অর্ধাঙ্গিনী দ্বিতীয় পরিচ্ছদ পর্ব ১১
নুসাইবা ইভানা
নয়না তাকিয়ে আছে চাঁদের দিকে। চাঁদের আলোটুকু যেন নয়নার হৃদয়ে ছড়িয়ে পড়ছে। মানুষ যেন বাস্তবতায় খুব দ্রুত বড় হয়ে যায়। বয়সের চেয়ে যে মানুষ বাস্তবতার মুখোমুখি হয়, জীবন তাদের খুব দ্রুত বড় করে তোলে।
‘থলামুয়ানা।’ অলিভিয়া বলে ডাকল।
নয়না দৃষ্টি ঘুরিয়ে বলে, ‘জ্বি, বাবা।’
‘তৈরি হও। আমাদের এখন রওনা দিতে হবে। দুর্গম রাস্তা, রাতের অন্ধকার আর হিংস্র প্রাণীদের ফাঁকি দিয়ে পৌঁছাতে হবে গন্তব্যে।’
নয়না বলল, ‘আমি প্রস্তুত।’
রাতের অন্ধকারে থলামুয়ানার হাত ধরে সামনে এগিয়ে যাচ্ছে নয়না।
মেইন রাস্তায় যখন পৌঁছাল, তখন ভোর চারটা বা সাড়ে তিনটা বাজে। সেখানে দাঁড়িয়ে আছে সিএনজি।
থলামুয়ানা নয়নার হাতে কিছু টাকা গুঁজে দিলেন। সাথে দিলেন তার মেয়ের জন্য তৈরি করা স্বর্ণের চেইন, আংটি।
নয়না বলল, ‘বাবা, এসবের কোনো দরকার নেই। আপনি আমার জন্য যথেষ্ট করেছেন।’
থলামুয়ানা নয়নার মাথায় হাত বুলিয়ে বলে, ‘মা রে, বাবা ডাকের দায়িত্ব অনেক। আমি যতদিন বেঁচে আছি, আমার সামর্থ্য অনুযায়ী করব তোর জন্য। এখানে তেমন কিছুই নেই। তবুও এইটুকুতে আমি আমার সব ভালোবাসা পাঠালাম।’
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
নয়নার চোখের কোণে পানি চিকচিক করছে। রক্তের সম্পর্ক না থাকার পরেও মানুষটা তার এত আপন! যেন বহু জন্মের সম্পর্ক।
‘কাঁদিস না। যা, গাড়িতে গিয়ে বস।’
নয়না বলল, ‘আপনি যাবেন না, বাবা?’
‘না, আমার সফর এই পর্যন্ত। ভোর হওয়ার আগেই আমাকে ফিরতে হবে। যাতে কারো সন্দেহ না হয়। যা, ভালো থাকিস। কোনোদিন যদি দুঃখ তোর কাছে আসে, মনে রাখিস, দুঃখ কেবল দুর্বল মানুষকে ভাঙতে পারে না। ওখানে থাকতে ইচ্ছে না করলে চলে আসবি এই বাবার কাছে।’
নয়না সিএনজিতে উঠে বসল। নয়নার চোখ থেকে অশ্রু ঝরছে। এতগুলো দিন মায়া, ভালোবাসা, স্নেহ দিয়ে আগলে রেখেছে এই মানুষটা। নয়নার ইচ্ছে করছে এখানেই থেকে যেতে। এমন মানুষ এখন আর কই পাওয়া যাবে? যে নিঃস্বার্থভাবে ভালোবাসতে পারে?
নয়না বাস স্টেশনে পৌঁছে দেখে ঈশান দাঁড়িয়ে আছে।
ঈশান এগিয়ে এসে বলে, ‘কোনো কষ্ট হয়নি তো আসতে?’
এরকম উদ্ভট প্রশ্ন শুনে বিরক্ত হল নয়না। ‘না, কিসের কষ্ট? আমি তো রোলারকোস্টারে চড়ে চলে এসেছি, খুব আরামে।’
‘ওহ, সরি। বেশি কষ্ট হয়েছে?’
‘মোটামুটি। বাস ক’টায় ছাড়বে?’
‘পাঁচটায়। চলুন, সামনের রেস্তোরাঁ থেকে নাস্তা সেরে নিই।’
‘আমার খিদে নেই।’
‘ওখানে বসতে হবে এক ঘণ্টা।’
‘আচ্ছা, চলুন।’
এরপর আর দুজনের মধ্যে কোনো কথা হল না। ঈশান জিজ্ঞেস করতে চাইছিল কিছু, কিন্তু নয়নার হাবভাব দেখে আর কিছু জিজ্ঞেস করল না।
অবশেষে ঈশান আর নয়না বাসে এসে বসেছে।
নয়না বসে আছে বাসের জানালার ধারের সিটে। তার পাশেই বসে আছে ঈশান।
নয়না বলল, ‘আমাদের পৌঁছাতে কত ঘণ্টা সময় লাগবে?’
‘ছয়/সাত ঘণ্টা।’
‘আমরা এখন কোথায় যাব?’
‘এখন আমার বাসায় যাব। তারপর আপনাকে আপনার বাসায় পৌঁছে দিয়ে আমার দায়িত্ব শেষ।’
‘আমি আপনার বাসায় যাব না। আপনি আমার সাথে সোজা আমার বাসায় যাবেন।’
‘যেমনটা আপনার ইচ্ছে।’
‘আপনার মোবাইলটা দিন তো।’
ঈশান নিজের ফোনটা বাড়িয়ে দিল নয়নার দিকে।
‘ইয়ারফোন নেই?’
ঈশান বলল, ‘আপনার কোনো টেনশন হচ্ছে না?’
‘না, হচ্ছে না। ভাবছি সবাই কী রিয়্যাকশন দেবে। সে যাই হোক, আমার প্ল্যান আছে নিজস্ব।’
‘সেটা কেমন?’
‘সেটা আপনাকে বলব না।’
‘ওকে।’
মিতা বেগম নাজিম চৌধুরীকে বলল, ‘তুমি আমাকে নিয়ে চলো থানায়। আমি এক মুহূর্তে চিনে ফেলব কে আমার জিয়ান, কে আমার জাহিন। তোমাকে বলেছিলাম আমার ছেলেকে ফিরিয়ে আনতে। আর তুমি আমার আরেক ছেলেকেও জেলে রেখে এসেছ!’
‘আমি বুঝতে পারছি না কী হচ্ছে? আমি নিজেও কনফিউজড। কী হচ্ছে, আমি কিছু বুঝতে পারছি না।’
অন্তর এসে বলে, ‘আঙ্কেল, আপনি এত টেনশন নিচ্ছেন কেন? আমি এমনভাবে কেস ঘুরিয়ে দেব, আপনার দুই ছেলেই মুক্ত হবে। একটু ধৈর্য ধরুন। আর আপনারাও এমন ভাব ধরেন যে বুঝতেই পারছেন না কে জাহিন, কে জিয়ান।’ মিতা বেগমের হাত ধরে বলে, ‘আন্টি, আমার ওপর ভরসা রাখুন। আমি আপনার নির্দোষ ছেলেকে শাস্তি পেতে দেব না।’
‘আমার বুকটা খালি হয়ে গেছে, বাবা। আমার ছেলেদের আমার কাছে ফিরিয়ে দাও।’
‘আপনি চিন্তা করবেন না। আমি চেষ্টা করব। ইনশা আল্লাহ সফল হব।’
মেহনুর দাঁড়িয়ে আছে অদূরে। একমাত্র মেহনুরের মধ্যে কোনো হেলদোল নেই। মেহনুর নিজের পেটের ওপর হাত রেখে বলে, ‘কারো কিছু হবে না রে। শুধু হবে তোর আর আমার। তোর বাবা তো তার পাপের শাস্তি একদিন পাবেই। কিন্তু আমরা দুজন কোনো অন্যায় না করেও সারা জীবন শাস্তি পাব। আমাকে ক্ষমা করে দিস। আমার জন্য তোকেও এই যন্ত্রণা সহ্য করতে হবে।’
অন্তর চলে আসল। আগামী শুনানি আবার রবিবার। ততদিনে আরো এমন কিছু করতে হবে, যাতে জাহিন নিজের মুখে সত্যিটা প্রকাশ করে। যদিও সবকিছু সেভাবেই সাজানো, শুধু দাবার চাল ঠিকমতো দিতে পারলেই বাজি জিতে যাব।
অনিকেত সায়নাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদছে।
সায়না সযত্নে আগলে রেখেছে অনিকেতকে।
অনিকেত বলল, ‘আমি জানতাম আমি এতিম। এটা জেনেই আমি বড় হয়েছি। আমি এটার সাথে মানিয়ে নিয়েছিলাম। তারপর জানতে পারলাম সুশীল সমাজের কেউ একজন আমাকে জন্ম দিয়ে এতিমখানায় ফেলে রেখে গেছে। এটা জানার পর আমি ভেঙে পড়েছিলাম, জানো। মনে হয়েছিল আমার মায়ের বোঝা ছিলাম আমি। যাকে ফেলে দিয়ে সে শুধু বেঁচে পালাতে চেয়েছে। এরপর আমি জানতে পারলাম আমার জন্মদাতা এতিমখানায় টাকা দিচ্ছে যাতে কোনোভাবেই আমি জানতে না পারি তাদের পরিচয়। আচ্ছা, বল তো, আমি কি এত খারাপ? আমাকে একটু ও ভালোবাসা যায় না? আমি এত নিকৃষ্ট। জানো, ইচ্ছে করছিল নিজেকে শেষ করে দিই। পাঁচ দিন আমি পড়ে ছিলাম হোস্টেলে। মনে হচ্ছিল পৃথিবীর জন্য আমি এক অভিশাপ। আমার চেহারা আমার কাছে ঘৃণিত মনে হচ্ছিল।
আমি মরতে চেয়েও মরতে পারলাম না। শুধু তোমার জন্য পারলাম। পৃথিবীতে একজনের ভালোবাসা যথেষ্ট বেঁচে থাকার জন্য। তুমি আমাকে কখনো ছেড়ে যাবে না তো?’
সায়না অনিকেতকে জড়িয়ে ধরে বলে, ‘আমি তোমাকে কোনোদিন ছেড়ে যাব না। কোনোদিন না। কখনো কষ্ট পাবে না এমন মানুষদের জন্য যারা তোমার মতো ছেলে পেয়েও মূল্য দিতে পারেনি। দুর্ভাগ্য তাদের, যারা তোমার মতো ছেলেকে পেয়েও হারিয়েছে। তুমি হাজারের মধ্যে না, লাখের মধ্যে একজন।’
একে অপরকে জড়িয়ে ধরে শুষে নিতে থাকল একে অপরের দুঃখ। মনের মতো জীবনসঙ্গী পেলে জীবনে কোনো দুঃখ স্থায়ী হতে পারে না।
জিয়ান হাঁটুতে মাথা গুঁজে বসে আছে। মনে মনে তার একটাই চাওয়া। এতকিছুর পরেও যেন তার প্রিয়তমাকে ফিরে পায়।
হঠাৎ একজন পুলিশ এসে বলে, ‘স্যার, আপনি কি জাহিন?’
জিয়ান কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলে, ‘সেটা আপনাকে কেন বলব?’
‘আগে নাম বলুন, তারপর বলছি। উপর মহল থেকে আপনার জন্য সুখবর আছে, স্যার।’
জিয়ান বলল, ‘বলুন, আমিই জাহিন।’
পুলিশ জিয়ানের হাতে তিনটা চাবি ধরিয়ে দিয়ে বলে, ‘রাতে চুপচাপ পালিয়ে চলে যাবেন। বাইরে আপনার জন্য সব ব্যবস্থা করা আছে। রাত দুটো বাজে বের হবেন, তখন রাস্তা ক্লিয়ার করে রাখব।’
জিয়ান কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলে, ‘উপর মহল আমাকে পালাতে কেন বলছে! তাদের বলো, জাহিনকে যদি সসম্মানে বাইরে বের না করে, তাহলে জাহিন তাদের নাকে দড়ি দিয়ে ঘোরাবে। তাদের বড় বড় রাঘব বোয়ালের পাপের তালিকা কিন্তু প্রমাণসহ আমার হাতে আছে। যেয়ে বলো, জাহিন চৌধুরী পালাবে না। জাহিন চৌধুরী এত দুর্বল না।’
পুলিশ অফিসার নিজেও এবার কনফিউজড হয়ে গেল। বাইরে এসে একজন মন্ত্রীকে কল করে বলে, ‘স্যার, কোনো পাখিই টোপ গিলল না। দুজনের কথার ধরনও প্রায় সেম। শালার, বুঝতেই পারছি না কোনটা জাহিন স্যার আর কোনটা তার ভাই! বিশাল জটিলতা, স্যার, কী করব এখন।’
অর্ধাঙ্গিনী দ্বিতীয় পরিচ্ছদ পর্ব ১০
‘জাহিনকে আলাদা করতে হবে, যে করেই হোক। ওই শালা মুখ খুললে আমরা বিতর্কে জড়িয়ে পড়ব। যদিও আপা আমাদের বাঁচিয়ে নেবে, কিন্তু জাল ঘোলা হবে। শালাকে বের করে সোজা এনকাউন্টারে খতম করে দিব। শালার মাথায় হাজার পাওয়ারের বুদ্ধি।’
‘কিন্তু স্যার, কীভাবে আলাদা করব?’
‘বলবা জমশেদকে শেষ করছে নাকি কোনো আয়না ঘরে রেখেছে। দুজনকে সেম প্রশ্ন করবা। যেই শালা সঠিক উত্তর দেবে, ওই শালাই আসল মাল।’
