অন্তঃদহন পর্ব ১৮

অন্তঃদহন পর্ব ১৮
DRM Shohag

সৌম্য সন্ধ্যাকে নিয়ে বাসস্ট্যান্ডে এসেছে। কাউন্টারে গিয়ে সিলেট মৌলভীবাজারের দু’টো টিকিট কাটে। রাত দু’টোয় গাড়ি আছে একটা৷ সন্ধ্যার দুর্বল শরীর সৌম্য বা হাতে আগলে রেখেছে। কাউন্টারের লোক দু’টো টিকিট সৌম্য’র দিকে বাড়িয়ে দিলে সৌম্য টিকিট নিয়ে পকেটে রাখে। এরপর ডান হাতে ব্যাগ আর বা হাতে সন্ধ্যাকে আগলে নিয়ে একটি বসার জায়গায় গিয়ে বসে৷ আশেপাশে তাকিয়ে দেখল, কিছুটা দূরে একটি দোকান খোলা। সৌম্য সন্ধ্যার গালে হাত দিয়ে বলে,

– কি খাবি বোনু?
সন্ধ্যা মলিন মুখে ভাইয়ের দিকে চেয়ে বোঝায়, কিছু খাবেনা সে৷ সৌম্য শুনলো না৷ বলল,
– তুই একটু বোস। আমি ওই দোকান থেকে শুকনো কিছু কিনে আনছি।
কথাটি বলে সৌম্য উঠে দাঁড়ায়। দু’পা এগোলে সন্ধ্যা দ্রুত দাঁড়িয়ে সৌম্য’র ডান হাত তার দু’হাতে জড়িয়ে ধরে। সৌম্য তাকায় তার বোনের দিকে। মৃদুস্বরে বলে,
– কি হয়েছে বোনু?

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

সন্ধ্যা ঝাপসা চোখে তাকায় ভাইয়ের দিকে। এরপর আশেপাশে তাকায়। সৌম্য হয়তো বুঝতে পারল সন্ধ্যার ভ’য় পাওয়ার কারণ। নিজেকে ভীষণ অসহায় লাগলো, সে তার বোনকে সেই প’শুগুলোর হাত থেকে বাঁচাতে পারেনি, আর এ কারণে তার বোন ভ’য় পাচ্ছে। তার কি হয়েছে কে জানে! বোনের অসহায়ত্বে আজ শুধু তার চোখের কোণে পানি জমছে। সৌম্য ডান হাতে সন্ধ্যাকে নিজের সাথে আগলে নিয়ে ভারী গলায় বলে,

– আমি আছি বোনু।
এরপর বা হাতে দু’চোখ ডলে সন্ধ্যাকে নিয়ে সামনের দোকানে যায়। তিনটে রুটি, তিনটে কলা কিনল। তার কাছে বেশি টাকা-ও নেই। চাইলে-ও অনেককিছু কিনতে পারলো না সৌম্য। আর একটি পানির বোতল কিনে। এরপর সন্ধ্যাকে নিয়ে আগের জায়গায় এসে বসে।
রুটির প্যাকেট ছিঁড়ে, একটি কলা ছিলে সন্ধ্যার মুখের সামনে ধরে। মৃদুস্বরে বলে,
– খেয়ে নে বোনু। নয়তো শরীর খারাপ করবে।

সন্ধ্যার যে কিচ্ছু ভালো লাগছে না। তার শুধু কাঁদতে ইচ্ছে করছে, ম’রে যেতে ইচ্ছে করছে। তার এখনো মনে হচ্ছে ওই লোকটা তাকে কত বাজেভাবে ছুঁয়েছে। সে শব্দ করে কেন কাঁদতে পারেনা? এর জন্য সন্ধ্যার দমবন্ধ লাগছে। না চাইতে-ও দু’চোখ বেয়ে টুপটুপ করে পানি গড়িয়ে পড়ে। সৌম্য বুঝতে পারলো তার বোনের অবস্থা। কি করবে সে? তার বোন নাহয় শব্দ করে কাঁদতে পারে না। সে তো পারে। কিন্তু তার কি বাচ্চাদের মতো কাঁদলে চলে? সৌম্য নিজেকে সামলালো। হাতের রুটি, কলা রেখে মাটিতে হাঁটু মুড়ে বসে। এরপর সন্ধ্যার দু’হাত তার দু’হাতে ধরে অপরাধী গলায় বলে,

– আমি আর কখনো তোকে একা রেখে কোথাও যাব না বোনু। প্লিজ নিজেকে একটু শ’ক্ত কর।
সন্ধ্যা নাক টেনে তার ভাইয়ের দিকে তাকালো। সৌম্য জোরপূর্বক একটু হেসে বলে,
– একটা নতুন জায়গায় যাচ্ছি। তোর খুব ভালো লাগবে ওখানে গেলে। একটু হাস বোনু।
সন্ধ্যা দু’হাতে মুখ মুছল। ছিলে রাখা রুটি কলায় একবার কা’ম’ড় বসিয়ে সৌম্য’র মুখের সামনে ধরলে সৌম্য নিঃশব্দে এক কা’ম’ড় নিয়ে চিবোয়। সন্ধ্যা একটু একটু করে খেতে থাকে। তার সত্যি-ই ক্ষুধা লেগেছে। কিন্তু খেতে ইচ্ছে না করলে-ও তার ভাইয়ের জন্য নিজেকে স্বাভাবিক করতে চাইলো।
সৌম্য মাটিতেই বসে থাকলো। কিছুই ভালো লাগছে না তার। উদাস মনে আকাশের দিকে তাকিয়ে রইল। ইদানিং মায়ের কথা খুব মনে পড়ে তার। ইশ! তা মা থাকলে তাদের দুই-ভাইবোনের জীবনটা কতই না সুখের হতো! অথচ আজ যেখানেই যায়, সেখানেই তাদের জন্য শুধু দুঃখ অপেক্ষা করে।

হেমন্তকালের শেষের দিকে। আবহাওয়া কিছুটা ঠাণ্ডা। সৌম্য তার বোনের দিকে তাকালো। সন্ধ্যা আঁটসাঁট হয়ে বসে একটু একটু করে রুটি খাচ্ছে। সৌম্য তার ব্যাগ থেকে একটি পাতলা চাদর বের করে সন্ধ্যার গায়ে জড়িয়ে দেয়। সন্ধ্যা তার ভাইয়ের দিকে তাকালো। সৌম্য কিছু বলল না। একটি রুটি, কলা নিয়ে কিছুটা দূরে বসে থাকা কু’কু’রের সামনে ছুঁড়ে ফেলে। কু’কু’রটি একপ্রকার হামলে পড়ে খাবারগুলোর উপর। এতো মন খারাপের মাঝে-ও সন্ধ্যা সৌম্য’র কাজে একটু হাসলো। যদি-ও সন্ধ্যা সৌম্য’র সাথে সেভাবে বাইরে যায়নি। তবে গ্রামের এখানে-ওখানে যেত। তখন সৌম্য প্রায়-ই কু’কু’রদের দেখলে খাবার দিত। তার মনে হয়, সৌম্য’র কু’কু’রদের সাথে আলাদা একটা সম্পর্ক আছে।
সৌম্য সন্ধ্যার পাশে বসে তার জন্য রাখা রুটির প্যাকেট ছিঁড়তে ছিঁড়তে একটু হেসে বলে,

– জানিস বোনু? পৃথিবীতে সব বোনদের হাসলে পেত্নীর মতো লাগে।
সন্ধ্যা কথাটা শুনতেই সৌম্য’র বাহুতে একটা চাপড় মারে। সৌম্য ইনোসেন্ট ফেস বানিয়ে বলে,
– আরে সত্যি! এটা প্রমাণিত!
সন্ধ্যা মুখ ভেঙিয়ে অন্যদিকে তাকিয়ে রুটিতে কা’ম’ড় দেয়। সৌম্য মৃদু হাসলো। সময় ন’ষ্ট না করে রুটি, কলা খেয়ে নেয়। এরপর পানি খেয়ে নেয়। ঘড়ি দেখতে পারলো না। তার ঘড়ি নেই, ফোনের চার্জ শেষ হয়ে ফোন বন্ধ। সন্ধ্যাকে ঢুলতে দেখে ডান হাতে সন্ধ্যাকে টেনে তার কাঁধে সন্ধ্যার মাথা রাখলো। মৃদুস্বরে বলে,
– খারাপ লাগলে ঘুমা বোনু।
সন্ধ্যা চোখ বুজল। শরীরটা ভীষণ ক্লান্ত লাগছে। সৌম্য দীর্ঘশ্বাস ফেলে। বেশ কিছুক্ষণ পর একজন বয়স্ক লোক সৌম্য’র সামনে দাঁড়িয়ে বলে,

– এটা তোমার কে বাবা?
সৌম্য বয়স্ক লোকটির দিকে তাকায়। হাতে একটি ব্যাগ। হয়তো যাত্রী। অতঃপর বলে,
– আমার বোন।
বয়স্ক লোকটি মৃদু হেসে বলে,
– তুমি রুটি কিনতে গেলে, তখন-ই তোমার মুখে বোনু ডাক শুনেছি। এরকম ভাই-বোন দেখা যায় না। আমার নাতনির দু’টো ছেলে মেয়ে আছে, তারা তো সারাদিন মা’রা’মা’রি করে।
বয়স্ক লোকটির কথায় সৌম্য মৃদু হাসলো। এসব মা’রা’মা’রি তো ভাইবোনের খুনসুটি। তার আর তার বোনের খুনসুটি করার সময় হয় কখন? তাদের তো দুঃখ-ই শেষ হয় না। তারা লাস্ট কবে টানা এক সপ্তাহ একসাথে থেকেছে, তাও মনে পড়ে না। যেটুকু সময় কাছে পায়, তার এই কলিজার বোনকে শুধু আদরেই রাখে সে। বয়স্ক লোকটি সৌম্য’কে চুপ দেখে বলে,

– মৌলভীবাজার যাচ্ছো?
সৌম্য ছোট করে বলে,
– জ্বি।
– আমি-ও যাচ্ছি ওখানে। আমার নাতনির ছেলে মেয়েদের দেখতেই যাচ্ছি।
সৌম্য ‘ওহ’ বলে চুপ থাকলো। লোকটি তার জায়গায় গিয়ে বসে। সৌম্য ঘাড় বাঁকিয়ে একবার তাকায়, তার কেন যেন মনে হলো, লোকটি নিজ জীবনসঙ্গী কে হারিয়ে একাকিত্ব অনুভব করেন। এজন্য-ই তাদের সাথে যেচে কথা বলতে এসেছিল।
মিনিট দুই পরেই কাউন্টারে এসে বাস থামে। সৌম্য সন্ধ্যাকে মৃদুস্বরে ডাকে,
– বোনু? বোনু?

সন্ধ্যা ধীরে ধীরে চোখ খুললে সৌম্য সন্ধ্যার হাত ধরে বাসে উঠে। সন্ধ্যাকে আগে আগে হাঁটতে দিয়ে, সৌম্য সন্ধ্যার পিছু পিছু হাঁটে বাসের মধ্যে। বাসের মাঝামাঝি জায়গায় তাদের সিট পেয়ে সৌম্য সন্ধ্যাকে জানালার পাশের সিটে বসতে বলে, হাতের ব্যাগ উপরের তাকের উপর রাখে। এরপর সন্ধ্যার পাশে বসে। আরও কিছু যাত্রী বাসে উঠে পড়লে কয়েক সেকেন্ড পর বাস ছেড়ে দেয়। ধীরে ধীরে বাস চলতে থাকে। সন্ধ্যা মলিন মুখে জানালা দিয়ে রাতের আঁধারে ঘেরা ঢাকাশহর দেখতে থাকে। সৌম্য’র বলা কথা মনে পড়ে, এখানে আর তারা কখনো আসবে না। কখনো এখানে এসেছিল, এটা-ও ভুলে যাবে। সত্যি-ই আর আসা হবে না। আকাশ-ও তাকে ভুলে যাবে। কথাগুলো ভাবতেই সন্ধ্যার চোখজোড়া ঝাপসা হয়।
সৌম্য সন্ধ্যার মাথা বুকে রেখে মৃদুস্বরে বলে,
– ঘুমা বোনু। আমি কথা দিচ্ছি এই শহরে তোকে আর কখনো আসতে হবে না।

ভোরের আজানের পর পর সৌম্য, সন্ধ্যা বাস থেকে মৌলভীবাজার নেমে পড়ে। একটি সিএনজি ঠিক করলে পিছন থেকে তখনকার বয়স্ক লোকটি সৌম্য’কে ডেকে বলে,
– তোমরা কোথায় যাবে?
সৌম্য জবাব দেয়,
– ভানুগাছ গ্রামে।
ভদ্রলোক মৃদু হেসে বলে,
– তাহলে চলো একসাথে যাওয়া যাক।

সৌম্য না করল না। লোকটিকে তার মিশুক লেগেছে। বয়স মোটামুটি অনেক। এতোটা পথ একা একা এসেছে। এনার সঙ্গ দেয়াই যায়। অতঃপর সন্ধ্যা আগে সিএনজিতে উঠে বসে, এরপর সৌম্য বসে, আর তারপর বয়স্ক লোকটি।
প্রায় ২ ঘণ্টা পথ পাড়ি দিয়ে সৌম্য’রা ভানুগাছ গ্রামে এসে পৌঁছায়। এরপর সিএনজিওয়ালাকে সম্পূর্ণ ভাড়া দিলে, বয়স্ক লোকটি সৌম্য’কে সব টাকা দিতে নিষেধ করে। কিন্তু সৌম্য শোনেনা। পুরো ভাড়া সে দিয়ে দেয়।
লোকটিকে দাদুর মতো বয়স লাগে। আসার পথে অনেক কথা-ও বলেছে। সৌম্য’র ভালো লাগলো না, এনার থেকে টাকা নিতে। তার নানি, দাদি বেঁচে থাকলে হয়তো আজ এমন-ই একজন কেউ তার সাথে গল্প করতো। ইনি যেমন তাকে দাদুভাই বলে ডেকেছে, তারা-ও হয়তো তাকে আর সন্ধ্যাকে আদর করে এরকম কোনো এক নামে ডাকতো। কথাটা ভাবতেই সৌম্য মনে মনে বিদ্রুপ হাসে। যার মা-ই বেঁচে নেই, তার নানা, দাদা বেঁচে থাকা বিলাসিতা। তাছাড়া বাবা যা মানুষ, কি জানি দাদা থাকলে হয়তো সেই গ্রামে-ও পা রাখতে দিত না। কথাগুলো ভেবে দীর্ঘশ্বাস ফেলে। সন্ধ্যার হাত ধরে এগিয়ে যায় বাড়ির দিকে।

ভোরের আলো ফুটতে শুরু করেছে। বয়স্ক লোকটি সৌম্য’দের পিছু পিছু যায়। হঠাৎ-ই ডাকে,
– এই যে দিদিভাই, তুমি তো আমার সাথে একটা কথা-ও বললে না!
লোকটির কথায় সন্ধ্যা, সৌম্য দু’জনেই পিছু ফিরে তাকায়। সন্ধ্যা ঢোক গিলে তার ভাইয়ের দিকে তাকায়। সে তো কথা বলতে পারেনা। লোকটি এগিয়ে এসে সন্ধ্যার উদ্দেশ্যে মৃদু হেসে বলে,
– তোমার নাম কি দিদিভাই?
সন্ধ্যা মায়া মায়া চোখে তাকায়। ডাকটি সন্ধ্যার কাছে যেমন নতুন লাগলো, তেমনি ভালো লাগলো।
পাশ থেকে সৌম্য বলে,
– দাদু ওর নাম সন্ধ্যা আর আমার নাম সৌম্য।
লোকটি হেসে বলে,
– দু’জনের নাম-ই খুব মিষ্টি।
সন্ধ্যা জোরপূর্বক একটু হাসলো। এরপর আবার-ও তারা সামনে এগিয়ে যায়। লোকটি সৌম্য’রা যে বাড়ি যাবে, তার তিনটে বাড়ি আগেই থেমে যায়। কাঙ্ক্ষিত জায়গায় পৌঁছেছে। সৌম্য, সন্ধ্যাকে বিদায় দিতে ভোলেনি। সৌম্য’রা-ও একটুখানি হাসে। ভদ্রলোক থাকায় তাদের দু’জনের মনটা একটু একটু ভালো হয়েছে।

আকাশ, বায়ানকে নিয়ে একটি সভায় এসেছে। যেখানে অনেক গণ্যমান্যব্যক্তি আছেন। আছেন অনেক সিনিয়র নেতা, যারা বক্তব্য দিচ্ছে। আকাশের সম্পূর্ণ মনোযোগ সেদিকে। যখন সভা মোটামুটি শেষের দিকে, তখন আকাশের সাথে একে একে সকলে কুশলাদি করে। আকাশের বাবার সাথে-ও করে। ভদ্রলোকের এনাদের সাথে ভালো সম্পর্ক থাকায় আকাশের পথ আরও বেশি ক্লিয়ার। এখানের মোটামুটি কাজ শেষে আকাশ বানায়কে নিয়ে এখান থেকে বেরিয়ে ফাঁকা জায়গায় যায়।
কোথা থেকে নিয়াজ আকাশের সামনে এসে দাঁড়িয়ে বলে,
– তুমি ব্যবসা রেখে এসবে জড়াতে চাইছ কেন?
আকাশ নিয়াজকে দেখে ভ্রু কুঁচকে তাকায়। প্যান্টের পকেটের কাছে সাদা পাঞ্জাবি একটু উঁচু করে দু’হাত প্যান্টের পকেটে রেখে দাঁড়ায়। এরপর গম্ভীর গলায় বলে,

– আমার ইচ্ছা হলো, তাই। কেন?
নিয়াজ বিরক্ত হয়ে বলে,
– তুমি বছর কয়েক আগে এদিকে আসতে গিয়ে-ও আসোনি। সেসব তোমার ব্যক্তিগত ব্যাপার। কিন্তু এখন তুমি এদিকে এসো না।
আকাশ ভ্রু কুঁচকে বলে,
– রাজনীতি জিনিস টা বোধয় খুব লোভনীয় তাইনা? এতোবছর মাঠ ছেড়ে তোমাকে খেলতে দিলাম। এখন তোমার উচিৎ সসম্মানে আমাকে সভাপতির দায়িত্ব তুলে দেয়া। কিন্তু তুমি আমাকে নিষেধ করছ। এতো লোভী হলে তো পারা যায় না!
নিয়াজ রে’গে বলে,

– আমি লোভী না।
– তাহলে কি দু’র্নী’তি’বা’জ?
নিয়াজ রে’গে আকাশের পাঞ্জাবির কলার ধরে বলে,
– মুখ সামলে কথা বলবে।
আকাশ শ’ক্ত চোখে তাকায় নিয়াজের দিকে। দু’হাত পকেট থেকে বের করে তার কলার থেকে নিয়াজের দু’হাত ঝাড়া দিয়ে নামিয়ে দেয়। এরপর রাগান্বিত স্বরে বলে,
– যে কেউ আমাকে টাচ করবে, এসব আমার পছন্দ না, বোঝাতে পেরেছি?
নিয়াজের মুখাবয়বের পরিবর্তন নেই। আকাশ দু’হাত তুলে নিয়াজের শার্টের দু’টো খুলে রাখা বোতাম লাগিয়ে দিতে দিতে গম্ভীর গলায় বলে,

– স্মার্ট সেজে লাভ নেই। যেখানে আমি আছি, সেখানে তোমাকে কেউ গুণবে না।
আকাশ নিয়াজের বোতাম দু’টো লাগিয়ে দিয়ে তার পাশে দাঁড়ানো বায়ানের উদ্দেশ্যে বলে,
– বায়ান আমি ঠিক বললাম তো?
বায়ান একবার নিয়াজের দিকে তাকায়, আরেকবার আকাশের দিকে। তার কাছে তো দু’জনকে আহামরি আলদা লাগেনা। তবে নিয়াজের দাঁড়ি খুঁজেই পাওয়া যায় না। আর আকাশের দাঁড়ি চাপ দাঁড়ির চেয়েও বড়। বায়ান আমতা আমতা করে বলে,
– মেয়েরা দাঁড়িওয়ালা ছেলেদের পছন্দ করে।
নিয়াজের পাশে দাঁড়ানো নিয়াজের পিএ রিমন বলে,
– ঠিক বলেছ।
নিয়াজ রিমনের দিকে রে’গে তাকালে রিমন মাথা নিচু করে বলে,

– স্যরি স্যার!
আকাশ ডান হাত দাঁড়িতে বুলায়, সাথে হাসে। এরপর গলা ঝেড়ে বলে,
– আপাতত রেস্ট কর। অনেকদিন তো দুর্নীতি করে কাটালে।
নিয়াজ রে’গে বলে,
– এখন কি তুমি দুর্নীতি করার জন্য মাঠে নামছ?
আকাশ নিয়াজের দিকে একটু এগিয়ে গিয়ে দৃঢ় কণ্ঠে বলে,
– সেই কৈফিয়ত আমি তোমাকে দিব, এটা তুমি কিভাবে ভাবো মিস্টার নিয়াজ? যাও গিয়ে এপ্রন পরে মানুষের সেবা কর।
নিয়াজ উত্তর করে,

– কাজটা তুমি ঠিক করছ না। আর আমি মাঠ ছেড়ে যাওয়ার মত এতো দয়ালু না।
আকাশ শব্দ করে হেসে ফেলল। মুহূর্তেই চোখমুখ শক্ত করে বলে,
– আমাকে তোমার কোন অ্যাঙ্গেল থেকে দয়ালু মনে হচ্ছে?
নিয়াজ বিরক্তিতে কপাল কুঁচকে নেয়। অতঃপর বলে,
– শুনলাম তুমি না-কি বিয়ে করেছ। বউয়ের চিন্তা কর একটু।
আকাশের সন্ধ্যার কথা মনে পড়ল। মুহূর্তেই চোখেমুখ বিষন্নতায় ছেঁয়ে যায়। তবে খুব দ্রুত নিজেকে সামলে ভ্রু কুঁচকে বলে,

– তুমি আমার বউকে চিনো?
নিয়াজ বলে,
– চিনি না। তবে চিনে নিব।
আকাশ গম্ভীর গলায় বলে,
– নিজের সীমার মধ্যে থাকো নিয়াজ। তাছাড়া তুমি তো ভদ্র ছেলে। আবার বউকে দিয়ে তোমার কাজ নেই।
নিয়াজ একটু হেসে বলে,
– আমি ভদ্র হলেও আমার চারপাশে অ’ভদ্র লোকের অভাব নেই। তোমার বউয়ের…..
কথাটা শেষ করার আগেই আকাশ নিয়াজের নাক বরাবর একটা ঘুষি মে’রে দেয়। নিয়াজ তেড়ে যেতে নিলে রিমন নিয়াজকে সাপ্টে ধরে। আকাশ রাগান্বিত স্বরে বলে,
– তুই কি আমার হাতে ম’র’তে চাইছিস?
বায়ান আকাশকে বলে,

– স্যার এখানে ঝামেলা করলে আপনি হে’রে যাবেন।
আকাশ রে’গে বলে,
– গেলে যাব। আমি তো এর জান নিয়ে নিব। আমার বউকে নিয়ে বাজে কথা বলার সাহস কোথায় পায় ও?
বায়ান বলে,
– কিন্তু আপনি তো আপনার বউকে ডি….
আকাশের শক্ত দৃষ্টি দেখে বায়ান চুপ হয়ে যায়।
নিয়াজ ঝামেলা এড়াতে দাঁড়িয়ে আছে। তবে চোখেমুখে রা’গ। বায়ানের অর্ধেক কথায় ভ্রু কুঁচকে চেয়ে আছে। আকাশ নিয়াজের পাশ কাটিয়ে যাওয়ার সময় দাঁড়ায়। অতঃপর নিয়াজের দিকে তাকিয়ে কঠোর স্বরে উচ্চারণ করে,
– স্কা’ম’ব্যা’গ!

এরপর হনহন করে তার গাড়ির দিকে এগিয়ে যায়। বায়ান-ও পিছুপিছু যায়।
নিয়াজ বিস্ময় চোখে তাকায়। গা’লি’টা ঠিক তার হজম হচ্ছেনা। চরম লেভেলের মে’জা’জ খারাপ হয়। কিন্তু এবারেও ঝামেলা করল না। কারণ ঝামেলা করলে সে সভাপতির আসন থেকে একধাপ পিছিয়ে যাবে।
রিমন নিয়াজকে বলে,
– স্যার স্কা’ম’ব্যা’গ মানে কি?
নিয়াজ রে’গে বলে, – মূর্খ!
রিমন ভ্রু কুঁচকে বলে, – মূর্খ’র ইংলিশ এটা নয় স্যার।
নিয়াজ বিরক্ত চোখে তাকায়। রিমন মেকি হেসে টপিক এড়িয়ে বলে,

– স্যার আপনি তো অনেক ভালো মানুষ। গতকাল একটি মেয়েকে কত হেল্প করলেন। আজ আরেকজনকে দু’ষ্টু লোকের হাতে তুলে দিতে চাইলেন কেন?
রিমনের কথায় নিয়াজের চোখে সন্ধ্যার কান্নামাখা মায়া ভরা মুখটা ভেসে ওঠে। কেমন অন্যমনস্ক হয় নিয়াজ। রিমন ডাকে, – স্যার?
নিয়াজ নিজেকে সামলে বলে,
– ভ’য় দেখিয়েছি।
রিমন সাথে সাথে বলে,

– কিন্তু আকাশ ভাইয়া তো ভ’য় পায়নি। উল্টে রে’গে আপনাকে মে’রে দিয়ে গেল।
নিয়াজ রিমনের দিকে রে’গে তাকালে রিমন ঢোক গিলে বলে,
– স্যরি স্যার! মুখ ফসকে সত্যি কথা বেরিয়ে গেছে।
নিয়াজ দাঁত কিড়মিড় করে বলে,
– কোনো একদিন তোমার হাত পা ফসকে চাকরিটাও চলে যাবে।
কথাটা বলে সামনে এগিয়ে যায়। রিমন পিছন পিছন আসে আর বলে,
– স্যরি স্যরি! আর কোনো কিছু ফসকেই সত্যি কথা বের হবে না।

সৌম্য সৃজাদের বাড়ি এসে আগে তার ফোন চার্জে দিয়ে ফোন অন করে। তার বিকাশে কিছু টাকা আছে, রিহানের থেকে বাকি টাকা নিয়ে আগে নিয়াজকে দিয়ে দিবে। নয়তো সে শান্তি পাচ্ছেনা। রিহানকে কল করলে সাথে সাথে কল রিসিভ হয়। সৌম্য কিছু বলার আগেই রিহান বিচলিত কণ্ঠে বলে,
– এই সৌম্য তুই কোথায় গিয়েছিস? আর ঘরের এসব কি অবস্থা? মনে হচ্ছে যুদ্ধ হয়েছে এই ঘরে।
সৌম্য দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে,
– যেখানে আছি ভালো আছি। এসব বাদ দে। আমি আর ঢাকা যাচ্ছি না। তুই আমাকে ৫০০০ টাকা দে। আমি কয়েকদিন পর ঘরভাড়াসহ এইটাকা দিয়ে দিব তোকে।
রিহান অবাক হয়ে বলে,,

– তা দিচ্ছি। কিন্তু তুই এভাবে না বলেই চলে গেলি? আবার আসবি না বলছিস। আচ্ছা গিয়েছিস কোথায়?
সৌম্য গম্ভীর গলায় বলে,
– আমাদের ঠিকানা ঢাকা শহরের কেউ জানবে না। তুই-ও না। এই নিয়ে আর প্রশ্ন করিস না।
রিহান বুঝল সৌম্য একবার যখন বলেছে বলবে না, তখন বলবে না। সেধে লাভ নেই। অতঃপর বলে,
– ঘরের এই অবস্থা যে? কোনো প্রবলেম হয়েছিল?
সৌম্য একটু চুপ থেকে বলে,

– আমার আর বোনুর জীবনে দুঃখের শেষ নেই। গতরাতে সেরকম-ই কিছু দুঃখ হেঁটে এসেছিল।
এটুকু বলে থানে। এরপর ঢোক গিলে বলে,
– ইরাবতীর সাথে তোর দেখা হয়েছিল?
রিহান দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে,
– নাহ।
সৌম্য মলিন কণ্ঠে বলে,
– ওর খৌঁজ নিস তো একটু।
– তোকে জানাবো?
সৌম্য শ্বাসরুদ্ধকর কণ্ঠে বলে,
– দরকার নেই। ওর হয়তো বিয়ে হবে খুব দ্রুত।
রিহান অবাক হয়ে বলে,
– আসলেই?

সৌম্য’র গত পরশু রাতের কথা মনে পড়ল। যখন সে তার ইরাবতীর থেকে কথা নিয়েছিল, ইরা যেন বিয়ে করে। ইরাবতী তাকে আর কল দেয়নি। হয়তো বিয়ের প্রস্তুতি নিচ্ছে। এভাবেই একদিন তার ইরাবতী অন্যকারো হয়ে যাবে। আর সৌম্য’র ভান্ডারে ইরাবতীকে না পাওয়ার আক্ষেপ, দুঃখ, ক’ষ্ট, হাহাকার জমা হবে। কথাগুলো ভেবে সৌম্য’র দম আটকে আসলো। চোখ বুজে সময় নিয়ে নিজেকে সামলে নেয়। এরপর বলে,
– এসব বাদ দে। যা বললাম এটা করিস। এখন রাখছি।
কথাটি বলে সৌম্য কল কেটে দেয়।
সন্ধ্যা একটি রুমে এসে ফ্রেশ হয়ে তখন থেকে চুপচাপ বসে আছে। সৌম্য তাকে এই রুমে বসিয়ে কোথায় যেন গেল।

সন্ধ্যার শুধুমাত্র একজন ভদ্রমহিলার সাথে দেখা হয়েছে। যার সাথে সৌম্য পরিচয় করিয়ে দিয়েছে। মামি হয় তার। সৌম্য মাঝে মাঝেই এই মামা মামির গল্প করতো তার কাছে।
কিছুক্ষণ পর দেখল সৌম্য একজন ভদ্রলোক, একটি বাচ্চা আর একজন মেয়েকে সাথে করে এই রুমে আসছে। সন্ধ্যা অপরিচিত সবাইকে দেখে দাঁড়িয়ে যায়। সৃজা, সিজান ঘুমিয়ে ছিল, উঠতে লেট হয়ে গিয়েছে। তাই দেরিতে আসলো। সৃজা দৌড়ে এসে সন্ধ্যাকে জড়িয়ে ধরে বলে,
– কেমন আছো সন্ধ্যা? তোমাকে দেখার অনেক ইচ্ছা ছিল আমার।
সন্ধ্যা জোরপূর্বক একটু হাসে। সৌম্য’র মামা এগিয়ে এসে বলে,
– কেমন আছো সন্ধ্যা মা?

সন্ধ্যা মাথা নেড়ে বোঝায়, সে ভালো আছে। সৌম্য’র দিকে তাকালে সৌম্য এগিয়ে এসে বলে,
– এটা আমার মামা। মনে পড়েছে?
সন্ধ্যা ভদ্রলোকটির দিকে তাকায়৷ সৃজার বাবা সন্ধ্যার মাথায় হাত রেখে বলে,
– সৌম্য’কে কত বলতাম তোমাকে আনতে। সৌম্য নিজেই আসতো না, তোমাকে কি আনবে। এবার থেকে তোমরা এখানেই পার্মানেন্ট হয়ে গেলে। আমি কিন্তু খুব খুশি হয়েছি।
সন্ধ্যা মৃদু হাসলো। সৃজার বাবা বাজারের দিকে যায়। তারা জানতো না সৌম্যরা আসবে। জানলে আগে থেকেই বাজার করে রাখতো। অতঃপর বাইরের যেতে যেতে সৌম্য’র উদ্দেশ্যে বলে,

– তোমরা বিশ্রাম নাও বাবা। আমি আসছি।
সৌম্য ছোট করে বলে, – জ্বি মামা।
সৃজা কোমরে হাত রেখে বলে,
– আর আমি তাদের মেয়ে সৃজা।
এরপর সৌম্য’র দিকে চেয়ে বলে,
– আপনার বোনকে আমার পরিচয় দিলে কি আপনার মুখ ক্ষ’য় হয়ে যেত?
সৌম্য বিরক্ত চোখে তাকায়। সন্ধ্যা একবার সৃজার দিকে তাকায়, আরেকবার সৌম্য’র দিকে। সৌম্য সন্ধ্যার উদ্দেশ্যে বলে,

– বোনু ঘমিয়ে নে একটু।
সৃজার ছোট ভাই সন্ধ্যার সামনে এসে ডান হাতের আঙুল উঁচিয়ে বলে,
– টুমার নাম কি? বুলো?
সন্ধ্যা বাচ্চা ছেলেটির দিকে তাকায়। সৃজা তার ভাইকে কোলে নিয়ে সন্ধ্যার সামনাসামনি দাঁড় করিয়ে বলে,
– এটা তোমার সন্ধ্যা আপু।
বাচ্চাটি বলে,
– তুমি অন্দকাল!
সিজান এর কথায় সন্ধ্যা সৃজা একটু হাসলো। সৌম্য সৃজার দিকে তাকিয়ে বলে,
– এখান থেকে যাও।
সৃজা বিব্রতবোধ করে বলে,
– কেন?
সৌম্য সিজানের দিকে তাকিয়ে বলে,
– তোমার আপুকে নিয়ে যাও সিজান ভাইয়া। আমরা অনেক ক্লান্ত।
সৃজা বিরক্ত হয়ে বাইরে যেতে যেতে বিড়বিড় করে,
– ইচ্ছে করে আমাকে বের করে দিল! সন্ধ্যা না থাকলে আর আসতাম-ই না।
সিজান সৃজার গলা জড়িয়ে ধরে বলে,

– কি বুলচ?
সৃজা রে’গে বলে,
– ঘোড়ার ডিম।
সিজান এক আঙুল গালের ভিতর দিয়ে আওড়ায়, – ঘোলাল ডিম।
সৃজা বেরিয়ে গেলে সন্ধ্যা সৌম্য’র সামনে গিয়ে ইশারায় বলে,
– তুমি আপুটাকে এভাবে যেতে বললে কেন?
সৌম্য মৃদুস্বরে বলে,
– এমনি। বেশি কথা বলে। তুই একটু ঘুমিয়ে নে বোনু।
সন্ধ্যা সৌম্য’র পরনের শার্টের দিকে তাকালো। গতকাল রাতে ওই ডক্টর তার ভাইকে বলেছিল, ২৪ ঘণ্টা রেস্ট নিতে হবে। সেখানে সৌম্য কয়েক ঘণ্টা পরেই জার্নি করেছে। সন্ধ্যার মাথায় চিন্তা ভর করে। দু’হাতে সৌম্য’র শার্ট ধরে উঁচু করে নিলে সৌম্য দ্রুত পিছিয়ে গিয়ে বলে,

– কি করছিস?
সন্ধ্যা বিরক্ত হয়। সে সৌম্য’র ক্ষ’তস্থান দেখতে চায়, এখন কি অবস্থা। সন্ধ্যা আবার-ও এগিয়ে গেলে সৌম্য উল্টো ঘুরে দাঁড়ায়। এতোটা পথ জার্নি করে পেটে প্রচন্ড চাপ পড়েছে। র’ক্ত ঝরেছে আবার। ভেজা ভেজা লাগছে। খুব ভালো-ই বুঝলো সন্ধ্যা তার অবস্থা দেখতে চাইছে। এরকম অবস্থা দেখে তার বোনটা আবার ভ’য় পাবে। এমনিতেই কাল থেকে কমকিছু ঘটেনি তার বোনের সাথে। সে তার পেটের এরকম অবস্থা সন্ধ্যাকে কিছুতেই দেখাতে পারবে না।
সন্ধ্যা সৌম্য’র সামনে এসে আবার-ও শার্ট উঠাতে নিলে সৌম্য দ্রুতপায়ে বিছানার উপর গিয়ে বসে বলে,
– আমি ঠিক আছি বোনু। তুই ঘুমা।
সন্ধ্যা খুব বিরক্ত হয়। সৌম্য’র সামনে গিয়ে ইশারায় বোঝায়, – আমাকে দেখতে দাও ভাইয়া।
সৌম্য মৃদু হেসে বলে,
– আমি ঠিক আছি। বিশ্বাস কর। তুই ঘুমা। আমি তোর মাথায় বিলি কেটে দিচ্ছি।
সন্ধ্যার রা’গ লাগছে। সে একটু ঝুঁকে সৌম্য’র শার্টে হাত দিলে সৌম্য দু’হাতে তার শার্ট টেনে ধরে অসহায় কণ্ঠে বলে,

– আরে শার্ট ধরে টানাটানি করিস না। আসলে অনেকদিন পর তোকে দেখে আমার একটু-আধটু ল’জ্জা লাগছে। বুঝলি বোনু?
সৌম্য’র কথা শুনে সন্ধ্যা এতো অদ্ভুদভাবে তাকলো, যেন সে এরকম অবাস্তব কথা তার ইহজীবনে শোনেনি। সৌম্য সন্ধ্যার দৃষ্টি দেখে অপ্রস্তুত হয়ে পড়ে। গতকাল-ই তো কতক্ষণ খালি গায়ে ছিল। ইশ! লজিকলেস কথা বলে ফেলেছে। সন্ধ্যা রে’গে দু’হাতে সৌম্য’র মাথার চুল টেনে ধরে। সৌম্য চোখমুখ কুঁচকে নেয়। তার শার্ট ছেড়ে সন্ধ্যার দু’হাত ধরে বলে,
– আরে কি করছিস? চুল ছাড়। আহ!
সন্ধ্যা সৌম্য’র চুল ছেড়ে সুযোগ পেয়ে সৌম্য’র শার্ট উঁচু করে ধরে। সৌম্য’র পেটের অবস্থা দেখে বিস্ময় চোখে তাকায়। সৌম্য ঢোক গিলল। সন্ধ্যা সৌম্য’র দিকে তাকালে সৌম্য সন্ধ্যার হাত ধরে তার পাশে বসিয়ে দেয়। এরপর মৃদু হেসে বলে,

– জার্নি করেছি। তাই একটু প্রবলেম হয়েছে। রেস্ট করলেই ঠিক হয়ে যাবে। তুই চিন্তা করিস না।
সন্ধ্যা সৌম্য’কে ঠেলে বোঝায়, – এক্ষুনি ডক্টরের কাছে যেতে।
– পরে যাবো বোনু। এখন ভালো লাগছে না।
সন্ধ্যা দু’দিকে মাথা নেড়ে বোঝায়। সে মানবে না। এক্ষুনি যেতে হবে ডক্টরের কাছে। সন্ধ্যার ঠেলাঠেলিতে সৌম্য দীর্ঘশ্বাস ফেলে। দু’হাতে সন্ধ্যার দু’হাত ধরে বলে,
– তোর ভাইকে তুই কবে থেকে বড়লোক ভাবতে শুরু করলি বোনু?
কথাটা শুনতেই সন্ধ্যা অবাক হয়ে সৌম্য’র দিকে তাকায়। সন্ধ্যা বুঝতে পারল, তার ভাইয়ের কাছে টাকা নেই। সন্ধ্যার নিজেকে ভীষণ অসহায় লাগলো। কিছুক্ষণ শান্ত হয়ে বসে থাকলো সন্ধ্যা।
মলিন মুখে সৌম্য’র পাশ থেকে উঠে দাঁড়ায়। সৌম্য মাথা নিচু করে বসে থাকলো।
সন্ধ্যা ব্যাগের ভেতর থেকে তার একটি পরিষ্কার ওড়না বের করে। চোখে কোণে জমা অশ্রুকণা ডান হাতে মুছে নেয়। মনে মনে খুব করে বললো, – আল্লাহ আমার ভাইয়াকে টাকা ছাড়াই সারিয়ে দাও!

এরপর সন্ধ্যা সৌম্য’র সামনে এসে বসে নিজে নিজেই সৌম্য’র শার্ট খুলে দিল। সৌম্য মলিন মুখে তার বোনের দিকে চেয়ে আছে। সন্ধ্যা সৌম্য’র শার্ট খুলে রেখে সৌম্য’র পেটে লেগে থাকা র’ক্তকণা তার শুকনো ওড়না দিয়ে আলতো হাতে মুছে দিতে থাকে। সন্ধ্যা এতো করে চাইলো, নিজেকে স্বাভাবিক রাখতে, কিন্তু পারলো না। চোখ থেকে দু’ফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে তার হাতের উপর পড়ে। সৌম্য’র চোখ এড়ায় না। কিন্তু সে কিছু বলল না। ঘাড় বাঁকিয়ে জানালার ফাঁকে নীল আকাশের দিকে তাকায়। লম্বা শ্বাস টেনে সামনের দিকে ফিরে সন্ধ্যার মাথায় বা হাত রাখে। সন্ধ্যা ঝাপসা চোখে তাকায় সৌম্য’র দিকে। দু’হাতে সৌম্য’র পেটে ওড়না চেপে রাখা।
সৌম্য ডান হাতে সন্ধ্যার চোখের পানি মুছে দিয়ে বোঝানোর স্বরে বলে,

– জানিস বোনু? ক’ষ্ট পেয়ে দুর্বল মানুষেরা কাঁদে। আর দুঃখরা সুযোগ পেয়ে সেই দুর্বল মানুষদেরকে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরে।
কিন্তু আমি চাই, আমার বোনু হবে ভীষণ স্ট্রং। হাজারটা দুঃখ, ক’ষ্ট নিজের মাঝে মুড়িয়ে অটল বৃক্ষের ন্যায় শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে থাকবে।
তুই আমার এই ইচ্ছেটা পূরণ করবি বোনু?
সন্ধ্যা মনোযোগ দিয়ে শুনলো ভাইয়ের কথা। জোরপূর্বক একটু হেসে ডানদিকে মাথা কাত করে হ্যাঁ বোঝায়। সৌম্য মৃদু হাসলো।

সময় বহমান। সে থেমে থাকে না। কারো হাসিতে থামে না, কারো দুঃখে থামে না, কারো অশ্রুতে থামে না, না তো কারো দীর্ঘশ্বাস, অপেক্ষাতে থামে। সে তার মতো চলে যায়।
যেমনটা পেরিয়েছে প্রায় দেড় মাস। আকাশ সৌম্যদের গ্রামে গিয়েছিল সৌম্য আর সন্ধ্যার খোঁজ করতে। কিন্তু সেখানে সন্ধ্যা, সৌম্য কেউ নেই। কতজনকে জিজ্ঞেস-ও করেছে, কিন্তু সবার একই কথা, কেউ জানে না। সৌম্য, সন্ধ্যা প্রায় দুইমাসের বেশি গ্রামে যায়নি।

এরপর আকাশ ভার্সিটিতে গিয়ে সৌম্য’র ক্লাসমেটদের থেকে সৌম্য’র রুমমেট রিহান এর খোঁজ নিয়ে সেখানে-ও গিয়েছিল। রিহান তাকে জানায় গত একমাস আগে সৌম্য’র সাথে তার শেষ কথা হয়। এরপর সে সৌম্য’র ফোনে অনেক চেষ্টা করেছিল, কিন্তু আর পায়নি। সৌম্য’রা কোথায় গিয়েছে এটা-ও তাকে জানায়নি। আকাশ সবজায়গা থেকে হতাশ হয়ে ফিরে এসেছে। আসমানী নওয়ানের মতো হাসিখুশি মানুষটা নিশ্চুপ হয়ে গিয়েছে। আকাশকে মাঝে মাঝে জিজ্ঞেস করে, সন্ধ্যার খোঁজ পেয়েছে কি-না। আকাশের উত্তর বরাবরই হয়, না।
শীতকালের শুরু,

ধরনীর বুক থেকে দুপুরের কড়ারোদ মুছে গিয়েছে। নেমেছে বিকালের ঠাণ্ডা আবহাওয়া। প্রকৃতি জুড়ে মৃদু বাতাস বইছে। এখনকার হাওয়া বেশ ঠাণ্ডা।
আকাশ বেলকনিতে উদাম শরীরে দাঁড়িয়ে আছে। মাত্র শাওয়ার নিয়ে এসে দাঁড়িয়েছে। পরনে সাদা গ্যাবার্ডিন প্যান্ট। দৃষ্টি বকুলফুলের গাছতলায়। যেখানে ছোট্ট ছোট্ট বকুল ফুল গাছ থেকে ঝরে মাটিতে অবহেলে পড়ে গেছে। ফুলগুলো কেউ যত্ন নিয়ে মাটি থেকে তুলছে না। আকাশের চোখের পর্দায় ভাসে সন্ধ্যার ফুল কুড়ানোর দৃশ্য। সন্ধ্যা থাকলে আজ-ও হয়ত, সন্ধ্যা মাটিতে পড়ে থাকা ফুলগুলো আদুরে হাতে তার আঁচলে ভরত? আকাশের দৃষ্টিতে অসহায়ত্ব। সন্ধ্যা কেন নেই? কোথায় হারিয়ে গেল?

ডানহাতের বকুল ফুলের মালাটি মুখ বরাবর উঠিয়ে সামনে ধরে আকাশ। দেড় মাসের বেশি হয়ে গেল ফুলগুলোর বয়স। যেটা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গিয়েছে বলা যায়। সন্ধ্যার হাতে গাঁথা মালা। আকাশ ফেলে দেয়নি এটা।
সন্ধ্যার রেখে যাওয়া চিঠিতে লেখা একটি লাইন আকাশের কানে প্রতিধ্বনি হয় বারংবার।
– একটি শেষ কথা রাখবেন? বকুল ফুলের এই মালাটি শুকিয়ে গেলে-ও আপনার কাছে রেখে দিবেন?
আকাশ বারবার এপাশ-ওপাশ করে মাথা নাড়ায়। বা হাতে বেলকনির গ্রিল থাবা দেয়ার মতো করে আঁকড়ে ধরে। ডান হাতে ধরে রাখা শুকনো ফুলের মালার পানে দৃষ্টি রেখে অসহায় কণ্ঠে বিড়বিড়িয়ে আওড়ায়,
– আমি তোমার শুকনো মালা রেখে দিয়েছি সন্ধ্যা। কিন্তু তুমি কোথায় হারালে? প্লিজ তোমার একটা খোঁজ দাও। আমি অসুস্থ হয়ে গিয়েছি সন্ধ্যা, অসুস্থতার কারণটা তুমি। তবে কেন এই অসুস্থ আমিকে একবার দেখতে আসছ না? প্লিজ এসো!

মৃদু শীতল হাওয়া আকাশের উদাম গা ছুঁয়ে দেয়। প্রশস্ত বুক ফেটে ঘাম জমতে শুরু করে। আকাশ চোখ বুজল। বেশ কিছুক্ষণ এভাবে থেকে হঠাৎ-ই গটগট পায়ে ঘরের ভেতর যায়। টেবিলের উপর থেকে ফোন নিয়ে সৌম্য’র নাম্বারে কল করে। বরাবরের মতোই ফোন বন্ধ। আকাশ এ পর্যন্ত যতবার কল দিয়েছে, ওপাশ থেকে প্রতিবার মেয়ে কণ্ঠে বিরক্তিকর এক লাইন ভেসে আসত,
– কাঙ্ক্ষিত নাম্বারটিতে সংযোগ দেয়া সম্ভব হচ্ছে না।
একই লাইন এবারে-ও ভেসে আসলো।
আকাশ স্ট্যাচু হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। এভাবেই তার দিন যায়।

সন্ধ্যা বিছানার উপর জানালার ধারে চুপটি করে বসে আছে। হালকা শীত উপশম করতে গায়ে একটি পাতলা চাদর মুড়িয়েছে। নিষ্প্রাণ দৃষ্টি আকাশপানে নিবদ্ধ। সৌম্য’র অসুস্থতায় প্রথম প্রথম সন্ধ্যা একটু-আধটু চঞ্চলতা দেখালেও, সৌম্য যত সুস্থ হতে শুরু করল, সন্ধ্যা তত চুপচাপ হয়ে গেল। সেই রাতের খারাপ স্মৃতিগুলো যেন একটু একটু করে সন্ধ্যাকে কুড়ে খেতে শুরু করল। মেয়েটি আর কাঁদে না। কি জানি, সৌম্য বলেছিল বলে কাঁদে না, না-কি, সে পাথর হয়ে গেল! সৌম্য কিছু বললে চুপচাপ ইশারায় বলে, তারপর আবার-ও চুপ হয়ে যায়। যেন সে কোনো রোবট।
সৌম্য সন্ধ্যাকে নিয়ে খুব চিন্তা করে। সে বুঝতে পারেনা, কিভাবে সন্ধ্যাকে স্বাভাবিক করবে। সৃজা এতো এতো গল্প করে, সৌম্য তার ইগো রেখে নিজে সৃজাকে গিয়ে অনুরোধ করেছে, তার বোনকে একটুখানি হাসাতে। তার বোনকে সময় দিতে।

সৃজা কতশত হাসির কথা বলে। সন্ধ্যা একধ্যানে শুধু চেয়ে থাকে। হাসে না, কাঁদে না। সৃজার ভীষণ মন খারাপ হয়, আর সৌম্য’র চিন্তার পাল্লা ভারী হয়।
সৌম্য বাইরে গিয়েছে। সন্ধ্যার পায়ের কাছে সৌম্য’র
ফোন। সৌম্য তার ফোন দু’এক মিনিটের জন্য মাঝে মাঝে অন করে প্রয়োজনে। এরপর আবার অফ করে রাখে। এখন ফোন বন্ধ ছিল, হয়তো সন্ধ্যার পায়ের চাপ লেগে ফোন খুলে গিয়েছে। সৌম্য’র ফোন ভাইব্রেট হয়। সন্ধ্যা বুঝেছে কি-না! সে মেঘলা আকাশ থেকে দৃষ্টি সরালো না। প্রয়োজনবোধ করল না ফোন তোলার।
সৃজা সন্ধ্যাকে ডাকতে ডাকতে সন্ধ্যার পাশে এসে বসে। ফোন ভাইব্রেট এর শব্দ পেয়ে ফোন হাতে তুলে নেয়। নড়াচড়ায় সন্ধ্যা ঘাড় ফিরিয়ে সৃজার দিকে তাকায়। সৃজা সন্ধ্যাকে ফোন দেখিয়ে বলে,

– কে যেন কল করেছে সৌম্য ভাইয়ার ফোনে। আমি ধরব না-কি রেখে দিব?
সন্ধ্যা কিছু বলল না। আবার-ও জানালার দিকে তাকাতে গিয়ে ফোনের স্ক্রিনে চোখ পড়ে সন্ধ্যার। স্ক্রিনে বড় বড় করে লেখা – আকাশ ভাইয়া।
সন্ধ্যার চোখ আটকায় সেথায়। সৃজা আবার-ও কিছু বলার আগেই সন্ধ্যা টান মে’রে সৃজার হাত থেকে ফোন নিয়ে নেয়। সৃজা অবাক হয়। সন্ধ্যা সৃজার দিকে চেয়ে ঢোক গিলল। কাঁপা হাতে কল রিসিভ করে কানে ধরে।
আকাশ তখন ফোন বন্ধ পেয়ে-ও পর পর আরও কয়েকবার কল দিচ্ছিল। হঠাৎ-ই সৌম্য’র নাম্বারে কল ঢুকলে আকাশ যেন আসমানের তারা হাতে পায়। রিসিভ হওয়ার সাথে সাথে বিচলিত কণ্ঠে ডাকে,

– সৌম্য তুমি কোথায়?
সন্ধ্যা ঢোক গিলল। কতদিন পর আকাশের ভয়েস শুনতে পেল। চোখের কোণে জলকণা জমতে শুরু করেছে। আকাশ উত্তর না পেয়ে আবার-ও বলে,
– সৌম্য কথা বলো প্লিজ? কোথায় আছো তোমরা? সন্ধ্যা কোথায়?
সন্ধ্যার চোখের সামনে আবার-ও সেই রাতের আবছা স্মৃতি ভেসে ওঠে। লোকটি তাকে কত বাজেভাবে ছুঁয়েছিল! গলায়, হাতে, পায়ে, মুখে কতশত ক্ষ’তের দাগ রয়ে গিয়েছে আজ-ও। বা হাত কোলের উপর রাখা, যা ধীরে ধীরে কাঁপতে শুরু করেছে। সন্ধ্যার মনে পড়ল,, তার ভাইকে আকাশের বলা শেষ কথা, ডিভোর্স পেপার হাতে পেলে সে সৌম্যকে জানাবে। আকাশ তাকে এমনি-ই ডিভোর্স দিতে চেয়েছিল। এসব শুনলে তাকে কতই না ঘৃণা করবে! কথাগুলো ভাবতেই সন্ধ্যার নিঃশ্বাস ভারী হয়ে আসে। ধীরে ধীরে পুরো শরীরে কম্পন শুরু হয়। নিঃশ্বাসের তীব্রতা বাড়তে থাকে। শব্দ করে শ্বাস নেয় সন্ধ্যা। সৃজা ভ’য় পেয়ে সন্ধ্যার বা হাত ধরে বলে,

অন্তঃদহন পর্ব ১৭ (২)

– সন্ধ্যা কি হয়েছে তোমার?
সন্ধ্যা তাকালো না সৃজার পানে। চোখজোড়া বুজে নিয়েছে। দু’চোখ থেকে টুপ করে দু’ফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পড়ে। শরীরের কম্পন বাড়লো বই কমলো না। না চাইতে-ও কতদিন পর রোবটের মতো মেয়েটির চোখ ভিজল!
আকাশ সৃজার বলা সন্ধ্যা শব্দটি শুনতে পেয়েছে। সাথে সন্ধ্যার অস্বাভাবিক শ্বাস-প্রশ্বাসে আকাশের বুকে চিনচিনে ব্য’থার উৎপত্তি দেখা দেয়। দু’চোখের পাতা বন্ধ করে ঢোক গিলে ভাঙা গলায় ডাকে,
– সন্ধ্যা?

অন্তঃদহন পর্ব ১৯