অর্ধাঙ্গিনী দ্বিতীয় পরিচ্ছদ পর্ব ৯
নুসাইবা ইভানা
ইউর অনার দেখলেন, আপনি কে আসল অপরাধী? আসল অপরাধী এতদিন ধরে বাইরে ঘুরছে। অথচ একজন নির্দোষ মানুষ সাজা ভোগ করছে!
জাহিন চিৎকার করে বলে, “আমি জাহিন চৌধুরী।”
জিয়ান বলে, “আমি জাহিন চৌধুরী। ও আমার ভাই জিয়ান রেজা চৌধুরী। মাই লর্ড, আমাকে বিশ্বাস করুন। আমার এই ভাই নিজের হাতে তার ওয়াইফকে হত্যা করেছে। এরপর আমাকে ফাঁসির জেলে পাঠিয়ে দিয়েছে।”
“সাইলেন্স ইন দ্য কোর্ট। আজকের মতো এই আদালত এখানেই মুলতবি ঘোষণা করা হলো। আগামী শুনানি পর্যন্ত। দুজনেই পুলিশ হেফাজতে থাকবে।”
অন্তর জাহিনের দিকে তাকিয়ে হাসছে।
জাহিনের হাতে হাতকড়া। অন্তরের সামনে দাঁড়িয়ে বলে, “তোর এত বড় সাহস, জাহিন চৌধুরীর বিরুদ্ধে চক্রান্ত করিস? তোকে শালা তখনই মেরে দেওয়া উচিত ছিল।”
“ঠিক বলেছিস। তুই আমাকে বাঁচিয়ে রেখে মস্ত বড় ভুল করেছিস। এখন দেখ, কোথাকার জল কোথায় গড়ায়।”
“দেখে নেব তোকে।”
“আগে নিজেকে দেখ। তুই নিষ্পাপ একটা মেয়েকে মেরে ফেললি! সেই দায়ে আমার নিজের ভাইয়ের ফাঁসি কার্যকর করার জন্য আরেকজন মেয়ের লাশ এনে ফেক রিপোর্ট বানালি! তবে কাজটা তুই ভালোই করেছিস, ওই রিপোর্ট এখন তোর বিরুদ্ধে কাজে আসবে। তুই মানুষ নোস, জাহিন, তুই পশুর চেয়েও নিকৃষ্ট হয়ে গিয়েছিস। পোস্তগোলা আর চাঁদপুর ব্রিজের নিচে নিয়ে নির্দোষ মানুষদের খুন করতে করতে তোর কলিজা বড় হয়ে গেছে। তোর মতো মানুষকে আমি অন্তর দেওয়ান যদি ফাঁসির কাঠে না ঝোলাতে পারি, তাহলে নিজের নাম পালটে রাখব। শালা জানোয়ার।”
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
জাহিনকে নিয়ে চলে গেল পুলিশ। অন্তর জিয়ানের সামনে এসে জিয়ানকে জড়িয়ে ধরে বলে, “ভাইয়া, আমি আপনার সাথে কোনো অন্যায় হতে দেব না। আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ আমার কথামতো কাজটা করার জন্য। আর কিছুদিন, তারপর জাহিন তার পাপের শাস্তি পাবে।”
“আমার নয়নার কোনো খবর পেলে?”
“এখনো পাইনি, তবে খুব দ্রুত পেয়ে যাব। আপনি স্ট্রং হোন, ভাইয়া। একদম নিখুঁত অভিনয় করতে হবে। যাতে কোনোভাবে কারো সন্দেহ না হয়। আপাতত আপনার বাবা-মায়ের কাছেও লুকাতে হবে সত্যিটা। সব প্রমাণ হলে তারপর সত্যিটা জানাব তাদের।”
**অতীত…**
অন্তর তুষির কথা শুনে সাথে সাথে থানায় এসে জিয়ানের সাথে দেখা করে। অন্তর যেহেতু সাবেক গোয়েন্দা কর্মকর্তা, তার জন্য বিষয়টা সহজ হয়। অন্তর জিয়ানকে সবটা খুলে বলে। শুধু নয়নার মৃত্যুর কথাটা বাদে।
জিয়ান বলল, “এসব করলে কি আমি নয়নাকে খুঁজে পাব? নয়নাকে না পেলে এসবের কোনো মূল্য আমার কাছে নেই।”
“আপনি যদি বাইরে বের না হন, তাহলে নয়নাকে কী করে খুঁজবেন? আর জাহিনের মতো অপরাধী এভাবে ঘুরবে? আপনি জানেন ওর কাজটা কী? সরকারের দালালি করা। সরকারপক্ষের হয়ে কতজনকে ও নিজের হাতে খুন করেছে, তার হিসাব নেই। আপনি কি চান এমন একজন মানুষ শাস্তি না পাক? প্লিজ ভাইয়া, আপনি আমার কথামতো কাজ করুন। আমি ন্যায়ের পক্ষে লড়তে চাই, আমাকে সহযোগিতা করুন।”
জিয়ান কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলে, “আমি রাজি।” অন্তরের হাত ধরে বলে, “তুমি আমার ছোট, তবু তোমার কাছে হাত জোড় করছি, আমার নয়নাকে খুঁজে দাও। জানি না আমার নয়না কেমন আছে।”
“আমি খুঁজব। আমার সর্বোচ্চ চেষ্টা করব ভাবিকে খোঁজার।”
“ধন্যবাদ, ভাইয়া।”
**বর্তমান…**
“ভাইয়া, আপনি চিন্তা করবেন না। আমি নিজে জাহিনের বিরুদ্ধে কেস স্টাডি করব। ওর জালে ওকেই আটকে ফেলব। যাতে ও নিজের মুখে সত্যিটা স্বীকার করতে বাধ্য হয়।”
জিয়ানের চোখের কোণে নোনা পানি চিকচিক করছে। ভারাক্রান্ত হৃদয়ে বলল, “আমার ভাইটা কী করে এমন অমানুষে পরিণত হলো? আমার সেই জাহিন, যার জন্য সব সময় আমি নিজের বুক পেতে দিতাম। সেই ভাই আমার বুকে ছুরি বসালো? সামান্য একটা বিষয়। ধরে নিলাম, ওর সাথে নয়নার কথা হতো, ওদের মধ্যে রিলেশন ছিল। তাই বলে কি কথা বলে এই বিষয়টা মিটমাট করা যেত না? একটা ভুলের জন্য মানুষ হত্যা করে ফেলল!”
“ভাই, ওর কাজটাই এটা। বিরোধী পক্ষের অনেক বাঘা বাঘা নেতারাও ওর হাতেই খুন হয়েছে। এসব করতে করতে ও আর মানুষ নেই, হিংস্র পশুতে পরিণত হয়েছে। জাহিনকে ওর পাপের শাস্তি দিতে হবে। নয়তো ও কোনোদিন বুঝতে পারবে না, ও কত জঘন্য কাজ করে যাচ্ছে সামান্য কয়টা টাকা আর পজিশনের জন্য।”
“ওর কি এতই টাকার লোভ? আমার বাবার কি টাকা কম ছিল? ওর টাকা লাগলে সব নিয়ে নিত।”
একজন পুলিশ এসে বলল, “আপনাদের টাইম শেষ। আসামিকে কারাগারে নিয়ে যেতে হবে।”
অন্তর জিয়ানকে বিদায় জানাল। শেষবারের মতো বলল, “এরপরের বার আপনি মুক্ত বাতাসে শ্বাস নেবেন। এটা এই অন্তর দেওয়ানের ওয়াদা।”
নয়না একটা বাঁশের দোলনায় মনমরা হয়ে বসে আছে।
ঈশান এসে বলে, “রেডি হোন।”
“মানে?”
“আপনাকে নিয়ে ঢাকা যাব।”
“আমি ঢাকা যাব না। আপনি আমার?”
“আমি কেউ না, আবার কেউ। এখন আপনি আমার সাথে যাবেন মানে যাবেন। দেখুন, এভাবে কতদিন থাকবেন?”
“যতদিন বেঁচে থাকব। মরে গেলে কবর দিয়ে দিয়েন। এমনিতেও ওই শহরের জন্য আমি মৃত।
“আমি আপনার ভাষা শুনেই বুঝেছিলাম, আপনার বাসা ঢাকা বা ঢাকার আশপাশে হবে। দেখুন মিস সুনয়না, জীবনটা ছেলেখেলা না। আপনার পরিবার, আপনার প্রিয়জনদের কথাটা একবার ভাবুন।”
“মানুষ মারা গেলে তার জন্য সর্বোচ্চ এক সপ্তাহ বা এক মাস কান্না করে মানুষ, অথবা তারচেয়েও কম। অতএব আমার চ্যাপ্টার তাদের জন্য ক্লোজ।”
ঈশান নয়নার হাত ধরে বলে, “এরকম ছেলেমানুষি করার কোনো মানে হয় না, মিস সুনয়না। আপনাকে আমার সাথে যেতেই হবে।”
নয়না এক ঝটকায় ঈশানের হাত ছাড়িয়ে বলে, “ডাক্তার ঈশান, এই দুঃসাহস আজ করেছেন, আর একবার করার কথা চিন্তাতেও আনবেন না।”
“আপনি রেগে কেন যাচ্ছেন? আমরা আপনার ভালো চাই। এখানের সবাই আপনাকে নিয়ে আলোচনা করে, গসিপ ছড়ায় নানা রকম। এসবের সাইড এফেক্ট চাচার উপর এসে পড়বে। বিচারসভা বসবে।”
“আজকের পর থেকে আপনার সাথে আমার আর কোনো কথা হবে না। বিচারসভা বসলে সেটা আমি বুঝে নেব।” বলেই দ্রুত চলে গেল নিজের ঘরে। গিয়েই দরজা বন্ধ করে দিল।
ঈশান তাকিয়ে রইল নয়নার চলে যাওয়ার পথে। ঈশান মোবাইল বের করে একজনকে কল করল।
ওপাশ থেকে একজন বলল, “স্যার, শুধু নাম বললে হবে না। এক নামের অনেক মানুষ থাকে। প্লিজ, বাবার নামটা বললে আমাদের জন্য সুবিধা হতো।”
ঈশান কল কেটে বলে, “ধুর, কেন ঝামেলা করতে গেলাম! আমার উচিত ছিল আরো কিছুদিন ওর সাথে মিশে কথা বের করা। কেন যেতে চায় না পরিবারের কাছে? কী এমন অতীত আছে ওনার?”
“মিসেস মাহমুদ, আপনি মিস্টার মাহমুদের বক্ষপিঞ্জরের বন্দি পাখি। ঝগড়া হবে, রাগারাগি হবে, অভিমান হবে। কিন্তু রাগ করে ছেড়ে আসার কোনো নিয়ম এই কারাগারে নেই। আপনি আমার, শুধুই আমার। পুরো পৃথিবীতে আমার একমাত্র ব্যক্তিগত নিজের মানুষ।”
“এসব ফিল্মি ডায়লগে সায়না গলে না।”
“নিজের পায়ে হেঁটে আসবেন? নাকি আপনার পুরো পরিবারের সামনে থেকে কোলে তুলে চুমু খেতে খেতে নিয়ে আসব?”
“আপনার যা খুশি করুন, আমি যাব না।”
“তুমি চাইছ সত্যি সত্যি আমি নির্লজ্জ হই শ্বশুর-শাশুড়ির সামনে?”
“সেটা আপনার ইচ্ছে। তবু আমি যাব না।”
“কী করতে হবে, মহারানী?”
“এই পাঁচদিন কোথায় ছিলেন? কেন ছিলেন? সব কিছু বলতে হবে, একদম সব। এক বিন্দু পরিমাণ মিথ্যা বলতে পারবেন না।”
অর্ধাঙ্গিনী দ্বিতীয় পরিচ্ছদ পর্ব ৮
“আচ্ছা, বলব সব। ভেতরে আসতে দাও।”
“আগে কানে ধরে পাঁচবার ওঠবস করুন। সাথে বলবেন, ‘সরি বউ, আর কখনো তোমার কাছে কিছু লুকাব না।’ বারবার বলবেন আর ওঠবস করবেন।”
“জোহুকুম, মহারানী। লোকে পাগল বলুক, মাতাল বলুক, আমি আমার বউয়ের পিছু ছাড়ব না।”
