অর্ধাঙ্গিনী দ্বিতীয় পরিচ্ছদ গল্পের লিংক || নুসাইবা ইভানা

অর্ধাঙ্গিনী দ্বিতীয় পরিচ্ছদ পর্ব ১
নুসাইবা ইভানা

ঢাকা শহরের ব্যস্ত রাস্তায় উন্মাদের মতো ছুটতে লাগল জিয়ান। পুলিশ স্টেশনে এসে মিসিং ডায়েরি করাল। প্রথমে পুলিশ নিতে চায়নি, কারণ এখনও চব্বিশ ঘণ্টা পূর্ণ হয়নি। চব্বিশ ঘণ্টার আগে কোনো মিসিং কেস নেওয়া হয় না। নাজিম চৌধুরীর কারণে শেষ পর্যন্ত ডায়েরি নিতে হয়েছে। জিয়ান এক মুহূর্তও ব্যয় না করে বাইক নিয়ে চলে এল নয়নাদের বাসায়।
রাত তখন দেড়টা পেরিয়ে গেছে। জিয়ান চিৎকার করে নয়নার নাম ধরে ডাকতে লাগল। এত রাতে জিয়ানের গলার স্বর শুনে জাহানারা বেগম রুম থেকে বেরিয়ে এলেন। মাহবুব তালুকদার চৌধুরী বাড়িতে গিয়ে হুমকি-ধমকি দিয়ে এসেছেন। আশপাশে খোঁজখবরও করেছেন। সবে বাসায় এসে বসেছিলেন। জিয়ানকে চোখের সামনে দেখতেই মাহবুব তালুকদারের চোয়াল শক্ত হয়ে গেল। একজন মেয়ে হারানো বাবা, অন্যজন জীবনসঙ্গিনী হারানো স্বামী।
জিয়ানের চোখমুখে তখন প্রিয়তমাকে হারানোর শোক। মাহবুব তালুকদারের চোখে সন্তান হারানোর আর্তনাদ।
পরিস্থিতি সামাল দিতে জাহানারা বেগম ছুটে এসে বললেন, “এখন মাথা ঠান্ডা রাখার সময়। এই সময় বিদ্বেষ করার সময় নয়। প্লিজ, আমার মেয়ের জন্য হলেও তোমরা নিজেদের মধ্যে বিবাদ সৃষ্টি করো না।”

জিয়ান জাহানারা বেগমের পায়ের সামনে হাঁটু মুড়ে বসে পড়ল। আর্তনাদ করে বলতে লাগল, “আন্টি, আমার নয়নাকে চাই। নয়নাকে ছাড়া আমি বাঁচতে পারব না। পৃথিবীর যেকোনো প্রান্ত থেকে হোক, আমার নয়নাকে চাই। আন্টি, নয়নাকে এনে দিন। আমার নয়না কোথায়, আন্টি?”
জাহানারা বেগমের চোখ দুটোও ভিজে উঠেছে। জিয়ানের চোখে তিনি স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছেন ভালোবাসা হারানোর শোক। তাহলে তার মেয়েটা গেল কোথায়? জাহানারা বেগম জিয়ানের মাথায় হাত রেখে বললেন, “বাবা, তুমি ভেঙে পড়লে হবে না। এখন তো তোমাকে শক্ত হতে হবে। খুঁজে আনতে হবে তোমার বেঁচে থাকার প্রাণভোমরাকে। উঠে বসো। নিজেকে সামলে নাও। তুমিই পারবে আমার মেয়েকে খুঁজে আনতে। ফিরিয়ে আনো তোমার ভালোবাসাকে।”
মাহবুব তালুকদার জিয়ানের কলার ধরে বললেন, “আমার মেয়ের সঙ্গে কী করেছিস? আমার মেয়ের কিছু হলে তোকে আমি ছাড়ব না, বলে দিলাম।”

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

পেছন থেকে নাজিম চৌধুরী বলে উঠলেন, “আমার ছেলেটা আপনার মেয়েকে পাগলের মতো খুঁজছে, আর আপনি ওকে দোষ দিচ্ছেন!”
জাহানারা বেগম বললেন, “এখন এসব করার সময় নয়। আমার মেয়েকে খুঁজে আনো। জানি না, মেয়েটা কোথায়, কী অবস্থায় আছে!”
জিয়ান আর এক মুহূর্ত সেখানে স্থির থাকল না। এক ছুটে চলে এল নয়নার রুমে। চিৎকার করে নয়নার নাম ধরে ডাকতে লাগল। ফাঁকা রুমে বারবার প্রতিধ্বনি হয়ে সে শব্দ ফিরে আসছে জিয়ানের কর্ণকুহরে। এক ছুটে বেরিয়ে এল তালুকদার ম্যানশন থেকে। দৌড়াতে লাগল রাস্তায়।

রাত জাগা দু-একজন পথিক, যাকে পাচ্ছে তাকেই ধরে জিজ্ঞেস করছে, “আমার বউকে দেখেছেন? তাকে খুঁজে পাচ্ছি না। সে কোথায় গেল, বলুন তো? জানেন, সে একা কোথাও কখনো বের হয় না। আজ কোথায় গেল?” সবাই মাতাল ভাবছে জিয়ানকে। জিয়ান ছুটে চলেছে অবিরাম। সে কোথায় আছে, তা যেন ভুলে গেছে। দূরপাল্লার বাসগুলো হুটহাট শা-শা করে ছুটে যাচ্ছে। হঠাৎ একটা দূরপাল্লার গাড়ির সঙ্গে আঘাত পেয়ে ছিটকে পড়ল রাস্তার পাশে। জিয়ানের চোখে নেমে আসতে লাগল নিকষ অন্ধকার। সে অন্ধকারে তলিয়ে যেতে যেতে বার কয়েক অস্ফুট স্বরে আওড়াল, “ফিরে এসো তুমি। তোমাকে ছাড়া আমি বাঁচব না।”
মিতা বেগম জাহিনের রুমে এসে দেখলেন জাহিন ঘুমাচ্ছে। তিনি জাহিনের মাথা ধরে ডাকতে লাগলেন। কয়েকবার ডাকার পর জাহিন চোখ খুলল।

বিরক্তি নিয়ে বলল, “এত রাতে ডাকছ কেন, আম্মু?”
“তোর ভাই পাগলের মতো রাস্তায়-রাস্তায় ঘুরছে। আর তুই নাক ডেকে ঘুমাচ্ছিস? তুই একটু ওর সঙ্গে যা। জানি না, আমার ছেলেটার কী হবে? নয়নাকে না পেলে আমার ছেলেটাও পাগল হয়ে যাবে।”
“কী বলছ এসব? কোন মেয়ে? আর কেনই বা জিয়ান রাস্তায় ঘুরবে?”
“নয়নাকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। মেয়েটাকে না পেলে আমার ছেলে এই শোক কাটিয়ে উঠতে পারবে না। নিশ্চিত পাগল হয়ে যাবে। তুই দ্রুত যা, বাবা। দেখ, তোর ভাই কোথায়। রাস্তায়-রাস্তায় ঘুরছে। কোনো বিপদ হলে তখন কী হবে? বাবা, তুই তোর ভাইকে বাঁচা।”

জাহিন তড়িৎ গতিতে উঠে বলল, “কী বলছ এসব! আগে বলবে তো? কখন হল এসব?”
“তুই যা, আমার ছেলেটাকে দেখ।” মিতা বেগম ঠুকরে কেঁদে উঠলেন। “কার নজর লাগল আমার সাজানো সংসারে! আল্লাহ, মেয়েটাকে সহি-সালামতে ফিরিয়ে দাও, নয়তো আমার সাজানো সংসার এলোমেলো হয়ে যাবে। আমার ছেলেটা পাগল হয়ে যাবে।”
পুরো রাত পার হয়ে গেলেও নয়নার কোনো খোঁজ পাওয়া গেল না। ঢাকা শহরের রাস্তার কোনো সিসিটিভি ফুটেজে নয়নাকে দেখা যায়নি! এটা কী করে সম্ভব? একজন মানুষ এভাবে গায়েব হয়ে যেতে পারে?
জিয়ানের আধখোলা শার্ট, উশকোখুশকো চুল, মাথা থেকে গলগল করে টকটকে তাজা রক্ত ঝরছে, ভিজে যাচ্ছে পিচঢালা রাস্তার পাশ। চোখ দুটো ক্রমশ ঝাপসা হতে লাগল। এক সময় পৃথিবীর সব অন্ধকার নেমে এল জিয়ানের চোখ জুড়ে।

জাহিন বাসা থেকে বের হয়ে জিয়ানকে খুঁজতে বের হল। তার নিজেকে হালকা লাগছে। কেন যেন অনুশোচনা হচ্ছে না। “আচ্ছা, এমন কেন হচ্ছে?” ভাবতে ভাবতে সময় নষ্ট করল না জাহিন। খুঁজতে লাগল রাস্তায়। প্রায় ঘণ্টাখানেক পর জিয়ানকে প্রায় মৃত অবস্থায় পেল জাহিন। দ্রুত গাড়িতে উঠিয়ে নিয়ে এল হাসপাতালে। জাহিন জিয়ানের দিকে বারকয়েক তাকাল। জিয়ানকে দেখে বোঝা যাচ্ছে না—বেঁচে আছে, নাকি মারা গেছে? তবে বেঁচে থাকার সম্ভাবনা একদম সামান্য। জাহিনের এখন খারাপ লাগছে। সে নিজের ভাইয়ের কোনো ক্ষতি চায়নি। ছোটবেলা থেকে জিয়ান তাকে আগলে রাখত। বাবার শাসন থেকে হোক বা কলেজের অ্যাসাইনমেন্ট, সব কিছুতে জিয়ান জাহিনকে সাহায্য করত। জাহিন দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল, “আমি চাই না, ভাই, তোর কিছু হোক। তোকে আমি হারাতে পারব না। কিছুতেই না।”

জিয়ানকে হাসপাতালে ভর্তি করে দু’হাতে মাথা চেপে বসে আছে জাহিন। একবার ভাবল, খোঁজ নেবে নয়নার লাশ কেউ খুঁজে পেল কি না। পরক্ষণেই মনে মনে বলল, “কোনো বইয়ের শেষ পৃষ্ঠা পড়ে ফেললে সে বইয়ে আর কোনো আকর্ষণ থাকে না। যার জীবনের ইতি নিজের হাতে টেনেছি, তার জন্য দরদ দেখাব না।”
জাহিন মাথা তুলে তাকাতেই সামনে দেখল একজন ডাক্তার দাঁড়িয়ে আছেন। জাহিন জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তার দিকে তাকাল।
ডাক্তার বললেন, “শি ইজ নো মোর।”
তালুকদার বাড়িতেও শোকের কালো ছায়া নেমে এসেছে। নয়নার জন্য থানা-পুলিশের দ্বারে দ্বারে ঘুরে বেড়াচ্ছেন মাহবুব তালুকদার আর মিজান তালুকদার। মাহবুব তালুকদার ভেঙে পড়েছেন। বিধ্বস্ত কণ্ঠে বললেন, “নিজের একমাত্র মেয়ের জীবনটা আমি নিজের হাতে শেষ করেছি, মিজান। আমার মেয়েটাকে জোর করে ওই কসাইখানায় পাঠিয়েছি। ওরা হয়তো আমার মেয়েটাকে মেরে গুম করে ফেলেছে। আমি কিছুতেই ওই কসাইকে ছাড়ব না। আমার মেয়েকে না পেলে ওদেরকেও জেলে পচিয়ে মারব। আমার মেয়েকে না পেলে চৌধুরীরা দেখবে মাহবুব তালুকদার কী জিনিস।”

“ভাইজান, এখন নিজেকে শক্ত করুন। যেভাবেই হোক, আমাদের সুনয়নাকে আগে খুঁজে বের করতে হবে। মেয়েটাকে যেন সহি-সালামতে পেয়ে যাই।”
মাহবুব তালুকদার হাউমাউ করে কেঁদে ফেললেন। “আমার মেয়ের জীবন আমার জন্য শেষ হয়েছে। আমি দায়ী। ওরা বাঁচতে দেয়নি মেয়েটাকে। নয়তো আমার ওইটুকু মেয়ে কোনোদিন একা বের হয়নি। ওরা বললেই আমি বিশ্বাস করব! ওরাই কিছু করেছে। ওই চৌধুরী বাড়ির সবাই অপরাধী। ছাড়ব না, আমি ওদের কাউকে ছাড়ব না।”

অর্ধাঙ্গিনী দ্বিতীয় পরিচ্ছদ পর্ব ২

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here