অর্ধাঙ্গিনী দ্বিতীয় পরিচ্ছদ পর্ব ৮

অর্ধাঙ্গিনী দ্বিতীয় পরিচ্ছদ পর্ব
নুসাইবা ইভানা

তুষি অন্তরের হাত ধরে বসে আছে। অন্তর তুষির হাত ছাড়িয়ে নিয়ে বলে, “তোমার একটা ভুলের জন্য এতগুলো মানুষের জীবন আজ ধ্বংসের মুখে। আমি তোমাকে ক্ষমা করতে পারবো না তুষি। ঘৃণা করতেও পারবো না তোমাকে। আমার জীবনের প্রথম ভালোবাসা তুমি। তাই তোমাকে ছেড়ে দিচ্ছি।”
তুষি হাঁটু মুড়ে বসে পড়লো অন্তরের পায়ের সামনে, “আমি মানছি আমার ভুল ছিলো। ওই বয়সে ঠিক ভুল বোঝার মতো জ্ঞান আমার ছিলো না। মজার ছলে টাইমপাস করছিলাম আমি।”
“দেড়-দুই বছর কেউ মজার ছলে টাইমপাস করে! নাইস জোকস! জাহিন যে নয়নার জন্য পার্সেল পাঠাতো সেগুলো কী করতে? নাকি ওসবের লোভকে তুমি টাইমপাস নাম দিয়েছো?”

“বিশ্বাস করো, প্রথম দিকে টাইমপাসই ছিলো, ধীরে ধীরে আমি বুঝতে পারলাম ব্যাপারটা সিরিয়াস পর্যায়ে চলে যাচ্ছে। তখন আমি জাহিনকে বললাম আমার পক্ষে প্রেম করা সম্ভব না।”
“ও বলল প্রেম করতে হবে না। আমার একটা ইম্পর্ট্যান্ট কাজ আছে শেষ করে এসে তোমাকে নিয়ে সংসার করবো।”
“আপনার আর আমার এজ ডিফারেন্স দেখেছেন?”
“ওসব এজ-টেজ বুঝি না আমি। আমি তোমাকে ভালোবাসি মানে তোমাকে আমার সাথেই বাকি জীবন কাটাতে হবে।”
“আপনার সাথে আমাকে মানাবে না। আমি দেখতে সুন্দর না।”

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

“দেখো, আমার হাতে সময় খুবই কম। এমন সময় এসব কথা বলছো এখন আমার হাতে মাত্র তিন ঘণ্টা সময় আছে। এক বছর ভালোমতো পড়াশোনা করো। নিজেকে সব ছেলেদের থেকে দূরে রাখবে। আমি ফিরে এসেই তোমাকে বৌ করে নিয়ে আসবো। ভালোবাসা মানে সারাজীবন সাথে থাকার প্রতিশ্রুতি। ভালোবাসি বলার আগে চিন্তা করা দরকার ছিলো তোমার। আমার সাথে তোমাকে মানাবে নাকি মানাবে না।”
“এরপর দীর্ঘ এক বছর আর কোনো খোঁজ নেই। আমিও এসব ভুলে গিয়েছিলাম। নাম্বার চেঞ্জ করেছি, সব জায়গা থেকে ব্লক করেছি। ফেক একাউন্ট ছিলো সেটাও ডিলিট করে দিয়েছি। বিশ্বাস করো, আমি বুঝতে পারিনি কোনো মানুষ এতো সাইকো হতে পারে।”
“ছিঃ তুষি, সামান্য কিছু গিফটের জন্য একটা ছেলের ইমোশন নিয়ে খেলে এখন তাকে সাইকো বলো! তুমি এক্ষুনি আমার সাথে চলো। জাহিনকে সব সত্যিটা জানাও।”
“জাহিন সবটা জানে।”
অন্তর বসে পড়লো চেয়ারে। “হোয়াট?”

অতীত…
“পাঁচ মাস আগেই আমি এক সন্ধ্যায় ক্রাশ স্টেশন রেস্তোরাঁয় ওনার সাথে দেখা করি। কর্নারের একটা টেবিল বুক করা ছিলো। আমি চুপচাপ বসে ছিলাম। ভয় হচ্ছিলো জানি না এসব শোনার পর কী রিয়্যাকশন হবে সেই টেনশনে। হঠাৎ জাহিন এলো। সবুজ পাঞ্জাবি পরে। খুব সুন্দর পরিপাটি হয়ে এসেছিলো। এসেই কোনো ভনিতা ছাড়া বলে, ‘কে আপনি? আর আমাকে টেক্সট করে ইমার্জেন্সি কথা আছে বলে কেনো দেখা করতে বললেন?’”
“আমি কাঁপা-কাঁপা কণ্ঠে বললাম, ‘আমি তুষি। সুনয়নার ফ্রেন্ড।’”
“তাতে আমার কী?”
“সুনয়না আর আমি খুব ক্লোজ ফ্রেন্ড।”
“আপনারা কেমন ক্লোজ ফ্রেন্ড সেটা জানানোর জন্য জাহিন চৌধুরীর সময় নষ্ট করছেন!”
“ভাইয়া, আসলে আপনাকে একটা সত্যি কথা জানানোর ছিলো।”

“আপনাদের কণ্ঠ এতো সিমিলার বাহ! মনে হচ্ছে আপনি ডুপ্লিকেট সুনয়না। কী কথা দ্রুত শেষ করুন।”
“আমি এতক্ষণ নিচে তাকিয়ে ছিলাম। হঠাৎ সামনে তাকিয়ে দেখি পুরো রেস্তোরাঁয় ফাঁকা। দুজন ওয়েটার আর আমরা দুজন আছি শুধু। আমার বুক কেঁপে উঠলো। কপালে ঘাম জমতে শুরু করেছে। ঘাম মুছে, এক গ্লাস পানি খেয়ে গলাটা ভিজিয়ে নিয়ে চোখ বন্ধ করে বললাম, ‘আসলে ওই মেয়েটা আমি যে আপনার সাথে প্রেম করেছিলাম। ওই ফোনকল, ওই টেক্সট, ওই গিফট সব আমি নিয়েছি। নয়না এসবের কিছুই জানে না। আমাকে যা ইচ্ছে শাস্তি দিন, প্লিজ নয়নার কোনো ক্ষতি করবেন না।’”
অন্তর বলল, “তারপর?”

“তারপর সাথে সাথে আমার মুখ চেপে ধরলো, চিৎকার করে বলল, ‘তুই কি আমাকে ফিডার খাওয়া বাচ্চা ভেবেছিস? আমি জাহিন চৌধুরী, আমার সাথে কোনো ছলচাতুরী চলবে না।’”
“বিশ্বাস করুন ভাইয়া, সব দোষ আমার, আমি দোষী। সুনয়না কিছু জানতো না।” আমাকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিয়ে বলে, “এখন সত্য মিথ্যা দুটোই সমান। আর সবচেয়ে বড় কথা ভালো তো আমি বেসেছি সুনয়নাকে, তোকে না।”
“প্লিজ ভাইয়া, আপনার যা শাস্তি দেওয়ার আমাকে দিন। নয়নাকে ছেড়ে দিন।”
“আরেহহ বাহ! সারাক্ষণ তো জান, জান বলে মুখে ফেনা তুলতি এখন জান থেকে সোজা ভাই!”
“তোর জন্য সবচেয়ে বড় শাস্তি এটা জানা যে সুনয়না আর বেঁচে নেই। আরো বড় শাস্তি তোর ভুলের জন্য হয়তো আমার ভাইটাও বাঁচবে না। আমি ওকে মারবো না। এতো বড় পাপী আমি না। আদালত মারবে ওকে। হয়তো ফাঁসি দিয়ে নয়তো যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দিয়ে।”

অন্তর তুষির দুই বাহু ধরে বলে, “দেখেছো তোমার মজা করার পরিণতি? তোমার মজা, তোমার লোভ দুটো মানুষের জীবন শেষ করে দিলো।”
“আমি কী করবো আমাকে বলো, আমি সেটাই করতে রাজি। নয়তো আমি নিজেকে শেষ করে দিবো।”
“তোমার কিছু করতে হবে না। যা করার আমাকে করতে হবে। জাহিন শুধু এই ভুল করেনি, আরো অনেক হিসেব বাকি জাহিনের কাছে।”

আজকে দিনটা মোটামুটি ভালো কাটলো নয়নার। সন্ধ্যাবেলা নিজের হাতে দুধ চা বানিয়ে বানালো, সাথে মিনি মোগলাই পরোটা। থলামুয়ানা তখন গাছ-লতাপাতা দিয়ে ঔষধ বানাচ্ছিলো। নয়না নাস্তা রেডি করে থলামুয়ানাকে ডেকে আনলো।
“এটা কী খাবার?”
“আপনি আমাকে আপনার ট্র্যাডিশনাল খাবার খাওয়া শিখিয়েছেন। আর আমি আমাদের পছন্দের খাবার খাওয়া শিখাবো আপনাকে। যতটুকু আমি পারি আর কী!”
নাস্তা করতে করতে দুজনে গল্প করছিলো। ঠিক তখন ঈশান বলল, “বাহ! আমাকে ছেড়েই নাস্তা খাওয়া চলছে? আমার কথা কারো স্মরণ নেই।”
“ডাক্তার সাহেব, এটা কিন্তু একদম ঠিক না। খাওয়ার সময় বিনে দাওয়াতে মেহমান।”
“জ্বি ম্যাডাম, বিনে দাওয়াতেই আসতে হলো। এখন আপনার কী অবস্থা?”
“এই তো ভালো।”
নাস্তা শেষ করে ঘরের বাইরে মাচায় এসে বসলো দুজন। ঈশান বলল, “তো কী ভাবলেন মিস অলিভিয়া?”

“মিস সুনয়না হবে।”
“আপনার নাম সুনয়না?”
“হুম, সুনয়না।”
“নাইস নেম। আপনার নামটা একদম পারফেক্ট আপনার জন্য।”
“কীভাবে?”
“আপনার চোখ দুটো অনেক সুন্দর। অবর্ণনীয় সৌন্দর্য আপনার দৃষ্টিতে। সে হিসেবে সুনয়না নামটা একদম পারফেক্ট।”
“তারপর মিস সুনয়না ভাবলেন কিছু?”
“ভেবেছি, ভাবতে গেলে মনে হয় সব সত্যি মিথ্যে। আমি শুধু ওই মানুষটাকে ভালোবাসি এই সত্যি ছাড়া।”
“মিস সুনয়না, আপনি আবেগ না বিবেক কাজে লাগান।”
“আবেগের কোনো মূল্য কেনো নেই ডাক্তার সাহেব?”
“কারণ আবেগ দিয়ে জীবন চলে না।”

“তাহলে শুনুন, সেদিন প্ল্যান করাই ছিলো আমরা সাজেক আসবো হানিমুনে।”
“সেদিন অস্বাভাবিক কোনো ঘটনা ঘটেছে?”
“হ্যাঁ, কিছুটা অস্বাভাবিক একটা ঘটনা লেগেছে আমার দৃষ্টিতে। সেটা হলো, ওইদিন আমরা যাবো সেটা সবাইকে জানিয়ে যাওয়ার কথা। কিন্তু হঠাৎ একজন সার্ভেন্ট আমাকে একটা পার্সেল দিয়ে যায়। সেখানে চিরকুট থাকে, আমি যাতে কাউকে না বলি আমরা যাচ্ছি হানিমুনে। যে নীল শাড়িটা পরা ছিলাম সেটাও ছিলো সাথে।”
“আপনার ফোন?”
“ইয়েস। এটাও একটা অস্বাভাবিক ঘটনা। আমার ফোনটা আমি ভুলে বাসায় ফেলে আসি।”
“তাহলে আপনি সাজেক পৌঁছালেন কী করে?”
“আমার হ্যাসব্যান্ড দ্য গ্রেট পাইলট জিয়ান রেজা চৌধুরী আমার জন্য গাড়ি, ড্রাইভার সব এরেঞ্জ করে রেখেছিলো।”
“আমার মনে হচ্ছে এখানে একটা কিন্তু আছে মিস অলিভিয়া— ওহ সরি, মিস সুনয়না। এতো কিছু কাকতালীয় না, এসব কিছু তো সূক্ষ্ম প্ল্যান।”
“হুম। প্ল্যান আমার বি-লাভ হ্যাসব্যান্ড রেজা চৌধুরীর নিখুঁত প্ল্যান। পৃথিবীতে কোনো মানুষকে বিশ্বাস করতে হয় না।”
“আপনার হ্যাসব্যান্ড আপনাকে কেনো মেরে ফেলবে? আপনাকে মেরে ওনার লাভ কী?”
“রিভেঞ্জ।”
“আপনি আজ রাতে আরো গভীরভাবে ভাববেন। আমার মনে হচ্ছে এখানে একটা রহস্য আছে। ভাবছি একজন গোয়েন্দার সাথে যোগাযোগ করবো, সে সহজেই রহস্য উন্মোচন করতে পারবে।”
“আর কিছুই করতে হবে না। আপনি কী আমাকে একটা মোবাইল দিতে পারবেন?”
“আমার নিজের দুটো ফোন আগামীকাল আপনার জন্য নিয়ে আসবো একটা।”
“ধন্যবাদ আপনাকে। আপনি আর চাচা না থাকলে হয়তো আমার লাশও পচে যেতো এতোদিন।”

জাহিন মনে মনে হাসছে, অবশেষে তার মনমতো রায় হলো। যদিও এসব তো তারই কারসাজি। উফফ, আজ রাতে শান্তির একটা ঘুম হবে। তারপর হাতের কাজগুলো শেষ করতে হবে।
জজ সাহেব উঠে যাবে এমন সময় একজন বলল, “কেস ক্লোজড কী করে হয়? কেস তো সবে ওপেন হবে, জজ সাহেব। আপনারা যার শাস্তি নিশ্চিত করেছেন, তিনি হলেন জাহিন চৌধুরী। আর ওই যে হ্যান্ডসাম স্যুটে বসে আছে, আসল ক্রিমিনাল জিয়ান রেজা চৌধুরী। নিজে অন্যায় করে ভাইয়ের ঘাড়ে দোষ চাপিয়ে দিয়েছে।”
আদালতে উপস্থিত সবাই নড়েচড়ে বসলো; সবার চোখেমুখে বিস্ময়।

“আমি অন্তর দেওয়ান, আসামি পক্ষের নতুন উকিল। আমি থাকতে কোনো নিরপরাধ ব্যক্তি শাস্তি পাবে না।”
কোর্টের সবার মধ্যে গুঞ্জন শুরু হলো। জজ সাহেব বলল, “প্লিজ, আপনারা সবাই চুপ করুন।”
জাহিন নড়েচড়ে বসলো, জেতে ম্যাচ হেরে যাওয়ার ভয় ঢুকে গেলো ভেতরে। এই সময় অন্তরকে এখানে একদম আশা করেনি জাহিন।
“ইউর অনার, ওই যে বসে আছে, আসামি জিয়ান রেজা চৌধুরী। আর এই আসামির কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে আছে আমার মক্কেল জাহিন চৌধুরী।”
জাহিন উঠে বলে, “কী সব বলছিস তুই? আমি জাহিন।”
এই প্রথম জিয়ান কথা বলল, “আমি জাহিন।”
জজ সাহেব, এরা দুজন আমার বিরুদ্ধে চক্রান্ত করেছে। এরা দুজনে আমাকে ফাঁসাতে এসব মিথ্যে বলে কোর্টের মূল্যবান সময় নষ্ট করছে।

অর্ধাঙ্গিনী দ্বিতীয় পরিচ্ছদ পর্ব ৭

অন্তর জিয়ানের হাতের উপর হাত রেখে বলে, “মিথ্যে কেন বলছেন ভাই? আপনি সত্যিটা মেনে নিন, আপনি জিয়ান। ওই যে অপরাধী সেজে যে দাঁড়িয়ে আছে, সে আমার বন্ধু জাহিন। প্লিজ, আপনি আপনার নোংরা খেলাটা বন্ধ করুন।”
জাহিন গর্জে উঠে ভরা কোর্টে অন্তরের কলার চেপে ধরে বলে, “অন্তর, আমার পিছু লাগতে আসিস না। পরিণাম ভালো হবে না।”

অর্ধাঙ্গিনী দ্বিতীয় পরিচ্ছদ পর্ব ৯

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here