অন্তঃদহন পর্ব ৩৪

অন্তঃদহন পর্ব ৩৪
DRM Shohag

সৌম্য ইরাকে ছেড়ে দাঁড়ায়। মৃদুস্বরে বলে,
– জামা পরে আয়। কার্জন হলে হাঁটতে যাবো।
ইরা সৌম্য’র দিকে তাকায়। বলে,
– সত্যিই হাঁটতে যাবি সৌম্য?
সৌম্য ইরার দিকে তাকায়। ইরার উৎফুল্ল মুখটার দিকে সৌম্য তাকিয়ে রইল।
ইরার ইচ্ছে ছিল, রাতের অন্ধকারে ইরা সৌম্য’র হাত ধরে কার্জন হলে হাঁটবে। সৌম্য’র কি সেই সাহস ছিল? সে ইরার সেসব ইচ্ছে খুব যত্ন করে এড়িয়ে যেত। মাঝে মাঝে ইরা খুব জোর আবদার করলে সৌম্য ভীষণ রে’গে যেত। ইরা চোখে পানি নিয়ে প্রস্থান করত। কথাগুলো ভেবে সৌম্য’র মুখ মলিন হয়। ইরার চোখের কোণের পানি। সৌম্য চেয়ে রইল।
ইরা এগিয়ে এসে সৌম্য’র হাত ধরে বলে,

– আমার সেই ইচ্ছে পূরণ করবি সৌম্য? আমার বিশ্বাস-ই হয়না।
কথাটা বলতে গিয়ে ইরার চোখে জমা এক ফোঁটা পানি টুপ করে গড়িয়ে পড়ল। সৌম্য ঢোক গিলল। ডান হাত ইরার গালে রেখে মৃদুস্বরে বলে,
– আমি তোর ইচ্ছে পূরণ করলে তুই কাঁদিস কেন? আমার নিজেকে অপরাধী লাগে ইরাবতী।
ইরা হেসে বলে,
– খুশি হয়ে চোখ ভিজে যায়। কি করব? এসব স্বপ্নেও ভাবিনি তো কখনো, তাই। তুই একটু দাঁড়া। আমি রেডি হয়ে আসি।
কথাটা বলে ইরা দৌড়ে বেরিয়ে যায় ঘর থেকে। সৌম্য একটু হাসলো। যদিও মলিন, তবে হাসিতে প্রাণ আছে৷
সে রেডি-ই আছে। পরনে কালো শার্ট, কালো প্যান্ট। টেবিলের উপর থেকে ঘড়ি নিয়ে হাতে পড়ল।
একটু পর-ই ইরা একটি থ্রি-পিস পরে ঘরে আসে। সৌম্য দেখল। ভালো লাগছে দেখতে। ইরা হতাশ কণ্ঠে বলে,

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

– আমাকে কি সবসময় থ্রি-পিস পরতে হবে সৌম্য?
সৌম্য টেবিলের উপর থেকে একটি চিরুনি নিয়ে ইরার মাথা আঁচড়িয়ে বেনি করতে করতে ছোট করে বলে,
– হুম।
ইরা বুঝতে পারলো, সৌম্য তার কোমর সমান চুলে বেনি করছে। সৌম্য অল্প একটু সময়ের মাঝেই ইরার চুলে একটি বেনি গেঁথে দেয়। ইরা আয়নার সামনে গিয়ে বেনি সামনে আনলে দেখল, বেনিটা সৌম্য খুব সুন্দর করে দিয়েছে। ইরা অবাক হয়ে বলে,

– তুই এতো ভালো বেনি করতে পারিস?
সৌম্য মৃদু হেসে বলে,
– বোনুকে বেনি, খোপা সবসময় আমিই করে দিতাম।
ইরার ভালো লাগলো। মনমরা হয়ে বলে,
– আমি পারিনা।
সৌম্য এগিয়ে এসে ইরার গলা থেকে ওড়না নিয়ে ইরার মাথায় দিয়ে দিতে দিতে বলে,
– একজন পারলেই হবে। যেমন তুই আমায় এতো ভালোবাসতি বলে আমরা এক হতে পেরেছি।
ইরা জবাবে বলে,

– তুই ভালোবাসতি না?
সৌম্য কিছু বলল না। ইরা সৌম্য’র দিকে চেয়ে। আবার-ও বলে,
– তুই যে সেদিন বলেছিলি, তুই বিয়ে করে নিবি।আমি ভেবেছিলাম, তুই সত্যিই বিয়ে করে নিয়েছিস।
সৌম্য ইরার চোখে চোখ রাখে। ইরা টলমল চোখে চেয়ে আছে। সৌম্য দু’হাতের আঁজলায় ইরার মুখটা নিয়ে বলে,
– একটা কথা শুনবি ইরাবতী?
ইরা জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকায় সৌম্য’র দিকে। সৌম্য ইরাকে উল্টোদিকে আয়নার দিকে ঘুরিয়ে দাঁড় করায়। পিছন থেকে ইরাকে জড়িয়ে নিয়ে ইরার মাথার উপর থুতনি রাখে। ইরা সৌম্য’র বুক সমান। সৌম্য তার থুতনি ইরার মাথার উপর রেখে আয়নায় সৃষ্ট ইরার প্রতিবিম্বের দিকে চেয়ে বলে,

কিছু মানুষের জীবনে এরকম অনেক পরিস্থিতি আসে, যখন ভালোবাসা প্রকাশ তো দূর, কাউকে ভালোবাসাটাই তাদের জন্য দণ্ডনীয় অপরাধ হিসেবে গণ্য হয়। আমি তাদের কাতারের একজন ছিলাম ইরাবতী। আর তুই অপরাধী ছিলি আমার মতো অপরাধীকে ভালোবেসে। তার মাসুল দিয়েছিস গত ১১ মাস কোমায় থেকে।
বিশ্বাস কর ইরাবতী, আমি নিজে ক’ষ্ট পেয়ে এতোটা ক্লান্ত হইনি, যতটা ক্লান্ত হয়েছি তোকে ক’ষ্ট দিয়ে। ইরাবতী কাঁদলে, আমার বুকে তীব্র ব্য’থা হত। মাঝে মাঝে মনে হত, ইরাবতীর বেদনাময় চোখের জল ঝরতে দেখে আমি হার্টের রোগী হয়ে গিয়েছি।

ভাবতাম এই নোনাপানির এতো শ’ক্তি কেন?
তারপর মনে পড়ত, সেই প্রতি ফোঁটা নোনাপানি তো আমার ইরাবতীর। আমার ইরাবতীর স্থান আমার বুকে। ইরাবতী ক’ষ্ট পেয়ে অশ্রু ঝরালে, আমার বুক ব্য’থা না করলেই তো বেমানান লাগতো।
আমার ইরাবতীর ঘরে রাজকন্যা দেখতে চেয়েছিলাম, বিশ্বাস কর ইরাবতী সেই রাজকন্যার বাবা শুধু আমি হতে চেয়েছিলাম। তোর রাজকন্যার বাবা হওয়ার এক আকাশ সমান দুঃস্বপ্ন বুকে পুষেছিলাম। কিন্তু আমি বাইরে বের হলে, বাস্তবতার সাথে মিশে যেতাম। বুকে পাথর চেপে তোকে বলেছিলাম, তোর রাজকন্যার বাবা অন্যকে বানিয়ে নিতে।

আমি স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে ছিলাম। কিন্তু ভেতরটা তৃষ্ণায় ফেটে যাচ্ছিল,, একবার তোর মুখে,, ‘ইরাবতীর রাজকন্যার বাবা শুধু সৌম্য হবে’ কথাটা শোনার জন্য।
কিন্তু তুই বললি, তুই ২৫ বছরের মেয়ে হয়ে, ১৫ বছরের মেয়ের মতো আর পা’গ’লা’মি করবিনা।
আমার জীবনে কিছুই ছিল না ইরাবতী। দিনশেষে তোর ওই পা’গ’লা’মি গুলোর কথা ভেবে আমি নিজেকে একটুখানি ভাগ্যবান ভাবতাম। কিন্তু তুই কেমন যেন শ’ক্ত করে নিলি নিজেকে।
কোথায় যেন শুনেছিলাম, মেয়েরা ক’ষ্ট পেয়ে পেয়ে নিজেকে একবার গুটিয়ে নিলে, প্রিয় মানুষটার দিকে আর ফিরেও তাকায় না। কথাটা ভেবে তীব্র ব্য’থায় আমার বুক ফেটে যাচ্ছিল।

মনে হচ্ছিল, আমার ইরাবতী সত্যিই আমাকে ভুলে যাবে? আমি তো আমার ইরাবতীকে ক’ষ্ট ছাড়া কখনো কিছুই দিইনি। তবে কি ইরাবতী অন্যজনকে তার রাজকন্যার বাবা হতে দিবে?
আমার এতোটা ক’ষ্ট কখনো হয়নি ইরাবতী। আমার একটুও বাঁচতে ইচ্ছে করছিল না। আমার ইরাবতীকে কেউ ছুঁয়ে দিলে…………..

সৌম্য থেমে যায়। গলা বেঁধে আসে। সৌম্য’র চোখজোড়া বন্ধ। ইরা অবাক হয়ে সৌম্য’র দিকে চেয়ে আছে। দু’চোখ বেয়ে কতশত অশ্রুকণা ঝরলো মেয়েটার। তার সৌম্য তাকে আগে থেকেই ভালোবাসে, সে জানে। কিন্তু তাকে এতোটা নিখুঁতভাবে অবহেলা করত, সবাই দেখে বলত, সৌম্য ইরাকে ভালোবাসেনা। কিন্তু সৌম্য আর তার ইরাবতী দু’জনেই অনুভব করত, দু’জন দু’জনকে কতটা ভালোবাসে।
সৌম্য চোখ মেলে তাকায়। চোখ দু’টো লাল। ইরাকে তার দিকে ঘোরালো। দু’হাতে আঁজলায় ইরার মুখটা নেয়। ইরা মাথা উঁচু করে তাকায়। দু’জন দু’জনের দিকে চেয়ে আছে। সৌম্য একটু হেসে বলে,
– আমি ভালোবাসা প্রকাশে অপারগ হলেও আমার ভালোবাসা এতোটা ঠুনকো ছিল না ইরাবতী। আমি আমার ইরাবতীর জায়গা কখনো কাউকে দিতাম না।

ইরার চোখ থেকে পানি গড়ায়। সে কি ভেবেছিল? তার সৌম্য কখনো এভাবে তার সামনে ভালোবাসার স্বীকারোক্তি দিবে? তার যে সব স্বপ্ন লাগে। ইরা হাত বাড়িয়ে সৌম্য’র গালে রাখে। ভাঙা গলায় বলে,
– আমি তোকে অনেক ভালোবাসি সৌম্য।
সৌম্য প্রশান্তির শ্বাস নেয়। ইরার কপালে চুমু আঁকে। এরপর দু’হাতে ইরার ভেজা গাল মুছে দেয়। ইরার কপালের সাথে কপাল ঠেকিয়ে চোখে বুজে মৃদু হেসে বলে,
– আমি বাসি না। কিন্তু আমার ইরাবতীকে আমি ছাড়া কেউ ছোঁবে না।
কথাটা বলেই ইরার ঠোঁটে একটা চুমু খায়। এরপর নিজের ছোট্ট একটি বাসনা পূরণ করতে সৌম্য তার ইরাবতীর ঠোঁটজোড়ার স্বাদ নিতে ব্যস্ত হয়। ইরা বোধয় প্রস্তুত ছিল। অবাক না হলেও, প্রথমবার ভালোবাসার মানুষের কাছে এটুকু ছোঁয়া পেয়ে কেঁপে ওঠে। বন্ধ চোখের পাতা পেয়ে সমানে জল গড়ায়। সৌম্য’র চোখ থেকে টুপ করে দু’ফোঁটা জল ইরার দু’গালে এসে পড়ে।

ইরা দু’পা উঁচু করে দু’হাতে সৌম্য’র গলা জড়িয়ে ধরে। সৌম্য তার ইরাবতীর কোমর জড়িয়ে ধরে। একজনের অশ্রুর বাঁধ ভেঙেছে, আরেকজন কঠোর মানবের চোখ থেকে একটু পর পর অশ্রু ঝরে।
কি জানি, কেন এই অশ্রু থামে না দু’জনের। তবে তাদের হৃদয়জুড়ে শুধু প্রশান্তির বন্যা। কেউ কাউকে ছেড়ে দেয় না। প্রায় দশ মিনিটের মাথায় সৌম্য নিজেই ইরাকে ছেড়ে দেয়। ইরা সৌম্য’র বুকে মুখ লুকায়। সৌম্য ইরাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরল। মাথায় একটি চুমু খেয়ে মিটিমিটি হেসে বলে,
– দ্রুত সুস্থ হয়ে যা। আমার ইরাবতীর রাজকন্যার বাবা হওয়ার জন্য অপেক্ষা করছি আমি।
কথাটা শুনে ইরা মাথা উঁচু করে তাকায়। সৌম্য’র চোখের দিকে তাকিয়ে লজ্জামাখা হাসি হেসে বলে,
– আর আমি আমার সৌম্য’র রাজকন্যার মা হওয়ার জন্য।
যদিও ইরার চোখেমুখে ল’জ্জা। কিন্তু সৌম্য’র চোখ থেকে চোখ সরালো না। দু’জনেই দু’জনের দিকে চেয়ে প্রশান্তির হাসি হাসলো।

আকাশ আসমানী নওয়ানকে সন্ধ্যাকে নিয়ে সন্ধ্যাদের বাড়িতে থাকার কথা বললেও সে থাকেনি। সে সন্ধ্যাকে নিয়ে সাইকায়াট্রিস্ট এর কাছে গিয়েছিল। ডক্টর বেশকিছু ঔষধপত্র দিয়েছে। সাথে সন্ধ্যাকেও অনেক কিছু জিজ্ঞেস করেছিল। ডক্টর বলেছে, সন্ধ্যা ভালো আছে। কিছুদিন ঔষধ খেলে একদম ঠিক হয়ে যাবে। সবসময় হাসিখুশি রাখতে হবে সন্ধ্যাকে।
আকাশ সন্ধ্যাকে নিয়ে আর সন্ধ্যাদের বাড়ি যায়নি।
তার সন্ধ্যামালতী তো তাকে দেখে হাসেনা।

বউকে দেখে স্বামী যেমন ধৈর্যহীন হয়ে পড়ে। আবার বউয়ের ভালোর জন্যই স্বামীকে ভীষণ ধৈর্যশীল হতে শেখায়। এই যে আকাশ তার সন্ধ্যামালতীকে কাছে পেয়েও নিজ ইচ্ছেয় দূরে রাখছে তার সন্ধ্যাকে ভালো রাখতে।
আকাশ সন্ধ্যাকে এই বাড়ি এনে শিমুকে বলেছে, তার বউকে হাসাতে। বিনিময়ে ও যা চাইবে তাই দিবে।
শিমু এবার আকাশের কাছে আইফোন চেয়েছে। আকাশ দিবে বলেছে। এ আর এমন কি!
নয়টার পর পর ফোনে অরুণের একটি মেসেজ পেয়ে আকাশ তাড়াহুড়ো করে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যায়। মেসেজটি ছিল,
– আর ৪০ মিনিট পর আমার ফ্লাইট। দেখা করতে চাইলে এয়ারপোর্টে আয়। নয়তো আসতে হবেনা।

আকাশ এয়ারপোর্টে এসে গাড়ি থামায়। আসতে আসতে সময় লেগে গিয়েছে। আকাশ গাড়ি দাঁড় করিয়ে রেখে আশেপাশে ঘুরে ঘুরে অরুণকে খোঁজে। অনেকবার কল করেছে। অরুণ কল ধরে না। আরেকটু ডানদিকে এগিয়ে গেলে অরুণকে উল্টো ঘুরে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে দ্রুত পায়ে এগিয়ে গিয়ে অরুণকে টেনে তার দিকে ফেরায়। রে’গে বলে,
– বে’য়া’দব। তোর প্রবলেম টা কি? কোথায় হারিয়েছিলি? কয়শোটা ফোন দিয়েছি, দেখ তো।
অরুণ চুপ। আকাশ অরুণকে চুপ দেখে রে’গেমেগে অরুণকে একটা থা’প্প’ড় মে’রে দেয়। কলার ধরে দাঁত কিড়মিড় করে বলে,

– আমি কথা বলছি। তোর কথা কানে যায় না। তোর সাহস তো কম না, একা একা টিকিট করে বিদেশ পাড়ি জমাস।
অরুণ এবারেও ছোট করে বলে,
– তুই তো টিকিট বুক করতে নিয়েছিলি। চলে যেতে বললি।
আকাশ বিরক্ত চোখে তাকায়। অরুণের কলার ছেড়ে অরুণকে ধাক্কা দিয়ে বলে,
– তো যা। মেসেজ দিলি কেন আমাকে? সব তো একাই করলি।
অরুণ হঠাৎ চেঁচিয়ে বলে,

– তোরা আমার বন্ধু নয়। আমি ফা’ল’তু টাইম ওয়েস্ট করতে বাংলাদেশে এসেছিলাম। নামের বন্ধু সব। চাস তো আমি ম’রে যাই। গলা টিপে-ও মে’রে ফেলিস না। বাঁচিয়ে রাখিস বেশি ক’ষ্ট দেয়ার জন্য।
এরপর আকাশের পাঞ্জাবির কলার ধরে বলে,
– গায়ে হাত তুললি কেন? এতো সাহস কেন তোর? সবাই তোর কথায় নাচবে কেন? নামের বন্ধু বানিয়ে রেখে কাজের লোকদের মতো আচরণ করবি, তাইনা? একদম বন্ধু গিরি দেখাতে আসবি না ভুলেও। বন্ধু হওয়ার যোগ্যতা-ই তোর নেই।
কথাগুলো বলে অরুণ আকাশের কলার ছেড়ে দেয়।

আকাশ বিস্ময় দৃষ্টিতে অরুণের দিকে চেয়ে রইল। বুকটা ভাড় লাগলো। এতো শ’ক্ত কথা অরুণের কাছে কখনো শোনেনি। আজ হঠাৎ এসব কথা শুনে মুহূর্তেই কেমন চুপচাপ হয়ে গেল।
অরুণ হাতঘড়িতে একবার সময় সময় দেখল। এরপর নিরব আকাশের দিকে চেয়ে তাচ্ছিল্য হেসে বলে,
– দেখ তোর সন্ধ্যামালতী তোর কাছে কয়দিন থাকে! দু’দিন পর আবার আরেকজনের সাথে ভেগে না যায়!
আকাশ অরুণের দিকে তেড়ে যায়। অরুণ আকাশকে ধাক্কা দেয়। আঙুল উঁচিয়ে বলে,
– তোর মা’র খাওয়ার জন্য বসে নেই আমি।

আকাশের শরীরটা দুর্বল ঠেকল। দাঁড়িয়ে রইল। দৃষ্টিতে বিস্ময়, সাথে অসহায়ত্ব। সন্ধ্যামালতী হারিয়ে গেলে অরুণ তার পাশে ছায়ার মতো থেকেছে। অথচ আজ সে তার সন্ধ্যামালতীকে নিয়ে কিসব বলছে। কাছের মানুষের থেকে দুর্বল জায়গায় আ’ঘা’ত পেয়ে আকাশ কেমন বোবা চোখে চেয়ে রইল।
অরুণ দেখল আকাশকে। এরপর উল্টো ঘুরে ঝাপসা চোখজোড়া শার্টের হাতা দিয়ে মুছে ভেতরে চলে যায়।
আকাশ অনেকক্ষণ চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল। বুকে চিনচিন ব্য’থা করছে। সে কি করেছে, যে অরুণ তার সাথে এভাবে কথা বললো? যেন তাকে অ’ভি’শা’প দিল। আর তার সন্ধ্যামালতী? এবার তার সন্ধ্যামালতীকে হারিয়ে ফেললে সে বাঁচবে কি নিয়ে?

আকাশ ঢোক গিলল। উল্টো ঘুরে এলোমেলো পায়ে হাঁটতে হাঁটতে গাড়ির দিকে যায়। মাথা নিচু করে বিড়বিড় করে,
– সন্ধ্যামালতী যেও না। তুমি চলে গেলে আমি এবার সত্যি ম’রে যাবো।
ব্যস্ত রোডে এলোমেলো ভাবে হাঁটছিল। কোনোদিকে খেয়াল ছিল না। যার ফলে ডানপাশ থেকে একটি কার গাড়ি এসে আকাশের পা বরাবর মে’রে দেয়। আকাশ কয়েক হাত দূরে গিয়ে ছিটকে পড়ে যায়। রে’গে বলতে চায়,
– কোন বে’য়া’দ……..

গলার স্বর বের হয় না। মাথা, বুক, পায়ের অ’স’হ্য য’ন্ত্র’ণা’য় চোখ বুজে আসে। দুর্বল ডান হাত তুলে কপালে রাখে। আশেপাশে থেকে মানুষ জড়ো হয়। রাস্তার ওপাশে দাঁড়ানো বায়ান দৌড়ে আসে। আকাশকে দেখে ভীত হয়। দ্রুত আকাশের মাথার কাছে বসে কাঁপা কণ্ঠে ডাকে,
– স্যা…র!!!
আকাশের মুখে মাস্ক থাকায়, সবাই আকাশকে সাধারণ মানুষ ভাবলো। আকাশ ঝাপসা চোখে বায়ানের দিকে তাকায়। ভেঙে ভেঙে বলে,
– বা..ড়ি.তে বল..লে, তো..মাকে খু’ন কর……
আর বলতে পারে না। জ্ঞান হারিয়েছে বোধয়।

আসমানী নওয়ান সন্ধ্যাকে তার পাশে বসিয়েছে। ল্যাপটপে অনবরত আঙুল চালায়। সন্ধ্যা অবাক হয়ে চেয়ে আছে। আসমানী নওয়ানের কথাবার্তার সাথে, এতো দক্ষ হাতে ল্যাপটপ চালানোতে সে ভীষণ অবাক।
আসমানী নওয়ান অনেক খোঁজাখুঁজির পর সন্ধ্যাদের গ্রামের আ’গু’নে পু’ড়ে যাওয়ার সেই ভিডিও সাথে তাদের বাড়ির সিসিটিভি ফুটেজ থেকে আকাশের তার সাথে কিছু বলা কথার ভিডিও কালেক্ট করে।
সে গত দু’দিন যাবৎ এসব খুঁজছে। এইজন্যই সে সন্ধ্যাকে মুখে কিছু বলেনি। তার মনে হয়েছিল, তার মুখের কথা সন্ধ্যা শুনলেও ফিল করতে পারবে না। তার ছেলে সন্ধ্যার জন্য কতটা হাহকার করেছে, সে জানে। আর এটা সে সন্ধ্যাকে নিজ চোখে দেখাতে চায়।

কাজ শেষে আসমানী নওয়ান ল্যাপটপটি সন্ধ্যার কোলের উপর রেখে মৃদু হেসে বলে,
– এইডা দেখ। আমি রান্নাঘরে যাই। কাজ ফাইলা রাখছি।
সন্ধ্যার অবাকের রেশ কাটেনা। আসমানী নওয়ান সন্ধ্যার মাথায় একটা চুমু খেয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে যায়। শাড়ির আঁচলে চোখের কোণা মুছলেন। ছেলের সেসব দিনের কথা মনে পড়লে তার আজ-ও চোখ ভিজে যায়।
সন্ধ্যা ল্যাপটপে ক্লিক করলে ভিডিও অন হয়। আকাশ আর আসমানী নওয়ান দাঁড়ানো। কিছু কথা ভেসে আসে,

আকাশ : মা, তুমি আমাকে শাস্তি দিতে চাইছ তো? আমি সব শাস্তি মেনে নিব বিশ্বাস কর। দেখ, সন্ধ্যা যাওয়ার পর মাস পেরিয়ে গিয়েছে। বিশ্বাস কর, আমি একরাত-ও শান্তিতে ঘুমাতে পারিনি। এবার আমাকে অন্যভাবে শাস্তি দাও।
আকাশ : মা বলো প্লিজ! আমি ম’রে যাচ্ছি। এভাবে আর থাকতে পারছি না। আমার দমবন্ধ লাগছে। সন্ধ্যাকে এনে দাও না মা!
আসমানী নওয়ান : তোমাগো বিয়ার আগে জান্নাত আমায় কইছিল, ওয় বোবা তাই তুমি ওরে ভালোবাসবা না।
আকাশ : ও যেমন, আমি ওকে সেভাবেই ভালোবাসি মা।

সন্ধ্যা বিস্ময় দৃষ্টিতে চেয়ে রইল। চোখের কোণ ঘেষে দু’ফোঁটা পানি গড়িয়ে পড়ে। সে চলে যাবার পর আকাশ তাকে এভাবে খুঁজছিল?
এরপর আরেকটি ভিডিও চালু হয়,
———-
সামনে আ’গু’ন জ্বলছে। রাত হলেও সন্ধ্যার চিনতে একটু-ও অসুবিধা হয়নি, এটাই সেই গ্রাম, যেখানে তার প্রিয় মানুষগুলো পু’ড়ে গিয়েছে।
কয়েক সেকেন্ড এর মাঝেই আকাশকে দেখতে পায়। আকাশের কথাগুলো ভেসে আসে,

সন্ধ্যামালতী?????????
ছাড়ো আমায়। ওখানে আমার সন্ধ্যা আছে। দয়া কর প্লিজ! আমার সন্ধ্যা ম’রে যাচ্ছে।
তোমাদের পায়ে পড়ি, আমায় ছেড়ে দাও প্লিজ! আমার সন্ধ্যা জ্ব’লে যাচ্ছে। আমাকে ওর কাছে যেতে দাও, ওকে বাঁচাতে দাও। আমার সন্ধ্যা ম’রে যাচ্ছে৷ কু’ত্তা’র বাচ্চা ছাড় আমায়।
সন্ধ্যামালতী ???????????
আমি আমার সন্ধ্যাকে ছাড়া বাঁচতে চাইনা। ওকে বাঁচিয়ে দিবি অরুণ? ওর আগুনে ক’ষ্ট হচ্ছে অরুণ। ওকে বাঁচিয়ে দে না!
মা আমার সন্ধ্যা পুড়ে গিয়েছে। আমি ওকে বাঁচাতে পারিনি মা। আমার খুব ক’ষ্ট হয় সন্ধ্যামালতীকে ছাড়া থাকতে। ওকে এনে দাও না মা! আমি আর ওকে বকব না, কখনো ওকে বা’জে কথা বলব না। আমার সন্ধ্যা অভিমান করে হারিয়ে গেছে। ওকে একবার বলো না মা, আমি ওকে খুব ভালোবাসি। ওকে ফিরতে বলো আমার কাছে। আমি ওকে ছাড়া কিছু ভাবতে পারিনা। ও কিভাবে আমাকে রেখে হারিয়ে গেল? মাআআআ কথা বলো।

সন্ধ্যা স্তব্ধ চোখে চেয়ে রইল ল্যাপটপের স্কিনের দিকে। সেই কখন থেকে চোখের কোণ ঘেঁষে টুপটুপ করে পানি গড়িয়ে পড়ছে। আকাশ তাকে এভাবে চেয়েছিল? আর সে সেই আগের আকাশকে ভেবে শা’স্তি দিতে চেয়েছিল। সে আকাশকে একটু-ও বুঝতে চায়নি। বুক চেপে আসছে মনে হলো।
কোলের উপর ল্যাপটপ ছুড়ে ফেলার মতো করে রেখে দৌড়ে ঘর থেকে বেরিয়ে যায়।
আসমানী নওয়ান সন্ধ্যাকে কাঁদতে দেখে চুপ থাকলো। এগোলো না। সন্ধ্যা দ্রুতপায়ে সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠছে। দৌড়ে গিয়ে তার ঘরে গিয়ে ঠাস করে দরজা আটকে দেয়।
এরপর দরজার সাথে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে দু’হাতের মাঝে মুখ লুকিয়ে ডুকরে কেঁদে ওঠে। এক পর্যায়ে কাঁদতে কাঁদতে দরজার সাথে লেগে বসে পড়ে। তার নিঃশ্বাস নিতে ক’ষ্ট হচ্ছে। ভীষণ ক’ষ্ট হচ্ছে তার। সে কথা বলতে পারবেনা জানার পর-ও এতোটা ক’ষ্ট হয়নি।

দেখা হওয়ার পর, সে বুঝেছিল, আকাশ তাকে চায়। কিন্তু সে চাইত, আকাশের একটু হলেও শা’স্তি পাওয়া উচিৎ। আকাশ যখন যা চায়, তা কেন হবে? কিন্তু আকাশ যখন যা চায়, তখন তো সে তা পায়নি। এই ঘটনা কত আগের। আকাশ কতআগে তার জন্য এভাবে পা’গ’লের মতো কেঁদেছে। এতোদিন শুধু তার জন্য অপেক্ষা করেছে। তাকে পেয়ে আবার-ও বাচ্চাদের মতো পা’গ’লা’মি করেছে। তার মুখ ফিরিয়ে নেয়া দেখে আকাশ আবার-ও ক’ষ্ট সহ্য করেছে। অ’প’রাধবোধে সন্ধ্যা নিজেই নিজের দু’হাত খামচে ধরল। চোখের বাঁধ থামে না। আকাশের কথাগুলো এখনো কানে বাজছে। আকাশের চিৎকার করে সন্ধ্যামালতী ডাকটা বারবার যেন তার তার কানে প্রতিধ্বনিত হয়। আকাশের বলা,
‘আমি আমার সন্ধ্যাকে ছাড়া বাঁচতে চাইনা।’

কথাটি ভেবে সন্ধ্যার কান্নার বেগ বাড়ে। তার আকাশ তাকে ছাড়া ম’রে যেতে চেয়েছে। তার আকাশ তাকে ছাড়া শান্তিতে ঘুমাতে পারেনি। আসমানী নওয়ানের কাছে কিভাবে আকুতি করেছে, তাকে এনে দেয়ার জন্য!
কাঁদতে কাঁদতে সন্ধ্যার হেঁচকি উঠে যায়। আকাশে বলা সেই কথাগুলো,
‘ওকে একবার বলো না মা, আমি ওকে খুব ভালোবাসি। ওকে ফিরতে বলো আমার কাছে। আমি ম’রে যাচ্ছি। এভাবে আর থাকতে পারছি না। আমার দমবন্ধ লাগছে। সন্ধ্যাকে এনে দাও না মা!

আকাশের আহাজারিগুলো তার মনে বোধয় গেঁথে গিয়েছে। সন্ধ্যা দু’হাতে মাথার চুল টেনে ধরে। সে কখনো চায়নি তার পাঞ্জাবি-ওয়ালা এতো ক’ষ্ট পাক। কাঁদতে কাঁদতে দম আটকে আসে তার।
কিছুক্ষণ পর সন্ধ্যা বেলকনিতে যায়। চাতক পাখির ন্যায় রাস্তায় তাকায়।
আকাশকে বেরিয়ে যেতে সে দেখেছিল। অনেক রাত হয়েছে তো! সে আসেনা কেন? সন্ধ্যা একটু পর পর দু’হাতে চোখ মুছে। চোখের বাঁধ ভেঙেছে যে, থামার নাম নেই।
ফুঁপিয়ে উঠে মনে মনে বিড়বিড় করে,
– আমার শুভ্র-পাঞ্জাবি-ওয়ালা, আমিও আপনাকে খুব ভালোবাসি। আপনি শুনবেন না?

বায়ান চিন্তিত মুখে আকাশের মাথার কাছে বসে আছে। আকাশের জ্ঞান ফেরেনি। অনেক বড়সড় ক্ষ’তি না হলেও, মোটামুটি ভালোই একটি এক্সিডেন্ট হয়েছে। হাত-পা ভাঙেনি। তবে সব কেঁটে-ফেটে অবস্থা খারাপ।
পকেটে ফোন বাজছে। বায়ান ফোন বের করে দেখল, আসমানী নওয়ানের ফোন। রাত একটা বাজে। আকাশ জ্ঞান ফিরে যদি শোনে, সে বাড়িতে বলে দিয়েছে। আকাশ তাকে যে কি করবে, ভেবেই ভ’য় পাচ্ছে বেচারা। আকাশ নিষেধ করেছে, এজন্য একটুও সাহস পচ্ছেনা।
অনবরত ফোনের আওয়াজেই বোধয় আকাশের জ্ঞান ফিরল। চোখ মেলে বায়ানের দিকে তাকায়। চোখ দু’টো লাল হয়ে আছে। মৃদুস্বরে বলে,

– কে ফোন করেছে?
বায়ান উত্তর দেয়,
– স্যার আপনার মা।
আকাশ হঠাৎ রে’গে বলে,
– বলেছ কিছু?
বায়ান সাথে সাথে বলে,
– না স্যার। কল রিসিভ করিনি।
আকাশ ছোট করে বলে,
– ভালো ছেলে।
এরপর বা হাত বাড়িয়ে বলে,
– আমার ফোন দাও।
বায়ান আকাশের ফোন বাড়িয়ে দেয়। গ্লাস ফেটেছে। তবে ফোন ভালো আছে। আকাশ তার মায়ের নাম্বারে কল করে।
– কই তুমি? ঘড়ি দেখনাই? কতরাত হইছে দেখছ?
আকাশ গলা ঝেড়ে বলে,

– মা আমি একটা কাজে আটকে গিয়েছি। সন্ধ্যামালতী কোথায় মা? ও কি হেসেছিল? শিমু ওকে হাসিয়েছিল তো?
আসমানী নওয়ান বলেন,
– হাসেনি জান্নাত। ওয় অনেকক্ষণ থেইকা কানতাছে।
আকাশ অবাক হয়ে বলে,
– মানে কি? শিমুর পিঠের ছাল তুলব কিন্তু।
– জান্নাত তোমার জন্য কানতাছে।
আকাশ কথাটা ঠিক হজম করতে পারছেনা। ভ্রু কুঁচকে বলে,
– মিথ্যা বলছ তুমি। মিথ্যা মিথ্যা আশা দেখাইওনা তো মা। আর কত যুগ যে সাধনা করতে হবে সন্ধ্যামালতীর ভালোবাসা পাওয়ার জন্য!
আসমানী নওয়ান হেসে বলে,
– আব্বা আমি সত্যি কইতাছি। তুমি কাজ আরেকদিন কইরো। আজ বাড়ি আসো। তারপর বুঝবা। আমি একটুও মিথ্যা কইতাছি না।

বলেই আসমানী নওয়ান কল কেটে দেয়। আকাশ ফোন রেখে হঠাৎ উঠে বসে। ডান হাতে কিছু বেঁধে গেলে বিরক্ত হয়ে ক্যানুলা একটানে খুলে ফেলে। ফলস্বরূপ ফিনকি দিয়ে র’ক্ত বের হয়।
আকাশ ডান হাত একবার ঝাড়া দিয়ে বিরক্ত হয়ে বলে,
– এসব কি বা’ল লাগিয়ে রেখেছে। মে’জা’জ খারাপ।
এরপর বেড থেকে নেমে দাঁড়ায়। ব্যান্ডেজ করা গায়ে তার সাদা পাঞ্জাবি পরতে পরতে বায়ানকে বলে,
– বায়ান গাড়ি বের কর।
বায়ান চোখ বড় বড় তাকায়। দ্রুত বলে,
– স্যার আপনি….
আকাশ রে’গে তাকালে বায়ান চুপ হয়ে যায়। নিয়াজ কেবিনে এসে আকাশের এই অবস্থা দেখে দ্রুতপায়ে এগিয়ে এসে বলে,

– আরে আরে এসব কি করেছ? তুমি তো অসুস্থ। আজকে তোমাকে হসপিটালে থাকতেই হবে।
আকাশ ডান পা সামান্য নাড়িয়ে বলে,
– তোমার হসপিটালে তুমি থাকো। আমি আমার কাজে যাচ্ছি।
নিয়াজ কোমরে হাত দিয়ে বলে,
– কোন মহান কাজ করতে যাচ্ছো তুমি?
আকাশ বলে,
– আমার বউ কাঁদছে, এক্ষুনি আমাকে বাড়ি যেতে হবে।
নিয়াজ অদ্ভুদভাবে বলে,
– এ্যাঁ?
আকাশ ভ্রু কুঁচকে বলে,

– এ্যাঁ নয়, হ্যাঁ। তুমিও বিয়ে করে নাও। তাহলে আমার মতো সুস্থ মানুষকে ফা’ল’তু টাইম ওয়েস্ট করার জন্য তোমার হসপিটালে আটকে রাখার কু’বুদ্ধি মুছে যাবে।
কথাটা বলে কেবিন থেকে বেরিয়ে যায় আকাশ। পায়ে টান লাগছে, একটু খুঁড়িয়ে হাঁটছে। সাথে গা, হাত, সবখানে কেটে যাওয়ায় ভালোই টান পড়ছে। সেসব পাত্তা দিল না।
নিয়াজ কটমট দৃষ্টিতে চেয়ে রইল আকাশের দিকে। এর চিকিৎসা করানোই ভুল হয়েছে। একদম ম’রা’র মতো হয়ে এসেছিল। সে সুস্থ করল, উল্টে তাকে কিসব আখ্যা দিয়ে গেল। নিজে ঠিক করে হাঁটতেই পারছেনা, অথচ দেমাগ দেখিয়ে চলে গেল। আকাশের এসব দেখে তার বিয়ে করার সাধ মিটে যাচ্ছে। এতো বউ পা’গ’লা হওয়ার সাধ তার নেই।

ঘড়ির কাটায় ১টা বেজে ৩০ মিনিট। সন্ধ্যা বেলকনিতে হাঁটু মুড়ে বসে আছে। গ্রিলের ফাঁক দিয়ে চেয়ে আছে। আকাশ বাড়ি ফেরেনা কেন? তার যে কিছুই ভালো লাগছে না। প্রচন্ড মাথা ব্য’থা করছে। কিন্তু তার ঘুম আসেনা। যেন সে প্রতিজ্ঞা করেছে, আকাশকে না দেখে ঘুমাবে না, খাবেনা। আসমানী নওয়ান অনেক জোর করেছিল। সে খেতেই পারেনি। তার সৌম্য ভাইয়া চিন্তিত হয়ে তাকে অনেক জিজ্ঞেস করেছিল। সে চুপ ছিল। কি বলবে সে? আকাশের জন্য তার খুব মন পু’ড়’ছে। এটা ভাইকে কিভাবে বলবে?

কাঁদতে কাঁদতে ক্লান্ত হয়ে গিয়েছে। অথচ আকাশ আসেনা। সন্ধ্যার ভীষণ ছটফট লাগছে। চোখের কোণ ঘেঁষে টুপ করে দু’ফোঁটা পানি গড়িয়ে পড়ে। হঠাৎ দেখল, বাড়ির সামনে একটি গাড়ি এসে থামে। সন্ধ্যা দেখেই চিনেছে এটা আকাশের গাড়ি। কান্নামাখা মুখে একফালি হাসি ফুটেছে। সে এক সেকেন্ড-ও সময় নষ্ট না করে বসা থেকে উঠে পড়ে। দ্রুতপায়ে ঘর থেকে বেরিয়ে দু’টো সিঁড়ি পর পর নামে। ডায়নিং অন্ধকার হলেও সন্ধ্যা কেন যেন আজ ভ’য় পেল না। বরং পায়ের গতি বাড়িয়ে দরজা খুলে বাড়ি থেকে বের হয়।
গাড়ির আওয়াজে দারোয়ান মেইন গেইট খুলে দেয়। বায়ান গাড়ি ঘুরিয়ে ভেতরে এসে গাড়ি গ্যারেজে রাখে। এরপর ভেতর থেকে বেরিয়ে এসে আকাশের পাশের দরজা খুলে দিলে আকাশ ধীরে ধীরে গাড়ি থেকে বের হয়। বায়ান এগিয়ে আসতে নিলে আকাশ বলে,

– লাগবে না। তুমি বাড়ি যাও। অনেক রাত হয়েছে। তোমার মা বাড়ি একা আছে না?
বায়ান মাথা নেড়ে সম্মতি দেয়। এরপর মেইন গেইটের দিকে এগিয়ে যায়। আকাশ কয়েকপা এগিয়ে গ্যারেজ থেকে বেরিয়ে আসে। মাথা উঁচু করে সামনে তাকালে আকাশের পা থেমে যায়। চারপাশে লাইটের আলোয় স্পষ্ট দেখল, তার সন্ধ্যামালতী তার দিকে দৌড়ে আসছে।
খোপা করা চুলগুলো খুলে হাঁটুর নিচে বারি খায়। সন্ধ্যার সেদিকে খেয়াল নেই। হঠাৎ-ই দৌড়ে এসে আকাশের বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ে।

হঠাৎ সন্ধ্যার এভাবে আঁচড়ে পড়ায় আকাশ বুকে ব্যান্ডেজ করার জায়গাটিতে ব্য’থা পায়। কিন্তু আকাশ একটি টুঁ-শব্দটিও করল না। না তো তার মুখে ব্য’থার ছাপ ফুটল।
বায়ান ব্যাপারটি খেয়াল করতেই এগিয়ে আসতে নিলে আকাশ বা হাত উঠিয়ে ইশারায় বায়ানকে চলে যেতে বলে। বায়ান দীর্ঘশ্বাস ফেলল। তাদের স্যার পা’গ’ল-ই হয়েছে বউকে ভালোবাসতে গিয়ে। ভাবনা নিয়ে চলে যায়।
সন্ধ্যার মুখ আকাশের বুকে গিয়ে ঠেকেছে। দু’হাতে আকাশের পিঠের পাঞ্জাবি শ’ক্ত করে খামচে ধরে ফুঁপিয়ে ওঠে। মনে মনে আওড়ায়,

অন্তঃদহন পর্ব ৩৩

– আমার শুভ্র-পুরুষ।
আকাশ স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ব্যান্ডেজে চাপ লেগে র’ক্ত বেরিয়ে পাঞ্জাবি ভিজে উঠেছে।
আকাশের সেসবে ধ্যান নেই। তার ধ্যান শুধু তার সন্ধ্যামালতীর দিকে।
সন্ধ্যামালতী তাকে নিজে থেকে জড়িয়ে ধরেছে, তাও এভাবে? এটা সত্য না-কি স্বপ্ন? আকাশ ঢোক গিলল। চোখ বুজে নেয় না। স্বপ্ন হলে ভেঙে যাবে তো! বিড়বিড় করে,
– আমার সন্ধ্যামালতী।

অন্তঃদহন পর্ব ৩৫