অবরুদ্ধ নিশীথ পর্ব ৮১

অবরুদ্ধ নিশীথ পর্ব ৮১
তেজস্মিতা মুর্তজা

অন্তূর একটু গা গরম। আমজাদ সাহেব সারারাত বাড়ি মাথায় করে রাখেন। রাবেয়া বিরক্ত হয়ে বলেন, “উফফ, অন্তিকের আব্বা, রাতভর চেঁচাবা না। কানের গোড়ে বসে চেঁচালে শরীর আরও খারাপ লাগে। তুমি ঘরে যাও, আমি দেখি।ʼ
কিন্তু আমজাদ সাহেব রাবেয়াকে এসব কাজে একটুও ভরসা করেন না। অন্তূ এক নম্বরের বোবা, জ্বরে ফিট খেয়ে গেলেও বলবে না, আর রাবেয়া ঘুমিয়ে পড়বেন। সুতরাং তিনি রাবেয়ার ধমক খেয়েও সারারাত মাথার কাছে বসে অজিফা পাঠ করেন, আর একটু পর পর কপালে হাত রাখেন। অন্তূ বিরক্ত হয়ে বলে, ‘আব্বু, আমি কিন্তু সুস্থ, এবং ঘুমাচ্ছি। কিন্তু তোমার এই একটু পর পর কপালে হাত রাখায় আমার ঘুম ভাঙছে। যাও তো, রুমে যাও।ʼ
আজ অন্তূ আছে। না, অন্তূও নেই। অন্তূ ফুরিয়ে গেছে, আর আমজাদ সাহেব নেই। আজ রক্তাক্ত অন্তূ দুর্গন্ধে ভরপুর, এক ধুলোমাখা মেঝেতে পড়ে রইল। অন্তূর মাতৃত্ব ধুয়ে কলকল করে রক্ত ছুটে যাচ্ছে দেহ ছেড়ে। তার ব্যথায় ছটফট করার মতো আপন কেউ নেই কোথাও। এ সময় অন্তূর মাকে খুব দরকার। রাবেয়া জানেন না তার গর্ভের ধন গর্ভ হারিয়ে মৃত্যুপথে।

রক্তপাত থামানো মুশকিল হয়ে যাচ্ছিল। অ্যানেস্থেসিয়া ব্যবহার না করে সম্পূর্ণ অনুভূতিসম্পন্ন অবস্থায় অন্তূর গর্ভজাত বস্তু ছিঁড়ে আনা হয়েছে গর্ভাশয় থেকে। সুতরাং জরায়ুপথে ডায়ালেটর ও ভ্যাকুয়াম যখন ব্যবহার করা হয়েছে, অন্তূর শরীর অসহ্য ব্যথায় নিদারুণ কাতরেছে, এ অবস্থায় অস্ত্র চালনায় ক্ষত তৈরি হয়েছে। অন্তূর সাথে যা হলো তা জীবিত কোনো নারীর সাথে হতে নেই।
অন্তূ এরপর মানসিকভাবে ভারসাম্য হারাতে পারে, গর্ভধারণ ক্ষমতা আর থাকবে না, ক্যান্সার হলে অবাক হবার কিছু নেই, এছাড়া যে অস্বাভাবিক পরিবেশে এই সংবেদনশীল কাজটি সম্পন্ন হলো যেকোনো ধরণের ইনফ্রাকশন না হলে সেটা অবাককর বিষয় হবে। কিন্তু ডাক্তারের কিছু করার নেই। গোপনে দুটো ন্যাপকিন অন্তূর নিম্নদেশে পরিয়ে ওভাবেই ফেলে তাদের চলে যেতে হলো, হামজার নির্দেশ। যদি অন্তূ না মরে তবে আবার নাহয় আসবে তারা। তবে এখন আর কোনো তদবীর নয়। ডাক্তার ও নার্সগুলো এক প্রকার মানসিকভাবে বিপর্যস্ত অবস্থায় ফিরে গেল।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

অন্তূর দেহটা নাড়িছেঁড়া ভ্রুণের পাশে পড়ে রইল অবরুদ্ধ হলরুমে। সেখানে অন্তূর পিঠের নিচে একখানা বিছানা নেই, নেই মাথার নিচে বালিশ, নেই পরিচ্ছন্নতা, ওষুধ বা দেখার মানুষ, স্নেহের হাত, খাবার-পানি, যত্ন, আলো…। নিশুতি রাতে একটি ছিন্নভিন্ন, অচেতন, নাপাক রক্তে গড়াগড়ি খাওয়া নারীদেহ আমির নিবাসের মেঝেতে ফেলে কতকগুলো মানুষ বহুদূর চলে গেল নিজেদের গন্তব্যে। হয়ত আমজাদ সাহেব এসে বসলেন অন্তূর শিয়রে। অন্তূ চোখ মেলে দেখল না। হয়ত রাবেয়া সুদূর কুষ্টিয়ার এক কুঠুরির মেঝেতে জায়নামাজ বিছিয়ে বসে তাহাজ্জুদে কাঁদলেন অঝোরে, অন্তূর কানে পৌঁছাল না সেই সুর। অন্তূ আরামে শুয়ে রইল। তার শরীর থেকে সদ্য বিচ্ছিন্ন ভ্রুণটা কি চেয়ে দেখল তার অভাগিনী মাকে? একটু ব্যথা পেল ভ্রুণটা? পেল না। তিনমাস বয়স তার, সে সবে জয় আমিরের শৌর্য-রক্তপিণ্ড থেকে মায়ের রক্তের ভাগ পেয়ে সেজে উঠতে শুরু করেছিল। সে নিজেই বোধহয় অভিমান করেছে—তাকে পরিণত হতে বাঁধা দেয়ায়; মায়ের ওপর, বাপের ওপরে একটু বেশি।

রউফ কায়সারের একটি তিন বছরের ছেলে আছে ও স্ত্রীকে নিয়ে পরিবার তার। এটা একটা ভালো খবর হামজার জন্য। এরকম কিছু সে ভাবতে চায়নি, সে একজন সমাজসেবক। প্রথমে রউফকে ভালো অঙ্কের পয়সা দিয়ে ব্যাংক-ব্যালেন্সে উন্নতি করতে চেয়েছিল সে। কিন্তু রউফ নিজের অবস্থার উন্নতি চায় না। হামজার কিছু করার নেই।
কবীরকে কোনোভাবেই এর মাঝে ঘোড়াহাঁট যাবার সুযোগ দেয়া হবে না। সে কবীরকে বলবে সে অন্য ছেলেদেরকে সব ব্যবস্থা করিয়ে দিয়েছে, সে যেন শুধু জয়ের সাথে থাকে।

হামজা ঠিক করেছে আরমিণকে সে মারবে না। তুলে দেবে এমপির হাতে। জয়ের কাছে নিজেকে সাফ রাখার এর চেয়ে ভালো উপায় নেই। সে খুব দুঃখের সাথে জয়কে বলবে, ‘আমি আরমিণকে বাঁচাতে পারিনি। এবং সেটাও তোর জন্যই। তুই যদি সেদিন বউকে আমির নিবাসে না রেখে আসতি…এতদিন ও আমার সীমানায় ছিল, কেউ ওকে ছুঁতে পর্যন্ত পারেনি। আর তোর কী মনে হয়েছিল এমপির লোকেরা খোঁজ পাবে না তোর বউ কোথায়?ʼ
এতে আরেকটা চমৎকার কাজ হবে। সে এর মাধ্যমে এমপির কাছে নিজেকে নিয়ে সাময়িক একটা ভরসা তৈরি করবে। এবং এটাও বলবে, ‘সে ইলেকশন করবে না। সিনিয়র এমপি সাহেবই এই আসনের এমপি হবার একমাত্র যোগ্যব্যক্তি।ʼ

এমপি খুশি হয়ে হামজাকে বুকে জড়াবে। হামজা তারপর এমপিকে খুন করবে। এমনভাবে খুন করবে যেন সাধারণ মানুষ লাশ দেখার সাহস না পায়। টিভি চ্যানেল এবং নিউজপেপারে লাশের ছবি ঝাপসা করে ছাপতেও সংকোচ হবে। জয়কে মারতে চাওয়া মানুষকে খুব বেশিদিন বাঁচিয়ে রাখা হামজার পক্ষে সম্ভব না। এবং রউফ কায়সারের বাচ্চা ছেলেটাকে কয়টাদিন বড়ঘরে ঘুরতে আনা হবে।
বিকেলের দিকে দোলন সাহেব এলেন। সুস্থির, দায়সারা গোছের সুখী সুখী মানুষটা আজ একটু অস্থির বোধহয়। উড়ো খবর পেয়েছেন তিনি। হামজার বড়ঘরে কিছু ঘটেছে। তিনি ভাবটা এমন করলেন যেন তিনি হামজাকে দেখতে এসেছেন। এক ঝুরি ফল ও মিষ্টি এনেছেন। হামজা বৈঠক-কক্ষের সোফায় বসা। চোখে সাদা চশমা। হাতে মোটা একখানা দর্শন ও রাজনীতির বই। যেমন শরীর ও চেহারাখানা শৌর্যে ভরপুর, তেমন তার শোভন ভঙ্গিমা। গভীর মনোযোগ বইয়ে।

-“কেমন আছো, তুমি? শরীরের কী হাল হয়েছে?ʼʼ
হামজা বই বন্ধ করে হাসল, “আপনি ভালো আছেন? কী খবর? তুলি, নাশতা-পানি নিয়ে আয়।ʼʼ
-“ওসব লাগবে না। তোমাকে দেখতে এলাম। কী করেছ শরীরের?ʼʼ
-“ওদিকের কী হাল?ʼʼ
-“এদিকের হাল বলো। জয়ের এসব কী করে হলো?ʼʼ
-“জানি না, স্যার। শত্রুরা পাখা লাগিয়েছে পিঠে। পাখা কাটাকাটিতে দিন ব্যস্ত যাচ্ছে, তার ওপর দুজনেরই দেহ জখম।ʼʼ
দোলন সাহেব কথা বের করার জন্য নিজের উকালতির মার খাটালেন, “সব শত্রু তো বন্দি তোমার খাঁচায়, আবার নতুন জুটিয়েছ?ʼʼ
হামজা হাসল, “পাখিগুলো উড়িয়ে দিয়ে খাঁচা খালি করে ফেলেছি। এগুলো বাইরেরই।ʼʼ
দোলন সাহেব এক ধাক্কা খেলেন, আন্দাজ সত্যি তাঁর।অস্থিরতা এবার বাইরে বেরিয়ে আসার পর্যায়ে। তবু তিনি হাসলেন, “কাউকে বাঁচিয়ে রাখোনি? মানে সওয়াল-জওয়াবের জন্য আর আমাকে লাগবে না, সেই জনকেও উড়িয়ে দিয়েছ?ʼʼ

হামজা সম্মতিসূচক হাসল। দোলন সাহেব ঘেমে উঠলেন। মুরসালীনের মুখটা সামনে এসে বড্ড জ্বালাতন করছে। হাতের আঙুলের ডগা শিরশির করতে লাগল উনার। তিনি হাসপাতালে জয়কে দেখতে গিয়ে অন্তূকে ওখানে পাননি।
জোর করে হাসলেন, “সব কই? বাড়ি এত শ্মশান। ও আচ্ছা, জয়ের কাছে কে রয়েছে, ওর বউ নাকি?ʼʼ
হামজা বলল, “না।ʼʼ

ব্যাস এটুকুই। আর কিছু না বলে হামজা তুলিকে তাড়া দিলো নাশতা আনতে। দোলন সাহেব টের পেলেন হামজা ব্যাপারটা গিলে খাচ্ছে। উনার বুক ঢিপঢিপ করতে লাগল। বড্ড অবাক হলেন। মুরসালীনের নীতি ও মতাদর্শে তিনি কি একমত? না নাকি হ্যাঁ তাঁর জানা নেই। অন্তূকে তিনি স্বল্প পরিচিতা এক মেয়ের বয়সী মেয়ে হিসেবে চেনেন মাত্র। তাহলে এই দুটো সত্ত্বার জন্য উনার মতো দায়সারা মানুষের ভেতরে এ ধরণের উদ্বেগের কী কারণ!?
তুলি চা দেবার সময় কেমন করে একবার দোলন সাহেবের দিকে তাকাল। তিনি হামজার সামনে বসে চা পান করতে করতে পণ করলেন হামজার বিরুদ্ধে কেইসটা তিনি নিজে লড়বেন। রউফ কায়সারের উনাকে প্রয়োজন এখন, তিনি যাবেন রউফের কাছে।

রিমি গোসল-খাওয়া ছেড়ে দিয়েছে। বিছানার সাথে মিশে শুয়ে ছিল। রাত তখন বারোটা পার। কয়েক প্যাগ মদ পান করে রুমে যায় হামজা। ওষুধ খাওয়া হয়নি রাতের।
হামজা ডাকল, “রিমি! ওঠো, গোসল করোনি। খাওনি। আমাকে শাস্তি দিচ্ছ দাও, আমি নাহয় পাপ করেছি। তুমি করোনি। তাহলে নিজের ওপর এই অবহেলা কেন? ওঠো, বলো আর কী শাস্তি বাকি আছে আমাকে দেবার!ʼʼ
রিমি নড়লও না।
-“তুমি কি চাও আমি জবরদস্তি করি? মেজাজ ভালো থাকে না আজকাল। আর কত ধৈর্যের পরীক্ষা নেবে, যেখানে এখন তোমাকে আমার অনিবার্য প্রয়োজন।ʼʼ

রিমিকে ধরে পাশ ফিরিয়ে মুখটা দেখল হামজা, চেনা যাচ্ছে না। সেখানে আজ অভিমান নেই। পাথরের মতো নিষ্প্রাণ, আবেগহীন। উশকো-খুশকো চুল। ঠোঁটদুটো শুকনো। রিমির চোখের এই অভিমানহীনতা হামজাকে দিশেহারা করে তুলতে চাইল। তার কি একাধারে সবার কাছে ঘৃণিত হবার পর্যায় চলছে? হামজার ভেতরটা দমে এলো। সে তো খুব বেশি কিছু চাইছে না। সে শুধু তার আগের সেই পরিবার, ক্ষমতা আর তার পিছুটানহীন জয়কে চাইছে। এসব তো তারই। নিজের জিনিস হারিয়ে যাবার পথে থাকলে সেসব রক্ষা চেষ্টা করাটা কি অপরাধ? এরা বুঝছে না কেন?

রিমিকে বসিয়ে মুখটা আজলায় ধরল, “আমার দিকে তাকাও। কী করেছি আমি? যখন ঘেন্নাই করবে তো ভালোবেসেছিলে কেন? তখন আর এখনকার আমি তো একই, তাহলে তোমার অনুভূতি কেন দু’রকম হবে রিমি?ʼʼ
রিমি চোখ বেয়ে পানি পড়ল। মনে হলো কোনো পাথরের মাথায় পানি ঢালা হয়েছে, সেই নিথর পাথরের গা বেয়ে পানি চুইয়ে নিচে নেমে যাচ্ছে। তাতে পাথরের কোনো যায় আসে না।
অনেকক্ষণ পর রিমি শুধু জিজ্ঞেস করল, “কী করেছেন আপনি আরমিণের সাথে?ʼʼ
-“কী করেছি? কী করতে পারি আমি? কী বোঝাতে চাইছ?ʼʼ
-“কোনোকিছুই অসম্ভব নয়। তাই আন্দাজে সব ধরণের নোংরামিই রেখেছি, যাতে জানার পর অবাক না হতে হয়।ʼʼ
হামজা অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল রিমির দিকে।

-“আমি কী করেছি সেটা শুধু দেখবে, ও আমার সাথে কী কী করেছে তাতে যায় আসে না তোমার? আমাকে ফাঁসির দড়ির সামনে নিয়ে দাঁড় করিয়েছে। তুমি সেটাতে সম্মত, খুশি? আমি সব ছেড়েছুড়ে কয়েদী হিসেবে পৌঁছে যাই আইনের দণ্ডের সামনে? চাও সেটাই?ʼʼ
-“আমি আজ কিছুই চাই না। তবু একটা কিছু চাই আপনার কাছে, যা শুধু আপনিই দিতে পারেন।ʼʼ
হামজার চোখ লাল হয়ে উঠল। রিমির শরীর ধরে থাকা হাত দানবের মতো কঠোর হলো, “মুখে উচ্চারণ কোরো না। সহ্য করতে পারব না, উল্টাপাল্টা কিছু করে বসব। আরও ব্যথা পাবে।ʼʼ
রিমি তাতে আরও দ্বিগুন উৎসাহ পেয়ে বলল, “আমাকে তালাক দিন। আপনার উল্টাপাল্টা কিছু করা হিসেবেও আমি আমার মুক্তিই চাই।ʼʼ

হামজার যেন অবাক হবার কাল চলছে। রিমির স্বর বলে মনে হলো না এটা। চোখ বুজে ভারী শ্বাস ফেলে নিজেকে সামলে হামজা রিমির শাড়ি খুলল। শাড়ি খোলার সময় নগ্ন পেটে বেশ কয়েকটা চুমু খেলো। কোমড়টা জড়িয়ে ধরে রিমির হাঁটুর কাছে বসল।
-“সত্যি বলবে, তুমি চাও আমি আইনের কাছে নিজেকে সমর্পন করি?ʼʼ
-“এটা ঠিক করার আমি কে? আমার সাথে আর কী এমন করেছেন আপনি? অন্যায় যাদের সাথে হয়েছে তারা ঠিক করবে আপনার কী হবে।ʼʼ
হামজা সহ্য করতে পারল না। ডানহাত এগিয়ে ল্যাম্পটা তুলে দাঁত আটকে এক আঁছাড় মারল। এত শক্তি প্রয়োগের ফলে ক্ষতগুলো জেগে উঠল যেন। জোরে জোরে শ্বাস ফেলল হামজা। রিমি নির্লিপ্ত বসে রইল নিরুদ্দেশ দৃষ্টি মেলে।
-“তোমাকে কীভাবে বোঝালে বুঝবে আমার তোমাকে প্রয়োজন, হ্যাঁহ্? মানসিক, শারীরিক এবং সার্বক্ষণিক সঙ্গী হিসেবে তোমাকে প্রয়োজন আমার। এই কঠিন সময়টায় এমন করছো কেন আমার সঙ্গে?ʼʼ
-“প্রয়োজন ব্যাপারটা কঠিন কিছু নয়, মেয়র সাহেব। বিকল্প দিয়ে দিব্যি মিটিয়ে নেয়া যায়।ʼʼ
-“চ্যাহ্! আমার রিমি, এমন সব কথা কে শিখিয়েছে তোমাকে? তোমার মনেহয় না এবার তুমি বাড়াবাড়ি করছো?ʼʼ

-“কী জানি! কেন আগে করতে পারিনি এই বাড়াবাড়ি?ʼʼ
রিমি তো! কতক্ষণ? তার মুখ নির্লিপ্ত থাকে, কিন্তু চোখের ওপর রিমির নিয়ন্ত্রণ নেই। ঝুপঝুপ করে আষাঢ়ে বৃষ্টির মতো ঝরে পড়ল নোনাজল। গলা ধরে এলো।
দাঁত কিড়মিড় করল হামজা, “এই এই এই, তোমরা মেরে ফেলবে আমায়? হ্যাঁহ্? সবাই মিলে পরিকল্পনা করে পেছনে লেগেছ? সব হারানোর পথে আমি। এত দিনে তিলে তিলে কামানো একেকটা খুঁটি আমার নড়বড়ে হয়ে উঠেছে।ʼʼ
রিমির হাতটা টেনে নিজের বুকে রাখে হামজা, “দেখো তো! টের পাও এখানকার অশান্তি?ʼʼ
-“বাহ্ রে! আপনার ভেতরে হৃদপিণ্ডও আছে নাকি? ওটার কাজ তো রক্তপাম্প করা। তার মানে আপনার শরীরে রক্তও আছে? রঙটা কী? মানুষের মতোই লাল?ʼʼ
হামজা হাসল, “পশুর রক্তও লালই হয়, রিমি। এত কথা আর এরকম কথা কবে শিখলে? কে শিখিয়েছে?ʼʼ
-“আপনার আন্দাজ সঠিক।ʼʼ
হামজা মাথা নাড়ে, “হু! এত ক্ষতি করল সে আমার!ʼʼ

রিমির বুক জ্বলে উঠল অজানা এক ঘেন্নার ব্যথায়। আচ্ছা এই লোক আরমিণকে ভয় পায়, সেই আরমিণকে কি নোংরাভাবে ছুঁয়ে এসেছে? রিমির পেট গুলিয়ে গলা অবধি এলো। হতেই পারে। অসম্ভব না।
যন্ত্রের মতো সে হাত বাড়িয়ে হামজার হাতটা নিজের খোলা পেট থেকে সরিয়ে দিতে চায় ঠেলে, যেন ছুটে এসে এক দলা ময়লা শরীরে লেগেছে। হামজা শক্ত করে হাত, হাতগুলো রিমির শরীরে গেঁথে দিতে পারলে হতো।
রিমি আবদার করে, “আপনি তালাক দিন আমায়। না না, আমি ছেড়ে যাব না কোথাও। রক্ষিতা হয়ে থাকব আপনার। ওটার ভার কম। রক্ষিতার আবার ধর্মজ্ঞান কী? মালিক যেমনই হোক দায় তার নয়। কিন্তু আপনার মতো পুরুষের স্ত্রীর পরিচয় খুব জঘন্য আর ভারী।ʼʼ
হামজা কীভাবে সহ্য করল কে জানে। শুধু বলল, “তোমার এসব কথা আরমিণের জন্য বিপজ্জনক হবে, রিমি। সত্যি বলছি। আমি তোমায় কিচ্ছু বলব না। এর প্রতিটা জবাব আরমিণ দেবে। তাই চাও?ʼʼ
রিমির শরীর শিউরে উঠল। এক লহমায় কঠিন, নির্বিকার মুখে নিদারুণ অসহায়ত্ব ও করুণা দেখা দিলো। হামজা খুশি হলো।

-“সে বেঁচে আছে?ʼʼ
হামজা মোটা একখানা সিগার ধরায়। পাঁজা পাঁজা ধোয়া তার, রিমির খোলা দেহ স্নান করে উঠল তাতে। হামজা সিগার ঠোঁটে চেপে রিমির ব্লাউজ খোলে। রিমি চোখ বুজে যেন মৃত্যুর অপেক্ষা করে। কিন্তু যখন অন্তর্বাস খুলতে যাবে, রিমি হামজার বাহুর দগদগে ঘা’তে নখের আচড় মেরে আর্তনাদ করে ওঠে—
-“ছুঁবেন না। ছুঁবেন না। মরে যাব আমি। আমার ঘেন্না লাগছে। প্লিজ, মেরে ফেলুন। এত লাঞ্ছিত হয়ে বেঁচে থাকতে নেই নারীর।ʼʼ

হামজা সিগারের মোটা জলন্ত প্রান্তটি রিমির বুকের বিভাজনের মাঝে চেপে ধরে কানের কাছে ফিসফিস করে বলল, “এই কথাটাও আরমিণ বলেছে। আরেকটা প্রাপ্তি বাড়ালে তুমি ওর।ʼʼ
রিমি কেঁদে উঠল চাপা শব্দে। তখনও জায়গাটি পুড়ছে চিরচির করে। রিমির কান্নার আওয়াজ থামাল হামজা—ঠোঁট চেপে ধরল, কামড়াল মূলত, ক্ষোভ ঝারা বললে সঠিক হয়। সাথে সিগারটা কোথাও ছুঁড়ে ফেলল। এরপর ঠোঁট ছেড়ে বুকের পোড়া ক্ষততে গাঢ় চুমু খেয়ে বলল—
“আমার বিরোধিতা করলে তোমার ভেতরটাও এভাবে পোড়াবো। তুমি জানো রিমি, পেট্রোলিয়ামকে কাছ থেকে পোড়াতে নেই। পোড়ানোর ইচ্ছে থাকলে দূর থেকে আগুন ছুঁড়তে হয়। এত কাছে এসে আমায় পোড়াবে, তুমি পুড়বে না, তা হতে নেই। আমার তো ধর্মই পোড়া, কিন্তু তোমার অদৃষ্ট। এখন আমায় খুশি করো, আই ওন্ট সাজেস্ট মোর।ʼʼ

অন্তূর সম্পূর্ণ চেতনা ফিরল দু’দিন পর। তখন তরতর করে রক্ত ছুটছে শরীর থেকে। নাকে এসে ঠেকে বিশ্রী দুর্গন্ধ। দুজন নার্সকে পেল অন্তূ চোখ খুলে। শরীরে অসহনীয় ব্যথা। তার অচেতন থাকা জরুরী, কিন্তু শরীর জেগে উঠেছে, কারণ অন্তূদেরকে ব্যথাহীন থাকতে নেই।
অন্তূর কিছুটা সময় লাগল মনে পড়তে যে তার কী হয়েছে। তারপর মনে হলো নার্স কেন এসেছে আবার? তার বাচ্চা তো পড়ে গেছে, এদের আর কী কাজ? আরও কিছু কি আছে অন্তূর কাছ থেকে ছিনিয়ে নেবার মতো? নাহ্ অসম্ভব। আর কিচ্ছু নেই। এই জগতে তার হারানোর মতো শেষ সম্পত্তিটুকুও অন্তূ বিসর্জন দেবার মাধ্যমে সে হলো সর্বোচ্চ শক্তিশালী ও দূর্বলতাহীন মানুষ।

নার্সরা কাছে আসতেই একটা ভাঙা মাটির ফুলদানি ছুঁড়ে মারল অন্তূ, “আমার কাছে আসবেন না। আপনাদের ভালোর জন্য বলছি। চলে যান, চলে যান। কী চাই আমার কাছে? প্রাণ নেবেন? না, এখন মরব না আমি। জয় আমিরের সাথে দেখা করা দরকার আমার। সে কোথায়? আসেনি? সে কি বেঁচে আছে? মরলে তার নিস্তার নেই। হাশরে একদম চেপে ধরব। কী পেয়েছে আমাকে? যা ইচ্ছে তাই না?ʼʼ
অন্তূর মনে পড়ল সে এখন আমির নিবাসে। এখানেই তার সাথে একটা চমৎকার ব্যাপার ঘটে গেছে। কিন্তু ভেতরের এই ব্যথাটা সহ্য করা যাচ্ছে না। নার্সদেরকে আগেই বিদায় করা যাবে না। একটা উপকার নার্সরা তার করতে পারে।

-“ঘুমের ওষুধ আছে? আছে, আছে? থাকলে দিন। তাহলে চিকিৎসা করতে দেব। সত্যি দেব। এনেছেন সাথে? আমি ঘুমাবো। ততক্ষণে যেন জয় আমির চলে আসে কেমন?ʼʼ
অন্তূর পরিকল্পনা হলো ভুলিয়ে-ভালিয়ে ওষুধ নিয়ে তারপর কাছে আসলে আক্রমণ করে তাড়িয়ে দেয়া। তার তো চিকিৎসার দরকার নেই। সে কিছুক্ষণ উন্মাদের মতোন দলা পাকানো ভ্রুণের দিকে তাকিয়ে থাকল। জোরে হাসল কয়েকবার। তার খুবই আনন্দ লাগছে। অবশেষে সে পুরোপুরি নিঃস্ব হতে পেরেছে। এটাই তো উচিত। যার কাছে প্রায় কিছুই নেই, তার সামান্য কিছুও থাকা উচিত নয়। থাকবে না মানে কিছুই থাকবে না। কিন্তু সে তারপরেই যে স্বরে কেঁদে ফেলল চেহারা ভেঙে, তা সহ্য করা দায়। সেই কান্নার সুর ও মুখের কাঁকুতি অপার্থিব লাগে কেমন!
জননদ্বার মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্থ, হাত কাঁপে, চোখ জাপসা হয় দেখলে। কী বিভৎস! নার্সদের নারীমন অস্থির হয়। জোরপূর্বক ধরে ড্রেসিং করা হলো। গলগল করে রক্ত আসছে। এই মুহুর্তে ভালো চিকিৎসার দরকার। কীভাবে বেঁচে থাকবে এই মেয়ে, আছেই বা কী করে, কী সহ্য করে এমন নির্লিপ্ত উন্মাদের মতো আচরণ করছে মেয়েটা? এত সুন্দর দেখতে, তার কণ্ঠস্বর কী মধুর লাগে শুনতে, তার সঙ্গে এসব কী ঘটছে?

নার্স দুজন একটা রিস্কি কাজ করেছে। অন্তূর জন্য স্বাস্থ্যপযোগী খাবার তৈরি করে এনেছে। কিছু প্রয়োজনীয় ওষুধ নিজেরা কিনে এনেছে। হামজা তাদেরকে পাঠিয়েছে কেবল বাঁচিয়ে রাখার জন্য। অন্তূকে ধরে জোর করে সামান্য খাবার খাওয়ার পর গলগল করে বমি করে ফেলল। বমির সাথে পিত্তি উঠে এলো, আঠালো মিউকাস এলো। বমির চাপে নিম্নদেশে টান পড়ায় কেমন অমানুষিক আর্তনাদ করে অন্তূ। শোনা যায় না সেসব। বুকের মাঝখানটায় আঙুল চেপে ধরে পাগলের মতো শ্বাস ফেলে, কয়েকটা ঘুষিও মারল বুকের ওপর। বোধহয় হুমকি দিলো, আর ব্যথা পাবি না। খবরদার। আমার সহ্য ক্ষমতার অনেক উপর দিয়ে যাচ্ছে তোর তাণ্ডব।

আবারও ধরে কিছুটা গরম দুধ, ও স্যুপ খাইয়ে ওষুধ খাওয়ানো হলো। সেফট্রিয়াক্সোন, ডাইক্লোফেনাক, এবং অবশেষে ক্লোজিপাম দেয়া হলো। অন্তূ হামাগুড়ির মতো এগিয়ে গিয়ে তার বাচ্চার সামনে বসে। থুতনি ভেঙে হু হু করে কেঁদে ওঠে। এত অবহেলিত? কেমন ধুলোয় জড়ানো মেঝেতে পড়ে আছে, যে মেঝে তার অধিকার। অন্তূ চাতকের মতোন হাত বাড়ায়, অথচ সাহস হয় না ছোঁয়ার। থরথর করে কাঁপছে হাত। সে পেছায় কয়েক কদম। সে শুনতে পায় তাকে ডাকছে।
‘মা’ম্মা’ মা’ মা’ ‘আম্মা’…অন্তূর বুকের ওঠানামা অনিয়ন্ত্রিত হারে বাড়ল। নার্স দটো ভয় পেয়ে দ্রুত প্রেশার মাপে অন্তূর। দমদম করে বাড়ছে তা। হৃদস্পন্দন অস্বাভাবিক।
তাকে সরিয়ে আনার চেষ্টা করা হলো, ভ্রুণে হাত দিতে গেলে ক্ষুব্ধ বাঘিনীর মতো আক্রমণ করে উঠল অন্তূ, “খবরদার ছুঁলে জান নিয়ে নেব। ওর বাপ এখনও দেখেনি ওকে, ছোঁয়নি ওকে। না না না, খবরদার না। আমাকে ডাকছে ও। ওর কাছে যাওয়া আমার দরকার। আমাকে কবে মারা হবে?ʼʼ
খানিক পর অন্তূ নিস্তেজ মতো কাত হয়ে শুয়ে পড়ল। একদৃষ্টে তাকিয়ে রইল রক্তপিণ্ডের দিকে। চোখের পানি মেঝের ধুলোয় মিশে কাদা হয়ে উঠল। অন্তূ নির্বিকার। চোখে দৃষ্টি নেই, কোথাও হারিয়ে যাচ্ছে। অন্তূ দেখতেই থাকে তার নাড়িছেঁড়া ধনকে। লাল টকটকে, থকথকে এক দলা।

গুলি খাওয়ার পাঁচদিন পর ছয়দিনের রাতে মনে হলো তার পিঠ বোধহয় অর্ধেক ক্ষয় হয়ে গেছে, কারণ বিগত কয়েক বছর যাবৎ সে শুয়ে আছে এই বেডে। এখন তার ওঠা দরকার। সে উঠতে গেলে নার্স তাড়া দিলো,
-“না না, উঠবেন না। শুয়ে থাকতে হবে আপনাকে। প্লিজ উঠবেন না।ʼʼ
-“সর শালি। দূরে যা, হাওয়া আসতে দে। কইবরা! তোল আমারে। সুস্থ-সবল মাইনষেরে পঙ্গু বানাইতে সমিতি খুলে রাখছে এইখানে। তোল।ʼʼ
কবীর ওকে তুলে হেলান দিয়ে বসালো।
-“সিগারেট দে।ʼʼ

ছেলেদের খুশি কে দেখে? বাইরে পুলিশ বসা, সেটা বড় কথা নয়। ওরা থেকে থেকে ‘জয় বাংলা’ স্লোগান দিচ্ছে। পাশের ওয়ার্ড ও কক্ষের রোগীর লোকজন ভয়ে ভয়ে এসে নিশ্চিত হয়ে যাচ্ছে তারা রাস্তা ভুল করে হাসপাতাল ভেবে কোনো রাজনৈতিক সম্মেলন অফিসে ঢুকে পড়েছে কিনা।
জয়ের সিগারেট জ্বালিয়ে দেয়া হলো। একহাত আর্ম স্লিংয়ে ঝুলছে, সে বসে যে উরুতে গুলি লেগেছে, সেই পা দুলাচ্ছে আর সিগারেট টানছে। এটা মূলত একটা এক্সপেরিমেন্ট। প্রথমত পা দুলানোর ফলে পায়ে ব্যথা সয়ে যাবে, দ্বিতীয়ত বোঝা যাবে কতটা ব্যথা এখনও রয়েছে, চলাফেলা কতটুকু করা যাবে।

ছয়দিনে মানুষ কথা বলতে পারে না ঠিকমতো। চারদিন আগেও লোকটা রক্তশূণ্যতায় কোমায় যাবার পথে। নার্স রাগে গজগজ করতে করতে ডাক্তার ডাকতে গেল। কবীর জয়কে ভুলেও খুশির সংবাদটা দিলো না। এই মুহুর্তে পাগলা ঘোড়ার মতো ছুটবে। সে নিজেও যায় না, সে যথেষ্ট পরিমাণ খাবার, আলোর ব্যবস্থা করে দিয়ে এসেছে।
সে শুধু সংকটপূর্ণ পরিস্থিতিটা বলল জয়কে। জয় সুস্থ হলে সে একবারে নিয়ে যাবে ওখানে জয়কে। জয় দুজন পুলিশকে ডেকে নিয়ে দাঁত বের করে হেসে সালাম দিলো। ব্যথায় শরীর ভেঙে আসার জো, এসব তার জন্য নতুন না। বাড়িতে থাকলে এতক্ষণ কয়েকটা মরফিন বা হিরোইন গিলে একচোট ঘুম দিলে ব্যথা গায়েব।
সিনিয়র নার্সকে ডেকে নিয়ে বলল, “দু-চারটে মাল-মশলা দেন। এসব ব্যতা-বেদনা এক যুগ ধরে শুয়ে থেকে মোকাবেলা করার অভ্যাস আমার নাই। আসলে আমি ক্রিমিনাল তো। দ্রুত সুস্থ হয়ে আইনের হাতে নিজেকে সোপর্দ করতে হবে। ঠিক না, দুলাভাই? একশটিরিমলি সরি—স্যার।ʼʼ

নার্স বলল, “ওগুলো নিষিদ্ধ, অবৈধ। এ অবস্থায় আমরা আপনাকে ওগুলো সেবন করতে দিতে পারি না। আপনার চিকিৎসা চলছে, খুব শীঘ্রই রিকোভার করবেন বলে আশা করা যায়! ওসবের প্রয়োজন হবে না।ʼʼ
-“কী কয় শালীর মেয়ে? নীতিকথা আমার শরীরের চারপাশে দুই কিলোমিটার পর্যন্ত জায়গার মধ্যে আসে না, কারণ নীতিকথা হলো জীবাণু, আর আমি ডেটল সাবান গিয়ে গোসল করি। কবীর, সিস্টারকে একটু সাঁতার শিখিয়ে আন তো।ʼʼ
পুলিশ দুজনকে পাশে বসিয়ে হেসে বলল, “আপনারা কি দিনাজপুরের স্থানীয়?ʼʼ

-“হু।ʼʼ
-“আগে দেখিনি। নতুন বদলী হয়েছেন নাকি?ʼʼ
-“হ্যাঁ, মাসখানেকের মতো।ʼʼ
-“শালা সরকারী চাকরি খুব খারাপ। কিন্তু আপনারা ভাগ্যবান পুরুষ। নিজের জেলায় বদলি হওয়া কম কথা না। আমাদের এরিয়াতেই নাকি?ʼʼ
সে হাসতে হাসতে চা-নাশতা করিয়ে পুলিশদের জন্ম-মৃত্যুর তথ্য এক কোরে ফেলল। কবীর কাগজে মুড়ে বেশ কিছুটা হিরোইন গুড়ো ও কয়েকটা মরফিন ক্যাপসুল নিয়ে এসেছিল। তাপ দেবার ব্যবস্থা নেই সুতরাং ধোঁয়া হিসেবে ব্যবহার করা গেল না, এছাড়া এখন নেশা করা নয়, ব্যথা কমানো জরুরী। পানিতে মিশিয়ে ইঞ্জেক্ট করল, কিছুটা নাকে টেনে নিলো, এরপর মরফিন ক্যাপসুল জিহ্বার নিচে নিয়ে শুয়ে রইল। এবার নিশ্চিন্ত লাগছে। সাধারণ ওষুধে তার পোষায় না।

মাঝে চারটা দিন হামজার শরীর আচমকাই যেন একেবারে শিথিল হয়ে উঠেছিল। দুটো ডাক্তার তার পেছনে চারটাদিন খুব খেটেছে। এর ফলে তার যে সমস্যা হলো, সে জয়কে দেখতে যেতে পারেনি, আর আরমিণের কোনো ব্যবস্থা করা যায়নি। এর মাঝে থানা থেকে বেশ কয়েকবার লোক এসেছে তার সঙ্গে দেখা করবার জন্য। এখনও যেটুকু ক্ষমতা বাকি আছে তা দিয়ে ভাগানো হয়েছে।

এর মাঝে সে একটা সিদ্ধান্ত পাল্টেছে। সে আরমিণকে দেবে না এমপির কাছে। আরমিণের করা ক্ষতির পরিমাণ অনেক। সুতরাং শাস্তি পুরো হয়নি। এত দ্রুত ওরকম পর্যায়ের ভয়াবহ মহিলাকে ছেড়ে দিলে হামজার ইমেজ নষ্ট হবে। সে আরমিণকে বহুদিন ধরে নিজের কাছে বন্দিনী করে রাখবে, রোজ খুন করবে একটু কোরে। এই দুনিয়া সে খবর জানবে না। জয়কে হাসপাতালে থাকতে হবে এখনও বেশ কিছুদিন। ততদিনে সে সব ব্যবস্থা করবে।
পরদিন সে প্রথমত এমপিকে কল করে বলল, ‘মামা, আসছি আমি। কিছু ভুল বোঝাবুঝি হয়েছে। তার ওপর জয়ের এই অবস্থা, আবার যতকিছু ঘটল। একটা আলোচনা দরকার। জয়ের বউ যা করেছে, তা আমি মেনেই নিতে পারছি না। আপনি ভালো মানুষ জন্য ধৈর্য ধরছেন। সেই মেয়েলোকের সাথে কী করা হবে তারই আলোচনা করব আজ।ʼ
এমপি যে কী খুশি হলেন! নিজের প্রাইভেট সময়েই ডেকে নিলেন হামজাকে। সে গেল রাত একটায়। এমপি তখন নিজের বিনোদন ফ্ল্যাটে বিনোদনে রাত কাটাতে যান। নতুন নতুন দুটো মেয়ে থাকে সেবা দেবার জন্য আর মদের যথেষ্ট পরিমাণ মদের বোতল। স্বর্গীয় অনুভূতি!

হামজা মেয়েদুটোকে বলল, ‘তোমরা একটু রুমে যাও।ʼ ওরা এমপিকে ড্রয়িং রুমে রেখে রুমে গেল। হামজা গিয়ে বাইরে থেকে রুমের দরজা আঁটকে দিয়ে এলো। বিষয়টা বোঝার খুব একটা সময় এমপি পেলেন না। হামজা সময় নষ্ট করল না। সেটা ঝুঁকিপূর্ণ। একজন এমপির ব্যাপার-স্যাপার।
সে এমপিকে এসিড পান করালো। সালফিউরিক এসিড। বড়ঘরে লোহা ইলেক্ট্রোপ্লেটিংয়ের কাজে ব্যবহৃত হয় এ পদার্থ। এমপি সাহেবের ঠোঁটে কিছুটা ঢেলে পড়ার সাথে সাথে ঠোঁটদুটো ফুরিয়ে গেল। মাংসের দলা হয়ে পরে আবার সেটুকুও ক্ষয় হয়ে গেল। ঠোঁট ও মুখে মাংস নেই, হাড় বেরিয়ে গেল, তখনও এমপি হামজার পা দুটো জড়িয়ে ধরে আছেন। মুখ নেই জন্য আর্তনাদ করে প্রাণভিক্ষা চাওয়ার সুযোগ নেই।

হামজা তাকে বলল, “মামা আমি আপনার মুখটা ঝলসালাম একটাই কারণে—এই মুখ দিয়েই আপনি জয়কে গুলি করার অর্ডার দিয়েছিলেন। একটাবার তো ভাবতেন জয়ের পেছনে হামজা দাঁড়িয়ে আছে। জয় তো একা না, মামা। ওর গায়ের রক্ত ঝরানো মানে আমার বুকে লাত্থি মারা। তাই আমি আপনার পা দুটোও কেটে নেব।ʼʼ
হামজা কেটে নিলো। অবশ্য আটকে রইল হাড়ের সাথে। তাতে সে এসিড ঢালল। ধোঁয়া উঠে গলে এড়িয়ে গেল শরীরের অঙ্গ। শেষে একটা ছোরা শুধু কণ্ঠনালির মাঝ বরাবর গেঁথে দিলো। অর্ধেকটার মতো এসিড তখনও বাকি। এটুকু ফিরিয়ে নিয়ে যাবার মানে নেই। এমপির পুরো শরীরে ফুল ছিটানোর মতো কোরে ছিটিয়ে ঢেলে দিলো সেটুকু। ব্যাস, একটা সুন্দর এমপি কাবাব তৈরি হয়ে গেল। মাংস ঝলসানোর বিশ্রী গন্ধে রুমটা ভরে উঠল।
কিন্তু হামজা কোনোকিছু হাতে ধরে রাখতে চাইলে তাকে এখন অতিরিক্ত জোর প্রয়োগ করতে হয়, স্বাভাবিক শক্তিতে হাত শিথিল, বস্তু থাকে না। এসিডের রেজিস্ট্যান্ট গ্লাস বোতলটি পড়ে গিয়ে চুরমার হয়ে গেল। তা তোলা হামজার পক্ষে সম্ভব নয়। তার হাত কাঁপে, স্নায়ু নিয়ন্ত্রণহীন প্রায়।

মেয়ে দুটোকে সে সঙ্গে নিয়ে এলো, বলল, ‘তার কাছে থাকলে প্রতি রাতের জন্য লাখ টাকা পেতে পারে তারা। কারণ সে নারীকে খুবই সম্মান করে। কমদামে সে কিনবে না তাদের।ʼ
তবে এটা মিথ্যা কথা। হামজা ওদেরকে বড়ঘরে চুল্লির জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার করবে। কোনোরকম ঝুঁকি রাখা যাবে না। একমাত্র সাক্ষী ওরা। বাকি প্রমাণ সে নষ্ট করে এসেছে যথাসাধ্য।

এ ঘটনার পরদিন যখন গোটা অঞ্চল তোলপাড় এমপির এমন মৃত্যুতে, হামজা তখন এমপির বাড়ির সোফায় মুখটা শুকনো করে বসে বিলাপ করছে। রাত দশটা বাজে। লাশ দেখার মতো অবস্থায় নেই।
জয় খবর শুনে হাসল সামান্য। বড়সাহেব ভয়াবহ কাজটা করে ফেলেছে। ব্যাপার না, সে এখান থেকে সটকে পড়ে একেবারে সামনে গিয়েই দাঁড়াবে। অনেকগুলো দিন হামজার ডাক শোনা হয়নি। সে পুলিশ দূটোকে ডেকে বলল, “আপনারা এখন মোট কয়জন আছেন?ʼʼ
-“ছয়জন। আর আশপাশে কিছু মোতায়েন আছে অবশ্যই। কেন জিজ্ঞেস করছো?ʼʼ
-“বসুন। আরামে আলাপ করি।ʼʼ
সে তাদেরকে বলল, “আপনাদের কাছ থেকে গত পরশু আমি আপনাদের ঠিকানা-পরিচয় জানলাম না? তারপর আমার ছেলেরা খোঁজ করে আপনাদের বাড়িতে পৌঁছে গেছে। কী বিচ্ছু ভাবুন। আসলে ওরা গেছে আপনাদের বাড়ির অবস্থা দেখতে। যদি ধরুন কোনো কমতি বা অভাব থাকে সেটা আপনারা চাইলে পূরণ করে দেয়া হবে মামা দিয়ে। ওহ্ মামা মানে হলো টাকা। আমার ভাষা এটা।ʼʼ

পুলিশেরা অবাক। টাকা মানে মামা? কিন্তু তারা জানে না জয়ের এরকম আরও কিছু নিজস্ব ভাষা রয়েছে। থানা হলো শ্বশুরবাড়ি। কর্মকর্তারা তার শালা-সম্বন্ধি, কেউ দুলাভাইও। তার ভাষায় স্যান্ডেল হলো চশমা। মেয়েদের কামিজ হলো পাঞ্জাবী। এরকম বহুতকিছু।
সে বলল, “আর যদি ধরেন এটাতে রাজী না হন, তাহলে আপনাদের বাড়ির জনসংখ্যা কমানোর ফলে বাংলাদেশের পরবর্তী আদমশুমারিতে একটা অবদান রাখা হবে। আর যদি না চান বাংলাদেশের এই উপকার করতে, তাহলে আমি আজ রাতে কাল্টি খাব এখান থেকে, আপনারা পেছনে থাকবেন। চাইলে বাকিদের সাথে আলাপ করে নিতে পারেন।ʼʼ

শরীর তার অনুভূতিহীন প্রায়, খোঁচা মারলেও ব্যথা লাগছে না, চোখের পাতা তখনও কিছু ভারী। শরীরে দুটো দিন ভালো পরিমাণ ড্রাগ গেছে। রাত একটা বাজল। উঠে লুঙ্গি পাল্টে নিলো। গলার চেইন, হাতের রিস্টলেট, বালা, ঘড়ি, ব্ল্যাক টাংস্টেনের কালো আংটিখানা—সব খুলে নেয়া হয়েছিল, সেসব পরল।
তার নাকি পায়ে প্রচণ্ড ব্যথা উঠল, টাকা খাওয়া দুটো নার্স ও ওয়ার্ডবয় এসে তাড়াহুড়ো লাগিয়ে দিলো এখনই একবার ব্যান্ডেজ খুলে দেখতে হবে, এক্সরে করতে হবে। হাসপাতালের সরকারী এক্স-রে নিম্নমানের। বাইরের ডায়াগনস্টিক সেন্টারে নিতে হবে উন্নতমানের এক্স-রে করাতে। জয় সেই পুলিশদুটোকে সঙ্গে নিলো। তারা পাহারা দেবে যাতে জয় ভেগে না যেতে পারে। বাকিরা তখন ক্লান্তিতে ঝিমিয়ে। যে লোক ব্যথায় আধমরা, এক্স-রে করতে যাচ্ছে, হাটার ক্ষমতা নেই সে কোথায় পালাবে? পালানোর উপায়ও নেই, চিকিৎসাও দরকার। তাছাড়া
রাত আসে ঘুমানোর জন্য, জয়ের মতো ক্রিমিনালকে পাহারা দিতে হবে তা ঘুম বোঝে না।
ডায়াগনস্টিক সেন্টারের পেছনে জিপ অপেক্ষা করছিল, ছিনতাই করা জিপ। পুলিশদুটো জয়কে তুলে দিলো জিপে। জয় ছেলেদেরকে বলল, “পরিবারগুলোকে ছেড়ে দে, ওদের দুটোর জন্য ভালো একজন গোরখোদক দেখে কবর খুড়িস।ʼʼ

কবীর অবাক হয়ে ডাকে, “ভাই!ʼʼ
জয় অন্তূর সেই রক্তমাখা ওড়নাটা মুখ পেচাতে পেচাতে বলল, “ওরা দেশের শত্রু, কবীর। আমার টাকা আছে বলে আমার মতো ক্রিমিনাল পার পেয়ে যাবে, আরেকজনের না থাকলে সে মারা খাবে, এটা তো হলো না! তাছাড়া আমার কাছে ওদের স্যাটা ভরানোর মতোন এখন টাকা নাই। তো কী হলো? বেইমান কমলো দুটো আর আমার টাকাও অপচয় হলো না। অপচয়কারী শয়তানের ভাই কবীর। শয়তান আমার সম্বন্ধি।ʼʼ
কবীরের পিঠ চাপড়ে বলল, “যেখানেই থাকিস, সাবধানে থাকিস, চট্রগ্রামের পাহাড়ে-টাহারে ঘুরে আয় কিছু দিন। আবার দেখা হবে। জয় বাংলা।ʼʼ
কবীর জয়ের হাতে চাবি ধরিয়ে দিয়ে কেমন আপ্লুত কণ্ঠে বলে, “জয় বাংলা, ভাই! আপনার সুখের দিন সামনে। সত্যি বলতেছি। যান না যান, আমার কথা মিলিয়ে নিয়েন। এখন কিছু বলব না। ভাবীরে আমার সালাম জানাইয়েন।

কবীর আস্তে কোরে ছেড়ে দেয় জয়ের হাতটা। যতক্ষণ জয়ের জিপখানা দেখা গেল, কবীর দাঁড়িয়ে রইল। তার চিন্তা হলো জয় এখনও খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটছে, একহাত আর্ম স্লিংয়ে বাঁধানো। এই সময় তাকে জয়ের প্রয়োজন, কিন্তু জয় কবীরের জীবন ঝুঁকিতে ফেলবে না। তাদেরকে এখন যার যার মতো লুকাতে হবে কিছুদিন।
রাত শেষের দিকে। জয়ের বুক কাঁপে বাড়ির সীমানায় পা রেখে। অন্তূ বাচ্চাদের ব্যাপারে প্রশ্ন করলে কী জবাব দেবে সে? কিন্তু অনুশোচনা মুখে রাখলে তো তার চলে না! সে গলা ফেঁড়ে ডাকতে ডাকতে তালা খুলল, “আরমেইণ! আরমেইণ!ʼʼ
অন্তূ তড়িঘড়ি উঠে বসে। এসেছে জয় আমির সত্যিই? এই নয়দিনে সে অসংখ্যবার আব্বু ও জয় আমিরের ডাক শুনেছে, দেখেছে পালাক্রমে দুজন এসে তার শিয়রে বসে, সেসব ছিল ধোঁকা। কিন্তু এবার শব্দ করে খুলে গেল শাল কাঠের কপাটদুটো।

পুরো হলরুমে সাতটা মোমবাতি জ্বলছে। হলদে আলো। আরমিণ পড়ে আছে মেঝের ওপর। পরনে একাখান ওড়না মাত্র। সারা মেঝেতে রক্ত, অন্তূ শুয়ে আছে শুকনো রক্তের ওপর। জয়ের হাত ও হাঁটু জুড়ে শিরশির করে একটা কাঁপুনি নিচে নেমে গেল। তারপর বুক থরথর করে উঠে নিঃশ্বাসের গতি বাড়ল, একসময় তা প্রচণ্ড হলে আটকে এলো। কেবল অস্ফূট স্বরে ডাকে সে, “আরমেণ!ʼʼ
-“জয় আমির! জয়?ʼʼ

ঢোক গিলতে পারলেও জয় পা চালাতে পারে না। ওটা কী পড়ে আছে আরমিণের পায়ের দিকে? জয়ের মাথাটা চিড়ে উঠল, ওটা কি করাত? জয়ের মস্তিষ্ককে দুইভাগ করে ফেলল চিড়ে? বুকের ভেতরে কী হচ্ছে? ওটা কী পড়ে আছে? এই রক্ত কীসের? আরমিণের কী হয়েছে?
জয় থরথর করে কাঁপা খোঁড়া হাঁটু টেনে নিয়ে গিয়ে আরমিণের সামনে ছেড়ে দেয়। ধপ করে মেঝেতে বসে। বসতে দেরি হলো, অন্তূর দেহটা এসে পাগল স্রোত-তরঙ্গের মতো তার বুকের ওপর আছড়ে পড়তে সময় নিলো না। জয় একটু দুলে ওঠে। চোখটা শক্ত করে চেপে বুজে নেয়। আরমিণ হেরে গেল আজ। জয় আমির বলেছিল এই জনমেই আরমিণ তাকে ভালোবাসবে। ব্যাস, হেরে গেছে চ্যালেঞ্জে আরমিণ। এই যে আছড়ে পড়া, শার্টটা খামচে ধরে হুহু করে কেঁদে ফেলা, জয়ের বুকের ভেতর ঢুকে যেতে চাইবার যে উন্মাদ প্রচেষ্টা, কান্নার তরে জয়ের শরীরটাও অন্তূর সাথে সমান হারে দুলে ওঠা, বুকের ভিজে ওঠা পশম—জয়ের কি এই সংক্ষিপ্ত জীবনে আর কিছু পাবার আছে? না, এই তো প্রাপ্তির খাতা পূর্ণ আজ!

অন্তূর কান্না ধীরে ধীরে চিৎকারে রূপ নিলো। সরু আর্তনাদে শিউরে উঠল আমির নিবাসের ভীত। জয়ের বা ভেতরে কী হলো! সে একটানে অন্তূর গায়ে আলতো কোরে জড়ানো ওড়নাটা একটানে খুলে ফেলল। সম্পূর্ণ অনাবৃত অন্তূ। জয় অন্তূর যোনীদ্বারে হাত ছুঁয়ে চুইয়ে আসা রক্ত হাতে মাখে। চলন্ত কোনো ইঞ্জিনের মতোন থরথর করে কাঁপে জয়ের হাত। রক্ত থেকে দূর্গন্ধ আসছে। জয় প্রাণভরে সেই গন্ধ টেনে নেয় ভেতরে। তার দম পড়ে না। কিন্তু সেই দুর্গন্ধযুক্ত রক্তের ওপর টুপ করে দুই ফোঁটা জল পড়ে গুলিয়ে যায় রক্তের সাথে। জয় কাঁদে না। সে কাঁদতে পারে না। এখনও কাঁদছে না, মাড়ির দাঁত আটকানো, শক্ত চোয়াল দেখে বোঝা যায়। কিন্তু চোখে পানি কেন?
সে একদৃষ্টে সেই রক্ত দেখে আর বলে, “আমা..র র..রক্ত! আরমেইণ! আ..মার র…ক্ত, হ্যাঁ? আমিরদের রক্ত এটা?ʼʼ
আরও তিনফোটা পানি হাতের রক্তের প্রলেপে পড়ে রক্তের ঘনত্ব কমিয়ে আনে। জয় ডাকে, “এই, এইহ্! এ..টা ক..কী?ʼʼ
অন্তূ শুধু কাঁদে। জয়ের গোটা দেহ মৃগী রোগীর মতো কেঁপে কেঁপে ওঠে। জয় মেঝেতে পড়ে থাকা চাপড়া ধরা রক্ত তুলে হাতে মাখে, পাগলের মতো গায়ে মাখে। এই রক্ত তার, আরমিণের গর্ভে স্থান পাবার পর আবার পরিত্যক্ত নাপাক রক্ত তার!

সে হাঁ করে বিশাল বড় বড় শ্বাস ফেলে। তার দম ফুরিয়ে আসে। সে ভ্রুণের টুকরো তুলে হাতের তালুতে নেয়। নাহ্ সে বাপ হিসেবে কোলে নিতে পারবে না এটাকে, ততবড় হতেই দেয়া হয়নি! গর্ভ ছিঁড়ে বের করে এনে এই নোংরা মেঝেতে ফেলে রাখা হয়েছে। এত কেন অবহেলিত তার রক্তরা আগে পরেই? একটুও কদর পেল না আমিরদের রক্ত কখনও। তার নিজের রক্তও সেই ছোটবেলা থেকে রাস্তায় রাস্তায় মিশে গেছে, মানুষ পায়ে মাড়িয়ে চলে গেছে।
এই রক্তপিণ্ডের চোখ, নাক, কান কি বোঝা যাচ্ছে? এটা তার সন্তান? জয় আমিরের সন্তান এটা? সন্তান কেমন হয়? জয় তো জানে না। কবে হলো এসব? তার ঘরওয়ালি কী করে ফেলেছে তার সাথে? জয়ের তো কখনও সাহসই হয়নি এই আসমানসম আকাঙ্ক্ষাটুকু প্রকাশ করার! সেও কি সন্তানের বাপ হতে পারে? আরমিণের গর্ভে তার রক্ত স্থান পেতে পারে? শালির মেয়ে বলেছিল এ জন্মে ভালোবাসবে না। ভালোবাসা কী? এই তো! আরমিণের ভেতরে সে স্থান পেয়েছে! এটা ছাড়া আর কী চাই জয় আমিরের?

কিন্তু এভাবে তাকে গর্ভছাড়া কে করেছে? জয়ের চোখ অন্ধকার লাগে। হৃদস্পন্দন অস্বাভাবিক হারে বাড়ছে। শরীর ঘেমে শার্ট ভিজে উঠেছে। সে কেমন অন্ধের মতো হাতরে বুকে টেনে নেয় অন্তূকে। বুকের সাথে এত জোরে চেপে ধরল যেন যতক্ষণ আরমিণ তার কলিজা ফুঁড়ে ভেতরে না ঢুকবে সে কিছুতেই এই আরমিণকে বুক থেকে আলগা হতে দেবে না।
-“আমি বলেছিলাম না আপনাকে? আমার রবের লাঠি আওয়াজহীন হয়। তিনি বিচার করলে এই জগতের কোনো শক্তি তা এড়াতে পারে না! আমি বলেছিলাম আপনাকে, তিনি মহাবিচারক। তার বিচারে একটুও না-ইনসাফ থাকে না। কী করেছেন আপনি? মেরে ফেলেছেন বাচ্চাগুলোকে?ʼʼ

আরমিণকে চুপ করানো দরকার। জয়ের নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে। আমির নিবাসের ছাদ উপেক্ষা করে একুশটা বছর পর সে সৃষ্টিকর্তার তরে আকাশের পানে তাকায়। কেউ আছেন ওখানে? সত্যিই আছেন নাকি? কে আছেন? তিনি ডাক শোনেন? তিনি বিচারও করেন? কেমন বিচার করেন সেই সত্ত্বা।
-“মহা বিচারক তিনি। কিন্তু আজ কি তার বিচারে একটু ভুল হয়নি, জয় আমির? কিন্তু তিনি তো ভুল করেন না! ভুলের ঊর্ধ্বে। তবু আজ একটা গড়মিল কেন হলো, বলুন না? বলুন বলুন, আমাকে বলুন। আমি আপনার স্ত্রী বলে? যাকে কখনও স্বামী হিসেবে মনকে মানাতেই পারলাম না, সেই পুরুষের স্ত্রী হওয়ার মাশুল কেন দেব আমি? কেন দেবোওওও?ʼʼ

অবরুদ্ধ নিশীথ পর্ব ৮০

অন্তূ চিৎকার করে কেঁদে ওঠে। জয় ঢোক গেলে দুটো। অন্তূকে একদম মিশিয়ে ধরল বুকের মাঝে। যেন ছেড়ে দিলেই হারাবে, আর তা হতে দেয়া সূর্যকে রাতে দেখার মতোই অসম্ভব জয়ের জন্য! অন্তূকে আরও একটু বাহুডোরে আঁকড়ে নিয়ে বুকের মাঝখানটায় চেপে ধরে ফিসফিস করে বলল, “সেদিন কাজী সাহেব তোর খোদার নামের কালাম পাঠ করে তোকে আমার সাথে জুড়েছিলেন, মনে আছে? আজ আমার সবকিছুর অর্ধেকটা তোরও, আরমিণ। আমার পাপ, তাপ, অভিশাপ সবেতে তোর ভাগ লেখা হয়ে গেছে। তোর ভেতরের সবটুকু ঘেন্না শুধু আমার, আমার পাপের অর্ধেক তোর।ʼʼ

অবরুদ্ধ নিশীথ পর্ব ৮২