অন্তঃদহন পর্ব ৪৪

অন্তঃদহন পর্ব ৪৪
DRM Shohag

পেরিয়েছে দু’দিন।
সকাল তার ছোট ভাই সায়নের জন্য অনেকগুলো চিপস-চকলেট কিনে এনেছে। পাঁচ বছরের সায়ন তার বোনের আনা চিপস-চকলেট পেয়ে মহাখুশি। বাড়ির বারান্দায় কাঁচা মাটিতে পা ছড়িয়ে বসে সায়ন চকলেট খাচ্ছে। সকাল নয়ন ভরে তার ছোট ভাইটাকে দেখে। সায়ন হাতের চকলেট সকালের দিকে এগিয়ে দিয়ে বলে,
– আপু তুমি নাউ।
সকাল সায়নের মাথায় হাত বুলিয়ে মৃদুহেসে বলে,

– আমি খাবো না। এগুলো সব তোর জন্য এনেছি। তুই আমার জন্য দোয়া করে দে।
সায়ন বা হাত তুলে সকালের মাথায় রেখে হেসে বলে,
– দোয়া করি দিলাম।
সকাল হেসে সায়নের দু’গালে কয়েকটা চুমু খায়। ঝাপসা চোখজোড়া মুছে বলে,
– সাবধানে থাকবি। মায়ের সব কথা শুনবি, বুঝলি?
সায়ন মাথা নাড়িয়ে বোঝায়, সে শুনবে। সকাল হাসল। তবে না চাইতেও চোখ ফেটে জল গড়িয়ে পড়ে। সায়ন খেয়াল করতেই এগিয়ে এসে দু’হাতে বোনের গাল ধরে বলে,
– তুমি কাদছ কিন ছকাল আপু?
সকাল সায়নকে জড়িয়ে ধরল। চোখ থেকে আরও কয়েক ফোঁটা পানি গড়িয়ে পড়ে। নিজেকে সামলে দু’হাতে চোখ মুছে বলে,

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

– কারণ আমি তোকে অনেক ভালোবাসি।
সায়ন বোনের কথা শুনে খিলখিল করে হেসে বলে,
– আমি তুমাকে অনেক বালুবাসি ছকাল আপু।
সকাল ঝাপসা চোখে দেখল ভাইয়ের হাস্যজ্জ্বল মুখ। জিজ্ঞেস করে,
– সন্ধ্যা আর সৌম্য ভাইয়াকেও ভালোবাসিস?
সন্ধ্যা, সৌম্য’র কথা শুনে সায়ন আরও খুশি হলো। সন্ধ্যা, সৌম্য দু’জনেই তাকে দেখলেই অনেক আদর করে। গ্রামে আসার পর সৌম্য তাকে দেখলেই চকলেট নয়তো চিপস আরও অনেককিছু কিনে দেয়। সায়ন মাথা নেড়ে বলে,
– হু। সুন্দা আপু সুম্য বাইয়াকেও বালুবাসি। তুমিও ওদের বালুবাসো?
সকালের চোখজোড়া আবার-ও ভিজে ওঠে। ভাঙা গলায় বলে,
– আমিও ওদের অনেক ভালোবাসি। কিন্তু ওরা আমাকে বিশ্বাস করেনা।
সায়ন চকলেট খেতে খেতে অবুঝ গলায় বলে,

– কিন?
সকাল মলিন হেসে বলে,
– কারণ আমি ভালো না।
সায়ন মাথা নেড়ে বলে,
– না না। ছকাল আপু তুমি বালো।
সকাল একটু হাসল। সায়নের মুখে আরও কয়েকটা চুমু খেয়ে বলে,
– সবসময় লক্ষী ছেলে হয়ে থাকবি, মনে থাকবে?
সায়ন মাথা নেড়ে বোঝায়, মনে থাকবে তার। সকাল সায়নকে বারান্দায় বসিয়ে দিয়ে উঠে দাঁড়ায়। দূরে দাঁড়ানো মায়ের কাছে এগিয়ে এসে বলে,
– মা আসছি।
সকালের মা কিছু বলল না। মলিন মুখে মেয়েকে দেখল। মেয়েটা দু’দিনেই যেন কত শুকিয়ে গিয়েছে। সকালের বাবা এগিয়ে এসে বলে,

– কোথায় যাচ্ছ তুমি?
সকাল কিছু বলার আগেই সকালের মা বলে,
– শহরে যাচ্ছে। বায়ানের কাছে।
সকালের বাবা আর কিছু বলল না। সকাল তার মা, ভাই আর বাবার দিকে আরেকবার তাকালো। দীর্ঘশ্বাস ফেলে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যায়।

আকাশ সন্ধ্যাকে নিয়ে ঢাকা থেকে বগুড়া ব্যাক করছে। তখন দুপুর। বগুড়ার মেইন শহরে আকাশ গাড়ি থামিয়ে সন্ধ্যাকে নিয়ে বের হয়। সন্ধ্যার হাত ধরে হাঁটতে হাঁটতে বলে,
– কি খাবে সন্ধ্যামালতী?
সন্ধ্যা আকাশের দিকে তাকায়। আকাশ ঘাড় ফিরিয়ে চোখ ছোট ছোট করে বলে,
– বুঝেছি চুমু খাবে।

কথাটা বলে সন্ধ্যার দিকে মুখ এগিয়ে আনতে নিলে সন্ধ্যা ডান হাত উঁচু করে আকাশের গাল ধরে মুখ ঘুরিয়ে দেয়। আকাশ হাসলো। আর কিছু বলল না।সন্ধ্যার হাত ধরে এগিয়ে যেতে নিলে হঠাৎ আকাশের চোখে পড়ে বায়ান রেললাইনের মাঝ দিয়ে দৌড়ে আসছে। আকাশ ভ্রু কুঁচকে তাকালো। তারা যেখানে আছে, এখানে ছোটোখাটো তিনটে রেললাইন। বায়ান তাদের পাশের লাইনটায় দৌড়ে এদিকে আসছে। মাঝের রেললাইন থেকে ট্রেন ধেয়ে আসছে। বায়ান দৌড়াতে দৌড়াতে আকাশদের ক্রস করে যায়। আকাশ সাথে সাথে পিছু ফিরে তাকালো। বায়ান মাঝের রেললাইনে চলে গিয়েছে। সামনে ট্রেন হর্ন দিচ্ছে আর এগিয়ে আসছে। আকাশ চোখ বড় বড় করে তাকায়। সন্ধ্যার হাত ছেড়ে বিচলিত কণ্ঠে বলে,

– সন্ধ্যামালতী এখানেই দাঁড়াও। আমি এক্ষুনি আসছি।
কথাটা বলে আকাশ এপাশ থেকে লাফ দিয়ে রেললাইনের উপর যায়। যে লাইনে ট্রেন আসছে, সেই লাইনের পাশের লাইনে আকাশ দৌড়ায় আর ডাকে,
– বায়ান? বায়ান দাঁড়াও।
সন্ধ্যা আকাশের কাজে ভ’য় পেয়ে যায়। ওই যে সামনে ট্রেন আসছে। আকাশ এভাবে দৌড়াচ্ছে কেন? সন্ধ্যা সামনে তাকিয়ে দেখল ট্রেন তাকে ক্রস করতে আর কয়েক সেকেন্ড সময় লাগবে হয়ত। সন্ধ্যা উপর দিয়েই আকাশের পিছু পিছু দৌড়ায়। সে তো ডাকতে পারছে না। কিন্তু ভ’য় বুক কাঁপছে মেয়েটার।

কিছুদূর দৌড়ালে সন্ধ্যার চোখে পড়ে আকাশের পাশের লাইন, অর্থাৎ যে লাইনে ট্রেন আসছে সেই লাইনে একটি ছেলে দৌড়াচ্ছে। ট্রেনের শব্দে আকাশের বলা বায়ান শব্দ শুনতে পায় না। তাই সন্ধ্যা বায়ানকে পিছন থেকে চিনতে পারলো না। তবে বায়ানের সামনে দাঁড়ানো সকালকে দেখে সন্ধ্যা এক দেকখাতেই সকালকে চিনতে পারলো। সন্ধ্যার চোখেমুখে বিস্ময়। দৌড়ের গতি বাড়ালো সে। সকাল এভাবে ভাবলেশহীনভাবে দাঁড়িয়ে আছে কেন?
সন্ধ্যা পিছু ফিরে দেখতে চায়, ট্রেন কতদূর, তখন-ই ট্রেন তাকে পাস করে চলে যায়। ভ’য়ে সন্ধ্যা কেঁপে ওঠে। সামনে তাকিয়ে সকালকে দেখতে চাইল, কিন্তু পারলো না। এখন কি হবে? সন্ধ্যা পায়ের গতি আরও বাড়ালো।
আকাশ দেখল ট্রেন তাকে পাস করছে। আকাশ পায়ের গতি বাড়ালো। চিৎকার করে ডাকে,

– বায়ায়ায়ান?
কয়েক সেকেন্ডের মাথায় আকাশ বায়ানের হাত ধরে টেনে বামদিকে গায়ের জোরে ধাক্কা দেয়। তখন-ই ট্রেনটি তাদের পাস করে চলে যায়। আকাশ স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে। বায়ান ছিটকে গিয়ে পাশের দেয়ালে ধাক্কা খেয়ে চিৎকার করে ডাকে,
– সকাল?
ট্রেনের গুমগুম শব্দে বায়ানের চিৎকার শোনা গেল না। আকাশ বায়ানের দিকে চেয়ে রে’গে বলে,
– তুমি কি পা’গ’ল বায়ান? এভাবে দৌড়াচ্ছিলে কেন? এক্ষুনি তো ট্রেনের নিচে পড়তে।
বায়ান কিছু শুনলো না, সে ঝিম মে’রে বসে আছে। তার হাত-পা অবশ হয়ে আসছে। আকাশ হঠাৎ খেয়াল করল তার সামনে লাইনের উপর সন্ধ্যা দৌড়াচ্ছে। আকাশ অবাক হলো। সন্ধ্যা এভাবে দৌড়াচ্ছে কেন? ভাবনা রেখে সন্ধ্যার পিছু পিছু দৌড়ায় আকাশ।

ইতোমধ্যে সন্ধ্যার চোখ ফেটে পানি গড়িয়ে পড়ছে। সকাল কি ট্রেনের সামনে থেকে সরে গিয়েছে? নাকি ওভাবেই দাঁড়িয়ে ছিল? ট্রেন তো এখনো পাশ দিয়ে যাচ্ছে। কথাগুলো ভেবে সন্ধ্যার বুক কাঁপে।
পিছন থেকে আকাশ এগিয়ে এসে সন্ধ্যাকে জাপ্টে ধরে। ততক্ষণে ট্রেনের শেষ মাথা তাদের পাস করে চলে গিয়েছে। আকাশ সন্ধ্যাকে জড়িয়ে নিয়ে হাঁপানো কণ্ঠে বলে,
– কি হয়েছে সন্ধ্যামালতী?

সন্ধ্যা কান্নামাখা চোখে আকাশের দিকে একবার তাকালো। আকাশ অবাক হয়। কি হয়েছে তার সন্ধ্যামালতীর? ও এভাবে কাঁদছে কেন? সন্ধ্যা আকাশের থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে সামনের দিকে দৌড়ে যায়।
আকাশ এগোতে নিলে দেখল বায়ান তার পাশ কাটিয়ে দৌড়ে সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। তার মনে হলো বায়ান কাঁদছে। আশেপাশে খেয়াল করলে দেখল, অনেক মানুষ ইতোমধ্যে রেললাইনের উপর জড়ো হয়ে গেছে। আকাশ এবার সামনে তাকালো। মানুষের ভিড়ে এখন কিছু দেখতে পেল না। সে ঠিক বুঝতে পারছে না। সে বায়ানকে এভাবে দৌড়াতে দেখে, বায়ানকে বাঁচাতে সম্পূর্ণ মনোযোগ বায়ানের দিকে দিয়েছিল। কিন্তু এখন আশেপাশের অবস্থা, বায়ান, সন্ধ্যার কান্না সব ভেবে আকাশ ঢোক গিলল। ধীরপায়ে সামনের দিকে এগিয়ে যায়।

বায়ান যত বেগে দৌড়ে এসেছিল, ততটাই স্থির হয়ে গিয়েছে তার সামনে রেললাইনের উপর সকালের র’ক্তা’ক্ত কা’টা শরীর দেখে। স্তব্ধ চোখে চেয়ে রইল। সকালের পরনে একটি লাল শাড়ি। সেজেছিল না-কি! কি জানি! বোঝা যায় না তো! পুরো মুখজুড়ে র’ক্তের ছড়াছড়ি। পুরো শরীরের আকৃতি ঠিক নেই। একটা হাত পুরো কে’টে আলাদা হয়ে কয়েক হাত দূরে গিয়ে পড়ে আছে। দু’পা ভেঙে কোনটা কোনদিকে গিয়ে ঠেকেছে ঠিক নেই। সকালের পুরো শরীরে যেন র’ক্তের বন্যা বইছে।

নির্জীব বায়ান কা’টা সকালের পাশেই ধপ করে বসে পড়ল। স্থির দৃষ্টি সকালের পানে।
কাল রাতে সকাল তাকে অনেকবার কল করেছিল। বায়ান কল রিসিভ করছিল না। প্রায় ৫০ বারের বার বায়ান কল রিসিভ করলে সকাল হাউমাউ করে কেঁদে উঠেছিল। বায়ান নয়ম হয়নি। কিছু শ’ক্ত কথা শুনিয়ে দিয়েছিল। এক পর্যায়ে সকাল কান্না গিলে বলেছিল,
– আমি আর তোমাকে বিরক্ত করব না বায়ান। কালকে সকালে একবার বগুড়া আসবে। এটাই শেষ। শুধু একবার দেখব তোমাকে।

বায়ান সাথে সাথে না করে দেয়। সকাল তখন-ও কেঁদেছিল। কাঁদতে কাঁদতে বলেছিল,
– আমি সত্যি-ই আর কখনো তোমাকে বিরক্ত করব না বায়ান। ভালো থেকো।
এরপর সকাল বলে কল কেটে দেয়।
বায়ান সকালকে না করে দিলেও তার মন টিকছিল না। এজন্য সকাল সকাল সে বগুড়ার বাসে উঠে পড়েছিল। কিছুকক্ষণ আগে এসে বগুড়া শহরে নেমেছে। এখন এই শহর থেকে সকালদের গ্রামে যেত, কিন্তু তার আগেই সকালকে এভাবে দেখে তার দুনিয়া ঘুরে ওঠে। জান দিয়ে হলেও বাঁচাতে চেয়েছিল তার সকালকে। কিন্তু পারলো না। সকাল তাকে মিথ্যে নয়, বরং সত্যি সত্যি-ই আর বিরক্ত না করার জন্য না ফেরার দেশে চলে গেল।
সন্ধ্যা সকালের মাথার কাছে বসে দু’হাতের মাঝে সকালের র’ক্তমাখা মুখ নিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদে। সে কখনো চায়নি সকাল খারাপ থাকুক। সকাল তো তার কাছে ক্ষমা চেয়েছিল। খুব কেঁদেছিল-ও। তবে সকাল কেন এমন করল? সে সময় করে বায়ানের সাথে সব ঠিক করে দিত। তবু-ও কেন সকাল এভাবে চলে গেল? সে তো বলতেই পারলো না, সে সকালকে মাফ করে দিয়েছে।

আকাশ কান্নারত সন্ধ্যার দিকে চেয়ে আছে। সন্ধ্যার দু’হাত সকালের র’ক্তে মাখামাখি হয়ে আছে। আকাশ কি বলবে বুঝল না। কেমন অনুভূতিহীন লাগছে।
বায়ানকে স্তব্ধ হয়ে বসে থাকতে দেখে আকাশ ঢোক গিলল। ধীরে ধীরে বায়ানের পাশে রেললাইনের উপর বসে আকাশ। বায়ান আকাশের দিকে তাকিয়ে ভাঙা গলায় ডাকে,
– স্যার! আমার সকাল। ও ও……
গলা বেঁধে আসে বায়ানের। আকাশ মৃদুস্বরে বলে,
– নিজেকে শ’ক্ত কর বায়ান।
বায়ান মাথা নিচু করে ফোঁপায়। বাচ্চাদের মতো করে কাঁদতে কাঁদতে বলে,
– স্যার ও কি একেবারে ম’রে গিয়েছে? ওকে কি বাঁচানো যায় না? একটু দেখুন না স্যার! আমি ওকে অনেক ভালোবাসি স্যার। একবার দেখুন না স্যার, ওকে বাঁচানো যায় কি-না!

আকাশ অসহায় চোখে চেয়ে রইল বায়ানের দিকে। সে বলার মতো কিছু খুঁজে পাচ্ছে না। ভীষণ খারাপ লাগছে তার। অফিসে জয়েন করার পর থেকে বায়ান তার সাথে। বায়নকে ছোট ভাইয়ের থেকে কম মনে হয় না তার।
সন্ধ্যা সকালকে ছেড়ে আকাশের পাশে এসে বসে। আকাশকে ইশারায় বোঝায়,
– সকাল আপুকে হসপিটাল নিয়ে চলুন। দেখুন না আপু বেঁচে আছে কি-না!
আকাশ দৃষ্টিতে অসহায়। সে সন্ধ্যাকে কিভাবে বোঝাবে, যার শরীরের আকৃতি-ই ঠিক নেই, ট্রেনের নিচে পড়ে এতো জ’ঘ’ণ্যভাবে কে’টে কেউ বেঁচে থাকেনা। তারা মেয়েটার কাছে আসার আগেই হয়ত সকাল মা’রা গিয়েছে।
সন্ধ্যা কাঁদতে কাঁদতে আকাশকে ঠেললে আকাশ সন্ধ্যাকে জড়িয়ে নেয়। ভারী গলায় বলে,
– শান্ত হও সন্ধ্যামালতী।

সন্ধ্যার কান্না থামেনা। তার ভীষণ ক’ষ্ট হচ্ছে। ছোট থেকে হাতেগোনা কয়েকদিন সকালের থেকে ভালো ব্যবহার পেয়েছিল। কিন্তু সে তো সকালকে তার বোন ভাবত। সকাল তো তার-ই র’ক্ত। ছোট থেকে সকালকেই বোন মেনে এসেছে। সকালের ভুলের জন্য তার ক’ষ্ট হলেও সে তো বেঁচে আছে। কিন্তু সকাল তো নিজের জীবন-ই দিয়ে দিল। সন্ধ্যা এটা কিভাবে মানবে? কত ক’ষ্ট পেয়ে ম’রে’ছে তার বোনটা। দু’দিন আগেও রাস্তায় বায়ানের পা ধরে কাঁদছিল। কথাগুলো ভেবে সন্ধ্যার কান্নার বেগ বাড়ে। আকাশ সন্ধ্যার মাথায় হাত রাখল। মৃদুস্বরে বলে,
– সন্ধ্যামালতী কান্না থামাও। অসুস্থ হয়ে যাবে।

ধরনীর বুকে সন্ধ্যা নেমেছে।
সকালের লা’শ অ্যাম্বুলেন্সে করে গ্রামে আনা হয়েছে। সকালকে গোসল করিয়ে আঙিনায় খাঁটিয়ায় রেখেছে। সাকলের মা সকালের মাথার কাছে বসে শব্দ করে কাঁদছে। মেয়েটা সকালেই বেরিয়ে গেল। তাকে বলে গেল, সে বায়ানের কাছে যাচ্ছে। অথচ মেয়েটা ম’র’তে গিয়েছিল। একটি কাগজে লিখে গিয়েছে।
– আমার এই পরিণতির জন্য তুমি আর বাবা দায়ী মা। পারলে সায়নকে ভালো শিক্ষা দিও। আর তোমাদের মধ্যে একটুও ভালো না থাকলে, ওকে ভালো শিক্ষা দিতে না পারলে সন্ধ্যা আর সৌম্য ভাইয়ার কাছে সায়নকে দিয়ে দিও। ওরা আমার ভাইকে ভালো মানুষ বানাবে। আর ওর পরিণতি-ও ভালো হবে। অন্তত আমার মতো হবে না।
আমাকে একটু ভালো হতে বলতে পারোনি মা? কেন বলোনি হিংসা করা ভালো নয়? কেন সন্ধ্যার গলা স্বর ন’ষ্ট করার জন্য আমাকে হাতিয়ার বানিয়ে আমার জীবন ন’ষ্ট করে দিলে? আমাকে তুমি বাঁচতে দিলে না মা।
কথাগুলো ভেবে সকালের মা আরও শব্দ করে কাঁদে। সকালের মাকে এভাবে কাঁদতে দেখে সন্ধ্যা এগিয়ে এসে ভদ্রমহিলার পাশে এসে দাঁড়ায়। সকালের মা সন্ধ্যাকে খেয়াল করতেই ডানদিকে ঘুরে দু’হাতে সন্ধ্যার পা ধরলে সন্ধ্যা দ্রুত বসে সকালের মাকে দু’হাতে আগলে নেয়। ভদ্রমহিলা কাঁদতে কাঁদতে বলে,

– আমার সকালের কোনো দোষ নাই মা। ওরে ক্ষমা কইরা দে। আমার মেয়েটারে ফিরে আসতে ক মা। আমি আর তোদের সাথে হিংসা করমু না। আমার মেয়েটা অনেক ক’ষ্ট নিয়া গেছে। এখন থেকে ওরে আমি ভালো হইতে কমু। তোর সাথে মিলেমিশে থাকতে কমু। তোরা আমার গলার স্বার ন’ষ্ট কইরা নে। আমাকে তোরা শা’স্তি দে। তুই, সৌম্য আমারে মাইরা ফালা। আমার মেয়েটারে ফিরে আসতে ক মা।
সন্ধ্যার চোখ থেকে থেকে পানি গড়িয়ে পড়ে। আসমানী নওয়ান মলিন মুখে সকালের মায়ের দিকে চেয়ে আছে। এই মহিলাটি তার বোনের মৃ’ত্যুর জন্য কিছুটা হলেও দায়ী। আর তার জান্নাতের কণ্ঠস্বর কেড়ে নেয়ার জন্য সরাসরি দায়ী। কথাগুলো ভেবে আসমানী নওয়ান এগোতে গিয়েও দাঁড়িয়ে পড়ল।

কিন্তু সন্তান হারানোর বেদনায় প্রতিটি মা যেমন ছটফট করে, ভদ্রমহিলা সেভাবেই ছটফট করছে। একজন মায়ের আর্তনাদে আসমানী নওয়ান নিজেকে আটকালেন না। এক মগ পানি নিয়ে এগিয়ে গিয়ে সকালের মায়ের অপর পাশে বসে। এরপর মগ থেকে সকালের মায়ের মাথায় হাত দিয়ে পানি দিয়ে দেয়।
সকালের মা কাঁদতে কাঁদতে শরীর ছেড়ে দিচ্ছে। সন্ধ্যা এক ধরে রাখতে পারছে না। আসমানী নওয়ান সকালের মাকে আগলে ধরলেন। সামনে খাঁটিয়ায় শোয়ানো সকালের চিরতরে ঘুমন্ত মুখপানে চেয়ে মৃদুস্বরে বলেন,
– যত পাপ-ই কর না কেন! কখনো অন্যের ক্ষ’তি কর না। অন্যের ক্ষ’তি করলে সেই ভার সর্বপ্রথম নিজের উপর আসে। আর তারপর ছেলেমেদের উপর। কখনো কখনো নাতি-নাতনীদের-ও দাদা-দাদির পা’পের ভার বয়ে বেড়াতে হয়।

জ্যোৎস্নার কারণে বাবা মৃ’ত্যুর কোলে ঢলে পড়েছিল। বাবার মনে ক’ষ্ট দিয়ে জ্যোৎস্না কখনো ভালো ছিল না। জ্যোৎস্নার করা সেই ভুলে ওর দু’টো ছেলে-মেয়ে,, সন্ধ্যা, সৌম্য-ও শা’স্তি ভোগ করেছে। তোমার আর তোমার স্বামীর ভুলে সকাল আজ আ’ত্ম’হ’ত্যা’র পথ বেছে নিয়েছে। দোয়া করি, তোমাদের ছোট ছেলের উপর এর প্রভাব না পড়ুক।
আসামনী নওয়ান এর কথাগুলো সকালের মা কাঁদতে কাঁদতে শুনলো। তার বুক ফেঁটে যাচ্ছে। সকাল তার প্রথম সন্তান। তার এই পরিণতি সে মা হয়ে কি করে মানবে? তার পা’প তাকে কোথায় নিয়ে গেল?
সন্ধ্যা অবাক হয়ে শুনলো আসমানী নওয়ানের কথাগুলো। কথাগুলোর অর্থ অনেক গভীর। সন্ধ্যা বুঝেছে। জীবনের সাথে খুব সহজেই মেলালো সে। দু’চোখের পাতা বেয়ে পানি গড়িয়ে পড়ল। তার খালাম্মার কথাগুলো একদম সত্যি।

সায়ন বাড়িতে এতো এতো মানুষ দেখে বাড়ির এক কোণায় দাঁড়িয়ে আছে। সবাইকে কাঁদতে দেখে বাচ্চা ছেলেটা ভ’য় পাচ্ছে। পরিচিত যাকে দেখছে সবাই শুধু কাঁদছে। সকালের খাঁটিয়ার পাশে গিয়ে দেখল সকাল সাদা কাপড়ে মুড়ে শুয়ে আছে। সামনে তার মা কাঁদছে। সায়ন সকালের মুখের দিকে তাকিয়ে অবুঝ গলায় ডাকে,
– ছকাল আপু? ছকাল আপু? উটো। ও ছকাল আপু?
সায়নের কথা শুনে সকালের মায়ের কান্নার বেগ বাড়ে। সন্ধ্যা আর আসমানী নওয়ান সায়নের দিকে অসহায় চোখে তাকালো।

সায়ন সকালকের সাড়া না পেয়ে একটু ঝুঁকে বা হাতে সকালের মুখে দিয়ে বলে,
– ছকাল আপু উটো। আমি তোমাকে বালুবাসি। ছবাই তোমাকে বালুবাসে। একন উটো।
বাচ্চা ছেলেটি ভেবেছে, সকালকে ভালোবাসে বললে সকাল ঘুম থেকে উঠে পড়বে। কিন্তু আশানুরূপ সাড়া না পেয়ে সায়ন টলমল চোখে তাকায়। তার সকাল আপু তো তার এক ডাকেই সাড়া দেয়। আজ কেন দিচ্ছে না। কেঁদে দিয়ে বলে,

– ও ছকাল আপু। ইকটু উটো না! আমার শব চকলেট ছেষ। মা, বাবা কেউ চকলেট কিনে দেয় না। তুমি উটো।
সায়নের কান্ডে আশেপাশেই সবার চোখ ঝাপসা হয়। সৌম্য’র বাবা একপাশে গাছ ধরে দাঁড়িয়ে আছে। থেকে থেকে বুক ব্য’থা উঠছে। চোখেমুখে স্তব্ধতা। ছোট ছেলের কথায় যেন বুক ব্য’থা হুড়হুড় করে বেড়ে গেল।
এদিকে সকালের সাড়া না পেয়ে সায়ন শব্দ করে কেঁদে দেয়। সন্ধ্যা উঠতে নিলে সৌম্যকে দেখে আর উঠল না। সৌম্য এগিয়ে এসে সায়নকে কোলে তুলে একটু দূরে গিয়ে দাঁড়ায়। সায়ন সৌম্য’র গলা দু’হাতে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে কাঁদতে বলে,

– সুম্য বাইয়া ছকাল আপু কতা বলে না কিন?
সৌম্য ডান হাতে সায়নের পিঠে হাত বুলায়। সায়ন সৌম্য’র দিকে তাকিয়ে বলে,
– ছকাল আপু আর আমাকে চকলেট কিনে দিবে না?
সৌম্য মৃদুস্বরে বলে,
– আমি তোকে কিনে দিব।
সায়ন ঠোঁট উল্টে বলে,
– ছকাল আপু আর আমাকে বালোবাসবে না?
সৌম্য অসহায় চোখে তাকালো। সায়ন সৌম্য’র কাঁধে মাথা ঠেকিয়ে ফোঁপাতে ফোঁপাতে বলে,

– ছকাল আপু ছবাইকে বালোবাসে। তুমি বিছছাস কর না, তাই ছকাল আপু কাঁদে।
সৌম্য ঢোক গিলল। আজ দুপুরের আগে আগে সকাল তার সামনে এসে কিছু বলতে চেয়েছিল। কিন্তু সে শোনেনি। সকালকে এড়িয়ে চলে গিয়েছে। সকাল এমন একটা কাজ করবে, সে একটু-ও বুঝতে পারেনি। সৌম্য’র পাশে দাঁড়ানো ইরা ঝাপসা চোখে বাচ্চা ছেলেটির দিকে চেয়ে রইল।
সৌম্য ডানদিকে নজর করলে হঠাৎ দেখল, তার বাবা পড়ে যাচ্ছে। সৌম্য সায়নকে কোলে নিয়েই একপ্রকার দৌড়ে তার বাবার দিকে এগিয়ে যায়। তার আগেই ভদ্রলোক মাটিতে ঠাস করে পড়ে যায়। পিছু পিছু ইরা যায়। আকাশ খেয়াল করলে সে-ও এগিয়ে যায়। সন্ধ্যা-ও উঠে আসে।
সৌম্য সায়নকে কোল থেকে নামিয়ে দিয়ে দ্রুত তার বাবার মাথা তর উরুর উপর নেয়। কাঁপা গলায় ডাকে,

– বাবা?
অপরপাশে এসে সন্ধ্যা বসেছে। ডানহাত বাড়িয়ে তার বাবার মাথায় হাত রাখে। সৌম্য’র বাবা ঝাপসা চোখে দুই ছেলেমেয়ের দিকে তাকায়। কাঁপা হাত তুলে সন্ধ্যার গালে রাখে। কিছু বলতে চাইছে বোধয়, কিন্তু কথা বলতে পারছে না। এই ছেলেমেয়ে দু’টোকে সে কত ভালোবাসতো! কিন্তু হঠাৎ কি হলো কে জানে! সে নিজেই নিজেকে চিনতো না। কত অবিচার করেছে এদের সাথে। কথাগুলো ভেবে ভদ্রলোকের চোখের কোণ ঘেঁষে পানি গড়িয়ে পড়ে। সন্ধ্যার গাল থেকে হাত নামিয়ে নেয়। ডান হাত বাড়িয়ে হাতিয়ে হাতিয়ে সৌম্য’র পা খুঁজে, পা ধরলে সৌম্য দ্রুত তার বাবা হাত টেনে ধরে অবাক হয়ে বলে,

– বাবা কি করছ?
সৌম্য’র বাবা কথা বলতে চাইলে এবারেও ব্যর্থ হয়। দু’হাত জমা করে ইশারায় বোঝায়, তাকে ক্ষমা করে দিতে। সন্ধ্যার দিকে একবার তাকালে দেখল সন্ধ্যা কাঁদছে। সৌম্য’র বাবার চোখজোড়া ভরে ওঠে। এতো অন্যায় করার পর-ও ছেলেমেয়ে দু’টো তার জন্য কত ব্যকুল। এতোবছর যেন জ্যোৎস্নার দু’টো প্রতিচ্ছবি দেখল সে।
সন্ধ্যা, সৌম্য তাকে ক্ষমা করলেও সে নিজেকে কখনো ক্ষমা করতে পারবে না। এতোদিন হাজারটা সুযোগ পেয়ে যাদের এড়িয়ে গিয়েছে। আজ তাদের সাথে দু’টো কথা বলতে ছটফট করছে। কিন্তু আল্লাহ ভদ্রলোকের সেই ইচ্ছে পূরণ করল না। ভদ্রলোক দু’হাত উঁচু করে কিছু বলতে চায়,, খুব চেষ্টা করল। ছটফট করল। কিন্তু একটি শব্দ-ও বের করতে পারল না। তার আগেই নিস্তেজ হয়ে গেল। দু’হাত পড়ে গেল। চোখজোড়া বন্ধ হয়ে গেল। দু’চোখের কোণ ঘেঁষে দু’ফোঁটা পানি গড়িয়ে পড়ল। সন্ধ্যা ফুঁপিয়ে ওঠে। সৌম্য শব্দ করে ডেকে ওঠে,

– বাবা?
সন্ধ্যার কান্নার বেগ বাড়ে। সৌম্য’র চোখজোড়া ভরে ওঠে। পাশে সায়ন সন্ধ্যাকে কাঁদতে দেখে শব্দ করে কেঁদে দেয়। ইরা সায়নকে কোলে নিয়ে একটু দূরে গিয়ে সায়নকে থামানোর চেষ্টা করে। ওড়নার কোণায় চোখ মুছে বলে,
– কাঁদে না ভাইয়া। কিছু হয়নি।
সায়ন দু’হাতে ইরার গলা জড়িয়ে ধরে ফোঁপায়। ছেলেটা কিছু বুঝতে পারছে না। তবে বাড়ির অস্বাভাবিক অবস্থায় ভীষণ ভ’য় পাচ্ছে।

আকাশ সৌম্য’র বাবাকে দেখে সৌম্য’র বাড়ির উঠান থেকে গাড়ি আনতে গিয়েছিল। রাস্তায় গাড়ি দাঁড় করিয়ে দ্রুতপায়ে এগিয়ে এসে বলে,
– সৌম্য গাড়ি এনেছি। উনাকে ধর। হসপিটাল নিতে হবে।
কথাটা বলে হাঁটুগেড়ে বসে বলে,
– সন্ধ্যামালতী সরে বসো।
সন্ধ্যা কাঁদতে কাঁদতে তাকায় আকাশের দিকে। সৌম্য পাশ থেকে ভাঙা গলায় বলে,
– বাবা তো আর নেই আকাশ ভাইয়া। কাকে হসপিটাল নিব?
সৌম্য’র কথা শুনে আকাশ অবাক হলো। ঢোক গিলে কান্নারত সন্ধ্যাকে দু’হাতে আগলে নেয়। দৃষ্টি সৌম্য’র পানে। চোখের কোণে পানি জমেছে আকাশের। নিজের বাবার কথা মনে পড়ে গেল যে!

সময় বহমান। সে তার মতো চলে যায়। ঠিক যেমন পেরিয়েছে দীর্ঘ একমাস।
ধরনীর বুকে সকালের আমেজ। বায়ান তার ঘরের বেলকনির কোণায় উদাম গায়ে চুপ করে বসে আছে। কিছুক্ষণ আগে ঘুম ভেঙেছে। বায়ান নির্জীব দৃষ্টিতে আকাশপানে চেয়ে আছে। পাশেই ফোন রাখা। নোটিফিকেশনের শব্দ পেয়ে বায়ান দ্রুত ফোন হাতে নিয়ে ফোনের আলো অন করলে দেখল সিম কোম্পানি থেকে মেসেজ এসেছে। বায়ান মলিন মুখে ফোনের স্ক্রিনের দিকে চেয়ে রইল। গত একমাসে বায়ান কতশতবার নোটিফিকেশনের শব্দে হত দন্ত হয়ে ফোন চেক করেছে সকাল মেসেজ দিয়েছে ভেবে। কিন্তু সকাল তো নেই। কোথাও নেই। বায়ান মেসেজ অপশনে গেল। এক মাস আগে সকালের নাম্বার থেকে আসা শেষ মেসেজটিতে চোখ বুলায় বায়ান,

– তোমার মনে আছে বায়ান? আমি তোমাকে বলেছিলাম আমার দু’টো ভাই-বোন ছিল। তারা পু’ড়ে মা’রা গিয়েছে। আমি তাদের জন্য মাঝে মাঝে কাঁদলে তুমি আমাকে সান্ত্বনা দিতে। আমি তোমাকে সন্ধ্যার নাম বলিনি কারণ ভ’য় পেতাম তেমাকে হারানোর। কিন্তু সবশেষে তুমি জানতে পারলে, আমিও হারিয়ে ফেললাম তোমায়।
একটা কথা জানো বায়ান, প্রতিটি ছেলেমেয়ে ছোট থেকে তাদের মায়ের থেকে শিক্ষা পায়, সত্য-মিথ্যার তফাৎ। ভালো-মন্দের বিচার করতে পারার মন-মানসিকতা। কিন্তু আমি আমার মায়ের থেকে শিক্ষা পেয়েছি, সন্ধ্যা আর সৌম্য ভাইয়া আমার শ’ত্রু। আর সেই শিক্ষাতেই আমার জীবন চলত। তারপর তোমার সাথে পরিচয় হওয়ার পর অনেককিছু বুঝেছি। অনেককিছু শিখেছি। তোমার সংস্পর্শে এসে ভালো মানুষ হওয়ার চেষ্টা করেছি। যা আমি আমার বাবা-মার কাছে পাইনি।

কিন্তু পাপ তো পাপ-ই। আমি অনেক অন্যায় করেছি। অনেক পা’প করেছি।
সবশেষে বুঝেছি, কিছু পা’পের খেসারত জীবন দিয়ে দিতে হয়। তাই আমিও আমার জীবন দিয়ে পা’পের খেসারাত দিয়ে দিলাম। তুমি বলেছিলে, সারাজীবন ন’ষ্ট করার চেয়ে সাময়িক ক’ষ্ট পাওয়া ভালো। আমি বুঝেছি আমার মতো মেয়ের সাথে থাকলে তোমার জীবন ন’ষ্ট হত। আর তাই আমি নিজেকে মুক্তি দিয়ে আমার থেকে তোমাকে বাঁচিয়ে দিলাম। এবার তুমি সাময়িক ক’ষ্ট পেয়ে তোমার সারাজীবন সুন্দর করে সাজিয়ে নিও, কেমন?
বায়ান জানো? আমি তোমাকে সত্যিই ভালোবাসি। তুমি অন্যকারো হলে আমি খুব ক’ষ্ট পাবো। তবুও তুমি তোমার জীবন নতুন করে সাজিয়ে নিও। আমার মতো মেয়ের ছায়া আর কখনো তোমার উপর পড়বে না। ভালো থেকো বায়ান।

মেসেজটি পড়তে গিয়ে বায়ানের চোখ থেকে দু’ফোঁটা পানি ফোনের স্ক্রিনের উপর পড়ল। মাথা তুলে ঝাপসা চোখে আকাশপানে তাকায়। ভাঙা গলায় আবার-ও বিড়বিড় করে বলে,
– ধরনীর বুকে নিয়ম করে সকাল আসে। আর আমি বায়ানের বুক থেকে সকাল চিরতরে হারিয়ে গিয়েছে।
তোমাকে সুযোগ দেয়ার একটি ক্ষুদ্র সুযোগ-ও আমায় তুমি কেন দিলে না সকাল!

সন্ধ্যার পর পর,
সায়ন সৌম্যদের বাড়ির সোফায় বসে দু’টো গাড়ি দিয়ে খেলছে। গাড়ি দু’টো সৌম্য কিনে দিয়েছে। সায়নের এক পাশে সন্ধ্যা বসা। আরেক পাশে ইরা। সায়ন হঠাৎ উঠে গিয়ে সন্ধ্যার কোলের মধ্যে বসে দু’হাতে সন্ধ্যার গলা জড়িয়ে ধরে। সন্ধ্যা সায়নকে জড়িয়ে নিয়ে সায়নের দিকে তাকায়। সায়ন সন্ধ্যার মাথার সাথে তার মাথা ঠেকিয়ে মন খারাপ করে বলে,

– ছকাল আপু আর আসে না। আর আমাকে চকলেট কিনে দেয় না। বাবা আর আসেনা। মা আর আমার সাথে কথা বলে না। মা শুদু একা একা কতা বলে। আমাকে আর কেউ বালোবাসে না সুন্দা আপু।
সায়নের কথা শুনে সন্ধ্যা আর ইরা একে-অপরের মুখ চাওয়াচাওয়ি করল। সন্ধ্যা সায়নের মাথা তার বুকে রেখে মাথায় হাত বুলায়। ইরা সায়নের গালে হাত দিয়ে মৃদু হেসে বলে,
– তোমার সন্ধ্যা আপু, সৌম্য ভাইয়া, আমি, আকাশ ভাইয়া সবাই তো তোমাকে ভালোবাসি ভাইয়া।
ইরার কথায় সায়ন একটু হাসলো। কিন্তু মন খারাপের রেশ কাটেনা। কতদিন হয়ে গেল তার বাবা, বোন স্বাভাবিক মাকে পায়নি। বাচ্চা ছেলেটার থেকে থেকে মন খারাপ হয়ে যায়।

– আমি আমার সন্ধ্যামালতীর অপারেশন করাবো না। না মানে না। আমি ম’রে গেলেও আমার সন্ধ্যালামতীর অপারেশন করাবো না। বুঝেছ তুমি? ফার্দার এই টপিক নিয়ে আমাকে কিছু বলতে আসলে একদম ভালো হবে না বলে দিলাম।
কথাগুলো বলে আকাশ ল্যাপটপ ঠাস করে বন্ধ করে দেয়। পাশে বসা সৌম্য আকাশের কান্ডে তব্দা খেয়ে যায়।
গত একমাস আগে নিয়াজ বলেছিল, তার সাথে ইম্পর্ট্যান্ট ব্যাপারে কথা বলবে। কিন্তু মাঝে তার বাবা আর সকাল মা’রা যাওয়ায় এতোদিন কিছু বলেনি। আজ কল করে তাদের সন্ধ্যার অপারেশ নিয়ে বলছিল। বলছিল, সব অপারেশনেই রিস্ক থাকে। আর এটা নরমাল। সন্ধ্যার অপারেশন সেরকমই। এতো প্যারা না নিতে। কিন্তু কথার মাঝখানেই আকাশ রে’গেমেগে চিল্লিয়ে ল্যাপটপের স্ক্রিন বন্ধ করে দিল।

সৌম্য আকাশকে কিছু বলতে চায়, তখন-ই দরজায় দৃষ্টি পড়লে সন্ধ্যাকে দেখে অবাক হয়। সৌম্য উঠে দাঁড়ায়। কি বলবে বুঝতে পারছে না। সন্ধ্যা ঝাপসা দৃষ্টি জড়ো এনে সৌম্য’র দিকে ফেলে। সৌম্য ঢোক গিলল। মৃদুস্বরে ডাকে,
– বোনু?
আকাশ সৌম্য’র ডাক শুনে দরজা দিকে তাকালে সন্ধ্যাকে দেখে অবাক হলো। সন্ধ্যা আবার-ও আকাশের দিকে তাকালে দু’জনের দৃষ্টি মিলিত হয়। সন্ধ্যার ঝাপসা দৃষ্টি দেখে আকাশ ঢোক গিলল। কোল থেকে ল্যাপটপ সরিয়ে উঠে দাঁড়ায়। সন্ধ্যার দিকে এগোতে নিলে সন্ধ্যা সায়নকে ইরার কোলে দিয়ে দ্রুতপায়ে তার রুমের দিকে যায়।
আকাশ পায়ের গতি বাড়িয়ে সন্ধ্যার পিছু পিছু যায়।
ইরা, সৌম্য দু’জনেই অসহায় দৃষ্টিতে চেয়ে রইল।

সন্ধ্যা তার ঘরে এসে বিছানার কোণায় উল্টো ফিরে শুয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। সে আকাশকে এ পর্যন্ত হাজারবার বলেছে, অপারেশনের কথা। কিন্তু আকাশ এক কান দিয়ে শোনে আরেক কান দিয়ে বের করে দেয়। আর আজ বলল, ম’রে গেলেও তার অপারেশন করাবেনা। সন্ধ্যার দলা পাকিয়ে কান্না আসছে।
আকাশ ঘরের দরজা আটকে দিয়ে সন্ধ্যার পাশে এসে শুয়ে পড়ে। পিছন থেকে সন্ধ্যাকে জড়িয়ে ধরে, সন্ধ্যার গালের সাথে গাল ঠেকিয়ে ডাকে,
– সোনা বউ?
সন্ধ্যা নড়ে না। আকাশ সন্ধ্যাকে তার দিকে ঘুরিয়ে দেখল সন্ধ্যা চোখ বুজে নিঃশব্দে চোখের পানি ফেলছে। আকাশের চোখেমুখে অসহায়ত্ব ঘিরে ধরে। সন্ধ্যাকে চিত করে শুইয়ে সে সন্ধ্যার উপর আধশোয়া হয়। দু’হাতে সন্ধ্যার দু’গাল আগলে নিয়ে বলে,

– স্যরি! প্লিজ কান্না অফ কর।
সন্ধ্যা না তো কান্না থামায়, আর না তো চোখ খোলে। আকাশ সন্ধ্যার কপালে চুমু আঁকে। এরপর সন্ধ্যার দিকে চেয়ে অসহায় কণ্ঠে বলে,
– প্লিজ সন্ধ্যামালতী! আমার দিকটা একটু বোঝো!
সন্ধ্যা ধীরে ধীরে চোখ মেলে তাকায়। আকাশ দেখল, এটুকু সময়ে কেঁদেকেটে চোখমুখের অবস্থা বারোটা বাজিয়ে ফেলেছে। আকাশ সন্ধ্যার চোখে চোখ রেখে বলে,
– তোমার কি চাই বলো? এটা ছাড়া তোমার সব ইচ্ছে পূরণ করব।
সন্ধ্যা ঠোঁট নাড়িয়ে বলে,

– আমি কথা বলতে চাই। এটা ছাড়া আর কিছু চাই না।
আকাশ কি বলবে বুঝল না। সন্ধ্যার দিকে আরেকটু এগিয়ে এসে অসহায় কণ্ঠে আওড়ায়,
– স্যরি!
সন্ধ্যার চোখজোড়া আবার-ও ভরে ওঠে। চোখ বুজে বামদিকে মুখ ফিরিয়ে নিলে, আকাশ সন্ধ্যাকে তার দিকে ফিরিয়ে সন্ধ্যার অধরে নিজ অধর মেলায়। সন্ধ্যা একটু-ও নড়লো না। আকাশকে আটকালো না। সে নিঃশব্দে চোখের পানি ফেলে।
প্রায় মিনিট তিন পর আকাশ সন্ধ্যাকে ছেড়ে সন্ধ্যার দিকে তাকায়। সন্ধ্যাকে নির্জীব দেখে আকাশের বুকে চিনচিন ব্য’থা হলো। আকাশ বিছানায় বাম কাত হয়ে শুয়ে তার বাম হাতের উপর সন্ধ্যার মাথা রেখে সন্ধ্যাকে জড়িয়ে ধরে। ডান হাতে সন্ধ্যার ভেজা মুখ মুছে দিয়ে সন্ধ্যার ঠোঁটে দু’টো শুকনো চুমু খায়। মৃদুস্বরে বলে,

– আমার সোনা বউ তুমি। আগামীকাল তোমাকে তোমার পছন্দের হাওয়াই মিঠাই খাওয়াবো। এখন কান্না অফ কর।
সন্ধ্যা চোখ মেলে তাকায়। নাক টেনে ঠোঁট নাড়িয়ে বোঝায়,
– আমি খাবো না।
আকাশ দু’হাতে সন্ধ্যাকে শ’ক্ত করে জড়িয়ে নেয়। সন্ধ্যার গলায় মুখ গুঁজে দুষ্টু হেসে বলে,
– আচ্ছা তাহলে আমাকে খাওয়াবো।

অসময়ে শুয়ে আকাশ, সন্ধ্যা দু’জনেই ঘুমিয়ে গিয়েছিল। হঠাৎ সন্ধ্যার ঘুম ভেঙে যায়। আকাশের বন্ধন থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে ফোনে সময় দেখল, রাত ১০ টা বাজে। সন্ধ্যা বিছানা থেকে নেমে ওয়াশরুমে গিয়ে ওজু করে বেরিয়ে আসে। এরপর এশার নামাজ পড়ে জায়নামাজে বসে বসে আবার-ও নিঃশব্দে কাঁদে। বিছানায় ঘুমিয়ে থাকা আকাশের দিকে তাকিয়ে কান্না বাড়ে। তার আকাশের উপর অভিমানের পাহাড় জমেছে। কিন্তু আকাশ তার অভিমান বুঝে হাজারটা উপায়ে অভিমান ভাঙায়, অথচ সে যেটা চায় সেটা দেয় না। উল্টে রে’গে যায়।
সন্ধ্যা দু’হাতে চোখ মুছে জায়নামাজ ভাঁজ করে দেখে দেয়। এরপর ঘর থেকে বেরিয়ে ঘরের দরজা ভিড়িয়ে দেয়। আসমানী নওয়ান হয়ত ঘুমিয়েছে। সন্ধ্যা সৌম্য’র ঘরের দিকে নজর করলে দেখল ঘরের লাইট জ্বালানো। সন্ধ্যা এগিয়ে গিয়ে সৌম্য’র ঘরের দরজায় দু’বার টোকা দিলে ইরা এসে দরজা খুলে দেয়। সন্ধ্যাকে দেখে বলে,

– ভেতরে এসো সন্ধ্যা।
সন্ধ্যা ইশারায় বোঝায়,
– সৌম্য ভাইয়া আছে?
ইরা বলে,
– হ্যাঁ তোমার ভাই ঘরেই আছে। এসো।
সন্ধ্যা ইরার পিছে ঘরে প্রবেশ করে। সৌম্য উদাম গায়ে বিছানায় সটান হয়ে শুয়ে ছিল। কপালে চিন্তার ভাঁজ। চিন্তাটা সন্ধ্যাকে নিয়ে। সে দোটানায় ভুগছে। সন্ধ্যা এসেছে শুনতে পেয়ে সৌম্য শোয়া থেকে উঠে বসল। ডান হাত বাড়িয়ে সন্ধ্যাকে ডাকে,
– বোনু এদিকে আয়।
সন্ধ্যা ধীরপায়ে এগিয়ে আসে ভাইয়ের দিকে। সৌম্য’র থেকে একটু দূরত্ব রেখে দাঁড়ায়। সন্ধ্যার কেন যেন কান্না পাচ্ছে। মাথা নিচু করে মেয়েটা। সৌম্য ডাকে,

– বোনু?
সন্ধ্যা মাথা তুলে ভেজা চোখে তাকায় ভাইয়ের দিকে। তার সৌম্য ভাইয়া-ও আকাশকে প্রশ্রয় দেয়। তার কথা শুনতেই চায় না। কিন্তু সে আজ তবুও এসেছে। আকাশ মাথা গরম মানুষ। কিন্তু সৌম্য ঠাণ্ডা মাথার মানুষ। তাই সে আবার-ও সৌম্য’র কাছে তার আবদার রাখতে এসেছে।
সন্ধ্যার ভেজা চোখ দেখে সৌম্য অবাক হলো না। তবে অসহায় চোখে তাকালো। সন্ধ্যা ইশারায় বলে,
– তুমিও আমার গলার অপারেশন করাবে না ভাইয়া?
সৌম্য ঢোক গিলল। সময় নিয়ে মৃদুস্বরে বলে,
– তোর কিছু হলে আমি যে ম’রে যাবো বোনু!
সন্ধ্যার চোখ থেকে পানি গড়িয়ে পড়ে। ইশারায় বোঝায়,
– আমার কিছু হবে না। তুমি একটু বোঝার চেষ্টা কর।
সৌম্য দু’হাত বিছানার সাথে ঠেকিয়ে মাথা নিচু করে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে,
– তুই এসব বুঝবি না বোনু। খেয়ে ঘুমা।
সন্ধ্যার চোখ থেকে এবার ঝরঝর করে পানি পড়তে থাকে। এগিয়ে গিয়ে ইরার কাছে দাঁড়ায়, ইরার ফোন নিয়ে সেখানে টাইপ করে,

– ও ইরা আপু সৌম্য ভাইয়াকে একটু বোঝাও না! নিয়াজ ভাইয়া বলেছে আমার কিছু হবে না। কিন্তু তোমার ভাই আর সৌম্য ভাইয়া কেউ বুঝতেই চাইছে না। আমি কথা বলতে চাই। সৌম্য ভাইয়া বলে ডাকতে চাই। তোমার ভাইকেও ডাকতে চাই। তোমাদের সবার সাথে কথা বলতে চাই।
ইরা লেখাটি পড়ে মলিন মুখে তাকায় সন্ধ্যার দিকে। ডান হাতে সন্ধ্যার মুখ মুছে দেয়। মৃদুস্বরে বলে,
– কান্না কর না।
এরপর এগিয়ে গিয়ে সৌম্য’র পাশে বসে বসে তার ফোন সৌম্য’র সামনে ধরলে, সৌম্য সন্ধ্যার লেখাটি পড়ে ঢোক গিলল। তার ভাবনার মাঝেই সন্ধ্যা এগিয়ে এসে মেঝেতে এসে সৌম্য’র পায়ের কাছে বসে। সৌম্য অবাক হয়ে তাকায় সন্ধ্যার দিকে। সন্ধ্যা কাঁদতে কাঁদতে ঠোঁট নাড়িয়ে বোঝায়,

অন্তঃদহন পর্ব ৪৩

– আমি কথা বলতে চাই সৌম্য ভাইয়া, প্লিজ! তোমরা কেউ তো আমায় বোঝো!
সন্ধ্যার কথাগুলো বুঝতে পেরে সৌম্য ঢোক গিলল। বুকে চিনচিন ব্য’থা হয়।
সন্ধ্যা কথা বলতে না পেরে কত ক’ষ্ট পায়। কথাটা ভেবে ইরার চোখজোড়া ভরে ওঠে।
সন্ধ্যা সৌম্য’র হাঁটুতে মাথা ঠেকিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদে। সৌম্য’র কাঁদতে ইচ্ছে করছে। তার বোনুর ক’ষ্ট যে সে সহ্য করতে পারেনা। কিন্তু সে কি করবে? সে যে কূল পায় না। সে তার বোনুর ক’ষ্ট কি করে কমিয়ে দিবে?
মুহূর্তেই সৌম্য’র চোখ দু’টো লাল হয়ে গেল। মাথাটা ভনভন করে ঘুরছে মনে হচ্ছে।

অন্তঃদহন পর্ব ৪৫