অর্ধাঙ্গিনী দ্বিতীয় পরিচ্ছদ পর্ব ৩
নুসাইবা ইভানা
একটা বি”ভৎস রাত শেষে নতুন দিনের শুরু হলো। রাতের অন্ধকার যতই গভীর হোক, দিনের আলো তা গ্রাস করবেই।
মাহবুব তালুকদারের চোখ লেগে গিয়েছিল। চোখ খুলতেই দেখতে পেলেন জাহানারা বেগম রুমে নেই। তার বুকটা ধক করে উঠলো।সারা বাড়ি খুঁজে, শেষে দ্রুত কিচেনে চলে এলেন। এসে দেখেন জাহানারা বেগম রান্না করছেন।
“এত সকালে তুমি কী রান্না করছ, জাহানারা?”
“নয়নার পছন্দের পায়েস, গরুর গোস্তের খিচুড়ি, ইলিশ ভাপা, রুপচাঁদা মাছ কড়া করে ভাজা। ভাবছি একটু আলু ভর্তা আর বেগুনও ভাজব। মেয়েটা নিজের সব পছন্দের খাবার একসঙ্গে দেখলে চমকে যাবে, তাই না? এই, তুমি কী খাবে? চা করে দেব? নাকি কফি?”
মাহবুব তালুকদার চুপ করে দাঁড়িয়ে আছেন। এত শোক হয়তো জাহানারা বেগমের মস্তিষ্ক নিতে পারেনি। তাই এমন উদ্ভট আচরণ করছেন।
মিজান তালুকদার এসে বললেন, “ভাইজান, আপনি কি এভাবে বসে থাকবেন? ওই চৌধুরীদের এভাবে ছেড়ে দেবেন?”
মাহবুব তালুকদার হাতের ইশারায় চুপ করতে বললেন মিজান তালুকদারকে।
জাহানারা বেগম বললেন, “ভাই, এত সকালে আপনি? চা খাবেন, নাকি কফি?”
মিজান তালুকদার বেশ অবাক হয়ে গেলেন। এত কিছুর পরেও জাহানারা বেগমের এমন শান্ত আচরণ!
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
“কী হলো, ভাইজান? বলুন?”
“চা।”
“আপনি বসুন, আমি এক্ষুনি নিয়ে আসছি।”
মাহবুব তালুকদার ও মিজান তালুকদার মুখোমুখি বসে আছেন। দুজনেই নীরব।
মিজান তালুকদার বললেন, “এসব কী হচ্ছে, ভাইজান? ভাবি এমন বিহেভিয়ার করছেন কেন?”
“জানি না, মিজান। আমার মনে হচ্ছে জাহানারার ব্রেনে কোনো সমস্যা হয়েছে। রাতেই কত কান্নাকাটি করল। হঠাৎ সকাল থেকে এমন উদ্ভট আচরণ করছে! আমার মাথাও ঠিক নেই। তুই কেস ফাইল কর। ওই ছেলেকে চৌদ্দ শিকের ভাত খাওয়ানোর ব্যবস্থা কর। আমার মেয়ের জীবন নিয়ে ছিনিমিনি খেলা! বুঝিয়ে দেব, তালুকদাররা এখনো মরে যায়নি।”
জাহানারা বেগম দৌড়ে এসে বললেন, “মিজান, তুমি কি আমার ছেলেটাকে দেখেছ? অনেক সুন্দর দেখতে সে। একদম রাজপুত্রের মতো। তার নাম নাফি মাহমুদ। ওকে একটু খুঁজে নিয়ে এসো, মিজান। কতদিন নাফিকে দেখিনি!”
মিজান তালুকদার হতভম্ব হয়ে গেলেন। নাফি নামটা আজ প্রথম শুনলেন। তাকিয়ে রইলেন তার ভাইয়ের দিকে।
মাহবুব তালুকদার বললেন, “তুই যা, যে কাজটা বললাম কর। আমি দেখি, জাহানারাকে নিয়ে সাইকিয়াট্রিস্টের কাছে যাব।”
মিজান তালুকদার উঠে যাচ্ছিলেন। জাহানারা বেগম পিছু ডেকে বললেন, “নাফিকে নিয়ে ফিরবে কিন্তু। আমার নাফি কিন্তু একদম রাজপুত্র।”
মিজান তালুকদার চুপচাপ বেরিয়ে গেলেন। কী থেকে কী হয়ে গেল! হাসিখুশি পরিবারটা মুহূর্তেই অন্ধকারে ঢেকে গেল।
এদিকে সব মিডিয়া জুড়ে হট টপিক। চৌধুরী বাড়ির বড় বউ মিসিং। ধারণা করা হচ্ছে, নানা রকম মানসিক য”ন্ত্রণা দিয়ে তাকে মে”রে গু”ম করে ফেলা হয়েছে। আসলেই কি চৌধুরী পরিবার এতটা নি”র্মমভাবে তাদের পুত্রবধূকে পৃথিবী থেকে বিদায় করে দিয়েছে? জানতে হলে দেখতে থাকুন। আমার সংবাদ। সাথেই থাকুন।
জাহিন জিয়ানের জন্য ব্লা”ড দিয়েছে। জিয়ানের অবস্থা এখনো বিপদজনক। ডাক্তার বলেছেন, আগামী বাহাত্তর ঘণ্টার আগে কিছুই বলা যাচ্ছে না।
অনিকেত ডাক্তারদের সঙ্গে সঙ্গেই সব কাজে সহযোগিতা করছে। নিজেকে অপরাধী মনে হচ্ছে অনিকেতের। সেদিন যদি তার অ্যাক্সিডেন্ট না হতো, তাহলে হয়তো এই পরিস্থিতি তৈরি হতো না। সুনয়না মেয়েটা খুব ভদ্র, ওর দ্বারা এভাবে পালিয়ে যাওয়া সম্ভব না। জানি না, মেয়েটার সঙ্গে কী হয়েছে। আল্লাহ তায়ালা মেয়েটার হেফাজত করুন।
নাহিদ বলল, “কী রে, এদিকের কী অবস্থা? জিয়ান ঠিক হয়ে যাবে তো?”
“সম্ভাবনা খুবই ক্ষীণ। তবুও আল্লাহ তায়ালা চাইলে সব সম্ভব।”
“আমি বুঝতে পারছি না, সুনয়নার মতো মেয়ে এমন কিছু করতে পারে। এসব ভাবতে ইচ্ছে করছে না। কিন্তু হতেও পারে, অন্য কারও সঙ্গে রিলেশন ছিল। টু-টাইমিং করছিল। আই মিন, পরকীয়া করছিল হয়তো।”
অনিকেত স্বান্ত স্বরে বলল, “নাহিদ, সবটা না জেনে কাউকে জাজ করতে নেই। আর তুই হয়তো জানিস না, রেজার চেয়ে নয়না বেশি ভালোবাসত। মেয়েটার কোনো বিপদ হয়েছে, নিশ্চিত আমি। পরকীয়া বা এসব করার মতো মেয়েই না। এখন এসব কথা বাদ দিয়ে কীভাবে সব ঠিক হবে, সেটা দেখতে হবে। অপারেশন শেষ। এখনো লাইফ সাপোর্টে আছে জিয়ান। বাহাত্তর ঘণ্টার মধ্যে জ্ঞান না ফিরলে আর বাঁচানো সম্ভব হবে না।”
“আঙ্কেলকে বল, সিঙ্গাপুর নিয়ে যেতে।”
“সেটার জন্যও বাহাত্তর ঘণ্টা ওয়েট করতে হবে।”
তুষি টিভিতে নিউজ দেখছে। তুষির মনের মধ্যে খামচে ধরল অজানা এক ভয়। তার মানে, এসব কিছু জাহিন করেনি তো? নয়নার সঙ্গে কী করেছে ওই লোকটা? আমাকে এখনই যেতে হবে। আমার ভুলের জন্য নয়না শাস্তি কেন পাবে? আমি সবটা স্বীকার করে নেব। এরপর যা হবে, দেখা যাবে। তুষি বোরকা পরে পার্স নিয়ে ড্রয়িং রুমে এল।
তুষির মা রেবেকা বেগম বললেন, “কোথায় যাচ্ছ? এখন কোথাও যাওয়া হবে না তোমার। আজকে পাত্রপক্ষ দেখতে আসবে তোমাকে। ওনারা হয়তো কাছাকাছি চলেও এসেছে। যাও, নিজের ঘরে গিয়ে রেডি হও।”
“আম্মু, আমাকে যেতেই হবে। নয়নার এত বড় বিপদে আমি কী করে ঘরে বসে থাকি?”
“বড়লোকদের কোনো বিপদ থাকে না। ওর বাবার টাকা আছে, শ্বশুরের টাকা আছে, ঠিক তারা সমাধান করেই ফেলবে। আমাদের মতো মধ্যবিত্ত লোকদের বড়লোকদের সমস্যায় কোনো কাজ নেই। যেটা বলেছি, সেটা করো।”
“আম্মু, তুমি কি ভুলে যাচ্ছ, নয়না আমার জন্য কী কী করেছে?”
“টাকা থাকলে ওরকম সবাই করে। চুপচাপ ঘরে যাও। এত যাওয়ার ইচ্ছে হলে কাল সকালে যেও।”
“আমি বিয়ে করতে পারব না। আমি একজনকে ভালোবাসি, তাকে আমি কথা দিয়েছি।”
“ঠাটিয়ে একটা চড় দিলে ভালোবাসা বেরিয়ে যাবে। তুমি কি ভেবেছ, আমি কিছুই জানি না? আজ পর্যন্ত কয়টা প্রেম করেছ? এর জন্যই তোমাকে বিয়ে দিয়ে দিচ্ছি। প্রথমে ওই রাফিন, তারপর জানি না আর কার কার সঙ্গে ফস্টিনস্টি করে বেরিয়েছ।”
“আম্মু!”
“আওয়াজ নিচে। ভুলে যেও না, কার সামনে দাঁড়িয়ে আছ। চুপচাপ রুমে যাও, ফ্রেশ হয়ে রেডি হও।”
“আমার সঙ্গে জোর করলে আমি কিন্তু সুইসাইড করব।”
“মনের আনন্দে করো। তোমার মতো মেয়ে বেঁচে থাকার চেয়ে মরে যাওয়া ভালো।”
লুসাই গ্রামে এক উঁচু পাহাড়ের কোলে দাঁড়িয়ে আছে দোতলা একটি কাঠের বাড়ি। পাহাড়ের কোলে, ঘন সবুজের মাঝে এই দোতলা কাঠের বাড়িটির দেয়ালগুলো মসৃণ করে ছেঁটে রাখা। গাঢ় বাদামি রঙের কাঠ দিয়ে তৈরি, যেন প্রকৃতির স্পর্শ ধরে রেখেছে। উপরের তলায় একটি প্রশস্ত সুন্দর কাঠের বারান্দা। বারান্দার ফাঁক দিয়ে সূর্যের আলো ছড়িয়ে পড়ছে, আর বাতাসের সঙ্গে পাহাড়ি ফুলের সুবাস ছড়িয়ে পড়ে।
বারান্দার দুপাশে সাজানো হয়েছে বাগান বিলাস। বাড়ির আঙিনায় রয়েছে নানা রকম রঙিন পাহাড়ি ফুল—লাল, হলুদ, সাদা ও নীল, যা চোখ ভরিয়ে দেয়। তার পাশেই সবজির গাছ লাগানো—টমেটো, বেগুন, কাঁচা মরিচের গাছগুলো যেন তরতর করে ভরে উঠেছে ফুলে-ফলে। বাড়ির সামনে ছোট ছোট পাথরের সিঁড়ি পাহাড়ের ঢাল বেয়ে উঠে গেছে। সামনে ও পেছনে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে উঁচু উঁচু সবুজে ঘেরা পাহাড়। পাহাড়গুলো দাঁড়িয়ে আছে এমনভাবে, যেন বাড়িটাকে পাহারা দিচ্ছে। পাহাড়ের কোল ঘেঁষে সাদা মেঘের ভেলা ভেসে আসছে। অদূরে শোনা যাচ্ছে পাখিদের গুঞ্জন।
পাহাড়ি প্রকৃতির এই কোলে, দোতলা কাঠের বাড়িটি যেন এক টুকরো স্বর্গ। বাড়ির ভেতর ঢুকলেই মাটির মসৃণ মেঝে আর বাঁশের পাটাতন চোখে পড়ে। দেয়ালগুলো বাঁশের কারুকাজ দিয়ে সজ্জিত, যেখানে গাঢ় রঙের হাতে বোনা চাদর ঝুলছে। তার ঠিক সামনে বাঁশের ছোট একটি খাট পাতা রয়েছে। সেখানেও শোভা পাচ্ছে হাতে বোনা কারুকার্য করা চাদর। খাটের এক কোণে কাঠের টেবিলে রাখা রয়েছে কিছু ছোট কাচের বোতল, যার মধ্যে রয়েছে পাহাড়ি ফুলের গুঁড়ো ও ঔষধি গাছের শুকনো পাতা।
অর্ধাঙ্গিনী দ্বিতীয় পরিচ্ছদ পর্ব ২
ঘরের দক্ষিণ দিক থেকে হালকা ঘ্রাণে ভরা একটি ধূপের পাত্র থেকে ধোঁয়া উঠছে। কাছেই রাখা আছে বাঁশের ঝুড়ি, যেখানে থলামুয়ানার নিজের হাতে তৈরি লাঠি, ছোট ছুরি ও বাঁশের কঞ্চি। জানালার পাশ ঘেঁষে বয়ে চলেছে ঝর্ণা। জানালা দিয়ে তাকালেই দেখা মেলে মনোমুগ্ধকর এক মনোরম দৃশ্যের। অথচ এত সুন্দর বাড়িটিতে থলামুয়ানা এক নিঃস্ব পথিক। জীবনে মৃত্যু ছাড়া আর কিছুর অপেক্ষা নেই থলামুয়ানার। আচ্ছা, মানুষ কি কেবল বেঁচে থাকে মৃত্যুর অপেক্ষায়?
