অর্ধাঙ্গিনী দ্বিতীয় পরিচ্ছদ পর্ব ৪
নুসাইবা ইভানা
জিয়ান নয়নার কানের পাশে চুল গুঁজে দিয়ে বলল, “তোমাকে প্রথমবার দেখেই মনে হয়েছে, এই মেয়ে শুধু আমার বৌ হবে। যে করেই হোক, একে আমার লাগবেই।”
নয়না খিলখিল করে হেসে বলল, “মিস্টার প্লেন ড্রাইভার, প্লিজ চাপা কম মারেন। চাপা মারারও তো একটা লিমিট থাকা উচিত।”
জিয়ান নয়নার নাকের ওপর আলতো চুমু দিয়ে বলল, “ছিহ! বাটার মাশরুম, তুমি তোমার বরকে চাপাবাজ বলছ?”
“তা নয়তো কী, মিস্টার প্লেন ড্রাইভার? আপনি কি ভুলে যাচ্ছেন, আমাদের কোনো প্রেম, ভালোবাসা বা এরেঞ্জ ম্যারেজ নয়। আপনার-আমার হলো কট ম্যারেজ।”
“নট কট ম্যারেজ, ইট’স ভাগ্যের ম্যারেজ। তুমি আমার জীবনসঙ্গী হবে, তাই এই সব হয়েছে। এখন আমার কী মনে হয়, জানো?”
“কী মনে হয়?”
“নীলাঞ্জনাকে ধন্যবাদ দেওয়া উচিত। ও চিট না করলে এতো কিউট, সুইট, লাভিং বৌ কোথায় পেতাম?”
নয়না হেসে বলল, “আপনি জিতে গেছেন, আমার মতো সুন্দরী বৌ পেয়ে, তাই না?”
“সুন্দরী না, ছাই! তুমি হলে বোকা।”
“কী বললেন?”
জিয়ান নয়নার কোমর ধরে নিজের দিকে টেনে নিয়ে, নয়নার ঠোঁটে ঠোঁট মিলিয়ে বলল, “ভালোবাসি আমার বোকা বাটার মাশরুমকে। তুমি বোকা বলেই তোমাকে আমি এতো ভালোবাসি।”
জিয়ানের কপাল ঘামছে। চোখ-মুখ খিঁচড়ে যাচ্ছে।
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
অনিকেত হেসে বলল, “ডাক্তার, পেশেন্ট রেসপন্স করছে। অপারেশন সাকসেসফুল।” অনিকেতের চোখদুটো চিকচিক করছে। হাসি-কান্নার এক মিশ্র প্রতিক্রিয়া।
জিয়ান চিৎকার করে উঠল, “আমি তোমাকে ভালোবাসি, সুনয়না। আমাকে ছেড়ে যেও না, সুনয়না…”
অনিকেত জিয়ানের হাত ধরে বলল, “রিলাক্স। তোর সুনয়নার কিছু হবে না। যেভাবেই হোক, তাকে তোর কাছে ফিরিয়ে আনবো।”
আর কোনো কথা জিয়ানের কর্ণকুহরে পৌঁছাল না। তার আগেই সে আবার সেন্সলেস হয়ে পড়ল।
ডাক্তার বললেন, “মিস্টার অনিকেত, চিন্তার কোনো কারণ নেই। খুব দ্রুত পেশেন্ট রিকভার করবে। তবে ওনাকে কোনোভাবেই হাইপার হতে দেওয়া যাবে না। আর হ্যাঁ, আজ আর কাউকে ওনার সঙ্গে দেখা করতে দেওয়া হবে না। আবার আগামীকাল।”
অনিকেত রুম থেকে বেরিয়ে এল। জাহিন আর নাজিম চৌধুরীকে বলল, “জিয়ান খুব দ্রুত সুস্থ হয়ে উঠবে। তবে সুনয়নাকে কোনোভাবে খুঁজে পেলে ভালো হতো। নইলে জ্ঞান ফিরলে আবারও পাগলামি করবে। আপনারা এখন বাসায় চলে যান। কাল সকালে এলেই হবে।”
জাহিন বলল, “বাবা, তুমি চলে যাও, আমি থাকি। বাসায় আম্মুর কী অবস্থা, জানা নেই। তুমি বরং গিয়ে আম্মুকে সামলাও।”
নাজিম চৌধুরী বাসার উদ্দেশে চলে গেলেন। তার আদরের প্রিয় ছেলের এই করুণ পরিণতি চোখের সামনে দেখে তিনি ভেতর থেকে ভেঙে পড়েছেন। আশপাশের কোনো কিছুতেই তার কোনো ধ্যানজ্ঞান নেই আপাতত।
এদিকে মাহবুব তালুকদার জিয়ানের নামে নারী নির্যাতন ও খুনের মামলা করলেন। জিয়ানের বিরুদ্ধে তিনটি মামলা করা হয়েছে: লাশ গুম, নির্যাতন, ও খুন।
জাহানারা বেগম সারাদিন উন্মাদের মতো আচরণ করে চলেছেন। শিল্পি বেগম মাথায় হাত দিয়ে সোফায় বসে আছেন।
জাহানারা বেগম এসে বললেন, “শিল্পি, তুই কি নাফিকে দেখেছিস? ছেলেটাকে কোথাও খুঁজে পাচ্ছি না। দুষ্টু ছেলে, কোথায় গেল বলতো?”
শিল্পি বেগম চমকে গেলেন! জাহানারা বেগমের হাত দুটো ধরে বললেন, “ভাবি, তুমি শান্ত হও। এমন কেন করছ? এখন তোমাকে ঠিক থাকতে হবে। আমাদের মেয়েটাকে খুঁজে বের করতে হবে, যেভাবেই হোক। একটা জলজ্যান্ত মানুষ এভাবে হারিয়ে যেতে পারে না।”
জাহানারা বেগম বললেন, “তোর মেয়েও হারিয়ে গেছে? আরে শিল্পি, আমার মেয়ে ক্লাস থেকে এখনো বাসায় ফিরছে না কেন? ওর জন্য সকাল থেকে রান্না করে বসে আছি। রাত গড়িয়ে গেল, এখনো আসছে না কেন? আমার ছেলেটাকেও দেখছি না। ওরা দুজন আমাকে জ্বালিয়ে মারবে।”
“ভাবি, তোমার কোনো ছেলে নেই। তোমার মেয়ে সুনয়না, তাকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।”
জাহানারা বেগম হঠাৎ চিৎকার করে বললেন, “আমার ছেলে নেই? আমার ছেলেকে মেরে ফেলেছি। আমি খুনি। এই শিল্পি, পুলিশে খবর দে, আমি খুনি।”
বিশাল বড় থালার মতো পূর্ণচাঁদ আকাশে। চাঁদের আলোতে আলোকিত হয়ে আছে কংলাক পাড়া। লুসাই সম্প্রদায়ের বসবাস এখানে। কংলাক পাড়ার শেষ সীমান্তে পাহাড়ের টিলায় অবস্থিত থলামুয়ানার কাঠের দোতলা বাড়ির জানালা দিয়ে ঠিকরে পড়ছে জোছনার আলো। প্রায় মাঝরাতে থলামুয়ানার ঘুম ভেঙে গেল। ঠিক এমনই এক রাতে পাহাড় ধসে হারিয়েছিল তার প্রাণপ্রিয় স্ত্রী ও সন্তানকে। তারপর এই বসতি নতুন করে গড়ে তুলেছেন। বিছানা থেকে উঠে কুপি জ্বালালেন। কুপির হলদে আলো ছড়িয়ে পড়ল রুমজুড়ে। ঠিক এই রাতের মতোই নিঃস্ব থলামুয়ানা।
বাইরে পাখির কিচিরমিচির শব্দ নেই। মাঝে মাঝে দূর থেকে ভেসে আসছে পাহাড়ি জন্তুর আওয়াজ। থলামুয়ানা ধীরে ধীরে উঠে বারান্দায় চেয়ারে বসলেন। শূন্যে দৃষ্টি রেখে চোখের কোণে জমে ওঠা জল মুছে নিলেন। এতো বছরেও যেন তার প্রিয়জন হারানোর ক্ষত একদম দগদগে। সময়ের সাথে তা বিলুপ্ত না হয়ে আরো যেন বেড়ে উঠেছে।
সবাই হয়তো গভীর ঘুমে। পাহাড়িরা রাতের বেলা খুব দ্রুত ঘুমিয়ে পড়ে। রাত এগারোটা মানে সেখানে গভীর রাত। হঠাৎ তার কানে একটা আওয়াজ এল। কোনো মানুষের চিৎকারের আওয়াজ, সাথে ভারি কিছু গড়িয়ে পড়ার শব্দ। থলামুয়ানা নিজের কানকে আরো সজাগ করে শোনার চেষ্টা করলেন, কোন দিক থেকে শব্দ আসছে।
রাত তখনো অতটা গভীর হয়নি। সাজেকের আকাশে পূর্ণচন্দ্র। পাহাড় আর মেঘের মিলন। মনোমুগ্ধকর এক অপরূপ দৃশ্য। কোরা রিসোর্টের বারান্দার কার্নিশ ঘেঁষে দাঁড়িয়ে ছিল নয়না। তার পরনে জিয়ানের দেওয়া নীল শাড়ি। জিয়ানের হাত ধরে ঝুলে আছে নয়না। এই হাতের বাঁধন মুক্ত হলেই পৃথিবী থেকে সুনয়না নামক মানুষটার অস্তিত্ব মুছে যাবে। ভয়ংকর এক রুদ্ধশ্বাস মুহূর্তে দাঁড়িয়ে আছে নয়না। ঠিক-ভুল, বিশ্বাস, ভরসার অন্ত জালে আটকে বোধবুদ্ধি লোপ পেয়েছে তার। মস্তিষ্ক, মন কোনোটাই মেনে নিতে চাইছে না। তার জিয়ান তাকে মেরে ফেলবে। কিন্তু সে-সব কিছু বুঝে ওঠার আগেই ছিটকে পড়ল নয়না। রাতের নীরবতা বিদীর্ণ করে ভেসে এল তার করুণ আর্তনাদ। “কে আছো? বাঁচাও আমাকে!”
যত নীচের দিকে যাচ্ছিল, মৃত্যু ঠিক ততটাই কাছে মনে হচ্ছিল। চিৎকারও বের হচ্ছে না মুখ থেকে। তবুও বাঁচার আকুতি করে যাচ্ছে। হঠাৎ ঝোপের মধ্যে গাছের সাথে বাড়ি খেল নয়না। মাথায় আঘাত পেয়ে, গাছের শক্ত শেকড়, লতাপাতায় হাত বাড়িয়ে দিল। বেঁচে থাকার শেষ সম্বল হিসেবে সেটুকু আঁকড়ে ধরল। কিন্তু মাথায় প্রচণ্ড আঘাত পেয়ে ছিটকে পড়ল কিছুটা দূরে। ব্যথায় জোরে চিৎকার করে উঠল নয়না। তার সে চিৎকার পাহাড়ে বাড়ি খেয়ে আবার ফিরে এল। ততক্ষণে নয়নার চোখে নেমে এল অন্ধকার। ধীরে ধীরে তলিয়ে যেতে লাগল অন্ধকারে। চোখ বন্ধ করার আগের মুহূর্তে তার চোখের সামনে ভেসে উঠল জিয়ানের হাসিমাখা মুখশ্রী। যে মুখের দিকে তাকিয়ে নয়না পুরো জীবন কাটিয়ে দিতে চেয়েছিল, সেই মানুষটা তাকে হত্যা করল নিজ হাতে!
থলামুয়ানা ছোট টর্চলাইট, বাঁশের কঞ্চি, আর ছুরি নিয়ে দ্রুত নিজের রুম থেকে বের হলেন। তবে বেশ কিছুক্ষণ খোঁজাখুঁজির পর হতাশ হয়ে আবার ফিরে এলেন নিজের বাড়িতে। বাকি রাতটুকু কাটিয়ে দেবেন নির্ঘুম। এরকম অনেক রাত তিনি না ঘুমিয়ে কাটিয়ে দিয়েছেন। তার জীবনজুড়ে অদ্ভুত এক নিঃসঙ্গতা। দিনের আলোতে তিনি হয়ে ওঠেন পরোপকারী থলামুয়ানা অথবা পাহাড়ি বৈদ্য থলামুয়ানা, যিনি পাহাড়ের বিভিন্ন গাছ-গাছালি দিয়ে চিকিৎসা করে আসছেন বহু বছর ধরে। অথচ রাতের আঁধারে তিনি এক অসহায়, নিঃস্ব মানুষ! শেষ রাতের দিকে চোখ লেগে গেল তার। সকালে ঘুম থেকে উঠে বাঁশের ঝুড়ি কাঁধে নিয়ে বেরিয়ে পড়লেন পাহাড়ি ফুল ও লতাপাতা সংগ্রহ করতে। পাহাড় ডিঙিয়ে কিছুদূর আসতেই চোখ আটকে গেল এক টুকরো কাপড়ের ওপর। সাবধানে ঢালুতে নেমে কাপড়টা হাতে নিলেন। এক-দেড় হাত লম্বা কাপড়ের অংশটুকু ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে দেখতে লাগলেন। আশপাশে সন্ধানী দৃষ্টি নিক্ষেপ করে খুঁজতে লাগলেন কিছু। হঠাৎ চোখ আটকে গেল। আরো কিছুটা ঢালুতে নামতেই চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে রইলেন!
অর্ধাঙ্গিনী দ্বিতীয় পরিচ্ছদ পর্ব ৩
সায়না রাত থেকে অনিকেতকে কল করছে, কিন্তু অনিকেত সায়নার ফোনের কোনো রেসপন্স করছে না। তাদের বাসার টিভি নষ্ট হয়ে আছে, আজ দুই-তিন সপ্তাহ। তাই জিয়ানের খবর তার কানে পৌঁছায়নি। তার মায়ের সাথেও আজ সারাদিনে একবারও কথা হয়নি। সায়না বুঝতে পারছে না, হঠাৎ এমন কী হলো যে একবারও কল করল না। ও তো নিজেও অসুস্থ। কী এমন ব্যস্ততা ওর, যে একবারও কল করা যায় না!
