অবরুদ্ধ নিশীথ পর্ব ৭৭ (২)

অবরুদ্ধ নিশীথ পর্ব ৭৭ (২)
তেজস্মিতা মুর্তজা

হাতকড়ার দিকে তাকিয়ে জয়ের হাসি পেল। তার হাতে বন্দিত্বের শিকল খুবই বেমামান। সে মুক্ত বাজ, দক্ষ শিকারী, তাকে শিকার করা দুঃসাধ্য।
সে চারদিকে তাকাতে তাকাতে সে বেশ কয়েকবার জোরে ডেকে উঠল, তরুউউওহ্! তরু…ʼʼ
কিন্তু তরু ছুটে বেরিয়ে এসে জয়ের সামনে দাঁড়াল না। তবু জয় আরও কয়েকবার গলা ফেঁড়ে ডাকল, যেন তরু শুনতে পায়নি, এবার শুনতে পেয়ে আসবেই আসবে।
তুলির কিন্তু বুক মোচড় দিয়ে উঠল। সে রুখে গিয়ে জয়ের হাতখানা চেপে ধরে বলল, “ওভাবে ডাকছিস কেন, জয়? শুনতে কেমন যেন লাগছে। যা তুই, যাহ্ তো। তুই পাপী, তোর পথে তুই যা। এসব তোদের জন্য না।ʼʼ
জয় দুই হাতের বাহু ফাঁক দিয়ে তুলির গলায় মালার মতো হাত ঢুকিয়ে ঝুঁকে বলল, “এইবার ফিরে আগে তোরে বিদায় করব বাড়ি থেকে। তোকে সহ্য করা যাচ্ছে না।ʼʼ

জয় বেরিয়ে যাবার সময় আবার একবার পেছন ফিরে বেহায়ার মতো হাসল। আজ তাকে কারাবরণ করতেই হতো। এর কারণ অনেকগুলো। কবীর আজ ক’টা দিন আঁটক। এটা সহ্য করা জয়ের জন্য সহজ নয়। দ্বিতীয়ত এমপির ছেলেরা কামরুলের খুনী–জয় আমিরের স্ত্রীকে চায়। তৃতীয়ত পুলিশ বাহিনী যখন তাকে গ্রেফতারের ওয়ারেন্ট হাতে পাটোয়ারী বাড়ির দোরগোড়ায় এসে পৌঁছে গেছে, মানে নিস্তারের পথ সংকীর্ণ হয়ে এসেছে।
জয়কে নিয়ে যেতেই ছেলেরা পাগলপারা হয়ে উঠল। কিন্তু হামজা ভাই হাসপাতালে। তাদের জন্য এখন সেখানে পৌঁছানো অতি জরুরী। এমপি সাহেব একটা নিজের ব্যবহার্য টয়োটা দিলেন। তুলি ঘুমন্ত কোয়েল ও রিমিকে সঙ্গে নিয়ে গাড়িতে উঠল। রিমির অবস্থা ক্রমে খারাপ হচ্ছে। তাকে তুলিরই সামলাতে হবে। কিন্তু তুলি নিজেই অস্থির। আরমিণ কোথায়? আরমিণের সুশ্রী মুখটা মনে পড়তেই তার গা শিরশির করে উঠল। আরমিণের সৌন্দর্য ভয়ংকর! আরমিণ বলেছিল তাকে হামজার বিরুদ্ধে সাক্ষী দিতে। সেটা কবে, কোন পরিস্থিতিতে? সেই পরিস্থিতিই কি এগিয়ে আসছে? আরও বলেছিল, এ বাড়িতে কেউ থাকবে না। ঘটনাপ্রবাহ সেদিকেই মোড় নিচ্ছে না কি!?

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

জয় তাকে শাস্তি দেবার উদ্দেশ্যে এমন অন্ধকারে রেখে গেছে কিনা অন্তূর জানা নেই। কিন্তু আমির নিবাসের এই অবরুদ্ধ নিশীথ দুঃসাহসী অন্তূকেও নাড়িয়ে দিলো। অন্তূর খেয়াল হলো, এই ইট-পাথরের বাড়িটা আস্ত এক রক্তখেকো রাক্ষসের অন্তঃগহ্বর।
কোথাও এক রত্তি আলো বা দূর অবধি জনমানবের বিচরণ নেই। অবরুদ্ধ হলরুম অন্তূকে গিলে নেবার আনন্দে নীরবে গর্জন করছে। যা শুধু অন্তূর কানে বাজে। পেছনের জঙলি বাগান থেকে শেয়ালের সরু ডাক ভেসে আসছে, আরও কত রকম জঙলি ছোট-বড় প্রাণীর নিশীথ-চিৎকার অন্তূর শরীরের লোমকূপ অবধি কুঁকড়ে তুলল। নিজের শরীরটা অবধি দৃশ্যমান নয় এখানে। জানালা দিয়ে মাঝেমধ্যেই বাতাসের ঝাপটা আসছে। তার সাথে ভেসে এসে নাকে ঠেকছে বহুদিনের অবরুদ্ধ হলরুম ঝেঁটিয়ে আসা ভ্যাপসা গন্ধ। অন্তূর পা চলে না জানালা আটকে দিতে যাবার জন্য। সে সদরদরজার সাথে লেপ্টে বসে রইল। এই ভয়টা অন্তূকে বড়ঘরে প্রবেশের দিন কাবু করেনি, সেদিন কেবল এক প্রবল উত্তেজনার বাজনা বেজেছিল বুকে।

বেশিক্ষণ কিন্তু এভাবে চলল না। ভয়, অস্বস্তি, মানসিক চাপ ও দূর্বলতা অন্তূর গর্ভাবস্থার ওপর ভারী পড়ল। মাথাটা চক্কর মেরে উঠে পেট গুলিয়ে আসার সাথে সাথে গলগল করে বমি করে ফেলল। কোথায় ছিটে পড়ল বমি, তা দেখারও উপায় নেই। জয়ের এই নিষ্ঠুরতার নাম কী দেবে অন্তূ?
আচ্ছা, জয় আমির যদি জানতো সে আজ আমির নিবাসের শেষ উত্তরসূরীকে আমির নিবাসে তার মায়ের পেটে রেখে মা-সন্তান দুজনকেই অবরুদ্ধ করে যাচ্ছে, সে কি এই কাজ করতো? সে কী করতো তখন?
অন্তূ ঘন্টা দুয়েকও ওভাবে থাকতে পারল না অসুস্থ শরীরে। বমি করার পর গলা আঁটকে এসেছিল। তার মিনিট দশেকের মধ্যে দেহটা ধুপ করে লুটিয়ে পড়ল আমির নিবাসের ধুলোর স্তর জমা মোজাইক করা মেঝের ওপর। পড়ে যাবার আগে অন্তূর কানে কেউ ফিসফিস করে–’তুই কোন সাহসে গর্ভাবস্থায় এই শিকারী বাংলোয় পা রেখেছিস, মেয়ে? হুমায়িরা পাটোয়ারীকে জানিস তো তুই? এই বাড়ির ভয়াবহতা সম্বন্ধে কি বেখবর তুই?ʼ
অন্তূর শরীরটা থরথর করে কেঁপে উঠল। অন্তূ এতবড় ভুল কী কোরে করে ফেলল! এটা খুব মূল্যবান দুঃসাহস! এই দুঃসাহসের মূল্য এই বাড়ি অন্তূর কাছ থেকে কোন উপায়ে আদায় করবে? এই বাড়িতে সে কি দ্বিতীয় হুমায়িরা হতে পারে না?
বিগত দিনগুলো সে নিজের ওপর যে জুলুম করে নিজেকে চালিয়ে নিয়ে বেড়িয়েছে। এই বাড়ি তার সেই জেদ ও জীবনীশক্তি ঘন্টা কয়েকের মাঝে শুষে নিলো।

এমপির বাড়িতে রউফের জায়গা হয়েছে ঘন্টা সাতেক আগে। আজ তাদের মিশন ছিল পাটোয়ারী বাড়ি। জয় আমিরকে গ্রেফতারের পরোয়ানা পাবার জন্য তার কাছে জয় আমিরের সব অপরাধের প্রমাণ না থাকলেও যে কয়েকটা ইতোমধ্যে সংগ্রহ করতে পেরেছিল সে, সেগুলো যথেষ্ট হয়েছিল।
অ্যারেস্ট ওয়ারেন্ট সে থানা পুলিশের হাতে দিয়ে দিয়েছিল। কিন্তু সেই সময়–দুপুর সাড়ে তিনটার দিকে এমপির কাছে তার ডাক পড়ল আলোচনার জন্য। এমপি জিজ্ঞেস করেছিলেন, “জয় আমিরকে অ্যারেস্ট করার জন্য কী কী প্রমাণ আছে আপনার কাছে?ʼʼ

রউফ হেসে বলেছিল, “আমি আপনার কাছে সেই জবাবদিহি করতে বাধ্য নই, এমপি সাহেব। ইভেন আমি তো আপনার ডাকে এখানে আসতেও বাধ্য নই, নেহাত আমি ভদ্রলোক বলে আপনার সম্মানে এসেছি। কিন্তু অবশ্যই আমি আমার কাজ সম্বন্ধে সামান্য আলোচনাও করব না আপনার সঙ্গে।ʼʼ
এই অপমান এমপি সাহেব গায়ে না মেখে বরং হাসলেন, “বেশ বেশ! আপনার মতো সাহসী ও নিষ্ঠাবান অফিসার আজকাল বিরল। খুব পছন্দ হয়েছে আমার। কিন্তু আমি শুধু জানতে চাইছি ওর অপরাধ কী? আমাকে মামা বলে ডাকে, আমার খুবই খারাপ লাগছে ছেলেটার জন্য।ʼʼ
-“অপরাধীর জন্য খারাপ লাগাই আপনাদের নীতি–রাজনীতি। তবে তাকে আমি গ্রেফতার আপাতত একজন সাসপেক্ট হিসেবে করলেও সে মূলত একজন দাগী ক্রিমিনাল। তা শীঘ্রই প্রামাণিত হবে আদালতে।ʼʼ

-“তো কি একেবারে ফাঁসি?ʼʼ
-“ফাঁসি না হলেও দীর্ঘস্থায়ী কারাবাস তো হতে পারে!ʼʼ
-“পারবেন তো?ʼʼ
-“কে ঠেকাবে? আপনি?ʼʼ
এমপি সাহেব হাসলেন, “হামজা পাটোয়ারীকে চেনো, অফিসার?ʼʼ
-“যায়-আসে না।ʼʼ
-“আসে আসে। খুব আসে। মন্ত্রীদের সাথে হ্যান্ডশেইক করা স্নেহের জুনিয়র হামজা। আমার মতো এমপির কথা না হোক, মন্ত্রীদের কথা মানতে হতেই পারে!ʼʼ
রউফের মুখে কোনো হেলদোল না এলেও ভেতরে ভেতরে সে একটু চিন্তিত হয়ে গেল, এবং নিজের জীবন ও চাকরি নিয়ে তো অবশ্যই সংশয় রয়েছে।

এমপি প্রস্তাব দিলেন, “আপনার বাহিনীর আগ্রাসন স্থগিত রাখুন। আমার একটু আলাপ আছে ওর সাথে। না না, ভয় পাবেন না। আমি নিজে তুলে দেব ওকে আপনাদের হাতে। বরং আমি ছাড়া ওকে আপনারা কনভেন্স করতে পারবেন বলে মনে হয় না। এক হতো যে সে শুধু জয় হতো। ও হচ্ছে হামজার কইলজার টুকরা। ওর গায়ে হাত মারলে আপনি হামজার কইলজায় খোঁচা মারবেন। এরপর কিছুই নিয়ন্ত্রণে থাকবে না। কিন্তু আমি পারব।ʼʼ
এবং এখন রউফ মোটামুটি সন্তুষ্ট। জয় আমির ধরা পড়েছে। ধরাটা কঠিন ছিল না অবশ্য, কিন্তু ধরে রাখাটা কঠিন। যেটার ঝুঁকি এখনও কাটেনি। জয় আমিরকে ধরে রেখে তার শাস্তি পর্যন্ত নিয়ে যাওয়া অবধি সব ঠিক থাকলে তবে হয়।

জয়কে হেফাজতে নেয়া হয়েছে রাত নয়টার দিকে। রউফ কায়সার ঘড়ির দিকে তাকাল– এখন রাত ১১: ২৩ মিনিট।
এমপি সাহেব এখন পর্যন্ত দুটো পাইপ শেষ করেছেন। পাইপ সেজে দিচ্ছে তার কাজের লোক। তিনি ধোঁয়া টানছেন।
দ্বিতীয়বার পাইপ শেষ করে এমপি সাহেব বললেন, “আপনি এবার যেতে পারেন, নিশ্চিন্তে যেতে পারেন। জয়কে কেউ বাঁচাতে পারবে না।ʼʼ
-“আপনি এখন এই নিশ্চয়তা কীভাবে দিচ্ছেন?ʼʼ
-“এতসব প্রমাণ আপনার কাছে, তাও আপনি ভাবছেন ও খালাস হয়ে যাবে? আপনি নিজেই নিজের ওপর ভরসা রাখতে পারতেছেন না?ʼʼ
খোঁচা মারা কথা। রউফ এটা টের পেল, কিন্তু টের পেল না এমপির গভীর চাল। সে বিভ্রান্ত হয়েই বেরিয়ে গেল এমপির বাড়ি থেকে। এমপি চোখ বুজে নিজের আসনে বসে রইলেন।

এমপি প্রায় দু’দিন পর্যন্ত জানতেই পারেননি ওঁর তিনজন লোকের কী হাল হয়েছে হামজার বড়ঘরে। তিনি তার সেক্রেটারিকে দিয়ে হামজাকে কল করিয়ে বললেন, ‘এই কাজ কে করেছে?ʼ হামজা খানিকক্ষণ পর কল ব্যাক করে বলল, ‘জয় মেরেছে। বাদ দিন। এসব হতে থাকে। হয়ত মেজাজ খারাপ ছিল, কিছু ঝামেলা হয়েছে, মেরে দিয়েছে। আমি ওকে বুঝিয়ে বলব।ʼ
ডাহা মিথ্যা কথা। কামরুলকে মেরেছে জয়ের বউ। কিন্তু দুই ভাই বাটপারি করল এমপির সাথে। কিন্তু এমপি সাহেব জানেন না–হামজা নিজেই জয়ের বাটপারির শিকার হয়েছে। জানা নেই জয় এর আগে কখনও হামজাকে মিথ্যা বলেছিল কিনা।

এমপি সাহেব তো বহুক্ষণ বিশ্বাসই করতে পারেননি ব্যাপারটা। ওঁর মাথায় শুধু একটাই কথা এলো–ওটা মেয়েলোক না ঘাতকিনী? বাপ্পী আবদার করেছে ওই ঘাতকিনীকে তার চাই। ভাতিজার আবদার এমপি ফেলতে পারেন না।
কিন্তু এটা তো ব্যাপারই না। আসল ব্যাপার পরদিন এমপির গোয়ালে পোষা এক পুলিশ জানিয়ে গেল–রউফ কায়সার হামজার বিরুদ্ধে আসা অভিযোগের নথি সরিয়ে রেখেছে। সেখানে সীমান্তর খুনী হিসেবে হামজা ছিল, এবং তার সাক্ষী ও প্রমাণও। এমপি সাহেব বিস্ময়ে হা করে ছিলেন অনেকক্ষণ। অনেকটা বাতাস গালে ঢোকার পর তিনি হুশ ফিরে পেলেন। হামজাকে তিনি আগে-পরেই ভয় পান। হামজা একটা বিচ্ছু।

এই তো সপ্তাহ কয়েক আগে তিনি জানতে পারলেন, ওই বিচ্ছু সামনের সংসদ নির্বাচনে প্রার্থী হবে এই আসনেরই। সেদিনের বিস্ময়ের কাছে এসব কিছুই না। সেদিনের পর তিনি সাতদিন হা করে ছিলেন একাধারে। এই আসনে হামজার প্রার্থী হওয়া মানে উনি ফিনিশ। হামজার জন্য মরণভয় জেগেছে সেদিন থেকে। তিনি শুধু অপেক্ষা করছিলেন সুযোগ বুঝে হামজার জানাজার নামাজে শরীক হবার। কিন্তু এরই মাঝে দুই ভাই উনাকে আবার হাঁ করিয়ে দিয়েছে।
সেক্ষেত্রে একজন সচেতন নাগরিক হিসেবে তিনি কোনোভাবেই আর বেশিদিন ওই দুই বিচ্ছুকে দুনিয়ায় রাখতে পারেন না। কিন্তু মজার ব্যাপার হলো উনার বিশেষ পরিশ্রমই হচ্ছে না। দৈববলে সব পথ তৈরিই হয়ে আছে দুই ভাইয়ের মরার, তিনি শুধু সামান্য আঙুল ঘুরাবেন।
হামজা এমনিতেই আধমরা হয়ে গেছে, এবং সেটা কাকতালীয়ভাবে আজই। সব তৈরি, তিনি শুধু দশ মিনিটে একটা ছক এঁকেছেন; তিনি উপরমহলে অনুরোধ করেছেন–কিছু বন্দি আছে হামজার হেফাজতে। তাদেরকে মারতে জয় আমিরকে এক রাতের জন্য কারাগার থেকে ছাড়তে হবে। বন্দিদেরকে খালাস করেই আবার সহি সালামতে কারাগারে চলে যাবে জয় আমির।
এমপি সাহেব আরেকটা পাইপ সেজে দিতে বললেন কাজের লোককে। জয় আবার কারাগারে ফিরবে নাকি খোদার কাছে, সেটা তিনি ঠিক করবেন।

হামজা চেতনা ফিরে পেল ভোর চারটার দিকে। শরীরে এক ধরণের অসাড়তা— চাইলেই সে তার অঙ্গগুলোকে নাড়াতে পারছে না। তার নিস্তেজ চোখদুটো কিছু খুঁজল। রুমটা অন্ধকার। সে কি পাটোয়ারী বাড়িতে নিজের বিছানায় শুয়ে আছে? রিমি কি এই অবস্থায়ও তার কাছে আসেনি?
কিন্তু টের পেল সে আসলে তার মাথার কাছে ঝুঁকে বসে ঝিমুতে থাকা জয়ের মুখটাকে খুঁজছে। হামজার প্রখর অনুভবশক্তি গন্ধে অনুমান করল সে হাসপাতালে শুয়ে আছে। আপাতত কেবিনে কেউ নেই, সে একা শুয়ে। হাতে ক্যানোলার সুঁচ ফুটানো জায়গায় এবার টনটন করে উঠল। কিন্তু যেকোনো অঙ্গেই মস্তিষ্কের নির্দেশ দেরীতে পৌঁছাচ্ছে।

ধীরে ধীরে চেতনা আসার সঙ্গে সঙ্গে তার সামনে তার জীবন এসে দাঁড়াল। অন্ধকারে জীবনকে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছিল না। কিন্তু অনুভূতিটা হামজার বুকে চাপ ফেলল। এই অন্ধকার কীসের? শেষরাতের? নাকি তার শেষ জীবনের? প্রতিকী অর্থে তো দুটোরই শেষ! তবু পার্থক্য আছে। রাত শেষ হলে আলো ফোটে, মানুষের জীবন শেষ হলে অসীম অন্ধকার।
সে জীবনের শুরুতে না খেয়ে চুপ থাকতে শিখেছিল, খাতার অভাবে কার্টুন বক্সের খাপে লেখা চর্চা করেছে, আঘাত হজম করে কূটবুদ্ধি পাকাতে পটু হয়ে জন্মেছে। বারো বছর বয়সে জানতে পেরেছে তার কোনো পরিচয় নেই। না, আছে। সে সম্ভবত বস্তির কোনো নোংরা কুঠরিতে বড় অবহেলার সাথে জন্মানো এক অপ্রয়োজনীয় জীবন। নবজাতকের কদর বড়লোকদের থাকে, গরীবদের কাছে নবজাতক সবজির খোসা। হামজার মনে পড়ল–তার ঔরসে জন্মানো দুটো শিশু কিনা তার চেয়েও বড় অভাগা ও অবহেলিত ছিল। যাদের মা তাদেরকে ভ্রুণ থেকে মানবশিশুতে অবধি পরিণত হতে দেয়নি, বাথরুমের কমোডের নিচে ফ্ল্যাশ হয়ে গেছে তারা।

কী আশ্চর্য! হামজার শরীরটা থরথরিয়ে উঠল। তার খুব ভয় করছে, অন্ধকারটা ভালো না। জয় কোথায়? হামজা কী করে পারে জয়কে দৃষ্টির বাইরে রেখে সে এভাবে পড়ে থাকতে? তার কিছু ছিল না। পরে সে দুটো জিনিস কামিয়েছে। জয় ও ক্ষমতা। একটাকেও সে হেলায় ফেলতে পারে না।
সে চেঁচিয়ে ছেলেদেরকে ডাকতে চাইল। সে জানে বাইরে তারা অপেক্ষা করছে। দিনাজপুর থেকে কি কেউ আসেনি? তার কেউ নেই কোথাও। এজন্যই কি কেউ আসনি? কিন্তু তার ক্ষমতা আছে। সেটা কোথায়? টুট টুট শব্দ হতে হচ্ছে, খুব দ্রুত। শেষরাতের নিস্তব্ধতায় অন্ধকার কেবিনে এই টুটটুট শব্দটা হামজাকে অস্থির করল। কীসের শব্দ এটা? কয়েক মিনিটের মাথায় কয়েকটা ছেলে নার্স নিয়ে দৌড়ে এলো। নার্স খুব বিরক্ত। শেষরাতে রোগীর সমস্যা হওয়া উচিত না। এসময় তারা একটু জিরিয়ে নেয়।

হামজার হার্টবিট ১২০-২২ পর্যন্ত উঠছে। সেটা খুব তাড়াতাড়ি ১৪০ ছাড়িয়ে গেল। কিছুক্ষণ থতমত খেয়ে নার্সের হুশ এলো দ্রুত এখন অ্যাডেনোসিন পুশ না করলে খারাপ কিছু হতে পারে। অ্যাডেনোসিন পুশ করার পর হামজার মনে হলো সে মরে যাচ্ছে। তার দম বন্ধ হয়ে এলো, বুকে ভয়ানক ব্যথা উঠে গেল। সে হাত তুলে বুকে রাখতে চেয়েও পারল না। বাঁ হাতে ক্যানোলা, ডান হাতের মধ্যমা আঙুলিতে অক্সিমিটার সেন্সর ক্লিপ লাগানো। তার জয় কোথায়? রিমি কি আসবে না?
হামজার চেনা মুখগুলোর ঢাকা পৌঁছাতে সকাল আটটা বাজল। তখন রিমি ভীষণ রকম কাহিল। মানসিক অস্বস্তি তার শরীরকেও দূর্বল করেছে। ছেলেরা গিয়ে হামজার কেবিনের সামনে নিয়ে এলো ওদেরকে। কিন্তু রিমির হাত-পা থরথর করে কাঁপছে। সে কীভাবে ওই মানুষটার সামনে গিয়ে দাঁড়াবে? শেষবার যখন দেখা হয়েছিল, রিমির ভেতরে যে ঘেন্নাটা ছিল, তা এখনও আছে? থাকলে সেটার ধরণ কেমন?

লোকটা ঘুমিয়ে আছে। হার্ট মনিটরিং ডিভাইসের টুট টট শব্দ ছাড়া কেবিনটা নিঃশব্দ, শীতল। রিমি দেখল লোকটার হার্টবিট ৮৮ থেকে হুট করে বেড়ে ৯৪ হচ্ছে, আবার কমে ৮৫ তে আসছে। মাথার ওপর বিশাল ব্যান্ডেজ, হাতের বাহুতেও। শরীরের বিভিন্ন স্থানের ত্বক ও মাংস ছেঁড়া, সেসব স্থানে ওষুধের প্রলেপ। প্রসস্থ লোমশ বুকের ওপর ছোট ছোট ইসিজি প্যাচ লাগানো। বিশাল দেহটা পড়ে আছে বেডের ওপর। রিমির বুকের ভেতর মুচড়ে উঠল। এমন বিশ্রী-ভয়ংকর কোনো দৃশ্য রিমি আগে কখনোই এমন খুঁটিয়ে দেখেনি।
রিমি দরজার কাছে দাঁড়িয়ে রইল। কোয়েল মামার এই অবস্থায় খুবই চিন্তিত। সে বুঝতে পারছে না মামার কী হয়েছে? গায়ে এসব লাগিয়ে শুয়ে থাকার মানেটা কী? সে গিয়ে মামার কানে কানে ফিসফিস করে ডাকল, “বলোমামা, এই মামা? কী হইতে তোমাল? ওথো, আমলা আসছি। মাম্মাম আসছে, মামণি আসছে। উথবে না?ʼʼ
খুব পরিশ্রমসাধ্য এক চেষ্টার পর সে উঠে বসল বেডের ওপর। প্রায় হামজার গায়ের ওপর চড়ে বসে ডাকল, “বাবাকে খুঁজতে হবে, বুজলে? ওথো। তুমাল কি খুব বেশি অসুক হইসে? আমি তো বুঝতেছি না।ʼʼ
হামজা উঠছে না দেখে পেছন ফিরে মামণির দিকে তাকায় সে। মামণির কেন চোখ চিকচিক করছে? মামণির উচিত ভেতরে এসে তার সঙ্গে মিলে মামাকে ডাকা।

কিন্তু তার ডাকেই হামজার হাত নড়ে উঠল। সকালের ওষুধ দেবার জন্য নার্স এসে দাঁড়ায়। হামজা কোয়েলকে দেখে, বুড়ির মতো বেডের এক টুকরো জায়গায় বসে আছে তার মুখের দিকে ঝুঁকে। হামজার বুকের ভেতর চিনচিন করে উঠল। মৃদু হাসি দেখা গেল ঠোঁটে। অস্ফূট উচ্চারণ করল, “আমার আম্মা!ʼʼ
অক্সিমিটার ক্লিপ লাগানো হাতটা দিয়ে জড়িয়ে নিলো নিজের সাথে কোয়েলকে। নার্স বাঁধা দিতে আসে। হামজা চোখের ইশারায় শুধু তাকাল একবার, ইশারায় চলে যেতে বলল। নার্স ভীত পায়ে দ্রুত বেরিয়ে যায়।

তখনও হামজার চোখ কিছু খুঁজছে। একটি চিন্তিত গম্ভীর মুখ, যে এখন নার্সের সাথে গায়ে পড়ে ঝগড়া করবে, ডাক্তারকে ধমকাবে, হুমকি দেবে হামজাকে এক্ষুনি ঠিক করার জন্য, নয়ত ডাক্তারের বউ-বাচ্চা শেষ। হামজার হৃদস্পন্দন ধাই ধাই করে ১০২ উঠে গেল। সে এতক্ষণে টের পেল তার পিঠ শরীরের অন্যান্য অংশের চেয়ে অবশ।
দরজার কাছে ছিপছিপে দেহের একটি শাড়ি পরিহিতা নারী দাঁড়িয়ে। হামজা চোখ ভরে দেখে নারীটিকে, একটু শান্ত হয় ভেতরটা। হাসে অল্প, বিরবির করে বলে, “কাছে আসবে না? এখনও ঘেন্না লাগছে?ʼʼ
রিমির চোখের পানি মেঝেতে পড়ে, তা দেখেও হাসে হামজা। রিমি ধীরে ধীরে এসে চেয়ারটায় বসে। রিমির শরীরের চেনা গন্ধটা হামজার নাকে প্রবেশ করে। তার রিমিকে খুব গভীরভাবে ছোঁয়ার আবেশ জাগে আচমকা।

-“জয় কই?ʼʼ
রিমির মুখে ক্ষোভ ফুটে ওঠে, “তার খোঁজ কেন?ʼʼ
হামজার ভালো লাগল এবার একটু। রিমির জয়কে সতিন বলার যৌক্তিক কারণ আছে।
-“আমি ভেবেছিলাম তোমরা আসবে না, তার আগেই আমি…ʼʼ
-“না আসাই তো উচিত ছিল। কেন এসেছি জানি না।ʼʼ রিমির গলা ধরে এলো, এক চিমটে পানি জমাট রইল চোখের কোলে।
হামজা হেসে ফেলল, “তুমি কেঁদে ফেললেই কিন্তু আমি বুঝে যাব কেন এসেছ।ʼʼ
রিমি যেন সত্যি সত্যি ভয় পেয়ে ব্যস্ত হয় কান্না লুকোতে। হামজার হাত নাড়ায়, তার স্নায়ু দূর্বল, শরীরের অঙ্গে মস্তিষ্কের নির্দেশ দেরিতে পৌঁছাচ্ছে, তার কী অসুখ হয়ে গেছে কে জানে! তবু লোকটার সর্বোচ্চ শক্তচিত্ত নিজেকে একদম সুস্থভাবে উপস্থাপন করতে তৎপর। রিমির হাতদুটো হামজার কপাল ছুঁয়ে দেয়। এই ছোঁয়া রিমিকে কাঁপিয়ে তোলে।

-“আপনি ফিরে আসুন।ʼʼ
-“কোথায়?ʼʼ
-“যেখানে এবং যেভাবে আমি আপনাকে পেয়েছিলাম।ʼʼ
-“বোকা নারী! তুমি খুবই সুন্দরী একজন নারী। কিন্তু ধরো কখনোই আয়নার নিজের সৌন্দর্য দেখোনি আগে। হঠাৎ-ই একদিন দেখলে। তা বলে কি তুমি সেদিনই সুন্দরী হলে, আগে ছিলে না?ʼʼ
রিমি হামজার হাত খামছে ধরে। হাতটা মৃদু কাঁপছে, সেই মতো রিমির বুকটাও কাঁপে। কী হয়েছে লোকটার?
-“আমি আগেও এ-ই আমিই ছিলাম, শুধু তোমার চোখে ধরা পড়েছি হঠাৎ। তার মানে তুমি আমার এই আমিকেই ভালোবেসেছ, গিন্নি।ʼʼ
-“কে বলেছে আমি ভালোবাসি আপনাকে?ʼʼ
-“তোমার চোখের পানিকে জিজ্ঞেস করলে তা-ই বলবে।ʼʼ

রিমি ছটফট করে উঠে ঠোঁট কামড়ে ধরে, “আমার সামনে আপনার এই বিশ্রী রূপ না আসলেও তো পারতো!ʼʼ
-“অর্ধাঙ্গিনী মানেই তো সবকিছুর অর্ধেক অর্ধেক। পাপেরও। পালাতে চাইছ কেন?ʼʼ
-“আমি আপনার পাপের ভাগ চাই না। ভালোবাসায় পাপ থাকে না।ʼʼ
-“তুমি জানো না তাহলে। ভালোবাসাই তো পাপের বাপ। যেকোনো কিছুকে ভালোবাসলেই সেখান থেকে পাপের জন্ম হয়। ভালোবাসাকে পেতে মানুষ সমস্থ সীমা অতিক্রম করে। সীমার ওপারেই তো পাপ, রিমি।ʼʼ
-“যেমন কোরে আপনি ক্ষমতাকে ভালোবেসেছেন।ʼʼ
-“আমি তোমাকেও ভালোবেসেছি।ʼʼ
রিমি তীব্র প্রতিবাদ কোরে ওঠে, “মিথ্যা কথা।ʼʼ
-“সত্যি কথা, রিমি। কিন্তু সেই ভালোবাসায় আমার অতীত ও ভবিষ্যতের চাহিদাকে কোরবানী করার শর্ত নেই।ʼʼ
-“তাহলে এটা কেমন ভালোবাসা?ʼʼ
-“আমি জানি না, রিমি। কিন্তু তুমি আমায় ঘেন্না কোরো না। আমার প্রয়োজন তোমাকে।ʼʼ

-“আমি আপনার প্রয়োজন হয়ে থাকতে চাই না।ʼʼ
-“তাহলে কী চাও?ʼʼ
-“চাইলে পাব?ʼʼ
-“দেবার মতো হলে যেকোনো কিছু পাবে। চেয়ে দেখো।ʼʼ
কথাটা রিমি জিদে অথবা আবেশে উচ্চারণ করে বসল, “তালাক চাই আমার। তালাক দিন।ʼʼ
হামজা চোখদুটো বুজে ফেলল। কিছুটা সময় তার বুকের ওঠানামা থেমে রইল, এরপর আস্তে আস্তে হাসি ছড়ালো ঠোঁটে, “তোমার অন্তরে আমার পাপের যে কালি লেগেছে, তা তালাকের কাগজ দিয়ে ঘঁষলে উঠবে না, রিমি। বৃথা চেষ্টা করে কী লাভ? মেনে নাও।ʼʼ
-“অসম্ভব।ʼʼ

-“আরমিণের মতো কথা বোলো না। সে আর তুমি এক নও।ʼʼ
-“তাকে ভয় পান? সে তাহলে সত্যিই সফল। তার মতো হতে আমায় কী করতে হবে, বলুন?ʼʼ
-“আমি তার সঙ্গে যা যা করেছি এবং করব, তোমার সাথে তা হয়নি।ʼʼ
-“কী করবেন? কী করবেন আপনি তার সঙ্গে?ʼʼ
-“ভাবতেও পারবে না, এমন কিছুই করব। জয় কোথায়?ʼʼ
রিমি চুপ করে তাকিয়ে রইল হামজার দিকে। ভীষণ সুদর্শন শক্তপোক্ত বলিষ্ঠ পুরুষ, কিন্তু চেহারায় এক ঘাতক-নীরবতা আছে। এখন দেখতে তা ম্লান লাগছে। এই অবস্থায় জয়ের গ্রেফতারের খবর দিয়ে পরিস্থিতি বেসামাল করার সাহস হয় না রিমির।

তুলি ঢোকে কেবিনে। হামজার সাথে তার সম্পর্ক ছিল অদ্ভুত। হামজার ভালোবাসা দুর্বোধ্য। সেটা কেউ পেলেও টের পায়নি। ক্ষোভও ছিল হামজার ওপর তুলির। কিন্তু এই মহাক্ষণে এসে হামজার দিকে তাকিয়ে তুলির বুক কেঁপে উঠল। তার মনে হলো যা হয়েছে তা না হলেই হতো। তুলির শুধু মনে হলো–আরমিণ কেন বলেছিল–পাটোয়ারী বাড়িতে কেউ থাকবে না? তার ধ্বংসের কতটুকু নিকটে অথবা দূরত্বে দাঁড়িয়ে?

রাতটা পুলিশফাঁড়ি কাটানোর পর পরদিন সকালে জয়কে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছিল। পরাগকেও আনা হয়েছিল সেখানে। এরপর পুলিশ ফাঁড়ির আলাদা একটি ডিটেনশন সেলে জয়কে স্থানান্তরিত করা হলো। দেশের আইনের অবস্থা জয়কে হাসালো। তাকে আজ রাতে খালাশ করা হবে, তারই প্রস্তুতি চলছে আলাদা ট্রিটমেন্টের মাধ্যমে। নয়ত সে যা স্বীকারক্তি দিয়েছে এতক্ষণে আদালতে নেবার অর্ডার আসার কথা। কিন্তু সন্ধ্যার দিকে কবীরকেও পুলিশফাঁড়িতে হাজির করা হলো। জয়ের দেয়া টাকাগুলো পুলিশদের মন নরম করে দিয়েছে।
জয় বসে ছিল ডিটেনশন সেলের দেয়াল ঘেষে। তাকে দেখে কবীরের চোখদুটো গোল্লা গোল্লা হলো, অশান্ত গলায় বলল, “আপনে এইখানে কী করতেছেন, ভাই?ʼʼ

-“ছেহ্! ভাবলাম, তোর বিয়েডা দিয়ে মরব। তোর ওপর একটা দায়িত্ব আছে না? কিন্তু চেহারার যে হুলিয়া বানাইছিস, কোনো হিজড়াও বিয়া বইতো না তোর লগে। অবশ্য তুই চাইলে আমি একটা লেডি মানকি ধরে আনতে পারি তোর জন্য। বানর হলো মানুষের অরিজিনাল। আমি তোর জন্য কোনো বিবর্তিত প্রোডাক্ট প্রেফার করব না। মেয়েলোকের অরিজিনাল হলো মেয়ে বান্দর। বুঝলি?ʼʼ
কবীর জয়ের পাশে মেঝের ওপর ঠেসে বসে অস্থির হয়ে বলল, “আপনি এইখানে ক্যান?ʼʼ
জয় হাসে, “এইখানেই তো থাকার কথা আমার! পাপীকে কারাগারে দেখলেই মানুষ অবাক হবার দিন যাবে কবে রে কইবরা?ʼʼ

কবীরের চোখে ভয় ও কাতরতা, সে জয়কে এখানে মানতে পারছে না। সে বলল, “বাজে কথা ছাড়েন, ভাই। আপনেরে এইখানে আনলো কেমনে শালারা?ʼʼ
জয় তাকায় কবীরের দিকে, শান্ত গলায় বলে “জয় আমির তোদের সবার মহানুভবতার সামনে এক ঋণী কুত্তা? এই যে এতগুলা দিন পুলিশ হাজতে চামচিকার মতোন গড়াগড়ি খাইলি, অথচ আমি একবার দেখতে পর্যন্ত যাই নাই, তোর ভেতরে বিদ্রোহ জাগে নাই আমার বিরুদ্ধে?ʼʼ
কবীর গম্ভীর গলায় বলল, “আপনেই যদি না থাকেন, এই কবীরের বাইরে কী কাম?ʼʼ
জয় বুকের বাম পাশ চেপে ধরল, “উফফ, সেন্টিমারা ডায়লোগ দিস না, বাপ। আমার বমি আসে। ওয়াক্..ʼʼ
কবীর রাগান্বিত চোখে তাকায়। জয় শুকনো হাসে।
-“ভাবী ভালো আছে, ভাই?ʼʼ
-“ওরে শালা বেইমান! আমি জেলে আইছি, এতক্ষণে আমারে একবার জিগাইলি না, আর ওই শালির খবর করতাছো? কবিরাজের গাছ খাওয়াইছে তরে?ʼʼ

-“আমার মাফ চাওয়া বাকি এহনও।ʼʼ
-“অ্যাঁহ্! কী বাবদে?ʼʼ
-“কত বেয়াদবী করছি, কত অসম্মান করছি।ʼʼ
-“তখন আমার বউ ছিল না।ʼʼ
-“কিন্তু সেই মেয়েটাই ছিল, এখন যে মেয়ে।ʼʼ
জয় হো হো করে হাসে, “সত্যিই জাদুটোনা করছে নাকি তোরে? সর্বনাশ! ভালো মানুষের পোকা কুড়কুড় করতে দেখতেছি ক্যান আমি তোর ভেতরে, কইবরা? পুলিশের ঘা পড়লে সাপ-ও সোজা হয়ে চলে, এই নীতি কাম কইরচে তোর ওপর? বহিষ্কার, আমার দরবার থেকে বহিষ্কার করা হলো তোকে। তুই আমার অযোগ্য শাগরেদ প্রমাণিত হইছিস।ʼʼ
-“হামজা ভাই কই, ভাই? কিছু তো কন। আপনে এইখানে…ʼʼ
-“তোর কী মনে হইছিল, এক তুই মুখ না খুললে জয় আমির অমর হয়ে যাবে?ʼʼ
-“এইসব কথা আসতেছেন ক্যান, ভাই? আপনারে আনছে কেমনে ওরা? সাহস কি বেশি হইছে গু চাটা কুত্তাগোরে?ʼʼ

-“হামজা ভাই মিটফোর্ডের বেডে পড়ে আছে। তোর পেয়ারের ভাবী তার শশুড়বাড়ি। আমি আমার শশুড়বাড়ি। আর কিছু জানতে চাইলে দ্রুত প্রশ্ন কর। আগামী আড়াই মিনিটের মধ্যে আমি ঘুমাই যাব।ʼʼ
কবীরের গলা শুকিয়ে এলো। জয় হেলান দিয়ে বসে থাকে দেয়ালের সাথে। চোখ বুজে হেলান দিয়েই বলে, “তোর কাইল ছুটি, কইবরা। তোর ভাবীর একটু খেয়াল-মেয়াল রাখিস। শালীর আবার কেউ নাই, এতিম।ʼʼ
-“ভাই, এইবার কিন্তু বাড়াবাড়ি হচ্ছে। বাইর হইলে আমি আপনে একসাথে বাইর হবো।ʼʼ
-“তাই নাকি? আমার পাপের দশ শতাংশও তোর আছে? তোর মা কাঁদতে কাঁদতে অন্ধ হয়ে যাচ্ছে, আর তুমি নিমোকহারাম শালা পরের চ্যাংরার জানের গ্যারান্টি হয়ে বসে আছো এইখানে?ʼʼ
কবীর এতক্ষণে খেয়াল করে জয় আমিরের গলায় গামছার মতোন একখানা ওড়না ঝুলছে। কবীর লুকিয়ে মুচকি হেসে বলে, “আপনি গেছিলেন মা’র কাছে?ʼʼ

জয় আচমকা চোখ খুলে তাকাল কবীরের দিকে, কাধে হাত রেখে বলল, “যার পরিবার আছে, তার জন্য পরিবারের উপরে কিচ্ছু নাই, কবীর। তোর বাপ পঙ্গু, তোর মা’র একমাত্র ভরসা তুই। আমি তোর ধ্বংসকারী, মূর্খের মতোন আমার পিছনে জীবন ক্ষয় করতেছিস, তোর সৃষ্টিকর্তা দুইজন তোর প্রতীক্ষায় বসে আছে দরজা খুলে।ʼʼ
-“আপনের প্রতীক্ষায় কেউ নাই?
জয় অবাক হবার ভান করে হেসে ফেলল, “আছে নাকি? বলিস কী রে?ʼ
-“আছে।ʼʼ
-“ভুয়া কথা। আমার কোনো মা নাই।ʼʼ
-“ভাই খালি মা-ই অপেক্ষা করে না।ʼʼ
-“আর কেউ করে না। আমি যখন খেলতে যাইতাম, এর ওর নাক ফাটায়ে আসব, কেউ আমারে ধাক্কা দিয়ে ফেলে আমার হাঁটুর চামড়া ছিলে দেবে, এই চিন্তায় আমির বাড়ির ব্যাটার বউ আমির নিবাসের ফটকের কাছে লাঠি নিয়ে দাঁড়াই থাকতো, কোনোদিন মারতো না। আমি আমির বংশের চ্যাংরা, আমারে মারে সাহস কার? তারপর আর কেউ করে নাই আমার অপেক্ষা।ʼʼ
-“আপনে এখন আর সেই বাচ্চা নাই। এখন যার করার কথা, এই অবস্থায় মা’র চাইতেও বেশি, সে আপনারে ঘেন্না করে। এইডা তো আপনেরই দোষ, ভাই।ʼʼ

জয় মাথা দুলিয়ে হাসে, “দুই চাইরডা দোষ থাকাই তো ভালো রে।ʼʼ
-“আর একজন আছে। আপনে হামজা ভাইরে চিনেন? দুনিয়া উলোট-পালোট করে ছাড়বে।ʼʼ
জয় চোখ বুজে হাসে, “আমার জন্য এই দুনিয়া? নাকি আমার দুনিয়া?ʼʼ
কবীর অস্থির হয়ে বলল, “কী বলতেছেন?ʼʼ
জয় ডাকে,“কবীর?ʼʼ
-“হু, ভাই?ʼʼ
-“ধর, জিন্নাহ্কে বড় সাহেব খুন করছে..ʼʼ
কবীর ছিটকে উঠল, “অসম্ভব। হইতেই পারে না…ʼʼ
মুখ চেপে ধরল জয়, “চুপ, শালা। আমি যতটা বিশ্বাস করি তাকে, তুই তার চাইতেও বেশি?ʼʼ
-“হামজা ভাইয়ের জান আপনে। এইসব কথা মুখে আনতে নেই ভাই। ভুল বুঝছেন। ওই মুরসালীন মহান জঙ্গী কিছু ভুলভাল বুঝাইছে আপনারে?ʼʼ

-“সঠিক কী?ʼʼ
কবীরের কাছে এর উত্তর নেই। সে শুধু এই জীবনে হামজা ও জয়ের ভাঙন দেখতে পারবে না। তার আগে তার চোখ উপড়ে ফেলা হোক। জয়কে সে চিনতে পারছে না বলেই মনে হলো তার। তার শরীরের অত্যাচারের ব্যথাগুলো আর অনুভূত হচ্ছে না। এখন শুধু তার খুব বুক জ্বলছে।
-“ভাই? ভাবীরে ওই বাড়ি রাখছেন। ওইখানে ভাবীরে নিয়া থাকার প্ল্যান আছে?ʼʼ
-“তুই খুব খুশি মনে হচ্ছে?ʼʼ
-“খুশিই তো, ভাই। এই জীবনে আপনের একটা সংসার দেখার চাইতে খুশির আর কী হইতে পারে?ʼʼ
জয় ছাদের দিকে মুখ তুলে এক চোট হাসে, “হু হু!? কার সংসার?ʼʼ
-“আপনের আর ভাবীর। ভাই আপনে চাইলেই পারবেন।ʼʼ
-“চাওয়া অন্যায়।ʼʼ

-“এত জটিল ক্যান লাগতেছে সবকিছু? ধুর!ʼʼ
-“সহজ ছিল কবে, সেই তারিখটা বল।ʼʼ
-“এইখান থেকে খালাশ হওয়া শুধু সময়ের ব্যাপার। তারপর যাচ্ছেন তো নিজের বাড়ি, ভাবীও ওইখানে। সব সহজ হয়ে যাবে।ʼʼ
-“এইখান থেকে খালাশ হয়ে আমি ওইখানে যাব, তুই শিওর?ʼʼ
কবীর উপর-নিচ মাথা দুলায়। জয় হাসল, “আমার তীর্থে যাবার সময় হয়ে গেছে রে পাগলা। বাঁচতে চাইলে আন্ডারগ্রাউন্ড হওয়া লাগবে। আর আমার সাথে যাইতে ও জীবনেও রাজী হবে না। আমাদের পথ আলাদা।ʼʼ
-“তাইলে বিয়ে ক্যান করলেন?ʼʼ
-“আমি করি নাই। হয়ে গেছে। বিয়ে করলে কসম ওরে করতাম না।ʼʼ
কবীর ক্ষেপে উঠল, “কারে করতেন, শুনি?ʼʼ

-“অন্তত ওরে না। ও সুপুরুষ ডিজার্ভ করে, কইবরা। আমি ওর জন্য না।ʼʼ
-“কিন্তু ও তো আপনার জন্য।ʼʼ
জয় তাকায়। কবীর মাথা দুলায়, “হ, ভাই। আপনে জীবনেও এমন কোনো চেংরিরে বিয়ে করতেন না যে কুপুরুষ ডিজার্ভ করে। আমি চিনি না আপনারে?ʼʼ
জয় কথা বলে না। কবীর আবার বলে, “আন্ডারগ্রাউন্ড হওয়া লাগে, ভাবীরে নিয়া হন। জোর করে হইলেও। আমার আবদার এইটা আপনের কাছে।ʼʼ
জয় হেসে ফেলল, “জোর করে? কীসের ঠেকা আমার?ʼʼ
-“আছে। আমার সাথে মিথ্যা বইলেন না, ভাই। আপনে এইখান থেকে বের হয়ে ভাবীর কাছে যাবেন। আমি জানি। আমিও চাই এইডাই। আমিও যাব আপনের সাথে। তারপর ভাবীরে নিয়া হিলি বন্দর পার কইরে ভারতে। দরকার পড়লে নেপাল চলে যাবেন একদম। যদ্দিন না হামজা ভাই সব কেইস সল্টে দেয় ততদিন দ্যাশে ফেরা নাই। বেশিদিন লাগবে না। তারপর ফিরে আমির নিবাসে চিরকাল.. বাড়ির ছেলে বউ নিয়া বাড়ি ফিরবে না?…ʼʼ
জয় হ্যাঁ-না কিচ্ছু বলল না। আনন্দে উদ্ভাসিত হয়ে আছে কবীরের মুখ। তার ক্লান্ত, ক্ষত-বিক্ষত মুখে শান্তির রেখা ফুটে উঠেছে।

উপরহলের নির্দেশে জয় আমির ও কবীরকে মাঝরাতের অন্ধকারে মুক্ত করে দেয়া হলো পুলিশফাঁড়ি থেকে। জয় আমিরের শুকনো হাতে কিছুটা লাল তরল মাখানোর আছে। এসব কাজ উপরমহল করে না। জয় আমিরেদেরকে দিয়ে করানো হয়ে থাকে।
জয় আমির ও কবীর বড়ঘরের কাজ সেরে বের হলো, তখন প্রকৃতিতে রাত তিনটা। জয় আমিরের সাদা ধবধবে লুঙ্গিতে রক্ত, হাতের কব্জিতেও, কপালের ওপরেও। গলায় তখনও ওড়নাখানা ঝুলছিল। জয় সেই ওড়নায় রক্তগুলো মুছতে মুছতে রাস্তায় নেমে এলো। রাস্তায় একটা কুকুরও নেই। ঝি ঝি পোকারাও ভয়ে ডাকা বন্ধ করে দিয়েছে বোধহয়।
কবীরের মেজাজটা থমকে ছিল, যা ঘটল বড়ঘরে, তা কবীরকে খুব একটা সুখী করেতে পারেনি বোধহয়। তবু কিছু একটা তাকে সপ্রতিভ করে, সে জয়ের কানে ফিসফিস করে বলে, “এইভাবে ওড়নার মালিকের সাথে নিজেকে ঘষে পাপগুলা মুছে ফেললেও পারেন।ʼʼ
জয় নিঃশব্দে হাসে, “ওড়নার মালিক আমাকে এ অবস্থায় দেখে বড়জোর ঘেন্নায় একদলা থুতু ছুঁড়ে দিতে পারে, নিজেকে এগিয়ে দেবে না পাপের ভাগ নিতে। আর তুই আমাকে থুতু খাওয়াইতেই নিয়ে যাচ্ছিস, কবীর। আমার এই মুহুর্তে একবার শুধু রাজধানী যাওয়া জরুরী। ওই শালী আত্মহত্যা করে নেবে তবু এখন আর আমার সাথে যাবে না।ʼʼ

-“আপনি রাইখে যাইতে পারবেন তারে এইখানে? সকালের আলো ফুটতেই যদি আপনার এনকাউন্টার করতে বাইর হয় পুলিশ শালারা? ওগোরে মনে কহন কী চাপে কওয়া যায়? আবার চিরুণী তল্লাশীর নাটক শুরু হইবো। তারে কার কাছে রাইখা যাচ্ছেন?ʼʼ
কবীর জানে জয় আমির। রাজধানী হয়ে যদি জয় আমির আন্ডারগ্রাউন্ড হবার পথে পাড়ি দেয়, তার ঘরওয়ালিকে কোনো শর্তেই এখানে রেখে যাবে না। কিন্তু সত্যিই কি এই অবস্থায় সেই নারীটি এই পিশাচকে গ্রহণ করবে?
একটা সিএনজি পেলে ভালো হতো। কিচ্ছু নেই রাস্তায়। দুজন হেঁটে হেঁটে বাঁশেরহাট বাজারের ওপর পৌঁছালো। আরেকটু হেঁটে এগিয়ে যাবার পথে সোঁ করে একটা দ্রুতগামী কিছু কবীরের কানের গোড় দিয়ে ছুটে গিয়ে সামনের চায়ের দোকানের বেঞ্চিতে বিঁধল বোধহয়। দূর থেকে পোলের সামান্য আলো অন্ধকারকে একটুও দূর করেনি। জয় এক মুহুর্তের মাঝে কবীরকে এক ধাক্কায় ছিটকে নিজের থেকে দূরে ফেলে দিলো।
পরের মুহুর্তেই বিকট শব্দ করে পর পর দুটো বুলেট এসে জয় আমিরের শরীরে বিঁধল। একটা মাংসপেশী ছিঁড়ে-ফুঁড়ে বেরিয়ে গেল। জয় কুজো হয়ে পড়ল। মুখ থেকে ছিটকে একটা ভোঁতা আর্তনাদ বেরিয়ে এলো। তার পরক্ষণেই হেসে ফেলল সে। চোখ জ্বলছে, পানি ভরে উঠেছে চোখদুটোয়। দম ফুরিয়ে এলো, বুকের মাঝখানে দলা হয়ে চাপ ধরে এলো। গলগল করে রক্ত বেরিয়ে মাটিতে পড়ায় অনেকটা ধুলো আটার মতো দলা পাকিয়ে মেখে উঠল জয় আমিরের রক্তে।

জয় গা কাঁপিয়ে হাসে। সেই হাসিতে শব্দ নেই। হাঁটু গেঁড়ে বসে পড়ায় চোখ থেকে টুপ টুপ করে কয়েক ফোঁটা পানি ধুলোর ওপর পড়ে। কারা যেন পেছন থেকে দৌড়ে পালিয়ে যায়। জয় দম নেবার চেষ্টা না করলেও তার অবাধ্য শরীরটা নিস্তেজ হয়ে লুটিয়ে পড়তে চাইল না। দম নেবার চেষ্টা করল।
কবীর এত্ত জোরে ডেকে উঠল, “ভাইইইই! ভাই, ভাই, জয় ভাই….ʼʼ
সাঁতরে উঠে আসে কবীর। জয়ের ঢলে পড়তে চাওয়া শরীরটা জড়িয়ে ধরে। জয় আমিরের গা কাঁপছে, জয় হাসছে, প্রাণখোলা হাসি হাসছে। বারবার দম আঁটকে এসে আবার নিঃশ্বাস টেনে নেবার ফোঁস ফোঁস শব্দ হয়ে কবীরের প্রচেষ্টাকে ব্যর্থ করে জয় আমিরের শরীরটা ঢলে পড়ল ধুলোর ওপর। কবীরের শরীরের নিচের দিকে জয়ের রক্তে ভরে উঠল।

অবরুদ্ধ নিশীথ পর্ব ৭৭ 

জয় দেখতে পায় মৃত্যু চপল পায়ে এগিয়ে এসে তার শিয়রে হাঁটু গেঁড়ে বসল। সে একবার শেষবার দম টানার চেষ্টা করে, অস্ফূট স্বরে ডাকে, “হামজা ভাই, বড়সাহেব হাস..পাতালে… কবীর। আমি তারে দেখতে যাব…ʼʼ
মৃত্যু বড় যত্নে জয় আমিরের মাথায় হাত বুলিয়ে দিলো। শরীরে কী অসহ্য ব্যথা! শিরা-উপশিরা ঝেঁটিয়ে রক্ত ছুটে যাচ্ছে ক্ষতর দিকে, সেই কলকল ধ্বনি শুনতে শুনতে জয় আমির আরামে চোখ বোজে। ব্যথা নেই আর কোথাও, রক্ত ঝরছে তাতে আর যায়-আসে না জয়ের।

অবরুদ্ধ নিশীথ পর্ব ৭৮