অর্ধাঙ্গিনী দ্বিতীয় পরিচ্ছদ পর্ব ৭

অর্ধাঙ্গিনী দ্বিতীয় পরিচ্ছদ পর্ব
নুসাইবা ইভানা

দুপুরের খাবারে পাহাড়ি বেগুন সেদ্ধ, মিষ্টি কুমড়া শাক সেদ্ধ, বরবটি সেদ্ধ, সিদোল দিয়ে ঝাল-ঝাল মরিচ ভর্তা, দেশি মুরগী হালকা মশলায় রান্না করা হয়েছে। থলামুয়ানা নিজের হাতেই সব রান্না করেন। নয়না আর থলামুয়ানা একসাথে দুপুরের খাবার খেয়ে বসে-বসে গল্প করছে।
নয়না বলল, “আমি আপনার মেয়ে হয়ে এখানে থেকে যেতে পারি না?”
থলামুয়ানা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল, “তোমার বাবা-মা নিশ্চয়ই তোমার জন্য চিন্তিত। পৃথিবীতে সব মানুষ তোমাকে ভুলে যেতে পারে, তোমার স্মৃতি মুছে ফেলতে পারে, কিন্তু তোমার জন্মদাত্রী মা কোনদিন তোমাকে হারানোর বেদনা ভুলতে পারবে না। তুমি থাকলে আমি যতদিন বেঁচে আছি তোমাকে নিজের সাধ্যমতো আগলে রাখব। কিন্তু তোমার বাবা-মায়ের কথা তোমাকে ভাবতে হবে।”

“আমার আর ওই শহরে ফিরে যাওয়ার ইচ্ছে নেই। যে শহরের অলিগলিতে শুধু মিথ্যে আর ধোঁকা, সেখানে যেতে চাই না।”
“একজনের জন্য সবাইকে শাস্তি দিচ্ছ? যার জন্য নিজের মানুষদের পরিত্যাগ করছ, সে কিন্তু নিজের মানুষদের নিয়ে ভালো থাকবে। আর তুমি সারাজীবন ভালো থাকার যুদ্ধ করবে। নিজেকে শক্ত করতে হয়। মোকাবিলা করার হিম্মত রাখতে হয়।”
“আমার বেঁচে থাকার ইচ্ছে নেই। হয়তো মরে যাব, নয়তো এখানে থেকে যাব।”
“পাগলামি করো না মেয়ে। জীবনে বেঁচে থাকার মতো মূল্যবান আর কিছু নেই। তোমার মৃত্যু মানে পৃথিবীতে তোমার অস্তিত্ব শেষ। যতদিন বেঁচে আছ, ততদিন তুমি আছ। এরপর আর এ জীবন কোনদিন পাবে না, এক মুহূর্তের জন্যও না। বেঁচে থাকার মূল্যবোধ অনুভব করো, জীবনে লড়াই করার শক্তি চলে আসবে।”
নয়না কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, “আপনি এখন কোথায় যাবেন?”

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

“কিছু গাছের মূল ও ফুল সংগ্রহ করতে যাব। ঔষধ বানাতে লাগবে।”
“চলুন, আপনার সাথে আমিও যাব।”
“তুমি হাঁটতে পারবে না। পাহাড়ের রাস্তা এবড়োখেবড়ো, ঢালু-নিচু-উঁচু।”
“না পারলে শিখে নেব, তবুও যাব।”
“অলিভিয়া, তুমি বড্ড জেদি। তোমার জেদটাকে কেন ভালো কাজে ব্যবহার করছ না? জেদ আনো, তুমি তোমার সাথে হওয়া অন্যের প্রতিশোধ নেবে। অপরাধীকে এভাবে ছেড়ে দিবে!”
“অপরাধী তো অন্য কেউ নয়। অপরাধী আমার শত্রু হলে তার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করতাম। কিন্তু আফসোস, অপরাধী আমার ভালোবাসার মানুষ। সে আমার মৃত্যুতে খুশি থাকলে আমি তার জন্য মৃতই থাকতে চাই।”

মেহনুরের পায়ের নিচ থেকে মাটি সরে গেছে, মনে হচ্ছে সে শূন্যে ভাসমান! এমন একটা জঘন্য মানুষ তার জীবনসঙ্গী! দেয়াল ঘেঁষে বসে পড়ল সে। কিছু সত্য না জানাই বোধহয় ভালো। এই সত্যের ভার মেহনুরকে আর বাঁচতে দেবে না। মেহনুর দু’হাতে চোখের জল মুছছে। তার এখনো বিশ্বাস হচ্ছে না, এতো নিষ্পাপ চেহারার পেছনে জলজ্যান্ত এক অমানুষ লুকিয়ে আছে। এখন কী করবে সে? কীভাবে বাঁচাবে জিয়ানকে? সত্যিই কি জিয়ানের ফাঁসি হবে?
জাহিন আবার রুমে এসে বলে, “মেহনুর, চোখের পানি মুছে ভদ্র মেয়ের মতো নিজে এসো। দই-চিনি খাইয়ে দাও আমাকে। এতো ভালো একটা কাজ করতে চাচ্ছি যাতে সেটা সফল হয়। স্বামীর মঙ্গল কামনা না করে ভাসুরের জন্য কান্না করছ! ছিঃ! মনে মনে পরকীয়া লিপ্ত তুমি মেহনুর। রাতে ঘুমাও আমার সাথে আর মনে মনে ফিল করো ভাসুরকে!”

মেহনুর উঠে নিজের চোখের পানি মুছে বলে, “আল্লাহর ওয়াস্তে চুপ করুন। ছিঃ! এতো নোংরা চিন্তা-ভাবনা আপনার! হ্যাঁ, জিয়ানকে আমি পছন্দ করতাম। কিন্তু বিয়ের পর আপনাকে ভালোবেসেছি। আমার ভাবতেও ঘৃণা হচ্ছে, আপনার মতো মানুষ আমার স্বামী! উফ! এর আগে আমি মরে কেন গেলাম না?” মেহনুর জাহিনের কলার চেপে ধরে বলে, “কেন নষ্ট করলেন আমার জীবনটা? কী দোষ করেছি আমি?”
জাহিন মেহনুরের হাত ছাড়িয়ে বলে, “তোমার সাহস তো কম না মেহু! জাহিন চৌধুরীর কলার চেপে ধরো! তোমার মতো মেয়েদের দিকে জাহিন চৌধুরী ফিরেও তাকায় না। নেহাৎ মায়ের ইচ্ছায় বিয়েটা করা। সো বউ হওয়ার দায়িত্ব পালন করো চুপচাপ। একটু এদিক-সেদিক হলেই তোমার জীবনের রফা-দফা করে দেব বেব।”
“তুমি অসুস্থ মস্তিষ্কের মানুষ। সাইকো তুমি একজন। ডাক্তার দেখাও নিজের।”

জাহিন দরজা লক করে, ঘড়ির দিকে তাকিয়ে পায়ের উপর পা তুলে বেডের উপর বসে বলে, “আমি সাইকো। আমাকে সাইকো বানানোর প্রথম কারিগর আমার বাবা। সারাজীবন রেজা, রেজা করেছে। কেন? আমি কি মানুষ না নাকি? রেজা ভালো ছেলে আর আমি খারাপ। এরপর দ্বিতীয় কারিগর সুনয়না। আচ্ছা, এই নামটা সুন্দর তাই না? এই মেয়ের সাথে আমার প্রথম দেখা হয় শপিং মলে। একদম নায়িকাদের মতো তার ওড়না এসে আমার ঘড়ির সাথে আটকে যায়। কী এন্ট্রি তুমি ভাবো। তখনও আমি প্রেমে পড়িনি। কিন্তু দ্বিতীয়বার ওর স্কুলে আমার একটা গানের প্রোগ্রাম ছিল। বিশ্বাস করো, ও বের হচ্ছিল আর আমি প্রবেশ করছিলাম। জাস্ট সেদিনই আমি ফিদা। অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে ওর নাম্বার যোগাড় করলাম। এরপর হোয়াটসঅ্যাপে, টুকটাক কথা হতো। ওর শর্ত ছিল বিয়ের আগ পর্যন্ত আমার সাথে দেখা করবে না। ভিডিও কলেও আসবে না।

আমি তো প্রতিদিন দেখতাম তাই এসব বাচ্চাদের ট্রিকস মনে করে মেনে নিলাম। এক থেকে দেড় বছর মোবাইলে চুটিয়ে প্রেম করলাম। হঠাৎ আমার মিশনের কাজে বাইরে গেলাম। এসে দেখি পাখি আমার খাঁচা ছেড়ে ভাইয়ের খাঁচায় বন্দি। প্রথম তো আমি জানতাম না। ও আমাকে রেজা ভেবে রাগতো। কিন্তু আমি ভাবতাম একটু ভাব নিচ্ছে কারণ সুন্দরী মেয়েরা ইগো দেখাবে, ভাব দেখাবে—এটা তো স্বাভাবিক। কারণ আমি ওকে না দেখলেও ও তো আমাকে দেখেছে, কত শত পিক পাঠিয়েছি নিজের। কিন্তু কাহিনীতে টুইস্ট আসলো তখন, যখন জানতে পারলাম আমার সিক্রেট প্রেমিকা আমার ভাইয়ের বউ! আমি তো যেন আসমান থেকে টুপ করে জমিনে পড়লাম। চেক করে দেখি আমার নাম্বার সব জায়গা থেকে ব্লক। ওর একটা ফেসবুক আইডি ছিল ‘ব্ল্যাক ডায়মন্ড’। ওই আইডিও ডিলিট। তবুও মনকে বোঝাতে থাকলাম। থাক, ভাইয়ের সুখে বাধা হব না। চোখের সামনে নিজের ভালোবাসার মানুষ নিজের আপন ভাইয়ের সাথে লাভ-ডভ কেমিস্ট্রি গড়ছে, সেটা কতক্ষণ সহ্য করা যায়! তারপর তো জানোই কী করেছি।”

“কী করেছ? মেহনুরের চোখ লাল হয়ে গেছে। মনে হচ্ছে জাহিনকে এখনই ভস্ম করে দেবে।”
জাহিন বলে, “উফ বিবি, ভয় পাচ্ছি তো! চোখ লাল কিসে?”
মেহনুর ফ্লোরে বসে পড়ল, চিৎকার করে বলে, “আমি সবাইকে বলে দেব। তুমি একজন খুনি।”
“যাও, এক্ষুনি যাও। তুমি পাঁচ কদম এগিয়ে যাওয়ার আগেই পৃথিবী থেকে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করবে। বাঁচতে চাইলে চুপ করে থাকবে যেন তুমি কিছুই জানো না। এনবিআরের অফিসার আমি। তোমার মতো একশো মেহনুরের ঘটেও আমার এক বিন্দু পরিমাণ বুদ্ধি নেই।”

জিয়ানকে কোর্টে হাজির করা হলো। জিয়ান যেন প্রাণহীন দেহ।
মাহবুব তালুকদার আড়চোখে জিয়ানের দিকে তাকিয়ে আছে। তার মন ঠিক শায় দেয় না এই ছেলেটা তার মেয়ের কোনো ক্ষতি করতে পারে।
বিচারক বিচারকার্য শুরু করলেন। পক্ষে-বিপক্ষের উকিলরা নিজেদের প্রমাণ পেশ করছে। সমানে-সমানে হাড্ডাহাড্ডি তর্ক চলছে।

জাহিন জিয়ানের দিকে তাকিয়ে বলে, “তুই তো এমনিতেই মরে গেছিস ভাই। আর বেঁচে থেকে কী করবি! তোকে তার চেয়ে জেলেই পচিয়ে মারি। সব ব্যবস্থা আমি করে রেখেছি। একটা প্রমাণ রায় তোর বিপক্ষে।”
বিপক্ষের উকিল কিছু রিপোর্ট আর ডিএনএ রিপোর্ট পেশ করলেন জজ সাহেবের কাছে।

অর্ধাঙ্গিনী দ্বিতীয় পরিচ্ছদ পর্ব ৬

সব দেখে জজ সাহেব কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন, “সমস্ত তদন্ত ও সাক্ষ্যপ্রমাণের ভিত্তিতে আদালত নিশ্চিত হয়েছেন যে, আসামি জিয়ান রেজা চৌধুরী ইচ্ছাকৃতভাবে ভিক্টিমকে হত্যা করেছেন। তাই দণ্ডবিধির ৩০২ ধারার অধীনে আসামি জিয়ান রেজা চৌধুরীকে ফাঁসির আদেশ দেওয়া হলো। দ্য কেস ইজ ক্লোজড।”

অর্ধাঙ্গিনী দ্বিতীয় পরিচ্ছদ পর্ব ৮

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here