অর্ধাঙ্গিনী পর্ব ৮০

অর্ধাঙ্গিনী পর্ব ৮০
নুসাইবা ইভানা

“তোমার মনে হয় পৃথিবীর সবচেয়ে জঘন্য মা তোমার?”
জাহানারা বেগমের কথা শুনে নীলাঞ্জনা বলল, “এতে কোনো সন্দেহ আছে, বড় আম্মু?”
“হুম, আছে। এক টুকরো কাগজে ছোট্ট একটা বার্তা লিখে চলে গেলে। একবারও ভেবেছিলে এই মানুষগুলোর কী হবে? যে মা তোমাকে পৃথিবীতে আনলো, আদর, স্নেহ, ভালোবাসা দিয়ে বড় করলো, তার কথা একবারও মনে হলো না? যে পিতা তোমার সুখের জন্য দিনের পর দিন পরিশ্রম করে উপার্জন করেছে, তার সম্মানের কথা মনে এলো না?”

“তখন আমার মাথায় এসব আসেনি। আমি নিজের ভুলের জন্য অনুতপ্ত, আম্মু।”
“নীলু, আমরা যাদের ভালোবাসি, তাদের ওপর আমাদের অনেক বিশ্বাস থাকে, ভরসা থাকে। আজকালের ছেলেমেয়েদের মনে হয়, আমার বাবা-মা আমার ওপর চাপিয়ে দেয় তাদের মতামত। এই যে আট মাস ধরে তুই যে কষ্ট সহ্য করছিস, সেটা তোর মা সহ্য করেনি? দিনের পর দিন তোর পিছনে পড়ে ছিলো তোকে ভালো রাখতে। তুই যেন একটুও ব্যথা না পাস, সে খেয়াল রাখতে গিয়ে নিজের খেয়াল রাখা ভুলে গেছে। তোর কী পছন্দ, কী অপছন্দ, সে-সব মনে রাখতে রাখতে নিজের পছন্দ-অপছন্দ ভুলে গেছে। শোন, তুই পালিয়ে গেছিস কারণ তোর ভালোবাসার মানুষ তোর কাছে ইম্পর্ট্যান্ট ছিলো। আর যে মানুষগুলো তোকে জন্মের আগ থেকে ভালোবাসা দিয়ে এসেছে, তাদের ভালোবাসার কোনো মূল্য নেই! এই যে এতগুলো দিন গেলো, একবারও তুই নিজে থেকে তোর মায়ের কাছে গিয়ে ক্ষমা চেয়েছিস?”

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

নীলাঞ্জনা চুপ হয়ে গেলো। তার চোখ থেকে টুপটুপ করে নীরব অশ্রু গড়িয়ে পড়তে লাগলো।
“শোন, মা-বাবা চাপিয়ে দেয় না। মা-বাবা সব সময় সন্তানের ভালো চায়। আর বিয়েটা তো তোর ইচ্ছেতেই হচ্ছিলো। তোর অন্য আরেকজনের সাথে সম্পর্ক, সেটা বিয়ের অনুষ্ঠান শুরু হওয়ার আগেই বুঝিয়ে বলতি। তবুও তোরা সন্তান, তোদের কোনো ভুল নেই। সব ভুল তোরা বাবা-মায়ের মাথায় চাপিয়ে দিস। তোর মা অভিমানে তোর সাথে কথা বলে না, কিন্তু চুপিচুপি খোঁজ রাখে তুই খেয়েছিস কিনা।”
নীলাঞ্জনা জাহানারা বেগমকে জড়িয়ে ধরে বলে, “আমাকে ক্ষমা করে দাও, আম্মু। আমি ভুল করেছি। সে ভুলের শাস্তি আমি পাচ্ছি।”
“যাহ, মায়ের কাছে যা। ক্ষমা চা। এই সময় ওই মানুষটাকেই তোর সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন।”

বেলা তখন তিনটে। জিয়ানের আসার কোনো খবর নেই।
নয়না খাবার খেয়ে নিজের রুমে মনমরা হয়ে বসে আছে। বারকয়েক কল করেও জিয়ানকে পাওয়া যায়নি! এত সুন্দর রাঙাবউ সেজে বসে থাকলো যার জন্য, তার দেখা নেই। লম্বা চুলগুলোতে চিরুনি করছে নয়না। হঠাৎ দরজায় কড়া নাড়লো কেউ। নয়না বলল, “কে?”
“বউমনি, আসতে পারি? এই বাড়ির সার্ভেন্ট।”
“আসুন।”
“এই পার্সেলটা আপনাকে বড় সাহেব দিতে বলল।”
“এখানে রাখুন।”

সার্ভেন্ট চলে গেলে নয়না উৎসাহ নিয়ে পার্সেল খুলল। নীল রঙের শাড়ি, সাথে ছোট্ট একটা চিরকুট। “তোমার অপেক্ষায় অপেক্ষমাণ পথিক আমি। অপেক্ষা শেষে খানিক ভালোবাসায় আমায় দিও সবটুকু সুখ।”
নয়না মুচকি হেসে বলে, “মিস্টার প্লেন ড্রাইভার, তোমার দুষ্টমিষ্টি প্রেমের বাঁধনে আমি যে শক্ত হাতে বাঁধা পড়ে যাচ্ছি! যদি এ বাঁধন হঠাৎ ঝড়ে ছিঁড়ে পড়ে, তখন নিজেকে আর জোড়া লাগাতে পারবো না।”
নয়না নিজেকে তৈরি করলো। অতঃপর কল করলো জাহানারা বেগমকে।

সকাল থেকে তার মনের মধ্যে কেমন অস্থিরতা বিরাজ করছে। সবকিছু ঠিক থাকার পরেও তার হৃদয়ে তুলপাট। জাহানারা বেগম ঠিক বুঝে উঠতে পারছে না তার হৃদয়ের এই ঝড় কীসের পূর্বাভাস! মনটাকে শান্ত করতে পারছে না। হঠাৎ ফোনটা বেজে উঠলো। জাহানারা বেগমের মুখে খানিকের জন্য হাসির রেখা ফুটে উঠলো। জাহানারা বেগম রিসিভ করে অপলক দৃষ্টিতে নয়নার দিকে তাকিয়ে বলে, “বাহ, আমার রাজকন্যাকে একদম রাজরানীর মতো লাগছে!”

নয়না হেসে বলে, “কতদিন তোমাকে জড়িয়ে ধরিনি, আম্মু! একবার আসি, তোমাকে আর ছাড়বো না। খুব ইচ্ছে করছে তোমাকে জড়িয়ে ধরতে।” নয়না এই কথা বলার জন্য কল করেনি, তবুও হঠাৎ কেনো এই কথা বের হলো! নিজেই মনে মনে বেশ অবাক হলো।
জাহানারা বেগমের চোখজোড়া ভিজে উঠলো। চোখের কার্নিশ বেয়ে গড়িয়ে পড়লো দুফোঁটা অশ্রু। স্মিত হেসে বলল, “তুই আয়, আমি তোকে আগলে রাখবো। কবে আসবি তুই? কতদিন তোকে মন ভরে দেখিনি।”
“এই তো, প্লেন ড্রাইভার চলে গেলেই এসে পড়বো।”
“এসব কেউ বলে! সে হলো পাইলট।”
“আম্মু!”

নয়নার হঠাৎ “আম্মু” ডাক শুনে জাহানারা বেগম কেঁপে উঠলো।
“কী হয়েছে তোর?”
“কতদিন পর তোমাকে ডাকলাম, বলো তো। তোমাকে আম্মু ডাকিনি, মনে হচ্ছে যুগ পেরিয়ে গেলো।”
“পাগলি মেয়ে, কাল সকাল-সকাল চলে আসিস।”
“কাল সকালে কী করে আসবো? কাল তো থাকবো পাহাড়ের চূড়ায়।”
“সাবধানে থাকিস, মা। নিজের খেয়াল রাখিস।”
নয়না ফোন কেটে দিলো। তার মন বিষণ্ণতায় ছেয়ে গেছে। আচ্ছা, এই আনন্দের মুহূর্তে এমন বিষাদ ছড়িয়ে পড়লো কেন? এই কেনোর উত্তর জানা নেই নয়নার। শেষবারের মতো নিজেকে আয়নায় দেখে বের হয়ে এলো রুম থেকে।
মিতা বেগম তখন নামাজে।
নয়না দাঁড়িয়ে রইলো তার সালাম ফেরানোর আশায়।
মিতা বেগম সালাম ফেরাতেই নয়না বলল, “আম্মি, আসতে পারি?”

“মাশাআল্লাহ, আজকে তো মনে হচ্ছে আসমানের পরী নেমে এসেছে জমিনে! তা, কোথাও যাচ্ছিস নাকি?”
নয়না বলতে গিয়ে থমকালো। নিজেকে ধাতস্থ করে বলল, “আমার ফ্রেন্ডের বার্থডে।”
“একা যাবি?”
“গাড়ি নিয়ে যাবো, আম্মি।”
“আচ্ছা, সাবধানে যাস, তাড়াতাড়ি ফিরে আসিস।” নয়নার মানা করা সত্ত্বেও বেশ কিছু টাকা গুঁজে দিলো নয়নার হাতের মুঠোয়।
নয়না বের হয়ে এলো চৌধুরী ম্যানশন থেকে। গাড়িতে ওঠার আগে আরেকবার ফিরে তাকালো। আচ্ছা, আমার মন কেনো এমন বিচলিত হচ্ছে? কেনো মনে হচ্ছে কোথাও কিছু ঠিক হচ্ছে না? বুঝেছি, মনটা তার বিচ্ছেদ-বিরহী হয়ে উঠছে। শোন, মন, সে আমার, সে যেখানেই থাকুক, সে শুধু আমারই। দূরত্ব কখনো আমাদের ভালোবাসায় বাধা হতে পারে না।

নয়না গাড়িতে উঠে বসলো। গাড়ি চলতে লাগলো।
হঠাৎ নয়না খেয়াল করলো ফোনটা সে ভুলে ফেলে এসেছে বাসায়। ড্রাইভারকে বলল গাড়ি ঘোরাতে।
ড্রাইভার নিজের ফোনটা বাড়িয়ে দিলো।
অপর পাশ থেকে জিয়ান বলল, “এত ভয় কীসের, বউ? যতটুকু এগিয়ে এসেছো, ততটুকু পিছাতে কেন চাও? এগিয়ে এসো ভালোবাসার রাস্তায়। হাতে সময় কম, পাখি।”
নয়না বলল, “আপনার জন্য দরকার ছিলো ফোনের। আপনি যখন আছেন, ফোন আমার অকেজো। আসছি, মিস্টার প্লেন ড্রাইভার। কিন্তু আমাদের তো একসাথে যাওয়ার কথা ছিলো। তাহলে তুমি একা কেন চলে গেলে আগে?”
“একসাথে গেলে তোমার জন্য সারপ্রাইজ প্ল্যান কীভাবে করতাম, জান? এই শোনো… তোমার মুখে তুমি ডাক বেশ মানায়, পাখি। তবুও আপনি কেন বলো?”

“সে-সব কথা তোলা থাকুক। চোখে চোখ রেখে না হয় বলবো।”
নয়না লজ্জায় লাল হয়ে যাচ্ছে। ইশ, তার মানুষ। তার নিজের ব্যক্তিগত মানুষ। মানুষটাকে সে কত যত্ন করে ভালোবাসে! আচ্ছা, সব তো ঠিকই আছে, তবুও মনের মধ্যে অজানা এক অদ্ভুত বাজে অনুভূতি কেন হচ্ছে? “কখন যে আপনাকে জড়িয়ে ধরবো? আপনাকে জড়িয়ে ধরলেই আমার মনের সব কষ্ট দূর হয়ে যাবে। আপনি আমার মন ভালো করার টনিক।”

জিয়ান বাসায় ঢুকলো সন্ধ্যা ছটায়। তাড়াহুড়ো করে দ্রুত নিজের রুমে এলো। সাথে নিয়ে এসেছে চকোলেট আর কাচের চুড়ি। মনে মনে বলে, “নিশ্চয়ই মহারানী ভীষণ রেগে আছে! মহারানী, রাগ ভাঙাতে এইটুকু আর সাথে আমার ভালোবাসা যথেষ্ট।” জিয়ান রুমে ঢুকতেই তার হৃদয়ে হাহাকার ছড়িয়ে পড়ে! রুম জুড়ে কী নিদারুণ শূন্যতা। শূন্যতা তাকে এসে ঘিরে ধরেছে। জিয়ান ডাকতে লাগলো, “সুনয়না, শুনছো? ওগো, কই তুমি? এই যে আমার প্রিয়তমা অর্ধাঙ্গিনী, লুকিয়ে না থেকে সামনে আসো, তোমাকে দেখার তৃষ্ণায় হৃদয় মরুভূমি হয়ে আছে। দর্শন দিয়ে আমার তৃষ্ণা মেটাও।” ফাঁকা রুমে নিজের কণ্ঠধ্বনি নিজের কানেই ফিরে আসছে। ওয়াশরুমে, বারান্দায়, সব জায়গায় খোঁজা শেষ, কোথাও নেই তার পিচ্চি বউ। হতাশা এসে ঘিরে ধরলো তাকে। নিজের ফোন উঠিয়ে কল করলো, ফোনটা বেজে উঠতেই হঠাৎ করে হৃদয়ে ছ্যাঁত করে উঠলো! নয়নার ফোনটা হাতে নিয়ে বলে, “ফোন ফেলে গেলো কোথায়?” রুম থেকে ছুটে বের হয়ে এলো মিতা বেগমের রুমে। “আম্মু, নয়না কোথায়?”

“কিছুক্ষণ আগেই তো বের হলো। ওর নাকি কোনো ফ্রেন্ডের বার্থডে?”
“কখন? কার সাথে বের হলো? ফোনটাও বাসায় ফেলে গেছে! আমাদের ফ্লাইটের সময় হয়ে যাচ্ছে। আজ কেনো যেতে দিলে? আজ তো আমরা সিলেট যাবো।”
“তুই রেডি হতে হতে ঠিক চলে আসবে, দেখিস। এতো বিচলিত হতে হবে না। বয়স কম হলেও বোধবুদ্ধি অনেক ভালো। তুই সারাদিন কোথায় ছিলি?”
“অনিকেতের এক্সিডেন্ট হয়েছে।”
“কী বলিস? এখন কী অবস্থা? গুরুতর কিছু?”

“মেজর কোনো ইস্যু যদিও নেই, তবে আঘাত পেয়েছে হাতে-পায়ে, শরীরের বিভিন্ন জায়গায়।” জিয়ান রুমে এসে বিছানার ওপর শুয়ে পড়লো। কিছু ভালো লাগছে না তার। রুম জুড়ে করুণ শূন্যতা গ্রাস করছে তাকে। হঠাৎ তাকিয়ে দেখে বিছানার ওপর তার পছন্দ করা টুকটুকে লাল শাড়িটা। শাড়িটা নাকের সামনে নিতেই যেনো নয়নার শরীরের ঘ্রাণ তাকে সতেজ করে তুললো। “ইশ, বড্ড লোভ হচ্ছে তোমাকে টুকটুকে লাল শাড়িতে দেখার! নিশ্চয়ই তোমাকে মারাত্মক লাগছিলো। এই শাড়ি ও হয়তো মুগ্ধ হচ্ছিলো তোমার অঙ্গে জড়িয়ে। এই লাল শাড়ি ও আমার যে ভাগ্যবান, সে তোমাকে নিগূঢ় আলিঙ্গনে জড়িয়ে ছিলো!

আমার যে এই শাড়িটাকেও হিংসে হচ্ছে, রাঙাবউ! কোথায় রইলে তুমি? তোমার মানুষটা তোমার অনুপস্থিতিতে কাতর হয়ে যাচ্ছে! ফিরে এসে তাকে জড়িয়ে ধরে এক পশলা প্রেমের বৃষ্টি নামিয়ে শীতল করো তার তৃষ্ণাতুর হৃদপিণ্ডকে। আসো না গো, বউ।” জিয়ানের মনে হচ্ছে নয়না এক্ষুনি এসে তাকে জড়িয়ে ধরবে। তার ঠোঁটে ঠোঁট রেখে বলবে, “ভালোবাসি তোমাকে।” অথবা রাগ দেখিয়ে বলবে, “মিস্টার প্লেন ড্রাইভার, সারাদিন কোথায় ছিলেন?” জিয়ান কল্পনা করতে লাগলো রাগলে নয়নাকে কেমন লাগবে। মেয়েটা এতো স্নিগ্ধ, সব রূপেই যেনো সে মোহনীয়। জিয়ান উঠে বসলো, তার হাঁসফাঁস লাগছে। শাড়িটা জড়িয়ে ধরলো বুকের মাঝে। মনে মনে বলে, “আজ আমরা হাতে হাত রেখে বিমানে বসে থাকতাম। তুমি আমার কাঁধে মাথা রাখতে। তিনটা দিন স্বপ্নের মতো কাটাতাম আমরা। কোথায় গেলে তুমি? তাড়াতাড়ি ফিরে এসো।”

অর্ধাঙ্গিনী পর্ব ৭৯

সাজেকের এক পাহাড়ের চূড়ায় দোলনায় পা দোলাচ্ছে জাহিন। হাতে তার গিটার, মুখে তার সুর, কণ্ঠে বাজাচ্ছে গান, “সখী, ভালোবাসা কারে কয়, হৃদয়ের মন্দিরে আছো বসে তুমি, এ ব্যথা প্রাণে নাহি সয়।” বারবার এই দুই লাইন গেয়ে যাচ্ছে।
মনে মনে কী আকাশ-কুসুম ভাবছে আর একি গান গাইছে আর মুচকি হাসছে। তার মনে কী চলছে, কেউ জানে না। সে যেনো গান শোনাচ্ছে মুক্ত বাতাস আর ওই দূরের পাহাড় আর আকাশকে।

অর্ধাঙ্গিনী শেষ পর্ব