অর্ধাঙ্গিনী পর্ব ৭৫

অর্ধাঙ্গিনী পর্ব ৭৫
নুসাইবা ইভানা

অনিকেত চেম্বার থেকে বের হয়েছে রাত ন’টায়। রিকশা নিয়ে কতক্ষণ রাতের ঢাকা শহর ঘুরলো। তখন বাজে রাত সাড়ে এগারোটা। কল করলো সায়নাকে। ওপাশ থেকে কোনো রেসপন্স নেই। অনেক ভেবেও কোনো কূলকিনারা পেল না। জিয়ানের নম্বর বের করে জিয়ানকে কল করলো।
“কিরে, বউ পেয়ে তো ভুলেই গেছিস আমাদের। হঠাৎ মনে পড়লো, কী ব্যাপার?”
“শ্বশুরবাড়িতে প্রথম গেলে কী কী নিতে হয়?”
“জিয়ান ক উচ্চারণ করে বল, ওয়েট, একটু উঠে দূরে সরে বলি।”

অনিকেত বুঝে গেছে জিয়ান কী বলতে চাইছে। জিয়ান কিছু বলার আগেই অনিকেত বলল, “চুপ কর শালা, এসব তোর বলতে হবে না। বেড়াল মারা এখনো বাকি নেই। তোর মতো নাকি? বাসর রাতেই বেড়াল মারা ডান।”
“তোর লজ্জাও করে না এসব বলতে! শালা, বিয়ে করবি না বলে কী কী নাটক করেছিস, সব জানা আছে। কবুল বলেই ঝাঁপিয়ে পড়েছিস, ছিহ!”
“রাখ তোর ছিহ। বিয়ে করতে চাইনি, কিন্তু কবুল বলার পরে বাসর করব না, তাও তো বলিনি।”
“বন্ধু আমার ছুপা রুস্তম!”
“ভাই, তোর চিমটি কাটা শেষ হলে বল, কী কী নিয়ে যাবো।”
“মিষ্টি, দই, তারপর সব ফল দুই-তিন কেজি করে নিয়ে নিবি।”
“জীবনের প্রথম শ্বশুরবাড়ি যাচ্ছি। মনের মধ্যে কেমন কেমন করছে।”

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

“সর শালা, বিয়ে করে ফেলেছিস আর এখন নাটক। যাহ, জামাই আদর খেয়ে আয়। বাঙালিরা জামাই আদর করতে কার্পণ্য করে না। একটা এসিটির মেডিসিন খেয়ে নিস।”
“কেন, তোর ফুপির হাতের রান্না ভালো না?”
“রান্না ভালো। কিন্তু ভাই, প্রথমবার শ্বশুরবাড়িতে গেলে যে লেভেলের খাবারের চাপ পড়ে, তাই বললাম।”
“শোন না, বউ তো রেগে আছে। ওর জন্য কী নেওয়া যায়?”
“চকোলেট, ফুল বা যা ওর পছন্দ, সে-সব কিছু।”
“তোকে ধন্যবাদ দিতে পারব না। যাহ, বউয়ের কোলে যা, আমিও যাই।”

অনিকেত দশ কেজি মিষ্টি, পাঁচ কেজি দই, তিন কেজি আপেল, তিন কেজি মালটা, তিন কেজি আঙুর, তিন কেজি নাসপাতি, তিন কেজি কমলা, তিন কেজি আনার, তিন কেজি কিউই, তিন কেজি ড্রাগন ফল, তিন কেজি স্ট্রবেরি, তিন কেজি পেয়ারা, তিন কেজি রামবুটান। অনেকগুলো ক্যাডবেরি চকোলেট। সাথে বিশাল বড় এক ফুলের বুকেট কিনে নিলো। রাস্তায় দাঁড়িয়ে ভাবছে, এসব নিয়ে যাবে কী করে। উপায়ান্ত না পেয়ে একটা ভ্যান ভাড়া করে তাতে সব কিছু উঠিয়ে দিয়ে নিজেও পা ঝুলিয়ে সামনে বসলো। চোখের চশমা ঠিক করে, মোবাইলের স্ক্রিনে নিজের চেহারাটা একবার দেখে নিলো।
“মামা, আপনি এত কিছু নিয়ে কোথায় যাচ্ছেন?”
“শ্বশুরবাড়ি যাচ্ছি।”

জিয়ান বের হয়েছে সন্ধ্যায়, এখনো বাসায় ফেরেনি। নয়না খাবার খেয়ে রুমে এসে সেই কখন থেকে অপেক্ষা করছে। বারান্দায় বসে আছে একা একা। টেক্সট পাঠিয়েছে, তাও রিপ্লাই করেনি। নয়না আকাশের দিকে তাকিয়ে বলে, “মন ভেসে যায় মেঘের ভেলায়, রাত কেটে যায় অবহেলায়।”
তারপর নিজেই মনে মনে বলে, “কী সব বকবক ছন্দ বানাই আমি!” কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে আবার হাতে মোবাইল নিলো, তারপর ভেবেচিন্তে টাইপ করলো, “হতাম যদি সাদা মেঘের ভেলা, তোমার ছায়া হয়ে কাটিয়ে দিতাম আমার সারাবেলা। এখন যদি না আসো, আমি কিন্তু ভীষণ রাগ করবো। একদম পাহাড়ের সমান রাগ।”
বারান্দার দোলনায় শুয়ে শুয়ে আকাশের তারা গুনছে নয়না। যেন এর চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ তার কাছে আর কিছুই নেই।

সায়না রাত বারোটা পর্যন্ত অপেক্ষা করেছিল অনিকেতের জন্য। অবশেষে আশা ছেড়ে দিয়ে রাতে না খেয়েই শুয়ে পড়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিল।
সুমি বেগম এসে বলল, “তুই রাতে খাবার না খেয়ে কেন শুয়ে পড়ছিস?”
“খিদে নেই আম্মু।”
“আমাদের প্রতি এখনো রেগে আছিস! অথচ রাগটা আমাদের করার কথা ছিল।”
“আচ্ছা আম্মু, তোমরা যদি আমাকে জন্ম দেওয়ার পর রাস্তায় ফেলে আসতে, তাহলে তো আমিও অনাথ হতাম। তারপর বড় হলে দোষটা কার হতো?”
“দেখ, মানুষ বোঝে না, এমন না। কিন্তু সমাজ এসব মেনে নেয় না।”

“এই সমাজ দিয়ে কী হবে? সমাজ কি আমাকে ভাত খাওয়াবে? নাকি সুখ-দুঃখ ভাগ করে নেবে? তুমি জানো, তোমরা কখনো এমন ভালো একটা মানুষ আমার জন্য খুঁজে আনতে পারতে না। উনি এত ভালো, আমি ওনার যত প্রশংসা করব, কম মনে হবে।”
“আমরা তো মেনে নিয়েছি। তুই সুখে থাকলেই হয় আমার।”
“আম্মু, তুমি কোনোদিন ওনার কষ্টটা অনুভব করতে পারবে না। একটা মানুষ যে কোনোদিন বাবা-মায়ের আদর, যত্ন, শাসন কিছুই পায়নি। শুধু পায়নি তা কিন্তু না, সে জানেও না বাবা-মায়ের ভালোবাসা কেমন হয়। তোমাদের কি উচিত না সেই মানুষটাকে একটু সম্মান আর একটু ভালোবাসা দেওয়া?”
“আমি কি মানা করেছি নাকি! তুই আসতে বল।”

মা-মেয়ে কথা বলতে বলতে রাতের একটা বেজে গেল। ঠিক তখন দারোয়ান ফোন করল বাসার ল্যান্ডলাইনে। সুমি বেগম কল রিসিভ করে বলল, “জ্বি, ডাক্তার অনিকেত মাহমুদ আমার মেয়ের জামাই। ভেতরে আসতে দিন।” কল কেটে সায়নার রুমে এসে বলল, “তোর ডাক্তার সাহেব এসেছে। আচ্ছা, তোরা কি অনেক গরিব? না, মানে ভ্যানে আসতে হলো! সিএনজি বা রিকশাও এফোর্ড করতে পারিস না? ডাক্তারদের ইনকাম তো খারাপ না!”
“কী বলছ এসব আম্মু? ওনার নিজের গাড়ি, নিজের ফ্ল্যাট সব আছে।”
“কিন্তু দারোয়ান বলল, ভ্যান গাড়িতে করে এসেছে।”
সায়না ওড়না গায়ে জড়িয়ে ঘর থেকে বের হয়ে লিফটে উঠল। মনে মনে বলল, “এই গাধা আবার কী অকাজ করেছে, কে জানে? সিরিয়াসলি ভ্যান গাড়িতে চড়ে এসেছে?”

সায়না নিচে এসে দেখে, দারোয়ান আর ভ্যান ড্রাইভার একের পর এক প্যাকেট এনে লিফটে রাখছে।
সায়না অনিকেতের দিকে তাকিয়ে বলল, “এসব কী? মাঝরাতে এসব হচ্ছে টা কী! মিস্টার ক্যাবলাকান্ত?”
অনিকেত ফুলের বুকেটটা সায়নার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলল, “তোমাকে ছাড়া বাসায় শূন্য শূন্য লাগছিল। তাই চলে এলাম।”
সায়না আর কিছু বলল না। বাসায় চলে এল। সাথে অনিকেতের আনা ফল, মিষ্টি। ফ্লোরের খালি অংশ পুরোটাই ভরে গেল।
সুমি বেগম হেসে বলল, “তা, বাবা, দোকানে আর কিছু ছিল না!”
“সরি আন্টি, রাত তো, তাই বেশি কিছু আনতে পারিনি।”
“ওহ, কম আনলে বুঝি। ভাগ্যিস রাত ছিল।”

জাহিন বাসায় এসে শাওয়ার নিয়ে, নুডলস রান্না করে খেয়ে, বেডের ওপর শুয়ে চোখ বন্ধ করে রেখেছে। সে অন্তরকে মারতে চায়নি। কিন্তু এসব কী হয়ে গেল! জাহিন উঠে বসল। ডান হাত মুষ্টিবদ্ধ করে বলল, “সুনয়না, এসব হয়েছে তোমার জন্য। ওই রাতের সব দৃশ্য আমাকে এতটাই আঘাত করেছে। আমি ভেতর থেকে ভেঙে গুঁড়িয়ে গেছি। আমি তোমাকে ছাড়ব না। কিছুতেই না। অন্তর যদি মারা যায়, তোমাকে মরতে হবে। অন্তর বেঁচে থাকলে আমি তোমার জান ভিক্ষা দেব। নয়তো তুমি দেখবে জাহিন চৌধুরী কতটা নিষ্ঠুর হতে পারে।”
জাহিন শার্ট পরে আবার বেরিয়ে পড়ল হাসপাতালের উদ্দেশে। অন্তরের বাবা-মা এখনো জানে না অন্তর হাসপাতালে ভর্তি। জাহিন কয়েকবার চেষ্টা করেও বলার সাহস করতে পারেনি। কীভাবে বলবে! কয়েকদিন আগে মেয়েকে হারিয়েছে, আর এখন ছেলে মৃত্যুর প্রহর গুনছে।

নীলাঞ্জনা বসে আছে জিয়ানের সাথে।
জিয়ান নিচের দিকে তাকিয়ে বলল, “এত রাতে আমাকে এখানে ডাকার মানে কী?”
“আমাকে একটা হেল্প করো। প্লিজ, আমার তোমাকে অনেক প্রয়োজন।”
“কী হেল্প লাগবে আপু? আপনি আমার ওয়াইফের বড় বোন। আমি চেষ্টা করব আপনার হেল্প করার। তবে এই শরীরে এত রাতে আপনার ঘর থেকে বের হওয়া ঠিক হয়নি।”
নীলাঞ্জনা হুট করে জিয়ানের হাত চেপে ধরে বলল, “প্লিজ, আমাকে ক্ষমা করে দাও। আমি আমার পাপের শাস্তি পাচ্ছি। তুমি আমাকে ক্ষমা করে দাও।”

জিয়ান হাতটা ছাড়িয়ে নিয়ে টেবিলের ওপর থাকা পানির বোতল নিয়ে নিজের হাতে পানি ঢালল। এরপর টিস্যু দিয়ে হাত মুছে নিয়ে বলল, “আপনাকে আমি অনেক আগেই ক্ষমা করে দিয়েছি। ক্ষমা কী, আমি তো আপনার প্রতি কৃতজ্ঞ। আপনার জন্য আমি সুনয়নার মতো একজন জীবনসঙ্গী পেয়েছি। ধন্যবাদ আপু।”
“জিয়ান, একবার আমার দিকে দেখো। আমি সেই নীলাঞ্জনা। বাদ দাও সে-সব। লাবিব আমাকে হুমকি-ধমকি দিচ্ছে। আমাকে ওর হাত থেকে রক্ষা করো। আমি আমার সন্তানকে নিয়ে বাঁচতে চাই।”

অর্ধাঙ্গিনী পর্ব ৭৪

“আপনার বাবা বা চাচাকে বলুন। আমি কীভাবে হেল্প করব?”
“তুমি ছাড়া কেউ আমাকে সাহায্য করতে পারবে না। আমার জন্য না হোক, আমার অনাগত সন্তানের জন্য এই হেল্পটা করো। আমি বড্ড অসহায়।”

অর্ধাঙ্গিনী পর্ব ৭৬