অর্ধাঙ্গিনী দ্বিতীয় পরিচ্ছদ পর্ব ২

অর্ধাঙ্গিনী দ্বিতীয় পরিচ্ছদ পর্ব ২
নুসাইবা ইভানা

এ যেনো পূর্ব পরিকল্পনা ছাড়াই হটাৎ আছড়ে পড়া কাল বৈশাখী ঝড়। যে হুট করে এসে নিমিষেই গুড়িয়ে দিয়ে গেছে সাজানো, গোছানো দু’টি জীবন। যে দু’টি মানুষকে ঘিরে তৈরি হয়েছিলো দুটি পরিবারের মেলবন্ধন, আজ তারা হয়ে উঠেছে চিরশত্রু। জাহিন মাথা নিচু করে বসে আছে। তার ইচ্ছে করছে নয়নার মরদেহ খুঁজে এনে টুকরো টুকরো করে কুকুরকে খাওয়াতে। মানুষ কি আর এখন মানুষ আছে?
এই যে জাহিন এখনো দোষ দিয়ে যাচ্ছে নয়নার, অথচ নিজের হাতেই সে সব ধ্বংস করেও দিব্যি অন্যের ঘাড়ে দোষ চাপিয়ে বুক ফুলাচ্ছে। জাহিনের চোখদুটো রক্তবর্ণ ধারণ করেছে, যেনো সামনে থাকা সব কিছু ভস্ম করে দেবে। জাহিনের পাশেই দাঁড়িয়ে আছে নাজিম চৌধুরী। সব সময় দাপট দেখিয়ে চলা মানুষটা আজ কেমন চুপসে গেছে! কেমন বিধ্বস্ত হয়ে দাঁড়িয়ে আছে হসপিটালের করিডোরে।

নাহিদ, অনিকেত এসে পৌঁছালো হসপিটালে। জাহিনের সামনে দাঁড়িয়ে বলে, “এসব কী করে হলো? এইতো কয়েক ঘণ্টা আগেও আমার সাথে ছিলো রেজা। আমাকে ক্লিনিকে নিয়ে গেলো। হুট করে কী হলো?”
জাহিন উঠে দাঁড়ালো, দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো অনিকেতের দিকে। অনিকেতের পায়ে ব্যান্ডেজ করা। চেহারায়ও ক্ষতচিহ্ন। এই প্ল্যানটাও ছিলো জাহিনের। অনিকেতের এক্সিডেন্টটা তারই প্ল্যানের একটা অংশ। ঠান্ডা মাথায় গেম খেলেছে জাহিন।
কিছু ঘণ্টা পূর্বে…

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

জাহিন নয়নাকে পৃথিবী থেকে সরিয়ে দেওয়ার প্ল্যান আগেই করে রেখেছিলো। সেই মতে মাস্টার প্ল্যান সাজিয়েছিলো নিজেই। সর্বপ্রথম তার মাথায় আসলো, নয়না তো মুহূর্তেই বুঝে যায়। খুব সহজেই পার্থক্য করে ফেলতে পারে জাহিন আর জিয়ানের মধ্যে, যেনো অদৃশ্য কোনো ঘ্রাণশক্তি আছে নয়নার। নয়তো প্রতিবার কী করে ধরা পড়ে যায় সে যে জিয়ান না, জাহিন! হাতের আঙুল দিয়ে মাথা স্লাইড করতে করতে এই মহাবিপদের একটা সলিউশন বের করে ফেললো। ওত পেতে ছিলো কখন জিয়ান আর নয়না রুম থেকে বাইরে থাকবে আর কখন সে ওদের রুম থেকে জিয়ানের ব্যবহৃত শার্ট আর পারফিউম চুরি করবে। একদিন সুযোগ বুঝে কাজটা সে করে ফেলে। ড্রেসিং টেবিলের আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে জিয়ানের পছন্দের পারফিউম নিজের শরীরে লাগিয়ে বলে, বারে বারে ঘুঘু তুমি খেয়ে যাও ধান, এইবার ঘুঘু তোমার বাঁধিব প্রাণ। জাহিন কখনো হারতে শেখেনি। ডিটেকটিভ জাহিন চৌধুরী। উন্নতমানের ট্রেনিংপ্রাপ্ত গোয়েন্দা বিভাগের অফিসার। এমনি এমনি তো হয়নি।

জাহিন বাঁকা হেসে বাসা থেকে বের হলো। মার্কেট থেকে একটা নীলরঙা শাড়ি, চুড়ি আর ছোট একটা চিরকুট লিখে পাঠিয়ে দিলো তাদের বাসার সার্ভেন্টের হাতে।
জাহিনের প্ল্যানের প্রথম ধাপ ক্লিয়ার। নয়না যখন মিতা বেগমের রুমে গেলো, সেই সুযোগে আস্তে করে নয়নার ফোনটা সরিয়ে রেখে দিলো ড্রয়ারে। তারপর বাসা থেকে বের হয়ে গেলো। তার সহকর্মী মাহফুজ আনামকে দায়িত্ব দিলো নয়নাকে সাজেকে পৌঁছে দেওয়ার। নিজে প্লেনে করে চলে গেলো আগেই। সেখানে গিয়ে কটেজের খোলা বারান্দার বাঁশের তৈরি রেলিং ভেঙে সেখানে ওয়ান-টাইম রেলিং সেটিং করলো। এই কটেজটা একদম পাহাড়ের চূড়ায়। এখান থেকে কেউ পড়লে তার বাঁচা অসম্ভব। জাহিন নড়বড়ে রেলিং-এ হাত রেখে বলে, কাউকে হত্যা করলে এমনভাবে করা উচিত, যেনো তার প্রাণভোমরা আর কখনো পৃথিবীতে নিশ্বাস নিতে না পারে।

বলেই আকাশের দিকে তাকিয়ে হাসলো। কী সুন্দর ঝলমলে পরিষ্কার আকাশ। মনে হচ্ছে আকাশ যেনো পাহাড়ের কোলে শুয়ে আছে। জাহিন খানিকক্ষণ তাকিয়ে থেকে বলে, হারানো জিনিসের প্রতি মায়া ত্যাগ করতে হয়। মায়া বড্ড খারাপ জিনিস। মায়া মানুষকে ধ্বংস করে দেয়। নারীর মায়ায় পুরুষ যেমন প্রেমিক হয়ে ওঠে, ঠিক তেমনভাবেই নারীর ছলনায় পুরুষ হয়ে ওঠে অমানুষ। নয়না যখন সাজেক পৌঁছালো, তখন রাতের অন্ধকার গ্রাস করেছে দিনের সব আলো। জাহিন নয়নাকে দেখে মুগ্ধ নয়নে কয়েক সেকেন্ড নয়নার দিকে তাকালো। দ্রুত দৃষ্টি সরিয়ে নিয়ে নিজের পরিকল্পনা বাস্তবায়নে মনোযোগ দিলো। নয়নাকে বেশি সময় দেওয়া যাবে না। তার মস্তিষ্ক কিছু বুঝে ওঠার আগেই সবটা শেষ করতে হবে।
নয়না পানি খেতে চেয়েছিলো। অথচ জাহিন নয়নাকে সেই সময়টুকুও দেয়নি। নয়না কিছু বুঝে ওঠার আগেই সুন্দর পৃথিবী ছেড়ে তাকে চলে যেতে হলো।

বর্তমান…
অনিকেত বার কয়েক ডাকলো জাহিনের নাম ধরে।
জাহিন বলে, হ্যাঁ?
কী ভাবছো?
নাহ, কিছু না। আমি একটু আসছি। বলেই দ্রুত প্রস্থান করলো।
জাহিন দ্রুত ওয়াশরুমে চলে আসলো। চোখে-মুখে পানি দিতে লাগলো। জাহিনের গলা শুকিয়ে আসছে। আয়নায় তাকাতেই নয়নার বিধ্বস্ত চেহারা ভেসে উঠলো, কানে বেঁচে উঠলো নয়নার কথা, আমার তৃষ্ণা পেয়েছে, পানি খাবো। জাহিন জোরে জোরে শ্বাস নিলো। চোখে-মুখে বার কয়েক পানির ঝাপটা দিয়ে আয়নার দিকে তাকিয়ে বলে, জাহিন চৌধুরী দুর্বল নয়। জাহিন চৌধুরী দুর্বল হতে পারে না। কত মানুষের খুন হয়েছে এই হাতে। জাহিন, জাস্ট রিলাক্স। ভুলে যা সব।

জাহিন ওয়াশরুম থেকে বের হয়ে আবার জিয়ানের রুমের সামনে এসে দাঁড়ালো।
নাহিদ জাহিনের কাঁধে হাত রেখে বলে, চিন্তা করো না, সব ঠিক হয়ে যাবে। তোমাকে স্ট্রং হতে হবে এখন। তোমার পরিবারকে তোমার সামলাতে হবে। বি স্ট্রং, ইয়াং ম্যান।
হঠাৎ ডাক্তার রুম থেকে বের হয়ে আসলো।
সবাই জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে ডাক্তারের দিকে তাকিয়ে আছে।
ডাক্তার মাথা নত করে বলে, শি ইজ নো মোর। সরি।
জাহিন ডাক্তারের কলার ধরে বলে, নো মোর মানে! তোকেও এখানে মে”রে দেবো। একজন সুস্থ মানুষকে মে”রে ফেলেছিস! আমার ভাইয়ের কিছু হলে তোকে ও বাঁচিয়ে রাখবো না।
নাহিদ এসে জাহিনের হাত থেকে ডাক্তারের কলার ছাড়িয়ে নিয়ে বলে, “সরি, ডাক্তার। আমি ভীষণ লজ্জিত। বুঝতেই তো পারছেন ওর অবস্থা।”

ডাক্তার নাহিদের দিকে তাকিয়ে বলে, “আপনি পেশেন্টের কী হন?”
“আমি ওর ফ্রেন্ড।”
“হোয়াট? এতো বয়স্ক একজন নারী আপনার ফ্রেন্ড!”
“মানে? নারী আসলো কোথা থেকে?”
পাশে বসা একজন বৃদ্ধ দ্রুত উঠে এসে বলে, “স্যার, আমার ওয়াইফের কথা বলছেন?”
ডাক্তার লোকটার দিকে তাকিয়ে বলে, “আপনার সাথে আর কেউ আসেনি?”
“জ্বি না, স্যার।”
“আপনার ওয়াইফ আর বেঁচে নেই। সব ফর্মালিটি পূরণ করে ওনাকে বাসায় নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করুন।”
লোকটা চোখের কোণের পানি মুছে নিয়ে দ্রুত পায়ে রিসেপশনে গেলো।
জাহিন জোরে জোরে শ্বাস নিয়ে বলে, “আমার ভাইয়ের কী অবস্থা?”

“প্রচুর রক্তক্ষরণ হয়েছে। ব্লাড ব্যাংক থেকে এবি নেগেটিভ রক্ত সংগ্রহ করুন। মাথায় রক্ত জমাট বেঁধে গেছে, দ্রুত অপারেশন করতে হবে। প্লিজ, একটু দ্রুত করবেন। আর হ্যাঁ, হসপিটালে এসে এরকম উগ্র আচরণ করা মোটেই ঠিক না। এখানে যেকোনো সময় যেকোনো কিছু ঘটতে পারে। কোনো ডাক্তার পেশেন্টকে মেরে ফেলতে চায় না। ডাক্তার সর্বোচ্চ চেষ্টা করে রোগীকে সুস্থ করে তোলার।”

মাহবুব তালুকদার পাগলের মতো ছোটাছুটি করছে। তার একমাত্র মেয়েকে হারিয়ে পাগলপ্রায় জাহানারা বেগমও। মাহবুব তালুকদারের সাহস হচ্ছে না জাহানারা বেগমের সামনে দাঁড়ানোর। তবুও ধীর পায়ে জাহানারা বেগমের পিছনে এসে দাঁড়ালো।
জাহানারা বেগম জায়নামাজে বসে ছিলেন। চোখের জলে ভিজে গেছে বুক। জাহানারা বেগম মাহবুব তালুকদারের উপস্থিতি টের পেয়ে বলেন, “পাপ তার বাপকেও ছাড়ে না। আজ তার প্রমাণ পেলে। তোমার ভুলের জন্য আমার মেয়েটাকে হারাতে হলো।” মাহবুব তালুকদার হাঁটু মুড়ে বসে পড়লো।

জাহানারা বেগম মাহবুব তালুকদারের শার্টের কলার ধরে বলে, “তোমার পাপে সব ধ্বংস হয়েছে। সেদিন ছেড়ে দিতে হয়েছিলো আমার ছেলেকে। আর আজ আমার মেয়েটাকেও হারালাম। ওইটুকু দুধের শিশুকে তোমার জন্য ফেলে দিতে হয়েছে। তুমি পাপী, তোমার মতো মানুষের সাথে আমি আর থাকবো না।”
মাহবুব তালুকদার জাহানারা বেগমকে জড়িয়ে ধরে বলে, “আমি কী করতাম বলো? তখন আর কোনো উপায় ছিলো না। সমাজ কোনোদিন স্বীকৃতি দিতো না ওই সন্তানকে।”

জাহানারা বেগম মাহবুব তালুকদারকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিয়ে বলে, “উপায়! মিস্টার মাহবুব তালুকদার, আপনি হয়তো ভুলে যাচ্ছেন। আপনাকে আমি কতবার বলেছিলাম, এসব পাপ, এসব অন্যায়। বিয়ের আগে শারীরিক সম্পর্ক করা মহাপাপ। কেনো আমরা শিক্ষিত, সচেতন মানুষ হয়ে এমন ঘৃণ্য কাজ করবো? আপনি সেদিন বলেছিলেন, ভালোবাসা কোনো পাপ-পুণ্যের হিসেবে করতে হয় না।

অর্ধাঙ্গিনী দ্বিতীয় পরিচ্ছদ পর্ব ১

ওসব করার সময় আপনার সমাজের কথা মনে ছিলো না! যখন আমার গর্ভে সন্তান এলো, তখন মনে পড়েছিলো আপনার সমাজের কথা! আমারই ভুল, আমি কেনো আপনার মতো মানুষকে বিশ্বাস করেছি। আমার পাপের ফল আমাকে ভোগ করতেই হবে। সেদিন আমার ছেলেটাকে নিজের ইচ্ছায় ত্যাগ করতে হয়েছিলো। আজ নিয়তি আমার মেয়েটাকে কেড়ে নিলো। দেখুন, মিস্টার মাহবুব, আমি শূন্য। আমার আর বেঁচে থাকার কোনো উৎস নেই।”
“চুপ করো, জাহানারা। এখন এসব কেনো তুলছো? মানুষ জানাজানি হলে কোথাও মুখ দেখানোর অবস্থা থাকবে না।”

অর্ধাঙ্গিনী দ্বিতীয় পরিচ্ছদ পর্ব ৩

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here