অশ্রুজলে বোনা বিয়ে পর্ব ৩০

অশ্রুজলে বোনা বিয়ে পর্ব ৩০
ইয়াসমিন খন্দকার

নিঝুম অনিমেষ চোখে তাকিয়ে আছে তার মায়ের নিথর দেহের পানে৷ তার চোখ দিয়ে এক ফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পড়ল। একটু আগেই ডাক্তার এসে বলে গেলেন, শান্তি বেগম আর বেঁচে নেই। ডাক্তারের বলা সেই শব্দটা এখনো নিঝুমের কানে বাজছে৷ সে কোন প্রতিক্রিয়া দেখাতে পারল না৷ যেন বিশাল এক ধাক্কা তাকে বধীর করে দিয়েছে। ছবি বেগম নিঝুমকে জড়িয়ে ধরে কান্না আরম্ভ করলেন৷ কিন্তু নিঝুম একেবারে স্তব্ধ হয়ে আছে।

পুরো বাড়ি যেন হঠাৎ করে শোকে স্তব্ধ হয়ে গেল৷ শান্তি বেগমের মৃত্যুর খবর জানালো হলো নাজমুল খানকে। কিন্তু তিনি স্পষ্ট জানিয়ে দিলেন, যেহেতু শান্তি বেগমকে তিনি ত্যাগ করেছেন তাই তার মৃত্যুতে তার কিছুই যায় আসে না। এদিকে শান্তি বেগমের শেষ বিদায়ের কার্যক্রম শুরু হয়। নিঝুম পুরোটা সময় নিশ্চুপ পাথরের মূর্তির মতো হয়ে থাকে। নিঝুমকে এভাবে স্তব্ধ দেখে ছবি বেগম বলে ওঠেন,”এভাবে চুপ হয়ে থেকো না নিঝুম। কিছু একটু বলো…তোমার মা আর বেঁচে নেই। একটু কান্না করো।”
নিঝুমের তবুও কোন প্রতিক্রিয়া নেই। নিঝুমের এই অবস্থা দেখে ছবি বেগম নিজেই কেঁদে ফেলেন। একজন মানুষটা কতটা কষ্ট পেলে এভাবে পাথর হয়ে যায়!

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

একটু পর জানাজার উদ্দ্যেশ্যে শান্তি বেগমকে নিয়ে যাওয়া হলো। নিঝুম শুধু নির্বিকার চোখে তাকিয়ে রইল। জানাজা শেষ হতেই যখন শান্তি বেগমকে কবরস্থানের দিকে নিয়ে যাওয়ার জন্য যাত্রা শুরু হয় সেই সময় হঠাৎ নিঝুম দৌড়ে তার মায়ের খাটিয়ার সামনে গিয়ে বলে,”কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন আমার আম্মুকে? আমার আম্মুকে নিয়ে যাবেন না দয়া করে। আমার আম্মু ছাড়া যে এই দুনিয়ায় আমার আর কেউ নেই। আমার আম্মুকে আমার থেকে আলাদা করবেন না।”
আলমগীর খান শান্তি বেগমের খাটিয়া বহন করছিলেন। তিনি নিঝুমের উদ্দ্যেশ্যে বলেন,”এমন পাগলামো করো না, নিঝুম। তোমার আম্মু মারা গেছেন। এই সত্যটা তোমায় মেনে নিতে হবে। কেউই চিরকাল বেঁচে থাকে না।”
নিঝুম বলে,”না, আমার আম্মু আমাকে ছেড়ে যেতে পারেন না। ভুল বলছেন আপনারা। আমার আম্মুকে আমার থেকে আলাদা করবেন না। নিয়ে যাবেন না আমার আম্মুকে।”

ছবি বেগম সহ তাদের পাড়া-প্রতিবেশী আরো কিছু মহিলা ছুটে এসে নিঝুমকে টেনে নিয়ে আসে। নিঝুম বাচ্চাদের মতো কাঁদতে কাঁদতে আহাজারি করতে থাকে। ছবি বেগম তাকে থামানোর জন্য নিঝুমকে নিজের বুকে জড়িয়ে ধরে বলেন,”শান্ত হও, নিঝুম। আল্লাহ তোমায় এই শোক সহ্য করার ক্ষমতা দিক।”
নিঝুম কাঁদতে কাঁদতে ওখানেই জ্ঞান হারায়।

রাতের বেলা, ছবি বেগম নিঝুমের সামনে ভাতের থালা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। নিঝুম হাটুতে মাথা ঠেকিয়ে বসে আছে। ছবি বেগম নিঝুমের মাথায় হাত বুলিয়ে বলেন,”একটু কিছু মুখে দাও নিঝুম৷ এভাবে না খেয়ে থাকলে যে তুমি অসুস্থ হয়ে যাবে। নিজের কথা না ভাবলেও নিজের বাচ্চাটার কথা ভাবো। তার জন্য হলেও তোমায় সুস্থ থাকতে হবে।”
নিঝুম মাথাটা তুলে বলে,”আম্মু কিভাবে পারল আমায় এভাবে ছেড়ে যেতে? আম্মু কি জানে না, সে ছাড়া আমার আর কেউ নেই?”
“এটা তুমি কি বলছ নিঝুম? আমরা কি তোমার কেউ নই?”

নিঝুম হা করে তাকিয়ে থাকে ছবি বেগমের পানে। ছবি তুলতে নিঝুমের মুখের সামনে ভাত ধরে বলে,”এই ভাতটুকু খেয়ে নাও। এই অবস্থায় না খেয়ে থাকলে তো চলবে না।”
নিঝুম চোখের জল মুছে ভাতটুকু খেয়ে নেয়। ছবি বেগম বলেন,”এই তো ভালো মেয়ের মতো কথা শুনছ।”
এমন সময় আবির হুইল চেয়ারে করে এগিয়ে এসে বলে,”আম্মু, আবরাজ ভাইয়া কল করেছিল। আমি আবরাজ ভাইয়াকে কাকির মৃত্যুর ব্যাপারে বললাম। সব শুনে ভাইয়াকে ভীষণ অস্থির লাগছিল। ভাইয়া বলল, নিঝুম আপিকে সামলানোর জন্য সে সিলেটে আসছে শীঘ্রই।”
নিঝুম এটা শুনেই ক্ষেপে গিয়ে বলে,”কেন আসবেন উনি এখানে? আমার মাকে মে*রে ফেলেও কি ওনার শান্তি হয়নি? এখন কি আমাকেও মারতে চান?”

ছবি বেগম বলেন,”তুমি এভাবে বলছ কেন নিঝুম? আবরাজ তো আর ইচ্ছা করে কিছু করে নি।”
“ওনার জন্যই আমার মা মারা গেছেন। আমি ওনাকে কক্ষনো ক্ষমা করবো না।”
“দেখো, আমি বুঝতে পারছি তোমার অবস্থাটা কিন্তু…”
“চাচি, আমি একটা অনুরোধ করব, রাখবেন?”
“হুম বলো।”
“আপনারা দয়া করে মিস্টার আবরাজকে জানিয়ে দিন, যে মায়ের মৃত্যুর পর আমি সিলেট শহর ত্যাগ করে কোথাও চলে গেছি। কোথায় গেছি সেটা বলে যাইনি এবং আমার খোঁজ না করতে বলেছি। আর আমি যে প্রেগন্যান্ট এটাও যেন উনি না জানেন।”

“এটা তুমি কি বলছ?”
“দয়া করে আমার এই কথাটা রাখুন, নাহলে আমি সত্যি সত্যি চলে যাব।”
“নিঝুম!”
নিঝুম উঠে বসে বলে,”আমার মায়ের খু**নির ছায়াও আমি আমার বা আমার বাচ্চার জীবনে পড়তে দিতে চাই না। এখন আপনারা ভেবে দেখুন আপনারা কি করবেন।”
আবির তার মায়ের উদ্দ্যেশ্যে বলে,”নিঝুম আপির কথা মেনে নাও আম্মু। ওর এখন যা মানসিক অবস্থা যদি সত্যি এমন কিছু ঘটিয়ে ফেলে তাহলে কি হবে?”
‘কিন্তু…’

ছবি বেগম একটু চিন্তা করে বলেন,”বেশ, যদি এমনটাতেই নিঝুম ভালো থাকে তাহলে তাই হোক।”
সেদিনই ছবি বেগম আবরাজকে ফোন করে এসমস্ত কথা বলেন। এসব শুনে আবরাজ ভীষণ কষ্ট পায়। তার বুক ছিড়ে দীর্ঘ শ্বাস বেরিয়ে আসে। কঠিন মানুষটার চোখেও জল৷ আবরাজ অশ্রুসিক্ত চোখে বলে,”নিঝুম এভাবে কিভাবে সবটা ছেড়ে চলে গেল? একবার আমাকে সরি বলার সুযোগটাও দিল না। আমি তো সজ্ঞানে ওর মাকে কিছু বলিনি..সেই সময় আমি নেশাগ্রস্ত ছিলাম তাই না জানি কি বলতে কি বলে ফেলেছি..”
“জানি আবরাজ, তুমি স্বেচ্ছায় কিছু করো নি। আমরা চেষ্টা করছি নিঝুমকে খোঁজার। যদি কোথাও ওর খোঁজ পাই তাহলে তোমাকে জানাবো।”
আবরাজ ফোনটা রেখে দেয়। নিজের চোখের জল মুছে বলে,”এভাবে আমার জীবন থেকে একেবারে হারিয়ে গেলে নিঝুম। আর কখনো কি আমি তোমার দেখা পাবো না? সবকিছু শেষ করার একটা শেষ সুযোগ কি তুমি আমায় দেবে না?”

আবরাজের এই দীর্ঘশ্বাস চাপা পড়ে তার এপার্টমেন্টের চার দেয়ালের মাঝে।
এদিকে, নিঝুম নিজের মায়ের ছবির উপর হাত বুলিয়ে বলে,”এখন আমি নিজের জীবনের উপর ফোকাস করব। আমার আম্মু তো চেয়েছিল আমি বড় ডাক্তার হই, আম্মুর সেই স্বপ্ন আমি পূরণ করবোই।”
অতঃপর সে নিজের পেটে হাত বুলিয়ে বলে,”একইসাথে নিজের অনাগত সন্তানকে আমাকে একটা সুন্দর জীবন দিতে হবে। আমার আম্মু আমায় যেভাবে আগলে বড় করেছে আমিও আমার বাচ্চাকে ঠিক সেভাবেই বড় করব।”

৫ বছর পর,
পুড়ো বাড়ি জুড়ে ছুট্টে বেড়াচ্ছে ৫ বছর ছুঁইছুঁই ছোট্ট একটা ছেলে। ছবি বেগম সেই বাচ্চাটার পেছনে সমানে দৌড়ে যাচ্ছে ভাত নিয়ে। বাচ্চাটা দৌঁড়াতে দৌঁড়াতেই বলছে,”আম্মু না আসা পর্যন্ত আমি কিচ্ছু খাবো না।”
ছবি বেগম এক স্থানে দাঁড়িয়ে হাফাতে হাফাতে বলেন,”এমন করো না দাদুভাই, আমি বয়স্ক মানুষ তোমার সাথে সাথে কি দৌড়াতে পারি? এই ভাতটুকু খেয়ে নাও। তোমার আম্মুর আসতে একটু দেরি হবে।”
“না, না, না। আম্মু না আসা অব্দি আমি খাবো না মানে খাবো না।”

এমন সময় ডাক্তারি পোশাক পরিহিত নিঝুম সেখানে চলে আসল৷ নিজের ছেলের এহেন কথা শুনে বলে,”এটা কেমন কথা? আমার নির্ঝর না গুড বয়। ও না আমাকে কথা দিয়েছিল আমি না থাকলে গুড বয় হয়ে থাকবে।”
নিজের মায়ের কন্ঠ শুনেই দরজার দিকে তাকায় নির্ঝর। নিজের মাকে দেখতে পেয়েই ছুট্টে গিয়ে জড়িয়ে ধরে বলে,”ইয়ে, আমার আম্মু এসে গেছে। এখন আমার আম্মু আমায় নিজের হাতে খাইয়ে দেবে।”

অশ্রুজলে বোনা বিয়ে পর্ব ২৯

নিঝুম হাসি মুখে এগিয়ে এসে বলে,”আম্মু একটু ফ্রেশ হয়ে আসুক,তারপর নির্ঝরকে খাইয়ে দেবে।”
“হুম জানি তো, আম্মু বাইরে থেকে এসেছে তাই আম্মুর শরীরে অনেক জামস আছে। তাই আম্মুকে ফ্রেশ হতে হবে।”
নিঝুম প্রসারিত হেসে বলে,”এই তো আমার সোনা ছেলে। তাহলে ততক্ষণে তুমি গ্র‍্যানির হাতে খাওয়া শুরু করো, আচ্ছা?”
“ঠিক আছে।”
নিঝুম তার রুমের দিকে পা বাড়ায়। মনে মনে ভাবে,”সময় কত দ্রুত পেরিয়ে গেল!”

অশ্রুজলে বোনা বিয়ে পর্ব ৩১