অন্তঃদহন পর্ব ১
DRM Shohag
প্রায় ত্রিশ মিনিট যাবৎ সদ্য বিবাহিতা স্ত্রীর উদ্দেশ্যে অনবরত একটি বাণী ছুঁড়ছে আকাশ নওয়ান।
~ তোমার নাম কি?
কিন্তু দুঃখের বিষয়, মেয়েটি একটা টুঁ-শব্দটিও করেনি এখন পর্যন্ত। আকাশ তীক্ষ্ণ চোখে চেয়ে আছে বিছানার কোণায় মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকা মেয়েটির পানে। কপালে বিরক্তির রেখা, সময়ের পাল্লা যত বাড়ে, আকাশের বিরক্তির মাত্রা তত বাড়ে। আকাশ সহজে রে’গে যায় না। তবে রে’গে গেলে কখন কি করে বসে, নিজেই বুঝতে পারেনা।
আকাশ নওয়ান। বয়স ২৯। যার ঘন কালো ভ্রু, সোজা নাক। দু’গাল ভর্তি মাঝারি দাঁড়ি, যা চাপদাঁড়ির চেয়ে কিছুটা বড়। গায়ের রঙ উজ্জ্বল ফর্সা। হাইট ৬ ফুট।
শক্ত চিবুকে সহজে হাসি ফোটে না আকাশের। প্রয়োজন ছাড়া তার মুখ থেকে কথা-ও শোনা যায় না।
আকাশ নওয়ান ঢাকা ভার্সিটিতে অর্থনীতি নিয়ে অনার্স, মাস্টার্স শেষে জার্মানি থেকে পিএইচডি করে বাংলােশে ফিরেছে গত দু’মাস আগে।
বাংলাদেশে ফিরে তার বাবা সাইফুদ্দীন নওয়ান এর ব্যবসায় নিজেকে নিয়োজিত করেছে।
আপাতত আকাশের বেশি রা’গ লাগছে তার অনাকাঙ্ক্ষিত বিয়ের জন্য। তার মায়ের ছোটবেলা গ্রামে বেড়ে ওঠা। মাঝেমাঝেই তিনি সেই গ্রামে যান। এবার তার মা তাকে কিছু না জানিয়ে হঠাৎ এমন একটা সিচুয়েশন ক্রিয়েট করেছিল, আকাশের বিয়ে করা ছাড়া আর কোনো উপায় ছিল না। মেয়েটির সঙ্গে কথা বলা প্রয়োজন, কিন্তু এ তো কথাই বলছে না। ৯০% সময় ঠাণ্ডা মে’জা’জের মানুষ ১০% সময়ের জন্য যখন রে’গে যায়, সে রা’গ এর ফল হয়তো মোটেই ভালো হয় না। যার প্রমাণ মাত্র ঘটে যাওয়া অনাকাঙ্ক্ষিত এক ঘটনায়।
আকাশ লাস্ট বার দাঁত কিড়মিড় করে মেয়েটির উদ্দেশ্যে প্রশ্ন ছুঁড়ে দেয়,
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
– তোমার নাম কি? সাথে বলে,
তোমার সাথে আমার ইম্পর্ট্যান্ট কথা আছে।
বরাবরের মতোই মেয়েটির থেকে উত্তর না পেয়ে আকাশ হতাশ হয়, রে’গে বোম হয়ে যায়। রা’গ কন্ট্রোল করতে না পেরে পুরুষালী শক্তহাতে মেয়েটির ডান গালে সাপটে এক থা’প্প’ড় মে’রে দেয়।
মেয়েটি মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে ছিল। বিয়ের প্রথম রাতে স্বামীর পাশে বসে, স্বামীর মুখ থেকে দু’টো মিষ্টি কথা নয়তো ভরসা দেয়ার মতো দু’টো কথা শোনার কোন মেয়ের ইচ্ছে থাকে না? কিন্তু সন্ধ্যার কপালে তো তা জুটলো না। মেয়েটি মেঝেতে উপুড় হয়ে পড়ে যায়। চোখের কোণে জলকণা জমেছে।
আকাশ রাগান্বিত স্বরে বলে,
– আমার বউ হওয়ার যোগ্যতা তোমার নেই। আমার মা তোমাদের বাড়িতে বেড়াতে গিয়েছিল, আর তোমরা আমার সহজ-সরল মা-কে গুটি বানিয়ে বড়লোক বাড়িতে ঢুকে পড়লে? আমার স্ট্যাটাস সম্পর্কে কোনো আইডিয়া আছে তোমাদের? যতসব রা’বি’শের দল!
কথাগুলো বলে আকাশ ঘরের দরজা খুলে হনহন করে বাইরে বেরিয়ে যায়। আকাশের কথাগুলো শুনে সন্ধ্যার চোখ থেকে টপটপ করে পানি গড়িয়ে পড়ে।
ধীরে ধীরে উঠে বসে। অসহায় ভরা দৃষ্টি খোলা দরজার পানে রাখে।
দু’হাঁটু জমা করে বুকের সাথে ঠেকিয়ে মলিন মুখে ছলছল দৃষ্টিতে চেয়ে থাকে।
যারা সৎ মায়ের অ’ত্যা’চা’র সহ্য করে, তারা কোনো এক অছিলায় সে বাড়ি থেকে বেরিয়ে অন্যকোথাও সুখের সন্ধান করে,, সন্ধ্যা তাদের-ই একজন। সে ভেবেছিল সৎ মায়ের ঘর থেকে বেরিয়ে সে মুক্তি পাবে,, কিন্তু তার কপাল তো এতো ভালো নয়। তার কপালে সুখ আসবে কিভাবে? যাদের কপাল ভালো, তাদের সুখের দেখা ঠিক-ই মিলে।
লোকটি তাকে লোভী বলে গেল কেন? সে বিয়েতে সম্মতি দিলেও এনার মাকে কিছু বলেনি সন্ধ্যা। কিভাবে যে বিয়ে হয়েছে সে ঠিক জানেই না।
১৮ বছরের মেয়ে সন্ধ্যা।
উজ্জ্বল শ্যামলা গড়নের মেয়ে সে। দেখতে পরীদের মতো সুন্দরী না হলেও মুখে অজস্র মায়া নিয়ে জন্মেছে সে। সুনিপুণ ছোট্ট নাক, গালের দু’পাশে হালকা ডিম্বাকৃতি গড়ন। হাইট ৫ ফুট ৩ ইঞ্চি।
ঘন চোখের পাতা ভেদ করে নোনাজল গড়িয়ে পড়ে।
পরনে একটি সাদামাটা লাল শাড়ি। মাথায় টানা আঁচল হেলে কাঁধে পড়ে যায়।
সন্ধ্যা দু’হাত হাঁটুর উপর উপর-নীচ করে রেখে ডান গাল ঠেকিয়ে চোখ বুজে নেয়। বন্ধ চোখের পাতা বেয়ে অনবরত গড়িয়ে পরা পানিতে গাল ভিজে যায়। বেশ অনেকক্ষণ এভাবেই বসে থাকলো। এরপর দু’হাতে চোখমুখ মুছে নিয়ে মেঝে থেকে দাঁড়াতে গিয়েও আবারও ঠাস করে মেঝেতে বসে পড়ে। পায়ের ব্য’থায় চোখমুখ কুঁচকে নেয়। ডান পা সামনের দিকে কিছুটা বাড়িয়ে দিয়ে দেখল, ডান পায়ের উপরের অংশে বেশ অনেকটা জায়গা জুড়ে ফোসকা পড়েছে।
সন্ধ্যার মনে পড়ল আজ সকালের কথা। মাটির চুলায় রান্না বসিয়েছিল সে। তার সৎ মা এক পাতিল গরম পানি চেয়েছিল,, সন্ধ্যা ভাতের মাড় ফেলে তার মায়ের কাজটি করে দিতে চেয়েছিল। তার ভাবনা অনুযায়ী চুলা থেকে ভাতের পাতিল নামিয়ে মাড় ফেলছিল, তখন-ই তার সৎ মা এসে সন্ধ্যার চুলের মুঠি ধরে বলে,
– তোর সাহস তো কম না? তুই আমার কথা না শুইনা এইহানে বইসা থাকিস? আমাকে পাত্তা দেস না? বসে বসে আমার অন্ন খাবি, আবার আমার-ই কথা না শুনে নবাবজাদী হয়ে বইসা থাকবি?
সন্ধ্যার হাত থেকে ভাতের পাতিল উল্টে পড়ে। পড়ে তো পড়ে সব তার ডান পায়ের উপর উল্টে পড়ে। তার সৎ মা ব্যাপারটি লক্ষ্য করে আরও জোরে সন্ধ্যার চুলের মুঠি ধরে। রে’গে বলে,
– এতোগুলো ভাত নষ্ট করলি কেন হা’রা’ম’জা’দি? কামাই করিস? বসে বসে ভাত খেয়ে হচ্ছিল না? এখন এভাবে ফেলে দিয়ে-ও নষ্ট করছিস?
সন্ধ্যা তার দু’হাতে তার চুল থেকে মায়ের হাত ছাড়াতে চায়। চোখ থেকে টপটপ করে পানি পড়ে। গরম ভাতসহ ভাতের মাড় পায়ের উপর পড়ে যাওয়ায় সন্ধ্যার মনে হলো তার ডান পা ছিঁড়ে পড়ে যাচ্ছে। জ্বলুনির মাত্রা তীব্র থেকে তীব্রতর হয়। পা অবশ হয়ে আসে। করুণ চোখে মায়ের দিকে চেয়ে থাকে। ছাড়া না পেয়ে দু’হাতে জমা করে অসহায় চোখে চেয়ে বোঝায়,
– তাকে ছেড়ে দিতে। তার যে ভীষণ ক’ষ্ট হচ্ছে।
কিন্তু তার সৎ মা একটু-ও দয়া দেখায়নি। বরং আরও কথা শোনাতে ব্যস্ত হয়ে ছিল। সন্ধ্যার ছোট ভাইয়ের কান্নার আওয়াজ পেয়ে সন্ধ্যার চুলের গোছা ছেড়ে ভেতরে যায়। সন্ধ্যা দু’হাতে তার পা ধরে ফুঁপিয়ে কাঁদে। ওই পা নিয়ে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে আবারও মাটির চুলায় ভাত বসায়। তার সৎ মাকে পানি গরম করে দেয়, নয়তো আবারও এসে কি না কি করবে!
কথাগুলো ভেবে সন্ধ্যার চোখ থেকে পানি গড়িয়ে পড়ে। পায়ে আর মলম দেয়া হয়নি। মলম? সে তো বিলাসিতা! গরম কিছু পড়ায় সাথে সাথে পায়ে পানিটুকু-ই দিতে পারে নি। সময় নষ্ট করলে যে তার সৎ মা আবারও তার দিকে তেড়ে আসবে।
সবকাজ শেষ করে পুকুরপাড়ে গিয়ে বেশ অনেকক্ষণ পানিতে পা ডুবিয়ে বসে ছিল! কিন্তু শুধু পানিতে কি আর কমে? বড়সড় ফোসকা পড়েছে পায়ের উপর। সন্ধ্যা মলিন মুখে ক্ষ’ত পায়ের দিকে চেয়ে রইল। চোখের পানির বাঁধ মাঝে মাঝে ভেঙে যায়,, কাঁদতে চায় না,, তবুও কখন যে গাল বেয়ে জল গড়ায়।
সন্ধ্যা এই আহত পা নিয়ে আর উঠলো না। ঘরের এক কোণায় বসে দেয়ালের সাথে পিঠ ঠেকিয়ে দেয়। সারাদিনের না খাওয়া, এখানে এসে একটুখানি খেয়েছিল, বেশি খেতে পারেনি। শরীরটা ভীষণ দুর্বল লাগছে। ক্লান্তিতে নুইয়ে আসা চোখজোড়া বুজে নেয়। বন্ধ চোখের পর্দায় গর্ভধারিণী মায়ের মুখটা ভেসে ওঠে। অবাধ্য অশ্রু গড়িয়ে আবারও গাল ভিজে যায়।
রাতের আঁধার ধীরগতিতে মিলিয়ে যায়। বাস চলছে তার গতিতে। যার গন্তব্য ঢাকা গাবতলী থেকে বগুড়া সাতমাথা।
বাসের মাঝ বরাবর সিটগুলোর মাঝের একটি সিটে সৌম্য ঘুমিয়ে আছে। বাসের গতি ধীর হয়, হেল্পার বাসে কয়েকটা থা’প্প’ড় দিয়ে যাত্রীদের উদ্দেশ্যে আওয়াজ করে কিছু বাণী বলতে থাকে। অনেকের ঘুম ভেঙে যায়, সাথে সৌম্য’র ঘুম হালকা হয়। চোখমুখ কুঁচকে নেয়। ধীরে ধীরে চোখ খুলে বুঝল বাস থেমেছে, আশেপাশে তাকিয়ে নিজের কাঙ্ক্ষিত জায়গা দেখে সিট থেকে দাঁড়িয়ে যায়। বাসের সিটের উপর ব্যাগ রাখার তাক থেকে তার ব্যাগ নামিয়ে দ্রুত বাস থেকে নেমে দাঁড়ায়।
এরপর একটি সিএনজি নিয়ে রওয়ানা হয় তার গ্রামের উদ্দেশ্যে। গ্রামের নাম “মিলনের পাড়া”।
সৌম্য’র পরনে একটি স্বল্প দামী অ্যাশ রঙের টি-শার্ট, সাথে বেশ পুরনো একটি জিন্স। ঘাড়ে একটি ছোটোখাটো ব্যাগ, যার ভেতর সর্বোচ্চ চার থেকে পাঁচটা শার্ট, প্যান্ট আছে। আর আছে তার ছোট বোন সন্ধ্যার জন্য একটি গোল জামা। টিউশনের টাকা পেয়ে সবার আগে তার বোনটার জন্য একটি জামা কিনেছে সে।
সৌম্য শেখ। বয়স ২৫। হাইট ৫ ফুট ৮ ইঞ্চি।
ছোট বোনের মতো-ই শ্যামলা গায়ের রঙ পেয়েছে। গায়ের রঙ মূলত তারা দু’ভাইবোন মায়ের থেকে পেয়েছে। দু’গালে কালো চাপ দাঁড়ি।
সৌম্য ঢাকা ভার্সিটিতে অ্যাকাউন্টিং সাবজেক্ট নিয়ে মাস্টার্সে পড়ছে।
একটি ছোট্ট গ্রামে সৌম্য’র বেড়ে ওঠা। তার সাথে ছিল তার বোন সন্ধ্যা। সন্ধ্যা সৌম্য’র চেয়ে সাত বছরের ছোট।
গ্রামের ছেলেমেয়ে, বাবা দিনমজুর,, অভাব-অনটনেই তাদের দিন কাটতো। মা দর্জির কাজ করত। তাদের সংসার চলে যেত কোনোরকমে।
যখন সৌম্য’র বয়স ১৭ বছর, সন্ধ্যার বয়স ১০ বছর। তখন হঠাৎ-ই একদিন তার বাবা তাদের বাড়িতে একজন মহিলাকে আনেন সাথে নয় বছরের একটি মেয়ে ছিল। মহিলাটি ছিল তার বাবার দ্বিতীয় স্ত্রী। তার মাকে বিয়ের পরপরই তার বাবা আরেকটি বিয়ে করেছিল। কিন্তু কাউকে জানায়নি।
সৌম্য’র মা স্বামীর এই রূপ মেনে নিতে পারেননি। এক সপ্তাহের মাথায় ভদ্রমহিলা ঘুমের মাঝেই মা’রা যায়।
আজ থেকে ৮ বছর আগে তার মা এই দুনিয়ার মায়া ত্যাগ করে চলে গিয়েছে। মা বেঁচে থাকতে সংসারে টাকার অভাবে তারা না খেতে পারলে দু’ভাইবোন মায়ের কোলে মাথা রাখতো আর মা তাদের মাথায় হাত বুলিয়ে দিত। ভালোবাসা দিয়ে ভরিয়ে দিত। কিন্তু মা মা’রা যাবার পর দু’ভাইবোন এই কঠিন দুনিয়াকে চিনেছে। সুখ কি জিনিস এইটাই হয়তো ভুলে গিয়েছে দুই ভাইবোন। তবে তারা দু’জন যখন পাশাপাশি বসে, তখন একটুখানি সুখ এসে তাদের কাছে ধরা দেয়।
কথাগুলো ভেবে সৌম্য দীর্ঘশ্বাস ফেলে। তার বাবা ৯ বছরের যে মেয়েকে সাথে করে এনেছিল তার বয়স এখন ১৭ বছর, যার নাম সকাল। বছর চারেক আগে তার একটি সৎ ভাই হয়েছে যার নাম সায়ন।
সৌম্য সকালের জন্য-ও একটি জামা কিনেছে। সায়নের জন্য একটি গেঞ্জি।
তবে সন্ধ্যার জন্য ভেতর থেকে আলাদা যত্ন চলে আসে। কিছু সৎ ভাইবোনেরা আপনদের মতো হয়,, তবে সকাল এমন নয়। সে পরদের চেয়ে বাজে বিহেব করে। তবুও সৌম্য তার সৎ ভাই-বোনকে ভালোবাসে। মুখ ফিরিয়ে নেয় না।
প্রায় দেড় ঘণ্টা সময়ের মাঝেই সৌম্য তার গ্রামে পৌঁছে যায়। ধরনীতে রাতের আঁধার পেরিয়ে ভোরের আলো ফুটতে শুরু করেছে। সৌম্য সিনএনজি থেকে নেমে বাড়ির পথ ধরে। যাওয়ার পথে এক মসজিদে গিয়ে ফজর নামাজ পরে নেয়।
বাড়িতে পৌঁছালে দেখল উঠানে তার সৎ মা বসে কাঁথা সেলাই করছে। সৌম্য এগিয়ে গিয়ে বলে,
– মা কেমন আছো?
তার সৎ মা বিরক্তি কণ্ঠে বলে ওঠে,
– আমি তোর মা কবে হইলাম?
সৌম্য’র মুখ মলিন হয়। ভেতর থেকে তার বাবা বেরিয়ে আসলে সৌম্য সালাম দেয়,
– আব্বা আসসালামু-আলাইকুম।
সৌম্য’র বাবা সালাম এর উত্তর দেয়। সৌম্য কেমন আছে জিজ্ঞেস করলে সে ছোট করে বলে,
– ভালোই।
সৌম্য’র ভীষণ খারাপ লাগে। মা মা’রা গেলে বাবারা যে পর হয়ে যায়, এই অভিজ্ঞতা তার আর সন্ধ্যার হয়েছে। সৌম্য আর কিছু বলল না। বাড়ির ভেতরে গিয়ে সরাসরি তার বোন সন্ধ্যার ঘরে যায়। টিনের ঘর, ঘরটির অবস্থা একদম ভালো নয়, টিনের কতজায়গায় যে ফুটো আল্লাহ-ই জানে। এখানেই তার বোনকে থাকতে দেয়া হয়। সৌম্য দীর্ঘশ্বাস ফেলে। তার একটু টাকা হলেই তার বোনকে নিয়ে এখান থেকে চলে যাবে। ঘরে সন্ধ্যাকে না দেখে কয়েকবার ডাকলো। ভাবলো হয়তো ঘুম থেকে উঠে এদিক-ওদিক গিয়েছে। সে তার বোনের ঘরেই ফ্রেশ হয়ে নিল। সন্ধ্যা টা কোথায়? ও থাকলে তাকে এটা ওটা এগিয়ে দেয়। সৌম্য বেশ অনেকক্ষণ বসে রইল সন্ধ্যার জন্য। এর মাঝে সকাল আর সায়নের জন্য আনা জামা, গেঞ্জি দিয়ে এসেছে।
সন্ধ্যাকে এখনো আসতে না দেখে সৌম্য ঘর থেকে বেরিয়ে আসে। তার বাবাকে বলে,
– আব্বা আমার বোনু কোথায়?
সৌম্য’র বাবা সাথে সাথে বলে,
– নাই।
সৌম্য অবাক হয়ে বলে,
– মানে?
সৌম্য’র সৎ মা বলে ওঠে,
– মানে বেঁইচা দিছি। খালি বইসা বইসা চারটে গিলে। ওরে রাইখা কি করমু আমি?
সৌম্য’র চোখেমুখে অজস্র বিস্ময়। তার বোনকে বিক্রি করে দিয়েছে মানে? হঠাৎ-ই রে’গে চিৎকারে করে বলে,
– আমার বোনুকে কি করেছ তোমরা? কোথায় বিক্রি করে দিয়েছ? বলো কোথায় আমার বোনু?
সৌম্য’র বাবা কোনো কথা বলে না। তার সৎ মা রে’গে বলে,
– এইডা তোর বাড়ি নয়। রা’গ নিজের মধ্যে রাখ।
সৌম্য’র দুনিয়া ঘুরছে। তার ওই ছোট বোনটা ছাড়া আর কেউ আছে? এই মানুষ দু’টো এতো পা’ষা’ণ কেন? রে’গে কিছু হবে না। অসহায় কণ্ঠে বলে,
– আমার বোনু কোথায় প্লিজ বলো?
কারো কোনো রেসপন্স না পেয়ে সৌম্য দু’হাত জমা করে ভারী গলায় বলে,
– দয়া করে বলো, বোনু কোথায়? আমি আমার বোনুকে নিয়ে একেবারে চলে যাবো এখান থেকে। আর কখনো তোমাদের বাড়িতে আসবো না। তোমাদের পায়ে ধরি,, আমার বোনটার খোঁজ দাও তোমরা! ও আব্বা, বলো আমার বোনু কোথায়? আমরা আর আসব না এখানে।
কারো কোনো ফিরতি উত্তর না পেয়ে সৌম্য সকালের সামনে গিয়ে বলে,
– সকাল, আমার বোনু কোথায় রে? বল না সকাল?
সকাল রা’গ দেখিয়ে বলে,
– আমি কিভাবে জানবো?
কথাটা বলে বাড়ির ভেতরে চলে যায়। সৌম্য ছোট্ট সায়নের সামনে হাঁটু মুড়ে বসে বলে,
– ভাই, তুই জানিস আমার বোনু কোথায়?
ছোট্ট সায়ন আদো আদো স্বরে বলে,
– বিয়ি য়য়ি গিচে।
সায়নের মা সায়নকে ঝট করে কোলে নিয়ে বকতে বকতে বাড়ির ভেতরে নিয়ে যায়। সৌম্য’র মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ে। বিয়ে হয়ে গেছে? তার বোনকে কোথায় বিয়ে দিয়েছে? কোনো ভালো ঘরে যে বিয়ে দিবে না সৌম্য জানে। তার বোনকে এক নরক থেকে আবার কোন নরকে পাঠালো? সৌম্য’র নিজেকে এতো অসহায় লাগেনি কখনো।
সকাল সকাল আসমানী নওয়ান তার ঘর থেকে বেরিয়ে আসে। ছেলের ঘরের দিকে নজর পড়লে দেখল দরজা একদম পুরোপুরো খোলা। ভদ্রমহিলা এগিয়ে গিয়ে ঘরের ভেতরে নজর করলে দেখল সন্ধ্যা বেডের পাশে দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে ঘুমিয়ে আছে। আসমানী নওয়ান বিস্ময় চোখে তাকায়। দ্রুত ঘরের ভেতরে এসে আশোপাশে তাকিয়ে ছেলে আকাশকে খুঁজলে পায় না।
এগিয়ে গিয়ে সন্ধ্যার পাশে বসে। মেয়েটির ঘাড় ডানদিকে হেলে আছে। আসমানী নওয়ান সন্ধ্যার গালে হাত দেয়। সন্ধ্যার ঘুম হালকা হয়। পিটপিট করে চোখ মেলে তাকায়। আসমানী নওয়ানকে দেখে সন্ধ্যা দ্রুত সোজা হয়ে বসে। আসমানী নওয়ান সন্ধ্যার ডান গালে নজর পড়লে অবাক হয়। মেয়েটি অনেক বেশি ফর্সা না হলেও উজ্জ্বল শ্যামা। গালের দাগ আবছা বুঝতে পারলেন তিনি। অবাক হয়ে সন্ধ্যার মুখের দিকে তাকালে সন্ধ্যা জোরপূর্বক একটু হাসলো। আসমানী নওয়ান সন্ধ্যার গালে হাত দিয়ে বলে,
– আকাশ তোরে মা’র’ছে মা?
সন্ধ্যা অসহায় চোখে চেয়ে রইল তার শ্বাশুড়ির দিকে। আসমানী নওয়ান সন্ধ্যাকে জড়িয়ে ধরল। তার ভীষণ খারাপ লাগলো। আকাশ এতো রে’গে গিয়েছে, যে মেয়েটাকে থা’প্প’ড় মে’রে’ছে? পায়ের দিকে নজর পড়লে দেখল পায়ে বেশ বড়সড় একটি ফসকা। যা বোঝার বুঝল। সন্ধ্যাকে ধরে ধরে উঠিয়ে বেডের উপর বসালো। এরপর মলম এনে সন্ধ্যার পায়ে দিতে নিলে সন্ধ্যা তার শ্বাশুড়ি কে বাঁধ সাধে। আসমানী নওয়ান সন্ধ্যার বাঁধ মানলেন না। নিজেই সন্ধ্যার পায়ে মলম লাগিয়ে দিলেন। গতকাল খেয়াল করেনি এটা, নয়তো তখন-ই দিয়ে দিত।
ব্যাগ থেকে একটা শুতি শাড়ি বের করে দিয়ে বলে,
– এই শাড়িটা পইরা নে মা। আকাশের লগে আমার বোঝাপড়া আছে।
একটু থেমে বলে,
– ওয় কি রাইতেই বাইর হইয়া গেছে?
সন্ধ্যা মাথা নেড়ে হ্যাঁসূচক সম্মতি দিলে আসমানী নওয়ান সন্ধ্যার গালে হাত দিয়ে বলে,
– ওয় আজ বাড়ি আসলে খবর আছে ওর। তুই যা মা। শাড়ি পাল্টায় নে।
সন্ধ্যা মাথা নেড়ে বেড থেকে নেমে ধীরে ধীরে ওয়াশরুমের দিকে এগিয়ে যায়। আসমানী নওয়ান দীর্ঘশ্বাস ফেলে।
সৌম্য সন্ধ্যার খোঁজে সেই সকাল সকাল বাড়ি থেকে বেরিয়ে এসেছিল। গ্রামের কতজনকে কে জিজ্ঞেস করেছে, কেউ সন্ধ্যার কথা বলতে পারে না।
কয়েকজন শুধু বলেছে তাদের বাড়ির সামনে একটি বড় কার গাড়ি আসতে যেতে দেখেছিল।
দিন গড়িয়ে বিকেল নেমেছে,, সৌম্য’র শরীরে শক্তি নেই যেন। গতরাত থেকে খাওয়া-দাওয়া নেই। আজ সারাদিন রোদে রোদে ঘুরে শরীরের অবস্থা নাজেহাল। আর মনের অবস্থা? সে তো বেহাল!
একটি মাঠের কোণে পা ছড়িয়ে বসল সৌম্য। ডান হাতে কপালের ঘাম মুছে ছিটকে ফেলল।
আর কোথায় খুঁজবে তার বোনকে? এই পা’ষা’ণ মানুষ দু’টো তার বোনের খোঁজ দিবেনা সৌম্য বেশ জানে। তার বাচ্চাদের মতো কাঁদতে ইচ্ছে করছে,, আকাশের দিকে তাকিয়ে বুঝল তার চোখজোড়া ঝাপসা। বাড়ি আসলে সন্ধ্যা যেখানেই থাকুক, দৌড়ে এসে ভাইকে জড়িয়ে ধরত। সৌম্য সন্ধ্যার গাল টেনে দিত। সন্ধ্যা খাবার এনে সৌম্য’র সামনে দিয়ে ভাইয়ের সামনে বসে থাকতো। খাওয়া শেষ না হওয়া পর্যন্ত সন্ধ্যা উঠতো না ভাইয়ের পাশ থেকে। সৌম্য শহরে চলে আসলে সন্ধ্যা নিরবে অশ্রু বিসর্জন দিত। সৌম্য তার বোনকে জড়িয়ে নিয়ে বলত,
– আর কয়েকমাস বোনু। এরপর আমি তোকে আমার কাছে নিয়ে যাবো।
সৌম্য’র দিন খুব ক’ষ্টে কাটে। তার তো চাঁদ কপাল নয়, লাস্ট কবে বাড়ি থেকে দু টাকা নিয়েছে তার মনে পড়ে না। টিউশন করে করে ঢাকা শহরে নিজের খরচ চালায়। আর একটু একটু করে টাকা জমাতো সন্ধ্যার জন্য। এই নরক থেকে তার বোনকে নিয়ে যাবে বলে কত ক’ষ্ট করেছে! কখনো তো তিনবেলা খায় না,, এই যে কাপড়-ও ঠিকঠাক কেনা হয় না। কত পুরনো পুরনো কাপড় ব্যবহার করে!
আর দু’মাসের মাথায় সে সন্ধ্যাকে নিয়ে যেত ঢাকায়।
সন্ধ্যা ক্লাস টেন পর্যন্ত পড়েছে। এরপর আর পড়েনি,, এটুকুই সৌম্য খুব জোর করে পড়িয়েছ। তার বাবা আর সৎ মা পড়তে দেয়নি৷ সে জানে তার বোনকে দিয়ে এই বাড়ির সব কাজ করিয়ে নিত। সৌম্য তার বোনকে সুখবর দিতে এসেছিল, সে খুব তাড়াতাড়ি তার বোনুকে তার কাছে নিয়ে যাবে। কিন্তু কি থেকে কি হয়ে গেল! সন্ধ্যার মায়া মায়া মুখটা ভেসে ওঠে। যে তার ভাইকে হয়তো নিরবে কতশত অভিযোগ দিত! সৌম্য বোনকে জড়িয়ে নিয়ে নিরবে সান্ত্বনা দিত। কোথায় হারিয়ে গেল তার বোনু?
ঝাপসা দৃষ্টিজোড়া আকাশপানে নিবদ্ধ রেখে বিড়বিড় করে,
– মা! আমার বোনু হারিয়ে গেছে মা। তোমার মেয়ে সন্ধ্যা কে আমি আগলে রাখতে পারলাম না। তুমি কেন চলে গেলে মা আমাদের রেখে? আমার বোনুর জন্য খুব ক’ষ্ট হচ্ছে। ওরা কোথায় রেখেছে আমার বোনুকে? ও ঠিক আছে তো মা?
সন্ধ্যার পর পর আকাশ বাড়ি ফিরে তার ঘরের দিকে যেতে নিলে আসমানী নওয়ান শক্ত গলায় বলেন,
– দাঁড়াও আকাশ। কোথায় আছিলা কাল থেইকা?
মায়ের কথায় আকাশের পা থেমে যায়। আসমানী নওয়ান মূলত গ্রামের মেয়ে৷ সাইফুদ্দীন নওয়ান আসমানী নওয়ানকে দেখে পছন্দ করেছিল, এরপর বিয়ে করে আনে। ভদ্রমহিলা গ্রাম্য ভাষায় কথা বলতে অভ্যস্ত ছিলেন, যে অভ্যাস বিয়ের পর শহরে এসেও ছাড়তে পারেননি। আকাশকে চুপ থাকতে দেখে আকাশের মা আবারও শক্ত গলায় বলে,
– কি হইলো? কথা কইতাছ না ক্যান?
আকাশ সাধারণত মায়ের বেশ বাধ্য সন্তান বলা যায়। মায়ের উপর কথা বলে না। ভ’য় পায় এমন নয়। সম্মান, ভালোবাসার জায়গা থেকে সে তার মায়ের সাথে কখনো উঁচু গলায় কথা বলেনা। তবে মায়ের কাজে ভীষণ রা’গ উঠছে। অতঃপর রাগান্বিত স্বরে বলে,
– মা তুমি কি করে পারলে আমার সাথে এরকম একটা কাজ করতে?
আসমানী নওয়ান ছেলের ব্যবহারে একটু ক’ষ্ট পেয়েছেন। আকাশ তার সাথে এভাবে কথা বলেনা, এজন্য বেশি খারাপ লাগছে।
আকাশ কথাটা বলে আকাশ চোখ বুজল। সে রা’গতে চায় না। অন্তত তার মাকে রা’গ দেখাতে চায় না। কিন্তু তার মা এমন একটা কাজ করেছে, সে চাইলেও শান্ত থাকতে পারছে না। ফোঁস করে শ্বাস ফেলে গলার স্বর কিছুটা নামিয়ে বলে,
– এভাবে তুমি আমার বিয়ে দিয়ে কাজটা কি ঠিক করেছ মা? আমি তোমার সম্মান বাঁচাতে বিয়েটা করেছি। এবার তুমি আমার সম্মান বাঁচাতে মেয়েটির আর আমার ডিভোর্স এর ব্যবস্থা কর মা।
আসমানী নওয়ান ছেলের পানে বিস্ময় দৃষ্টিতে তাকায়। অবাক হয়ে বলে,
– তুমি ডিভোর্স চাইতাছ ক্যান আকাশ?
আকাশ এবারেও রে’গে বলে,
– কারণ আমি রাহাত আঙ্কেলের মেয়েকে বিয়ে করব। আমাদের ডিল ফাইনাল করা শেষ। আর এক সপ্তাহ পর আমাদের বিয়ে হতো। গতকাল তোমাকে বলতে চেয়েছিলাম, কিন্তু তুমি আমার কোনো কথাই শুনলে না!
আসমানী নওয়ান বিস্ময় কণ্ঠে বলেন,
– তুমি কইছিলা, তোমার পছন্দের কেউ নাই। তাই আমি আমার পছন্দ মতোন একটা বউ আনছি তোমার লাইগা। তুমি এমন করতাছ ক্যান বাবা?
আকাশ চোখ বুজে মাথা দু’দিকে নাড়ালো কয়েকবার। এতো রা’গ লাগছে তার। ইচ্ছে করছে সবকিছু উলটপালট করে দিতে। শুধু তার সামনে মা বলে নিজেকে সামলে নিচ্ছে বারবার।
চোখ খুলে তার মায়ের উদ্দেশ্যে চিৎকার করে কিছু শক্ত বাণী ছুঁড়ে দেয়,
– করতাম না পছন্দ। এখন করি। হয়েছে? তুমি সবসময় উল্টাপাল্টা কাজ কর,, আমি আর বাবা সামলে নিই। কিন্তু এইবার একদম লিমিট ক্রস করে ফেলেছ। আমাদের কাজের বারোটা বাজিয়ে দিয়েছ। সবচেয়ে বড় কথা কার না কার বাড়ি গিয়ে একদল লোভী মানুষদের কবলে পড়ে নিজের ছেলেকে বলির পাঠা বানালে।
সাইফুদ্দীন সোফার উপর বসা ছিল। হাতের খবরের কাগজ ভাঁজ করে আকাশের দিকে তাকিয়ে শান্ত গলায় বললেন,
– আকাশ আমার স্ত্রীর সাথে এভাবে কথা বলবে না।
আকাশ দু’হাত মুষ্টিবদ্ধ করে চোখ বুজল। সে না চাইতেও হাইপার হয়ে যাচ্ছে।
আসমানী নওয়ান ছলছল দৃষ্টিতে ছেলের পানে তাকিয়ে রইল। এরপর স্বামীর পানে চেয়ে বলে,
– আকাশের আব্বা তোমার ছেলে এইসব কি কইতাছে?
সাইফুদ্দীন নওয়ান এগিয়ে এসে তার স্ত্রীর পাশে দাঁড়ালেন। বউকে ভীষণ ভালোবাসেন ভদ্রলোক। কখনো ধমক দেয় না। এই যে এখন তার স্ত্রী উল্টাপাল্টা কাজ করেছে, সে মনে মনে রে’গেছে৷ তবে তা তার স্ত্রীর উপর ফলাচ্ছে না। বরং ছেলেকে চুপ করিয়ে দিলেন। স্ত্রীর উদ্দেশ্যে মৃদুস্বরে বললেন,
– আকাশ যা বলেছে ঠিক-ই বলেছে। তুমি শান্ত হও। তোমার পক্ষ থেকে আমি ওদের ডিভোর্সের ব্যবস্থা করব।
সন্ধ্যা রান্নাঘরের দরজার কোণায় দাঁড়িয়ে আছে। রাগান্বিত আকাশের পানে মায়া মায়া চেখে চেয়ে রইল। লোকটিকে সে বিয়ের আগে দেখেনি। তবে স্বামীকে নিয়ে একটুখানি স্বপ্ন দেখেছিল!
লোকটি কি সুন্দর! সে তো অতো সুন্দর না। আবার কত খুঁত তার! এমন মেয়ের কপালে দুঃখ-ই মানায়!
চোখের পাতা ভেদ করে নোনা জল গড়িয়ে পড়ে। গতকাল বিয়ের পর পর এক মুহূর্তের জন্য সন্ধ্যা ভেবেছিল, সে ওই সৎ মায়ের নরক থেকে বেরিয়ে একটু সুখের দেখা পাবে। কিন্তু তার কপাল এতো ভালো নয়, এটা তো সন্ধ্যার আগেই বোঝা উচিৎ ছিল!
মায়ের কথা মনে পড়ল। কতদিন হলো মাকে দেখেনা। মায়ের আদর কতদিন হলো পায় না! ভাইয়ের কথা মনে পড়লো। সৌম্য ভাইয়া যে তাকে তার কাছে নিয়ে যেতে চেয়েছিল! তাকে নিয়ে যাবে না? এখানে কি আসবেনা? সৌম্য ভাইয়া তো জানে না তার বিয়ের কথা। এখানে কি আসবে তার ভাইয়া? সন্ধ্যার চোখ থেকে টপটপ করে পানি গড়িয়ে পড়ে। খুব করে ভাইকে ডাকছে। আপন বলতে তার একটা ভালোবাসার ভাই ছাড়া আর কেউ নেই তার।
আসমানী নওয়ান তার স্বামীর কথায় দ্বিগুণ অবাক হলেন। কি করবেন, কি বলবেন বুঝে পায় না। আকাশের দিকে তাকিয়ে রে’গে বলে,
– তুমি ওরে মা’র’ছি’লা ক্যান?
আকাশ বিরক্ত হয়। সে ভেবেছিল, যা হওয়ার হয়েছে। মেয়েটির সাথে ঠাণ্ডা মাথায় কথা বলে সব মিটমাট করবে। কিন্তু সে ওই মেয়ের মুখ থেকে একটা শব্দ বের করাতে পারেনি। তার মায়ের উদ্দেশ্যে দাঁতে দাঁত চেপে বলে,
– এরকম বে’য়া’দ’ব মেয়ে কোথা থেকে তুলে এনেছ? একে তো লোভী সাথে আদবের ছিঁটেফোঁটা নেই ওর মাঝে।
কথাটা শেষ করতে না করতেই আসমানী নওয়ান এগিয়ে গিয়ে আকাশের গালে গায়ের জোরে একটা থা’প্প’ড় মে’রে দেয়। আকাশের মুখ বামদিকে হেলে যায়। সাইফুদ্দীন নওয়ান অবাক হয়ে ডাকে,
– আসমানী?
আকাশ চোখ দু’টো বুজে দু’হাত মুষ্টিবদ্ধ করে নিয়েছে। রা’গে মাথা থেকে পা পর্যন্ত জ্বলছে।
চোখ খুলে সামনে তাকালে সন্ধ্যাকে চোখে পড়ল। যে রান্নাঘরের কোণায় দাঁড়ানো। চোখে চোখ পড়লে সন্ধ্যা তার ভেজা চোখজোড়া মেঝেতে নামিয়ে নেয়।
আকাশ শক্ত চোখে তাকায় সন্ধ্যার দিকে। ওই মেয়েটার জন্য সে আজ জীবনের প্রথম মায়ের হাতে থা’প্প’ড় খেয়েছে। ইচ্ছে করছে এই একটা থা’প্প’ড় এর বদলে এই মেয়েকে যাস্ট খু’ন করে ফেলতে। মাকে তো কিছু বলল না। রে’গে’মে’গে তার আশেপাশে যতগুলো ফুলদানি ছিল সবগুলো গায়ের জোরে ছুঁড়ে ফেলে। চিৎকার করে বলে,
– বাবা তোমার স্ত্রী কাজটা একদম ঠিক করেনি। একটা বাইরের বে’য়া’দ’ব মেয়ের জন্য আমাকে আ’ঘা’ত করেছে।
কথাটা বলে আকাশ হনহন করে বাইরে বেরিয়ে যেতে নিলে আসমানী নওয়ান ভেজা চোখে চেয়ে শক্ত কণ্ঠে বলে,
– বে’য়া’দ’ব ওয় নয়। বে’য়া’দ’ব তুমি। একটা অচেনা মেয়েরে মা’র’তে তোমার হাত কাঁপলো না?
আকাশ পিছু ফিরে রে’গে বলে,
– না কাঁপেনি। আরও কয়েক’শ টা থা’প্প’ড় দিতে পারছি না বলে আফসোস হচ্ছে। একটা কথার-ও উত্তর দেয় না। তুমি তাকে রেখে আমায় বে’য়া’দ’ব বলছো?
কথা টুকু বলে আকাশ আবারও পায়ের গতি বাড়ায় বাড়ি থেকে বেরিয়ে যাওয়ার জন্য। আসমানী নওয়ান ঢোক গিলে বলে,
– ওয় তোমাগো মতো কইরা কেমনে কথা কইবো? ওয় তো বোবা।
