অবাধ্য পিছুটান পর্ব ৪৩

অবাধ্য পিছুটান পর্ব ৪৩
সাদিয়া শওকত বাবলি

তুর্য উত্তর দিল না পৃথার কথার। উল্টো নিজের শরীরে জড়ানো টিশার্টটা খুলতে খুলতে বলল,
-“চুপ! একদম চুপ।‌ আর একটা কথাও নয়। আর একটা উল্টা পাল্টা কথা বলবে তো জানে মে’রে দেব একদম।”
পৃথা ওষ্ঠ প্রসারিত করলো। ডান হাতটা উঁচিয়ে তর্জনী আঙ্গুলটা দ্বারা আলতোভাবে স্পর্শ করলো তুর্যের নগ্ন বক্ষ। কন্ঠে দৃঢ় বিশ্বাস নিয়ে বলল,
-“পৃথাকে জানে মে’রে দেওয়ার আগে তুর্য চৌধুরীরই জান চলে যাবে।”
তুর্যের দৃষ্টি শীতল হলো। পৃথার হাতটা চেপে ধরলো নিজ বক্ষে। মৃদু কন্ঠে বলল,
-“এত বিশ্বাস?”
পৃথা হাসলো। দৃঢ় কন্ঠে বলল,
-“নিজের থেকেও বেশি।”

তুর্য চোখে চোখ রাখলো পৃথার। প্রশান্তিতে ভরে উঠলো তার হৃদয়। যে চোখে এতকাল ভালোবাসা দেখার তীব্র আকাঙ্ক্ষায় ছটফটিয়ে কাটিয়েছে বেচারা আজ সেই চোখে পূর্ণ ভালোবাসার অস্বিত্ব দেখতে পাচ্ছে, খুঁজে পাচ্ছে অগাত বিশ্বাস। এই জীবনের সবচেয়ে বড় পাওয়া, জীবনের পূর্ণতা। তুর্য আর কথা বাড়ালো না। আজ এই বৃষ্টিস্নাত রজনীতেই সে নিজের করে নিতে চাইলো নিজ প্রিয়তমাকে। তুর্য আবারও নিজেদের দূরত্ব ঘোচালো, একটু ঝুঁকে মুখ ডোবালো পৃথার ঘাড়ে। ছোট ছোট চু’মু’তে সিক্ত করলো মেয়েটাকে। ধীরে ধীরে বেশামাল হলো তুর্যের স্পর্শ, ভারী হলো পৃথার নিঃশ্বাস। আর কোনো বাঁধা দেওয়ার সক্ষমতা হারালো মেয়েটা। ভালোবাসাময় সুখে খামচে ধরলো তুর্যের উন্মুক্ত ফর্সা পিঠ। একে অপরের মাঝে হারিয়ে গেল একটু একটু করে। অবশেষে পূর্ণতা পেল দুটি নর নারী, একটি স্নিগ্ধ ভালোবাসা।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

ভোরের আলো ফুটেছে। চারদিকটা ইতমধ্যে ভরে উঠেছে সূর্যের তীব্র আলোক রশ্মিতে। গতকাল সারারাত ধরে বৃষ্টি হওয়ার দরুন আজ যেন একটু বেশিই চনমনে সূর্যটা। সেই চনমনে সূর্যের আলো চোখে পড়তেই ঘুম ভেঙে গেল পৃথার। পিট পিট করে চোখ খুলতেই নিজেকে আবিষ্কার করলো তুর্যের নগ্ন বক্ষে। সাথে নিজের দেহের পানে তাকিয়েও লজ্জায় পড়লো মেয়েটা। ইসসস গতকাল রাতে কি অ’স’ভ্য’তা’মো’টা’ই না করলো তুর্য অথচ এখন ভাজা মাছটা উল্টে খেতে জানে না যেন। একদম নিষ্পাপ বাচ্চাদের ন্যায় ঘুমিয়ে আছে। পৃথা চোখ তুলে তাকালো তুর্যের ঘুমন্ত মুখশ্রীর পানে। ইচ্ছে হলো হাত বাড়িয়ে ঐ মুখটা একটু ছুঁয়ে দিতে, একটু আদর দিয়ে ভরিয়ে তুলতে। পৃথা তাই করলো। হাত বাড়িয়ে ছুঁয়ে দিল তুর্যের ঘুমন্ত মুখশ্রী। মাথাটা ঝুঁকিয়ে আলতোভাবে চু’মু’ও খেল স্বামীর গালে কপালে। অতঃপর কি ভেবেই হঠাৎ তুর্যকে ধাক্কা মে’রে উঠে বসলো বিছানায়। গভীর ক্রোধ তুর্য আর তার শরীরে একসাথে জড়ানো কাঁথাটা টেনে ঢেকে নিল শুধুমাত্র নিজেকে।
ঘুমের মধ্যে আকস্মিক ধাক্কায় ভরকে গেল তুর্য। ধরফরিয়ে উঠে বসলো বিছানায়। ব্যস্ত হয়ে বলল,

-“কি! কি হয়েছে?”
পৃথা অগ্নি দৃষ্টিতে তাকালো তুর্যের পানে। ঝাঁঝালো কন্ঠে বলল,
-“অসভ্য লোক, আপনি একদম কথা বলবেন না আমার সাথে।”
তুর্য দ্বিতীয় দফায় ভরকে গেলো পৃথার কথায়। সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠতে না উঠতেই এর আবার কি হলো? কাল এত সুন্দর মধুময় এক রজনী অতিবাহিত করে আজ বলছে কথা বলবে না। তুর্য নিজের দুই হাত বাড়িয়ে জড়িয়ে ধরতে উদ্যত হলো পৃথাকে। কোমল কন্ঠে বলল,
-“কি হয়েছে তোমার? অন্যায় কি করেছি বলবে তো।”
পৃঁথা সরে গেল তুর্যের নিকট থেকে। শরীরে জড়ানো কাথাটা আরও ভালোভাবে শরীরে জড়িয়ে পা বাড়ালো ওয়াশ রুমের পানে। যেতে যেতে আবার বলল,

-“একদম আমাকে ছোঁবেন না অসভ্য পুরুষ। আমার আশেপাশেও যেন আপনাকে না দেখি, তাহলে হাত পা কে’টে বিছানায় বসিয়ে রাখবো বলে দিলাম।”
তুর্য যেন বেয়াক্কেল বনে গেল পৃথার কথায়। রাতে সারারাত এত গভীরভাবে ছুঁয়ে দেওয়ার পর এখন বলছে ছোঁবেন না। আবার কি বলল, পৃথার আশেপাশে গেলে হাত পা কে’টে বিছানায় বসিয়ে রাখবে? তুর্যের চোখ বড় বড় হয়ে গেল। কি সাহস তার বউয়ের। এ তো তারও এক কাঠি উপর থেকে আসা যাওয়া করে।

বেলা গড়িয়েছে কিছুটা। যদিও এখনও সকালের সময়েই থেমে আছে সময়টা তবে সূর্য তার প্রখরতা ছড়িয়েছে অনেকটা। আর এই সময়ই চৌধুরী বাড়ির বসার কক্ষে সভা বসিয়েছে তুর্য। জরুরী কথা আছে বলে আজ কাউকে অফিসেও যেতে দেয়নি। আরুশকেও টেনে এনেছে সকাল সকাল। বেচারা আরুশ তো তার সাথে কি হতে চলেছে, তুর্য তাকে শাস্তি দেয় কিনা এই ভেবেই হার্ট অ্যাটাকের উপক্রম। কিন্তু তুর্য তাকে অবাক করে দিয়ে তেমন কিছুই করলো না। উল্টো আরুশের কাঁধ ধরে বসলো বসার কক্ষের সোফায়। বাড়ির সকলকে উদ্দেশ্য করে বলল,
-“তোমাদের সকলের সাথে আমার একটা জরুরী কথা আছে।”
উপস্থিত সকলে উৎসুক হয়ে তাকালো তুর্যের পানে। তবে তাহমিনা বেগম বরাবরের ন্যায়ই একটু ফোড়ং কেটে বললেন,

-“সেই তখন থেকে তো জরুরী কথা বলবে বলেই বসিয়ে রেখেছো আমাদের। এখন এত ভনিতা না করে বলে ফেলো কি বলতে চাও।”
তপ্ত নিঃশ্বাস ফেলল তুর্য। সকলের পানে একবার তাকিয়ে বলল,
-“আমি চাইছিলাম আরুশের সাথে ইরার বিয়েটা দিতে।”
থামলো তুর্য। আবার বলল,
-“এমন নয় যে আরুশকে তোমরা চিনো না। সবাই আরুশকে চিনো। আরুশ যথেষ্ট ভালো ছেলে। আমার যতদূর মনে হয় ইরার জন্য ওর থেকে ভালো ছেলে আর হবে না।”

তুর্যের হঠাৎ এহেন কথায় চমকালো উপস্থিত সবাই। আরুশ নিজেও বিস্ময়ের চরম সীমায় পৌছে গেছে এই মুহূর্তে। তুর্য এত ভালো কবে থেকে হলো? এভাবে বাড়িতে ডেকে এনে নিজে থেকে ইরার সাথে বিয়ের কথা বলছে। যেখানে আরুশকে তার শাস্তি দেওয়ার কথা সেখানে বোনের সাথে বিয়ে দিতে চাইছে? ব্যাপারটা ঠিক হজম হচ্ছে না আরুশের। এর মধ্যে নিশ্চই অন্য কিছু আছে। আরুশ তুর্যের পানে চেপে বসলো। একটু ঝুঁকে ফিসফিসিয়ে বলল,
-“স্যার আপনি ঠিক কি করতে চাইছেন বলবেন একটু?”
তুর্যও আরুশের ন্যায় ফিসফিসিয়ে জবাব দিল,
-“তোকে বোন জামাই করতে চাইছি। কেন ইরাকে তোর পছন্দ না?”
আরুশ উত্তর দেওয়ার জন্য মুখ খুললো। কিন্তু সে কিছু বলার আগেই মুখ খুললেন তাহমিনা বেগম। থমথমে কন্ঠে তিনি বললেন,

-“ইরা এখনও ছোট। এখনই ওর বিয়ের ব্যাপারে আমরা ভাবছি না কিছু।”
তুর্য তীক্ষ্ম দৃষ্টিতে তাকালো মায়ের পানে। গম্ভীর কন্ঠে বলল,
-“ইরা ছোট আর আমার বউ তো ছোট ছিল না, একদম খুন খুনে বুড়ি ছিল। মাত্র দশ বছর বয়সে পৃথার বাবা মায়ের হাত পা ধরে ঐ ছোট মেয়েটাকে বিয়ের পীড়িতে উঠিয়ে দিতে তোমাদের বুক কাঁপেনি আর এখন নিজেদের ১৭ বছর বয়সী মেয়েকে বিয়ে দিতে বুক কাঁপছে। নিজের মেয়েরা মেয়ে আর পরের মেয়েরা তো মেয়ে নয় তাদের যেভাবে খুশি নাচানো যায় তাই না?”

তুর্যের কথায় চুপ হয়ে গেল সবাই। ছেলেটা ভুল কিছু তো বলেনি। সেদিন সত্যিই তারা ভুল করেছিল যার দরুন ভুগতে হয়েছে ঐ মেয়েটাকে। সকলের নিশ্চুপতার মাঝেই উঠে দাঁড়ালো তুর্য। সকলের পানে একবার তাকিয়ে বলল,
-“কি করবে ভেবে চিন্তে আমাকে জানিও। তোমাদের মেয়ে না দিলে আমি আরুশের জন্য অন্য মেয়ে দেখবো। বেচারা আর কতদিন আইবুড়ো থাকবে।”
কথাটা বলেই লম্বা লম্বা পা ফেলে বসার কক্ষ থেকে প্রস্থান করলো তুর্য। আর আরুশ ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে রইলো তার যাওয়ার পানে। এই লোক আবার হঠাৎ ওর বিয়ে নিয়ে আবার এত মাতলো কেন? কি চাইছে এ?

বসার কক্ষ থেকে বেরিয়ে তুর্য সোজা গেল ইরার কক্ষের পানে। তার বউ সকলে তার উপরে চোটপাট দেখিয়ে এ কক্ষেই এসে ঘাঁটি গেড়েছে। এতক্ষনও সকলে বসার কক্ষে উপস্থিত থাকলেও এই দুই নারী উপস্থিত ছিল না। যেহেতু ইরার বিয়ের কথাই বলবে তাই তুর্যও আর তাদের বসার কক্ষে যেতে জোরাজুরি করেনি। তুর্য দাঁড়ালো ইরার কক্ষের দরজার সম্মুখে। হাত উঁচিয়ে দরজায় টোকা দিয়ে বলল,
-“পৃথা রুমে এসো তাড়াতাড়ি।”
তুর্যের কথা শেষ হওয়ার প্রায় সাথে সাথেই দরজার ওপাশ থেকে উত্তর এলো,
-“আমি যাব না, আপনি যান।”
তুর্য ভ্রু কুঁচকালো। নিজের ভদ্রতা বাদ দিয়ে দরজা ঠেলে ভিতরে ঢুকলো সে। ইরাকে আদেশের সুরে বলল,
-“তুই বাইরে যা।”

তুর্যের আদেশ দিতে দেরী কিন্তু ইরার কক্ষ থেকে বেরিয়ে যেতে দেরী হলো না। ইরা বেরিয়ে যেতেই তুর্য এগিয়ে গিয়ে কক্ষের দরজাটা আটকে দিল। অতঃপর পৃথার পানে তাকিয়ে বলল,
-“কি হয়েছে? সকাল থেকে রেগে আছো কেন?”
পৃথা অন্য দিকে মুখ ঘুরিয়ে নিল। থমথমে কন্ঠে বলল,
-“কিছু হয়নি আমার।”
তুর্য এগিয়ে গিয়ে পৃথার মুখোমুখি দাঁড়ালো। মেয়েটার একটা হাত নিয়ে নিল নিজের পুরুষালি দুই হাতের ভাঁজে। কোমল কন্ঠে বলল,

-“তোমার কি হয়েছে বলবে তো। না বললে আমি বুঝবো কিভাবে বলো।”
পৃথা তীক্ষ্ম দৃষ্টিতে তাকালো তুর্যের পানে। ঝাঁঝালো কন্ঠে বলল,
-“আমাদের বিবাহ বার্ষিকী ছিল আজ। কত প্ল্যানিং করেছিলাম। সব আপনি কাল এক রাতে ভেস্তে দিয়েছেন।”
তুর্য চমকালো। গোল গোল চোখে সে তাকালো পৃথাকে পানে। অবাক সুরে বলল,
-“আজকে আমাদের বিবাহ বার্ষিকী?”
পৃথার চোখ জোড়াও বড় বড় হয়ে গেল। বিস্ময় নিয়ে বলল,
-“আপনি আমাদের বিবাহ বার্ষিকীর কথাও ভুলে গিয়েছেন? অথচ সারাদিন ভালোবাসি ভালোবাসি বলে হেদিয়ে ম’রে’ন।”
তুর্য হঠাৎ রেগে গেল। দাঁতে দাঁত চেপে বলল,

-“ঐ আরুশের বাচ্চার গুষ্টি আমি উদ্ধার করে ফেলবো। ব্যাটা মীর জাফরের বংশধর, মাথায় একটা বারি মে’রে’ই আমার বিবাহ বার্ষিকী ভুলিয়ে দিল।”
পৃথা ভ্রু কুঁচকালো। কপালে ভাঁজ ফেলে প্রশ্ন করলো,
-“আরুশ ভাই আপনার মাথায় বারি মে’রে’ছি’ল? আপনি না সড়ক দুর্ঘটনায় মাথা ফাটিয়েছে?”
তুর্য অপ্রস্তুত হলো। রাগের মাথায় সে কি বলতে গিয়ে কি বলে ফেলেছিল। ঢোক গিললো তুর্য। আমতা আমতা করে বলল,

অবাধ্য পিছুটান পর্ব ৪২

-“হ্যা হ্যা সড়ক দুর্ঘটনাতেই মাথা ফেটেছে। ওটা তো আরুশ সাথে ছিল তাই বলছিলাম আর কি?”
কথাটা বলেই থামলো তুর্য। দুই হাতে পৃথাকে জড়িয়ে নিল নিজের সাথে। দুষ্টু হেসে বলল,
-“তুমি কি প্ল্যান করেছিলে বউ? নিশ্চই আজকে এই শুভ দিনে আমাদের বাসরটা সাড়ার চিন্তা ভাবনা করেছিলে যা আমি গতকাল রাতেই সেড়ে ফেলেছি। একদম চিন্তা করো না বউ, আমরা কাল বাসর সেড়েছি আজ আবার সাড়বো। ভবিষ্যতেও প্রতি রাতে বাসর সাড়বো। একটা রাতও বাদ যেতে দেব না।”

অবাধ্য পিছুটান পর্ব ৪৪

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here