অর্ধাঙ্গিনী দ্বিতীয় পরিচ্ছদ পর্ব ১৫
নুসাইবা ইভানা
নয়না জিয়ানের কথা উপেক্ষা করে সামনে পা বাড়াল। জিয়ান নয়নার হাত ধরে বলে, “সত্যি আমাকে একা ফেলে চলে যাবে? তোমার কষ্ট হবে না আমাকে কষ্ট দিতে?”
নয়না সামনের দিকে ঘুরে বলে, “হাত ছাড়ুন।”
“ছাড়ার জন্য ধরিনি। সারাজীবন ধরে রাখার জন্য ধরেছি। এটা আমার অধিকার। এত নিষ্ঠুর হচ্ছ কেন, অর্ধাঙ্গিনী? একটুও মায়া হচ্ছে না এই অসহায় প্লেন ড্রাইভারের জন্য?”
“নাহ, হচ্ছে না। মায়া মরে গেছে?”
“তুমি কি জানো, তোমার মুখ থেকে ‘প্লেন ড্রাইভার’ ডাক শোনার জন্য আমি ব্যাকুল হয়ে আছি।”
নয়না হাত ভাঁজ করে বলে, “আচ্ছা। মিস্টার জিয়ান রেজা চৌধুরীর তো এই ডাকটা ভীষণ অপছন্দ ছিল। হুট করে পছন্দ হওয়া শুরু করলেন কবে?”
“যেদিন থেকে সুনয়না নামের হৃদয়হরণী আমার হৃদয় দখল করেছে, সেদিন থেকে।”
“যাব না আমি।”
“আমার চোখের দিকে তাকিয়ে বলো।”
“পারব না।”
“বলো, সাহস নেই আমার চোখে চোখ রেখে ‘না’ বলার। আমার চোখের কাছে হেরে যাবে তুমি, ভীতু মেয়ে।”
“হুম, আমি ভীতু।”
“জান, চলো না, এমন করছ কেন! কতদিন রাতে একটু প্রশান্তিতে ঘুমাতে পারিনি। আজকে রাতটা তোমাকে জড়িয়ে ধরে শান্তিতে ঘুমাতে চাই।”
নয়না হাঁটা শুরু করল।
জিয়ান নয়নার সামনে এসে দাঁড়িয়ে বলে, “তুমি শুধু আমার ডিয়ার বাটার মাশরুম। যত দূরেই যাও, ফিরে তোমাকে আমার কাছেই আসতে হবে।”
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
“যাব না আপনার সাথে।”
জিয়ান নয়নাকে কোলে তুলে নিয়ে বলে, “না বলার কোনো অপশন নেই, বাটার মাশরুম। বেশি বাড়াবাড়ি করলে রাস্তাঘাটে চুমু খেতে শুরু করব কিন্তু।”
“নামান কোল থেকে, লোকে দেখছে।”
“লোকে দেখলে দেখুক। আমার বৌকে আমি কোলে নেব, মাথায় নেব, তাতে কার কী!”
“লজ্জা-শরম নেই?”
“নাহ, একদম নেই। বৌয়ের আঁচলের তলেই লজ্জা-শরম সেই কবে জমা রেখে দিয়েছি।”
“নামান।”
“তুমি করে বলো ‘বৌ’।”
“বাবা ভীষণ রাগ করবে এভাবে চলে গেলে। এমনিতেই তাদের না জানিয়ে এসব করেছি।”
জিয়ান নয়নাকে নিয়ে গাড়িতে বসল। “শোন, শ্বশুরমশাই যা করেছে, এরপর সে রাগ করবে নাকি আমার রাগ করার কথা? আমার তো তোমার সাথে ও রাগ করা উচিত। কিন্তু ভালোবাসি বলেই এতদিন পর তোমাকে কাছে পেয়ে রাগটা করতে পারছি না। তুলে রাখলাম। হু। ড্রাইভার, সোজা চৌধুরী ম্যানশন চলো।”
“জি, স্যার।”
নয়না ড্রাইভারকে বলল, “আঙ্কল, ভুলে যাচ্ছেন, আপনাকে সেলারি আমার বাবা দেন।”
জিয়ান বলল, “আমি যেটা বলেছি, আপনি সেটাই করুন। চাকরি গেলে ডাবল সেলারি-সহ চাকরি দেব আপনাকে।”
জিয়ান নয়নাকে নিজের দিকে টেনে এনে বলে, “অনেক হয়েছে, প্লিজ এবার থামো। আমি খুব ক্লান্ত।” বলেই নয়নার কাঁধে মাথা রাখল। “তুমি জানো, সেদিন রাতে আমার বড় একটা অ্যাক্সিডেন্ট হয়েছিল তোমাকে খুঁজতে বের হয়ে। হয়তো আর কোনোদিন আমাদের দেখা হতো না, যদি সেদিন বেঁচে না ফিরতাম।”
নয়না জিয়ানের ঠোঁটের ওপর আঙুল রেখে বলে, “তোমাকে আমি এ জীবনে আর হারাতে চাই না।”
জিয়ান নয়নাকে জড়িয়ে ধরে বলে, “আমিও তোমাকে হারাতে চাই না, বাটার মাশরুম।”
জিয়ান নয়নাকে নিজের সাথে আগলে রাখল পুরোটা রাস্তা। এত ঝড়-ঝাপ্টার পর দু’জন পাশাপাশি আসতেই যেন সব কষ্ট, সব দুঃখ বিলীন হয়ে গেছে। মনের মধ্যে এমন ফিলিংস হচ্ছে, যেন কখনো কিছুই হয়নি। সাময়িক বিচ্ছেদ কি ভালোবাসার গভীরতা বাড়িয়ে দেয় কয়েক গুণ?
রাত একটায় গাড়ি এসে থামল চৌধুরী ম্যানশনে। বাড়ির প্রায় সবাই তখন গভীর ঘুমে। শুধু জেগে আছে নাজিম চৌধুরী। জাহিনের পুরো সত্যিটা জেনে সে ভেতর থেকে ভেঙে পড়েছে। কীভাবে সবাইকে বলবে, জাহিন সুনয়নাকে হত্যা-চেষ্টা করেছিল! আমাদের জাহিন কীভাবে এমন হলো! বারান্দায় পায়চারি করছিলেন তিনি। গাড়ির শব্দ শুনে নিচে চলে আসেন। নিচে এসে মেইন দরজা খুলে দাঁড়ান।
জিয়ান আর নয়না গাড়ি থেকে নেমেই দেখে, নাজিম চৌধুরী সামনে দাঁড়িয়ে আছে।
জিয়ান ছুটে এসে নাজিম চৌধুরীকে জড়িয়ে ধরে। নাজিম চৌধুরী জিয়ানকে জড়িয়ে ধরেন। বাবা-ছেলে একে অপরকে জড়িয়ে রাখে কিছুক্ষণ। নাজিম চৌধুরীর চোখের কোণে খানিক অশ্রু এসে ভিড় জমিয়েছে।
নাজিম চৌধুরী জিয়ানকে বললেন, “তোর মা চোখের নিচে কালি বসিয়ে ফেলেছে, তোর ফেরার অপেক্ষায় কেঁদে কেঁদে।”
“বাবা, সত্যের জয় একদিন হবেই। হয়তো একটু আগে, নয়তো একটু দেরিতে। তবে কষ্টটা কোথায় জানো বাবা, নিজের রক্তের ভাইয়ের জন্য এতগুলো মানুষ কষ্ট পেল। অথচ এখনো ওর মধ্যে কোনো অনুতাপ নেই।”
“যেদিন অনুতপ্ত হবে, সেদিন খুব দেরি হয়ে যাবে। তোরা রুমে গিয়ে ফ্রেশ হ। আমি একজন সার্ভেন্টকে ডেকে তুলে তোদের জন্য খাবার পাঠাচ্ছি।”
নয়নার মাথায় হাত বুলিয়ে বলেন, “আমাকে ক্ষমা করে দিও মা। আমার ছেলের জন্য তোমাকে না জানি কত কী সাফার করতে হয়েছে।”
“বাবা, আপনার তো কোনো দোষ নেই। নিজেকে দোষী ভাববেন না। যা হওয়ার হয়ে গেছে, সে-সব এখন অতীত।”
নয়না আর জিয়ান রুমে আসল। এতদিন পর নিজের রুমে। এই ঘরটা জুড়ে রয়েছে কত সুখ-দুঃখের স্মৃতি। কত পাওয়া-না-পাওয়ার গল্প।
জিয়ান দরজা লক করেই সোজা নয়নাকে জড়িয়ে ধরল।
এতদিন পর প্রিয় পুরুষের স্পর্শে নয়না লজ্জায় নুয়ে পড়ল।
🌿 সায়না নিজের গালে হাত দিয়ে বসে আছে। চোখ থেকে টুপটুপ করে অশ্রু ঝরছে। অনিকেতের দিকে তাকিয়ে বলে, “সামান্য একজন পরিচিতা মেয়ের জন্য এ অবস্থায় আমার গায়ে হাত তুললে! ওই মেয়ে তোমার কাছে এত ইম্পর্ট্যান্ট? তাহলে ওই মেয়েকে এনেই সংসার করো। আমি থাকব না তোমার সংসারে। তুমি শুধু আমাকে আঘাত করোনি, আমার সাথে সাথে আমাদের অনাগত সন্তানকেও আঘাত করেছ। যাও, নিজের বন্ধুর বৌকে এনে সংসার সাজাও। এতই যখন দরদ, তাহলে আমার সাথে কী?”
অনিকেত চিৎকার করে বলে, “সায়না, মুখ সামলে কথা বলো।” হাত উঠিয়েও আবার গুটিয়ে নিল অনিকেত।
“থামলে কেন? ডাক্তার অনিকেত মাহমুদ তার আসল রূপ দেখাক। একটা বাইরের মেয়ের জন্য কোর পুরুষ ঘরের বৌয়ের গায়ে হাত তোলে, জানেন। চরিত্রহীন পুরুষ কিংবা কাপুরুষ।”
“সুনয়না বাইরের মেয়ে না। আর না ও বাজে মেয়ে। সুনয়না আমার বোন। আমার রক্তের বোন। আমার বোনকে নিয়ে একটাও বাজে কথা আমি সহ্য করব না। তোমার মতো একজন এডুকেটেড মেয়ের চিন্তাভাবনা এত চিপ, আমি ভাবতেও পারছি না! নিজে একটা মেয়ে হয়ে আরেকজন মেয়ের ব্যাপারে এত জঘন্য কথা বলতে তোমার একটুও বাধল না? নিজেকে ওই মেয়ের জায়গায় কল্পনা করো। তোমাদের মতো মেয়েরাই মেয়েদের শত্রু। যারা ধর্ষককে না, ধর্ষিতা নারীকে অপবাদ দেয়।”
সায়না নিজের ভুল কিছুটা বুঝতে পারল। অনুতপ্ত হয়ে বলে, “স্যরি।”
অনিকেত বলে, “স্যরি! খুন করে স্যরি বললে মৃত মানুষটা জীবিত হয়ে যায়? কথা হল ধারালো ছুরি। কথার আঘাতে মানুষের হৃদয় ছিন্নভিন্ন হয়ে যায়। তাই কথা বলার আগে ভেবে-চিন্তে বলতে হয়।”
“সুনয়না তোমার রক্তের বোন কী করে হল? তুমি তো এতিম, তোমার তো কেউ নেই। তুমি তো নিজেই জানো না তোমার বাবা-মা কে? তাহলে সুনয়না তোমার রক্তের বোন কী করে হল?”
অনিকেতের টনক নড়ল সবে। কথার তেজে মুখ ফসকে সত্যিটা বের হয়ে গেছে। এখন কী করবে? মিথ্যে বলবে, নাকি সত্যিটা বলে দেবে সায়নাকে?
“কী হলো, কী ভাবছ, উত্তর দাও? সুনয়নার সাথে তোমার কিসের সম্পর্ক? তোমার আর ওর মধ্যে রক্তের সম্পর্ক কী করে আসতে পারে? ওর তো কোনো ভাই-বোন কিছু নেই।”
অনিকেত সায়নার হাত ধরে সোফায় বসাল। নিজে বসে পড়ল ফ্লোরে। সায়নার হাত ধরে বলে, “আমার তোমার গায়ে হাত তোলা উচিত হয়নি। তোমারও আরেকজন মেয়ের ব্যাপারে সবটা না জেনে এভাবে মিথ্যে অপবাদ দেওয়া ঠিক হয়নি।”
“অনি, আমি এসব শুনতে চাই না। আমি জানতে চাইছি। তোমার আর সুনয়নার মধ্যে রক্তের সম্পর্ক কী করে আসল? সত্যিটা বলো আমাকে।”
“কিছু সত্যি প্রকাশ করতে নেই। আমিও এই সত্যিটা চেপে যেতে চাইছি, সায়না।”
অর্ধাঙ্গিনী দ্বিতীয় পরিচ্ছদ পর্ব ১৪
“অনি, আমি জানতে চাই। আমাকে বলতেই হবে এই রহস্যের পেছনে কী সত্য লুকিয়ে আছে। আমি তোমাকে একদিন বলেছি, আমার কাছে কোনো কিছু লুকাবে না। তোমার সব সত্য জানার অধিকার আমার আছে। আমি তোমার অর্ধাঙ্গিনী, তোমার সুখ, দুঃখ, ভালো-খারাপ সবটা শোনার অধিকারিণী।”
