অর্ধাঙ্গিনী পর্ব ৭৭
নুসাইবা ইভানা
তুমি কি রাগ করেছ? দেখো, আমি চাইলে তোমার কাছ থেকে বিষয়টি লুকিয়ে রাখতে পারতাম। আমি যখন নাহিদের বাসা থেকে বের হয়েছি, তখন লাগাতার কল আসতে থাকে। এটা হয়তো ওর নতুন নম্বর। রিসিভ করতে গিয়ে ওর কণ্ঠ শুনে কেটে দিতে চেয়েছিলাম। কিন্তু একটা মেয়ে এই অবস্থায় এত রাতে বাইরে এসেছে। তাই গিয়েছি।”
নয়না জিয়ানের দিকে তাকালো।
জিয়ান নয়নার হাত দুটি মুঠোয় বন্দি করে বলল, “অনেক মানুষ জীবনে আসে, আবার চলেও যায়। নীলাঞ্জনা আমার সঙ্গে ভুল করেছিল, মানছি। আমি নীলাঞ্জনাকে ঘৃণা করতে পারি। কিন্তু এটাও সত্য, একটা সময় আমি তাকে ভালোবাসতাম। তোমার বয়স কম, তাই আমি সব সময় চেষ্টা করি তোমার মনে যেন সন্দেহ না জন্মায়। মাঝে মাঝে মানুষের জীবনে এমন একটা সময় আসে, যখন হাজার মানুষের ভিড়েও সে নিঃস্ব হয়ে যায়। তখন খড়কুটো পেলেও সে তা আঁকড়ে ধরে বাঁচতে চায়। আমি মানুষ হিসেবে পারিনি একজন প্রেগন্যান্ট মেয়েকে এত রাতে একা ছেড়ে দিতে। তাই দেখা করে আমার গাড়িটা দিয়ে নীলাঞ্জনাকে বাসায় পাঠিয়ে দিয়েছি। সঙ্গে এটাও বুঝিয়ে দিয়েছি যে আমি ওর সেই খড়কুটো নই। আমি অন্য কারও।”
নয়না জিয়ানকে জড়িয়ে ধরে বলল, “তোমাকে এত কথা বলতে হবে না। আমি জানি তুমি কেমন! তোমার ওপর ভরসা আছে আমার।”
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
জিয়ান নয়নাকে আরও গভীরভাবে জড়িয়ে ধরে বলল, “ভালোবাসি তোমাকে। আমার এই ছোট জীবনটা তোমার নামে উৎসর্গ করে দিয়েছি। ভালোবাসার কাছে মানুষ বড্ড অসহায়।”
নয়না জিয়ানের কাঁধে চুমু দিয়ে বলল, “ভালোবাসার কাছে তুমি অসহায় হও, সেটা আমি চাই না। আমি চাই আমার ভালোবাসা তোমার শক্তি হোক। মানুষ মাত্রই ভুল করে। কখনো ভুল-ত্রুটি হলে আমরা নিজেরা সমাধান করে নেব। আমরা প্রেমিক-প্রেমিকা নই যে কথায় কথায় ঝামেলা করে ব্রেকআপ করে ফেলব। আমি তোমার অর্ধাঙ্গিনী, তোমার জীবনসঙ্গিনী। সব চড়াই-উতরাই পার করে সুখে-দুঃখে একসঙ্গে থাকব।”
জিয়ান নয়নার দুই গালে হাত রেখে বলল, “তোমার মতো করে কে ভালোবাসবে আমায়? এভাবে কে গুছিয়ে নিতে পারত, বলো? তুমি শুধু আমার। এ জন্মে আমি শুধু তোমারই।” আলতো করে ঠোঁটে চুমু খেয়ে বলল, “কাল রাতে আমাদের টিকিট বুক করেছি। তৈরি তো মিসেস চৌধুরী, হানিমুনের জন্য?”
নয়না জিয়ানের কানের কাছে মুখ নিয়ে বলল, “পুরোনো বউ নিয়ে হানিমুনে যাচ্ছ, আবার ভয় দেখাও। এখন কি ভয় পায় নাকি ওসব?”
জিয়ান নয়নার থুতনিতে হাত দিয়ে বলল, “কোন সব?”
নয়না চোখ বন্ধ করে বলল, “ভালো হয়ে যাও, ময়নার বাপ।”
জিয়ান নয়নাকে কোলে তুলে নিয়ে বলল, “তুমি আমার কাছে চিরসবুজ। কখনো পুরোনো হবে না। প্রতিদিন নতুনভাবে, নতুন করে তোমার প্রেমে উন্মাদ হব।”
জাহিন অন্তরের রুমে বসে আছে। অন্তর অর্ধমৃত অবস্থায় বেডে পড়ে আছে। হাসপাতালের এই চার দেয়ালে যেন আটকে গেছে অন্তরের জীবন। পৃথিবীতে সে বেঁচে আছে নাকি মরে গেছে, সেই অনুভূতিও তার নেই। নিষ্প্রাণ হয়ে পড়ে আছে সে, যেন জীবন্ত লাশ।
জাহিন চেয়ার টেনে বসল, অন্তরের দিকে তাকিয়ে বলল, “যখন আমরা সিক্রেট গোয়েন্দা সংস্থায় যুক্ত হই, তখন অনেক শর্ত, অনেক নিয়ম-কানুন মেনে ঢুকতে হয়। তার মধ্যে সবচেয়ে বড় শর্ত, আমরা নিজেদের এই পরিচয় কাউকে বলব না, এমনকি নিজের পরিবারকেও না। আমি জানি, আমি তোর অপরাধী, কিন্তু দোষটা আমার নয়। যখন আমরা এই ফোর্সে কাজ শুরু করি, একদিন হঠাৎ মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর পক্ষ থেকে আমার ডাক আসে। তিনি আমাকে তার নিয়মে চলার হুকুম দেন।
সেদিন আমার শরীরে রাগ, জেদ সব ছিল, কিন্তু পথ ছিল না। প্রধানমন্ত্রীর বিপক্ষে যাওয়া মানে মৃত্যু। হয়তো অনেকের মতো আমাদের লাশও ফেলে দেওয়া হতো পতেঙ্গা সমুদ্র সৈকতে। কত তথ্য উলটপালট করেছি, কত নির্দোষ শাস্তি পেয়েছে। অথচ ক্ষমতার মসনদে বসে থাকা সরকারপক্ষের বড় বড় নেতারা পায়ের ওপর পা তুলে অন্যায় করে গেছে। সেসব জেনেও তাদের সাপোর্ট করেছি। টাকাও কামিয়েছি, কোটি কোটি টাকা। মানুষকে গুম করেছি। তুই হয়তো কিছু বিষয় জেনে গিয়েছিলি। কিন্তু বিশ্বাস কর, তোর বোনের সঙ্গে হওয়া অন্যায়ে আমার হাত ছিল না। মন্ত্রীর ভাগ্নে, মন্ত্রীর ছেলে আর বন্ধু মিলে তোর বোনকে ধর্ষণ করে। আমি যখন স্পটে পৌঁছাই, তখন রিতুর অবস্থা শোচনীয়। আমি দ্রুত ওকে হাসপাতালে নিয়ে যাই। আমার বেড়াল ম্যারিনো স্পটে মারা যায়। আমি তোর বোনকে বাঁচাতে পারিনি। মিস মান্নাতের বাবা-মা মন্ত্রীর বিরুদ্ধে আওয়াজ তুলেছিল। দুজনকে গুম করে খুন করা হয়েছে। তোর বোনের মতো মান্নাতেরও একই অবস্থা হতে পারত। আমি মান্নাতকে বাইরের দেশে পাঠিয়ে দিয়েছি। মানছি, আমি পৃথিবীর সবচেয়ে জঘন্য মানুষ। কিন্তু ক্ষমতায় টিকে থাকতে হলে এসব করতে হয়। এই যে অল্প কয়েক দিনেই আমি বড় পদ পেয়েছি, এটা তো এমনি এমনি নয়। আমি খুব নিকৃষ্ট মানুষ। হয়তো আগামীকাল আমি আমার জীবনের সবচেয়ে নিকৃষ্ট কাজটা করব। তারপর হয় নিজেই নিজেকে শেষ করব, নয়তো নিজেকে অন্য কারও আড়ালে লুকিয়ে ফেলব।”
অন্তর জাহিনের কথা শুনতে পেল কি না, বোঝা গেল না। কোমায় পড়ে থাকা মানুষ কি কথা শুনতে পারে? তবে অন্তরের চোখের কার্নিশ বেয়ে নোনা জল গড়িয়ে পড়ছে।
জাহিন উঠে দাঁড়িয়ে বলল, “তুই বেঁচে থাক। আমি তোর কোনো ক্ষতি করতে চাইনি।” বলেই পা ফেলে বেরিয়ে এল হাসপাতালের কেবিন রুম থেকে।
এই কয়দিন টেনশনে তুষির চোখের নিচে কালো দাগ পড়ে গেছে। একটা মানুষ এভাবে কীভাবে উধাও হয়ে যেতে পারে? কোথাও কোনো চিহ্ন নেই, যেন সে কখনো ছিলই না! তুষির জানামতে, সে সব জায়গায় খোঁজ নিয়েছে। কেউ সন্ধান দিতে পারেনি। ফোনটাও সুইচড অফ। একদিন কলেজেও যায়নি তুষি। অবশেষে সিদ্ধান্ত নিয়েছে, আগামীকাল সকালে অন্তরের বাসায় যাবে। তুষি অন্ধকারে বিছানায় বসে আছে, চোখ জুড়ে তার রাজ্যের চিন্তা। মনটা যেন মরে গেছে। চোখের পানিও যেন ফুরিয়ে গেছে। তুষি মনে মনে বলল, “তোমার কি আমার কথা মনে পড়ে না? এই যে তোমার শোকে আমার ঘুম নেই চোখে, মন নেই দেহে। চোখের অশ্রুও ফুরিয়ে গেছে। তোমার মনে কি সেই টান অনুভব হয় না? কেন ভালোবেসে নিঃস্ব করে দিয়ে গেলে? ভালোবাসায় আমি বরাবরই আনলাকি।”
সায়না অনিকেতের হাতে হাত রেখে ছাদে হাঁটছে, নিজের ছোটবেলার নানা কথা শেয়ার করছে। অনিকেত গভীর মনোযোগ দিয়ে সে কথা শুনছে। সায়না বলল, “জানো, একবার আমি মেলায় গিয়েছিলাম পাশের নিচের ফ্লোরের আপুদের সঙ্গে। মেলা থেকে ফিরতে রাত হয়ে যায়। বাবা বলল, ‘আজ আর ঘরে ঢুকতে দেব না।’ আমি বাবার কথা শেষ হওয়ার আগেই ভ্যাঁ ভ্যাঁ করে কান্না শুরু করে দিলাম।
বাবারা হয়তো মেয়েদের কান্না সহ্য করতে পারে না। বাবা আমার হাত টেনে রুমে নিয়ে এসে বলল, ‘কাঁদবি না। এরপর মেলায় গেলে আমাকে বলবি, আমি নিয়ে যাব।’
আমি বাবাকে জড়িয়ে ধরলাম। বাবা আমাকে পরম যত্নে বুকে আগলে নিলেন। ওই স্পর্শে কত স্নেহ, কত মমতা, কত ভালোবাসা ছিল, তা হয়তো প্রকাশ করে বোঝানো যাবে না।
সেই বাবাকে আমি কষ্ট দিয়েছি। তার রাগ করা কি বেমানান?”
অনিকেত সায়নার হাত আরও শক্ত করে ধরে বলল, “আমি তো এসব অনুভূতির সঙ্গে পরিচিত নই। আমি মন খারাপ করিনি। কারও কাছ থেকে তার সবচেয়ে প্রিয় জিনিস কেড়ে নিলে সে তো রাগ করবেই। নিশ্চয়ই বাবাদের কাছে তার মেয়ে সবচেয়ে প্রিয়। তাই ওনার রাগ আমি মনে করিনি।
বাবা তোমার সঙ্গে রুড বিহেভিয়ার করেছে, তার জন্য সরি।”
অনিকেত সায়নাকে জড়িয়ে ধরে বলল, “সরি কেন বলছ? আমি জানতাম না বাবাদের শাসন কেমন হয়। আজ দেখে নিলাম। এটাও কম কিসে? তবে একটা কথা, তুমি আমাকে কখনো ছেড়ে যেও না। আমার পৃথিবীতে আপন বলতে তুমি ছাড়া আর কেউ নেই।”
সায়না উত্তর দেওয়ার আগেই অন্য ছাদ থেকে একজন বলল, “রুম থাকতে ছাদে রোমান্স কেন?”
অনিকেত সায়নার হাত ধরে সিঁড়ির দিকে টেনে নিয়ে এল।
সায়না হেসে বলল, “ভীতু কোথাকার! বলল আর চলে এলে? তোমার উচিত ছিল আমার কোমর ধরে নিজের দিকে টেনে নিয়ে ঠোঁটে ঠোঁট ডুবিয়ে দেওয়া।”
অর্ধাঙ্গিনী পর্ব ৭৬
“ছিঃ! আমার বউকে আমি একা একা নির্জন রুমে আদর করব। মানুষ দেখাব কেন? বউ আমার, আদর আমার। তবে যত্ন করব সবাইকে দেখিয়ে, যাতে সবাই বুঝে, বদ্ধ রুমে ভালোবাসলেই হয় না, যত্ন করে আগলেও রাখতে হয় প্রিয়তমা অর্ধাঙ্গিনীকে।”