অবাধ্য পিছুটান পর্ব ১৪
সাদিয়া শওকত বাবলি
আমতা আমতা করে আবার বলল,
-“একবার সত্যিটা বলে দিলেই তো হয়। সব ঝামেলা শেষ হয়ে যায়। এসব লুকোচুরি খেলার মানে কি স্যার?”
তুর্য হাসলো। গাড়ির সিটের সাথে গা এলিয়ে দিয়ে বলল,
-“বউয়ের সাথে লুকোচুরি খেলতে ভালো লাগছে আরুশ। বউটার বিভ্রান্তিকর মুখশ্রী হৃদয়ে প্রশান্তি দিচ্ছে।”
তপ্ত নিঃশ্বাস ফেলল আরুশ। বিরবিরিয়ে বলল,
-“এই প্রশান্তি না আবার অশান্তির কারন হয়ে দাঁড়ায়।”
আরুশের নিচু স্বরে বলা কথাগুলো তুর্যের কর্ণে ঠিকঠাকভাবে পৌঁছালো না। ভ্রু উঁচিয়ে সে শুধালো,
-“কিছু বললি?”
আরুশ এড়িয়ে যেতে চাইলো তুর্যকে। এই কথাগুলো শুনলে আবার কি না কি বলে আধপাগল লোকটা কোনো বিশ্বাস নেই তো। আরুশ কন্ঠস্বর স্বাভাবিক রেখেই বলল,
-“তেমন কিছু না স্যার।”
বিকালের তেজহীন সূর্য। দুপুরের ন্যায় আর প্রচন্ড গরম এবং তেজ ছড়াচ্ছে না সে। আবহাওয়াও বেশ সদয় আজ। মৃদু শীতল বাতাস বইছে চারপাশে। আবহাওয়ার এমন অনুকূল রূপ দেখে রিদি এসে জুটেছে পৃথাদের বাড়িতে। উদ্দেশ্য পৃথাকে নিয়ে বাইরে বেরুবে, কিছু কেনাকাটা করার আছে তার। প্রথমে পৃথা রাজি না হলেও রিদির জোরাজুরিতে না করতে পারলো না আর। দুই বান্ধবী একদম সেজেগুজে কক্ষ থেকে বেরিয়ে এলো। এখন শপিং এ যাবে তারপর একটু ঘুরবে, শেষে পড়ন্ত বিকালে গোধূলি লগ্নকে সাক্ষী রেখে ফুচকা খেয়ে বাড়িতে ফিরবে। তবে তাদের এই এত পরিকল্পনা টিকলো না খুব বেশিক্ষন। বসার কক্ষে আসতেই পরিকল্পনায় ভাটা লাগিয়ে দিল পিয়াস। ছেলেটা বসে ছিল বসার কক্ষের সোফাতেই। দুই বান্ধবীকে এত সেজেগুজে বেরুতে দেখে ভ্রু যুগল কুঁচকে এলো পিয়াসের। থমথমে কন্ঠে প্রশ্ন করলো,
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
-“কোথায় যাচ্ছিস?”
রিদি আর পৃথা থমকে দাঁড়ালো সাথে সাথেই। রিদি মেয়েটা জড়সড় হয়ে দাঁড়ালো পৃথার পাশেই। এমনি ভাই বাবারা যতই ভালোবাসা দিক না কেন সময়ে শাসন করতেও পিছপা হয় না তারা। তাছাড়া তার এক একটা ভাইয়ের যে শরীর ভর্তি ক্রোধ। পৃথা আমতা আমতা শুরু করলো। ভেঙে ভেঙে বলল,
-“এই বাইরে যাচ্ছিলাম একটু। রিদির কিছু কেনাকাটা করার আছে তো তাই।”
পিয়াস আড় চোখে তাকালো ভীত রিদির পানে। মেয়েটা তাকে অজানা কারনেই ভয় পায় সর্বদা। কখনও এই মেয়ের উপরে নিজের কোনো ক্রোধ প্রকাশ করেছে বা ক্রোধে দুই চারটা থাপ্পর মে’রে’ছে তাও তো নয়। তারপরও কেমন যেন মেয়েটা তার সম্মুখে আসলেই গুটিয়ে যায়। অন্যদের বেলায় তো বেশ প্রাণাচ্ছল চঞ্চল থাকে। তাহলে তার দোষটা কি? তাকে কেন ভয় পাবে? তপ্ত নিঃশ্বাস ফেলল পিয়াস। বসা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে বলল,
-“চল আমিও যাব তোদের সাথে।”
পিয়াসের সাথে যাওয়ার কথা শুনে যেন আঁতকে উঠলো দুই রমনী। রিদি খামচে ধরলো পৃথার হাত। তাদের সাথে পিয়াস যওয়া মানে সকল পরিকল্পনাতে জল ঢালা। পিয়াস তাদের বাসা থেকে সোজা শপিং মলে নিয়ে যাবে সেখান থেকে আবার খেদিয়ে বাড়িতে নিয়ে আসবে। কোথাও ঘোরাঘুরিও হবে না, আর ফুচকা খাওয়া তো হবেই না। পৃথা জ্বীহ্বা দ্বারা নিজের দুই ওষ্ঠ ভিজিয়ে নিল অতঃপর বলল,
-“তোমাকে যেতে হবে না ভাইয়া। আমরা দুই বান্ধবী তো আছিই। যাব আর চলে আসবো।”
পিয়াস এক পলক তাকলো বোনের পানে। অতঃপর রিদির পানে শীতল দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বলল,
-“এর জন্যই তো আমাকে আরও বেশি করে যেতে হবে। এক গর্দভের সাথে যাচ্ছে আরেক গর্দভ।”
পৃথা আর রিদি অপমানিতবোধ করলো বেশ। তবে পিয়াসের মুখের উপরে আর কিছু বলার সাহস হলো না তাদের। অগত্যা পিয়াসের সাথেই শপিং এ যাওয়ার জন্য উদ্যত হলো দুই নারী।
একটু বাদেই কাছাকাছি একটা ছোট খাটো শপিং মলে এসে পৌঁছালো পিয়াস, রিদি এবং পৃথা। তারা শপিং মলে ঢুকতেই সেখানে এসে পৌঁছালো তুর্য এবং আরুশ। আরুশের উপরে সর্বদা পৃথার উপর নজর রাখার দায়িত্ব ছিল। সেই দায়িত্ব পালনে নিয়োজিত অবস্থায় আরুশ যখন দেখলো পৃথা বাড়ি থেকে বের হচ্ছে চট জলদি সে খবরটা পৌঁছে দিল তুর্যের কানে। তুর্যও দেরী করেনি। কোনো রকমে তৈরী হয়ে পিছু নিয়েছে বউয়ের। ফলস্বরূপ এখন সে শপিং মলে। শপিং মলে ঢুকে পিয়াসকে বউয়ের সাথে দেখেই মেজাজটা চটে গেল ছেলেটার। কোথায় বউ একা আসবে। তার পিছু পিছু একটু ঘুরঘুর করবে। কিশোরী বয়সের ন্যায় নিজের বউ নামক মেয়েটাকে বিরক্ত করবে তা না। কাবাবের মধ্যে হাড্ডি হতে আরেকজন এসে হাজির। তুর্য দাঁতে দাঁত চাপলো। কটমট করে আরুশকে বলল,
-“এই আল বদ’রটা এখানে আমার বউয়ের সাথে কি করছে?”
আরুশ শুনলো তুর্যের প্রশ্ন তবে প্রতিউত্তরে বলল না কিছুই। আসলে এই আল ব’দর কেন এসেছে তা তো সেও জানে না। হয়তো বোনকে একা ছাড়তে চায়নি তাই এসেছে। তুর্য আড়াল থেকে বেশ কিছুটা সময় নিয়ে ঘুরঘুর করলো বউয়ের কাছে যাওয়ার জন্য কিন্তু সে সুযোগ আর এলো না। পিয়াসটা যেন আঠার মতো লেগে আছে মেয়েটার সাথে। তুর্যের মেজাজ বিগড়ালো আরও। আজ শুধুমাত্র বউটার মনের মধ্যে তাকে নিয়ে কোনো নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে চায় না বিধায় পৃথার বাপ ভাইয়ের সাথে ঝামেলা করছে না নয়তো দেখিয়ে দিতো তুর্য কি জিনিস। এমনিই বউয়ের হৃদয়ে তার জন্য নেতিবাচক চিন্তা ভাবনার তো শেষ নেই। তুর্যের ভাবনার মধ্যেই পৃথারা এগিয়ে গেল বিল পরিশোধ করতে। আজকের মতো কেনাকাটা শেষ তাদের। বিল পরিশোধ করার সময়ে শপিং মলেরই একজন মহিলা কর্মচারী তড়িঘড়ি করে দৌড়ে এলো একটা প্যাকেট হাতে। জনবলে পিয়াস, পৃথা, রিদি তিনজন থাকলেও কর্মচারী নারীটি প্যাকেটটা এগিয়ে দিল পৃথার পানে। হাসি মুখে বলল,
-“ম্যাম এটা আপনার।”
পৃথা অবাক হলো। প্যাকেটটা হাতে নিয়ে ভিতরে দেখলো একটা বেশ সুন্দর শাড়ি। কালো নরম জর্জেটের উপর সোনালী কারুকাজ খচিত। সুন্দরের সাথে সাথে শাড়িটা দামীও মনে হচ্ছে। তবে এমন কোনো শাড়ি পৃথা তো নেয়নি বা নেওয়ার ইচ্ছাও প্রকাশ করেনি। পৃথা অবাক কন্ঠেই বলল,
-“আমার মানে? আমি তো এই শাড়িটি কিনিনি।”
অল্প বয়সী নরীটি একগাল হাসলো। অত্যন্ত নম্র কন্ঠে বলল,
-“এটা আপনি কিনেননি ম্যাম এটা আমাদের তরফ থেকে আপনার জন্য উপহার। কয়দিন আগে বসন্ত গেল তো সেই উপলক্ষ্যেই আমাদের এখানে একটা অফার চলছে তিন হাজার টাকার উপরে কেউ শপিং করলে তাকে একটা শাড়ি গিফট করা হবে। সেই শাড়িটাই আপনি পেয়েছেন।”
মহিলা কর্মচারীর এহেন যুক্তিতে ভ্রু কুঁচকে এলো পিয়াসের। পৃথার হাত থেকে শাড়িটা নিজের হাতে নিল সে। উল্টে পাল্টে দেখে বলল,
-“কিন্তু শাড়িটা দেখে তো মনে হচ্ছে তিন হাজারের থেকে অধিক দাম হবে।”
মেয়েটি আমতা আমতা করলো। কিছুটা ইতস্তত ভঙ্গিতে বলল,
-“আমি কি জানি? শপিং মল কতৃপক্ষের সিদ্ধান্ত এটা।”
পিয়াস, পৃথা এবং রিদি বোধহয় বিশ্বাস করলো মেয়েটার কথা। রিদির মন খারাপ হলো। সে বলল,
-“তাহলে আমারটা কোথায়?”
-“ম্যাম আপনারা দুজন সম্ভবত মিলেমিশে তিন হাজার টাকার শপিং করেছেন তাই শাড়ি একটাই পাবেন।”
রিদি আর কিছু বলল না। যদিও শাড়িটা তার পছন্দ হয়েছিল কিন্তু যেহেতু সেটা পৃথার হাতেই প্রথম উঠেছে এবং তার বলে সম্বোধন করা হয়েছে তাই সে চুপ রইলো। তাছাড়া পিয়াসের সামনে এই শাড়ি শাড়ি নিয়ে ঝগড়া করার সাহসও তার নেই। নয়তো বান্ধবীর সাথে এক ছরটক ঝগড়া লাগিয়ে হলেও শাড়িটা নিতো সে। পিয়াস তাকালো রিদির মলিন মুখশ্রীর পানে। শাড়ি দেওয়া ঐ নারী কর্মীকেই বলল,
-“হুবহু এমন আরেকটা শাড়ি দিন আমাদের।”
-“জ্বী স্যার।”
ওষ্ঠ নাড়িয়ে কথাটা একবার আওড়িয়েই নারী কর্মীটি চট জলদি হুবহু একই রকম একটা শাড়ি এনে বাড়িয়ে দিল তাদের পানে। পিয়াস তাকালো রিদির দিকে। আদেশের সুরে বলল,
-“শাড়িটা নাও।”
রিদি নিল না শাড়িটা। আমতা আমতা করে বলল,
-“আমার লাগবে না।”
পিয়াস সাথে সাথে ধমকে উঠলো রিদিকে। গম্ভীর কন্ঠে বলল,
-“তোমার কাছে জিজ্ঞেস করেছি আমি? নিতে বলেছি নাও।”
রিদি আর না করার সাহস পেল না। এমনিও শাড়িটা সে নিতে চাইছিলো ভীষণভাবে শুধুমাত্র ভদ্রতার খাতিরে না না করছিল। যাক এ লোক ধমকটা তো কোনো কাজে এলো তার। অন্তত ধমকের বদৌলতে একটা সুন্দর শাড়ি পেয়েছে সে।
রাত বেড়েছে কিছুটা। চারদিক যদিও এখনও নীরব হয়ে ওঠেনি তবে অন্ধকার গ্রাস করেছে বেশ ভালোভাবেই।আকাশটাও বেশ মেঘলা। বিকালে অল্প বিস্তর শীতল হাওয়ার উপস্থিতি পাওয়া গেলেও এখন টিপ টিপ বৃষ্টির আভাস পাওয়া যাচ্ছে। আবহাওয়া খারাপ থাকায় শিকদার বাড়ির সবাই আজ তাড়াতাড়িই নিজেদের রাতের খাবারের পাঠ চুকিয়ে যার যার কক্ষের দ্বার দিয়েছে।
পৃথা কক্ষে প্রবেশ করেই বিছানার উপরে রাখা বিকালে শপিং মল থেকে পাওয়া শাড়িটা হাতে তুলে নিল। দুই পা ফেলে গিয়ে দাঁড়ালো ড্রেসিং টেবিলের সম্মুখে। শাড়িটা গায়ে ফেলে দেখতে লাগলো কেমন কেমন লাগছে তার। শাড়িটা ভারী পছন্দ হয়েছে মেয়েটার। ভাগ্যিস আজ শপিং মলে গিয়েছিল সে নয়তো কত সুন্দর একটা শাড়ি মিস করে যেত। পৃথার শাড়িটা নিয়ে ব্যস্ততার মধ্যেই বিছানার উপরে ফেলে রাখা তার মোবাইলটা বেজে উঠলো প্রবল ঝংকার তুলে। মেয়েটা বিরক্ত হলো। কে আবার এই সময়ে কল করেছে? পৃথা একরাশ বিরক্তি নিয়ে এগিয়ে এলো বিছানার পানে। মোবাইলের স্ক্রীনে জ্বলজ্বল করছে অপরিচিত নাম্বার। একবার রিসিভ করবে না ভেবেও কলটা রিসিভ করলো সে। যদি কেউ কোনো প্রয়োজনে কল করে থাকে তখন? তবে কল ধরে মেয়েটা নিজের ভিতরকার বিরক্তি ভাব প্রকাশ করলো না। বরং নম্র কন্ঠে বলল,
-“আসসালামুয়ালাইকুম। কে বলছেন?”
সাথে সাথেই ওপাশ থেকে ভেসে এলো এক পুরুষালী গম্ভীর কন্ঠস্বর। সালামের জবাব দিয়ে সে বলল,
-“ওয়ালাইকুমুস সালাম। আমি কে তা জানার আগে বলো তোমাকে এই বয়সে মোবাইল কে দিয়েছে?”
পৃথার কপাল কুঁচকে এলো। কে এই লোক এই মাঝ রাতে কল করে জবাবদিহিতা চাইছে। আর পৃথাই বা কেন অপরিচিত কাউকে কইফিয়ৎ দিবে? পৃথা চড়ম বিরক্তি নিয়ে বলল,
-“কে আপনি বলুন তো। আর এত রাতে কল করে এসব কি প্রশ্ন?”
-“আগে বলো তোমাকে এই বয়সে মোবাইল কে দিয়েছে?”
পৃথা চোখ মুখ খিচে বলল,
-“বাবা দিয়েছে।”
-“হ্যা তা তো দিবেই। তোমার রাজা’কার বাপটা আমার কপাল পোড়ার জন্য উঠে পড়ে লেগেছে দেখছি।”
এই “রাজা’কার” এই টুকু শুনেই পৃথা বুঝে গেল কে হতে পারে এই লোক। দাঁতে দাত চাপলো পৃথা। কটমট করে বলল,
-“এই এই ব্রিটিশ লোক আপনি আমার নাম্বার কোথায় পেয়েছেন?”
তুর্য যেন মজা পেল পৃথার কথায়। রসিয়ে রসিয়ে বলল,
-“আকাশে বাতাসে আমার মনে।”
পৃথা তেতে গেল। এই আধ পাগল লোক তো হাত ধুয়েই তার পিছনে পড়ে গেছে। চাইছে টা কি এ? পৃথা ঝাঁঝালো কন্ঠে প্রশ্ন করলো,
অবাধ্য পিছুটান পর্ব ১৩
-“অসভ্য লোক আমাকে এত রাতে কল করেছেন কেন?”
তুর্য হাসলো। দাঁত দিয়ে নিচের ওষ্ঠ কামড়ে বলল,
-“প্রেম করতে। করবে আমার সাথে প্রেম?”