অশ্রুজলে বোনা বিয়ে পর্ব ১৯
ইয়াসমিন খন্দকার
ডাক্তার স্মিথ বিস্ময়ের সাথে সমস্ত রিপোর্ট দেখেন। আবরাজ নিজের সত্যটা ধরা পড়ার ভয়ে চোখ বন্ধ করে নেয়। ডাক্তার স্মিথ বলে ওঠেন,”এই রিপোর্টে এটা স্পষ্ট যে মিস্টার আবরাজ খানের মাথায় বেশ ভালোই আঘাত লেগেছে এবং আমার মনে হয় এই আঘাতের জন্যই ও নিজের স্মৃতি হারিয়ে ফেলেছে। আমাক এবিষয়ে একটু ভাবতে দিন। আমি ভালো কোন চিকিৎসার ব্যবস্থা করছি যার মাধ্যমে উনি দ্রুতই সুস্থ হয়ে উঠবেন।”
আবরাজ তো পুরোই অবাক। এটা কিভাবে সম্ভব হলো তাই ভাবতে লাগল সে৷ মিজানুর রহমান বলে উঠলেন,”বেশ আপনার যা ভালো মনে হয় করুন কিন্তু আমার ভাগ্নে যাতে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব সুস্থ হয়৷ ও কিন্তু একদম আমার ছেলের মতোই৷ তাই আমি চাই ওর যেন কোন বড় ক্ষতি না হয়।”
“জ্বি, আমরা ব্যাপারটা দেখছি।”
তারা আরো কিছু সময় কথাবার্তা বলে হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে আসে। ডাক্তার স্মিথের বলা কথা গুলো এখনো ঘুরছে আবরাজের মাথায়। এরইমধ্যে হঠাৎ করে মিজানুর রহমান নিঝুমকে বলে ওঠে,”মা, তুমি যাও গাড়িতে গিয়ে বসো। আমি আবরাজকে নিয়ে কিছু মেডিসিন নিয়ে যাচ্ছি।”
নিঝুম মাথা নাড়ায় এবং সামনের দিকে পা বাড়ায়। সে গাড়িতে গিয়ে উঠে বসে। নিঝুম চলে যেতেই মিজানুর রহমান আবরাজের উদ্দ্যেশ্যে বলে ওঠে,”কি হলো? অবাক হয়ে গেলি তো? কি ভেবেছিলি তুই আবরাজ? তোর অভিনয় আমি ধরতে পারব না? শোন, আমি না ছোটবেলা থেকে তোকে মানুষ করেছি। তাই কোনটা তোর অভিনয় আর কোনটা বাস্তব তা বোঝার ক্ষমতা আমার আছে।”
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
“তার মানে?”
মিজানুর রহমান হেসে বলেন,”আমি তো তোকে প্রথম দেখেই বুঝতে পেরে গেছিলাম যে তুই অভিনয় করছিস। এরপর তোর বন্ধু ম্যাক্সের সাথে কথা বলে এই ব্যাপারে আরো বেশি নিশ্চিত হয়ে নেই।”
“তার মানে তুমিও এতদিন আমার সাথে অভিনয় করে গেছ ”
“হ্যাঁ, আর এখন সেই অভিনয়ে যোগ দিল আমার বন্ধু ডাক্তার স্মিথও।”
মিজানুর রহমারের কথা শুনে আবরাজ দীর্ঘ শ্বাস ফেলে বলে,”কিন্তু আমার এরকম ভাবে আর অভিনয় চালিয়ে যেতে ভালো লাগছে না। আমার প্রতিনিয়ত মনে হচ্ছে আমি সবাইকে ধোকা দিচ্ছি, বিশেষ করে নিঝুমকে।”
“এটা তো ঠিকই, তুই মেয়েটাকে সত্যি ধোকা দিচ্ছিস। এটার উপলব্ধি করতে পারলে তো ভালোই। দেখ, আমি তোর আর নিঝুমের বিয়ের ব্যাপারে সবটা জানতে পেরেছি। আমি এটা জানি যে, যা হয়েছে মোটেই ঠিক হয়নি। তোর সাথে ধোকাবাজি হয়েছে এই ভাবনা টাও ভুল না। কিন্তু আমার তো নিঝুমকে দেখে মনে হয়নি ও লোভী বা এমন কোন মেয়ে। বরং আমার ওকে বেশ ভালো মনের মেয়েই মনে হয়েছে। তবুও তুই যদি চাস ওকে আরো একটু পরীক্ষা করে নিতে পারিস। তবে আমার একটা বিশেষ পরামর্শ থাকবে তুই মেয়েটাকে বোঝার চেষ্টা কর। ওর মধ্যে তোর মামির বৈশিষ্ট্য গুলো খুঁজে পেয়েছি আমি। আমার তীব্র বিশ্বাস এই মেয়েকে জীবনসঙ্গী হিসেবে বেছে নিলে তুই ঠকবি না।”
আবরাজ বলে ওঠে,”আমি ভেবে দেখছি কি করা যায়।”
কয়েক সপ্তাহ পর,
মিজানুর রহমান আবরাজ ও নিঝুমকে ফ্লাইটে তুলে দিতে চলে এসেছেন। ফ্লাইটের কাছে এসেই মিজানুর রহমান নিঝুমকে বলেন,”আমার ভাগ্নেটার খেয়াল রেখো। ডাক্তার স্মিথ তো বলেই দিয়েছেন যে ওর স্মৃতি খুব শীঘ্রই ফিরতে চলেছে। অনেক কিছুই তো ও এখন মনে করতে পেরেছে। তবে এখনো অনেক কিছু মনে করা বাকি। ”
নিঝুম মাথা নাড়িয়ে বলে,”জ্বি, আঙ্কেল। আপনাকে ধন্যবাদ।”
“ধুর পাগলী! আমায় ধন্যবাদ দিচ্ছ কেন? এটা তো আমার কর্তব্য ছিল। আর হ্যাঁ, আমার ফোন নম্বরটা নিয়ে রেখো। কোন সমস্যা হলে আমার সাথে যোগাযোগ করবে। একদম অস্বস্তি বোধ করবে না। আমি তোমাকে নিজের মেয়ের মতোই ভেবেছি। তুমিও আমাকে নিজের বাবার আসনে বসাতে পারো।”
নিঝুমের চোখে একদম জল চলে আসে। অবশেষে নিঝুম ও আবরাজ তাকে বিদায় জানায় এবং লন্ডনের ফ্লাইটের উদ্দ্যেশ্যে উঠে পড়ার জন্য রওনা দেয়। যাওয়ার আগে মিজানুর রহমান আবরাজকে আলিঙ্গন করে এবং তার কানে কানে বলে,”তুমি এখনো ভেবে দেখো কোনটা ভালো আর কোনটা খারাপ। তবে আমি তোমাকে এতটুকু নিশ্চয়তা অবশ্যই দিতে পারি, যে এই নিঝুম মেয়েটি তোমার জন্য কেয়ার করে। তাই ওকে বেছে নিলে তুমি ঠকবে না। বরং বলতে গেলে জয়ীই হবে।”
আবরাজ নিঝুমের দিকে তাকিয়ে মাথা নাড়ায়। আসলে এই ক’দিনে নিঝুমের প্রতি তার দৃষ্টিভঙ্গি অনেকটাই পরিবর্তন ঘটেছে। সে এখন নিজের অনেক সিদ্ধান্তই পুনবিবেচনা করার কথা ভাবছে৷ তার কেন জানি মনে হচ্ছে, একসময় যখন সে ভেবেছিল এই মেয়েটির সাথে তার এক মুহুর্তও থাকা সম্ভব নয় কিন্তু আজ মনে হচ্ছে এই মেয়েটির সাথে যুগের পর যুগ থাকা সম্ভব। শক্ত খোলসের আড়ালে মেয়েটির কোমল দিক সে আবিস্কার করে ফেলেছে।
এদিকে নিঝুম মনে মনে ভাবে,”আর হয়তো মাত্র কিছুদিন। তারপরই এই দায়বদ্ধতার সম্পর্ক থেকে আমি মুক্ত পাবো। আবরাজ তো মনে করতেন যে, আমি ওনার যোগ্যই না। হয়তো ওনার এই মনে করাটাই ওনার দৃষ্টিভঙ্গিতে ঠিক। আমিও জোর করে কারো জীবনে স্থান নেবো না। উনি সম্পূর্ণ রূপে নিজের স্মৃতি ফেরত পেলেই আমি ফিরে যাব সিলেটে।”
লন্ডনের এয়ারপোর্টে নেমেই তারা দুজন ট্যাক্সিতে করে আবরাজের এপার্টমেন্টের দিকে রওনা দেয়৷ নিঝুম পুরোটা যাত্রায় জানালা দিয়ে লন্ডন শহরটি দেখছিল এবং ভাবছিল খুব শীঘ্রই হয়তো আবার তাকে এই শহর ত্যাগ করে নিজের জন্মভূমি, সিলেটে ফেরত যেতে হবে।
আবরাজের এপার্টমেন্টে পৌঁছেই তারা দুজন ট্যাক্সি থেকে নামে। সমস্ত জিনিসপত্র নিয়ে ঘরের ভেতরের দিকে রওনা দেয়।
আবরাজ নিজের এপার্টমেন্টে ফিরে ছটফট করতে থাকে। তার কেন জানি বারবার মনে হচ্ছে এখনোই নিঝুমকে তার সমস্ত সত্যটা বলে দেবে। কিন্তু কোথাও একটা গিয়ে সে আটকে যাচ্ছিল। নিঝুম আবরাজের এই অস্থিরতা খেয়াল করে বলে,”আপনি কি কোন বিষয় নিয়ে অস্বস্তি বোধ করছেন?”
আবরাজ ভাবে এটাই সঠিক সময় যখন তার নিঝুমকে সমস্ত সত্যিটা বলে দেওয়া উচিত। সে বলতেই যাবে এমন সময় হঠাৎ করে তাদের বাসার কলিং বেল বেজে ওঠে। যার ফলে আবরাজ আর বলতে পারে না। নিঝুম বলে ওঠে,”আমি দেখে আসি, কে এসেছে।”
বলেই নিঝুম গিয়ে দরজাটা খুলে দেয়। দরজাটা খুলতেই দেখতে পায় এক পুরুষ অববয় পিছন ফিরে দাঁড়িয়ে আছে। যার ফলে তার মুখ দেখতে পারে না নিঝুম। কৌতুহলের সাথে বলে ওঠে,”এক্সকিউজ মি, কে আপনি?”
পুরুষ অববয় এবার সামনের দিকে ঘোরে। মুখে মাস্ক পড়া থাকায় তখনো নিঝুম তাকে ঠিক চিনতে পারছিল না। সামনের দিকে ঘুরেই সে নিজের মুখ থেকে মাস্ক সরিয়ে বলে,”আমাকে তুই চিনতে পারলি না নিঝুম? এটাও আমায় বিশ্বাস করতে হবে?”
নিঝুম অবাক স্বরে বলে ওঠে,”ইমরান! তুই!”
আবরাজ ধীর পায়ে এগিয়ে এসে বলে,”কে এসেছে নিঝুম?”
ইমরান নামক সেই আগন্তুক বলে ওঠে,”লেট মি গেস, এটা নিশ্চয়ই তোর সেই কাজিন টু বি হাজবেন্ড..উম..আবরাজ..রাইট? হ্যালো, আবরাজ। নাইস ঠু মিঠ ইউ। আ’ম ইমরান খান। নিঝুমের চাইলহুড ফ্রেন্ড।”
আবরাজ কিছুটা গম্ভীর স্বরে বলে,”নাইস ঠু মিঠ ইউ ঠু। বাট আপনি হঠাৎ এখানে..”
নিঝুম বলে,”আমরা একই স্কুলে পড়তাম। ইমরান যখন ক্লাস ৭ এ পড়তো তখনই ও সপরিবারে লন্ডনে চলে আসে। আজ দীর্ঘ ৫ বছর পর আমি ওকে দেখলাম।”
অশ্রুজলে বোনা বিয়ে পর্ব ১৮
ইমরান বলল,”তুই তো বন্ধু নামে কলংক। লন্ডনে এসেও আমার খোঁজ করলি না। তাই আমি নিজেই তোর খোঁজ করতে করতে এখানে চলে এলাম।”
নিঝুম হেসে ওঠে। এদিকে ইমরানের উপস্থিতি আবরাজের একদমই ভালো লাগে না। সে ঈর্ষা অনুভব করতে থাকে।