য কিন্তু খুব খারাপ হবে।”
রাকিবও অনেক চেষ্টা করল শীর্ষকে ছাড়ানোর কিন্তু পারলো না। কায়সার বাঁকা হাসলো। এগিয়ে এসে চেপে ধরলো শীর্ষের কলার। তাচ্ছিল্যের স্বরে বলল,
“আগে তুই তো ছাড়া পা। তারপর দেখা যাবে কার খারাপ হয় আমার নাকি তোর।”
শীর্ষের দুই পাশ থেকে ধরে রেখেছে কায়সারের লোকেরা। কিন্তু মাথাটা তো মুক্ত। শীর্ষ নিজের মাথা দ্বারা বেশ জোরেশোরে একটা টাক দিলো কায়সারের মাথায়। হুংকার ছেড়ে বলল,
“কু’ত্তা’র বাচ্চা একবার ছেড়ে দিয়ে দেখ আমাকে তোর কি হাল করি।”
শীর্ষের আকস্মিক আক্রমণে কায়সার দুই কদম পিছিয়ে গেল। বেশ গাঢ়ভাবেই মাথায় আঘাতটা লেগেছে তার। ব্যথায় মাথাটা ঝিমঝিম করে উঠেছিল, চোখের অভিমুখটা ঝাপসা হয়ে গিয়েছিল কিছুটা সময়ের জন্য। কায়সার ফুঁসে উঠল। দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
“শা’লা’র তেজ শেষ হয় না। আমার হাতে বন্দি হয়ে আমাকেই মা’র’তে আসে।”
কথাটা বলতে বলতেই কায়সার একটা লাথি বসালো শীর্ষের পেট বরাবর। আঁতকে উঠল ত্রয়ী। নিজের চোখের সামনে স্বামীকে মা’র খেতে দেখে সহ্য করতে পারল না সে। হৃদয় অস্থির হয়ে উঠল। কণ্ঠনালী ভেঙে এলো কান্নায়। কায়সার আরেকটা লাথি দিতে একটু এগিয়ে যেতেই ত্রয়ী দৌড়ে এসে তার পায়ে পড়ে গেল। ফুঁপিয়ে উঠে বলল,
“উনাকে মা’র’বে’ন না দয়া করে। উনি ব্যথা পাবেন। এমনিই উনার শরীরে অনেক ক্ষত।”
কায়সার থেমে গেল। হৃদয় ভারী হয়ে উঠল তার। শরীরটা যেন ভেঙে এলো। নিজের প্রিয় রমনীর কণ্ঠে অন্য পুরুষের জন্য কষ্ট, অনুনয়, কাতরতা নিশ্চয়ই কারো পক্ষে সহ্য করা সম্ভব নয়। কই একটু আগে যখন শীর্ষ তাকে মা’র’লো তখন তো ত্রয়ী ছুটে এলো না। অথচ শীর্ষের শরীরে একটু আঘাত করতেই ছুটে এসেছে। অনুনয় করে তাকে আঘাত করতে নিষেধ করছে। কায়সার হাঁটু গেঁড়ে বসলো ত্রয়ীর অভিমুখে। ধীর কণ্ঠে বলল,
অনুরাগে তুই পর্ব ৫১
“আমি পুনর্জন্মে বিশ্বাসী নই। তাই এ জন্মেই তোমাকে পেতে চেয়েছিলাম। তোমার রঙে আমি আমার জীবনকে সাজাতে চেয়েছিলাম। অথচ তুমি আমার হলে না।”
এই টুকু বলে থামলো কায়সার। কাতর কণ্ঠে ফের বলল,
“আমি কি শীর্ষের থেকে খুব বেশি খারাপ ছিলাম ত্রয়ী? তাহলে তুমি আমার কেন হলে না?”