অর্ধাঙ্গিনী শেষ পর্ব
নুসাইবা ইভানা
” রাত বারোটা বেজে গেছে। জিয়ান বিছানা ছেড়ে লাফিয়ে উঠে বসল। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বুকটা ধক করে উঠল। নয়না এত রাত পর্যন্ত বাইরে থাকার মেয়ে নয়। কোনো বিপদ হলো না তো? নয়নার ফোন থেকে তুষিকে কল করল।
তুষি বলল, “কী হয়েছে? এত রাতে কল করেছিস? কোনো সমস্যা?”
জিয়ান বলল, “আমি রেজা বলছি। নয়না তোমার সঙ্গে নেই?”
“আমার সঙ্গে কোথা থেকে আসবে? আজ নাকি আপনারা সিলেট যাবেন?”
“যাওয়ার কথা ছিল। বাসায় এসে দেখি নয়না নেই। ওর কোনো ফ্রেন্ডের জন্মদিনে গেছে।”
“কী বলছেন এসব! ওর এমন কোনো ফ্রেন্ড নেই আমি ছাড়া। ভাইয়া, আমার মন বলছে নয়না কোনো বিপদে পড়েছে। আপনি প্লিজ ওকে বাঁচান।”
জিয়ান দ্রুত পায়ে নিচে বেরিয়ে এল। গাড়ির খোঁজ নিয়ে দেখল, সব গাড়ি বাসায়। দারোয়ানকে জিজ্ঞেস করল, দারোয়ান বলল, “বৌমনি একটা কালো রঙের গাড়িতে উঠে এখান থেকে গেছে।”
“কোন দিকে গেছে গাড়িটা?”
“ওই দিকে।”
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
জিয়ান পাগলের মতো ছুটতে লাগল। সে যেন উন্মাদ হয়ে গেছে। ফাঁকা রাস্তায় পাগলের মতো ছুটে চলেছে। নিজের ফোন বের করে কল করল তালুকদার বাড়িতে। মাহবুব তালুকদার ফোন রিসিভ করতেই জিয়ান হড়বড় করে বলল, “নয়না কোথায়? নয়নাকে কোথাও পাচ্ছি না কেন? ও কি অভিমান করে আপনাদের বাসায় লুকিয়ে আছে?”
মাহবুব তালুকদার রেগে গেলেন। কর্কশ কণ্ঠে বললেন, “ফাজলামি পেয়েছ? মাঝরাতে কল করে মাতলামি করছ? আমার মেয়ের কিছু হলে তোমাদের গুষ্টিসুদ্ধ সবাইকে চৌদ্দ শিকের ভাত খাওয়াব।” ফোন কেটে তিনিও বেরিয়ে পড়লেন চৌধুরী ম্যানশনের উদ্দেশে।
রাত পেরিয়ে দিনের আলো ফুটে উঠেছে। কিন্তু নয়নার কোনো খোঁজ নেই। এভাবে কেউ হারিয়ে যেতে পারে? জিয়ান গুরুতর অ্যাক্সিডেন্ট করে হাসপাতালে পড়ে আছে। জীবন-মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করছে সে। রাতে হঠাৎ দূরপাল্লার বাস থেকে জঘন্যভাবে আঘাত পেয়েছে।
নয়না জিয়ানের দেওয়া ঠিকানা মতো পৌঁছাল, তখন প্রায় রাত দশটা বাজে। এত দূরের জার্নির ফলে চেহারায় মলিনতা ছড়িয়ে পড়েছে। চোখের কাজল লেপ্টে গেছে, ঠোঁটের লিপস্টিক মুছে গেছে, পরনের শাড়িটাও খানিক এলোমেলো হয়ে গেছে।
নয়না রাগান্বিত স্বরে বলল, “তোমার জন্য শত কিলোমিটার পার হয়ে এলাম। এই অন্ধকারে কী তোমার? আমাকে ফ্রেশ হতে হবে। বড্ড তৃষ্ণা পেয়েছে, এক গ্লাস পানি হলে ভালো হতো। আমাকে ছেড়ে একা আসার জন্য রয়েছে কঠিন থেকে কঠিনতম শাস্তি। আবার চিরকুটে লিখেছ আম্মুকে যাতে না বলি। আম্মু আমাকে কী ভাববে?”
জিয়ান সামনের দিকে ঘুরে বলল, “আমি থাকতে পানি কেন জান? এত টেনশন করার কী আছে? আমি আছি, সব সামলে নেব।”
“একদম কাছে আসবে না।”
জিয়ান নয়নার হাত ধরে রেলিংয়ের সামনে নিয়ে এল। রেলিংয়ের দুই পাশে হাত রেখে বলল, “কাছে আসব না। শুধু তোমাকে এই সুন্দর ভিউ উপভোগ করাব। সামনে তাকিয়ে দেখো, মনে হচ্ছে না হাত বাড়ালেই চাঁদের নাগাল পাওয়া যাবে? আসলে কি তাই? সত্যিই কি চাইলেই চাঁদকে ছোঁয়া যায়?”
“চাঁদ ধরা ছোঁয়ার বাইরে হলেও চাঁদের সৌন্দর্য অনুভব করা যায়। জোছনা বিলাস করা যায়। তুমি কি ভুলে গেছ জোছনা ভরা রাত আর আমাদের গভীর প্রণয়?”
জিয়ান নয়নার চুল কানের পাশ থেকে সরিয়ে দিয়ে বলল, “তুমি মোহনীয়। নারীর মোহ পুরুষকে কঠিন থেকে কঠিনতম ঘৃণ্য কাজ করায়, জানো তো?”
নয়না বলল, “আপনার স্পর্শ কেমন অদ্ভুত লাগছে? আর হ্যাঁ, মোহ তো ক্ষণস্থায়ী। আপনি কি জানেন না, মিস্টার প্লেন ড্রাইভার, নারীর ভালোবাসা কঠিন থেকে কঠিনতম হৃদয়ের পুরুষকেও বরফ গলা নদী বানিয়ে দেয়? ভালোবাসা দিয়ে জিতে নেওয়া যায় সবকিছু।”
“সব ভালোবাসা তো পূর্ণতা পায় না। প্রকাশের আগেই কত ভালোবাসা আড়াল হয়ে যায়। সব ভালোবাসা কি সমাজ মেনে নেয়?”
“ভালোবাসা মানে যে তাকে পেলে আপনি পূর্ণ, এমন নয়। যে মানুষ না থেকেও আপনার হৃদয়ে থেকে যায়, সেটাও ভালোবাসা। আমি আর আপনি দুই মেরুর মানুষ, তবুও কেমন মিলে গেছি একে অপরের মাঝে। যেন শতজনমের সম্পর্কে বাঁধা আমরা। ভালোবাসা সব অসম্ভবকে সম্ভব করতে পারে, মিস্টার পাইলট মহাশয়।”
“তুমি শুধু সুন্দর নও, তোমার কথাও জাদুকরী। কোনো ছেলে তোমার সঙ্গে পাঁচ মিনিট কথা বললে, তোমার প্রেমে পড়তে বাধ্য।”
“আমার আর কারও প্রেম চাই না এই জন্মে। আমি শুধু তোমাকে চাই, তুমি আমার হয়ে থাকো। আমি ভালোবাসা দিয়ে তোমাকে জড়িয়ে নেব আদরের চাদরে।”
“তুমি কি সত্যি আমাকে ভালোবাসো?”
“আপনি বুঝি সত্যি ভালোবাসেন না?”
“উত্তর দাও।”
“কোনো সন্দেহ আছে?”
“আমার জন্য তুমি কী করতে পারবে?”
“আপনি চাইলে তো নিজের প্রাণটাও দিয়ে দিতে পারব। আপনিই এখন আমার প্রাণভোমরা।”
জিয়ান নয়নাকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিল, এক হাতে ধরে রাখল।
নয়না চোখ বন্ধ করে বলল, “সত্যি সত্যি মেরে ফেলবে নাকি?”
“তুমি আমাকে ভালোবাসো না। ভালোবাসা থাকলে বিশ্বাস আর ভরসাও থাকত।”
নয়না পিটপিট করে চোখ খুলল। মাঝখানের রেলিংটুকু পড়ে গেছে। সে শূন্যে ভাসমান। এই হাতের বাঁধন উন্মুক্ত হলেই তার জীবনের সমাপ্তি। নয়না জিয়ানের চোখের দিকে তাকিয়ে বলল, “তোমার আমার ভালোবাসার সমাপ্তি।”
“ধরেই নিচ্ছ আমি তোমাকে হত্যা করব?”
“যে হৃদয় আপনি জিম্মি করেছেন, তার দেহ যদি নেওয়ার হয়, নিয়ে নাও। তবু মনে রেখো, পাহাড়ের এই নীরবতা, এই বাতাস, এই প্রকৃতি সাক্ষী থাকবে এক কিশোরীর পবিত্র প্রেমের। ওই অস্তমিত সূর্যটা সাক্ষী রইল, প্রতিদিন তুমি ঠিক তার মতোই ধুঁকে ধুঁকে অস্তমিত হবে। সূর্য তো পরের দিন ফিরে আসে পূর্ণ তেজ নিয়ে, তুমি আর কখনো পূর্ণ হবে না।”
“আমার রক্তে যে হাত রঞ্জিত করেছ, সে হাত কোনোদিন পূর্ণ হবে না।”
নয়না যদিও এতক্ষণ ফিল্মি ডায়ালগ দিচ্ছিল, হঠাৎ জিয়ানের চোখের দিকে তাকিয়ে তার রুহ কেঁপে উঠল। নয়না কম্পিত কণ্ঠে বলল, “প্লিজ, আমাকে টেনে তুলুন, ভয় পাচ্ছি। মনে হচ্ছে তুমি আসলে তুমি নও, অন্য কেউ।”
জিয়ান গর্জে উঠে বলল, “তোকে আমি কোনোদিন ভালোবাসিনি। অভিনয় করেছি, নিখুঁত অভিনয়। ঠিক যেভাবে তোর বোন আমার সাথে অভিনয় করে আমার কোমল হৃদয়টাকে হত্যা করেছে, তার চেয়ে হাজার গুণ বেশি কষ্ট দিয়ে মারব তোকে। রিভেঞ্জ অব নেচার। তোর কোনো দোষ নেই যদিও, কিন্তু রক্ত তো একই?”
জিয়ানের হাত আলগা হচ্ছে। নয়না দুহাতে আঁকড়ে ধরল জিয়ানের হাত। করুণ স্বরে বলল, “আমাকে মেরে ফেলবেন না। আমি আপনাকে ভালোবাসি। আমার মৃত্যু মানে পৃথিবীতে আপনার ভালোবাসার মৃত্যু। কেন করছেন এমন? আমি জানি আপনি আমার সঙ্গে মজা করছেন। এমন মজা আমি আর নিতে পারছি না।”
জিয়ান নয়নার দিকে তাকিয়ে অট্টহাসি দিয়ে বলল, “আমি মজা করছি না, আমি সত্যি বলছি। তোর জীবনের বাতি এখানে আমার হাতে নিভে যাবে। রিভেঞ্জ নেব তোর রক্ত দিয়ে।”
নয়না চিনতে পারছে না এই মানুষটাকে। আসলেই কি সে ওই মানুষ, যার ভালোবাসায় গতকাল সিক্ত হয়ে মনে হয়েছিল ভালোবাসার মতো সুন্দর জিনিস পৃথিবীতে আর নেই?
নয়না কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলল, “পৃথিবীতে যত সুন্দর জিনিস আছে, তার অর্ধেক হলো নারী। নারীর ভালোবাসা ছাড়া তা পূর্ণতা পায় না।”
জিয়ান নয়নার হাত ছাড়িয়ে নিতে নিতে বলল, “বেশি সুন্দর জিনিস আমার আবার সহ্য হয় না, ডিয়ার। এ জন্মের মতো আলবিদা… পরের জন্ম বলে কিছু থাকলে দেখা হবে, প্রিয়।”
নয়না “জিয়ান” বলে চিৎকার করে উঠল। তার চিৎকার মিলিয়ে যেতে লাগল পাহাড় আর বাতাসে। তার করুণ আর্তনাদ কারও কর্ণকুহরে পৌঁছাল না। অসহায় চাঁদও যেন ব্যথিত হলো এই করুণ দৃশ্যের সাক্ষী হয়ে। সে শুধু তাকিয়ে দেখল, অথচ বাঁচাতে পারল না এক নিষ্পাপ ফুলকে। কী দোষ ছিল তার? ভালোবাসা কি আসলেই দোষের?
জাহিন পাগলের মতো হাসতে লাগল, পৈশাচিক সে হাসি। দুফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পড়ল জাহিনের চোখ থেকে। “আমি যাকে ভালোবাসি, তাকে অন্য কারও বাহুতে সহ্য করার ক্ষমতা আমার নেই। আমি এত মহান হতে পারব না। তোমার সঙ্গে প্রথম দেখার কথা আমি কোনোদিন ভুলতে পারব না। বসুন্ধরা সিটি শপিং মল, ফ্লোর নম্বর সাত, সেই চাহনি, সেই চঞ্চল হরিণীর মতো চোখ, সেই জাদুকরী কণ্ঠ। আমি কোনোদিন ভুলতে পারিনি। কতশতবার তোমার খোঁজ নিয়েছি স্কুল গেটের দারোয়ানের কাছে। আমি শুধু তোমাকে চেয়েছিলাম, শুধুই তোমাকে। ওই রেজা আমার কাছ থেকে তোমাকে কেড়ে নিয়েছে। আমি মহৎ হতে পারলাম না, আমি তোমাকে বলতেও পারলাম না আমি তোমায় কতটা ভালোবাসি। তুমি ছলনাময়ী। ধোঁকা দিয়েছ আমাকে। আমার ভালোবাসা, ভালো থেকো পরপারে।”
জাহিন নিজের চোখ মুছে নিল। আগে থেকেই হেলিকপ্টার প্রস্তুত করে রেখেছিল। হেলিকপ্টারে করে চলে এল ঢাকায়। এসে চুপচাপ নিজের রুমে ঘুমিয়ে রইল। চোখ বন্ধ করে বলল, “এবার মরেও শান্তি পাব।”
মিতা বেগম জাহিনের রুমে এসে বললেন, “এখনো ঘুমাচ্ছিস? তোর ভাইকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। ফোনটাও বন্ধ বলছে। ওই মেয়েটাও ওর বোনের মতো নিশ্চিত কোনো ছেলের সঙ্গে পালিয়ে গেছে। নয়তো আমাকে কেন মিথ্যে বলল?”
অর্ধাঙ্গিনী পর্ব ৮০
জাহিন কিছুই না বোঝার ভান করে বলল, “কী বলছ, এসব বুঝিয়ে বলো।”
মিতা বেগম সব বললেন।
জাহিন অবাক হয়ে বলল, “আমাকে আগে বলবে না! এক্ষুনি যাচ্ছি।” বাইরে এসে বাইক নিয়ে বেরিয়ে পড়ল জাহিন। আকাশের দিকে তাকিয়ে বলল, “যারা অন্যায় করে, তাদের কখনো শাস্তি হয় না। শাস্তি তো পায় নিরপরাধ মানুষ। ক্ষমতা আর বুদ্ধি থাকলে, দুই-চারটা খুন করা কোনো ব্যাপার না। আজ থেকে জাহিনের রাজ্যে জাহিন একাই রাজা।”
“জাহিন হয়ত ভুলে গেছে পাপ তার বাপকেও ছাড়ে না”৷