অনুরাগে তুই শেষ পর্ব
সাদিয়া শওকত বাবলি
অতঃপর ব্যাগ ঘেটে মোবাইলটা বের করে শেষবারের মতো শীর্ষকে একটি মেসেজ করল,
“আপনাকে মুক্ত করে দিয়ে অবশেষে আমি হারিয়ে গেলাম। আমাদের আর কখনো দেখা না হোক, একে অপরের সান্নিধ্যে আর আসা না হোক।”
মেসেজটা পাঠানোর পরপরই ত্রয়ী নিজের মোবাইল থেকে সিম কার্ডটা খুলে নিল। দুই আঙ্গুলের মধ্যভাগে নিয়ে বলপ্রয়োগে খুব অল্প সময়ের মধ্যেই ভেঙে ফেললো সেটা। অতঃপর ভাঙা অংশগুলো ছুঁড়ে দিলো অভিমুখে অদূরে। আঁখিদ্বয় ভরে উঠল ত্রয়ীর, হৃদয়ের অবস্থা নাজুক। তবুও নিজেকে সামলে নেওয়ার চেষ্টা করল সে। ঝাপসা চোখে তাকালো ভাঙা সিম কার্ডটার দিকে। মৃদু হেসে বলল,
“আপনি হয়তো কখনো জানতেও পারবেন না, আপনাকে পাওয়ার কতটা তীব্র ইচ্ছা, আকাঙ্ক্ষা, ভালোবাসা নিয়ে আপনার থেকে দূরে সরে এসেছি।”
এইটুকু বলে থামলো ত্রয়ী। দীর্ঘশ্বাস ফেলে ফের বলল,
“গোটা একটা জীবন শূন্যতায় কেটে যাক, তবুও আপনার মতো মানুষের সাথে দ্বিতীয়বার আর দেখা না হোক।”
শীর্ষ অফিসেই ছিল। নিজের কেবিনে বসে বসে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ফাইল দেখছিল। আর তার মোবাইলটা রাখা ছিল অভিমুখে টেবিলের উপরে। ত্রয়ীর মেসেজটা অনেক আগেই এসেছে, মেসেজের রিং টোন ও তার কানে পৌঁছেছে তবে চেক করে দেখা হয়নি। মোবাইলে আসা মেসেজ খুব একটা চেক করা হয় না শীর্ষের। সারাদিনই এমন অগনিত অনেক মেসেজ সিম কোম্পানি থেকে আসে। শীর্ষ ভেবেছিল এটাও হয়তো সিম কোম্পানির।
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
বেশ অনেকটা সময় নিয়ে ফাইলগুলো সব দেখে মোবাইলটা হাতে নিল শীর্ষ। স্ক্রীনের দিকে তাকাতেই ত্রয়ীর নামটা চোখে পড়লো তার। সাথে সাথে ভ্রু যুগল কুঁচকে গেল। এই মেয়ে আবার কি মেসেজ করেছে তাকে? শীর্ষ সময় ব্যয় করল না। দ্রুত পড়লো মেসেজটা। তবে মেসেজের কথাগুলো নিয়ে তেমন একটা ভাবলো না সে। হতে পারে গতকাল রাতে রাগ দেখিয়েছে, দুপুরে খেতে যায়নি তাই এমন একটি মেসেজ করেছে। শীর্ষ আবার মোবাইলটা রেখে দিলো টেবিলের উপরে। মনযোগ দেওয়ার চেষ্টা করল অন্য কাজে। কিন্তু কিছুতেই অন্য কাজে মনোযোগ যাচ্ছে না তার। ত্রয়ীর মেসেজটা প্রথমে স্বাভাবিকভাবে নিলেও এখন কেমন যেন খটকা লাগছে। মেয়েটা এমন শক্ত কথা তো কখনো বলে না।
তাকে গা’ল’ম’ন্দ করলে কিংবা মা’র’লে’ও তো এমন শক্ত কথা কখনো বলে না। তাহলে বাড়িতে কি কিছু হয়েছে? হতে পারে। গতকাল তার এবং ত্রয়ীর বিয়ে নিয়ে তো সে আব্দুর রহমান খানের সাথে কথা বলেছিল। আব্দুর রহমান খান বলেছিলেন ফাহমিদা বেগমের সাথে কথা বলবেন। সেই বিয়ে বিয়ে নিয়ে আবার কিছু হলো না তো? তেমন কিছু হলে ত্রয়ী তো সামলাতেও পারবে না। মেয়েটা এমনিই বোকাসোকা, নরম স্বভাবের। শীর্ষ অস্থির হলো। সময় ব্যয় না করে মোবাইলটা হাতে নিল দ্রুত। কল লাগালো ত্রয়ীর নাম্বারে। কিন্তু হায়! একজন সুমিষ্ট কণ্ঠধারী নারী নম্রতার সাথে জানালেন নাম্বারটি বন্ধ আছে। শীর্ষের অস্থিরতা বাড়লো। দ্রুত সে ছুট লাগালো বাড়ির দিকে। আব্দুর রহমান খান কিছুক্ষণ আগেই বেরিয়েছেন বাড়ির উদ্দেশ্যে। শীর্ষকে ডেকে গিয়েছেন। তখন যদি যেতো!
কিছুটা সময় অতিবাহিত হতেই বাড়িতে পৌঁছালো শীর্ষ। সদর দরজা থেকে বাড়িতে প্রবেশ করে সে আর এদিক ওদিক তাকালো না। সোজা চলে এলো ত্রয়ীর কক্ষে। কক্ষে কাউকে চোখে পড়লো না। তবে কি ত্রয়ী ওয়াশ রুমে বা বারান্দায়? শীর্ষ গলা বাড়িয়ে ডাকলো,
“বালির বস্তা, বালির বস্তা।”
কোনো সাড়াশব্দ নেই। মেয়েটা কি তবে কক্ষেই নেই? শীর্ষ ভালোভাবে তাকালো আশেপাশে। কপালটা কুঁচকে এলো তার। ত্রয়ীর কক্ষটা আজ কেমন ভিন্ন ভিন্ন লাগেছে। মনে হচ্ছে যেন অনেক কিছুই এ কক্ষ থেকে উধাও। কেমন ফাঁকা ফাঁকা লাগছে চারপাশ। শীর্ষ এগিয়ে এসে আলমারিটা খুললো। আলমারি ফাঁকা। ত্রয়ীর কোনো কাপড় সেখানে নেই। ড্রেসিং টেবিলের অভিমুখটাও প্রায় ফাঁকা বললেই চলে। শীর্ষের কলিজাটা ধক করে উঠল। তবে কি ত্রয়ী সত্যিই হারিয়ে গেছে? তাকে ছেড়ে চলে গেছে? না, না এ হতে পারে না। ত্রয়ী কখনো তাকে ছেড়ে যেতে পারে না। আর গেলেও বা কোথায় যাবে? মেয়েটার যাওয়ার যে আর কোথাও জায়গা নেই। হয়তো এই কক্ষ থেকে অন্য কক্ষে গেছে। এ বাড়িতে তো আর কক্ষের অভাব নেই। শীর্ষ পা চালিয়ে বসার কক্ষে এলো। গলা উঁচিয়ে ডাকলো,
“ত্রয়ী, ত্রয়ী, কোথায় তুই?”
শীর্ষের হাঁক ডাকে আব্দুর রহমান খান, ফাহমিদা বেগম, রিমা, পন্না এবং নুড়ি ছুটে এলো বসার কক্ষে। ফাহমিদা বেগম বেশ থমথমে কণ্ঠেই শুধালেন,
“কি হয়েছে? এভাবে চিৎকার করে ওকে ডাকছো কেন?”
শীর্ষ জবাব দিলো না মায়ের কথার। বরং সে পাল্টা প্রশ্ন করল,
“ত্রয়ী কোথায়?”
“চলে গেছে।”
“চলে গেছে মানে?”
শীর্ষের সাথে সাথে অবাক হলেন আব্দুর রহমান খানও। এমনিই আজ বাড়িতে ফিরতে ফিরতে দেরি হয়েছে তার। প্রতিদিন বিকালের দিকেই বাড়ি ফিরেন তিনি, সন্ধ্যায় বাড়ির সবাইকে নিয়ে চায়ের আসর বসান। তবে আজ অফিসের কাজ শেষ করতে করতেই সন্ধ্যা গড়িয়েছিল। তারপর বাড়িতে ফিরেছেন। বাড়িতে ফিরেই সোজা ফ্রেশ হতে চলে গিয়েছিলেন। কে বাড়িতে আছেন আর কে নেই অতশত খেয়াল করেননি। আব্দুর রহমান খান বেশ অবাক কণ্ঠেই শুধালেন,
“চলে গেছে মানে? কোথায় গিয়েছে?”
“জানি না।”
শীর্ষ কিছু বলবে তার পূর্বেই তেতে উঠলেন আব্দুর রহমান খান। হুংকার ছেড়ে বললেন,
“জানি না মানে কি? একটা অসহায় মেয়েকে আমি এ বাড়িতে এনেছিলাম, তোমাদের দায়িত্বে রেখে গিয়েছিলাম। অথচ তোমরা এখান বলছো মেয়েটি বাড়ি থেকে চলে গেছে, আর কোথায় গিয়েছে তাও জানো না।”
বাবা এবং ভাইয়ের উপস্থিতিতে পন্না যেন এবার একটু সাহস পেল। এগিয়ে এসে সে বলল,
“ত্রয়ী আপু কোথায় গিয়েছে এরা জানলেও তো বলবে না। কারণ ত্রয়ী আপু তো নিজের ইচ্ছায় বাড়ি ছেড়ে চলে যায়নি, এরা বাধ্য করেছে। মা আর রিমা আপু মিলে ত্রয়ী আপুকে জোর করে এ বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছে।”
পান্নার কথায় শীর্ষ এবং আব্দুর রহমান খানের মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়লো। ফাহমিদা বেগম এবং রিমা মিলে ত্রয়ীকে বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছে? শীর্ষ ছুটে এসে দাঁড়াল পন্নার মুখোমুখি। ব্যাকুল কণ্ঠে শুধাল,
“মা আর রিমা ত্রয়ীকে বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছে! কেন দিয়েছে? আমার আর বাবার অবর্তমানে কি হয়েছিল বাড়িতে?”
পন্না একবার তাকালো মা এবং বোনের দিকে। অতঃপর গড়গড় করে বলতে শুরু করল তাদের অনুপস্থিতিতে কি কি হয়েছে, ফাহমিদা বেগম এবং রিমা মিলে ত্রয়ীকে কতটা অপমান করে বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছে। সবটা শুনে চোখ মুখ শক্ত উঠল শীর্ষের। ক্রোধে চোখ দুটোও লাল হয়ে উঠল। কপালের রগগুলো নীলচে বর্ণ ধারণ করল মুহুর্তেই। আব্দুর রহমান খানও সইতে পারলেন না নিজ স্ত্রী এবং মেয়ের এমন কান্ডকীর্তি। গ্রাম থেকে একটি এতিম, অসহায় মেয়েকে নিজ বাড়িতে এনে ঠাঁই দিয়েছিলেন তিনি। অথচ তার অবর্তমানে সেই অসহায় মেয়েটির উপরে তার স্ত্রী এবং মেয়ে কিনা এভাবে অত্যাচার করেছে? আব্দুর রহমান খান বুকে সূক্ষ্ম চিনচিনে ব্যথা অনুভব করলেন। বুক চেপে পাশেই সোফার উপরে বসে পড়লেন তৎক্ষণাৎ। আশেপাশে উপস্থিত সবাই অস্থির হয়ে পড়লো সাথে সাথে। ফাহমিদা বেগম ছুটে এসে ধরলেন স্বামীকে। ব্যগ্র কণ্ঠে বললেন,
“কি হয়েছে তোমার? এমন করছো কেন?”
আব্দুর রহমান খান ফুঁসে উঠলেন। ছিটা মে’রে স্ত্রীকে নিজের থেকে দূরে সরিয়ে দিলেন তিনি। জোরে নিঃশ্বাস নিতে নিতে বললেন,
“আমাকে স্পর্শ করবে না তুমি। তোমার ঐ নোংরা হাত দ্বারা আমাকে একদম স্পর্শ করবে না।”
ফাহমিদা বেগম ব্যথিত হলেন। আব্দুর রহমান খানের সাথে তার বিয়ে হয়েছে অনেক বছর। এত বছরেও লোকটা এত শক্ত কথা তাকে কখনো বলেননি। আজ একটি বাইরের মেয়ের জন্য তাকে এমন কথা বলল! ফাহমিদা বেগমের চোখে মুখে আঁধার নেমে এলো। আহত কণ্ঠে বললেন,
“তুমি আমাকে এমন একটি কথা বলতে পারলে? তাও বাইরের একটি মেয়ের জন্য?”
“আমি বাইরের মেয়ে হোক আর ঘরের মেয়ে হোক কারো জন্য তোমাকে কিছু বলিনি। যা বলেছি সবটাই তোমার নিচ মন মানসিকতার জন্য।”
আব্দুর রহমান খানের কথা শেষ হতে না হতেই মুখ খুললো রিমা। বেশ দাপটের সাথে বলল,
“তাতেও তুমি মাকে এভাবে বলতে পারো না, বাবা। তুমি জানো ওই ত্রয়ী কি করেছে? যে থালায় খেয়েছে সেই থালায় ফুটো করেছে। তোমার ছেলেকে ফাঁ’সি’য়ে বিয়ে করেছে। তারপর আমাদের সবাইকে ফাঁ’সি’য়ে এ বাড়িও কব্জায় নিতে চেয়েছিল। ভাগ্যিস আমি আর মা সবট আগেই বুঝে গিয়েছিলাম। তাই ওকে বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছি।”
কথাগুলো বলে রিমা থামলো। সাথে সাথে বেশ শক্তপোক্ত একটা থা’প্প’র এসে পড়লো তার গালে। আকস্মিক থা’প্প’রে হকচকিয়ে উঠল রিমা। নিজের তাল সামলাতে না পেরে নিচে পড়তে পড়তেও বাঁচিয়ে নিল। গালে হাত দিয়ে তাকালো পাশ ফিরে। চোখে পড়লো শীর্ষের রক্তিম মুখ খানা। রিমা চোখ বড়ো বড়ো করল। হতবাক কণ্ঠে বলল,
“তুই আমাকে মা’র’লি ভাইয়া?”
শীর্ষ সাথে সাথে আরেকটা থা’প্প’র দিলো রিমার আরেক গালে। রিমা ফের গালে হাত দিয়ে বলল,
“ভাইয়া….”
এই টুকু উচ্চারণ করতেই তার গালে আরও একটি থা’প্প’র এসে পড়লো। এবারের থা’প্প’র’টা একটু জোরেই পড়েছে। মেয়েটার এক ধার কেটে লাল রক্তের দেখা মিলেছে। ফাহমিদা বেগম, পন্না এবং নুড়ি আঁতকে উঠল। দৌড়ে এসে তারা ধরলো রিমাকে। মায়ের সান্নিধ্য পেয়ে রিমা যেন একটু সান্নিধ্য পেল। ডুকরে কেঁদে উঠল সে। ফাহমিদা বেগম দুই হাতে মেয়েকে নিজের সাথে জড়িয়ে নিলেন। কণ্ঠে রাগ নিয়ে বললেন,
“কি করছিস কি? মেয়েটাকে মে’রে ফেলবি নাকি?”
শীর্ষ তবুও থামলো না। ফাহমিদা বেগমের বাহুবন্ধনে থাকা অবস্থাতেই রিমার উপরে থাবা বসালো সে। টেনে ধরলো চু’ল গুলো। দাঁতে দাঁত পিষে বলল,
“ওর মতো বজ্জাত, নোংরা মন মানসিকতার বোন রেখেই বা কি করবো? ভেবেছিলাম বাবার টাকা, আর শাসনের অভাবে ওর ভিতরে অ’হংকা’রের সৃষ্টি হয়েছে। এখন তো দেখছি ও তার থেকেও অধম। ওর মনটা সম্পূর্ণ নোংরা মানসিকতায় ভরা। তাই ঘটনা যতই ছোট এবং স্বাভাবিক হোক না কেন ও ওর নোংরা মন মানসিকতা দ্বারা তা অস্বাভাবিক করবেই।”
শীর্ষ বেশ জোরেই চুল টেনে ধরলো রিমার। ব্যথায় কঁকিয়ে উঠল মেয়েটা। দুই চোখ বেঁয়ে অবিরাম ধারায় ঝড়ছে অশ্রু বিন্দু। ফাহমিদা বেগম, পন্না এবং নুড়ি তিন নারী কি আর পারে শীর্ষের পুরুষালী শক্তির সাথে? তবুও অনেক কষ্টে রিমার থেকে ছাড়িয়ে নিল তাকে। ফাহমিদা বেগম ক্রোধের দাপটে একটা থা’প্প’র’ও বসিয়ে দিলো শীর্ষের গালে। ঝাঁঝালো কণ্ঠে বলল,
“কি শুরু করেছিস তুই? একটা বাইরের মেয়ের জন্য আমাকে মেয়েকে মা’র’ছি’স?”
এই টুকু বলে থামলেন ফাহমিদা বেগম। দম নিয়ে ফের বললেন,
“হ্যা, আমি আর রিমা মিলে ঐ মেয়েকে বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছি। যা করেছি বেশ করেছি। ওর মতো একটা ঠ’ক, প্র’তা’র’ক, বা’জে মেয়েকে নিজেদের বাড়িতে রাখার প্রয়োজন মনে করিনি আমরা।”
ক্রোধে শরীরটা রি রি করে উঠল শীর্ষের। তবুও অভিমুখে তার মা দাঁড়িয়ে আছে ভেবে নিজেকে সামলানোর চেষ্টা করলো। জোরে জোরে কয়েকটা নিঃশ্বাস নিয়ে নিজেকে একটু ধাতস্থ করে সে বলল,
“ঠ’ক, প্র’তা’র’ক ত্রয়ী নয়, বরং তোমারা। একটা অসহায়, এ’তি’ম মেয়েকে এ বাড়িতে এনে তাকে একটু সুখের স্বপ্ন দেখিয়ে বাড়ি থেকে বের বের করে দিয়েছো। আর হ্যা কি বললে তোমরা? ও আমাকে ফাঁ’সি’য়ে বিয়ে করেছে? না, বরং আমি ওকে ফাঁ’সি’য়ে বিয়ে করেছি। আমি ত্রয়ীকে অনেকদিন আগে থেকেই ভালোবাসি। বাবাকেও এ কথা জানিয়েছিলাম। বলেছিলাম আমাদের বিয়ে দিতে। কিন্তু ত্রয়ী বিয়েতে রাজি না থাকায় বাবাও বিয়ের ব্যাপারে বেঁকে বসে। তারপর আমরা গ্রামে যাই। সেখানে রাতের আঁধারে গ্রামবাসীরা আমাদের ধরেছিল ঠিক তবে বিয়ে-থায়ের ব্যাপারে তেমন কোনো জোরজবরদস্তি ছিল না। ওটা আমি ইচ্ছা করে করেছি। এরপর বিয়ের ব্যাপারটা তোমাদের নিকট প্রকাশ করতে গিয়েও করিনি। ভেবেছি তোমাদের ছেলে এভাবে বিয়ে করেছে শুনলে কষ্ট পাবে। আমি আমার বাবা মায়ের কষ্টের কারণ হতে চাইনি। অথচ শেষ পর্যন্ত স্ত্রীর কষ্টের কারণ হয়ে দাঁড়ালাম।”
এই টুকু বলে থামলো শীর্ষ। দম নিয়ে ফের বলল,
“ছোট বেলা থেকে আমার মাকে আমি আদর্শ মেনেছি। কিন্তু আমার মায়ের ভিতরেও যে অন্য এক নোংরা নারী ছিল জানা ছিল না।”
ফাহমিদা বেগম থমকালেন। ছেলের কণ্ঠ নিঃসৃত প্রতিটি ধ্বনি যেন তীরের মতো আঘাত হানলো তার হৃদয়ে। তিনি তো এতকিছু জানতেন না। আপাত দৃষ্টিতে যা দেখেছেন তার উপরে নির্ভর করেই পদক্ষেপ নিয়েছেন এবং যা করেছেন ছেলের ভালোর কথা চিন্তা করেই করেছেন। ফাহমিদা বেগম আহত দৃষ্টিতে তাকালেন ছেলের দিকে। মলিন কণ্ঠে বললেন,
“তুই আমাকে এমন একটা কথা বলতে পারলি, শীর্ষ? আমি তো যা করেছি তোর ভালোর কথা ভেবেই করেছি।”
শীর্ষের আঁখি দ্বয় অশ্রুসিক্ত হলো। ধরা গলায় বলল,
“হ্যা, তুমি আমার ভালোর কথাই ভেবেছো। এত ভালোর কথ ভেবেছো যে আমার বাঁচার সম্বল, আমার ভালোবাসাকেই আমার থেকে কে’ড়ে নিয়েছো।”
থামলো শীর্ষ। পরপর আবার বলল,
“একটা কথা কি জানো মা, আমি ভেবেছিলাম আমার মা পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ মা। সে যেমন আমাদের জন্য মমতাময়ী। তেমন ঐ এ’তি’ম মেয়েটার জন্যও মমতাময়ী। আমি বুঝিনি সহজ সরল ঐ মেয়েটার প্রতি তোমাদের এত অভিযোগ। যদি জানতাম তবে কিছুই লুকাতাম না। আচ্ছা মা বুঝলাম, তোমাদের ওর প্রতি অভিযোগের শেষ নেই। কিন্তু অভিযোগ গুলো তো আমাকে ঘিরেই। ওকে বের করে দেওয়ার আগে অন্তত আমাকে এ বিষয়ে কিছু বলতে পারতে, একটা কল তো করতে পারে।”
শীর্ষ থামলো। ছেলের কথার পৃষ্ঠে ফাহমিদা বেগম কি বলবেন খুঁজে পেলেন না। সত্যিই না জেনে শুনে তিনি যা করেছেন তা ক্ষমার অযোগ্য। ফাহমিদা বেগম একটু হলেও নিজের ভুল বুঝতে পারলেন। অপরাধীর কণ্ঠে বললেন,
“ওকে আমি গ্রামে পাঠিয়ে দিয়েছি। রিমা নিজে ওকে গাড়িতে তুলে দিয়ে এসেছে। তুই ওর গ্রামে যা, ওকে ফিরিয়ে নিয়ে আয় বাবা।”
শীর্ষ একটু হলেও আশার আলো খুঁজে পেল। আর সে দাঁড়াল না। দ্রুত বাড়ির গাড়ি নিয়ে ছুটলো ত্রয়ীদের গ্রামে।
নিশিথের আঁধার কেটে আকাশে সূর্যটা উঁকি দিয়েছে কেবল মাত্র। শীর্ষও মাত্রই ত্রয়ীদের গ্রামে পৌঁছালো। রিমা এবং ফাহমিদা বেগমের ভাষ্যমতে ত্রয়ী যে বাসে এসেছে তাতে এতক্ষণে তার গ্রামে চলে আসার কথা। কিন্তু এখানে এসেও হতাশ হলো শীর্ষ। ত্রয়ী গ্রামে আসেনি। তাহলে কোথায় গেল মেয়েটা? শীর্ষ বেশ অনেকবার কল করল ত্রয়ীর নাম্বারে। বারবারই নাম্বারটা বন্ধ বলছে। আচ্ছা পথিমধ্যে ত্রয়ীর কোনো বিপদ আপদ ঘটলো না তো? দুর্ঘটনা বা অন্য কিছু? আজকাল নারীদের জন্য পথঘাট তো তেমন ভালো না। তার উপর মেয়েটা সুন্দরী, বোকাসোকা, সহজ সরল। এমন মেয়েকে একা পেলে পুরুষদের এমনিই লালা ঝড়ে। অনেক সময় নিজেরা ধ’র্ষ’ন করে মে’রে ফেলে, আবার অনেক সময় অর্থের জন্য বিক্রি করে দেয় কোনো প’তি’তা প’ল্লী বা কো’ঠা’য়। নানান ধরণের চিন্তা ভাবনা করতে করতে শীর্ষের যেন দম বন্ধকর অবস্থা। আর কিছু ভাবতে পারছে না সে। প্রিয় মানুষকে হারানোর ভয়, সংশয়, আতংক চারদিক থেকে ঘিরে ধরেছে তাকে। বুকে ব্যথা হচ্ছে ভীষণ। নিঃশ্বাস নিতেও যেন কষ্ট হচ্ছে। এর মধ্যেই হঠাৎ শীর্ষের স্মরণে এলো কায়সারের কথা। ঐ ব’দ’মা’ই’শ টা তো আগে থেকেই ত্রয়ীর পিছনে পড়ে আছে। মেয়েটাকে বাড়ি থেকে বের করে দেওয়ায় ওর তো আরও সুযোগ হয়েছে। ও কোনোভাবে ত্রয়ীকে নিয়ে যায়নি তো। শীর্ষ আর গ্রামে থাকলো না। যেভাবে গিয়েছিল সেভাবেই আবার রওনা হলো শহরের উদ্দেশ্যে।
শীর্ষের শহরে পৌঁছাতে পৌঁছাতে দুপুর গড়িয়ে প্রায় বিকাল। আকাশের সূর্যটা তার তেজ কমিয়ে ঢলে পড়েছে এক দিকে। শহরে পৌঁছেই শীর্ষ হানা দিলো কায়সারের হাসপাতালে। কায়সারের জন্য বরাদ্দকৃত কেবিনে গিয়ে কেউ কিছু বুঝে ওঠার পূর্বেই থাবা বসালো তার কলার ধরে। উদ্ভ্রান্তের ন্যায় শুধাল,
“ত্রয়ী কোথায়? বল ত্রয়ী কোথায়?”
কায়সার বেচারা এমনিই অসুস্থ তার উপর শীর্ষের ফের আক্রমণ। আকস্মিক আক্রমণে হকচকিয়ে উঠল কায়সার এবং কেবিনে উপস্থিত সবাই। কেবিনে কায়সারের বাড়ির লোক এবং দলের কিছু লোকেরা ছিল। তারা দ্রুত এসে শীর্ষকে টেনে হিচড়ে ছাড়িয়ে নিল তার থেকে। কায়সার নিজের গলা ধরে খুকখুক করে কেশে উঠল। শীর্ষ ফের ক্রোধ নিয়ে শুধাল,
“ত্রয়ী কোথায়? আমার ত্রয়ী কোথায়?”
কায়সার কাশতে কাশতেই বলল,
“আমি জানবো কিভাবে ত্রয়ী কোথায়? ওর তো তোর বাড়িতে থাকার কথা।”
“আমার বাড়িতে নেই। কোথাও নেই ও, কোথাও নেই।”
কায়সার অবাক হলো। একটু সময় নিয়ে সে নিজের কাশি বন্ধ করল। শীর্ষের দিকে শীতল দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল,
“হারিয়ে ফেললি ওকে?”
শীর্ষ ফুঁসে উঠল। তেজ নিয়ে বলল,
“হারিয়ে ফেলিনি। ওকে নিশ্চয়ই তুই নিয়ে কোথাও লুকিয়ে রেখেছিস।”
কায়সার আলতো হাসলো। মলিন কণ্ঠে বলল,
“সে সুযোগ যদি আমার থাকতো তবে তাই করতাম। এই পৃথিবীর বুক থেকে সরিয়ে নিয়ে ওকে লুকিয়ে রাখতাম আমার নিকট। যাতে কেউ ওকে আর আমার থেকে কেড়ে নিতে না পারে।”
শীর্ষের বোধ হয় একটু হলেও বিশ্বাস হলো কায়সারের কথা। শান্ত কণ্ঠেই সে শুধাল,
“তাহলে তুই বলছিস ত্রয়ী কোথায় তুই জানিস না?”
“না।”
শীর্ষ আর কোনো প্রশ্ন করল না। তার এখন এখানে দাঁড়িয়ে থাকলে চলবে না। ত্রয়ীকে খুঁজে বের করতে হবে। কায়সারকে একবার জিজ্ঞেস করার কাজ করেছে। এরপর এর পিছনে না হয় কোনো লোক লাগিয়ে দেওয়া যাবে। ত্রয়ীকে যদি এ লুকিয়ে রেখে থাকে তাহলে সেখান থেকেই জানা যাবে। শীর্ষ আর দাঁড়াল না। পা বাড়ালো কক্ষ থেকে বেরিয়ে যাওয়ার উদ্দেশ্যে। কায়সার তখনই তার পিছু ডাকলো। শীর্ষ থমকে দাঁড়াল। কায়সার মৃদু হেসে বলল,
“এক আকাশসম ভালোবেসেও আমি যাকে পেলাম না। তুই তাকে পেয়েও ধরে রাখতে পারলি না।”
শীর্ষ শুনলো কায়সারের কথাগুলো। তবে উত্তর দিলো না সে। নীরবে নিঃশব্দে বেশি কক্ষ থেকে। বাইরে এসে গাড়িতে বসলো। নিজেকে কেমন পাগল পাগল লাগছে। কি করবে, কোথায় যাবে কিচ্ছু ভাবতে পারছে না। এত বড়ো শহরে এখন সে মেয়েটাকে কোথায় খুঁজবে? আর যদি মেয়েটার কোনো বিপদ আপদ হয়ে থাকে তখন? শীর্ষের এই মুহূর্তে ত্রয়ীর উপরে রাগ লাগছে ভীষণ। বাড়িতে যখন এতকিছু ঘটলো তখন তাকে একটা কল করলে কি এমন হতো?
অনুরাগে তুই পর্ব ৫৮
তখন না হয় কল করেনি, পরে করতো। মেসেজ যখন করতে পেরেছে তখন কলও নিশ্চয়ই করতে পারতো। অথবা মেসেজে ওসব না লিখে বাড়ি থেকে বের করে দেওয়ার কথাও তো লিখতে পারতো। শীর্ষ ক্রোধে দিশেহারা হয়ে উঠলো। গায়ের জোরে একটা ঘুষি বসালো গাড়ির স্টিয়ারিংয়ে। হাতটা থেতলে গেল যেন। লাল র’ক্তে’রা গড়িয়ে পড়লো তড়িঘড়ি করে। শীর্ষ তাকালো সে র’ক্তে’র দিকে। দাঁতে দাঁত পিষে বলল,
“একবার তোকে খুঁজে পাই, শুধু একবার। আজ আমাকে তুই যতটা কষ্ট দিলি। আমার হৃদয়ে যতটা রক্তক্ষরণ ঘটালি প্রতিটির হিসাব নেব আমি। গুনে গুনে হিসাব নেব।”