অর্ধাঙ্গিনী দ্বিতীয় পরিচ্ছদ পর্ব ১২
নুসাইবা ইভানা
নয়না বাসায় আসল ঠিক দুপুর একটা বাজে। তাঁতের তৈরি জলপাই রঙের একটা শাড়ি পরা। চুলগুলো হাত খোপা করা। নিজের বাসার দরজায় দাঁড়িয়ে কলিং বেল চাপল নয়না।
“ঈশান বলে, আসলেই এটা আপনার বাসা তো?”
“আপনার সমস্যা কী? আমাকে দেখে কি আপনার মনে হয় আমি কোনো অসহায় এতিম? অথবা রেললাইনে পড়ে থাকা অসহায় মেয়ে যার কোনো পরিবার নেই?”
“আপনি সব সময় ভুল মিনিং বের করেন আমার কথার। আমি বলতে চেয়েছি আপনার বাসা ঠিকঠাক চিনে আসতে পারলেন নাকি?”
“শুনুন, বাসায় ঢুকে আপনি একদম আপনার মুখ বন্ধ রাখবেন। একদম মুখ খুলবেন না। চুপ করে থাকবেন। আপনাকে যা কিছু জিজ্ঞেস করুক আপনি তবুও চুপ করেই থাকবেন। আগ বাড়িয়ে কিছু বলবেন না।”
সুচনা টিভি দেখছিল বাসার রুমে বসে বসে। কলিং বেলের আওয়াজ পেয়ে দৌড়ে এসে দরজা খুলে দিল। কিন্তু তার সামনে নয়নাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে চিৎকার করে উঠল।
জাহানারা বেগম তখন পায়চারি করছিলেন রুমের মধ্যে। তার মাথা ঠিক নেই। বেশিরভাগ সময় সে কেবল তার ছেলে নাফিকে কল্পনা করে। মাঝে মাঝে নয়না বলে চিৎকার করে উঠে। পুরোপুরি পাগল না হলেও মাঝে মাঝে তার ব্রেন ঠিকভাবে কাজ করে না।
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
জাহানারা বেগম ছুটে আসলেন চিৎকার শুনে। নয়না জাহানারা বেগমকে দেখে ছুটে এসে জড়িয়ে ধরে বলে, “আম্মু, তুমি কেমন আছো? এই অবস্থা কেন তোমার?”
জাহানারা বেগমের মধ্যে কোনো হেলদোল নেই। তিনি বরং অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন সামনে দাঁড়িয়ে থাকা ঈশানের দিকে।
নয়না বলল, “আম্মু, কী হলো, কথা বলছো না কেন?”
কিছুক্ষণ পর জাহানারা বেগম বললেন, “কে তুমি? আমাকে এভাবে ধরে আছো কেন?”
ঈশান নয়নার দিকে তাকাল।
নয়না তখন জাহানারা বেগমের দিকে তাকিয়ে বলে, “আমাকে চিনতে পারছো না আম্মু? আমি তোমার সুনয়না।”
নয়নাকে মাহবুব তালুকদারের হাতে তুলে দিয়ে ঈশান সবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে চলে আসল।
মাহবুব তালুকদার নিজের চোখকে যেনো বিশ্বাস করতে পারছে না! নয়নাকে দেখে জড়িয়ে ধরে চোখের জল ফেললেন।
নয়না সবার সাথে কথা বলে নিজের রুমে চলে গেল। মাহবুব তালুকদার নয়নাকে বেশি কিছু জিজ্ঞেস করলেন না। শুধু বললেন, “আজ রেস্ট নে। যা বলার পরে বলিস। নিজেকে সময় দে কিছুটা।”
নীলাঞ্জনার কোলে একটা ছেলে। ছেলেটাকে নিয়ে রুমের দরজায় দাঁড়িয়ে দেখল নয়নাকে। ছেলেটা দেখতে একদম লাবিবের মতো। সারাজীবন চাইলেও ওই মানুষটাকে ভোলা যাবে না এই চেহারার জন্য।
ঈশানকে খাবার খাইয়ে তারপর ছাড়লেন মাহবুব তালুকদার।
ঈশান রওনা দিল নিজের গন্তব্যে।
অন্তর আজ সারারাত কেস স্টাডি করবে। আগামীকাল শেষ চালটা তাকে খুব সতর্কভাবে চালতে হবে। যদিও রাজা এখন তার কবলে, তবুও সামান্য ভুল হলেই জেতা কেস হেরে যেতে হবে।
তুষি অনেকবার অন্তরকে কল করেছে। অন্তর মোবাইল সাইলেন্ট করে রেখেছে। আজ অন্য কোথাও বিন্দু পরিমাণ সময় নষ্ট করতে চাইছে না। অন্তর তুষির কল দেখে কেটে দিল। ছোট একটা টেক্সট পাঠাল, “আমি ব্যস্ত।”
অন্তর মোবাইল রাখবে তখন তুষির টেক্সট আসে, “ওহহ, এখন আমার জন্য কোনো সময় নেই?”
অন্তর লিখল, “তোমার জন্য যে জীবনগুলো নষ্ট হওয়ার দারপ্রান্তে সেগুলো ঠিক করার জন্য ব্যস্ত। না তুমি ওরকম চিপ মজা করতে, আর না আজ এসবে আমাকে জড়াতে হতো। আচ্ছা, মানুষের মনকে কি তোমার খেলার মাঠ মনে হয়? কীভাবে ওইটুকু বয়সে এমন জঘন্য খেলটা খেলেছো? সামান্য কয়টা চকোলেটের জন্য কারো মনের সাথে হাডুডু খেললে!”
অন্তর নিজের ভেতর জমে থাকা রাগটা যেনো উগলে দিল।
তুষি আর কোনো রিপ্লাই করল না।
নয়না নিজের রুমে এসে অবাক হয়ে গেল। একদম চকচকে সব কিছু, কী সুন্দর করে গোছানো! নয়না নিজের বেডে শুয়ে চোখ বন্ধ করে রাখল। হুট করে আবার উঠে এসে নিজের মোবাইল খুঁজতে লাগল। ড্রয়ারে পড়ে আছে। কিন্তু মোবাইল বন্ধ। নয়না চার্জার খুঁজতে লাগল। না পেয়ে নীলাঞ্জনার রুমে আসল।
নীলাঞ্জনা তখন তার বাচ্চাকে ফিডিং করাচ্ছে।
নয়না রুমে ঢুকে অবাক হয়ে বলে, “এটা তোমার বেবি!”
নীলাঞ্জনা বলল, “হুম।”
“বয়স কত ওর?”
“দেড় মাস।”
নয়না ফোন চার্জে দিয়ে নীলাঞ্জনার ছেলেকে কোলে তুলে নিল। কপালে, গালে চুমু খেয়ে বলে, “নাম কী ওর?”
“নীলাদ্রি আহসান নীল।”
“বাহহহ, নীলাঞ্জনার ছেলে নীলাদ্রি। ছোট করে নীল। কী মিষ্টি দেখতে। ইচ্ছে করছে টুপ টুপ করে শুধু চুমু খাই।”
“এতদিন কোথায় ছিলি?”
“ট্যুরে গিয়েছিলাম।”
“মজা করছিস? তোকে আমি চিনি। তোর তো বাসা থেকে বের হওয়ারও সাহস নেই একা। বল, কী হয়েছিল তোর সাথে?”
নীল ততক্ষণে ঘুমিয়ে পড়েছে নয়নার কোলে। নয়না আলতো করে নীলাদ্রিকে বেডে শুইয়ে দিয়ে ছোট মশারি টেনে দিল।
নিজের মোবাইলটা হাতে নিয়ে অন করে বলে, “একি, আমার মোবাইল ফাঁকা কেন! কারো কোনো কল, টেক্সট কিছুই নেই কেনো?”
“জানিনা। তোর মোবাইল তো পুলিশের কাছে ছিল।”
“আশ্চর্য, তারা আমার ফোন থেকে এসব ডিলিট কেন করেছে?”
“আমি কী করে বলব?”
নয়না নিজের ফোন নিয়ে রুমে চলে আসল। চার্জে দিয়ে কাঁদতে লাগল সে। তার আর জিয়ানের সব স্মৃতি মুছে গেছে। আচ্ছা, যে মানুষটা নিজের হাতে তাকে হত্যা করতে চাইল, তার স্মৃতি মুছে যাওয়ার দুঃখ তার হৃদয় কেন স্পর্শ করছে! মানুষ কি কেবল বেঁচে থাকে স্মৃতি আঁকড়ে?
নয়না জিয়ানের হোয়াটসঅ্যাপ মেসেজ টাইপ করল:
“প্রিয় অপ্রিয় মানুষ, আজকের পর থেকে আপনি মনে করবেন আপনার জন্য আমি কোনোদিন পৃথিবীতে ছিলাম না। অথবা আমি মৃত। নয়ত এরপর যতদিন আপনি বেঁচে থাকবেন, আপনার নিজের প্রতি করুণা হবে, আফসোস হবে, যন্ত্রণা হবে। যতদিন বেঁচে থাকবেন আপনার মনে হবে আমাকে হারানোর মতো দুর্ভাগা মানুষ আপনি। অন্যকে দোষ দিয়ে বেঁচে থাকা সহজ, তবে নিজের কাছে নিজে দোষী হয়ে বেঁচে থাকা মৃত্যুর যন্ত্রণার চেয়েও কষ্টসাধ্য। আপনি বেঁচে থাকবেন যেভাবে সর্বহারা মানুষ বেঁচে থাকে। আপনি পাগলের মতো আমার কাছে ফিরতে চাইবেন। অথচ তখন ফেরার সব পথ বন্ধ। আমিও তখন নিজের জীবন সাজাতে ব্যস্ত আর আপনি কেবল দিশেহারা পথিক। আপনার কথা আমার মনে পড়বে। ভালোবাসার স্মৃতি ভুলে যাওয়া যায় না। তবে সেই মনে পড়ায় থাকবে আমার রুহের হায়, আমার সরল ভালোবাসাকে কলুষিত করার দীর্ঘশ্বাস কিংবা দু’ফোঁটা চোখের জল। আমি জানি ক্ষমা করা মহৎ গুণ, কিন্তু আপনি তো ক্ষমার অযোগ্য। তবুও আপনি ভালো থাকুন, তবে সেই ভালো থাকায় মিশে থাকুক দহন।”
নয়না সেন্ট করে দেখে মেসেজ ডেলিভারি হচ্ছে না।
মোবাইল রেখে দিয়ে মনে মনে বলে, “আপনি হয়তো ফ্লাইটে আছেন। আচ্ছা, একটা মানুষের জীবন শেষ করে কীভাবে আপনি সুস্থ স্বাভাবিক জীবন কাটাচ্ছেন! আমার সাথে করা অন্যায়ের কথা কি আপনার একবারও মনে পড়ছে না?” নয়নার দু’চোখ বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়ছে। কী অদ্ভুত, সে কান্না করতে চায় না এমন মানুষের জন্য যে মানুষ তাকে মৃত্যুর মুখে ছেড়ে দিয়ে ছিল। কান্না করতে করতে নয়না ঘুমিয়ে পড়ে।
একটা সকাল মানে একটা নতুন সম্ভাবনা। অন্তর রেডি হচ্ছে কোর্ট যাওয়ার জন্য। বাসা থেকে বের হয়ে সোজা কোর্টে আসল।
মাহবুব তালুকদার, মিজান তালুকদারও এসেছে। আপাতত নয়নার ফিরে আসার সংবাদ সে প্রকাশ করতে চাইছে না। চৌধুরীদের শিক্ষা দেওয়ার এই সুযোগ হাতছাড়া করতে চাইছে না মাহবুব তালুকদার।
“ইউর অনার, আসামি জিয়ান রেজা চৌধুরী নিজের হাতে তার স্ত্রীকে হত্যা করেছে। আপনার টেবিলে একটা মেমোরি কার্ড আছে, সেখানে সে নিজের মুখে এসব স্বীকার করেছে। মাননীয় জজ সাহেব, এরকম খুনিকে সর্বোচ্চ শাস্তি দেওয়ার আবেদন জানানো হলো।”
অর্ধাঙ্গিনী দ্বিতীয় পরিচ্ছদ পর্ব ১১
জজ সাহেব বললেন, “এদের মধ্যে জিয়ান কে?”
“ইউর অনার, গত শুনানিতে আমি স্পষ্ট করেছিলাম। ওই যে ক্লিন শেভ করা নায়কের মতো সেজে থাকা মানুষটাই আসল কালপ্রিট। আর ওই যে কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে আছে আমার মক্কেল জাহিন চৌধুরী। যে কারাগারের অন্দরমহলে ধুঁকে ধুঁকে নিজেকে দুর্বল করে ফেলেছে। একজন অপরাধী প্রকাশ্যে ঘুরছে আর একজন নিরপরাধ কারাগারে শাস্তি পাচ্ছে! আপনার কাছে আমি অনুরোধ করছি, আসল অপরাধীকে শাস্তি দিন। আর নিরপরাধ মানুষটাকে মুক্তি দিন। আইনের নিয়মে কোনো নিরপরাধ ব্যক্তি শাস্তি পেতে পারে না।”
হঠাৎ করে নয়না কোর্টে ঢুকে বলে, “জজ সাহেব, আমি জানি কে আসল অপরাধী।”
