অন্তঃদহন পর্ব ২০

অন্তঃদহন পর্ব ২০
DRM Shohag

সৃজার বাবা তার ঘরে পায়চারি করছেন। ঘাম ছুটছে তার। আকাশ যাওয়ার আগে তাকে হুমকি দিয়ে গিয়েছে। সে সন্ধ্যা আর সৌম্যকে ঠিক খুঁজে বের করবে। আর তারপর সৃজার বাবার ব্যবস্থা করবে। সৃজার বাবা নিজের ছেলেমেয়েদের জন্য যেমন ভ’য় পাচ্ছে। তেমনি সন্ধ্যা, সৌম্য’র জন্য ভ’য় পাচ্ছে। তার ধারণা, সৌম্য’র পেটে চা’কু মা’রা, সন্ধ্যাকে রে’প করার চেষ্টা এসবে আকাশের হাত রয়েছে। মনে না হওয়াটা-ও অস্বাভাবিক না।

সৌম্য’র মায়ের নাম ছিল, জ্যোৎস্না। বিত্তশালী পরিবারের মেয়ে ছিল সে। সেই সূত্রে হয়তো তার ছেলেমেয়েদের জন্য এসব বড় বড় মাপের মানুষের শত্রু’র অভাব নেই। সে, সৃজার মা আর সৌম্য’র মা জ্যোৎস্না একসাথে পড়াশোনা করত। সে সৃজার মাকে ভালোবাসতো। জ্যোৎস্না সৃজার মাকে কনভিন্স করেছিল। কিন্তু কারো পরিবার মেনে নিচ্ছিল না। এমনকি সৃজার মাকে জোর করে অন্যজায়গায় বিয়ে দিয়ে দিচ্ছিল। এরপর সে সৃজার মাকে নিয়ে পালিয়ে আসার পর তাকে অনেক হেল্প করেছিল। তার পকেট শূণ্য ছিল।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

সৌম্য’র মা নির্দ্বিধায় তাকে বেহিসাব টাকা-ও দিয়েছিল। তখন জ্যোৎস্নার বিয়ে হয়নি। এরপর বহুবছর জ্যোৎস্নার আর কোনো খবর পাইনি সৃজার বাবা। তারপর একদিন এসে জায়গার দলিলগুলো তাকে দিয়েছিল আর বলেছিল, এগুলো যত্ন করে রেখে দে। আমি আবার আসব নিতে।
সৃজার বাবা জিজ্ঞেস করেছিল, সে কোথায় হারিয়েছিল। জ্যোৎস্নার উত্তর ছিল, সে পরে এসে বলবে। সে বিয়ে করেছে। একটি ছেলে আছে যার নাম সৌম্য, আর মেয়ে পেটে,, নাম রাখবে সন্ধ্যা। জ্যোৎস্নার শেষ আবদার ছিল,,- তুই তো আমার ভাইয়ের মতো। আমি না থাকলে, তুই ওদের আপন মামা হয়ে থাকিস। আমার এই কথাটা কখনো ফেলিস না।

তারপর একদিন সৌম্য এসে নিজের পরিচয় দেয়, আর জানায় তার মা মা’রা গিয়েছে বেশ কয়েকবছর আগে। সেদিন সৃজার বাবা, মা দু’জনে নিঃশব্দে চোখের পানি ফেলেছিল। তার প্রিয় বান্ধবী ছিল, যে নিঃস্বার্থে তাদের কতশত সাহায্য করেছে। এরপর সৌম্য’র থেকে সৌম্য’র বাবার স্বার্থপরতার কথা শুনে বুঝেছিল, জ্যোৎস্না কেন তাকে সৌম্য আর সন্ধ্যার মামা হতে বলেছিল।
কথাগুলো ভেবে সৃজার বাবা দীর্ঘশ্বাস ফেলে। জ্যোৎস্নার পরিবারকে সে চেনে না। জ্যোৎস্নার মৃত্যুর পর শুধু জানলো, সৌম্য’র বাবা ২য় বিয়ে করেছিল,, এইটুকু-ও সৌম্য’র মুখে শুনেছে।
সৃজার মা চিন্তিত কণ্ঠে বলেন,
– ওরা যদি সৌম্য’দের খুঁজে পায়, তখন কি হবে?
সৃজার বাবা ঝাপসা চোখজোড়া মুছে বলেন,
– জ্যোৎস্নার ছেলে মেয়ে আমার কাছে আমানতের মতো। ওদের আমি ঠিক র’ক্ষা করব। চিন্তা কর না।
এরপর পকেট থেকে ফোন বের করে সাধনের নাম্বারে কল করে।

সাধন, সোহা,, সন্ধ্যা, সৌম্য আর সৃজাকে নিয়ে কিছুক্ষণ আগে তাদের এক ছোট্ট বাড়িতে এসেছে। কাঠের ছোট্ট একটি বাড়ি। দু’টো রুম আছে এখানে। সৌম্য, সন্ধ্যা অবাক হলো। কেউ নেই এখানে। সৌম্য বলে,
– তোমরা একাই থাকো? আর কেউ নেই?
সোহা হেসে বলে,
– আর কে থাকবে? আমি আর ভাইয়া একাই থাকি এখানে।

সাধন সোহাকে এই ঘরটা সুন্দর করে গুছিয়ে দিতে বলে, সৌম্য আর সে এখানে থাকবে। সোহা সন্ধ্যা আর সৃজা পাশের রুমে থাকবে। সোহা ভাইয়ের কথামতো ঘর গোছাতে লাগলো। সুন্দর করে বিছানা ঝেড়ে সন্ধ্যা আর সৃজার সাথে গল্প করে। সন্ধ্যা ইশারায় বোঝায়। সোহা-ও সুন্দর মতো বুঝে যায়।
ওদিকে সাধন পাশের ঘর ঠিকঠাক করে এই ঘরে এসে দেখল সোহা ঘর ঝাড়ু না দিয়েই আবার-ও গল্পে মেতেছে। রাত হয়েছে, আর এই বিচ্ছু কাজ বাদে আবার-ও গল্প করতে লেগে পড়েছে। এগিয়ে এসে ঠাস করে সোহার মাথায় মা’রে। সোহা-ও রে’গে তার ভাইকে মা’রে। সাধন এবার আরও রে’গে যায়। এর একটু-ও আদব নেই। তাকে কিভাবে মা’রে! কথাটা বেবে সাধন সোহার ঘাড় ধরে সমানে পিঠে থা’প্প’ড় দেয়। আজ একে আদব শিখিয়েই ছাড়বে। বড় ভাইয়ের গায়ে হাত তুলবে কেন। সৌম্য আর সন্ধ্যা হতভম্ব হয়ে চেয়ে আছে। সৌম্য দ্রুত এগিয়ে গিয়ে সাধনকে টেনে ছাড়িয়ে নেয় আর বলে,

– মেয়েটাকে এভাবে মা’র’ছ কেন? ব্যা’ঘা’তে লেগে যাবে। তুমি তো দেখছি ভাই হয়ে বোনকে মে’রে মে’রে আমার মান-ও ডুবাবে। আমি আমার বোনুকে একটা টাচ না করে-ও শুনবো, ভাইয়েরা বোনদের শুধু মা’রে।
সন্ধ্যা আর সৃজা সোহাকে টেনে ধরে রেখেছে। সৌম্য’র কথা শুনে সন্ধ্যা সৌম্য’র দিকে তাকিয়ে হাসে। সৌম্য সন্ধ্যার দিকে অসহায় মুখ করে তাকায়। সোহা সন্ধ্যা আর সৃজার থেকে নিজেকে ছুটিয়ে নিয়ে তেড়ে যায় সাধনের দিকে। গিয়ে ঠাস ঠাস করে গালে গালে সবখানে সমানে থা’প্প’ড় মা’রে। তাকে কতগুলো মা’র’লো। সে ছেড়ে দিবে না-কি! এদিকে সোহার এমন কাজে আবার-ও সৌম্য, সন্ধ্যা চোখ বড় বড় করে তাকায়। সাধন রে’গেমেগে সৌম্যকে ধাক্কা দিয়ে সোহার চুল টেনে ধরে দু’গালে সমানে চড়ায়। সৌম্য সাধনকে টানলে-ও সাধনকে একটু-ও টলাতে পারেনা। ওদিকে সন্ধ্যা-ও সোহাকে টেনে ছাড়াতে চাইছে। কিন্তু পারছে না।

এক পর্যায়ে সাধন গায়ের জোরে সোহাকে ধাক্কা দেয়। ফলস্বরূপ সোহা ঘরের কোণায় উল্টে পড়ে, পাশে রাখা বটির উপর ডানহাত গিয়ে পড়ে। টেবিলের কোণায় গিয়ে কপাল লাগে, একইসাথে ঘরের দেয়ালের সাথে মাথায় অনেক জোরে ধাক্কা খায়। মেয়েটা ফুঁপিয়ে ওঠে। সন্ধ্যা দৌড়ে গিয়ে সোহাকে টেনে তোলে। ডান হাতের একটু কেটেছে। বেকায়দায় লাগলে আজ কি হয়ে যেত! কপালের কোণায় কেটেছে৷ সোহা মাথার পিছনে হাত রেখে ফোঁপাচ্ছে৷ সন্ধ্যা অসহায় চোখে তাকালো।
সৃজা রে’গে বলে,

– সাধন ভাইয়া তুমি কি জীবনে-ও ভালো হবা না? শুধু মা’র’তেই থাকো।
কথাটা বলে সে-ও সোহার কাছে গিয়ে বসে।
সোহার অবস্থা দেখে সৌম্য’র এতো রা’গ হলো। একটা ভাই তার বোনকে এভাবে কি করে মা’র’তে পারে? সৌম্য’র মাথা-ই কাজ করেনা। তার কি হলো কে জানে! তীব্র রা’গে সৌম্য সাধনকে টেনে সাধনের গা’লে জোরেসোরে একটা থা’প্প’ড় মে’রে দেয়৷ সৌম্য’র কাজে সাধন সহ সোহা, সন্ধ্যা, সৃজা সবাই বিস্ময় চোখে তাকায়৷ সৌম্য রে’গে বলে,
– তুমি কি মানুষ? ও তোমার বোন নয়? নিজের বোনকে কেউ এভাবে মা’রে? আজ যদি তোমার বোন ম’রে যেত! কিভাবে ধাক্কা দিয়েছ। বোনকে কাছে পাও এজন্য কদর করনা৷ কখনো হারিয়ে গেলে বুঝতে পারবে বোন কি জিনিস!
কথাগুলো বলতে বলতে সৌম্য’র গলা ভারি হয়ে আসে। বোনুর শূণ্যতা তার পূরণ হয়না৷ সে ভুলতে পারেনা, সন্ধ্যাকে হারিয়ে ফেলার পর সেই বি’ষা’দ’ময় দিনগুলো৷ সন্ধ্যা ঝাপসা চোখে তার ভাইয়ের দিকে চেয়ে রইল। সৌম্য এগিয়ে এসে সন্ধ্যার উদ্দেশ্যে বলে,

– বোনু সোহাকে নিয়ে বিছানায় বসিয়ে দে৷ র’ক্ত মুছে দে। তারপর আমরা এখান থেকে চলে যাবো।
সোহা অবাক হয়ে বলে,
– আপনি চলে যাবেন সৌম্য ভাইয়া?
সৌম্য মৃদুস্বরে বলে,
– হ্যাঁ। আমার দুই নাম্বার বোনু সোহাকেও সাথে নিয়ে যাবো। তোমাকে আর মা’র খেতে হবে না৷
সোহা অবাক হয়ে সৌম্য’র দিকে তাকায়৷ সৌম্য কত ভালো! সন্ধ্যা মৃদু হাসলো।
সৃজা মুখ ফসকে বলে,

– সোহাকে একদিনেই বোন বানিয়ে ফেললেন? আর আমি একমাসের বেশি হয়ে গেল, একসাথে থাকছি। তাও আমাকে বোন ভাবতে পারছেন না? আপনি এতো কিপ্টা কেন?
সৌম্য বিরক্ত চোখে তাকায় সৃজার দিকে। সোহা হেসে বলে,
– আরে সৃজা আপু রা’গ কর না। সৌম্য ভাইয়া তোমাকে-ও মনে মনে বোন ভাবে।
সৌম্য সন্ধ্যাকে তাড়া দিয়ে বাইরে যেতে যেতে বলে,
– আমার পার্সোনাল লাইফ নিয়ে কথা বলা মানুষদের আমি পছন্দ করিনা।
সৃজা বুঝলো, সে ইরাবতী নামের সেই মেয়েটির কথা বলায় সৌম্য’র এতো রা’গ।
এরপর সন্ধ্যা আর সৃজা সোহাকে ধরে ধরে বিছানায় বসায়৷ সাধন স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে৷ দৃষ্টি সোহার দিকে। সোহা সাধনকে মুখ ভেঙায়৷ সে তার ভাই পেয়ে গেছে। এই ভাইয়ের কাছে মা’র খাওয়ার জন্য আর থাকবে না। সন্ধ্যা সোহার মুখ চেপে ধরে। ইশারায় এরকম করতে না করে।
সাধন সোহার ব্যঙ্গতে কোনো প্রতিক্রিয়া দেখালো না। চুপচাপ তাকিয়ে রইল সোহার দিকে। এরপর দ্রুত ঘর থেকে বেরিয়ে যায়।
সৌম্য উঠানের এক কোণায় বসে আছে। সাধন এগিয়ে গিয়ে বলে,

– আমার বোনকে নিয়ে যেতে দিব না আমি।
সৌম্য পিছু ফিরে বলে,
– তোমার বোন নিজেই আমার সাথে যাবে। শুনে দেখ।
সাধন চুপ থাকলো। এরপর সৌম্য’র পাশে বসে বলে,
– আমি ওকে ইচ্ছে করে মা’রি’নি।
সৌম্য গম্ভীর গলায় বলে,
– যারা বোনদের মা’র’তে কোনো পরোয়া করেনা, বাঁচলো না-কি ম’র’লো দেখেনা। তাদের আমি পছন্দ করিনা। তুমি আমার অপছন্দের তালিকায় চলে গিয়েছ। সোহা সন্ধ্যার সাথেই থাকবে। আমি সন্ধ্যার মতো সোহাকে-ও আমার আরেকটি বোনু হিসেবে মেনে নিয়েছি।
সাধন চুপচাপ শুনলো সৌম্য’র কথা। এরপর মলিন মুখে বলে,

– আমার তো সোহা ছাড়া কেউ নেই।
– এজন্যই দয়ামায়া’হীনভাবে মা’রো? আজ যদি ম’রে যেত?
– ছোটবেলায় বাবা মা মা’রা গিয়েছে। এরপর সোহাকে আমি-ই তো দেখে রাখলাম। কখনো কখনো নিজে না খেয়ে ওকে খাইয়েছি। তোমরা শুধু মা’র টাই দেখছ কেন?
– কারণ তোমার মা’র সাংঘাতিক।
সাধন চুপ হয়ে গেল। সৌম্য আড়চোখে সাধনের দিকে তাকায়। সাধন পকেট থেকে ফোন বের করে মাটিতে রাখতে গিয়ে-ও ফোনের স্ক্রিনে চোখ পড়লে কিছু দেখে ফোনের লক খুলে দেখল সৃজার বাবার নাম্বার থেকে অনেকগুলো কল এসেছিল বেশ অনেকক্ষণ আগে। সাইলেন্ট বলে বুঝতে পারেনি। নোটিফিকেশনে মেসেজ চেক করল। সৃজার বাবার নাম্বার থেকে মেসেজে লেখা,

– সাধন সৌম্য আর সন্ধ্যাকে নিয়ে এই শহর থেকে কয়েকদিনের জন্য দূরে কোথাও যেতে পারবে বাবা? সৌম্য’কে বলবে, ওদের শত্রু এখানে-ও চলে এসেছে। তুমি ওদের তোমার চেনাপরিচিত কোনো জায়গায় নিয়ে যেতে পারবে বাবা? আমার এই কথাটা রাখো তুমি। আগামীকাল সকাল সকাল যেন দেরী করনা বাবা।
মেসেজটি পড়ে সাধন ভ্রু কুঁচকে তাকায়। এরপর সৌম্য’র দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলে,
– আঙ্কেল এসব কি মেসেজ দিয়েছে দেখ তো।

সৌম্য সাধনের ফোনে মেসেজটি পড়ে অবাক হলো। সন্ধ্যাকে রে’প করার চেষ্টা, তাকে মে’রে ফেলার চেষ্টা, এসব মনে পড়তেই সৌম্য’র গলা শুকিয়ে আসলো। কারা এমন করছে? সে আর তার বোনু কার কি ক্ষ’তি করেছে? ইরার বাবা তার বোনকে মে’রে ফেলতে চাইছিল, কিন্তু সে তো ইরাবতীর থেকে অনেক দূরে চলে এসেছে। তাহলে? সৌম্য বুঝতে পারে না, তবে ইরার বাবাকে বিশ্বাস-ও করেনা। লোকটি খুব নিচু মনমানসিকতার লোক। উনাদের মতো মানুষদের দ্বারা হয়তো সবই সম্ভব।
সৌম্য ভ’য় পায় ভীষণ। তার বোনকে সে হারাতে হারাতে ফিরে পেয়েছে। আবার-ও কি করে হারাবে? বোনুর কিছু হলে সে বাঁচবে কি করে?
মামা যেহেতু এই শহরে থাকতে নিষেধ করেছে, নিশ্চয়ই এমনি এমনি বলেনি। কিন্তু সে কোথায় যাবে? হাতটা-ও একদম খালি।
সৃজার বাবাকে একবার কল করতে গিয়ে-ও করল না। হয়তো ঘুমিয়েছে। অনেক রাত হয়েছে তো।
সাধন সৌম্য’কে ঝাঁকিয়ে বলে,

– কি হয়েছে? তোমাদের কি কোনো সমস্যা হয়েছে?
সৌম্য সাধনের দিকে তাকালো না। সাধন মলিন মুখে বলে,
– আমি আর সোহাকে মা’র’বো না। ওকে মে’রে আমার-ও খুব খারাপ লেগেছে। সোহার মতো আমাকে-ও ভাই হিসেবে মেনে নাও। আমার আর সোহার দু’জনের-ই কেউ নেই।
সৌম্য সাধনের দিকে তাকালো। সাধন মৃদু হেসে বলে,
– তুমি কিন্তু আমাকে থা’প্প’ড় মে’রে’ছ। আমি কিছুই বলিনি। তোমাকে ভাইয়ের মতো ভেবেছি, এজন্যই নিজের ভুল মেনে তোমার শাসন সাদরে গ্রহণ করেছি।
সৌম্য মৃদু হাসলো। ছেলেটা সোহার মতোই মিশুক। খুব দ্রুত মানুষকে আপন করে নিতে পারে এরা দুইভাইবোন। সাধন আবার-ও বলে,

– তোমাদের সমস্যার কথা কি আমি জানতে পারি? তুমি বলতে না চাইলে সমস্যা নেই।
সৌম্য দীর্ঘশ্বাস ফেলল। আকাশপানে চেয়ে বিষন্ন কণ্ঠে বলে,
– যখন আমার ১৭ বছর বয়স, তখন আমার বাবা তার দ্বিতীয় বউসহ আর একটি ১০ বছরের মেয়েকে সাথে আনে আমাদের বাসায়। অনেক আগেই লুকিয়ে বিয়ে করে অন্যজায়গায় রেখেছিল। তারপর একদিন বাবা তার দ্বিতীয় বউকে নিজের বাড়ি নিয়ে আসলো। মায়ের সাথে খুব খারাপ ব্যবহার করেছিল। অনেকগুলো থা’প্প’ড় মে’রেছিল। আমি আটকাতে গিয়ে আমি-ও মা’র খেয়েছিলাম বাবার হাতে।
এরপর মা ঘরের এক কোণায় গিয়ে শব্দ করে কাঁদছিল। আমি আর বোনু মায়ের পাশে গিয়ে বসলে মা আমাদের দু’জনকে জড়িয়ে ধরে সেদিন খুব কেঁদেছিল। মায়ের কান্না দেখে বোনু-ও কাঁদছিল। আমার চোখ ভিজে যাচ্ছিল। আমি মাকে বলেছিলাম,

– মা তুমি কান্না কর না। আমি এইচএসসি পরীক্ষা দিয়ে কিছু একটা করে তোমাকে আর বোনুকে এখান থেকে নিয়ে যাবো।
মা কান্নার মাঝে-ও একটু হেসেছিল। আমার কপালে চুমু খেয়ে বলেছিল,
– আমার আব্বা তুই। কিছু করতে হবে না সোনা। আমি আছি না?
বোনু দু’হাতে চোখ মুছে বলেছিল,
– সৌম্য ভাইয়া তোমার আব্বা, তাহলে আমি কি?
মা বোনুর দু’গালে চুমু খেয়ে বলেছিল,

– তুই আমার আম্মা। আমার আব্বা, আম্মা থাকতে আমার কোনো ক’ষ্ট নাই।
সৌম্য’র এইটুকু কথা শুনে সাধন বলে ওঠে,
– তার মানে সন্ধ্যা কথা কথা বলতে পারতো? এইজন্যই আমি ভাবতাম, সন্ধ্যা শুনতে পায়, তবে কথা কেন বলতে পারেনা। কি হয়েছিল সন্ধ্যার?
সৌম্য’র গলা ধরে আসে। চোখ থেকে টুপ করে একফোঁটা পানি গড়িয়ে পড়ে। সময় নিয়ে নিজেকে সামলে ধরা গলায় বলে,

– মা আমাদের সেদিন সান্ত্বনা দিলে-ও নিজেকে সান্ত্বনা দিতে পারেনি। একসপ্তাহের মাথায়, ভোরে আলো চোখের উপর এসে পড়লে আমি জেগে যাই। মা প্রতিদিন ফজরে আমাকে ডেকে দিত। কিন্তু সেদিন ডাকেনি। আমি অবাক হয়েছিলাম। এরপর মায়ের ঘরে গিয়ে মাকে ডাকলে মা সাড়া দেয় না। আমার ডাকে বোনু ঘুম থেকে উঠে পড়ে। কিন্তু মা ওঠেনা। আমি আর বোনু এতো করে ডাকলাম, মা আর উঠলোই না। আমাদের মাথায় হাত বুলিয়ে আর বলল না, – আব্বা, আম্মা আমাকে এতো ডাকিস কেন? একটু ঘুমাতে-ও দিবিনা?

মা এই কথা মাঝে মাঝেই বলতো। কিন্তু সেদিন আর বলেনি। সেদিনের পর থেকে আর কখনো বলেনি। আমি, বোনু গলা ফাটিয়ে কেঁদেছিলাম, মা একবার-ও সাড়া দিল না। রাত্রেই মা আমাকে আর বোনুকে ভাত মাখিয়ে তুলে খাওয়ালো, কত আদর করল, আমাদের আব্বা আম্মা বলে ডাকলো। সকাল হতে না হতেই মা একেবারে ঘুমিয়ে গেল।
এরপর কতরাত বোনু না ঘুমিয়ে মায়ের জন্য কাঁদতো। মা মা করে ডাকতো। আমি চোখ মুছে বোনুকে জড়িয়ে সান্ত্বনা দিতাম। ঘুম পাড়িয়ে দিতাম।
এটুকু বলে সৌম্য থামে। দু’হাতের মাঝে মুখ নিয়ে নিঃশব্দে চোখের পানি ফেলে। খুব মনে পড়ে মাকে। সাধন সৌম্য’র কাঁধে হাত রাখলো। সৌম্য নিজেকে সামলে ভাঙা গলায় বলে,

– সৎ মাকে আনার পর থেকেই বাবা আমাদের সাথে আগের মতো কথা বলতো না। আর মা মা’রা যাওয়ার পর বাবা যেন ভুলেই গেল, আমি আর বোনু তার-ই সন্তান। প্রায়-ই আমি ভাতের হাঁড়িতে ভাত খুঁজে পাইনি। বোনু ক্ষুধায় কাঁদতো। আমি কোথায় পাবো খাবার? সৎ মাকে গিয়ে বললে, সে কথার আগে থা’প্প’ড় মে’রে বলতো, আগে টাকা ফেল। তারপর খাবার চাইবি। ভরা চোখে বাবার দিকে তাকালে বাবা মুখ ফিরিয়ে নিত। মা মা’রা যাওয়ার পর বাবার ওই রূপটা আমাদের দুই-ভাইবোনের জন্য বি’ষ ছিল।

মা আমাকে টিফিন খাওয়ার টাকা দিতো। আমি কখনো খেতাম না। মা অনেক ক’ষ্ট করত। ওই টাকা খরচ করতে ইচ্ছে করতো না। জমিয়ে জমিয়ে আবার মাকে ফেরত দিতে চেয়েছিলাম। কিন্তু মা তো চলে গেল। আমি সেখান থেকে বোনুকে রুটি কলা এনে খাইয়ে ঘুম পাড়াতাম। মাঝে মাঝে একজনের ভাত থাকতো। গরম ভাতেই পানি দিয়ে রেখে দিত সৎ মা, যাতে না খাই আমরা। কি করব? বোনু ক্ষুধায় কাঁদতো। ওই পান্তা বেড়ে কাঁচা মরিচ আর লবণ দিয়ে মাখিয়ে খাইয়েছি। বোনুর পেট ভরে পাতে থাকলে দু’একবার আমি খেতাম, না থাকলে আমার আর খাওয়া হতো না।
কথাগুলো বলে সৌম্য একটু দম নেয়। এরপর আবার-ও বলে,

– একবছরের মাথায় আমি এইচএসসি দিলাম। এরপর এ্যাডমিশনের প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম। আমার ইচ্ছা ছিল সাইন্স নিয়ে পড়ার। কিন্তু এতো প্রায়ভেট কিভাবে পড়তাম? তাই মাকে কখনো বলাই হয়নি, আমি সাইন্স নিয়ে পড়তে চাই। এ্যাডমিশনের প্রস্তুতিটা আমার জন্য ছিল খুব কঠিন। বই, খাতা কিছু ছিল না আমার। প্রথম এক মাস আমার গ্রামের পরিচিত বন্ধুদের থেকে বই নিয়ে পড়তাম। আর একটা স্যারের কাছে শুধু একাউন্টিং সাবজেক্ট পড়তাম।
সাধন বলে,

– সেই স্যার তোমার থেকে টাকা নিতো না তাইনা?
সৌম্য একটু হেসে বলে,
– একটা কথা জানো সাধন? যাদের মা বেঁচে থাকেনা, একটি পোকা-ও তাদের পাশে এসে দাঁড়ায় না।
সাধন মৃদুস্বরে বলে,
– ঠিকই বলেছ।
সৌম্য দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে,

– এডমিশনের তিনমাস আমি একজায়গায় রংমিস্ত্রির কাজ করেছিলাম। প্রথম মাসের টাকা পেয়ে কিছু বই কিনেছিলাম। সেখান থেকেই স্যারের টাকা মিটিয়ে দিয়েছিলাম। এরপর প্রায় তিনমাস এডমিশনের জন্য প্রিপারেশন নিলাম। পাশাপাশি মিস্ত্রির কাজ করলাম। সকালে বেরিয়ে যেতাম, সন্ধ্যার আগে আগে বাড়ি ফিরে প্রায়ভেট যেতাম। এরপর রাতে বাড়ি ফিরে বই পড়তাম। আমার বোনু ছোট হলে-ও আমার কাজ এগিয়ে দিত, তার ভাই পড়তো যে! এরপর এক্সাম চলে আসলো। কেন্দ্র দিয়েছিলাম রাজশাহী। পরীক্ষার দিন খুব ভোরে রেডি হয়ে নিলাম। বোনু আমাকে জড়িয়ে ধরে বলেছিল,

– সৌম্য ভাইয়া আমি তোমার ছোট মা, আর মায়েরা দোয়া করলে দোয়া কবুল হয়। আমি দোয়া করেছি। তোমার পরীক্ষা অনেক ভালো হবে।
এরপর বোনুকে সাবধানে থাকতে বলে বাবাকে একবার বলে বেরিয়ে যাই। পরীক্ষা ভালো হয়েছিল। ঢাকা ভার্সিটিতে একাউন্টিং নিয়ে চান্স হয়ে গেল। সবচেয়ে বেশি খুশি হয়েছিল আমার বোনু। মিস্ত্রি হয়েছিলাম বলে ভার্সিটিতে ভর্তি হতে পেরেছিলাম। বাবা ফিরে-ও দেখত না আমার দিকে। বোনুকে রেখে আসতে ভীষণ ক’ষ্ট হচ্ছিল। ওকে কাদের কাছে রেখে এসেছি? ওরা কেউ আমার আর বোনুর আপন নয়।

বোনুকে আমার সাথে ঢাকায় আনতে চেয়েছিলাম। তখন বোনুকে এনে কোথায় রাখতাম? আমার পকেটে ছিল দুই হাজার টাকা। কোথায় থাকবো, এটাই বুঝতে পারছিলাম না, বোনুকে আনলে রাস্তায় রাখতে হতো। ভাবলাম নিজেকে একটু গুছিয়ে নিয়ে বোনুকে ঢাকা শহরে নিয়ে যাবো। কিন্তু যতটা সহজ ভেবেছিলাম, কাজটা তত সহজ ছিল না। নিজেই ঠিক করে খেতে পারতাম না। বোনুকে এনে কি করতাম?
প্রথম কয়েকমাস ক্লাস করার পর ছুটি পেয়ে গ্রামে ছুটে যাই বোনুকে দেখতে। বোনুকে ছাড়া ওটাই প্রথম দূরে থাকা ছিল।
বাড়ির দরজায় পা রেখেছিলাম, হাসবো বলে। কিন্ত দরজায় পা রাখতেই ঘর থেকে বোনুর চিৎকার শুনে দৌড়ে ঘরে গেলাম। দেখলাম, বোনু মাটিতে শুয়ে দু’হাতে গলা ধরে গলা কাটা মুরগির মতো ছটফটাচ্ছে। পাশেই আমার সৎ বোন চুপচাপ দাঁড়িয়ে দেখছিল। আমি দৌড়ে গিয়ে বোনুকে দু’হাতে জড়িয়ে নিয়ে বলি,

– কি হয়েছে বোনু?
বোনু শুধু গলা দেখাচ্ছিল। কিছুক্ষণ পর আর আওয়াজ বের হচ্ছিল না বোনুর গলা দিয়ে। আমি সময় নষ্ট না করে বোনুকে হসপিটালে নিয়ে যাই। ডক্টর বোনুকে দেখে বলে,
– বোনুকে কস্টিক সোডা খাওয়ানো হয়েছে। এর ফলে গলার ভেতর পুড়ে গিয়েছে। দেরি করিনি বলে বাঁচাতে পেরেছে। তবে বোনু আর কখনো কথা বলতে পারবেনা। কিন্তু অপারেশন করালে কথা বলতে পারবে। যদি-ও সম্ভাবনা খুব কম।
কথাগুলো শুনে পুরো দুনিয়া কেঁপে উঠেছিল আমার। অপারেশন করাতে অনেক টাকার প্রয়োজন, আমি তো তিনবেলা খেতেই পারিনা। অপারেশন করাবো কি করে?

চুপচাপ বাড়ি ফিরলাম বোনুকে নিয়ে। এরপর জানতে পারলাম আমাকে নিয়ে সৎ মা আর সৎ বোন অনেক উল্টাপাল্টা কথা বলছিল। বোনু দু’টো কথার উত্তর দিয়েছিল বলে সকাল আর তার মা মিলে কার থেকে যেন এসব আনিয়ে তার বোনকে অন্যনাম দিয়ে খাইয়ে দিয়েছে।
আমি কিছু বলার মতো ভাষা খুঁজে পাচ্ছিলাম না। বাবার কাছে গিয়ে বললাম,
– বাবা তোমার বউ আর মেয়ে আমার বোনের গলা পুড়িয়ে দিয়েছে। এখন-ও কিছু বলবেনা তুমি?
বাবার উত্তর ছিল,

– তোমার বোনের গলার আওয়াজ বেড়ে গিয়েছিল। ওরা শাস্তি দিয়েছে। এখানে আমি কি বলব?
সেদিন বাবার কথা শুনে এতো অবাক হয়েছিলাম, এতো ক’ষ্ট হচ্ছিল, শুধু বাবাকে দেখছিলাম। পরের মানুষকে কি বলব, যেখানে নিজের বাবা-ই এসবকে সাপোর্ট করে?
বোনু ঘরের কোণায় বসে বসে কাঁদছিল। আমি কিভাবে সান্ত্বনা দিব বোনুকে? আমার নিজের-ই কাঁদতে ইচ্ছে করছিল। তবুও নিজেকে সামলে বোনুকে জড়িয়ে সান্ত্বনা দিলাম। যাদের কেউ নেই, তাদের আল্লাহ আছে। ওই জা’নো’য়া’র গুলোর বিচার আল্লাহ-ই করবে।
কথাগুলো বলে সৌম্য লম্বা করে শ্বাস ফেলে। সাধনের চোখের কোণে জল চিকচিক করছে। হঠাৎ সৌম্য রাগান্বিত স্বরে বলে,

– ওই বাবা নামে জা’নো’য়া’রকে যদি কখনো কু’কু’র ছিঁড়ে-ও খায়, আমি এক পা-ও এগোবো না তাকে বাঁচাতে। শুধু চেয়ে চেয়ে দেখব।
কথাটা বলতে গিয়ে সৌম্য’র গলা ধরে আসে। মনে পড়ে, ছোটবেলার কথা, যখন তার বাবা তাকে ঘাড়ে নিয়ে গ্রাম ঘুরতো। মন বলে, পারবে না হয়তো। একদিন হলে-ও বাবা তার মাথায় স্নেহের হাত বুলিয়ে দিয়েছিল। এসব ভাবলে রা’গ পড়ে গিয়ে ক’ষ্টরা এসে ভিড় করে। মানুষ কেন বদলে যায়?
সৌম্য নিজেকে সামলে নিয়ে ভারী গলায় বলে,

– ছুটি শেষে বোনুকে রেখে আসতে মন স্বায় দেয়না। একবার ভাবলাম, পড়া বাদ দিয়ে দিব। বোনু নিজেই আমাকে ঠেলে পাঠালো। বুঝদারের মতো বোঝালো, সে না পড়লে তারা তো এই বাড়িতেই সারাজীবন পড়ে থাকবে। আর সন্ধ্যা আরও সাবধানে থাকবে। ওরা আর কিছু করতে পারবে না।
এরপর এভাবেই আমার অনার্স শেষ হলো। মাস্টার্সের ফার্স্ট ইয়ার শেষ হলো। সেকেন্ড ইয়ারের শেষে জানলাম বোনুকে বাবা বিক্রি করে দিয়েছে। কতবার ঠিকানা জানতে চাইলাম, কেউ বোনুর ঠিকানা বলেনি। দিনগুলো যে কিভাবে পার করেছি, একমাত্র আমি জানি। আর তারপর হঠাৎ বোনুর খোঁজ পেয়ে গেলাম। বিনিময়ে ইরাবতীকে কত কাঁদালাম!
সৌম্য’র আওয়াজ ক্ষীণ হয়ে আসে। সাধন জিজ্ঞেস করে,

– ইরাবতী কে?
সৌম্য দু’হাতের মাঝে মুখ ঠেকিয়ে ধরা গলায় বলে,
– ইরাবতী আমায় খুব ভালোবাসে। এতোটা ভালোবাসে, যে ভালোবাসার যোগ্য আমি নই। ওকে কোনোদিন একটু-ও হাসাতে পারিনি। ও আমাকে ভালোবেসে হাসতে ভুলে গিয়েছে, পেয়েছে শুধু ক’ষ্ট।
এরপর সৌম্য সাধনের দিকে ভেজা চোখে তাকায়। একটু হেসে বলে,
– জানো সাধন, ইরাবতী আমার পা ধরেছিল ওর সাথে থাকার জন্য। কিন্তু আমি তাকে ফিরিয়ে দিয়েছি। ওর থেকে কথা নিয়েছি, ও যেন ওর মতো বড় ঘরের কাউকে বিয়ে করে নেয়। কত স্বার্থপর আমি!
কথাগুলো বলে একটু থামে। এরপর ভাঙা গলায় বলে,

– ইরাবতীর খাতায় এই পৃথিবীর সবচেয়ে স্বার্থপর মানুষটা আমি। হয়তো সারাজীবন আমি-ই থাকবো। আমাদের মতো মধ্যবিত্ত-নিম্নবিত্তরা ভালোবেসে কখনো মহান হতে পারে না। বরং তারা ভালোবাসা নামক অধ্যায়ে সবচেয়ে স্বার্থপর হিসেবে আখ্যায়িত হয়। এটাই আমাদের নিয়তি।
এরপর একটু থেমে সৌম্য আবার-ও বলে,
– আমি আর বোনু বেশ অনেকটা সময় বাবা মায়ের আদর পেয়েছিলাম। তারপর একদিন মা মা’রা গেল, আর বাবা বদলে গেল। আমদের অবস্থা অথৈ সাগরে হাবুডুবু খাওয়ার মতো হলো।
এই যেমন,

আল্লাহ আমাকে আর বোনুকে নদীর তীরে খুব সুন্দর একটি নৌকা উপহার দিয়েছিল। বোকা আমি আর বোনু ভেবেছিলাম পুরো নদী আনন্দে ভ্রমণ করব। কিন্তু আল্লাহ আমাদের নদীর মাঝখানে এনে ফেলে দিয়েছে, আর তারপর যতবার সাঁতরে উঠতে গিয়েছি। কেউ না কেউ এসে পানির মাঝে ঠেসে ধরেছে। দম আটকে আসতো আমাদের, আর তখন-ই আল্লাহ ঘোষণা করত, আমাদের হায়াত এখনো বাকি। দুঃখ পাওয়া বাকি! এভাবেই বেঁচে আছি আমরা।
সাধন মলিন মুখে সৌম্য’র দিকে চেয়ে আছে। সৌম্য উঠে দাঁড়িয়ে বলে,

– বোনুকে পেয়ে খুব খুশি হয়েছিলাম। অনেকদিন পর একসাথে বসে খেতে চেয়েছিলাম। কিন্তু ওই যে দুঃখ ছাড়া আমাদের জীবন অপূর্ণ। তাই আমাকে কেউ এসে চা’কু মে’রে গেল। আর আমার বোনকে রে’প করার চেষ্টা করল। যখন আমার বোনু শ্বাস আটকে ছটফট করতে লাগলো, তখন আল্লাহ আবার-ও বাঁচিয়ে নিল নতুন দুঃখ দেয়ার জন্য। এই যে খারাপ লোকেরা আবার-ও আমাদের পিছু নিল।
সাধন শার্টের হাতা দিয়ে চোখ মুছে সৌম্য’কে জড়িয়ে ধরল। সৌম্য অবাক হলো না। সাধন খুব নরম মনের মানুষ, এটুকু সময়ে চিনেছে সে। সাধন মৃদুস্বরে বলে,

– সন্ধ্যার অপারেশন আমি আর তুমি দু’জন মিলে করাবো। তুমি এটা নিয়ে চিন্তা কর না কেমন?
সৌম্য কিছু বলল না।
সৌম্য আর সাধন বাইরে বেরিয়ে আসার পর পর সন্ধ্যা, সোহা আর সৃজা বাইরে বেরিয়েছিল। সৌম্য’র বলা সব কথা শুনে সৃজা আর সোহা বিস্ময় দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। দু’জনের চোখজোড়া অসংখ্যবার ভিজেছে। সোহা সন্ধ্যার গলায় হাত দিয়ে বলে,
– সন্ধ্যা আমার অনেক খারাপ লাগছে, জানো?
সৃজা মলিন মুখে সন্ধ্যার দিকে চেয়ে আছে। এইটুকু মেয়ে কতকিছু সহ্য করেছে। সন্ধ্যা সোহার দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসলো। সোহা নাক টেনে বলে,

– শোনো আমার ভাইয়া এক নাম্বারের ব’জ্জা’ত। কিন্তু মাঝে মাঝে আবার অনেক ভালো। দু’টো ভাই মিলে তোমার গলার অপারেশন করালে তুমি আবার কথা বলবে। উফ! আমার ভাবতেই কি যে ভালো লাগছে!
সন্ধ্যার ঠোঁটের কোণে হাসি। তবে চোখের কোণে পানি জমছে অনবরত। ডক্টর বলেছে, সম্ভাবনা খুবই কম। তাছাড়া সেদিনের পর কতবছর পেরিয়েছে। সে আর কথা বলতে পারবে না, সে বোঝে।
সৌম্য পিছন থেকে বলে,
– এখানে কি করছিস বোনু?
সন্ধ্যা পিছু ফিরে দু’হাতে সৌম্য’কে জড়িয়ে ধরে। কতবছর হয়ে গেল, সে কথা বলতে পারেনা। ভাইয়া বলে ডাকতে পারেনা, মা বলে ডাকতে পারেনা। কথাগুলো ভেবে সন্ধ্যার দলা পাকিয়ে কান্না আসলো। ভাইয়ের বুকে মাথা রেখে ফোঁপালো। সৌম্য বা হাতে সন্ধ্যাকে জড়িয়ে নিয়ে ডান হাত সন্ধ্যার মাথায় রেখে বলে,

– কেন কাঁদছিস বোনু?
সন্ধ্যা যেভাবে ছিল, সেভাবেই থাকলো। সৌম্য অসহায় চোখে তাকালো। একটু পর সন্ধ্যা মাথা উঁচু করে সৌম্য’র দিকে তাকায়। চোখমুখ লাল করে ফেলেছে। সৌম্য সন্ধ্যার মুখ মুছে দিয়ে বলে,
– এভাবে তো বোকারা কাঁদে। তুই কবে স্ট্রং হবি বোনু?
সন্ধ্যা নাক টেনে মাথা নেড়ে বোঝায়, সে স্ট্রং হয়ে যাবে।
সৌম্য মৃদু হাসলো।
সোহা সাধনের পাশে গিয়ে বলে,

– তুমি আমাকে আর মা’র’বে না বলেছ।
সাধন সোহার দিকে চেয়ে রে’গে বলে,
– তুই আড়ি পাতলি কেন? এজন্য মা’র খাবি।
সোহা রে’গে বলে,
– আবার তুমি আমাকে মা’র’তে চাইছ? তুমি জীবনেও ভালো হবানা।
সাধন একটু হেসে বলে,
– এখন থেকে শুধু মুখে বলব।
সাধনের কথায় সবাই হাসলো। সোহা-ও হাসলো। সে তো ভাইয়ের ভালোবাসা বোঝে। কিন্তু সারাদিন ঝগড়া, মা’রা’মা’রিতেই সময় কাটে।

গতরাত একবারের জন্য-ও আকাশ চোখ এক করতে পারেনি। সন্ধ্যার চিন্তায় মাথা ফেটে যাওয়ার উপক্রম হয়েছিল। সবার আগে আর্টিস্ট দিয়ে সৌম্য আর সন্ধ্যার দু’টো স্কেচ তৈরী করে নেয়।
এরপর রাতেই সবাইকে খবর দিয়ে, উচ্চপদস্থ পুলিশ কর্মকর্তাদের প্রস্তুত থাকতে বলেছিল। ডিবি, স্পেশাল ব্রাঞ্চ সবকিছু নিয়ে পুরো সিলেট শহর সারাদিন ঘুরেছে। সৃজাদের গ্রামের প্রতিটা মানুষ ছবি দু’টো দেখে বলেছে তারা এই দু’জনকে দেখেছে গতকাল। আকাশ খুশি হয়েছিল। কিন্তু সিলেট শহরের প্রতিটি গ্রাম, শহর তন্নতন্ন করে খুঁজে-ও সন্ধ্যা সৌম্য’র টিকিটিও পায়নি। আকাশ অসহায় হয়ে সৃজার বাবার কাছে ফিরে এসেছে। ভেবেছিল লোকটাকে কিছু বলবে না। কিন্তু এই লোকটা তার ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে দিল। কোথায় লুকিয়েছে সন্ধ্যা আর সৌম্যকে।
আকাশ সিজানকে কোলে নিয়ে সৃজার বাবার উদ্দেশ্যে রাগান্বিত বাণী ছুঁড়ে দেয়,

– নিজের ছেলের প্রতি-ও কি আপনার মায়া নেই? এখন-ও সময় আছে বলে দিন সন্ধ্যা কোথায়?
সৃজার বাবার চোখেমুখে অসহায়ত্ব। সে সকাল থেকে সাধনকে ফোনে পায়নি। সে নিজে-ও জানেনা ওরা কোথায় গিয়েছে। জানলে-ও বলতো না। সে স্বার্থপর হতে পারবে না কখনো।
আকাশ আগের চেয়ে-ও চিৎকার করে বলে,
– কিছু বলছেন না কেন? আমার সন্ধ্যা কোথায় বলুন?
সৃজার বাবা-ও কেন যেন রে’গে গেল খুব। অতঃপর তেজী কণ্ঠে বলে,
– কি ক্ষ’তি করেছে ওরা তোমার? সন্ধ্যাকে রে’প করার চেষ্টা করে-ও সাধ মেটেনি? সৌম্য’র পেটে ছু’রি চালিয়েও ক্ষান্ত হচ্ছো না কেন তুমি? কেন এমন করছ? কারণ টা বলো?
সৃজার বাবার কথা শুনে আকাশ স্তব্ধ চোখে তাকায়। তার মাথা চক্কর দিয়ে ওঠে। কানে একটা কথা বাজছে, সন্ধ্যা রে’প। আকাশ ঢোক গিলল। সিজানকে কোল থেকে নামিয়ে দিয়ে সৃজার বাবার দিকে চেয়ে ঢোক গিলে বলে,

– কি বলছেন এসব?
সৃজার বাবা আকাশের ব্যবহারে অবাক হলো। এই ছেলে হঠাৎ এমন শান্ত হয়ে গেল কেন? আকাশ সৃজার বাবার সামনে দাঁড়িয়ে হাসফাস কণ্ঠে বলে,
– কি হয়েছিল সন্ধ্যার সাথে?
সৃজার বাবা আর-ও অবাক হলো। অতঃপর ভ্রু কুঁচকে বলে,
– সন্ধ্যাকে রে’প করার চেষ্টা করা হয়েছিল।
একটু থেমে কণ্ঠে তেজ নিয়ে বলে,
– চেষ্টা করা হয়েছিল কেন বলছি, সন্ধ্যাকে মানসিক রোগী বানিয়ে দেয়া হয়েছিল। মেয়েটার মুখের দিকে তাকানো যেত না। ট্রমার মধ্যে চলে গিয়েছিল ও। ওকে স্বাভাবিক করার ব্যবস্থা করতে না করতেই হাজির হয়ে গেলে তুমি? ওর হাত-মুখের ক্ষ’তগুলো মিশতে না মিশতেই আবার তুমি……
আকাশ দু’হাতে কান চেপে চিৎকার করে বলে,

– চুপ করুন।
সৃজার বাবা চুপ হয়ে গেল। সবাই অবাক হয়ে তাকায় আকাশের দিকে। আকাশের কণ্ঠ কাঁপছে, সাথে শরীর। চোখ দু’টো বন্ধ। এসব শুনতে চায় না সে। কে ছুঁয়েছে তার সন্ধ্যাকে? আকাশ হঠাৎ-ই সৃজার বাবার দিকে এগিয়ে গিয়ে ধরা গলায় বলে,
– আঙ্কেল আপনি এসব মিথ্যা বলছেন তাইনা? সন্ধ্যা কোথায় আঙ্কেল?
সৃজার বাবা অবাক হয়ে চেয়ে আছে। সৃজার মা সিজানকে কোলে নিয়ে আকাশকে অবাক হয়ে দেখছে। আকাশ সৃজার বাবাকে চুপ দেখে চিৎকার করে বলে,
– আপনি কেন মিথ্যা বলছেন? সন্ধ্যাকে কেউ ছোঁয়নি বলুন?
পাশ থেকে সৃজার মা মলিন গলায় বলেন,
– সৌম্য নিজে আমাদের এসে বলেছে। আর সন্ধ্যার শরীরে অনেক ক্ষ’ত ছিল। আমরা দেখেছি। মিথ্যা কেন বলব আমরা?

আকাশের বুক ভার হয়। সময়ের পাল্লা যত বাড়ে, দেহ জুড়ে ব্য’থা তত বাড়ে। এসব কি শুনছে সে? এসব শোনার মতো শ’ক্তি তার নেই।
সৃজার বাবার কাছে এগিয়ে এসে সৃজার বাবার ডান হাত তার দু’হাতের মাঝে নিয়ে অনুনয়ের সুরে বলে,
– আঙ্কেল প্লিজ বলুন! আমার সন্ধ্যা কোথায়?
সৃজার বাবা ঢোক গিলে। এই ছেলে কোনোদিক থেকেই তার কাছে সৌম্য, সন্ধ্যার জন্য খারাপ লাগছে না। কে এই ছেলে? ভাবনা রেখে তার ফোন এগিয়ে দিয়ে বলে,
– সৌম্য’র সিম নেই। আমার আরেকটি ছেলের ফোনে অনেকবার কল দিয়েছি, পায়নি। তুমি ওদের খোঁজ পেলে আমাকে জানিয়ো।

আকাশ আর একটা কথা-ও বললো না। সৃজার বাবার কথা হয়তো বিশ্বাস করে নিয়েছে। চুপচাপ বড় বড় পা ফেলে সৃজাদের বাড়ি থেকে বেরিয়ে যায়। বড় রাস্তায় দাঁড় করিয়ে রাখা গাড়ির ড্রাইভিং সিটের পাশের সিটে উঠে বসে। ড্রাইভিং সিটে বায়ান উঠে বসে। ঘাড় বাঁকিয়ে আকাশের দিকে তাকালে দেখল আকাশ সিটে হেলান দিয়ে চোখ বুজে রেখেছে। ডান হাত চোখের উপর রাখা। বায়ান মৃদুস্বরে ডাকে,
– স্যার?
আকাশ ছোট করে বলে,
– ঢাকা ব্যাক কর। ফার্স্ট।
বায়ান গাড়ি স্টার্ট দেয়। একটু পর পর আকাশের দিকে লক্ষ্য করে। তার ভীষণ খারাপ লাগছে। আকাশকে হঠাৎ কেমন নিস্তেজ লাগছে।

আকাশ সত্যি-ই নিস্তেজ হয়ে পড়ে আছে। তার কাঁদতে ইচ্ছে করছে। মনে পড়ে, সন্ধ্যার হাসিমাখা মুখ। চঞ্চল সন্ধ্যা সুযোগ পেলেই নাচতো, প্রাণ ভরে হাসতো, আকাশ দেখেছিল সন্ধ্যার ভেতরে লুকিয়ে থাকা উচ্ছ্বাস। শেষবার সন্ধ্যা তার দিকে তাকিয়ে হেসেছিল। সেই সন্ধ্যাকে কেউ ছুঁয়েছে। সন্ধ্যা বাঁচতে চেয়ে ছটফট করেছিল তাই না?
কথাগুলো ভেবে আকাশ দু’হাতে মাথার চুল টেনে ধরল। বায়ান গাড়ি সাইড করে, ভেতরের লাইট জ্বালায়। এরপর বিচলিত কণ্ঠে বলে,
– স্যার ঠিক আছেন?
আকাশ বায়নের দিকে তাকায়। বায়ান অবাক হয়। আকাশের চোখদু’টো লাল। আকাশ আবার-ও সিটে হেলান দিয়ে ভারী গলায় বলে,
– বাড়ি চলো।

রাত তখন প্রায় দু’টোর কাছাকাছি। আসমানী নওয়ানের চোখে ঘুম নেই। এজন্য ঘর থেকে বেরিয়ে ডায়নিং-এ এসে বসেছে। আকাশ কোথায় গিয়েছে কে জানে! গতকাল থেকে নেই। আর এদিকে সন্ধ্যার চিন্তায় কিছু ভালো লাগে না। হঠাৎ বাড়ির বেল বেজে ওঠে। আসমানী নওয়ান এগিয়ে গিয়ে লুকিং গ্লাস দিয়ে দেখল বাইরে আকাশ দাঁড়ানো। অতঃপর দরজা খুলে দিয়ে বলতে নেয়,
– কোথায় গেছি….
শেষ করার আগেই আকাশ তার মাকে জড়িয়ে ধরে। আসমানী নওয়ান অবাক হয়। কাঁধে ভেজা লাগলো। ভদ্রমহিলা বিস্মিত হয়। আকাশের পিঠে হাত রেখে বলে,
– কি হইছে আব্বা?

আকাশ তার মাকে ছেড়ে, মায়ের দু’হাত তার দু’হাতের মাঝে নিয়ে ভাঙা গলায় বলে,
– তুমি সব জানতে তাইনা মা? এজন্যই এতো চুপচাপ হয়ে গিয়েছ তুমি। আমি জানি, তুমি জানো সন্ধ্যা কোথায়! প্লিজ মা বলো, সন্ধ্যা কোথায়?
আসমানী নওয়ান ছেলের পানে চেয়ে অবাক। আকাশের চোখদু’টো লাল সাথে ভেজা। ভদ্রমহিলা আকাশের গালে হাত দিয়ে বলে,
– কি কইতাছ তুমি? আমি কেমন জানমু আমার জান্নাত কই?
আকাশ চেঁচিয়ে বলে,
– একদম মিথ্যা বলবে না। তুমি জানো আমার সন্ধ্যার খোঁজ।
একটু থেমে আবার-ও ভাঙা গলায় বলে,

অন্তঃদহন পর্ব ১৯

– মা, তুমি আমাকে শাস্তি দিতে চাইছ তো? আমি সব শাস্তি মেনে নিব বিশ্বাস কর। দেখ, সন্ধ্যা যাওয়ার পর মাস পেরিয়ে গিয়েছে। বিশ্বাস কর, আমি একরাত-ও শান্তিতে ঘুমাতে পারিনি। এবার আমাকে অন্যভাবে শাস্তি দাও।
আসমানী নওয়ান বাকহারা হয়ে ছেলের পানে চেয়ে আছে। আকাশ তার মায়ের দু’হাতের উপর তার কপাল ঠেকিয়ে রোধ হয়ে আসা কণ্ঠে বলে,
– মা বলো প্লিজ! আমি ম’রে যাচ্ছি। এভাবে আর থাকতে পারছি না। আমার দমবন্ধ লাগছে। সন্ধ্যাকে এনে দাও না মা!

অন্তঃদহন পর্ব ২১