অন্তঃদহন পর্ব ৩০
DRM Shohag
সন্ধ্যা নড়েচড়ে ওঠে। যদি-ও তাকে ঘুমের ইনজেকশন দেওয়া হয়েছে, তবে তার ঘুম ততটা গাঢ় হয়নি। আকাশের বলা কথাগুলো তার কানে পৌঁছেছে। আরেকটু নড়েচড়ে উঠলে আকাশের ধ্যান ভাঙে। দ্রুত মাথা তুলে সোজা হয়ে বসে। সন্ধ্যা চোখ মেলেছে। ঘাড় বাঁকিয়ে আকাশের দিকে বিস্ময় দৃষ্টিতে তাকায়। একে তো আকাশের বলা কথাগুলো, তার উপর আকাশের চোখজোড়া ভেজা। আকাশ তার খালাতো ভাই জেনে যতটা না অবাক হয়েছিল, তার চেয়েও বেশি অবাক হয়েছে আকাশের এই রূপ দেখে।
আকাশ সন্ধ্যার দৃষ্টি দেখে বিব্রতবোধ করে। সে সন্ধ্যার সামনে নিজেকে এভাবে এক্সপোজ করতে চায়নি। দ্রুত বসা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে উল্টো ঘুরে দাঁড়ায়। দু’হাতে চোখজোড়া মুছে নেয়।
সন্ধ্যা ঢোক গিলল। আকাশের দিকে তাকিয়েই দুর্বল শরীর টা নিয়ে উঠে বসার চেষ্টা করে। কিছুটা উঠে পড়ে যেতে নিলে আকাশ দ্রুত এগিয়ে এসে সন্ধ্যাকে আগলে নেয়। বিচলিত কণ্ঠে বলে,
– ঠিক আছো?
সন্ধ্যা অবাক হয়ে তাকায়। আকাশের বলা কথা, ব্যবহারে মেয়েটির না রা’গ হলো, না তো ভ’য় পেল।
আকাশ সন্ধ্যার দিকে তাকিয়ে। সৌম্য’র কথাগুলো মনে পড়ল। সন্ধ্যার কথা সে শুনতে চায়নি। নিজে সবসময় জোর করেছে। কথাটি তার উপর বেশ প্রভাব ফেলেছে। অতঃপর ঢোক গিলে মৃদুস্বরে বলে,
– তুমি কি আমাকে কিছু বলতে চাও?
সন্ধ্যা অদ্ভুদভাবে তাকায়। আকাশ একবার ভাবলো, সে সন্ধ্যার পিছনে বসে, সন্ধ্যাকে সাপোর্ট দিবে। সন্ধ্যাকে দেখেই বোঝা যাচ্ছে, মেয়েটি ভীষণ দুর্বল। আবার ভাবলো, তার ইচ্ছেগুলো আপাতত চাপা থাকুক। ডান হাতে বেডের সাথে বালিশ রেখে সন্ধ্যাকে হেলান দিয়ে বসিয়ে দিল। এরপর সোজা হয়ে দাঁড়ায়। সন্ধ্যার দিকে তাকিয়ে দেখল, মেয়েটির চোখেমুখে বিস্ময়, সাথে মায়া। কিছুক্ষণ আগেও বাড়িতে কত রে’গে ছিল। এখন একদম শান্ত। আকাশের দুঃখ হলো, মানুষের মধ্যে রা’গ কেন থাকে এজন্য। রা’গলে তার মাথাও ঠিক থাকেনা। তার বউয়ের মাথা-ও ঠিক থাকে না। এই যে সে শান্ত হয়ে আছে, সন্ধ্যার সাথে জোর করছেনা। মেয়েটি-ও কি সুন্দর শান্ত হয়ে আছে। মনে মনে ভাবলো, রা’গ কি সেটাই ভুলে যাবে।
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
সন্ধ্যা এখন-ও আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে। আকাশ অতি নরম কণ্ঠে বলে,
– কি খেতে চাও তুমি? আমি আনিয়ে দিচ্ছি। তোমাকে অনেক উইক লাগছে।
সন্ধ্যা মলিন মুখে আকাশের দিকে চেয়ে রইল। আকাশ তো তার সাথে এতো নরমভাবে কথা বলেনা। এখন কি হলো আকাশের? সন্ধ্যাকে চুপ দেখে আকাশ ভ্রু কুঁচকে বলে,
– মাকে জিজ্ঞেস করে আনিয়ে দিচ্ছি। তুমি পাঁচমিনিট ওয়েট কর।
কথাটা বলে আকাশ যেতে নিলে সন্ধ্যা বা হাতে আকাশের ডান হাত টেনে ধরে। আকাশ বিস্ময় দৃষ্টিতে তাকায়। একবার তার হাতের দিকে তো আরেকবার সন্ধ্যার দিকে। সন্ধ্যা বিব্রতবোধ করে আকাশের হাত ছেড়ে দেয়। মাথা নিচু করে নেয়। সে আসলে আকাশের ওই কথাগুলোর মানে শুনতে চাইছে। কিভাবে বলবে সেটাই বুঝতে পারছে না। তার এখানে তো ফোন নেই। ফোন বাড়িতে।
আকাশ চেয়ার টেনে বসে। পকেট থেকে ফোন বের করে সন্ধ্যার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলে,
– নাও।
সন্ধ্যা আবার-ও অবাক হয়। আকাশ বুঝে গেল ভেবে মেয়েটির ভালো লাগলো। তবে অবাক-ই বেশি হচ্ছে। কাঁপা হাতে আকাশের থেকে ফোন নিয়ে টাইপ করে,
– আপনি তখন এসব কথা কেন বললেন? আর কাঁদছিলেন কেন?
লেখাটি পড়ে আকাশ বিব্রতবোধ করল। কান্নার ব্যাপারটায় বেশি বিব্রত লাগছে। মানে সে কতবড় এক ছেলে হয়ে এক মেয়ের সামনে কেঁদেছে। ভাবতেই নিজের উপর বিরক্ত হলো। সন্ধ্যাকে নিজের দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে আকাশ গলা ঝেড়ে বলে,
– এসব কেউ কেন বলে বলো তো?
সন্ধ্যা সাথে সাথে টাইপ করে,
– অনেক ভালোবাসলে।
লেখাটি লিখে, সন্ধ্যা বুঝল কি লিখে ফেলেছে। দ্রুত আবার-ও লেখাটি কেটে দেয়। সন্ধ্যার কান্ড দেখে আকাশ শব্দহীন হাসলো। সন্ধ্যা মাথা নিচু করে চুপ করে বসে আছে। আকাশ চেয়ারে হেলান দিয়ে বলে,
– তোমার ভাষায়, তোমাকে এক ছেলে অনেক ভালোবেসে বসে বসে কাঁদছে। বুঝলে কিছু সন্ধ্যামালতী?
সন্ধ্যা অবাক হয়ে আকাশের দিকে তাকালো। আকাশকে হাসতে দেখে সন্ধ্যা আবার-ও মাথা নিচু করে নেয়।
আকাশ আর কিছু বলল না। রুম থেকে বেরোনের জন্য দরজার কাছে গিয়ে দাঁড়ায়। পিছু ফিরলে সন্ধ্যাকে তার দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে আবার-ও একটু হাসলো। আফসোস হলো, সে শান্ত থাকলে হয়ত, আরও আগেই তার সন্ধ্যামালতী তাকে বুঝত। সন্ধ্যা চোখ নামিয়ে রেখেছে। তার সব গুলিয়ে যাচ্ছে। এতোটা আশা করেনি আকাশের থেকে। আকাশ কেবিন থেকে বেরিয়ে যায়।
সন্ধ্যা ঢোক গিলল। আকাশ বেরিয়ে যেতেই শিমু হুড়মুড়িয়ে কেবিনে ঢুকে পড়ে। সে আসমানী নওয়ানকে সন্ধ্যার মেসেজগুলো দেখিয়ে এসেছে। কিন্তু উনি মেসেজগুলো দেখে কিছুই বলল না। শিমুর রা’গ লাগছে। সে ভেবেছিল তার খালাম্মা সন্ধ্যাকে আকাশের ব্যাপারে সব বলবে। কিন্তু সে হতাশ হলো। আসমানী নওয়ান ইরার পাশে বসে আছে। তাই সে নিজেই সন্ধ্যাকে বলতে এসেছে। অন্তত আকাশ যে সন্ধ্যাকে গত ১১ মাস থেকেই অনেক করে চেয়েছে, এইটুকু সে বলবেই। শিমু এগিয়ে এসে সন্ধ্যার পাশে বসে। বিচলিত কণ্ঠে বলে,
– ভাবি শোনো, খুব গুরুত্বপূর্ণ কথা বলছি তোমাকে। প্লিজ বিশ্বাস কর আমার কথা।
সন্ধ্যা অবাক হয়ে তাকায়। শিমু সন্ধ্যার হাত ধরে বলে,
– সৌম্য স্যার তোমাকে নিয়ে যাওয়ার পর থেকে আকাশ ভাইয়া তোমাকে খুঁজেছে। অনেক খুঁজেছে। কিন্তু কোথাও পায়নি। তোমার জন্য অনেক কেঁদেছে জানো? তুমি বেঁচে নেই ভেবে আকাশ ভাইয়ার সে কি কান্না! তোমাকে দেখাতে পারলে ভালো হত। আমি আমার সারাজীবনেও মেয়ে হয়ে এতো কাঁদিনি, আকাশ ভাইয়া তোমার জন্য ওতো কেঁদেছে।
সন্ধ্যা বিস্ময় চোখে চেয়ে আছে। একটু আগে তো সে নিজের চোখেই আকাশের চোখে পানি দেখল, তাও আবার তার জন্য। সন্ধ্যা ঢোক গিলল। শিমু আবার-ও বলে,
– আকাশ ভাইয়া তোমাকে অনেক ভালোবাসে, জানো ভাবি? তোমার স্ট্যাটাস দেখে ভালোবাসে না। আসলে আমি এই কথা বলতাম না। এটা বলা উচিৎ না জানি। কিন্তু তুমি বুঝতে পারছো না, তাই বলছি।
তুমি তো কথা বলতে পারো না। আকাশ ভাইয়া তবুও তোমায় কত চায়। কোনোদিন অন্য মেয়ের দিকেও তাকায় নি। তুমি বুঝতে পারছ?
তুমি আকাশ ভাইয়াকে ডিভোর্স দিতে চেয়েছ বলে ভাইয়া খুব ক’ষ্ট পেয়েছে। তোমার ব্যবহারে আকাশ ভাইয়া অনেক কষ্ট পায়। একটু বোঝো আকাশ ভাইয়াকে, প্লিজ! আমার খুবই খারাপ লাগে।
শিমু লাস্ট কথাগুলো মলিন মুখে বলে।
সন্ধ্যা বাকহারা হয়ে শিমুর দিকে চেয়ে আছে। শিমু সন্ধ্যার চাহনী দেখে মন খারাপ করে বলে,
– বিশ্বাস কর আমি একটু-ও মিথ্যা বলছিনা। তুমি কি আমার কথা বিশ্বাস করছ না? কি বললে বিশ্বাস করবে?
একটু ভেবে বলে,
– আল্লাহর কসম সব সত্যি বলছি। আমি কিন্তু আল্লাহকে নিয়ে মিথ্যা বলিনা। আচ্ছা দাঁড়াও, তোমার মেসেজগুলো পড়ে তোমার বলা সব কথাগুলোর এক এক করে উত্তর দিচ্ছি।
তখন-ই আকাশ কেবিনের ভেতর প্রবেশ করে। হাতে একটি প্যাকেট, ভেতরে ফলমূল আছে। আপাতত তার কাছে এটাই বেশি প্রয়োজন মনে হলো। এগিয়ে এসে সন্ধ্যার পাশে দাঁড়িয়ে শিমুর উদ্দেশ্যে বলে,
– তুই এখানে কি করছিস?
শিমু ফোন থেকে মাথা তুলে থতমত খেয়ে তাকায়। সে এক্ষুনি বলতে যাচ্ছিল, ভাগ্যিস বলেনি। নয়তো আকাশ ভাইয়া শুনে নিলে কেমন একটা লাগতো। মেকি হেসে বলে,
– ভাবীর সাথে গল্প করছিলাম।
আকাশ চেয়ারে বসে। হাতের প্যাকেট সন্ধ্যার কোলের উপর রেখে বলে,
– মা কে ডেকে আন। তুই ইরার কাছে থাক। আমরা একটু পর আসছি।
শিমু সন্ধ্যার দিকে একবার তাকালো। বিরক্ত হলো। সে তো সব বলতেই পারলো না। আকাশের কথা অমান্য করা যাবে না। তাই অনিচ্ছা সত্ত্বেও উঠলো। যাওয়ার আগে সন্ধ্যার কানে ফিসফিস করে বলে,,
– তোমাকে পরে সব বলব। মন খারাপ করনা।
আকাশ চোখ ছোট ছোট করে তাকায়। এই বে’য়া’দ’ব তার বউয়ের কান ভাঙাচ্ছে না-কি! রে’গে বলে,
– আমার বউয়ের কান ভাঙালে তোর কান কাটব বলে দিলাম।
শিমু হেসে দৌড়ে বেরিয়ে যায়। আকাশ সন্ধ্যার দিকে তাকায়। জিজ্ঞেস করতে গিয়েও জিভ গুটিয়ে নিল। কিছু জিজ্ঞেস করতেও ভ’য় লাগে। থাক। জানার দরকার নেই তার। তার কথাগুলো ধমকের মতো শোনাবে হয়ত। সন্ধ্যা আবার ভ’য় পাবে। খারাপ লাগবে। তার চেয়ে তার কথা কম বলাই ভালো।
সন্ধ্যা মাথা নিচু করে চুপ করে বসে আছে। চোখের কোণে জলকণা চিকচিক করছে। সে আজ কত খারাপ ব্যবহার করেছে আকাশের সাথে। তার আর আকাশের বিয়ের কয়েকদিন পর আকাশ এভাবে বলায় তার কত ক’ষ্ট হচ্ছিল। আর আকাশ যদি এতোদিন হলো তাকে ভালোবেসে থাকে, তবে তার ব্যবহারে নিশ্চয়ই অনেক কষ্ট পেয়েছে। আকাশের কথা, শিমুর কথায় মেয়েটির মনে সূক্ষ্ম ব্য’থার সৃষ্টি হলো। অনুতাপের ব্য’থা। চোখ থেকে টুপ করে দু’ফোঁটা পানি গড়িয়ে তার হাতে বিদ্যমান আকাশের ফোনের উপর পড়ে।
আকাশ হাত বাড়িয়ে তার ফোন নিতে চাইছিল, কিন্তু টুপ করে দু’ফোঁটা পানি পড়তে দেখে আকাশের হাত থেমে যায়। আকাশ ঢোক গিলল। তার সন্ধ্যামালতী কাঁদছে কেন? হাত গুটিয়ে নেয়। মুখটা মলিন হয়। আকাশ সন্ধ্যার কান্নার কারণ ধরতে পারলো না। তার উপস্থিতি সন্ধ্যার কান্নার কারণ ভেবে নিঃশব্দে বেরিয়ে গেল কেবিন থেকে।
দরজায় শব্দ পেয়ে সন্ধ্যা মাথা উঁচু করে তাকায়। আকাশকে বেরিয়ে যেতে দেখে সন্ধ্যার চোখেমুখে আগের চেয়েও দ্বিগুণ অসহায়ত্ব ঘিরে ধরে।
চোখ থেকে টুপটুপ করে পানি গড়িয়ে পড়ে। সে ভুলে কেন গেল, সে শ্যামলা রঙের মেয়ে, সে কথা বলতে পারেনা। তার গুণ নেই বললেই চলে। আকাশ যদি তাকে ভুলেও যেত, তবুও তার অভিযোগ করা মানাত না। কিন্তু আকাশ তো তাকে ভুলে যায়নি। শিমু যে বলল, মনে রেখেছে। সবচেয়ে বড় কথা আকাশের ভাঙা গলায় বলা কথাগুলো এখনো তার কানে বাজছে। আকাশ তার জন্য অপেক্ষা করতে চায়। তার মনে আকাশ থাকতে চায়। তার মনে তো আকাশ ছাড়া কেউ নেই।
কথাগুলো ভেবে দু’হাতের মাঝে মুখ লুকিয়ে ফুঁপিয়ে ওঠে।
আসমানী নওয়ান ইরার কেবিন থেকে বেরিয়ে সন্ধ্যার কেবিনের দিকে যাচ্ছিল। আকাশকে বাইরে বসে থাকতে দেখে ভদ্রমহিলা এগিয়ে আসেন। আকাশ মাথা নিচু করে, দু’হাতের মাঝে মুখ ঠেকিয়ে রেখেছে। আসমানী নওয়ান আকাশের সামনে দাঁড়িয়ে আকাশের মাথায় হাত রেখে ডাকেন,
– আব্বা?
মায়ের কণ্ঠে আকাশ মাথা তুলে তাকায়। আসমানী নওয়ান দেখলেন ছেলের চোখে পানি। দীর্ঘশ্বাস ফেললেন তিনি। ছেলেটার কষ্টে তার বুক ভার হয়ে আসে। মা হয়ে আর কত ছেলের কষ্ট সহ্য করবে? আকাশের গালে হাত দিয়ে বলে,
– কি হইছে আব্বা?
আকাশ বসা অবস্থাতেই দু’হাতে তার মায়ের কোমর জড়িয়ে মুখ ঠেকিয়ে বেঁধে আসা গলায় বলে,
– মা প্লিজ! সন্ধ্যামালতীকে ভুলে যেতে বলো না। আমি আর পারছি না। ওকে একটু বোঝাও না মা, আমি ওকে খুব ভালোবাসি। বিশ্বাস কর, ওকে ছাড়া থাকার কথা ভাবলে আমার দম আটকে আসে। আমি সন্ধ্যামালতীকে ছাড়া ম’রে যাবো মা।
আসমানী নওয়ানের চোখে পানি জমলো। ছেলেটা যে কতশত এমন পা’গ’লামী করেছে এই কয়মাসে। তা শুধু তিনি-ই জানেন।
সন্ধ্যার জ্ঞান ফিরেছে শুনে সৌম্য ইরার কেবিন থেকে বেরিয়ে সন্ধ্যার কেবিনের দিকে যাচ্ছিল। আকাশ আর আসমানী নওয়ানকে পাস করতে গিয়ে আকাশের কথা শুনে তার পা থেমে যায়। আকাশের বলা প্রতিটি কথা শুনতে পেয়েছে সে। বিস্ময় দৃষ্টিতে তাকায় আকাশের দিকে, যে তার মাকে জড়িয়ে বাচ্চাদের মতো বিলাপ করছে। এটা আকাশ? তার তো বিশ্বাস হয়না।
আসমানী নওয়ান আকাশের থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে আকাশের পাশের চেয়ারে বসে। আকাশ ঝাপসা চোখে মায়ের দিকে তাকায়। আসমানী নওয়ান আকাশের চোখ মুছে দিয়ে বলে,
– তুমি বাচ্চাকালেও এতো কাঁদোনি। মেয়েদের মতো এমন ছিঁছকাদুনে হলে কীভাবে? আমি মেয়ে হয়ে নিজেও এতো কাঁদিনা।
আকাশ মায়ের কথা কানে নিল না। শুধু তার মায়ের সামনেই একটু কাঁদে। অন্যদের সামনে তো আর কাঁদেনা। ঢোক গিলে বলে,
– যা ইচ্ছা বলো আমাকে। সন্ধ্যামালতী কবে আমাকে ভালোবাসবে এটা বলো আগে?
আসমানী নওয়ান দীর্ঘশ্বাস ফেলেন। সন্ধ্যার লেখা মেসেজগুলো পড়েছেন তিনি। সন্ধ্যার মনের খবর পেয়েছেন তিনি। কিন্তু মেয়েটি মানসিকভাবে ঠিক নেই। একটু সময় দিলে, একটা স্বাভাবিক পরিবেশ দিলে, ও ঠিক হয়ে যাবে। একটু তো অপেক্ষা করতেই হবে। আসমানী নওয়ান মৃদুস্বরে বলে,
– জান্নাত তোমার-ই থাকবো আব্বা। একটু ধৈর্য ধর। তুমি তোমার রা’গ টা একটু কমাও। অন্তত জান্নাতের কাছে একটুও রা’গ দেখাইবা না।
আকাশ মাথা নেড়ে বলে,
– আচ্ছা।
দু’আঙুলের সাহায্যে ডান হাত গলায় রেখে বলে,
– গড প্রমিস, রা’গ দেখাবো না। আর জোর-ও করব না। ওর থেকে একটু একটু দূরত্ব রাখব, কিন্তু অনেক বেশি দূরত্ব বাড়াতে পারবো না, মানে বোঝাতে চাইছি দূরে চলে যেতে পারবো না।
তবে ও যেন অন্য ছেলেদের সাথে কথা না বলে, তাহলেই হবে।
আসমানী নওয়ান মৃদু হাসলেন। আকাশের এলোমেলো করে লাগানো শার্টের বোতামের দিকে তাকালো। এরপর দু’হাতে শার্টের বোতাম গুলো খুলে, আবার-ও ভালোভাবে লাগাতে লাগাতে বলে,
– তোমারে এইভাবে কেউ দেখলে সবাই তোমারে পা’গ’লা কইবো। বোতামগুলো ভালোভাবে লাগাইবা না?
আকাশ একটু হেসে বলে,
– সন্ধ্যামালতীর জন্য যদি পা’গ’ল উপাধি-ই না পাই, তাহলে সেটা আবার ভালোবাসা হলো না-কি!
আসমানী নওয়ান কিছু বললেন না। আকাশ ডান হাতে ঝাপসা চোখজোড়া মুছে মায়ের কাঁধে মাথা রেখে চোখ বুজল। আগের চেয়ে কিছুটা হালকা লাগছে। ওই যে মা বললো, সন্ধ্যামালতী তার-ই থাকবে। এটুকু-ই তার জন্য অনেককিছু।
সৌম্য স্ট্যাচু হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। দৃষ্টি আকাশের দিকে। তার মনে হলো,, মা-ছেলের এতো সুন্দর একটি বন্ডিং সে আজ প্রথম দেখল আকাশ আর আসমানী নওয়ানের মাধ্যমে। সবচেয়ে বড় কথা, আকাশ তার বোনুকে নিয়ে আসলেই এতোটা সিরিয়াস? আকাশের জোরজবরদস্তির ব্যাপারগুলো সৌম্যকে প্রথম থেকেই ভাবিয়েছে। কিন্তু এতোটা না, যতটা এখনকার আকাশকে দেখে মনে হচ্ছে।
সে এখানে আর দাঁড়ালো না। সন্ধ্যার কেবিনের দিকে এগিয়ে গেল।
আসমানী নওয়ান মৃদুস্বরে বলেন,
– আব্বা একটা কথা শোনো।
আকাশ চোখ বুজে রেখেই বলে,
– বলো।
ভদ্রমহিলা বোঝানোর স্বরে বলেন,
– তুমি কি জানো, সৌম্য অনেক ক’ষ্ট করে বড় হইছে? ওর মাথার উপর কেউ ছিল না। তুমি ওর বড় ভাই। ওকে সবসময় আগলায় রাখবা। ওর মনে আ’ঘা’ত দিবানা। কিছুক্ষণ আগে ওকে যা যা কইছ, এটা একদম ঠিক করনাই।
কথাগুলো শুনে আকাশ মাথা তুলে তার মায়ের দিকে তাকায়। অবাক হয়ে বলে,
– ও আমাকে যা বলেছে, আমি তাই ওকে ফিরিয়ে দিয়েছি। ও শুধু ওর ভালোবাসাকে শ্রদ্ধা করছে। দেখ মা, আমার ভালোবাসার ধরণ ভুল হতে পারে। এর মানে এই নয় যে, আমি আমার সন্ধ্যামালতীকে ভালোই বাসিনা, আমি কা’পু’রু’ষ!
একটু থেমে বলে,
– তাছাড়া ওকে যা বলেছি, রে’গে বলেছি। ওসব ভুলে যাও।
আসমানী নওয়ান বলেন,
– সেটা আমি বুঝতাছি। সৌম্য তো বুঝব না। ওয় কত ক’ষ্ট পাইছে, একবার ভাবছ?
আকাশ কিছু বললো না। আসমানী নওয়ান আকাশের মাথায় হাত বুলিয়ে বলে,
– মানুষের দুর্বল জায়গায় আ’ঘা’ত দিতে নাই আব্বা।
আকাশ গম্ভীর গলায় বলে,
– এই কাজটা তোমার ছোট ছেলেও করেছে। শুধু আমাকে বলছ কেন?
আসমানী নওয়ান মৃদু হেসে বলে,
– কারণ তুমি বড়।
আকাশ হতাশার নিঃশ্বাস ফেলে। অসহায় কণ্ঠে বলে,
– তোমার ওই দুই ছেলেমেয়ে যেন ধোঁয়া তুলসীপাতা। এখন সব সেক্রিফাইস আমার-ই করতে হবে। এটাই আমার কপাল। করছি নাও। আমার সন্ধ্যামালতী আমাকে ভালোবাসলেই হবে।
ছেলের হেয়ালি কথায় আসমানী নওয়ান হাসলেন।
সৌম্য সন্ধ্যার পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। সন্ধ্যা মাথা নিচু করে আছে। থেকে থেকে কেঁপে উঠছে। সৌম্য সন্ধ্যার পাশে বসে বিচলিত কণ্ঠে বলে,
– বোনু তুই কাঁদছিস?
ভাইয়ের কণ্ঠে সন্ধ্যা সাথে সাথে মাথা তুলে তাকায়। দু’হাতে চোখ মুছে নেয়। সৌম্য মলিন গলায় বলে,
– কাঁদছিস কেন বোনু?
সন্ধ্যা কি বলবে বুঝল না। তার কোলের উপর আকাশের ফোন। সে ফোনে টাইপ করতে লাগলো,
– সৌম্য ভাইয়া, আমি রে’গে খালাম্মার ছেলেকে
ডিভোর্স দিতে চেয়েছিলাম। উনি হয়ত, অনেক ক’ষ্ট পেয়েছে। আর উনার ল্যাপটপে পানি ফেলেছিলাম। আমি না বুঝে করেছি। তুমি উনাকে একটা ল্যাপটপ কিনে দিবা ভাইয়া?
সৌম্য বিস্ময় দৃষ্টিতে তাকায়। তার বোন আকাশকে ডিভোর্স দিতে চেয়েছিল? ল্যাপটপে নাকি পানি-ও ফেলেছে। তার তো বিশ্বাস-ই হচ্ছেনা।
সন্ধ্যা তার ভাইকে এটা-ও বলতে চাইলো, যে সে আকাশকে অনেক খামচি দিয়েছে, কিন্তু কেমন যেন অস্বস্তি লাগলো। তাই এটা বললো না। তার অনুশোচনা কাজ করছে। অতঃপর টাইপ করল,
– আমি গতকাল উনার মুখে থুতু দিয়েছিলাম ভাইয়া। আসলে উনি তোমার সাথে দেখা করতে দিচ্ছিল না। তাই অনেক রা’গ হয়েছিল।
সৌম্য সন্ধ্যার লেখাগুলো পড়ে আগের চেয়েও বিস্মিত হয়। অবাক হয়ে বলে,
– কিহহহ? এসব তো বে’য়া’দ’বি। থা’প্প’ড় মা’রলেও মানা যায়!
সন্ধ্যা ঝাপসা চোখে তার ভাইয়ের দিকে তাকায়। সৌম্য বোনের অসহায়ত্বে ঘেরা মুখখানি দেখে আর কিছু বলল না।
আসার সময় আকাশের কথাগুলো সাথে আকাশের তার বোনুর জন্য এমন দশা তার মনে লাগছে ভীষণ। সে আকাশকে খারাপ মানুষ কখনোই ভাবেনি। মাঝে ভুল বুঝেছে। আবার ঠিক-ও হয়েছে। মাঝেমাঝে রে’গে অনেক খারাপ ব্যবহার-ও করেছে। কিন্তু সবশেষে সৌম্য জানতো, আকাশ খারাপ না। কিন্তু একটু আগের আকাশকে দেখে তার অদ্ভুদ লাগছে। এটা তার আশার বাইরে ছিল। সন্ধ্যার উদ্দেশ্যে মৃদুস্বরে বলে,
– আমাদের এতো দুঃখের জন্য আকাশ ভাইয়া দোষী না বোনু।
সন্ধ্যার চোখ থেকে পানি গড়িয়ে পড়ে। আকাশের আগের আচরণ, দেখা হওয়ার পর থেকে আচরণ, আর আজকে একটু আগের আচরণ, সাথে শিমুর কথা,, সবমিলিয়ে সন্ধ্যার সব গুলিয়ে যাচ্ছে।
কিন্তু সবশেষে আকাশের জন্য তার খারাপ লাগছে। সে চায় না, আকাশ ক’ষ্ট পাক। তার-ও তো কষ্ট হয় আকাশ কষ্ট পেলে।
এতোমাস পর আকাশকে দেখে, সে যে একটুখানি বিস্মিত হবে, সেই সুযোগটাও বোধয় আকাশ তাকে দেয়নি। শুধু জোর করেছে তার সাথে। এই দু’দিন তার সাথে যে কি হলো, সবই কেমন গুলিয়ে যাচ্ছে। মাথা ব্য’থা বাড়ে এসব ভাবলে।
সৌম্য কিছু ভাবছে।
আকাশের সাথে দেখা হওয়ার পর থেকে সবাই শুধু রা’গ-ই দেখাচ্ছে। তার বোনু পর্যন্ত রে’গে’ছে। বোনু রে’গে তার চুল টানতো।
কথাটা ভাবতেই সৌম্য নিজের মাথায় হাত বুলালো। আর আকাশের সাথে কত কিছু করে ফেলেছে। ল্যাপটপের কথা মনে পড়তেই সন্ধ্যার উদ্দেশ্যে বলে,
– বোনু তুই তো টাকার মূল্য বুঝিস। আমরা কত ক’ষ্ট করেছি ১০ টাকার জন্য। তবে তুই ল্যাপটপে পানি ফেললি কেন?
সন্ধ্যা ঢোক গিলল। সে তো রে’গে শুধু পানি-ই ফেলেছিল। আকাশ ভেঙেছে। কিন্তু সন্ধ্যার মনে হলো, তার পানিতেই ল্যাপটপ নষ্ট হয়েছে। ওতো দামী জিনিস নষ্ট হওয়াতে আকাশ রে’গে গিয়েছে, সাথে কষ্ট-ও পেয়েছে। কথাগুলো ভেবে সন্ধ্যা ছলছল দৃষ্টিতে তাকায় সৌম্য’র দিকে।
সৌম্য সন্ধ্যার চোখের পানি মুছে দিল। এসব নিয়ে আর কিছু বলবে না ভাবলো। সন্ধ্যা এমনিতেই অনুশোচনা করছে। তার উপর মানসিক অবস্থাটাও ভালো না।
সৌম্য’র ভাবনায় আসে, তার বোনু কত বড় হয়ে গিয়েছে। ক’ষ্ট লুকাতে শিখেছে। সন্ধ্যা আকাশের প্রতি দুর্বল, সে আগে একটুও বুঝত না। সন্ধ্যার কোনো কাজে প্রকাশ পেত না। সবসময় তো হাসতো। কি করে বুঝবে সে? আজ মনে হলো, একটু-আধটু বুঝছে।
এই যে আকাশকে কষ্ট দিয়ে কাঁদছে। আবার তাকে সেসব বলছে। সৌম্য বুঝেছে সন্ধ্যা তার কাছে সমাধান চাইছে। সৌম্য দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে,
– আমি সব ঠিক করে দিব বোনু।
ভাইয়ের কথায় সন্ধ্যা স্বস্তি পেল।
সন্ধ্যাকে নিয়ে আকাশ, আসমানী নওয়ান আর শিমু বাড়িতে চলে গিয়েছে। সৌম্য নিষেধ করেনি। করার কারণ তো নেই। আসমানী নওয়ানের কাছে তার বোনু নিরাপদেই থাকবে। আকাশকেও বিশ্বাস হয়। অরুণ পাশের কেবিনে ঘুমিয়ে আছে।
ইরাকে আগামীকাল রিলিজ দিয়ে দিবে। ইরার মাকে বলতে চাইছিল, সৌম্য বলল না। ইরা তো আগের মতোই ঘুমিয়ে আছে। তাছাড়া একটু পর ফজরের আজান দিবে। আসমানী নওয়ান তাদের নিয়ে সকাল সকাল চলে আসবে। সবমিলিয়ে সৌম্য ইরার কাছে থেকে গিয়েছে।
ইরা চোখ মেলে তাকায়। ঘাড় বাঁকিয়ে দেখল সৌম্য তার মাথার কাছে চেয়ার নিয়ে বসে আছে। দু’হাত আড়াআড়িভাবে রেখে চোখ বুজে আছে। ইরা মৃদুস্বরে ডাকে,
– সৌম্য?
সাথে সাথে সৌম্য চোখ মেলে তাকায়। ইরাকে তাকাতে দেখে সৌম্য একটুখানি এগিয়ে এসে বলে,
– কি হয়েছে ইরাবতী? খারাপ লাগছে?
ইরা ঢোক গিলে বলে,
– একটু পানি খাবো।
সৌম্য পাশের টেবিলে রাখা জগ থেকে গ্লাসে পানি ঢেলে নেয়। এরপর ইরাকে সামান্য উঁচু করে পানি খাইয়ে ইরাকে বালিশে হেলান দিয়ে বসিয়ে দেয়।
ইরা সৌম্য’র দিকে তাকায়। সৌম্য বিয়ে করেছে ভেবে চোখের কোণে পানি জমে। সৌম্য ইরার দিকে ঝুঁকে ইরার মাথায় হাত দিয়ে মৃদুস্বরে বলে,
– ইরাবতী কাঁদিস না প্লিজ!
ইরা ভাঙা গলায় বলে,
– তুই বিয়ে করলি কেন?
সৌম্য সাথে সাথে বলে,
– আমি কাউকে বিয়ে করিনি, বিশ্বাস কর। আমি শুধু তোকে বিয়ে করব ইরাবতী। এখন-ও কাঁদবি তুই?
ইরা সৌম্য’র চোখের দিকে তাকিয়ে আছে। সৌম্য’র কথা শুনে অবাক হয় আবার-ও। নাক টেনে বলে,
– তুই সত্যি বলছিস?
সৌম্য বাম পা তুলে ইরার সামনে বেডের উপর বসল।
ইরার দিকে তাকিয়ে মৃদুস্বরে বলে,
– কিভাবে বললে বিশ্বাস করবি, বল? সেভাবেই বলব।
– তবে ওই মেয়েটা কে?
কথাটা বলতে বলতে ইরার চোখ থেকে পানি গড়িয়ে পড়ে। সৌম্য ডান হাত বাড়িয়ে ইরার চোখ মুছে দিয়ে বলে,
– তোর বাবা এডিট করেছিল হয়ত! আমি তো এসব ব্যাপারে কিছু জানতাম না ইরাবতী। তুই এই যুগের মেয়ে হয়ে এডিট বুঝিস না?
ইরা ছলছল দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। আবার-ও বলে,
– আমার বাবা, মা ওরা কোথায়? আর বাবা কি তোকে মেনে নিবে?
সৌম্য ইরার দিকে তাকিয়ে রইল। এসব ব্যাপারে কিছুই বলল না। ধীরে ধীরে সব বলবে। আজ বললে মেয়েটির ব্রেনের উপর উল্টো প্রভাব পড়তে পারে। অতঃপর বলে,
– সবাই বাসায় আছে। এসব নিয়ে চিন্তা বাদ দে। আমি বলেছি তো তোকে বিয়ে করব। আমাকে বিশ্বাস করিস না তুই?
ইরা মলিন মুখে সৌম্য’র দিকে তাকিয়ে রইল। সৌম্য উঠে দাঁড়ালো। ইরার জন্য খাবার কিনে আনবে ভাবলো। উল্টো ঘুরে এক পা বাড়ালে ইরা সৌম্য’র হাত টেনে কান্নামাখা গলায় বলে,
– আমায় রেখে যাস না সৌম্য।
সৌম্য অসহায় চোখে তাকালো। সে বুঝতে পারছে,
ইরা ভ’য় পাচ্ছে। ভাবছে সে ইরাকে রেখে চলে যাবে। সৌম্য আবার-ও ইরার সামনে বসে দু’হাতের আঁজলায় ইরার মুখটা নেয়। নরম গলায় ডাকে,
– ইরাবতী?
ইরার চোখ থেকে টুপ করে পানি গড়িয়ে পড়ে। সৌম্য ইরার চোখে চোখ রেখে বলে,
– কোথাও যাব না তোকে রেখে। এবার দুনিয়া উল্টে গেলেও তোকে শুধু আমার কাছে রাখব। একবার বিশ্বাস কর আমায়।
আবেগে ইরার চোখ থেকে টুপটুপ করে পানি গড়ায়।
সৌম্য দু’হাতের ইরার চোখ ভেজা গাল মুছে দেয়। মৃদুস্বরে বলে,
– কাঁদিস না আর। তুই কাঁদলে আমার ক’ষ্ট হয়। দু’মিনিট অপেক্ষা কর। তোর জন্য খাবার আনছি।
এরপর ইরাকে ছেড়ে কেবিন থেকে বেরিয়ে যায়। কিছুক্ষণ পর একটি খাবারের প্যাকেট, আর একটি পানির বোতল কিনে আনে সৌম্য।
বা পা ভাঁজ করে বেডের উপর বসে। খাবারের প্যাকেটটি বা পায়ের উরুর উপর রেখে ডান হাতের শার্টের হাতা কনুই থেকে আরেকটু উপরে গুটিয়ে নেয়। এরপর বোতলের পানি ঢেলে হাত ধুয়ে নেয়।
ভাত মাখিয়ে ইরার মুখের সামনে ধরলে দেখল ইরা ছলছল দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে আছে।
সৌম্য মৃদুস্বরে বলে,
– আবার কেন কাঁদছিস ইরাবতী? আমি সত্যি তোকে বিয়ে করব।
ইরা মলিন মুখে বলে,
– তুই তো কখনো খাওয়ার কথা জিজ্ঞেস-ও করতি না। আজ আমাকে খাইয়ে দিবি সৌম্য?
সৌম্য ঢোক গিলে বলে,
– হা কর।
ইরা হা করলে সৌম্য ইরার মুখে খাবার তুলে দেয়। ইরার চোখে জমায়িত নোনাপানি ঝরে পড়ে। সৌম্য বা হাতে ইরার মুছে দিয়ে বলে,
– তুই কি কান্না অফ করবিনা?
ইরা কিছু বলল না। সৌম্য আবার-ও খাবার তুলে দেয় ইরার মুখে। বেশ কিছুক্ষণ পর-ও যখন ইরার চোখ থেকে টুপটুপ করে পানি গড়াতেই থাকে, সৌম্য খাবারের প্যাকেট ইরার কোলের উপর রেখে গম্ভীর গলায় বলে,
– এবার তুই খা। আর খাওয়াতে পারবোনা।
ইরা ছলছল দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলে,
– কেন খাওয়াবিনা?
সৌম্য অসহায় চোখে চেয়ে বলে,
– আমি খাওয়াচ্ছি বলেই তো তুই কাঁদছিস, কখন থেকে কাঁদতে নিষেধ করছি বল তো? আবার অসুস্থ হয়ে যাবি না?
ইরা দু’হাতে চোখ মুছে নেয়। সৌম্য’র দিকে চেয়ে নাক টেনে বলে,
– আর কাঁদবো না। এবার খাওয়াবি সৌম্য?
ইরার কথাটা সৌম্য’র বুকে গিয়ে লাগলো। মন বলে, তার ইরাবতী তাকে এতো কেন ভালোবাসে? সে সত্যিই ইরাবতীর ভালোবাসা কখনো পুষিয়ে দিতে পারবেনা।
আকাশের বলা কথাটা মনে পড়ল সৌম্য’র। ‘ভালোবেসে পা’গ’ল উপাধি না পেলে না-কি সেটা ভালোবাসা নয়।’
কথাটা ভেবে সৌম্য বিড়বিড় করল,
– মনে হচ্ছে,, আকাশ ভাইয়া বোনুকে ভালোবেসে পা’গ’ল হবে। আর আমি ইরাবতীর ভালোবাসা পেয়ে পা’গ’ল হবো।
এরপর খাবারের প্যাকেট নিয়ে ইরার মুখে খাবার তুলে দিতে দিতে বলে,
– খবরদার আর কাঁদবি না।
সৌম্য কথাটা রেগে বলতে চেয়েছিল হয়তো। কিন্তু অতি নরম হয়ে গিয়েছে। ইরা বুঝতে পেরে একটু হাসলো। সৌম্য-ও ইরার দিকে চেয়ে মৃদু হাসলো।
সন্ধ্যা বাসায় আসার পর ফ্রেশ হয়ে বিছানায় শুয়ে আছে। পাশে শিমু ঘুমিয়েছে। ঘরের লাইট জ্বালিয়ে রাখায় শিমু মুখের উপর বালিশ নিয়ে ঘুমাচ্ছে। সন্ধ্যা শিমুকে অন্যরুমে থাকতে বলেছিল। তার জন্য শিমুর-ও ঘুমের প্রবলেম হয়। সবাই তো তার মতো লাইট জ্বালিয়ে ঘুমায় না। কিন্তু শিমু শুনলো না। বলল, সে ম্যানেজ করবে।
সন্ধ্যার ঘুম আসছে না। বারবার এপাশ-ওপাশ করে। সেই হসপিটাল থেকে আকাশকে নিয়ে ভাবছে। এখনো মাথা থেকে বের করতে পারছে না। আকাশ তাকে সত্যিই চায়? অনেক ভালোবেসে চায়? এই একটা কথা ভাবতে ভাবতে তার মাথা ব্য’থা শুরু হয়ে গিয়েছে।
তার অনেক খুত থাকা সত্ত্বেও আকাশ তাকে চায়। কিন্তু আকাশ তো জানেনা তার শরীরে নোংরা স্পর্শে ভরা। সবকিছু মেনে নিলেও এটা কোনো ছেলে মেনে নেয়? তার মনে হলো,, আকাশ তো এখনো জানেনা, সে অপবিত্র। এটা জানলে নিশ্চয়ই তাকে চাইবে না? কোনো ছেলেই চাইবে না। কথাটা ভাবতেই সন্ধ্যার চোখের কোণ ঘেষে পানি গড়িয়ে পড়ে। দমবন্ধ লাগছে। আকাশ তার থেকে আবার-ও আগের মতো মুখ ফিরিয়ে নিলে সে কি করে সহ্য করবে? সন্ধ্যা ছটফট করতে করতে শোয়া থেকে উঠে বসল। পাশে শিমুর ফোন নিয়ে আকাশের নাম্বার তার ফোনে তুলে নিল। এরপর কাঁপা হাতে টাইপ করে, একটি মেসেজ লেখে।
বেশ অনেকটা সময় চুপচাপ মেসেজটির দিকে চেয়ে রইল সন্ধ্যা। এই মেসেজ দেখলে আকাশ হয়ত এখনকার মতো আর তাকে চাইবেনা। কথাটা ভেবে সন্ধ্যার গাল বেয়ে অশ্র গড়ায়।
একসময় মেসেজটি আকাশের নাম্বারে সেন্ড করে দেয় সন্ধ্যা। তারপর ফোন রেখে দু’হাতে মুখ লুকিয়ে ফুঁপিয়ে ওঠে সন্ধ্যা। সে আকাশকে জানিয়ে দিয়েছে। এবার হয়তো আকাশ আর তাকে চাইবে না। কথাটা ভাবতেই মেয়েটির বুক ভেঙে আসলো।
একসময় দু’হাতে মাথার চুল টেনে ধরে। কেন ওসব বাজে স্মৃতি তার পিছু ছাড়ে না? তার জীবন থেকে আল্লাহ সুখ কেড়ে নিয়েছে। তবে তাকে বাঁচিয়ে কেন রেখেছে?
মনে মনে খুব করে চাইল, আকাশ তাকে না চাইলে, সে ম’রে যাক। তার এভাবে বাঁচতে ভালো লাগে না।
আকাশের হাতেই ফোন ছিল। ঘুম আসছিল না বলে ডিভানের উপর বসে ফোন ঘাটছিল। হঠাৎ ফোনে নোটিফিকেশন আসলে আকাশ নোটিফিকেশনটি কেটে দিতে গিয়েও দিল না। ক্লিক করে মেসেজটি অপেন করে।
– আসসালামু-আলাইকুম।
আমি ধ’র্ষি’তা মেয়েদের কাতারে পড়ি। অপবিত্র হয়েছি আমি। আপনি হয়তো এটা জানেন না, এজন্য আমায় চাইছেন। এইতো আমি জানিয়ে দিলাম, এবার আর আমায় চাইবেন না, আমি জানি।
~ সন্ধ্যা
মেসেজটি পড়ে আকাশ বিস্ময় দৃষ্টিতে তাকায়। দ্রুত দাঁড়িয়ে যায়। এমন মেসেজ সন্ধ্যার থেকে কল্পনাও করেনি। বুকে চিনচিন ব্য’থা অনুভূত হলো। তার সন্ধ্যামালতী এসব কেন ভাবছে? মেয়েটি কি জানেনা, ভালোবাসলে এসব ফেলনা হয়ে যায়। কিন্তু তার সন্ধ্যামালতী ক’ষ্ট পাচ্ছে। আকাশ ঢোক গিলল। মেসেজটির রিপ্লে দিতে গিয়ে-ও ফোন ডিভানের উপর ছুড়ে ফেলল। তার ক’ষ্ট হচ্ছে। সে তার সন্ধ্যামালতীকে আগলে নিতে পারেনি।
তার সন্ধ্যামালতী কেন ভাবে সে অপবিত্র? অপবিত্র হলেও বা কি? আকাশ বিড়বিড় করে,
– আমি আমার সন্ধ্যামালতীকে সবসময় চাই, সারাজীবন এভাবেই চাইব।
এরপর দরজা খুলে ঘর থেকে বেরিয়ে আসে। দু’টো ঘর পর সন্ধ্যার ঘর। ভেতর থেকে লাইটের আলো বাইরে এসে পড়েছে। আকাশ বড় বড় পা ফেলে সন্ধ্যার ঘরের সামনে গিয়ে দাঁড়ায়।
সন্ধ্যা বিছানার উপর বসে বসে অনেকটাসময় কাঁদলো। এরপর বিছানা থেকে নেমে দাঁড়ায়। কাঁদতে কাঁদতে হেঁচকি উঠে গিয়েছে। দু’হাতে মুখ মুছে নিজেকে সামলে নিতে চায়। চোখ বুজে থাকে কিছুক্ষণ। এরপর চোখ মেললে দরজায় আকাশকে দেখে সন্ধ্যা বিস্ময় চোখে তাকায়।
আকাশ দেখল, সন্ধ্যার চোখমুখ লাল। তার সন্ধ্যামালতী এতো কেঁদেছে? কেঁদেকেটে চোখমুখ ফুলিয়ে ফেলেছে একদম। আকাশ ঢোক গিলল। এক পা এগোয়, আবার ভাবে সে তো সন্ধ্যার থেকে দূরত্ব রাখতে চেয়েছিল। কথাটা ভেবে দাঁড়িয়ে যায়।
সন্ধ্যা ছলছল দৃষ্টিতে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে। সে কি চাইছে, জানেনা। আকাশকে থেমে যেতে দেখে ক’ষ্ট হলো। দু’চোখ থেকে টুপ করে দু’ফোঁটা অশ্রু গড়ালো।
অন্তঃদহন পর্ব ২৯
আকাশ দেখল সন্ধ্যার গালে গড়িয়ে পড়া নোনাপানি। নিজেকে বোঝালো, সে অনেক আলতো করে জড়িয়ে ধরবে তার সন্ধ্যামালতীকে। অতঃপর দ্রুতপায়ে এগিয়ে গিয়ে দু’হাতে সন্ধ্যাকে বুকে জড়িয়ে নেয়। সন্ধ্যার কানের কাছে মুখ নিয়ে ভারী গলায় সন্ধ্যার মেসেজের উত্তর করে,
– ওয়ালাইকুমুস-সালাম বউ।
আমি সব জানি মেয়ে। তুমি দুনিয়ার সবচেয়ে অপবিত্র নারী হলেও আমার শুধু তোমাকেই চাই সন্ধ্যামালতী।
