অবরুদ্ধ নিশীথ পর্ব ১৮
তেজস্মিতা মুর্তজা
রাবেয়া চেয়ার এনে দিলে মুস্তাকিন বসে বলেছিল, “বাহাদুরী করে একা যাবেন ঠিক আছে। এরপর আপনার সাথে কী হবে, তা দেখার জন্য ওখানে কে থাকবে? প্রথমে অন্তিক, পরে স্যার, এরপর আপনি, এরপর এ বাড়ির কার পালা?ʼʼ
অন্তূ নিশ্চুপ। মুস্তাকিন বলেছিল, “আমি ফোর্স ডাকি, তারা গোপনেই আপনাকে প্রোটেক্ট করবে, ওরা জানতে পারবে না কেউ গিয়েছে আপনার সঙ্গে। এবং তা নিশ্চিত করার দায়িত্ব আমার।ʼʼ
অন্তূ রাজি হয়নি, “প্রয়োজন নেই, অফিসার! আমি কোনো ধরণের ছোট্ট একটা রিস্কও নিতে প্রস্তুত নই। আমার মন বলছে, ওরা ভয়ংকর। কথার খেলাপি হলে খারাপ কিছু হতেই পারে!ʼʼ
রাবেয়া কান্না লুকালেন শাড়ির আঁচলে। অন্তূ নিস্তেজ পায়ে এগিয়ে গিয়ে আলতো কোরে একবার আম্মুকে জড়িয়ে ধরেছিল। বেরিয়ে যাবার সময় মুস্তাকিন সামনে দাঁড়িয়ে বলেছিল, “এক ঘন্টা সময়। এর মাঝে না ফিরলে আপনি না ফিরলে আমি ইচ্ছেমতো পদক্ষেপ নিতে পারি।ʼʼ
মুস্তাকিন কেমন কোরে যেন চেয়ে ছিল মিনিটখানেক অন্তূর চোখের দিকে। সেই চোখের রহস্য বোঝার উপায় নেই। এরপর আশ্বাস দেবার ভঙ্গিতে মাথা নেড়ে বিদায় জানিয়েছিল, “গড ব্লেস, ইউ।ʼʼ
বাঁশের হাঁটের ওপর থেকে গাড়িতে কোরে নয়াবাগ যেতে কমবেশি আধঘন্টা সময় লাগে। সন্ধ্যা হয়ে গেছে।
নয়াবাগ মসজিদের অদূরে দাঁড়িয়ে থেকে তার ভেতরে এক প্রকার ছটফটানি কাজ করছিল। অন্তূ জানে না, এই অনিশ্চিত প্রবাহধারা তাকে ধাওয়া কোরে কোথায় নিয়ে যাচ্ছে।
আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন
মিনিট দুয়েক বাদে দুটো লোক এসে নিয়ে গেল অন্তূকে। ওদের দেখে মনে হচ্ছিল, অন্তূকে মেহমানদারীর উদ্দেশ্যে পথ দেখিয়ে নিয়ে যেতে এসেছে। চারপাশের লোক আসল ঘটনা আন্দাজ করতে পারবে না এদের আচরণ দেখে, হয়ত বুঝলেও কিছুই বলবে না। রাজত্ব এদের, শাসন এদের। সমাজটা এদের নোংরা পায়ের তালুর তলে পদদলিত।
রাস্তাটা ক্রমশ ঢালু হয়ে এগিয়ে গেছে। দুপাশে বন, জঙলি এলাকার মতো। এককথায় নির্জন একটি জায়গা। অন্তূ হাসল। তার হাসি পাচ্ছে, নিজের জীবনের ঘটনাপ্রবাহের ওপর, এবং অনিশ্চিত আগামী কালের ওপর। আবার হাত-পা শিরশির করছে। সেটাকে পাত্তা দিলে মানসিকতা মেরুদণ্ডহীন এক কেঁচোর মাফিক হয়ে পড়বে। যাকে আলতো পায়ের চাপে পিষে মারা যায়। অন্তূ চাইল শক্ত হতে। কিন্তু পারা যাচ্ছে না। নারীমন মচকে যাচ্ছে।
একদম নির্জন জায়গাটির কেন্দ্রে দাঁড়িয়ে আছে একটি বাংলো অথবা কোয়ার্টারের মতো বিল্ডিং। রঙচটা দেয়াল, মরিচা ধরা লোহার জানালাগুলো। ওর পেছনে হাঁটছিল লোকদুটো। এত কাছে, গা লাগিয়ে হাঁটছে, এতক্ষণে বেশ কয়েকবার প্রায় ছোঁয়া লেগেছে।
বাড়ির গেইটের ভেতর দিয়ে ঢুকতেই চোখে অন্ধকার দেখল। ঘুপছির মতো ভেতরটা, বিশ্রী গন্ধ আসছে চারপাশ থেকে। অন্তূর মাথা চক্কর কেটে উঠল অসহ্য দুর্গন্ধে। মদ এবং ড্রাগসের গন্ধ মিশে একাকার হয়ে একটা ভ্যাপসা পেট গুলানো দুর্গন্ধের সৃষ্টি করেছে। সিঁড়িতে ওঠার সময় বেশ কয়েকবার লোকদুটো যেন ওকে ইচ্ছে কোরেই ছোঁয়ার চেষ্টা করল।
অন্তূর কিছুই করার নেই। তার মনে হতো, সে প্রতিবাদী, অল্প হলেও। তার সামনে কোনো অন্যায় টিকার নয়। কিন্তু আজ ওসব কাজ করছে না। হাত-পা অবশ হয়ে আসছে। কলেজের ছোকড়াদের, অথবা পাড়ার মহিলাদের সম্মুখে প্রতিবাদী আওয়াজ উঠানোটাই জীবনের জিত এবং নিরাপত্তা নয়। আজ মনে হচ্ছে, তার প্রতিবাদ বোধহয় শুধুই মহিলা এবং সাধারণ অসভ্যদের সামনে সীমাবদ্ধ। নয়ত এখানে কেন সে একটা চলন্ত পুতুলের মতো হেঁটে চলেছে এভাবে? কোনোই প্রতিবাদের ভাষা মুখে আসছে না, হাতে উঠছে না। শরীরে কম্পন ধরেছে, মনে নারীসুলভ দূর্বলতা বিরাজ করছে। অসহায়ত্বের চাদরে পুরো অন্তূ-সত্ত্বাটা বাজেভাবে ঢাকা পড়েছে।
অর্থাৎ এই সমাজের খারাপদের সম্মুখে টিকে থাকার মতো প্রতিবাদ রপ্ত করা সাধ্যের বাইরে? সে নাহয় পারেনি, আচ্ছা না-ই বা পারল! কিন্তু মুস্তাকিন? সে একজন এফবিআই অফিসার। তার কাছে নাকি হুমকি-চিরকুট আসে, শাসানো ফোনকল আসে। মাঝপথে কেইস দাবিয়ে দেয়া হয়! সমাজে আসলে কাদের বিচার এবং রাজ চলছে? কারা ভালো আছে? চিৎকার কোরে কেউ যেন কানের তালা ফাটালো এটা বলে—খারাপদের! খারাপরা, খারাপরা ভালো আছে। একমাত্র খারাপেরা তুলনামূলক ভালো আছে।
দোতলায় নিয়ে যাবার পর অন্তূর মনে হয়েছিল তাকে কোনো কক্ষে বন্দি কোরে দেয়া হবে। নারী-মন আতঙ্কে গুঙরে উঠছিল। কিন্তু তাকে বদ্ধ রুমগুলো পার করে রুফটপের সামনে নিয়ে যাওয়া হলো। চারপাশ ততক্ষণে অন্ধকার হয়ে এসেছে।
রুফটপটাও পুরোনো, সবুজাভ শেওলা পড়েছে, পুরোনো বিল্ডিং। মাগরিবের আজান শোনা গেল এবার।
রুফটপে পা রেখে মাথা তুলে আশপাশ দেখল। লোকদুটো গা ঘেষে দাঁড়িয়ে আছে। কয়েজন পুরুষের সম্মিলিত হাসির আওয়াজ পেয়ে তাকাল। সোফাতে গা এলিয়ে বসে আছে একজন পুরুষ। জ্বলজ্বলে বিড়ালের মতো চোখ, খাঁড়া নাক অনেকটা খিলানের মতো, পাটাগুলো যেন ফনা তুলে আছে। ঠোঁটে প্যাচপ্যাচে হাসি ঝুলছে। তার সম্মুখে পিঠ ফিরিয়ে বসে আছে আরেকটি লোক। এক মুহুর্তের জন্য অন্তূর মনে হলো, এই পিঠ ফেরানো পেছনটাকে সে চেনে।
চারদিকে কুয়াশা ঘন হয়ে আসছে, দিনের আলো ফুরিয়েছে। রুফটপটাকে বাইরে থেকে পুরোনো পরিত্যক্ত জায়গা বলে মনে হলেও এখন বুঝল, এক অভিজাত বৈঠকখানার চেয়ে কম নয় এটা। গোলাকার সারি কোরে সাজানো সোফার সেট, সেন্টার টেবিল। টেবিলের ওপর সারি ধরা মদের বোতল, ড্রিংকিং গ্লাস, সোডার কৌটা, মেডিসিনের পাতা, মোড়ানো কাগজ, বিটলবন, স্ন্যাক্স, ছুরি ইত্যাদি পড়ে আছে।
অন্তূ চোখ বুজে শ্বাস ফেলল। আলো জ্বললো। অন্তূ চূড়ান্ত মরণের জন্য প্রস্তুত। সামনে বসা লোকটি হাতের গ্লাসটি নামিয়ে রেখে মনোযোগী দৃষ্টি মেলল অন্তূর গোটা শরীরে। যেন আকর্ষণীয় কিছু পেয়েছে হুট কোরে। কিন্তু এবার পেছন ফিরে বসে থাকা লোকটা অনীহার দৃষ্টি মেলে পেছনে ফিরল একবার। তার দৃষ্টি কেঁপে উঠে বিদ্যুতের মতো ধাক্কা খেল যেন অন্তূর ওপর।
জয়! অন্তূ হতবিহ্বল চোখে তাকিয়ে দেখল জয়কে। ধীরে ধীরে বিস্ময়ভাবটা কেটে মন-মস্তিষ্ক ও গোটা শরীর জুড়ে এক বিদ্বেষী ঘৃণারা লাফিয়ে উঠল যেন। এরা এত নিচে নামতে পারে? জয় সেদিন ভার্সিটি প্রাঙ্গনে দাঁড়িয়ে চ্যালেঞ্জ নিয়েছিল, সেসবের জেরে এসব করছে? অথবা অন্তূকে দমাতে। প্রশ্ন অনেক, উত্তর নেই যথাযথ।
পেছন থেকে একজন ধাক্কা মারল অন্তূকে। ভেতরে ধপ কোরে আগুন জ্বলে উঠল যেন। আরও দুটো ঠেলা তাকে সহ্য করতে হলো।
জয় চট কোরে উঠে দাঁড়ায়। তার চোখদুটো হাসছে। সেখানে এখন বিস্ময় থাকার কথা, কিন্তু তা ছাপিয়ে দুষ্টু হাসি প্রকট। হাতের ধোঁয়া ওঠা কলকিটা টেবিলে ফেলে বলল, “ও কে? ওরে এইখানে নিয়ে আইছেন ক্যান? কী সমস্যা?ʼʼ
সোফায় বসা লোকটা চার হাত-পা ছড়িয়ে বসে আছে, তার নজর এখনও অন্তূর শরীরে। অন্তূ একদৃষ্টে চেয়ে ছিল জয়ের দিকে। জয় এবার কঠিন স্বরে জিজ্ঞেস করল, “ওরে এইখানে আনছেন ক্যান, পলাশ ভাই?ʼʼ
প্যাচপ্যাচে হাসি শোনা গেল। বিড়ালের মতো জ্বলজ্বলে চোখগুলো কীসের নেশায় যেন জ্বলছিল পলাশের। সরু নাকের খিলানের মতো পাটাটা কাঁপে, যখন পলাশ হাসে। অন্তূর ঘেন্না এলো সেদিকে তাকিয়ে। জয় খেঁকিয়ে উঠল, “হের বাল! ওরে ক্যান নিয়ে আসছেন এইখানে? এইডা জিগাইছি। ওর কী কাম এইখানে?ʼʼ
পলাশ তখনও অন্তূর দিকে চেয়ে। জয় দুই-ভ্রুর মাঝে আঙুল ঘষে দাঁত খিঁচল, “পলাশ ভাই, কিছু জিজ্ঞেস করতেছি। হাসি অফ করে জবাব দিয়ে এরপর হাসেন।ʼʼ
অন্তূ চমকে উঠল। পলাশ? দিনাজপুরের শীর্ষ সন্ত্রাস? বাজারের প্রতিটা দোকানে কসাইয়ের মতো চাঁদাবাজি থেকে শুরু কোরে নতুন নতুন পাপের সৃষ্টিকর্তা পলাশ ও রাজন। দেখেছিল না কোনোদিন লোকটাকে। আন্ডারওয়ার্ল্ড বলে একটা কথা আছে, আর সেখানকার জানোয়ারেরা আন্ডারগ্রাউন্ডেই বিচরণ করে সাধারণত। অন্তূর মাথায় এলো না, তাকে কেন এই নরকে আনা হয়েছে? মহাজন পলাশ। মানুষকে টাকা ধার দেয় সুদের চুক্তিতে। সময় এতটা কম দেয়, যে একজন ঋণী লোকের পক্ষে অত দ্রুত সুদসহ টাকা জোগাড় সম্ভব হয়না। পলাশ তার বদলে বউ-বাচ্চা, জমির দলিল, বাড়িঘর, ব্যবসা, সবশেষে জান নিয়েও নিজের সুদসহ টাকা আদায় কোরে নেয়। এমন বহু কথা শুনেছে অন্তূ পলাশের ব্যাপারে। এটাই কি সেই পলাশ? জয় এখানে কেন? অন্তূর খুব দূর্বলতা বোধ হচ্ছিল।
চারপাশে দর্শকের মতো দাঁড়িয়ে আছে পলাশের লোকগুলো। দেখতে নর্দমার পাশে ক্ষুধার্ত অবস্থায় শুয়ে থাকা কুকুরের মাফিক রূপ সবগুলোর।
পলাশ হেসে জয়ের দিকে তাকায়, “এত ক্যান ব্যস্ত হইতেছিস, বাপ! এমন টসটসে মাল ঘরে রেখে এসে কীসব আউল-ফাউল জিনিস বন্ধক রেখে মানুষ ট্যাকা ধার নেয়, বোকার দল সবগুলা!ʼʼ
জয় নাক-মুখ জড়িয়ে বিরক্ত হয়ে মদের বোতল তুলে নিয়ে তাকে দুটো চুমুক দিলো। আস্তে কোরে অনাগ্রহী স্বরে জিজ্ঞেস করল, “অন্তূর বাড়ির লোকও কি সুদের টাকা নিয়েছে নাকি আপনার কাছে?ʼʼ
-“হ।ʼʼ
-“এই শালীর বাপরে তো এমন লোক মনে হয়না!ʼʼ
পলাশ হাসছে। চোখদুটো জ্বলজ্বল করে জ্বলছে। সেই হাসিতে রহস্য মেশানো। কিন্তু তাতে জয়ের কোনো আগ্রহ নেই। তার গলা জ্বলছে আজ। মদে অল্প সোডা এবং পানি না মেশালো।
পলাশ এগিয়ে গিয়ে অন্তূর খুব কাছে দাঁড়ায়। অন্তূ চেয়েও পেছাতে পারল না। পিছনে আরও দুটো লোক দাঁড়িয়ে। পলাশের শরীর থেকে দুর্গন্ধ আসছে। অন্তূর মনে হলো সে যখন তখন গলগল করে বমি করে ফেলবে। এতটা কাছে কোনো পুরুষ কোনোদিন আসেনি তার। বিরবির কোরে সৃষ্টিকর্তাকে ডেকে ওঠে অন্তূ। পলাশ জিব বের করা কুকুরের মতো গন্ধ শুঁকছে ওর শরীরের। বোরকা এবং নেকাবের ওপর দিয়েই যেন কীসের পৈশাচিক স্বাদ পাচ্ছে পলাশ।
অন্তূ চোখ বুজে ডুকরে উঠল নীরবে, ‘আল্লাহ পাক! পানাহ চাই এসব থেকে, তুলে নিন আমাকে, রক্ষা করুন।ʼ
পলাশ স্থির হয়ে দাঁড়াল। প্যাচপ্যাচে হাসি দিয়ে বলল, “তোমারে ক্যান নিয়াসছি এইখানে?ʼʼ
-“বলেননি এখনও।ʼʼ অন্তূর গলাটা কেঁপে উঠেছিল। ইজ্জতের ভয় তাকে কাহিল করে তুলেছিল।
-“তুমি চেনো আমারে?ʼʼ
অন্তূ নিজেকে গোছাতে গিয়েও এলোমেলো হয়ে গেল, “কেন এনেছেন আমাকে এখানে? আমি কি কোনো অপরাধ করেছি?ʼʼ
পলাশ হাসছে। সেই হাসিতে পশম দাঁড়িয়ে যায়। পলাশ বলল, “তোমারে মনেহয় কিছুই কয় নাই অন্তিক, হ্যাঁ?ʼʼ
অন্তূ চোখ নামালো। চোখ বুজে শ্বাস ফেলল।
-“তোমার ভাই যখন বউয়ের গয়না নিয়ে এসে টাকা চাইছিল আমার কাছে, আমি অবশ্য ওরে কইছিলাম, ‘বউয়ের গয়না দরকার নাই, বউডারে আনলেই পারতি!ʼʼ
ট্যাকা আর পরিশোধ করা লাগতো না। ছেঁমড়া দেখলাম জ্বলে উঠছিল, অথচ ট্যাকারও প্রয়োজন, কিছু বলবার পারেনাই, হাহাহা!ʼʼ
অন্তূ অবাক হলো। বুকে ভার অনুভূত হলো।
-“পরে কইল, ‘না, আমি গয়নাই রাখতে চাই, ভাই। দোকানে যা কামাই হবে, তা দিয়ে মাসে মাসে আপনার টাকা দিয়ে সময় ফুরানোর আগেই শোধ করে দেব।ʼ শালার ছাওয়াল পারল তো না। সেই হয়রানি পেরেশানী হইলো, দোকানডাও গেল, রাখতে পারল না। শেষ পর্যন্ত দুইদিন আগে নাকি নিজেও পালাইছে। অথচ তোমারে আনলে খুশি হয়ে দেখা যাচ্ছে ওর ব্যবসাডারে নিজহাতে চিরদিন প্রোটেক্ট করতাম! তোমারে আনে নাই ক্যান আগে?ʼʼ
এবার ঝুঁকে পড়ল পলাশ অন্তূর ওপর, “জানতাম না যে তুমি এত সুন্দরী! জানলে অন্তিক ছেমড়াডার সুদ, আসল, চাঁদা, দোকানের কামাইয়ের ভাগ সবডা মাফ করে দিতাম। মেয়েলোকের ওপর কিচ্ছু নাই, কারবারও না। আমি মেয়েলোকের খাতিরে বহুত ত্যাগ করবার পারি।ʼʼ
অন্তূর শরীর কাঁপছে থরথর করে। নিজের ওপর রাগ হলো তার। এত অস্থির হয়ে পড়ছে কেন সে? কোনোভাবেই শান্ত হতে পারছে না। কোনোমতো জিজ্ঞেস করল, “আমার আব্বু কোথায়?ʼʼ
-“আহহ! কথা তো শ্যাষ হয় নাই। শোনো, অন্তিক ছেড়াডা আমার থেকে লুকায়ে, না পালায়ে যদি তোমারে আনতো আমার কাছে, তোমার বাপডারও এত ভোগান্তি হইতো নাহ! ষেহ! আমি জানতামই না তুমি এরম..ʼʼ
অন্তূর কলিজাটা ছ্যাঁৎ করে উঠল। অনিয়ন্ত্রিতভাবে এক চরম ভুল হয়ে গেল তার দ্বারা। থাবা দিয়ে পলাশের শার্ট খামছে ধরে বলল, “এই জানোয়ারের বাচ্চা, কী বললি তুই? আব্বু কোথায়? আব্বু তোর কাছে? কী করেছিস তুই আব্বুর সাথে? আব্বু কই, কোথায় আব্বু?….ʼʼ
এতক্ষণের জমে থাকা পানি ঝরঝর কোরে গড়িয়ে পড়ল নেকাবের নিচে। হুংকারটা কান্নার সাথে মিশে নির্মম আর্তনাদের মতো শোনালো।
জয় বিরক্ত হয়ে একটা সিগারেট ধরাল। বকে উঠল বিরবির করে, “শালীর ধার কমবে না তবু।ʼʼ
পলাশকে দেখে মনে হচ্ছে, তার প্রিয় খাবারটা খেয়ে তৃপ্তির হাসি হাসছে, এতটা পৈশাচিক তার মুখের ভঙ্গি। অন্তূ শুনেছিল, মহাজন আর সন্ত্রাসরা পিশাচদের আরেক বংশধর। অন্তূর বুকে কাঁপন ধরেছে। পলাশ শার্ট থেকে অন্তূর হাতটা ছড়ানোর নাম কোরে বাজেভাবে জড়িয়ে ধরে ছুঁয়ে দিলো হাতটা। অন্তূ ঝটকা মেরে হাত ছড়িয়ে পিছিয়ে যায়। ধাক্কা খায় পুরো দেহটা দুটো পুরুষের সাথে। ঘেন্না আসল নিজের শরীরের ওপর। কোথাও পুরুষের ছোঁয়া লাগা বাকি রইল না গোটা দেহে। ছটফট করতে করতে দূরে সরে দাঁড়াল।
ফুঁপানো কান্নায় নেকাব ভিজে উঠল। জয় সোফা ঘুরিয়ে নিয়ে বসেছে। সে খুব আরামে আছে। যাত্রাপালা দেখতে এসেছে। সামনে খেলা হচ্ছে, সে দেখছে। তার হাতে স্বল্প মাত্রার বিয়ারের ক্যান। এবার অন্তূর দৃঢ় বিশ্বাস জাগল, জয় সব জানে, সব। তবুও কেন নাটক করল প্রথমদিকে?
অন্তূ চেঁচিয়ে উঠল, “আব্বু কই?ʼʼ চেঁচানোও নিদারুণ আহাজারির মতো ন্যায় শুনতে লাগল, “আমার আব্বু কই? ও আব্বু! আমার আব্বুকে কোথায় রেখেছেন? কোথায় আমার আব্বু? আব্বু..ʼʼ সবে কথা বলতে শেখা ছোট্ট শিশুটির মতো অবুঝ স্বরে ডেকে ওঠে অন্তূ আবার।
“আব্বু? ও আব্বু? আব্বু?ʼʼ—পাগলের মতো এদিক ওদিক খুঁজল আব্বুকে। অবুঝ শিশু যেমন অচেনা জায়গায় কাতর হয়ে ওঠে, অন্তূ তার চেয়েও সহায়হীন এতিমের মত কাতরাচ্ছে রুফটপের এক পাশে দাঁড়িয়ে।
পলাশ বারবার দেখছে অন্তূর চোখদুটো। পলাশের মনে হলো, ভিজে ওঠা পাপড়ির জন্য মেয়েটার চোখদুটো তাকে বেশি মাতাল করছে। নোংরা চাহিদায় উতলা হয়ে উঠছে তার পুরুষ দেহ। অন্তূর আর্তনাদ একেকবার কানে যাচ্ছে আর কামনা-তাড়নার আগুনে কেরোসিনের ছিটা পড়ছে। এগিয়ে গেল অন্তূর দিকে। ক্ষুধার্ত পিশাচ যেমন রক্ত পেলে জ্বলজ্বলে হেসে ওঠে, ওরকম হেসে বলল, “আব্বুকে দেখতে চাও, সুন্দরী? তার মানে তুমি আমার কাছে কিছু চাও?ʼʼ
অন্তূ থেমে যায়। অবুঝের মতো তাকিয়ে থাকে পলাশের দিকে। পলাশ কোমল স্বরে বলল, “লেনদেন বোঝো? নেয়া-দেয়া। তুমি কিছু চাচ্ছ আমার কাছে। এর বদলে আমারও তো কিছু চাওয়া থাকতে পারে। পারে না?ʼʼ
অন্তূ হাল ছেড়ে দিয়ে আস্তে কোরে বলে, “পারে।ʼʼ তারপর একটু সপ্রতিভ হলো, “আমি বুঝতে পারছি। অন্তিকের টাকাটা পরিশোধ করতে হবে। সে তো জানি। কিন্তু এখন তো কিছু বলেননি, আমি সাথেও আনিনি। কথা দিচ্ছি, আগামী….ʼʼ
পলাশ আঙুল তুলে অন্তূর ঠোঁটে নেকাবের ওপর দিয়ে চেপে ধরল, “হশশ! এত কথা না। আমি চেয়ে নিই, তুমি দাও।ʼʼ
অন্তূ তাকিয়ে রইল। তার সরলতা ব্যর্থ গেল বোধহয়।
পলাশ খুব সাবলীলভাবে বলদ, “নেকাবটা খোলো, দেখি মুখটা।ʼʼ
অন্তূ থমকে দাঁড়াল। পলাশ বোঝালো, “উমহ! লেন-দেন।আমি তোমার মুখ দেখবো, তুমি তোমার আব্বুর মুখ!ʼʼ
পাথরে পরিণত হলো অন্তূ। নির্বাক চোখে দেখল পলাশকে। পলাশ এগিয়ে যায় আরেকটু ওর দিকে। বে-খবর আক্রমণ করে বসে অন্তূর ওপর। খপ করে অন্তূর মেয়েলি হাতদুটো নিজের থাবায় পুড়ে অন্তূর পেছনে আটকে ধরে। তাতে পলাশের শরীরের সামনের অংশের সিংহভাগ ছুঁয়ে যায় অন্তূর নারীদেহ। অপর হাত দিয়ে অন্তূর বুকের ওপরে গলার নিচে লেহন করার মতো হাত বুলায়, যেমন কোরে কুকুর তার খাবার চাটে জিহ্বা দিয়ে। অন্তূ হাত মুচড়ানোর বৃথা চেষ্টাটা করল না। চোখদুটো বুজে পাথরের মতো দাঁড়িয়ে রইল। কিন্তু আশ্চর্যজনকভাবে সেদিনের পাথরের চোখ বেয়েটপ টপ করে কয়েক ফোটা তপ্ত জল গড়িয়ে পড়ল।
অবরুদ্ধ নিশীথ পর্ব ১৭
বিরবির করে ডেকে ওঠে অন্তূ, “আল্লাহ!ʼʼ
অন্তূ হার মানলো, “আমি খুলছি নেকাব। আমি খুলছি…ʼʼ
পলাশ পারতো নিজে খুলতে। খুলল না। সে অন্তূকেই বাধ্য করল। এতে তার চোখে-মুখে জিতে যাওয়ার চমক। অন্তূর কাছ থেকে সরতে ইচ্ছে করছিল না। তবুও নিজেকে টেনে নিয়ে অল্প সরে দাঁড়াল যেন।
অন্তূ হাত কাপছে। নেকাব অবধি উঠছে না। এতগুলো বছরে কোনোদিন কেউ মুখ দেখেনি তার। আজ দেখবে। শরীরের ওপর ঘেন্না লাগছে। এই শরীরের বিভিন্ন জায়গা আজ নষ্ট হাতের ছোঁয়া পেয়েছে। নিজেকে একপেশে নষ্টা বলেই মনে হচ্ছিল তার। তবুও কেন যে নেকাব খুলতে হাত উঠছিল না মুখের ওপর। ছোঁয়ার চেয়ে নজর বেশি ভয়ানক?