অন্তর্দহন পর্ব ১৫ || লেখনীতে- অলিন্দ্রিয়া রুহি

অন্তর্দহন পর্ব ১৫
লেখনীতে- অলিন্দ্রিয়া রুহি

পূর্ব দিগন্তে খুবই ক্ষীণ আলোর উৎস, সকাল হওয়ার সম্ভাবনা। অভ্র অবিশ্বাসী সুরে বলল,
-“কী বলছেন চাচী?শায়লা ছাদ থেকে লাফ দিয়েছে?”
শিখা ওপর-নিচে মাথা নাড়ালেন,
-“শুনে খারাপ লাগছে? বুঝতে পারছো এবার আমার মেয়ে তোমাকে কতটা ভালোবাসতো? অনুতপ্ত হচ্ছো তুমি অভ্র?”
অভ্র তাৎক্ষণিক কোনো জবাব প্রদান করতে পারল না। সে হা-মুখ করে তাকিয়ে আছে।
শিখা পুনরায় বললেন,

-“দাঁত থাকতে দাঁতের মর্যাদা তো বুঝলে না। এখন কী বুঝতে পারো আমার মেয়ের জন্য তোমার ভেতরেও একটা অনুভূতি সৃষ্টি হয়েছিল? কিন্তু পড়ন্তর কারণে সেটা তুমি উপলব্ধিই করতে পারোনি?”
অভ্র হতভম্ব। চাচীর কোনো কথাই তার বোধগম্য হচ্ছে না। কোথায় তার মেয়ের বিপদ, সে সেখানে থাকবে। বিলাপ পাড়বে। তা না অভ্রকে কীসব কথা শোনাচ্ছে!
অভ্র ভ্রু কুঁচকে বলল,
-“শায়লার কাছে যাই, চলুন।”
শিখা দু-দিকে হাত মেলে বাঁধা দেওয়ার অভিপ্রায় করে হড়বড়িয়ে বলে উঠল,
-“আগে বলো, আমার মেয়ের মৃত্যুর খবর কী তোমাকে এতটুকুও নাড়ায়নি?”
-“নাড়িয়েছে। তবে সেটা একটা মানুষ হিসেবে। যে কেউ মৃত্যুর সংবাদে আহত হয় একটু হলেও। এখানে অন্য কোনোকিছু খুঁজতে যাবেন না চাচী।”

-“মানে, আমার মেয়েকে তুমি সত্যিই ভালোই বাসো না?” শিখা রাগ নিয়ে বললে অভ্রর মেজাজ চড়ল। ভোর বেলায় ঘুম ভাঙিয়ে একটা দুঃসংবাদ দিলো, তার উপর এসব কী আলতু ফালতু প্যাঁচাল করছে!
অভ্র চিবিয়ে চিবিয়ে বলল,
-“আপনার কী মাথায় সমস্যা চাচী? শায়লার মতো? মানে আপনারা পারছেন না আমার উপর শায়লাকে চাঁপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছেন। এমন কেন করছেন, বলেন তো! আমি শায়লাকে ভালোবাসি না, আর না ওর জন্য অন্যরকম কোনো অনুভূতি আমার ভেতরে আছে! আমি শুধু পড়ন্তকে ভালোবাসি। আর তাকেই স্ত্রী’র মর্যাদা দিয়েছি। প্লিজ, এবার অন্তত আপনারা থামেন। নইলে আমি পড়ন্তকে নিয়ে এই বাড়ি ছাড়তে বাধ্য হবো।”

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

-“তোমাকে কোথাও যেতে হবে না। সকাল হোক, আমি এর ফয়সালা যা করার করব।”
শায়লার কণ্ঠ কানে আসতেই অভ্র চমকে পেছন ফিরে তাকাল। এদিকে শিখা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। শায়লার কথামতোই অভ্রকে মিথ্যে বলে ওর ভেতরে আসলেই শায়লার জন্য কিছু আছে কী-না তা জানতে চেয়েছিলেন। এবার বুঝলেন, তার মেয়ে মরলেও অভ্র কখনোই অনুতপ্ত হবে না। তার চেয়ে ভালো হয়, এখনি শায়লাকে অভ্রর থেকে সরিয়ে নেওয়া। ভালো থাকুক অভ্র পড়ন্তকে নিয়ে। শায়লার সাথে অভ্রর চেয়েও ভালো কাউকে দেখে বিয়ে দিয়ে দিবে…
অভ্র চমকিত সুরে বলল,

-“তুই?”
-“কেন? আমাকে দেখে খুশি হওনি? মনে হচ্ছে সত্যি সত্যি মরে গেলেই বোধহয় ভালো হতো।”
শায়লা তাচ্ছিল্য মাখানো হাসি হেসে সামনে এগিয়ে আসে। অভ্র আক্রোশপূর্ণ চোখে শিখার দিকে একবার তাকিয়ে রাগে গজগজ করতে করতে নিজের রুমে ঢুকে দরজা আঁটকে দিলো। রাত বিরাতে এভাবে ঘুম ভাঙিয়ে মজা করার কোনো মানে হয়! শায়লা চেঁচিয়ে বলল,
-“আমার মুখদর্শনও করতে চাও না নাকি?”
অভ্র জবাব দিলো না। একা একা কিছু বিড়বিড় করতে করতে শুয়ে পড়ল। রাগে গায়ের ভেতর কুটকুট করে কামড়াচ্ছে কিছু। কতবড় ধোঁকা খাওয়ালো তাকে!
শায়লা মৃদু শ্বাস ফেলল। শিখা দায়সারাভাবে বললেন,
-“আর কত চেষ্টা করবি তুই? কেউ তোকে পছন্দই করে না! আর তুই তার সাথেই থাকতে চাইছিস?”
শায়লা মায়ের জবাবে হাসল শুধু, মলিন হাসি। কোনো জবাব না দিয়ে নিজের ঘরের দিকে পা বাড়ালো।

সকালের নাশতার পর পর বিচারসভা বসলো। মূলত একটা সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়ার জন্যেই সবাই একত্র হয়েছে। এক কোণায় পড়ন্ত চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে। তার বুক কাঁপছে। অভ্রকে এত কষ্টে পেয়েও হারাতে চায় না সে, আর শায়লার সঙ্গে ভাগও করতে চায় না। একই জামাই, দুই বোন! ছিঃ কী নোংরা ব্যাপার লাগবে তখন! শুধু শায়লা কেন, এই পৃথিবীর কারো সাথেই সে অভ্রকে মিলাতে পারবে না। নিজের মৃত্যুর পরেও না…
গতকাল ভীষণ ফুরফুরে মেজাজে থাকলেও আজ একটু একটু চিন্তা অভ্ররও হচ্ছে। আর সেটা শায়লার জন্য। ওর উপর নির্ভর করছে সবকিছু। তমিজ উদ্দিন ভরা সভায়ই বলেছেন, শায়লা যা চাইবে তাই হবে। যদি সে অভ্রর সঙ্গেই সংসার করতে চায়, তাহলে অভ্রকে করতে হবে। সে বাধ্য…

এর পিঠে পড়ন্তর বাবা-মা কেউই কিছু বলতে পারেননি। ভুলটা তাদেরই মেয়ের। কীইবা বলবে! শায়লা প্রথম স্ত্রী, ও দ্বিতীয়! কিন্তু বড় চাচী গাইগুই করলেন। কেন ওদের জীবনটা নষ্ট করতে চাচ্ছে,বোঝালেন। শায়লাকেও সরে যাওয়ার জন্য বললেন, অনুরোধ করলেন। দু’জন ভালোবাসার মানুষকে পরস্পরের সাথে মিলিত করার মাঝেও সুখ বিদ্যমান। শায়লা শুধু বলল,
-“আপনি শুধু ওদের ভালোবাসাটাই দেখলেন? আমি যে ভালোবাসি, সেটা?”
বড় চাচী প্রত্যুত্তরে নরম গলায় বললেন,

-“আমি জানিরে মা। কিন্তু তুই কিন্তু একতরফা ভালোবাসিস। একতরফা ভালোবাসা সবসময় জিতে যায় না। এটা জানার পরও কেন বুঝতে চাইছিস না?”
শায়লা চুপ করে রইলো। জবাব দিলো না।
অনেকক্ষণ চুপচাপ থাকার পর শায়লার থেকে তার মতামত জানতে চাইলেন বড় চাচা। পড়ন্ত করুণ চোখে শায়লার দিকে তাকাল। তার কেন যেন মনে হচ্ছে, অভ্রকে চেয়েই বসবে শায়লা! অভ্রর বুকটা ঢিপঢিপ করছে। শায়লাকে নিজের স্ত্রীর আসনে কখনোই দেখতে চায় না সে। পড়ন্ত একদম ভেঙে পড়বে। মেয়েটা এমনিতেই তার কারণে অনেক কষ্ট সহ্য করেছে। ও আরও কষ্ট সহ্য করুক, সেটা একদমই চায় না অভ্র।
শায়লা কিছু বলার পূর্বেই অভ্র বলে উঠল,

-“আমি কিছু বলতে পারি?”
উপস্থিত সবাই অভ্রর দিকে তাকাল। তমিজ উদ্দিন চোখ রাঙালেন, তবে মুখে কিছু বললেন না। অভ্র পড়ন্তর চোখে চোখ রাখল। অসহায় মেয়েটিকে চোখের ভাষায় আশ্বস্ত করে শায়লাকে উদ্দেশ্য করে বলল,
-“আমার কথাগুলো শুধু তোর উদ্দেশ্যে শায়লা। আজ এই সবার সামনে আমাকে একটা সত্যি কথা বলবি, তোর জন্য আমার কোনোদিন কোনো অনুভূতি বা অন্যরকম কিছু দেখেছিলি? আর তুই কী জানতি না পড়ন্তর সঙ্গে আমি সম্পর্কে জড়িয়ে ছিলাম?”
শায়লা গাঁট হয়ে চুপচাপ রইলো। জবাব দেওয়ার মতো আদৌও কোনো যুতসই উত্তর তার কাছে নেই। বড় চাচী হৈহৈ করে বলে উঠলেন,

-“ও সব জেনেশুনে অভ্রকে বিয়ে করেছে। এর মানে কী দাঁড়াল? ও ইচ্ছাকৃত ভাবে এসব করেছে। পড়ন্ত ওর ছোট বোন। আর ছোট বোনের প্রতি সামান্য মায়া মমতা হলো না?”
-“মা থাক, তবুও সবাই বলবে আমারই দোষ! আমার দিকটা কেউই দেখবে না। আমার মনে এক, আর আমি অন্য কাউকে নিয়ে সংসার করব! এতে আমার সংসার জীবন কত সুখের হবে তাই না মা? অথচ বাবার তো সেদিকে বিন্দুমাত্র খেয়াল নেই! তার কাছে বিয়ে হতে পারলেই হলো। বিয়ে হয়ে গেছে মানে সব কমপ্লিট৷ এই বিয়ে আমার নিঃশ্বাস আঁটকে দিচ্ছে কী-না তা জানার প্রয়োজনবোধ তার নেই।”

একদমে কথাগুলো বললে তমিজ উদ্দিন হা করে ছেলের দিকে চেয়ে রইলেন। অভ্রর কথাগুলো তাকে আহত করলেও তিনি ভাবতে শুরু করলেন। ভুল তো কিছু বলেনি ছেলেটা!
তমিজ উদ্দিন নিজের দোষ ঢাকার জন্য দ্রুত বললেন,
-“শায়লা, সব জেনেও কেন এমনটা করলি?”
শায়লা নির্বাক, দায়সারাভাবে বসে রয়েছে। উত্তর নেই তো। দেবে কী! পেছন থেকে নাসরিন শায়লাকে ধাক্কা দিয়ে বললেন,

-“আমার মেয়েটা যদি ভেঙে পড়ে ভুল পথে পা বাড়াতো, তার দায়ভার কী তুই নিতি শায়লা? এখন কথা বলছিস না কেন? ও তোর বোন না? ওর সাথে এরকমটা করতে পারলি তুই?”
শায়লা এবার চিৎকার করে উঠল। চেঁচিয়ে বলল,
-“হ্যাঁ করতে পারলাম। কারণ অভ্রকে আমিও ভালোবাসি। আমি ভাবছিলাম বিয়েটা হয়ে গেলে ও আমাকে মেনে নিতে বাধ্য। আর দু’জনের আবেগ একসময় বাস্তবতার কাছে হার মানবে। কিন্তু এমনটা হয়নি। আমি হেরে গেছি। আমি ভেঙে গেছি।” মাটিতে বসে পড়ল শায়লা ধপ করে। শিখা দৌড়ে এসে মেয়েকে জড়িয়ে ধরলেন। বড় চাচী বললেন,

-“তোর কারণে আজ ওদের জীবনটা নষ্ট, আর তোর নিজের জীবনটাও..” দীর্ঘশ্বাস ফেললেন তিনি।
শায়লা মায়ের বুকে মুখ লুকিয়ে কাঁদতে লাগল। তার প্ল্যান মাফিক কিছুই হলো না, এতে তার আক্রোশের পাল্লা বেড়ে যাচ্ছে। শিখা এই প্রথম মেয়ের পক্ষ না নিয়ে তাকে উল্টো বোঝাতে লাগলেন। অভ্রর চেয়েও ভালো কাউকে এনে দেবে শায়লার জন্য, এমনটা বললে শায়লা চোখমুখ মুছে নিজেকে স্বাভাবিক করে নিলো। উঠে দাঁড়িয়ে অভ্রর মুখোমুখি বসলো।

-“মাঝে মাঝে বাস্তবতা সত্যিকারের ভালোবাসার কাছে হার মানতে বাধ্য হয় অভ্র ভাই। আজ চোখে দেখলাম। আর তাই, আমি তোমার দাবী ছেড়ে দিচ্ছি। তুমি আর পড়ন্ত সুখে থাকো, ভালো থাকো, দোয়া করি। আমার উপর রাগ, অভিমান বা জেদ কিছুই রেখো না।” করুণ শোনালো শায়লার কণ্ঠটা। অভ্র চমকিত, প্রতিটি সদস্য চমকিত। পড়ন্তর চোখে খুশির পানি। অবশেষে তারা একত্রিত হতে যাচ্ছে! এর চেয়ে সুখের সংবাদ আর কীইবা হতে পারে?
শায়লা নাক টেনে ফের বলল,

-“তবে আমার একটা শর্ত আছে। আমি এই দেশ ছাড়তে চাই। বাহিরে চলে যেতে চাই। আমি সবকিছু ভুলে আবার পড়াশোনায় ডুবে থাকতে চাই। নিজেকে এবং নিজের জীবনকে একটা সুযোগ দিতে চাই।”
তমিজ উদ্দিন এগিয়ে এসে শায়লার মাথায় হাত রাখলেন,
-“নিশ্চয়ই তুই পড়বি মা। তুই কোথায়, কোন ভার্সিটিতে যেতে চাস, আমাকে বলিস। আমি ব্যবস্থা করে দিবো।”
শায়লা মাথা কাত করে ‘হ্যাঁ’ বোঝালো। বড় চাচী শায়লাকে দোয়া দিলেন। নাসরিন শায়লাকে জড়িয়ে ধরলেন।নিতু পড়ন্তকে টেনে রুমে নিয়ে গেল। তারপর নাচতে শুরু করল। এই এত এত খুশির ভেতরেও পড়ন্তর বুকটা হাহাকার করে উঠল পাপনের জন্য। না জানি কোথায় আছে ছেলেটা! কেমন আছে!

পাপন ভালো আছে। উল্লাসী তাকে বেশ ভালো রেখেছে। আগের চাইতেও বেশি আদবকায়দাশীল হয়েছে, আল্লাহভীরু, সৎ এবং ধার্মিক বানানোরও চেষ্টা করছে উল্লাসী। তার সঙ্গে তাল মিলিয়েছেন মোল্লা সাহেব। আজ নিয়ে দ্বিতীয়দিন, পাপন ছেলেদের জামাকাপড় নিয়ে দোকানে বসেছে। দোকান বলতে একটা ভ্যান, যেটা প্রতিদিন একশো টাকায় ভাড়া নেয়। তার উপরই তার সমস্ত পোশাক-আশাক থাকে। প্রথমদিন তেমন একটা বেচাকেনা না হলে পাপন ভীষণ হতাশ হয়ে পড়ে। তখন উল্লাসীই তাকে অনুপ্রেরণা জাগায়৷ মাত্র একদিন, তাতেই কী সাফল্য চলে আসবে নাকি? আরও সবুর করতে হবে, তাহলেই না মিষ্টি ফল পাবে! মধ্য রাতে ঘুম ছুটে যাওয়ায় পাপন পাশ হাতড়ে উল্লাসীকে না পেয়ে উঠে বসেছিল। দেখে উল্লাসী তাহাজ্জুদ পড়ছে। পাপন একদৃষ্টে তার দিকে কতক্ষণ তাকিয়ে ছিল,নিজেও জানি না। মহানবী (সঃ) বলেছেন, টাকাপয়সা ওয়ালা মেয়ের চাইতেও একজন ধার্মিক মেয়ে স্ত্রী হিসেবে বেশি যোগ্য। আজ পাপনের মনে হচ্ছে, আসলেই উল্লাসী তার জীবন পরিবর্তন করতেই এসেছে। আল্লাহ নিজেই ওকে পাঠিয়েছে। নইলে কোথা থেকে কীভাবে তারা এক হয়ে গেল, ভাবা যায়?

উল্লাসীর অনুপ্রেরণাতেই নতুন উদ্যোম নিয়ে আজকে দ্বিতীয়বারের মতো একই স্থানে এসেছে পাপন এবং তার মন ভালো হয়েছে অসম্ভব। ঘন্টা দেড়েকের মধ্যে প্রায় নয়টা শার্ট সেল হয়ে গেছে। এটা তার মতো নতুনের কাছে অনেক কিছু! একদম আশাতীত।
পাপন একফাঁকে খুশি সামলাতে না পেরে ফোনই করে ফেলল উল্লাসীকে। বলা বাহুল্য, খুব কম মূল্যের একটি বাটন ফোন কিনেছে সে যোগাযোগের জন্য৷ যে ছেলে স্মার্টফোন ছাড়া একদণ্ড চলতে পারতো না, সে আজ বাটনেই সন্তুষ্টি খোঁজে। সময় মানুষকে কতটা পরিবর্তন করে দেয়!

উল্লাসী ফোনেই বুদ হয়েছিল। ইতিমধ্যে একটি ফেসবুক আইডি খুলে ফেলেছে সে। কিছু ভালো ভালো সেলিং গ্রুপে এড হচ্ছে প্রতিনিয়ত। যত প্রচার, ততই প্রসার। এমন সময়ে ফোন এলে সে হাসিমুখে ফোন ধরে প্রথমেই সালাম প্রদান করল। পাপনও হাসিমুখে সালামের জবাব দিয়ে তার খুশিটুকু স্ত্রীর সঙ্গে ভাগ করে নিলো।
-“এতেই এতো খুশি জনাব? প্রতিনিয়ত আল্লাহর কাছে চাইলে এরচেয়েও বেশি দিবেন উনি। তখন তো পাগলই হয়ে যাবে বোধহয়।”
উল্লাসী কথাটি বলতেই পাপন ওপর পাশ থেকে প্রফুল্লচিত্তে বলে উঠল,

-“হলে হলাম। থাকবে না এই পাগলের সাথে?”
-“যে আমার জন্য পাগলে রূপান্তরিত হবে, তার সঙ্গ আমিই ছেড়ে দেবো? কেমন করে ভাবো?”
-“বাহ! ইদানীং দেখছি কবি-সাহিত্যিকদের মতো করে জবাব দিচ্ছো। ঘটনা কী?”
-“ঘটনা কিছুই না। গুছিয়ে কথা বলতে ভালো লাগে। আচ্ছা পাপন, আমরা অনলাইনে যাত্রা শুরু করবে কবে থেকে? যত দিন যাবে টাকা ফুরাবে, আর তোমার আয় সীমিত। তাই যা মাল কেনার এখনি কিনে ফেলা প্রয়োজন। কী ঠিক না?”
-“হুম। আচ্ছা আমি বাসায় আসি। তারপর একটু খোঁজ খবর নিয়ে মাল কিনে নিয়ে আসবো। একটা কথা বলি?”
-“বলো।”
-“ইয়ে মানে.. তুমি ভালোমতো ভেবেছো তো? সত্যি ওসব সেল যাবে?”
পাপনকে দ্বিধাগ্রস্ত মনে হলে উল্লাসী অভয় দিলো।
-“তুমি চিন্তা নিও না। ভরসা রাখো।”
পাপন মৃদু হেসে বলল,
-“তোমার উপর পরিপূর্ণ আস্থা আছে আমার।”

পড়ন্ত বিকেলেই পড়ন্ত আর অভ্রর গায়ে হলুদের অনুষ্ঠান করা হচ্ছে। নিজেরা নিজেরা বিয়ে করে ফেলেছে, তাই বলে অনুষ্ঠান হবে না? এ কেমন কথা? তাই পারিবারিক ভাবে ছোট্ট একটি অনুষ্ঠান করা হচ্ছে। রাতে আশেপাশের কিছু মানুষদের ডাকা হয়েছে। চাচীরা মিলে বিরিয়ানি রান্না করবে। তাই দিয়ে অতিথি আপ্যায়ন করবেন সকলে। অভ্র-পড়ন্তকে সামাজিক স্বীকৃতি দেওয়া আর কী। নিতু গিয়েছে ফুল কিনতে। বাসর ঘরটাও সাজাতে হয় যে!

বড় চাচী অবশ্য বলেছিলেন, শায়লার সাথে আইননুসারে বিচ্ছেদের পর নাহয় অভ্র – পড়ন্তর বিয়ের অনুষ্ঠান করা হবে। কিন্তু শায়লাই তাতে রাজী হয়নি। তার কারণে শুধু পড়ন্ত-অভ্রই না, পরিবারের সকলেই ভীষণ ঝামেলার মধ্য পড়েছে। অনেক অশান্তির সম্মুখীন হয়েছে। সে চায় না আর কোনো ঝামেলা হোক। আর তাদের বিচ্ছেদ পেপারে হতে মাস তিনেক লাগবে। ততদিন ওরা আলাদা থাকবে স্বামী-স্ত্রী হয়েও? কেমন দেখাবে তাহলে? আর এমনিতে মনের দিক থেকে তো বিচ্ছেদ হয়েই গেছে অভ্রর সঙ্গে। পেপার আর এমন কী বস্তু!

তবুও তমিজ উদ্দিন আশ্বস্ত করেছেন, আগামীকাল তার পরিচিত বন্ধুকে ডাকা হবে। উনি পেশায় একজন উকিল। যত দ্রুত সম্ভব পেপারের ঝামেলাগুলোও মিটমাটের ব্যবস্থা করা হবে।
শায়লা চড়ুই পাখির ন্যায় ফুড়ুৎ ফুড়ুৎ করে উড়ছে আর কাজ করছে। অবাক করা বিষয় হলেও এটি সত্য। তাকে দেখে মনে হচ্ছে, সে সব চাইতে বেশি খুশি৷ পড়ন্তর চাইতেও বেশি খুশি.. অভ্র তাই দেখে অতঃপর স্বস্তির নিশ্বাস ফেলল। শায়লার সরে যাওয়ার পরও ভয়ে ভয়ে ছিল সে, এটা কোনো প্ল্যানও তো হতে পারে! কিন্তু এখন মনে হচ্ছে যে না.. শায়লা সত্যি সত্যি দূরে চলে গেছে। পড়ন্ত আর তার ভেতর বাঁধা নেই কোনো।

দু’জনকে হলুদ ছোঁয়ানোর সময় সবাই সব কষ্ট, ক্লেশ ভুলে মেতে উঠল অনাবিল আনন্দে। একজন অপরজনকে রঙ ছোঁয়ালো। এমনকি তমিজ উদ্দিনও দুই ভাইকে ধরে ধরে রংয়ের দ্বারা মুখে প্রলেপ এঁকে দিলেন। ভীষণ হাসি-ঠাট্টার মাঝ দিয়ে হলুদ লাগানোর পর্যায়টা শেষ হলো। তারপর দু’জনকে ছাদেরই এক কোণে একত্রে পাশাপাশি দাঁড়া করানো হলো। গোসল করানো হবে, এই কারণে। তখন আগত অতিথিদের মধ্য দিয়ে কেউ একজন বলে উঠল,
-“মানুষের একটা হয় না, আর এর তো দুইটা!”

স্পষ্ট খোঁচা। আমাদের সমাজে এইধরনেরই মানুষ বেশি। যারা যার পাতে খাবে, তাতেই ছেদ করবে! অভ্রর মুখ থমথমে হয়ে গেল। উপস্থিত সবাই কেউ কোনো প্রত্যুত্তর করতে না পারলেও পড়ন্ত হিসহিসিয়ে বলল,
-“আর আপনার মেয়ের তো বিয়েই লাগবে না আন্টি। বিয়ে ছাড়াই হয়ে গেছে সব। ওই যে, আকরাম আংকেলের ছেলে বাবুর সাথে সেদিনও দেখলাম চিপা গলির ভেতরে… আর কিছুদিন আগে যে একটা ভিডিও বের হইছিল। আপনার মেয়ে কতগুলা ছেলের সাথে মিলে আপত্তিকর ভাবে নাচানাচি করছিল। মনে আছে আন্টি? আর…”

এ পর্যায়ে খোঁচা মারা আগন্তুক হাত ইশারায় থামতে বলে সটকে পড়লেন। পড়ন্ত খিলখিলিয়ে হেসে উঠল। তার সঙ্গে হাসল উপস্থিত সকলে। অভ্র তখন দারুণ সব অনুভূতির সাক্ষাৎকার নিচ্ছে।
পাশাপাশি দুটো চেয়ার পাতা হলো। এখানে পড়ন্ত আর অভ্রকে বসিয়ে গোসল করানো হবে। কিন্তু কোথাথেকে যেন শায়লা ছুটে এলো এবং অভ্রর পাশের চেয়ারটি দখল করে নিলো। অভ্র-পড়ন্ত দু’জনেই অবাক চোখে চাইলে শায়লা ভ্রু নাচাতে নাচাতে বলল,

-“এত সহজে তো মেয়ে পাবেন না দুলাভাই। মেয়েকে পেতে হলে বিনিময়ে কিছু দিতে হবে।”
সবাই মুচকি হাসছে। এবার পড়ন্তও বুঝতে পেরে হেসে ফেলল। তার খুব আনন্দ লাগছে। বেশি আনন্দ লাগছে শায়লার মন থেকে মেনে নেওয়াটা কে। সে যে এত দ্রুত সব ভুলে হাসিমুখে তাদের একত্র হতে দিবে,এটা কল্পনা বৈ অন্য কিছু ছিল না। অভ্র মাথা চুলকালো। এই মুহূর্তে তার কাছে মানিব্যাগ নেই। সে মিনমিন করে বলল,
-“মানিব্যাগ নেই তো।”
-“উঁহু, বাহানা চলবে না দুলাভাই। মানিব্যাগ কোথায় আছে বলুন।”
-“কেন? যেয়ে নিয়ে আসবি?”

-“হ্যাঁ, আমি এখান থেকে উঠি আর আপনি আপনার কার্যসিদ্ধি করেন? কোনো চান্স নেবো না। এই নিতু এদিক আয়।”
শায়লার ডাকে নিতু কাছে এগিয়ে এলে শায়লা পুনরায় বলল,
-“দুলাভাইয়ের মানিব্যাগটা নিয়ে আয় যা। আজ মালামাল হয়ে যাবো।”
নিতু একছুটে চলে গেল। আবার একছুটেই চলে আসলো। অভ্র একশো টাকার দুইটি নোট শায়লার হাতে গুঁজে দিয়ে বলল,
-“নে, ধর।”
শায়লা আর্তনাদ করে উঠল।

-“মাত্র দুইশো টাকা? হাজার টাকার নিচে একটাকাও কম না। কিপটে দুলাব্রো…”
অভ্রর কাছে সঙ্গে সঙ্গে দুইশো টাকা ফেরত দিয়ে দিলে অভ্র নিরুপায় হয়ে হাজার টাকার একটা নোট শায়লাকে বের করে দিলো। শায়লা নোট পেয়ে খুশি। কিন্তু বলল,
-“আর নিতুর টা?”
-“ওকেও আলাদা দিতে হবে?”
-“হ্যাঁ, হবে। একেবারে বিনা খরচে বিয়ে করতে চাও? শখ কত!”

-“তোরা আমাকে লুটেপুটে খাইলি।” গজগজ করতে করতে নিতুকেও হাজার টাকার নোট দিলে শায়লা চেয়ার ছেড়ে দিলো। সেখানে পড়ন্তকে বসানো হলো। তারপর দু’জনের গায়ে আরও এক পাল্লা হলুদ বাটা মাখিয়ে দিয়ে মাথার উপর পানি ঢেলে দেওয়া হলো। দূরে মিথুন উদ্দিন দাঁড়িয়ে আছেন। তার বুকটা হু হু করে কাঁদছে। আজ এত আনন্দের সময় পাপনটা নেই! আদৌও ভালো আছে কী-না, কে জানে! পাপনটার একবার যদি খোঁজ মিলতো, সে বউ সমেতই নিয়ে আসতো। তবুও চোখের সামনে থাকতো ছেলেটা। রোজ চোখের দেখাটা দেখতে পারতো।

অন্তর্দহন পর্ব ১৪

ছাদে শামিয়ানা টানানো হয়েছে। মোটে পঞ্চাশ জন লোক। তাদের খানাখাদ্যও ঘরের কর্ত্রীরাই করেছে। এদের খাইয়ে অভ্র আর পড়ন্তর জন্য দোয়া চেয়ে নিবে,এটাই মূখ্য উদ্দেশ্য।
রাত প্রায় ন’টার কাছাকাছি। একটা রক্ত লাল কাতানের আবরণে পড়ন্তকে জড়িয়ে সুন্দর করে সাজিয়ে দিয়েছে শায়লা আর নিতু মিলে। পড়ন্তর রূপ যেন শাড়িতে বহুগুণ বেড়ে গেছে। সেটা লোক মুখে শুনলেও এখনো সামনাসামনি দেখার তৌফিক হয়নি অভ্রর। তাকে বর বেশে ছাদে নিয়ে বসিয়ে রাখা হয়েছে তো হয়েছে। এদিকে পড়ন্তকেও নিয়ে আসছে না। সেও যেয়ে দেখতে পারছে না। অথচ ক্ষণেক্ষণে একেকজন আসে, আর অভ্রকে বাহবা দিয়ে পিঠ চাপড়ে দেয়। পড়ন্তকে যে হুরপরী লাগছে, সেটা ইনিয়েবিনিয়ে বারবার তোলে। আর অভ্রর বুকে আগুন ধরায়।

তমিজ উদ্দিন, খোকন উদ্দিন, মিথুন উদ্দিন খাবারের তদারকি করছেন। সবাই অনুষ্ঠানের ব্যস্ততায় বুদ হয়ে রয়েছে। এমন সময়ে নিচ থেকে হট্টগোলের শব্দ ভেসে এলে খোকন উদ্দিনকে রেখে বাকি দুই ভাই নিচে নেমে এলো। দেখল, জাওয়াদের পরিবার এসেছে। তাদের সাথে কথা পাকাপাকি করে অন্যত্র মেয়ের বিয়ে দেওয়ার মানে কী, এটা তারা জানতে চাইছে। তবে কী আবার কোনো ঝড় আসতে চললো তাদের জীবনে?

অন্তর্দহন শেষ পর্ব