অর্ধাঙ্গিনী দ্বিতীয় পরিচ্ছদ পর্ব ৬

অর্ধাঙ্গিনী দ্বিতীয় পরিচ্ছদ পর্ব
নুসাইবা ইভানা

আপনি যদি মনে করেন আমি আপনাকে পছন্দ করি বা ভালোবাসি, সেটা সম্পূর্ণ ভুল ধারণা আপনার। আচ্ছা, আপনার নিজের ব্যাপারে কিছু বলতে হবে না। অন্য কথা বলুন।
নয়না নিচের দিকে তাকিয়ে বলে, “আমি কেন মনে করব আপনি আমাকে পছন্দ করেন!”
“কারণ কেয়ার। কারো যত্ন নিলে বা কেয়ার করলে আমরা ধরে নিই সে আমাকে ভালোবাসে।”
“ভালোবাসা কি মুড়ির মোয়া?”
“মানে?”

“মানে হলো ভালোবাসা সহজ না। এর জন্য প্রয়োজন অনুভূতি। অনুভূতিহীন ভালোবাসায় প্রাণ থাকে না।”
“অলিভিয়াকে আমি বোনের নজরে দেখতাম, তেমনটা কিন্তু নয়। অলিভিয়াকে আমি ভালোবাসতাম। চাচা জানতেন সবটা, কিন্তু তিনিও চাননি আমরা একে অপরের হই। কারণ আমরা ভিন্নধর্মী, আমাদের সম্পর্কের কোনো নাম বা প্রণয় কোনোটাই সম্ভব না। তাই আমি ঠিক করেছিলাম খ্রিস্টান হওয়ার মিথ্যে নাটক করব। একবার অলিভিয়াকে পেয়ে গেলে আর কে আমাকে পায়।”
“আপনি এখনো অলিভিয়াকে ভালোবাসেন?”

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

“হুম, যুগের পর যুগ কেটে গেলেও অলিভিয়ার প্রতি আমার ভালোবাসা থাকবে অক্ষয়। মানুষ সব ছাড়তে পারে, তবে ভালোবাসার মানুষের স্মৃতি ছাড়তে পারে না। এ জনম আমি একাই কাটিয়ে দেব। জানি না পরের জনম বলে কিছু আছে কি না। যদি থাকেও, সেখানে কী হবে তা তো জানি না। তাই এই জনম আমি অলিভিয়ার ভালোবাসার স্মৃতি বহন করে কাটিয়ে দিতে চাই। আচ্ছা, আপনার সমস্যা কী মিস? কেন আপনি কিছু বলছেন না?”
“আমার এখানে থাকতে ভালো লাগছে। যেদিন চলে যেতে ইচ্ছে করবে, সেদিন সব বলব।”
“আপনি চাইলে আমাকে বলতে পারেন। বিশ্বাস করতে পারেন।”

“বিশ্বাস! পৃথিবীতে সবচেয়ে ঠুনকো শব্দ হচ্ছে বিশ্বাস। বিশ্বাস শব্দটাও লজ্জিত হয় বিশ্বাস শব্দ শুনে।”
“মানুষ বিশ্বাসে স্বপ্ন দেখে। আশায় বাঁচে। বেঁচে থাকার জন্য বিশ্বাস জরুরি।”
“বিশ্বাস করে তো মরতেও হয়। আমাকে দেখেন। যাকে ভালোবেসে আমি নিজের চেয়ে বেশি বিশ্বাস করেছিলাম, সেই মানুষটা নিজ হাতে আমাকে হত্যা করার চেষ্টা করছে। আচ্ছা, আমি কেন বেঁচে গেলাম?”
ঈশান আরো কিছুটা নরম স্বরে বলল, “আপনার ভালোবাসার মানুষ আপনাকে কেন আঘাত করবে! এর পেছনে কী কোনো কারণ আছে?”

“আমি জানি, এই এক সপ্তাহ আপনি আমার সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ আচরণ করেছেন শুধুমাত্র এসব জানার জন্য। আমি বিবাহিতা। আমার হাসব্যান্ড আমাকে মেরে ফেলতে চেয়েছিল। এইটুকু জেনে রাখুন, আমাকে সেই মানুষটা আঘাত করছে যার কাছে আমি নিজেকে নিরাপদ মনে করতাম। মনে হতো এই মানুষটা পাশে থাকলে আর কোনো ভয় নেই। আমার ওপর আঘাত আসতে হলে এই মানুষটাকে আগে মোকাবিলা করতে হবে। কিন্তু বাস্তবতায় কী হলো? সে নিজের হাতে আমার হত্যার চেষ্টা করল!”
“আপনার কথা আংশিক সত্য। আমি পুরো সত্য জানতে চাই। আপনি কে? আর কীভাবে এখানে আসলেন? হাসব্যান্ড! আপনার হাসব্যান্ড কেন আপনাকে হত্যা করতে চাইছিল?”

“আমার যখন বিয়ে হয়, তখন আমি এক ষোড়শী কিশোরী। হুট করে বিয়ে নামক ঝড়টা আমার ওপর আঁচড়ে পড়ে। আমার বোনের ভুলের মাশুল আমাকে দিতে হয়। শুরুতে দু-একদিন আমার হাসব্যান্ড আমার সাথে খুব বাজে বিহেভিয়ার করে। তারপর আমি অনুভব করতে থাকি মানুষটা এতটাও খারাপ না। বরং আমার ভাবনার চেয়েও ভালো আর আমার কল্পনার চেয়ে হ্যান্ডসাম। আমরা একে অপরের প্রেমে পড়ি, ভালোবাসি। সে ভালোবাসার ব্যাখ্যা দেওয়া অসম্ভব। আমার এখনো বিশ্বাস হচ্ছে না আমার মানুষটা আমাকে হত্যা করতে চেয়েছিল। ওই মানুষটা তো আমার জন্য রোজ নিজের জীবন হাসতে হাসতে দিয়ে দিতে পারত। তার মানে কি সে-সব শুধুই অভিনয় ছিল?”
“আপনি না বললেন ভালোবাসায় অনুভূতি থাকতে হয়। আপনার অনুভূতি কি মিথ্যে ছিল? হতে পারে আপনি মুদ্রার এক পিঠ দেখছেন, অপর পিঠ আপনার অজানা।”

“আমি তো নিজের চোখে তাকে দেখেছি। চোখের দেখা কি ভুল হতে পারে?”
“চোখের দেখাও ভুল হয়। সত্য-মিথ্যা মিলিয়ে আমরা চলে যাই বিভ্রমে। তখন চোখ আমাদের তাই দেখায় যা আমরা দেখতে চাই। আপনি রাতে শুয়ে রিলাক্স ভাবে সেদিনের প্রত্যেকটি ঘটনা, ছোট থেকে ছোট বিষয়ও বিশ্লেষণ করুন। আশা করি আপনি নিজেই উত্তর পেয়ে যাবেন।”
“যদি উত্তর আমার দেখার সাথে মিলে যায়?”
“আগে আমাকে ভেবে-চিন্তে সবটা জানান, তারপর আমি আপনাকে বলব কী করবেন।”
“বসুন, চা নিয়ে আসি।”
“মিস অলিভিয়া, আপনার নামটা?”

“অলিভিয়া। যতদিন না সত্য পর্যন্ত পৌঁছতে পারি, ততদিন অলিভিয়া থাকুক।” নয়না চলে গেল চা বানাতে।
ঈশান মুচকি হাসল। তার মানে উদ্দেশ্য সফল হওয়ার প্রায় কাছাকাছি। ঈশান একটা জিনিস বুঝল, মেয়েটা খুব সহজ-সরল। অল্পতেই মানুষকে বিশ্বাস করে। যারা সহজে মানুষকে বিশ্বাস করে, তারা খুব সহজেই ঠকে যায়। ঈশান একটু লক্ষ্য করল, মেয়েটার বাসা ঢাকা বা নারায়ণগঞ্জ হবে, অথবা এদিকে আশেপাশে।

জাহিন ব্ল্যাক কালারের শার্ট পরল, হাতে ব্ল্যাক কালারের ওয়াচ পরে নিল। চুলগুলো হাত দিয়ে ঠিক করে নিয়ে তার পছন্দের পারফিউম লাগিয়ে আয়নায় তাকিয়ে বলে, “সেম চেহারার দুটো মানুষ পৃথিবীতে থাকার কী কোনো প্রয়োজন আছে? একজন তো না থাকলেও চলে।”
মেহনুর দরজা নক করে বলে, “আসতে পারি?”
“কামিং।”

“তুমি তো চাইলে কোনো না কোনোভাবে জিয়ানকে বাঁচাতে পারো। বাবা বলল, তুমি গোয়েন্দা কর্মকর্তা।”
জাহিন সামনের দিকে ঘুরে, পকেটে হাত দিয়ে বলে, “আমি এই গল্পের হিরো না। আমি এই গল্পের ভিলেন। ভিলেন শুধু একতরফা ভালোবাসতেই জানে না, ভালোবাসার জন্য ভালোবাসার মানুষকেও দুনিয়া থেকে সরিয়ে দিতে পারে। আমি তোমাকে ভালোবেসেছি, শুধু তোমাকেই ভালোবাসি, সুনয়না।”
মেহনুর অবাক হয়ে বলে, “মানে!”
“মানে, আপনার আঙ্কেল ততটুকু জানে, যতটুকু আমি তাকে জানাতে চেয়েছি। আমি যা জানাতে চাইনি, তা সে কোনোদিন জানবে না। আর হ্যাঁ, সুনয়না আমার ফার্স্ট লাভ। আমার ভাইকে বিয়ে করেছে, সহ্য হয়নি, তাই মেরে দিয়েছি।”

“তুমি খুনি?”
“ইয়েস, জানেমান, তোমার হাসব্যান্ড একজন খুনি। এসব খুন-টুন করা আমার বাঁ-হাতের কাজ। সো ডিয়ার, নিজের মুখটা বন্ধ রেখো, নয়ত আর একটা খুন করা আমার জন্য পান্তাভাত।”
মেহনুর দুই কদম পিছিয়ে গেল। দরজায় হেলান দিয়ে তাকিয়ে আছে জাহিনের দিকে। এই মানুষটা আসলেই এত ভয়ংকর?
জাহিন সামনে এসে মেহনুরের কপালে চুমু দিয়ে বলে, “চেহারায় কি মন লেখা থাকে নাকি! চেহারা তো মুখোশ মাত্র। আসল রূপ তো থাকে ভেতরে। আমি যা ব্যবস্থা করেছি, তাতে রেজার হয়তো যাবতজীবন কারাদণ্ড হবে, নয়তো ফাঁসি হবে। এরপর আমি রাজা, তুমি রানী।” ফুউউ দিয়ে মেহনুরের চুল সরিয়ে দিয়ে বলে, “মুখটা বন্ধ না রাখলে কিন্তু নিশ্বাস বন্ধ করে দেব।” বলেই বের হয়ে গেল রুম থেকে।
নাজিম চৌধুরী আগেই বের হয়েছে।

জাহিন বলল, “বাবা, আজকের শুনানি আমাদের পক্ষে হবে। না হলেও জামিন তো হবেই।”
“জানি না, আমার আর শক্তি নেই এই করুণ দৃশ্য দেখার। আমার ফুলের মতো ছেলেটা এত কষ্ট সহ্য করছে, আমি তা মানতে পারছি না।”
জাহিন নাজিম চৌধুরীকে ধরে বলে, “আমি আছি তো, বাবা, চিন্তা কইরো না। একটা না একটা রাস্তা ঠিক বের করবই।”
“আমাকে কথা দে, তুই তোর ভাইয়ের কিছু হতে দিবি না। সেই ছোট থেকে রেজা তোর ঢাল হয়ে ছিল। এইটুকু কর রেজার জন্য তুই।”
“বাবা, আমি নিজের সর্বোচ্চ চেষ্টা করব। ওই চরিত্রহীন মেয়ের জন্যই সব হয়েছে। বড় বোন পালিয়ে গেছে বিয়ের দিন, এখন ছোট বোন পালালো বিয়ের পর। ওদের চরিত্রই খারাপ। একবার মেয়েটাকে খুঁজে পাই, তারপর বোঝাব তালুকদারদের।”

আজ পাঁচদিন ধরে অনিকেত বাসায় যাচ্ছে না। নাহিদ আর নাহিদের বউ বাসায় নেই। সব কাজ শেষে সেখানেই একাকী সময় কাটায়। মনমরা হয়ে বসে থাকে।
সায়না বারবার কল করলেও রিসিভ করে না। রিসিভ করলেও ঠিকভাবে কথা বলে না।
সায়নার ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে গেছে। নিজের পছন্দে বিয়ে করলে বাবা-মায়ের কাছেও দুঃখ শেয়ার করা যায় না। ফট করে বলে বসে, “নিজেই তো পছন্দ করেছিস।” সায়না বালিশে মুখ গুঁজে কাঁদছে। বারবার কল করছে, কিন্তু অনিকেত ফোন রিসিভ করছে না।

অর্ধাঙ্গিনী দ্বিতীয় পরিচ্ছদ পর্ব ৫

চোখের পানি মুছে উঠে বসল, দ্রুত টাইপিং করল, “পারুকে বারবার ফিরিয়ে দেওয়া হলো। পারু যখন নিজের মনকে পাথরে পরিণত করল, তখন দেবদাসের পারুর প্রতি ভালোবাসা উথলে উঠল! আপনি আমাকে পারু হতে বাধ্য করবেন না, ডাক্তার অনিকেত মাহমুদ। আপনি আমার, মানে আপনার সুখ, দুঃখ সব আমার। আপনার লুকানো যন্ত্রণাও। এক বিন্দু পরিমাণ আড়াল করবেন না আমার কাছ থেকে নিজেকে। সায়না মাহমুদ থেকে সায়না ভুঁইয়া হতেও দুই দণ্ড সময় নেব না।” টেক্সট সেন্ট করেই বলে, “আমাকে সহজে পেয়ে গেছো, তাই মূল্যায়ন করছো না। আমি সায়না ভুঁইয়া, আমার ভালোবাসার চেয়ে আমার ব্যক্তিত্বের তেজ বেশি।”

অর্ধাঙ্গিনী দ্বিতীয় পরিচ্ছদ পর্ব ৭

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here