অন্তঃদহন পর্ব ২
DRM Shohag
আসমানী নওয়ান এর কথায় আকাশের পা থেমে যায়। পিছু ফিরে বিস্ময় দৃষ্টিতে তাকায় তার মায়ের দিকে। সাথে অবাক হয় সাইফুদ্দীন নওয়ান। মেয়েটি বোবা মানে?
আসমানী নওয়ান নিজেকে সামলে বলেন,
– তোমাগো যেহেতু ওরে নিয়া এতোই সমস্যা, আমি-ই তোমাগো ডিভোর্স করামু। এরপর আমি ওরে আরও ভালো ঘরে বিয়া দিমু।
সাইফুদ্দীন নওয়ান অবাক হয়ে বলেন,
– মেয়েটির পরিবার নেই?
আসমানী নওয়ান শক্ত গলায় বলে,
– না নাই।
কথাটা বলে আসমানী নওয়ান উল্টো ঘুরে সন্ধ্যার দিকে এগিয়ে গিয়ে সন্ধ্যার হাত ধরে তার ঘরের পাশের ঘরের দিকে যায়। সন্ধ্যা তার শ্বাশুড়ির সাথে পা মেলায়, মাথার আঁচল একটুখানি টেনে নেয়। আকাশ কেমন অদ্ভুদ চোখে চেয়ে রইল। সন্ধ্যার চোখেমুখে পানির কণা। একবার পিছু ফিরে তাকালে আকাশের সাথে চোখাচোখি হলে সন্ধ্যা দ্রুত সামনে ফিরে মাথা নিচু করে নেয়। আসমানী নওয়ান সন্ধ্যাকে নিয়ে যতক্ষণ পর্যন্ত সেই ঘরে প্রবেশ না করে, ততক্ষণ আকাশ নির্জীব চোখে চেয়ে রইল। সাইফুদ্দীন নওয়ান এর-ও একই অবস্থা। দুই বাবা ছেলের অবাকের মাত্রা ছাড়িয়েছে।
সাইফুদ্দীন নওয়ান বেশ কিছুক্ষণ পর আকাশের উদ্দেশ্যে বলে ওঠে,
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
– তুমি চিন্তা কর না। তোমার মা কে আমি সামলে নিব। তুমি ইরা কে বিয়ের প্রিপারেশন নাও।
আকাশ কিছু বলল না। সাইফুদ্দীন নওয়ান ছেলের নিরবতায় আবারও বললেন,
– আমি কি বলেছি, বুঝেছ?
আকাশ ছোট করে বলে,
– হুম।
কথাটা বলে আকাশ তার ঘরে যাওয়ার জন্য সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠতে থাকে। সাইফুদ্দীন নওয়ান পকেট থেকে ফোন বের করে কাউকে কল করে।
“আমার ছেলের বউ হইবি না?”
আসমানি নওয়ান মেয়েটির মন খারাপ দেখে ভ্রু কুঁচকে বলল,
“কি হইলো? মন খারাপ কইরা নিলি ক্যান?”
মেয়েটি হাত দিয়ে ইশরা করে কিছু বোঝালো, যার অর্থ
‘আমি তো তোমাদের মতো কথা বলতে পারিনা। আমারে তোমার ছেলে বিয়া করব?’
আসমানি নওয়ান মৃদু হেসে মেয়েটির থুতনিতে হাত রেখে বললেন,
“আমার ছানা আমারে খুব ভালোবাসে। আমার কথা ফালানোর সাহস নাই তার।”
মেয়েটি আবারও হাতের ইশারায় বোঝালো,
‘ভালোবাসবে না তো আমারে।’
আসমানি নওয়ান হেসে বললেন,
“আমার জান্নাতরে ভালো না বেসে কি কইরা থাকে আমিও দেইখা লমু।”
মেয়েটির মুখে হাসি ফুটল। আসমানি নওয়ানকে দু’হাতে জড়িয়ে ধরে লজ্জামাখা হাসি হাসলো।
কয়েকদিন আগের একটি ঘটনা মনে করে সন্ধ্যা মলিন হাসলো। আসমানী নওয়ানকে সে বেশিদিন হলো চেনে না। তার গ্রামে মাঝে মাঝে দেখা হতো। আর ভদ্রমহিলা তার সাথে অনেক কথা বলতো। সন্ধ্যা ইশারায় বললে আসমানী নওয়ান-ও সব বুঝে যেত। প্রায় দু’মাস আগে দেখা হলে তার ছেলের সাথে বিয়ের কথা বলে। সন্ধ্যা প্রথম প্রথম বিব্রতবোধ করলেও ধীরে ধীরে আসমানী নওয়ান এর কথায় সন্ধ্যা বেশ প্রভাবিত হয়। আকাশকে না দেখেও ভাবত, আসমানী নওয়ান এর ছেলে তার স্বামী হবে।
কিন্তু গতকাল হঠাৎ-ই তাদের বাড়িতে আসমানী নওয়ানকে দেখে সন্ধ্যা অনেক অবাক হয়েছিল। আরও অবাক হয়েছিল যখন শুনেছিল তখন-ই তার বিয়ে এনার ছেলের সাথে। সন্ধ্যা আগে থেকেই আসমানী নওয়ান এর ছেলের বউ হওয়ার স্বপ্ন দেখত, এখানে সে দ্বিমত করেনি। তবে আসমানী নওয়ান এর কথা শুনে সে ভাবতো, এনার ছেলে-ও তাকে বউ হিসেবে মানবে। কিন্তু তার ভাবনা ভুল।
আসমানী নওয়ান সন্ধ্যার গালে হাত দিয়ে বলে,
– কি ভাবতাছস মা?
সন্ধ্যা বেশ কিছুক্ষণ চুপ থেকে ইশারায় বোঝায়, আসমানী নওয়ান তাকে কিভাবে চেনে?
আসমানী নওয়ান বেশ কিছুক্ষণ চুপ থাকলো। এরপর মৃদুস্বরে বলে,
– তোর মা আর আমি একলোগে পড়তাম। বিয়ের পর আর তেমনভাবে যোগাযোগ আছিল না। এরপর হঠাৎ-ই একদিন খবর পাই তোর মা মা’রা গেছে। তুই তখন ছোট আছিলি। এরপর ভুলেই গেছিলাম। পরে তোর ব্যাপারে গ্রামের একজনের কাছে গল্প শুইনা বুঝলাম তুই ভালা নাই। তখন থেইকা তোরে আমার কাছে আনতে চাইতাম। কারণ ছাড়া আনতে পারমু না, তাই আমার পোলার বউ করে আনতে চাইছিলাম।
একটু থেমে বলে,
– মন খারাপ করিস না মা। আমি তোরে আরও ভালো জায়গায় বিয়া দিমু। কারো কথা ভাববি না। তোর কেউ নাই। আমি আছি। তোর বাপ মা তো নাই-ই, ভাইডা থাইকা-ও নাই। সবগুলাই স্বার্থপর।
সন্ধ্যা ইশারায় বলতে চাইল,
– তার ভাই অনেক ভালো।
আসমানী নওয়ান বাঁধ সাধে। মৃদুস্বরে বলে,
– আর কিছু বোঝাতে হইবো না। এহন কিছু খাবি। আর এহন থেইকা এই ঘরেই থাকবি।
সন্ধ্যা মাথা নেড়ে আচ্ছা বোঝায়।
পরদিন, সকাল ১০ টা, আকাশ অ্যাশ কালার স্যুট, প্যান্ট পরে। সাথে সিলভার কালার চেইনের ঘড়ি,, চুলগুলো ভালোভাবে সেট করে নেয়। মাঝারি সাইজের ঘনকালো দাঁড়ি ভালোভাবে গুছিয়ে নেয়।
এরপর আকাশ সিঁড়ি বেয়ে নেমে আসে।
সাইফুদ্দীন নওয়ান টেবিলে বসে নাস্তা করছিলেন। আকাশ দেখল তার বাবা কে, পাশে-ই মা দাঁড়ানো। সে কিছু বলল না। গটগট পায়ে বাইরে বেরিয়ে যেতে নিলে আসমানী নওয়ান বলে ওঠে,
– খেয়ে যাও।
আকাশ ছোট করে বলে,
– ক্ষুধা নেই।
আসমানী নওয়ান এর চোখ ভরে ওঠে। এতো বাধ্য ছেলে হঠাৎ এরকম ব্যবহার করলে মেনে নেয়া যায়? সাইফুদ্দীন নওয়ান মৃদুস্বরে বলে,
– আকাশ খেয়ে যাও।
আকাশ শুনলো না কারো কথা। গটগট পায়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যায়। বাবা মা দু’জনেই হতাশার শ্বাস ফেললেন। সাইফুদ্দীন নওয়ান স্ত্রীর পানে চেয়ে বলে,
– মন খারাপ কর না আসমানী। তোমার ছেলে তো। তোমার মতোই একটু-আধটু ত্যাড়া আছে। মানিয়ে নাও।
আসমানী নওয়ান রে’গে তাকায় স্বামীর পানে। ভদ্রলোক ইনোসেন্ট ফেস বানিয়ে বলে,
– ত্যাড়ামি একটা মহৎ গুণ আসমানী জানো? এইজন্যই তো আমি তোমাকে এতো পছন্দ করেছি।
আসমানী নওয়ান কিছু বললেন না।
আকাশ একটি রেস্টুরেন্টে বসে আছে। এক কাপ ব্ল্যাক কফি অর্ডার করে। ফোনে কিছু করছে সাথে কফিতে একটু পর পর চুমুক দেয়।
কিছুক্ষণ পর দু’টি মেয়ে এসে দাঁড়ায় আকাশের সামনে। ইরা আকাশকে সালাম দেয়,
– আসসালামুআলাইকুম ভাইয়া।
আকাশ মাথা নিচু করেই সালাম এর উত্তর নেয়। ইরা আকাশের সম্মুখ বরাবর একটি চেয়ার টেনে বসে। ইরার কাজিন ইতি হা করে আকাশের দিকে চেয়ে আছে। যদিও আকাশের মাথা অনেকটা নিচু, তবুও যেটুকু দেখা যাচ্ছে, এতেই মেয়েটা অবাক হয়ে চেয়ে আছে। ইরা ইতির কান্ডে বিরক্ত হলো। টেনে তার পাশের চেয়ারে বসিয়ে দেয় ইতিকে। চোখ গরম করে তাকায়৷ ইতি আকাশের দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ রেখে ইরার কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিসিয়ে বলে,
– পাখি, তোর পা ধোঁয়া পাবি খাবো। তুই এই বিয়ে ভাঙার সাথে সাথে আমার সাথে সেট করিয়ে দে বোন।
ইরার মে’জা’জ খারাপ হয়। সামনে আকাশ বসা, এইজন্যকিছু বলতেও পারছে না। নয়তো এর চুল ছিঁড়ে এসব কাজকর্ম ছেড়ে দিত। আকাশ গম্ভীর গলায় বলে,
– আমার কাজ আছে। যা বলার ফাস্ট বলো।
ইরা ঢোক গিলল। সে অনেক ক’ষ্টে তার বাবার ফোন থেকে আকাশের নাম্বার সংগ্রহ করেছিল কাল রাতে। অনেক রিকুয়েস্ট করে আকাশকে দেখা করতে বলায় আকাশ এই লোকেশন পাঠিয়ে দিয়েছিল। ইরা ভ’য়ে ভ’য়ে বলে,
– ভাইয়া আমি আপনাকে বিয়ে করতে চাই না।
আকাশের দৃষ্টি ফোনে নিবদ্ধ। কফির কাপে চুমুক দিয়ে মৃদুস্বরে বলে,
– ওকে।
ইরা অবাক হয়ে তাকায়। আকাশ এতো তাড়াতাড়ি রাজি হয়ে গেল? পাশ থেকে ইতি আওয়াজ করে বলে ওঠে,
– আরে কেয়া বাত হে!
ইরা ইতির হাত টেনে ধরে। আকাশ বিরক্ত চোখে তাকায় ইতির পানে। বিড়বিড় করে,
– রা’বি’শ!
কথাটা বলে আবারও ফোনে মগ্ন হয়। ইরা প্রচন্ড বিরক্ত হয় ইতির কান্ডে। নিজেকে সামলে আকাশের উদ্দেশ্যে বলে,
– ভাইয়া আমাদের বিয়েটা কি তাহলে হচ্ছে না?
আকাশ কিছু বলে না। ইরা আকাশের উপর-ও খানিক বিরক্ত হয়। ঠিক করে কথা-ও বলে না। কি অদ্ভুদ! আবার ভাবলো, অপরিচিত এক ছেলে যেটুকু বলছে এটাই অনেক। সৌম্য তার বন্ধু হয়েও তার সাথে ঠিক করে কথা বলে না।
ইতি ইরার পাশ থেকে উঠে গিয়ে আকাশের পাশের চেয়ার আকাশের দিকে আরেকটু টেনে নিয়ে বসে। আকাশ ব্যাপারটা খেয়াল করতেই চরম বিরক্তি নিয়ে বা দিকে একটু ঘাড় ঘোরায়। কিছু বলল না। সাথে সাথে রে’গে যাওয়ার অভ্যাস তার নেই। প্রথমে ঠাণ্ডা থাকে, এরপর তার অপছন্দের কাজ বারবার রিপিট হলে তখন আকাশের রা’গ আর নিয়ন্ত্রণে থাকে না।
আকাশ তার সিট থেকে উঠে, তার ডান পাশের চেয়ারে বসে পড়ে। এরপর আবারও ফোনে মগ্ন হয়। ইতির মন খারাপ হয়। ইরার দিকে তাকালে দেখল ইরা কি যেন ধ্যান করছে।
ইতি আকাশকে কফি খেতে দেখে মৃদুস্বরে বলে,
– বলছি আমাদের জন্য এক কাপ কফি অর্ডার করুন।
আকাশ কিছু বলল না। কপালে বিরক্তির ভাঁজ। ইতি আবারও আকাশের পাশের সিটে বসে। তার ভাবটা এমন যেন সে আজকেই আকাশকে পটিয়ে আকাশের কোলে উঠে বসে থাকবে। আকাশ ঘাড় ফিরিয়ে শক্ত চোখে তাকায়। ইতি মুখ টা ছোট করে বলে,
– আপনি তো ইরা আপুকে বিয়ে করবেন না। তাহলে আমাকে করুন। আমার আপনাকে হেব্বি লেগেছে!
আকাশের রা’গ তড়তড় করে বেড়ে যায়। ইরার ধ্যান ভাঙে। ইতিকে আকাশের পাশে দেখে চোখ বড় বড় হয়ে যায়। কপাল চাপড়ায়। এর বয়স ২০ পার হতে চলল। অথচ এসব স্বভাব আর গেল না!
আকাশ এবারেও নিজেকে সামলে নিতে চাইলো। ফোঁস করে শ্বাস ফেলে আবারও সোজা হয়ে বসে। ইতি আকাশের মুখ ফিরিয়ে নেয়া দেখে মুখ ফোলায়। এই লোকটির এতো ভাব কেন? সুন্দর বলে? ফর্সা বলে? আরও কত ফর্সা ছেলে আছে? এতো ভাব দেখানোর কি আছে? কিন্তু ইতির আকাশকেই ভালো লেগেছে। দাঁড়িগুলো কি সুন্দর বড় বড়! মেয়েটি তার স্বভাবসুলভ দু’হাতে আকাশের হাত সাপ্টে ধরে বলে,
– আমাকে এক্সেপ্ট করে নিন। মেয়ে হয়ে আপনাকে প্রপোজ করছি। প্লিজ ফিরিয়ে দিবেন না। আমার বাবা-ও ইরা আপুদের মতো আর আপনাদের মতো বড়লোক।
আকাশের ধৈর্যের বাঁধ শেষ। তাকে এই মেয়ে টাচ করেছে কোন সাহসে? বুঝে পায় না! ইরা চোখ বড় বড় করে চেয়ে আছে। একে সাথে আনা মস্ত বড় ভুল হয়ে গেছে বুঝল। মৃদুস্বরে বলে,
– ইতি কি করছিস?
ইতি ইরার কথা পাত্তা দিল না। আকাশের হাত-ও ছাড়লো না। আকাশ দাঁতে দাঁত চেপে বলে,
– হাত ছাড়ো!
ইতি একটু ভ’য় পেলেও ছাড়লো না। তার ধারণা আকাশ ঠিক পটে যাবে! সে কি কম সুন্দরী নাকি! কি সুন্দর করে সেজে এসেছে!
কিন্তু আকাশের আর সহ্য হলো না। একে তো বারবার পাশে এসে বসছিল, আকাশ নিজেকে সামলে নিচ্ছিল। কিন্তু এখন সব লিমিট ক্রস করে ফেলেছে মেয়েটি। আকাশ ঝট করে তার হাত ছাড়িয়ে নিয়ে ইতির গালে ঠাস করে একটা থা’প্প’ড় মে’রে দেয়। বেচারি বুঝতেই পারেনি। চোখের পলকে কি থেকে কি যেন হয়ে গেল! ইতি হুমড়ি খেয়ে চেয়ার থেকে পড়তে গিয়েও পড়ে না।
ইরা হতভম্ব চোখে চেয়ে আছে। আকাশ আধখাওয়া কফিটুকু রেখে ফোন পকেটে রেখে হনহন করে বেরিয়ে যায় রেস্টুরেন্টে থেকে। যাওয়ার আগে গম্ভীর গলায় বলে,
– মিস ইরা, বিয়ে হবে না।
ইরা আকাশের কথা শুনে খুশি হবে, না-কি তার কাজিনকে এমন থা’প্প’ড় খেতে দেখে দুঃখ পাবে বুঝলো না। আশেপাশের অনেকেই অদ্ভুদচোখে চেয়ে আছে। ইরা বিব্রতবোধ লাগে। কি করবে, এই ইতি টা এমন কেন? এর আগে তার অন্যান্য কাজিনদের সাথে গিয়েও এমন করত। এমন থা’প্প’ড় খাওয়ার অভিজ্ঞতা এর আগে হয়নি। এই প্রথম,, ঠিক-ই আছে। এর শিক্ষা হওয়া উচিৎ।
সে তার জায়গা থেকে উঠে বলে
– বাড়ি যাবি না-কি এখানেই শুয়ে থাকবি?
ইতি রে’গে তাকায় ইরার দিকে। কিছু না বলে ধুপধাপ পা ফেলে রেস্টুরেন্ট থেকে বেরিয়ে যায়। ইরার একটু খারাপ লাগলো, আবার ভালো লাগলো বিয়ে হবে না ভেবে। ব্যাগ থেকে ফোন বের করে দ্রুত সৌম্য’র নাম্বারে কল করলে, ফোন রিং হয়, কিন্তু রিসিভ হয় না। ইরা হতাশ হয়ে সে-ও রেস্টুরেন্ট থেকে বেরিয়ে যায়।
আকাশ রেস্টুরেন্ট থেকে বেরিয়ে তার গাড়ির দিকে এগিয়ে গেলে হঠাৎ-ই আনিকা আকাশের সামনে এসে দাঁড়ায়। আকাশ দাঁড়িয়ে যায়, সাথে বিরক্ত চোখে তাকায়। আনিকা হেসে বলে,
– তুই রেস্টুরেন্টে যে? ডেট করলি না-কি?
আকাশ মৃদুস্বরে বলে,
– করলাম।
আনিকার দৃষ্টি রেস্টুরেন্ট থেকে বেরিয়ে আসা ইরার দিকে পড়লে অবাক হয়ে বলে,
– আরে ইরা-ও এখানে? বিয়ের আগে এতো ঘনঘন মিট করলে ভুলভাল কিছু হয়ে যেতে পারে।
আকাশ বিরক্ত হলো। আনিকাকে পাশ কাটিয়ে তার গাড়িতে বসে গাড়ি স্টার্ট দেয়। আনিকা কিছু বলল না। ব্যাপার টা বুঝলো না, ইরা আর আকাশ রেস্টুরেন্টে কেন? আকাশ তো এমন বান্দা নয়। কাহিনী কি? বেচারি ভাবনায় ব্যস্ত হলো।
– দাঁড়াও!
ইরা আর ইতি মাত্র বাড়িতে পা রেখেছে। ঘরে যাওয়ার জন্য কয়েক পা এগোতেই ইরার বাবা ইশতিয়াক আহমেদের শক্ত কণ্ঠে দু’জনের পা থেমে যায়। ইতি ভীত চোখে তাকায় তার মামার দিকে। ইরা ঢোক গিলল।
ইশতিয়াক আহমেদ এগিয়ে এসে ইরার সামনের দাঁড়িয়ে শক্ত গলায় বলে,
– কোথায় গিয়েছিলে?
ইরা আমতা আমতা করে বলে,
– ইতিকে নিয়ে রেস্টুরেন্টে গিয়েছিলাম।
ইশতিয়াক আহমেদ দাঁতে দাঁত চেপে বলে,
– খেতে গিয়েছিলে না-কি বিয়ে ভাঙতে?
ইরা নিজেকে শক্ত করল। অতঃপর দৃঢ় কণ্ঠে বলে,
– আমি এখন বিয়ে করতে চাই না বাবা।
কথাটা বলতে না বলতেই ইশতিয়াক আহমেদ ইরার গালে ক’ষি’য়ে এক থা’প্প’ড় মে’রে দেয়। ইরা পড়ে যেতে নিলে ইতি দ্রুত আগলে নেয়। রেস্টুরেন্টে এক অপরিচিত ছেলের হাতে থা’প্প’ড় খেয়ে বেচারি গালের ব্য’থা আর অপমান টুকুই এখনো ভুলতে পারেনি। এরমধ্যে আবার মামার হাতে তার মামাতো বোনের থা’প্প’ড়!
ইরার মা এগিয়ে এসে বলে,
– ইরার বাবা কি করছ?
ইশতিয়াক আহমেহ চিৎকার করে বলে,
– ওর পা এতো লম্বা হয়েছে কেন? ও কোন সাহসে বিয়ে ক্যান্সেল করতে বলেছে আকাশকে?
ইরা’র চোখের কোণে পানি। তবে নিজেকে শক্ত রাখল। তার বাবার দিকে ভেজা চোখে চেয়ে বলে,
– আমি করব না বিয়ে। আমায় কেন জোর করছ? দয়া করে এসব বন্ধ কর।
ইশতিয়াক আহমেদ রে’গে আরেকটি থা’প্প’ড় মা’র’তে নিলে ইরার মা মেয়েকে আগলে নিয়ে বলে,
– এতো বড় মেয়ের গায়ে হাত তুলছ কেন?
ইশতিয়াক আহমেদ রে’গে বলে,
– ও বড় হয়েছে, এটা ওকে বোঝাও। ২৫ বছর পেরোতে চলল, অথচ তোমার মেয়ে বিয়ে ভেঙে ঘরে বসে থাকছে। এসব আমি মানব না। আকাশের সাথেই ওর বিয়ে হবে।
ইরা ভাঙা গলায় বলে,
– আমি কোনো আকাশ পাতাল কে বিয়ে করব না। তোমার ব্যবসায় উন্মতির জন্য আমায় কেন বলির পাঠা বানাচ্ছ?
ইশতিয়াক আহমেদ দাঁতে দাঁত চেপে বলে,
– আমি কোনো গাঁজাখোর কে ধরে আনিনি। আকাশ যথেষ্ট ভদ্র ছেলে। বিয়ের প্রিপারেশন নাও।
কথাটা বলে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যায়। ইরার চোখ থেকে পানি গড়িয়ে পড়ে। তার মাকে জড়িয়ে বিড়বিড় করে,
– মা আমি বিয়ে করতে পারবো না, প্লিজ! বাবাকে বোঝাও মা।
ভদ্রমহিলা হতাশ চোখে চেয়ে রইল। তিনি মাঝ নদীর মাঝি। তার স্বামীকেও যেমন কিছু বলতে পারেন না। তেমনি মেয়ের জন্য-ও মন কাঁদে।
ইরা বেশ অনেকক্ষণ ঘরে বসে একা একা নিরবে চোখের জল ফেলেছে। এরপর রেডি হয়ে ভার্সিটির উদ্দেশ্যে বেরিয়ে যায়। বাবা বাসায় নেই। থাকলে হয়তো তাকে আর বেরোতে দিত না।
ঢাকা ভার্সিটির কার্জন হল চত্বরে রিক্সা থামায় ইরা। গাড়ি দিয়ে সবসময় চলাচল করে,, তবে সুযোগ পেলেই রিক্সায় ওঠার লোভ সামলাতে পারে না ইরা। আশেপাশে তাকিয়ে কাউকে খুঁজতে খুঁজতে এগিয়ে যায় সামনের দিকে। মাঠের এক কোণায় সৌম্য’কে দেখে ইরা একপ্রকার দৌড়ে যায় সৌম্য’র দিকে। সৌম্য’র পাশে গিয়ে ইরা বসে। কিন্তু সৌম্য ইরার দিকে তাকালো না। ইরা মন খারাপ করে বলে,
– সৌম্য তুই আমার কল রিসিভ করছিলি না কেন রে? আমি ভাবলাম তুই টিউশনে।
সৌম্য কিছু বলল না। যেন শুনতেই পাইনি। ইরা সৌম্যকে টাচ করতে গিয়ে হাত গুটিয়ে নিল। সৌম্য এসব পছন্দ করে না। আগের চেয়ে আরেকটু জোরে বলল,
– সৌম্য তোর কি কিছু হয়েছে?
সৌম্য হঠাৎ-ই ঝাঁকি দিয়ে ওঠে। ইরা অবাক হয়ে বলে,
– সৌম্য আমি।
সৌম্য ইরাকে একবার দেখে চোখ সরিয়ে নিতে গিয়েও আরেকবার তাকালো। আবার এক সেকেন্ড এর মাঝেই চোখ সরিয়ে নিল। দীর্ঘশ্বাস ফেলে। ফর্সা গালে পাঁচ আঙুলের দাগ স্পষ্ট। সৌম্য মাথা নিচু করে গম্ভীর স্বরে বলে,
– কে মে’রে’ছে তোকে?
ইরা ছোট করে বলে,
– বাবা।
সৌম্য তাকালো না ইরার দিকে। সে জানে ইরা কেন তার বাবার হাতে মা’র খেয়েছে। এটা নতুন নয়।
সৌম্য আজ সকালে গ্রাম থেকে শহরে এসেছে। ভালো লাগছে না কিছু। বোনটার জন্য মন খারাপ। কোথায় আছে কে জানে? কেমন-ই বা আছে?
ইরা আবারও বলে,
– সৌম্য তোর কি হয়েছে? তুই কি কিছু নিয়ে চিন্তিত?
সৌম্য ইরার দিকে একবার তাকালো। এরপর বসা থেকে দাঁড়িয়ে যায়। ইরার চোখের কোণে পানি। সৌম্য জানে এই জমানো পানির পিছনের কারণ। মেয়েটি যথাসাধ্য নিজেকে সামলাতে চায়, কিন্তু পারে না হয়তো। উল্টো দিকে এগিয়ে যেতে নিলে ইরা দ্রুত সৌম্য’র হাত ধরে বলে,
– তোর কি হয়েছে সৌম্য? আমাকে বললে কি হয়?
সৌম্য দ্রুত পিছু ফিরে অবাক হয়ে তাকায়। ঢোক গিলে নিজেকে সামলায়। এরপর শক্ত গলায় বলে,
– হাত ছাড় ইরা।
ইরা সাথে সাথে সৌম্য’র হাত ছেড়ে দেয়। মাথা নিচু করে বলে,
– স্যরি!
সৌম্য উল্টো ঘুরে এগিয়ে যেতে যেতে বলে,
– আমার জন্য ভাবনার ইতি টেনে নে ইরা। তোর বিয়ের বয়স পেরিয়ে যাচ্ছে।
ইরা ছলছল দৃষ্টিতে সৌম্য’র গমন পথে চেয়ে রইল। বিড়বিড়িয়ে বলে,
– তোর জন্য ভাবনার সূচনার পথটা জানতাম। কিন্তু ভাবনার ইতি ঘটানোর পথ তো জানিনা সৌম্য।
আকাশ অফিস শেষে বাড়ি ফেরার পথে আনিকার সাথে আবারও দেখা হয়। আনিকা আকাশের গাড়িতে উঠে আকাশের বাড়ি আসে। অনেকদিন হলো সে আকাশের মায়ের সাথে দেখা হয় না। সেজন্যই মূলত এসেছে।
এখন আকাশদের বাড়ির দরজার সামনে আকাশের পাশে দাঁড়িয়ে আছে আনিকা। আনিকা নিজেই বেশ কয়েকবার বেল চাপলো। আকাশ চুপচাপ পাশে দাঁড়িয়ে আছে। কিছুক্ষণের মাঝেই ওপাশ থেকে দরজা খুলে দেয় সন্ধ্যা। সন্ধ্যাকে দেখে আনিকা ভ্রু তাকায়। মেয়েটাকে ঠিক চিনলো না। সন্ধ্যা একবার আনিকার দিকে তাকায়, আরেকবার আকাশের দিকে। আকাশ গম্ভীর চোখে চেয়ে আছে সন্ধ্যার পানে। সন্ধ্যা ডানদিকে সরে দাঁড়িয়ে দু’জনকে সাইড দিয়ে মাথা নিচু করে দাঁড়ায়। সন্ধ্যার খুব মন খারাপ হলো। লোকটি যাকে বিয়ে করতে চেয়েছিল, সেই মেয়েটি-ই কি এটা? অবশ্য হতেই পারে। আকাশের পাশে দাঁড়ানো মেয়েটি কি সুন্দর! গায়ের রঙটা-ও কত ফর্সা। সন্ধ্যার ভাবনার মাঝে আনিকা আর আকাশ ভেতরে চলে যায়।
আনিকা আসমানী নওয়ান’কে দেখে এগিয়ে এসে বলে,
– আন্টি কেমন আছো?
আসমানী নওয়ান আনিকার গালে হাত দিয়ে হেসে বলে,
– ভালা মা। তুমি ভালা আছো?
আনিকা হেসে তার কথা জানায়। আকাশের মায়ের সাথে কথা বলতে তার বেশ ভালো লাগে। কেমন অন্যরকম করে কথা বলে।
সন্ধ্যা ডায়নিং টেবিলের পাশে মেঝেতে বসে আছে। তার কোলের উপর প্লেটে পান্তা সাথে পেঁয়াজ, মরিচ দিয়ে খাচ্ছিল। অনেক গরম পড়েছে। মেয়েটি নিজেই আসমানী নওয়ান এর কাছে চেয়ে নিয়েছে। এই খাবার। আগে শীতকালে ক’ষ্ট পেয়ে কত খেয়েছে। তবে এখন গরমের কারণে শান্তি করে খাচ্ছে।
অন্তঃদহন পর্ব ১
সন্ধ্যার খাওয়ার মাঝে হঠাৎ-ই সামনে চোখ পড়লে দেখল তার সামনে দু’টো পা। সন্ধ্যা দ্রুত মাথা উঁচু করে তাকায়। আকাশ দু’হাত প্যান্টের পকেটে গুঁজে রেখে গম্ভীর মুখে চেয়ে আছে সন্ধ্যার পানে। সন্ধ্যা ঢোক গিলল। সে তো আড়ালে বসে খাচ্ছিল। লোকটি টের পেয়ে গেল কিভাবে? সন্ধ্যা কি করবে বুঝতে পারে না। মাথা নিচু করে মুখের খাবার টুকু গিলে নেয়। বেশ কিছুক্ষণ পর-ও যখন দেখল তার সামনে থেকে পা দু’টো সরছে না। সন্ধ্যা ঢোক গিলল। আবার তাকে মা’র’বে না-কি? সন্ধ্যার ভাবনার মাঝে আকাশ ভরাট কণ্ঠে বলে,
– এটা খাওয়ার জায়গা নয়।