অন্তঃদহন পর্ব ২৮

অন্তঃদহন পর্ব ২৮
DRM Shohag

সকালের খাবার খেয়ে সন্ধ্যা বিছানায় গা এলিয়ে দেয়। ভালো লাগছে না। ইরা আপু যে কবে সুস্থ হবে, তার সৌম্য ভাইয়া একটু হাসবে সেই আশায় মেয়েটি।
দরজা ঠেলে শিমু সন্ধ্যার ঘরে প্রবেশ করে। শিমুকে দেখে সন্ধ্যা শোয়া থেকে উঠে বসে। শিমুর হাতে একটি বাটি। এগিয়ে এসে সন্ধ্যার পাশে বসে, পাশে হাতের বাটি রেখে হেসে বলে,
– ভাবি আমার ফেবারিট খাবার। তোমার সাথে শেয়ার করতে আসলাম।
কথাটা বলতে বলতে ছোট্ট বাটিটি সন্ধ্যার মুখের সামনে ধরলে সন্ধ্যা মুখ কুঁচকে ডানদিকে ফিরে উকি করে। শিমু অবাক হয়ে বলে,

– আরে আরে কি হলো তোমার?
সন্ধ্যা ওড়না দিয়ে নাক চেপে বা হাতে শিমুর হাত ঠেলে বাটি সরিয়ে দেয়। ইশারায় বোঝায়,
– আমি এটার গন্ধ সহ্য করতে পারিনা।
শিমু অবাক হয়ে বলে,
– সিরিয়াসলি? তুমি শুটকির গন্ধ নিতে পারো না? আর আমি তো এই শুটকির গন্ধ দিয়ে-ই পুরো দুই প্লেট ভাত খেতে পারি।
সন্ধ্যা অবাক হলো। সৌম্য ভাইয়ার-ও শুটকি খুব পছন্দের খাবার। কিন্তু সন্ধ্যা এই গন্ধ সহ্য-ই করতে পারে না। শিমু হাতের বাটি থেকে চামুচ দিয়ে এক চামুচ শুটকি ভর্তা মুখে নিয়ে দেখায়,

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

– ওগো সন্ধ্যা আপা, ভাবি,, বিশ্বাস কর, কি যে সুস্বাদু খাবার এটা। তুমি মিস করলে। আকাশ ভাইয়া-ও তোমার মতো। শুটকি তার আশেপাশে দেখলে নাক ছিটকায়, যে তার আশেপাশে নিয়ে যায়, রে’গে বোম হয়ে যায়।
একবার আমি আমার পছন্দের খাবার, আকাশ ভাইয়ার পছন্দের ভেবে নিয়ে গিয়েছিলাম। ওমা আকাশ ভাইয়া বাটি উল্টে ফেলে রে’গে’মেগে বলেছিল,

– আর একদিন এসব ফা’ল’তু জিনিস আমার আশেপাশে আনলে তোর বাংলাদেশে আর জায়গা হবে না!
শিমুর করা এক্টিং দেখে সন্ধ্যা হেসে ফেলল। নাকে এখনো ওড়না চেপে রেখেছে। শিমু কয়েকবার খেয়ে অতিরিক্ত ঝালে মুখ দিয়ে ফোসঁফোঁস শব্দ করে। আসমানী নওয়ানের থেকে বেশি ঝাল দিয়ে এই ভর্তা বানিয়ে নিয়েছে সে। এই বাসায় আসলেই তার খালাম্মার হাতের শুটকি ভর্তা সে খায়।
সন্ধ্যা বেড সাইট টেবিল থেকে গ্লাস নিয়ে শিমুর দিকে বাড়িয়ে দিলে শিমু পানি খেয়ে গ্লাস সন্ধ্যার হাতে দেয়। এরপর গালে হাত দিয়ে বলে,

– আচ্ছা ভাবি, সৌম্য স্যারের কি শুটকি পছন্দ?
সন্ধ্যা ভ্রু কুঁচকে তাকায়। তার ফোনে টাইপ করে শিমুকে দেখায়, যেখানে লেখা –
– তুমি সৌম্য ভাইয়াকে স্যার বলে ডাকো কেন?
শিমু হেসে বলে,
– আরে আমি সৌম্য স্যারের কাছে অনেকদিন প্রায়ভেট পড়েছি, বুঝেছ। তাই স্যার ডেকে অভ্যাস। ভাইয়া আসছে না।
সন্ধ্যা এবার বুঝল। একটু অদ্ভুদ লাগলো, নিজের খালাতো বোনকে প্রায়ভেট পড়িয়েছে তার ভাই, অথচ সেটা জানতোই না। এরপর সন্ধ্যা আবার-ও তার ফোনে কিছু লিখে শিমুকে দেখায়। যেখানে লেখা

– শুটকি সৌম্য ভাইয়ার পছন্দের তালিকায় প্রথম।
লেখাটি পড়ে শিমু অবাক হয়ে দু’গালে দু’হাত রেখে বলে,
– ওয়াও! মিলে গেল আমাদের। তোমাকে একটা সিক্রেট বলি শোনো।
আমার পাঁচজন ক্রাশ আছে বুঝলে? তার মধ্যে দু’জন শ্যাম বর্ণের। আর তিনজন ফর্সা।
শিমুর কথা শুনে সন্ধ্যা কেশে ওঠে। একজন নয়, দুই জন নয়, পাঁচজন ক্রাশ! শিমু থেমে গিয়ে বলে,
– আরে আসল টা না শুনেই কাশছ কেন? আচ্ছা তুমি একটু বসো। আমার এখনো ঝাল লাগছে। খালাম্মার থেকে একটু গুড় খেয়ে আসি। তারপর বলছি।
কথাটা বলেই শিমু দৌড়ে ঘর থেকে বেরিয়ে যায়।
সন্ধ্যা মৃদু হাসলো। শিমু তার চেয়ে এক বছরের ছোট। সন্ধ্যা যে কলেজে পড়ে, শিমু সেই কলেজের স্কুল শাখায় এবার ক্লাস টেনে।

শিমু চলে গেলে সন্ধ্যার চোখে পড়ল গতকাল রাতে আকাশের দেয়া দু’টো স্প্রিট এর দিকে। একটি স্প্রিট নিল, আরেকটি শিমুর জন্য রাখলো। এরপর বিছানা থেকে নেমে স্প্রিটটি খুলে দু’বার গলা ভেজায়। সন্ধ্যার মনে হচ্ছে শুটকির গন্ধে ঘর ভরে গিয়েছে। তাই সে স্প্রিট খেতে খেতে বেলকনিতে আসে।
দোতলায় আকাশের রুম থেকে কয়েকটি রুম পরে এই রুম। সন্ধ্যা আর শিমু গতরাতে একসাথে এই রুমে ছিল। সন্ধ্যা বেলকনিতে দাঁড়িয়ে সামনে তাকালে চোখে পড়ে আকাশদের বাগানে বড়সড় বকুল ফুলের গাছ। সন্ধ্যার মনে আছে, সে এই বাড়ি থেকে তার সৌম্য ভাইয়ার সাথে যাওয়ার আগে এই গাছতলা থেকে বকুল ফুল কুড়িয়ে দু’টো মালা গেঁথেছিল। একটি আকাশকে দিয়ে গিয়েছিল, আরেকটি নিজের কাছে রেখেছিল। আকাশ মালাটি রেখেছে কি-না জানে না। কিন্তু সে তার মালা হারিয়ে ফেলেছে। সন্ধ্যার মন খারাপ হয়।

হঠাৎ রাস্তায় চোখ পড়লে দেখল একটি গাড়ি বাড়ির ভেতর ঢুকছে। গাড়িটি গ্যারেজে রেখে ভেতর থেকে আকাশ বেরিয়ে আসে। সন্ধ্যা ভ্রু কুঁচকে চেয়ে আছে। আকাশ গাড়ি থেকে নেমে ধীরে ধীরে হাঁটছে। ফোনে কথা বলতে বলতে বাড়ির দিকে এগিয়ে আসছে। সন্ধ্যা তার হাতে আধখাওয়া স্প্রিট এর দিকে তাকায়, গতকাল সৌম্য ভাইয়ার সামনে আকাশের বলা কথাগুলো ভাবতেই সন্ধ্যার ইচ্ছে করল, আকাশের মাথায় চারটে বাড়ি দিতে। ভাবলো, এই স্প্রিট আকাশের মাথায় ঢালবে।

শিমুর বলা কথাটা মনে পড়ল, আকাশের শুটকি একদম পছন্দ নয়। মাথায় কিছু আসতেই সন্ধ্যা একটুখানি হাসে। এরপর দ্রুতপায়ে ঘরের ভেতর আসে। স্প্রিটটি টেবিলের উপর রেখে, শিমুর রেখে যাওয়া শুটকি পানি ভর্তা জগের মধ্যে ঢেলে দেয়। বা হাতে মুখে ওড়না চেপে ডান হাতে জগের ভেতর শুটকি ভর্তা গোলায়।
কাজ শেষে জগটি নিয়ে আবার-ও বেলকনিতে চলে আসে। নিচে তাকালে দেখল, আকাশ এখনো ফোনে কথা বলতে বলতে এগিয়ে আসছে। সন্ধ্যা বেলকনির কোণায় এসে দাঁড়ালো।
আকাশদের বাড়ির মাঝখানে গেইট। দু’পাশে অনেকগুলো বেলকনি। সন্ধ্যা যে রুমে আছে, এই রুম মেইন গেইট এর পাশ বরাবর দোতলায়। আকাশ দরজার সামনে দাঁড়িয়েছে।
সন্ধ্যা আকাশের অবস্থান দেখল।

গতকাল থেকে তার ভাইয়ের সাথে কথা বলতে পারেনি। অন্তত তার ভাই তাকে একটি মেসেজ করত, বাড়িতে পৌঁছেছে কি-না! সে-ও ভাইয়ের খোঁজ নিত। কিন্তু এই আকাশের জন্য তাদের দু’ভাইবোনের অবস্থা কাহিল। সৌম্য নিশ্চয়ই আসমানী নওয়ানের থেকে তার খোঁজ নিয়েছে। কিন্তু তারা ল’জ্জায়, অস্বস্তিতে একে-অপরের সাথে যোগাযোগ করতে পারছে না। কথাগুলো ভেবে রা’গ হয় সন্ধ্যার।
আবার-ও আকাশের দিকে চেয়ে মনে মনে হাসে। এবার বুঝবে মজা, এই বিশ্রী গন্ধের পানি দিয়ে আকাশকে গোসল করাবে সে!
ভাবনা অনুযায়ী সন্ধ্যা সুযোগ মতো শুটকি ভর্তা মেশানো জগ ভর্তি পানি আকাশের মাথার উপর ঢেলে দেয়।
শিমু সন্ধ্যাকে ঘরে না পেয়ে বেলকনিতে এসে দাঁড়িয়েছিল, সন্ধ্যাকে নিচের দিকে এভাবে ঝুঁকে থাকতে দেখে শিমু-ও একটু ঝুঁকে নিচে তাকায়। সন্ধ্যার করা কেলেঙ্কারি দেখে শিমু চোখ বড় বড় করে বলে,

– হায় আল্লাহ! তু….
এটুকু বলতেই সন্ধ্যা দ্রুত উল্টো ঘুরে শিমুর মুখ চেপে ধরে। শিমু বিস্ময় দৃষ্টিতে তাকায় সন্ধ্যার দিকে। সন্ধ্যা হাতের জগ বেলকনিতে ছুঁড়ে ফেলে শিমুকে টেনে ঘরের ভেতর নিয়ে যায়।
আকাশের বা হাতে ফোন, যেটা এখনো কানে। খুব সিরিয়াস বিষয়ে কথা বলছিল। ডান হাতে দু’বার কলিংবেল চাপ দিয়েছে। তখন-ই মাথার উপর এমন বিশ্রী গন্ধের পানি এসে পড়ায় আকাশ হতভম্ব হয়ে যায়। কথা থেমে যায়। শুটকির গন্ধ নাকে ভেসে আসে।
নাকমুখ কুঁচকে ফেলে আকাশ। এটা যে তার সবচেয়ে অপছন্দের জ’ঘ’ণ্য শুটকির গন্ধ, খুব ভালো করে বুঝলো। সাথে সাথে উপরে তাকালো, কাউকে দেখল না। এই পানি ফেলল কোন বে’য়া’দ’ব?
আসমানী নওয়ান দরজা খুলে আকাশকে দেখে অবাক হয়ে বলে,

– তুমি কই থেইকা ভিজে আসলা আব্বা?
আকাশ মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে। বা হাতের মুঠোয় ফোন শক্ত করে ধরে রেখেছে। রা’গে শরীর কাঁপছে তার। শুটকি থেকে একশ হাত দূরে থাকে সে, আর এখন তার গায়ে শুটকির মাখামাখি।
আসমানী নওয়ান মুখ কুঁচকে বলে,
– তোমার শরীর থেকে শুটকির গন্ধ আসতাছে ক্যান আব্বা?
আকাশ হঠাৎ মাথা তুলে মায়ের দিকে চেয়ে রাগান্বিত স্বরে বলে,
– এই বাড়িতে শুটকি আসলো কোথা থেকে?
আসমানী নওয়ান চোখ বড় বড় তাকায়। শিমুর শুটকি খুব পছন্দ। আসমানী নওয়ান শিমুর জন্য এনে রাখে। আকাশ যখন বাড়ি থাকে না, তখন শিমুকে ভর্তা করে দেয়, নয়তো রেঁধে দেয়। আকাশ আসার আগে পুরো বাড়ি স্প্রে করে দেয়।

যেমন আজকেও, কিছুক্ষণ আগে শিমুকে শুটকি ভর্তা করে দিয়ে কাজের মেয়েকে নিচতলা পুরোটা স্প্রে করে দিতে বলেছে। আসমানী নওয়ান জানতেন, আকাশ কিছুক্ষণের মাঝে চলে আসবে। মেয়েটি তার কথামতো কাজ করেছে। বাড়ির ভেতরে তো কোনো কোনো গন্ধ নেই। এদিকে আকাশের শরীরটা-ই শুটকির গন্ধে ভরা। আসমানী নওয়ান আকাশের মাথা থেকে বুক পর্যন্ত দেখল। পুরো ভিজে গিয়েছে। সাদা পাঞ্জাবিতে শুটকির একটু-আধটু অংশ লেগে আছে।
আকাশ তার মাকে চুপ দেখে চেঁচিয়ে বলে,

– কথা বলছ না কেন? তুমি তোমার আদরের ভাগ্নির জন্য আবার শুটকি রেঁধেছ? আজ ওর খবর আছে। আর তারপর তোমার শুটকি কেনার সব রাস্তা আমি বন্ধ করছি, ওয়েট কর।
কথাট বলে আসমানী নওয়ানকে পাশ কাটিয়ে বাড়ির ভেতরে চলে যায়। ডায়নিং এ দাঁড়িয়ে চিৎকার করে ডাকে,
– শিমু???? শিমু???? কই তুই???
আসমানী নওয়ান দ্রুত দরজা আটকে এগিয়ে আসে। তার ঠাণ্ডা ছেলেটাকে শিমু এভাবে রা’গিয়ে দিয়েছে? মেয়েটা একটু চঞ্চল, তাই বলে আকাশের সাথে এরকম করবে? আসমানী নওয়ানের বিশ্বাস হয় না, আবার না করে-ও উপায় নেই। ও ছাড়া এমন মেয়ে আর কেউ তো নেই এ বাড়ি।
ভাবনা রেখে আকাশের সামনে দাঁড়িয়ে আকাশের হাত ধরে বলে,

– আব্বা তুমি যাও, গোসল কইরা নাও। শিমুরে আমি বকমু। তুমি যাও।
আকাশ রে’গে ফায়ার হয়ে আছে। মায়ের হাত ঝাড়া দিয়ে সরিয়ে দেয়। রে’গে বলে,
– একদম বোনের মেয়েকে বাঁচাতে আসবে না। ওর কান টেনে ছিঁড়ে ফেলব আজ। ওর সাহস কি করে হয়, আমার গায়ের উপর এসব ফেলার।
এরপর আবার-ও ডাকে,
– শিমু??? বের হ বে’য়া’দ’ব!
আসমানী নওয়ান অসহায় চোখে তাকালো। ইরার মা আর শিমুর মা কিছুক্ষণ আগে হসপিটালে গিয়েছে। তাই কেউ বের হলো না।
ওদিকে,
শিমু আকাশের ডাক শুনে ভীত কণ্ঠে বলে,

– আকাশ ভাইয়া আমার পিঠের ছাল সব তুলে ফেলবে ভাবী। ভাইয়া জানে, এই বাড়িতে একমাত্র আমার-ই শুটকি পছন্দ। আমি এখন কই যাব, আল্লাহ!
সন্ধ্যা তার ফোনে টাইপ করে,
– আমি ফেলেছি তো। তুমি ভ’য় পাচ্ছো কেন?
আকাশের আবার-ও চিৎকারে শিমু, সন্ধ্যা দু’জনেই কেঁপে ওঠে। শিমু কাঁদোকাঁদো মুখ করে বলে,
– যা রা’গ বাবা! সাধে কে ভ’য় পায়! যাচ্ছি আমি, নয়তো একটার জায়গায় দশটা মা’র খেতে হবে।
কথাটা বলে শিমু দৌড়ে যেতে যেতে বিড়বিড় করে,

– আর জীবনে শুটকি খাবো না। খাইলে-ও শুধু নিজের বাড়ি খাবো।
আর মনে মনে জল্পনা-কল্পনা করে, নিচে গিয়ে কি কি বলবে।
তার জল্পনা-কল্পনা সব ভাবনা পর্যন্ত-ই স্থির থাকলো, নিচে নামতেই আকাশ শিমুর কান টেনে ধরে। আস্তে ধরেনি। একদম ছিঁড়ে ফেলার মতো করেই ধরেছে। শিমু চেঁচিয়ে ওঠে,
– আহ! আকাশ ভাইয়া কান ছাড়ো।
আকাশ ছাড়া তো দূর, আরও জোরে কান টেনে ধরে। সন্ধ্যা শিমুর পিছু পিছু এসেছিল। সিঁড়ি বেয়ে নামছিল সে। শিমুর এভাবে কান টেনে ধরা দেখে সন্ধ্যা দ্রুতপায়ে সিঁড়ি বেয়ে নামতে থাকে।
আসমানী নওয়ান এগিয়ে এসে জোর করে আকাশের হাত ছাড়িয়ে নিয়ে শিমুকে বা হাতে আগলে নেয়। আকাশ রে’গে বলে,

– আবার ওকে বাঁচাতে এসেছ তুমি?
বলতে বলতে আবার-ও শিমুর কান টেনে ধরলে শিমু চেঁচিয়ে বলে,,
– আল্লাহ! আমার কান ছিঁড়ে গেল, তোমার বউ অকাম করল, আর তুমি কান টানছ আমার! ইশ!
আসমানী নওয়ান আবার-ও আকাশের হাত ছাড়িয়ে বোঝানোর স্বরে বলে,
– না বুঝে করছে আব্বা। তুমি যাও গোসল কইরা নাও।
শিমু তার খালার কাঁধে মাথা রেখে বা হাতে কান ডলতে ডলতে কান্নার ভান করে। শিমুর কথাটা আকাশ শুনেছে। তার বউ মানে, সন্ধ্যা এই কাজ করেছে? দৃষ্টি ফেরালে তার একটু সামনেই সন্ধ্যাকে দেখে ভ্রু কুঁচকে তাকায়। আসমানী নওয়ান নিজেও শিমুর কথায় অবাক হয়েছে। সন্ধ্যা করেছে এমন? এদিকে সন্ধ্যা, মা আর ছেলের দৃষ্টি দেখে অস্বস্তিতে পড়ে যায়।
আকাশ বা হাতের ফোন পাঞ্জাবির পকেটে রাখলো। দৃষ্টি সন্ধ্যার পানে। দু’হাতের পাঞ্জাবির হাতা গোটাতে গোটাতে রে’গে বলে,

– বে’য়া’দ’ব মেয়ের বে’য়া’দ’বি কাজ।
কিভাবে বে’য়া’দ’বি ছাড়াতে হয়, সব টেকনিক আমার জানা আছে। আপাতত একটা থা’প্প’ড়-ও মাটিতে পড়বে না।
সন্ধ্যা ঢোক গিলল। আকাশ ভালোই রে’গেছে। দৃষ্টি, আর রাগান্বিত স্বর-ই বলে দিচ্ছে। সত্যি সত্যি তাকে থা’প্প’ড় মারবে না-কি!
আকাশ সন্ধ্যার দিকে এগিয়ে আসতে নিলে সন্ধ্যা দ্রুত আসমানী নওয়ানের পিছে গিয়ে দাঁড়ায়। আসমানী নওয়ান আকাশকে ঠেলে বলে,
– আব্বা ও ছোট মানুষ। না বুইঝা কইরা ফাইলাইছে। তুমি ঘরে যাও।
আকাশ রে’গে বলে,

– তোমার প্রবলেম কি মা? সবসময় আমার কাজে বাঁধা দাও। তোমার সব বোনের ছেলেমেয়ে বে’য়া’দ’বির উপর পিএইচডি করেছে। সবগুলোকে থা’প’ড়া’তে থা’প’ড়া’তে সোজা করব আমি।
কথাগুলো সন্ধ্যার দিকে চেয়ে বলল। আকাশের চোখেমুখে রা’গ। সন্ধ্যা ঢোক গিলল। মনে মনে মুখ ভেঙালো। নিজে বে’য়া’দ’ব হয়ে তাদের সব ভাইবোনদের উপর দোষ চাপাচ্ছে।
আকাশ আবার-ও সন্ধ্যার দিকে এগোতে নিলে আসমানী নওয়ান ডান হাতে আকাশকে ঠেলে বলে,
– আকাশ যাইতে কইতাছি আমি। কথা শোনো আমার।

আকাশ বিরক্ত হলো। শুটকির গন্ধে সে নিজেই মো মো করছে। ধুপধাপ পা ফেলে সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠতে থাকে।
সন্ধ্যা আকাশের অবস্থা দেখে মিটমিটিয়ে হাসছে। এটা গতকাল তাকে আর তার ভাইকে ল’জ্জায় ফেলার শাস্তি। হঠাৎ-ই আকাশ উপরে উঠতে উঠতে পিছু ফিরে তাকায়, সন্ধ্যা আকাশকে তাকাতে দেখে দ্রুত চোখ সরিয়ে নেয়। আকাশের চোখে পড়ে সন্ধ্যার সূক্ষ্ম হাসি। কি যে রা’গ লাগছে! পায়ের গতি বাড়িয়ে দাঁত কিড়কিড় করতে করতে বিড়বিড় করল,
– একবার শুধু তোমাকে হাতের কাছে পাই সন্ধ্যামালতী, সব সুদে-আসলে ফেরত দিব।

আসমানী নওয়ান শিমুকে ছেড়ে সন্ধ্যার দিকে চেয়ে অবাক হয়ে বলে,
– তুই আমার ছেলের উপর এসব ফেলেছিস জান্নাত?
সন্ধ্যা ইনোসেন্ট ফেস বানিয়ে তাকায়। আসমানী নওয়ান কি বলবেন বুঝলেন না। আকাশের রা’গ দেখে তার একটু ভ’য় লাগে, কারণ সে হুট করে রে’গে গিয়ে ভুলভাল কাজ করে ফেলে। পরে অনুতপ্ত হলে-ও ভুল তো করে! সেসব ভুলের মাসুল সে নিজেই দেয়, নিজেই ক’ষ্ট পায়।
সন্ধ্যার হাতে তার ফোন ছিল। সে কিছু লিখে আসমানী নওয়ানের সামনে ধরে। আসমানী নওয়ান ফোনের দিকে তাকালো,

– তোমার ছেলে একটু-ও ভালো নয়, বুঝলে? তুমি তো তোমার ছেলের খবর-ই রাখো না!
লেখাটি পড়ে আসমানী নওয়ান হেসে ফেলল। অতঃপর বলে,
– ছেলের তো বিয়া হইয়া গেছে। এহন বউ ছেলের খোঁজ রাখবো। আমার তো ছুটি।
আসমানী নওয়ানের কথা বুঝতে পেরে সন্ধ্যা একটু ল’জ্জা পায়। মনে মনে মুখ বাঁকালো। ওমন লোকের খোঁজ রাখতে বয়েই গিয়েছে তার। সবসময় কেমন জোরজবরদস্তি করে। সন্ধ্যার রা’গ লাগে।

আজ রাতে সৌম্য আর অরুণ হসপিটালে আছে। আকাশ এসেছিল, কিন্তু সৌম্য বলেছে থাকতে হবেনা। অরুণকেও যেতে বলেছিল। কিন্তু আকাশের উত্তর ছিল,
– সৌম্য অরুণ তোমাকে খুব ভালোবেসে ফেলেছে। তাই তোমাকে রেখে বাসায় গিয়ে ওর ঘুম হবে না।
আকাশের কথা শুনে সৌম্য অদ্ভুদভাবে তাকিয়েছিল অরুণের দিকে। অরুণ নিজেও হাবার মতো সৌম্য’র দিকে তাকিয়েছিল। একটুর জন্য তার নিজেকে গে মনে হচ্ছিল। আকাশের বলার ধরণটাই এমন ছিল।
মানে এই আকাশ তার বউয়ের ত্রিসীমানায় অরুণকে রাখবে না বলে কিসব কথা তার উপর চাপাচ্ছে। অরুণ হাতশ! তার কত দুঃখ! বন্ধুটা শুধু নামেই বন্ধু। কাজে তো পুরাই শ’ত্রু।

ঘড়িতে কাটা তখন ১১:৩০ এর ঘরে।
ইরার ঘরে কেউ নেই। সৌম্য কিছুক্ষণ আগে ইরাকে দেখে তার কেবিনে গিয়েছে।
ইরার হাত-পা একটু পর পর নড়েচড়ে উঠছে। প্রায় মিনিট পাঁচ পর ইরার চোখের পাতা নড়ে ওঠে। শরীরটা ভীষণ ভারী লাগছে তার। মনে হচ্ছে কয়েকশো মণ কিছু তার উপর রাখা হয়েছে। মাথা ঝিমঝিম করছে। চোখ মেলতে চায়, কিন্তু পারে না,, কি ভীষণ ভারী! অনেকটা সময় পর ইরা ধীরে ধীরে চোখ মেলে। চারপাশটা অন্ধকার লাগছে। কিছু সময় পেরিয়ে গেলে মনে হলো, একটু একটু করে অন্ধকার কেটে যাচ্ছে, তবে সবকিছু ঝাপসা। আরেকটু সময় পেরোলে ইরার চোখে ঝাপসা ভাবটি কেটে যায়। শরীরটা আগের চেয়ে খানিকটা পাতলা লাগছে।

ইরা রুমে ক্লান্ত দৃষ্টি ঘোরায়। বুঝতে পারছে না এটা কোথায়। ডান হাত ওঠাতে নিলে হাতে ক্যানোলা বেঁধে যায়। ইরা ডান হাত বেডের উপর রেখে চোখ বুজে নেয়। মনে হলো, মুখে কিছু আটকানো। এবার সে ধীরে ধীরে বা হাতে মুখে লাগানো অক্সিজেন মাস্ক বেশ কসরত করে টেনে খুলে ফেলে। শরীরটা ভীষণ দু্র্বল লাগছে।
একটু পর চোখ মেলে আবার-ও আশেপাশে দৃষ্টি ঘোরায়৷ এখানে কেউ নেই কেন? দেখে মনে হচ্ছে এটা হসপিটাল। হঠাৎ কিছু মনে করতে পারলো না। আবার-ও চোখ বুজে নিল। কিছু সময় পর হঠাৎ একটি একটি করে স্মৃতি যেন মাথাচাড়া দিয়ে উঠল।
ইরার হিসাবে,

সে গতরাতে সৌম্য’র সাথে দেখা করতে গিয়েছিল। সৌম্য’র পায়ের কাছে বসে অনেক অনেক কেঁদেছিল। অনেক আকুতি-মিনতি করেছিল সৌম্যকে বিয়ে করার জন্য। তার কাছে সৌম্য’র একটি ডায়েরি ছিল, ওখানে সৌম্য লিখেছিল, সৌম্য তাকে ভালোবাসে। কিন্তু ও তো স্বীকার করল না। ডায়েরি টা পুড়িয়ে দিল সৌম্য। আর বলল, তাকে ভুলে গিয়েছে। ভালোবাসে না তাকে।
আর আজ তো তার বাবা তাকে সৌম্য’র বিয়ের ছবি দেখালো। সৌম্য সত্যি-ই বিয়ে করে নিয়েছে? কথাগুলো ভেবে ইরার চোখের কোণ ঘেষে পানি গড়িয়ে পড়ে। উচ্চারণ করতে চাইল, সৌম্য নাম টা। কিন্তু গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে আছে। ক’ষ্ট হচ্ছে তার৷

ইরা চোখ মেলে। আশেপাশে কেউ কেন নেই? তার মা কোথায়? বাবা কোথায়? বাবা কি তাকে বিয়ে দিয়ে দিবে? সে বিয়ে করতে চায় না। সৌম্য বিয়ে করলে কি সে-ও বিয়ে করে নিবে? সে কখনো পারবে না।
একসময় ইরা ধীরে ধীরে শোয়া থেকে উঠে বসে। শরীরটা কেমন যেন কাঁপছে। ইরা ভেজা চোখে আশেপাশে তাকায়। একটু পানি খেতে পারলে ভালো লাগতো। সামনে তাকালে দেখল কেউ দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকছে। ইরা ক্লান্তিমাখা চোখেমুখে দরজার পানে চাইলো।
সৌম্য দরজা ঠেলে খুব স্বাভাবিকভাব ইরার আইসিইউ রুমে প্রবেশ করে। বেখেয়ালি চোখ বেডের দিকে পড়লে সৌম্য’র পা থেমে যায়। স্তব্ধ চোখে তাকায়। পা থেকে মাথা পর্যন্ত অদ্ভুদ একটি শিহরণ হলো। সুখ-দুঃখের মিশ্রণ সে শিহরণে।

বা হাতে ধরে রাখা দরজা সৌম্য আরেকটু শ’ক্ত করে ধরে। ইরার ক্লান্তিতে নুইয়ে পড়া মুখ দেখে সৌম্য ঢোক গিলল।
ইরার চোখজোড়া ভেজা। মেয়েটি অবাক হয়ে সৌম্য’র দিকে তাকিয়ে আছে। সে অসুস্থ বলে সৌম্য কি তাকে দেখতে এসেছে? সৌম্য যে বলেছিল, সৌম্য তাকে ভালোবাসে না। বন্ধু ভাবে বলে দেখতে এসেছে? আর ওই বউ? ইরা মলিন মুখে সৌম্য’র দিকে চেয়ে রইল।

সৌম্য এগোতে পারছে না। বুকটা কেমন ধুকধুক করছে। যেন মনে হচ্ছে কত যুগ পর যে সে তার ইরাবতীকে দেখল। নিস্তেজ ইরাবতী হঠাৎ প্রাণ ফিরে পেয়েছে। সৌম্য দরজা ছেড়ে দু’পা এগিয়ে আবার-ও দাঁড়ালো। তার শরীর কাঁপছে। দৃষ্টি ইরার চোখে। সৌম্য ইরাকে ঝাপসা দেখতে শুরু করেছে। দৃষ্টি সরিয়ে ডান দিকে ঘাড় বাঁকিয়ে দু’বার পলক ঝাপটালো। নিজেকে সামলালো।
এরপর হঠাৎ বড় বড় পা ফেলে এগিয়ে এসে দাঁড়ায় ইরার সামনে। তার ইরাবতী চোখ মেলে তাকিয়েছে, উঠে বসেছে। সে স্বপ্ন দেখছে না তো! সৌম্য কয়েকবার শুকনো ঢোক গিলল। ইরাকে ডাকতে চায়, কিন্তু কণ্ঠ ভীষণ কাঁপছে। বহু’ক’ষ্টে কাঁপা কণ্ঠে উচ্চারণ করল,

– ইরাবতী?
ইরার চোখজোড়া ভরে ওঠে। সৌম্য তাকে চায় না, আবার শুধু তাকে দুর্বল করে দিতে আসে। তার নাম তো ইরা। সৌম্য তাকে ইরাবতী ডেকে ডেকে তাকে আবার দুর্বল করে দিচ্ছে। ইরা ঢোক গিলে থেমে থেমে বলে,
– তুই বিয়ে করেছিস সৌম্য?
কথাটা বলতে গিয়ে ইরার ডান চোখ থেকে টুপ করে একফোঁটা পানি গালে গড়িয়ে পড়ে। সৌম্য ইরার চোখের দিকে তাকিয়ে আবার-ও ঢোক গিলে। মৃদুস্বরে বলে,
– ইরাবতী ছাড়া আমার বউ হওয়ার অধিকার কারো নেই।
সৌম্য’র কথায় ইরা অবাক হয়। কাঁপা কণ্ঠে বলে,
– একটু আগে যে বাবা তোদের বিয়ের পিক দেখালো। ওই মেয়েটি কে সৌম্য? তুই ওই মেয়েটাকে বিয়ে করলি কেন?

কথাগুলো বলতে বলতে ইরার চোখ আবার-ও ভিজে যায়। সৌম্য মলিন মুখে শোনে ইরার অভিযোগ। সে অন্যকাউকে বিয়ে করবে? এটা আদৌও সম্ভব?
অবাক হয়, ইরার বলা একটু আগে, শব্দ দু’টি তার মস্তিষ্ক তৎক্ষনাৎ ধরতে না পারলেও একটু পরেই বুঝতে পারে হয়ত। ইরার চোখে পানি দেখে সৌম্য ভারী গলায় বলে,
– ইরাবতী কাঁদিস না। তুই অসুস্থ!
ইরা নাক টেনে বলে,

– আমি কাঁদলে-ও তো তোর কিছু না। নিশ্চয়ই অনেক অসুস্থ হয়ে ম’রে যাচ্ছিলাম। তাই তুই আমাকে দেখতে এসেছিস। নয়তো কেঁদেকেটে অজ্ঞান হয়ে গেলে-ও তো আমার দিকে ফিরেও তাকাস না।
সৌম্য’র বুক ভার হয়। সে কি উত্তর দিবে তার ইরাবতীকে? সে তো সত্যি-ই ইরাবতী কাঁদলে ফিরেও তাকাতো না। কিন্তু সে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে যে একটু-ও ভালো থাকেনি, সে খবর ইরাবতী রাখেনি?
বাম পা তুলে বেডের উপর ইরার সামনে বসে সৌম্য।
ইরা তার কাঁপা এবা হাত সৌম্য’র গালে রেখে সৌম্য’র দিকে তাকিয়ে কান্নামাখা গলায় বলে,
– তুই সত্যিই বিয়ে করে নিয়েছিস সৌম্য? তোর পাশে অন্যকাউকে দেখতে অনেক ক’ষ্ট হয় আমার। তুই যে বলেছিলি, বিয়ে করে নিবি। ওই কথা মিথ্যে বলিস নি কেন? আমি তোকে কত করে নিষেধ করলাম। বললাম, আমি তোকে আর চাইবো না, তবু-ও তুই বিয়ে করিস না!
এটুকু কথা বলতে গিয়ে ইরা হাঁপিয়ে ওঠে।
সৌম্য ঢোক গিলল। অবাক হয়ে শুধু তাকিয়ে থাকে ইরার দিকে। ইরা তাকে কেন এতো ভালোবাসলো? দীর্ঘ এগারো মাস পর ইরাবতীর জ্ঞান ফিরল, অথচ সেই এগারো মাস আগের করা পা’গ’লা’মি আজ-ও তার ইরাবতীর মাঝে ভেসে উঠছে।

সে হয়ত, তার ইরাবতীর এতো এতো ভালোবাসা এই জনমে পুষিয়ে দিতে পারবে না।
ইরাবতী সেই ১১ মাস আগের সব বলছে। সেই রাতে সে তার ইরাবতীকে কত কাঁদিয়েছিল! কত ক’ষ্ট দিয়েছিল। কান্নারা সৌম্য’র গলায় দলা পাকায়। অপরাধবোধে তার ভেতরটা ছিঁড়ে যাচ্ছে। সে কি বলবে ইরাবতীকে? তার বোনুকে বাঁচাতে গিয়ে ইরাবতীকে মৃত্যুর মুখে ফেলে গিয়েছিল, এটা বলবে? কিভাবে বলবে? সে শুধু তার বোনুর কথা ভেবেছে, একটাবার ইরাবতীর খোঁজ নেয়নি। কিভাবে বলবে এই কথা?
ইরা মলিন মুখে সৌম্য’র দিকে তাকিয়ে রইল। সৌম্য’র গাল থেকে হাত সরিয়ে নেয়। মাথা নিচু করে নিঃশব্দে চোখের পানি ফেলে। সে জানে, এতো আবেগ সৌম্যকে দেখিয়ে লাভ নেই। সৌম্য’র মন গলে না। সৌম্য যে ভীষণ কঠোর মানুষ। শুধু তার জন্য কঠোর। তাকে একটু-ও ভালোবাসলো না। বিড়বিড় করে,
– তুই আমাকে একটু-ও ভালোবাসলি না কেন সৌম্য?
সৌম্য’র দমবন্ধ লাগছে। সে কথা বলতে চাইছে, পারছে না। ইরাকে কাঁদতে দেখে ভীষণ অসহায় লাগছে। ডানহাত বাড়িয়ে ইরার থুতনির নিচে পাতলো। ইরার চোখের নোনাপানি টুপটুপ করে তার হাতে এসে স্পর্শ করে। সৌম্য ভাঙা গলায় বলে,

– আমি বিয়ে করিনি। তুই আমার বউ হবি ইরাবতী?
কথাটা শুনে ইরা অবাক হয়ে তাকায় সৌম্য’র দিকে। সৌম্য’র চোখজোড়া লাল। সৌম্য বা হাতে ইরার চোখের পানি মুছে দিয়ে বলে,
– আর কখনো কাঁদাবো না। তোকে ভালোবাসতে দিবি ইরাবতী?
ইরা নুইয়ে আসা কণ্ঠে বলে,
– তুই আমায় ভালোবাসবি সৌম্য?
সৌম্য ঢোক গিলে বলে,
– বাসবো।
কথাটা শুনতেই ইরার চোখেমুখে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। তার মনে হচ্ছে, গতকাল-ও সৌম্য তাকে বলেছিল, সৌম্য তাকে ভালোবাসবে। আর তারপর শর্ত দিয়েছিল, তাকে অন্যকাউকে বিয়ে করে নিতে হবে। ইরার চোখজোড়া বুজে আসে। ফুঁপিয়ে বলে,

– আমি বিয়ে করব না সৌম্য। আমি ম’রে যাবো।
সৌম্য যে তাকে সৌম্য’র বউ হতে বলেছে। মেয়েটি হয়তো বুঝতেই পারেনি। অতিরিক্ত দুর্বল, সাথে এতোক্ষণে কান্নার ফলে আরও দুর্বলতা ঘিরে ধরে তাকে। ভীষণ তৃষ্ণা পেয়েছে। বলতেও পারছে না।
ইরাকে ঢুলতে দেখে সৌম্য দ্রুত ইরার গালে দু’হাত রেখে ভীত কণ্ঠে বলে,
– ইরাবতী কি হয়েছে তোর?
ইরার চোখ বুজে আসে। শরীর ছেড়ে দেয়। সৌম্য দু’হাতে আগলে নেয় তার ইরাবতীকে। তার শরীর মৃদু কাঁপছে। ইরাবতীর বলা শেষ কথা, আমি ম’রে যাবো কথাটি কানে বাজতেই সৌম্য’র চোখ থেকে দু’ফোঁটা পানি গড়িয়ে ইরার গালে পড়ে। সৌম্য ইরার নিস্তেজ শরীর তার বুকে চেপে ভাঙা গলায় বলে,
– ইরাবতী যাস না আমায় রেখে। এবার তোর কিছু হলে, আমি কিন্তু সত্যি-ই ম’রে যাবো। ইরাবতী ওঠ!

আকাশ হসপিটাল থেকে ফিরে শাওয়ার নিয়ে বেরিয়েছে। পরনে একটি কালো গ্যাবার্ডিন প্যান্ট। কাভার্ড থেকে একটি ফুলহাতা কালো পাতলা টিশার্ট বের করে পরে নেয়। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে ভেজা চুলগুলো ঝাড়তে থাকে। মুখাবয়ব গম্ভীর। হঠাৎ-ই একটুখানি হেসে উঠল। খুব গুরুত্বপূর্ণ কাজ করেছে আজ সে।
দু’হাতের গেঞ্জির হাতা কনুই পর্যন্ত উঠিয়ে বা হাত প্যান্টের পকেটে রাখে। ডান হাতে চুলের ভাঁজে হাত চালাতে চালাতে শিমুর ঘরের দিকে যায়। হসপিটাল থেকে ফিরে, শিমু আর সন্ধ্যাকে জেগে থাকতে দেখেছে। দ্রুত পা চালিয়ে শিমুর ঘরের সামনে গিয়ে দাঁড়ালে দেখল দরজা খোলা, এখন-ও দু’জন বসে আছে। শিমু কথা বলছে। সন্ধ্যা উল্টো ঘুরে বসে হাত নাড়িয়ে বোঝায়।

আকাশ সময় নষ্ট না করে ঘরের ভেতর প্রবেশ করে। শিমু কথা বলতে বলতে সামনে তাকালে আকাশকে দেখে অবাক হয়। এতো রাতে আকাশ ভাইয়া এখানে কেন? মৃদুস্বরে বলে,
– আকাশ ভাইয়া কিছু বলবে?
সন্ধ্যা শিমুর কথায় পিছু ফিরতে চায়। তার আগেই আকাশ ঝট করে সন্ধ্যাকে কোলে তুলে নেয়। সন্ধ্যা হতভম্ব হয়ে যায়। মোচড়ামুচড়ি করে নামার জন্য। শিমু অবাক হয়ে বলে,
– ভাবিকে কোথায় নিয়ে…….
আকাশের শ’ক্ত দৃষ্টি দেখে শিমুর কানে হাত চলে যায়। এখনো কানটা ব্য’থা হয়ে আছে। মেকি হেসে বলে,

– বলছিলাম, ভাবিকে নিয়ে যাও। নিয়ে যাও। ভাবিটা শুধু পথ ভুল করে আমার ঘরে চলে আসে।
আকাশ দ্রুত উল্টে ঘুরে বড় বড় পা ফেলে এগোয়। সন্ধ্যা রে’গেমেগে দু’হাতে আকাশের গলায় খামচে ধরে। আকাশ চোখমুখ কুঁচকে নেয়। এই বউটা যে কি লেভেলের বে’য়া’দ’ব। এটা ভেবেই সে ডিপ্রেশনে চলে যাচ্ছে গতকাল থেকে।
আকাশ কোনোদিকে না তাকিয়ে সোজা ওয়াশরুমে চলে যায়। সন্ধ্যা মোচড়ামুচড়ি করে। আকাশ ওয়াশরুমে এসে বাথটবের সামনে দাঁড়ায়। এরপর ঠাস করে সন্ধ্যাকে ভরা বাথটবের ভেতর ফেলে দেয়। সন্ধ্যা হতভম্ব হয়ে যায়। হঠাৎ এভাবে এতো পানির মধ্যে ফেলায়, সন্ধ্যা বুঝতে পারেনি। যার ফলে দু’তিন ঢোক পানি মুখের ভেতর চলে গিয়েছে। নারী-ভুরি উল্টে আসছে। এটা তো শুটকির গন্ধ। সন্ধ্যা হাত দিয়ে মুখ চেপে ধরে। রে’গে তাকায় আকাশের দিকে।

আকাশ হাঁটু মুড়ে বসে, দু’হাত দু’হাঁটুর উপর রেখে সন্ধ্যার চোখে চোখ রেখে বাঁকা হেসে বলে,
– ভুলেও আমার পিছনে লাগবে না সন্ধ্যামালতী। যা দিবে, সব দশ গুণে ফেরত পাবে। এবার শুটকি ফ্লেভারে শাওয়ার নিয়ে আমাকে তোমার অনুভূতি জানিয়ো। ভালো লাগলে পরেরবার সুইমিংপুলে এই ফ্লেভার অ্যাড করে দিব।
কথাটা বলতে বলতে সন্ধ্যার গালে হাত দিলে সন্ধ্যা ঝাড়া মেরে আকাশের হাত সরিয়ে দু’হাতে গায়ের জোরে আকাশকে ধাক্কা দেয়। আকাশ পড়তে পড়তে বেঁচে যায়। রে’গে সন্ধ্যার চোয়াল শক্ত করে ধরে।
সন্ধ্যার মুখে ব্য’থার ছাপ। তবে চোখে রা’গ। ডান হাতে আকাশের গলায় খামচে ধরেছে।
আকাশ বা হাতে সন্ধ্যার হাত তার গলা থেকে সরিয়ে দেয়।

সন্ধ্যার ব্য’থাতুর মুখাবয়ব দেখে সাথে সাথে গাল ছেড়ে দেয় আকাশ। চোখ বুজে শ্বাস ফেলে। এই বউটার এতো তেজ! তার-ও এসব হজম হয় না। কিন্তু হাজার হোক, বউটাকে কত ভালোবাসে! এজন্য চাইলে-ও আ’ঘাত করতে পারেনা। একে ভালো না বাসলে এসব বে’য়া’দ’বির জন্য মুখটা ভেঙে দিত একদম। ভালোবাসে বলে কি যে ক’ষ্ট করে রা’গ গুলো গিলতে হয়, একমাত্র সেই জানে। আল্লাহ! কবে না জানি রে’গেমেগে হুট করে আবার মে’রে দেয়। মনে মনে দোয়া করল, ওমন দিন না আসুক।
আকাশ দাঁড়িয়ে যায়। ফোঁস করে শ্বাস ফেলে সন্ধ্যার দিকে চেয়ে বলে,

– সন্ধ্যামালতী তোমার তেজ কমাও। নয়তো আমার হাত উঠলে, পরে আমাকে দোষারোপ করতে পারবে না।
কথাটা বলে আকাশ বেরিয়ে যায়। সন্ধ্যা খেয়ে ফেলা দৃষ্টিতে আকাশের প্রস্থান দেখল। কি পরিমাণ বে’য়া’দ’ব হলে বলে, তাকে মা’র’বে, আবার সে না-কি দোষারোপ করতে পারবে না। জীবনেও মা’র খাবে না সে। তার সৌম্য ভাইয়ার একটা কথা সবসময় তার কানে বাজে,
– বোনু, একটা কথা জানিস? নরম মাটি মানুষ পারায় বেশি। কারণ,
মাটি যত নরম,
হাঁটতে তত আরাম।

সৌম্য এই কথাটা মাঝেমাঝেই তাকে বলত। এমনকি গতকাল তাকে আকাশের বাড়িতে এসে ওতো বিধ্বস্ত দেখে, বাইকে তাকে নিয়ে যাওয়ার সময়-ও সৌম্য এই কথা বলেছিল। তার মাথায় গাঁথা আছে কথাটি।
সন্ধ্যা বাথটব থেকে উঠে দাঁড়ায়। পুরো শরীর থেকে শুটকির গন্ধ আসছে। মুখে হাত দিয়ে দু’বার উঁকি করল। শুটকির গন্ধ সহ্য হয় না তার। সন্ধ্যার এতো রা’গ লাগছে। এই লোকটাকে তো সে ছাড়বে না। আশেপাশে কিছু খুঁজল। একটি ছোটোখাটো লাল বালতি পেয়ে বাথটবে ডুবিয়ে বালতি ভরে নেয়। এরপর ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে আসে।
আকাশ বেডের কোণায় বসে, পায়ের উপর ল্যাপটপ। খুব মনোযোগ দিয়ে কাজ করছে, গুরুত্বপূর্ণ কাজ করছে। আশেপাশে খেয়াল নেই। যার দরুন সন্ধ্যাকেও খেয়াল করেনি। সন্ধ্যা দ্রুত পায়ে এগিয়ে এসে পুরো বালতি আকাশের মাথার উপর ঢেলে দেয়। এরপর হাতের বালতি ছুড়ে ফেলে দৌড় দেয়।

আকাশ হতভম্ব হয়ে যায়। সে সহ ল্যাপটপ ভিজে যা তা অবস্থা। একদম সকালের মতো ফিলিংস হলো আকাশের।
সকালে ফোনে ইম্পর্ট্যান্ট কথা বলছিল, তখন-ই এই বে’য়া’দ’ব মেয়ে তার মাথার উপর ঠিক এভাবেই পানি ফেলেছিল। এখন সেই একই কাজ। এককাজ কয়শোবার করবে? মে’জা’জ টা চরম লেভেলের খারাপ হলো।
রা’গে কোলের উপর থাকা ল্যাপটপ ছুঁড়ে ফেলল। ল্যাপটপটি পুরো দু’ভাগ হয়ে দু’টো দু’দিকে ছিটকে যায়। আকাশ বেডের উপর থেকে উঠে দাঁড়ায়। রে’গে তাকিয়ে আছে সন্ধ্যার দিকে।
সারাঘর পানি পানি হয়ে গিয়েছে। টাইলস পুরো পিচ্ছিল হয়ে থাকায়, সন্ধ্যা পা পিছলে ধপ করে পড়ে যায়। দরজার কাছে-ও যেতে পারলো না। সন্ধ্যাকে এভাবে পড়ে যেতে দেখে আকাশ রা’গের মাঝে-ও একটু হেসে ফেলল। কয়েক পা এগিয়ে আসে। সন্ধ্যা আকাশকে দেখে ঢোক গিলল। আকাশ বা হাতে মুখে লেগে থাকা পানি ঝেড়ে ফেলে বাঁকা হেসে বলে,

– ভেবেছিলাম, কয়েকদিন পর একসাথে শাওয়ার নিব। কিন্তু আমার মনে হচ্ছে, তোমার তাড়া বেশি। তাই তোমার সাথে আমাকেও ভিজিয়ে দিলে, তাই না সন্ধ্যামালতী?
সন্ধ্যা রে’গে তাকায়। সে উঠতে পারছে না। শুধু পিছলে যাচ্ছে। মনে হচ্ছে তার গায়ে তেল মাখা। আকাশ দু’হাতে মাথার ভেজা চুল ঝাড়তে ঝাড়তে সন্ধ্যার দিকে খেয়াল করে। ভিজে পুরো জুবুথুবু অবস্থা মেয়েটার। ভালো লাগলো আকাশের।
আরও দু’পা এগিয়ে এসে বলে,
– কালো জামা পরেছ সন্ধ্যামালতী? তার মানে আজ-ও সাদা-কালোর কম্বিনেশন। বেশ ভালো লাগলো! তোমার পছন্দ কালো, আমার সাদা। তোমার আমার পছন্দ কত সুন্দর মিলিয়ে পর তুমি!
এখন আবার তুমি চাইছ, আমার সাথে শাওয়ার নিতে, আমি চাইছি তার আগে ফরজ কাজটি সেরে নিতে। এবারে-ও দু’জনের ইচ্ছে মিলিয়ে কাজ সারি তবে, এসো সন্ধ্যামালতী।
সন্ধ্যা কটমট দৃষ্টিতে তাকায়। অ’স’ভ্য লোকের চেয়েও জ’ঘ’ণ্য এই লোকটা। আকাশকে এগিয়ে আসতে দেখে সন্ধ্যা একটু ঘাবড়ে যায়। তবে নিজেকে সামলে নেয়। তার কাছে আসলে, আজ আকাশের সব চুল ছিঁড়বে সে। তার সাথে সবসময় জোরজবরদস্তি করে। হাতের কাছে ল্যাপটপের একটি খন্ড পেয়ে, সেটি হাতে নিয়ে রে’গে আকাশের দিকে ছুঁড়ে মা’রে।

আকাশ দ্রুত বাম দিকে একটু সরে গিয়ে ল্যাপটপের অংশটি ডান হাতে ধরে নেয়। এটা আজ তার বুকে লাগলে, কি হত! আকাশ রে’গে যায়। আর তো নেয়া যাচ্ছে না একে। দু’দিনে তার জীবনটা পুরো ঝালাপালা করে দিল! চোখমুখ শ’ক্ত করে তাকায় সন্ধ্যার দিকে।
একটু আগের দোয়া বোধয় কবুল হয়নি। সন্ধ্যার কানেও তার কথা যায়নি। মনে হচ্ছে, আজকেই তার হাতে মার খাওয়ার জন্য উঠেপড়ে লেগেছে মেয়েটা।

অন্তঃদহন পর্ব ২৭ (২)

সে এই দা’জ্জা’ল মেয়ের জন্য এতোদিন কেঁদেকেটে বুক ভাসিয়েছে! ছ্যাহ!
ইচ্ছে তো করছে, এক আছাড় মে’রে সব নাড়িভুড়ি বের করে এই মেয়ের বে’য়া’দ’বি ছোটাতে।
ল্যপটপের খন্ডটি ছুঁড়ে ফেলে, যেন সন্ধ্যাকেই ছুড়ে ফেলল। এরপর সন্ধ্যার দিকে শক্ত দৃষ্টি নিক্ষেপ করে পরনের ভেজা টি-শার্ট এর হাতা শক্তি খাঁটিয়ে উপর দিকে ওঠায় আকাশ, মনে হচ্ছে সন্ধ্যাকে মারার প্রস্তুতি নিচ্ছে। দাঁতে দাঁত চেপে বিড়বিড় করে,
– যতবড় মেয়ে নয়, ততবড় বে’য়া’দ’বি!
বে’য়া’দ’বি ছোটাবো আজ।

অন্তঃদহন পর্ব ২৯