অশ্রুজলে বোনা বিয়ে পর্ব ৩১

অশ্রুজলে বোনা বিয়ে পর্ব ৩১
ইয়াসমিন খন্দকার

আবরাজ দাঁড়িয়ে আছে লন্ডন ব্রিজের মধ্যে। সেখানে দাঁড়িয়ে থেকে সে প্রবাহমান টেমস নদীর দিকে তাকিয়ে আছে। তার মনে নানানো প্রশ্ন৷ এই পাঁচ বছরে তার জীবনে অনেক পরিবর্তন এসেছে, বয়স বেড়েছে সাথে মনের ক্ষতও গভীর হয়েছে। বিগত বছরগুলোয় সে একটিবারও দেশে ফেরেনি। ছবি বেগমের কাছে যা তথ্য পেয়েছে তাতে নিঝুম এখন ডাক্তার হিসেবে ঢাকা শহরে স্থায়ী হয়েছে।

আবরাজ অনেকবার চেষ্টা করেছে নিঝুমের সাথে যোগাযোগ করার কিন্তু নিঝুম সেরকম কোন সুযোগই রাখেনি। তাদের ডিভোর্স টাও এখনো কার্যকর হয়নি তাই নিঝুম এখন তারই স্ত্রী৷ অথচ আবরাজের অস্তিত্বই সে স্বীকার করতে চায় না। এসব ভেবেই আবরাজ একটা দীর্ঘ শ্বাস ফেলে। এমন সময় পিঠে কারো স্পর্শ পেতেই পিছনে ফিরে তাকায়৷ তার দিকে আকুল চোখে তাকিয়ে আছে এলিনা। মেয়েটার জীবনেও দুঃখের অন্ত নেই। বিয়ের পর ম্যাক্সের সাথে তার সংসার সুখেই চলছিল। তাদের ঘরে একটি ছেলে সন্তানও জন্ম নেয়, যার নাম এলেক্স। কিন্তু এত সুখ বোধহয় তাদের ভাগ্যে সহ্য হয়নি। আজ থেকে দুই বছর আগে একটা বিমান দূর্ঘটনায় ম্যাক্সের মৃত্যু ঘটে। তারপর এলিনা তার ছেলে এলেক্সকে নিয়ে একদম একা হয়ে পড়ে। এখন এলিনা ও আবরাজ দুজনেই তাদের সুখ-দুঃখের সঙ্গী। এলিনা আবরাজকে বিষন্ন দেখে জিজ্ঞেস করে,”আবারো নিঝুমের কথা ভেবে কষ্ট পাচ্ছ?”

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

“কষ্ট না..কষ্ট না বড্ড অনুশোচনা হচ্ছে আমার। আজো আমার নিজেকে নিঝুমের মায়ের মৃত্যুর জন্য দায়ী মনে হয় জানো? আমি একটা রাতও ঠিকভাবে ঘুমাতে পারি না। যেদিন আমি জেনেছিলাম যে, নিঝুম কাউকে কিছু না বলে হারিয়ে গেছে সেদিন থেকেই আমার এই অবস্থা। অতঃপর আমি সিদ্ধান্ত নিলাম নিজে বাংলাদেশে গিয়ে নিঝুমকে খুঁজব এমন সময় আমার সৎমা আমায় জানালেন, নিঝুমের খোঁজ পাওয়া গেছে এবং ও এখন স্বাভাবিক আছে। আমি ওর সাথে কথা বলার সুযোগ চাই কিন্তু ও নাকি বলেছে আমার সাথে কোন কথাই বলতে চায়না। যদি আমি ওর সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করি তাহলে নাকি ও নিজেকে শেষ করে দেবে বা সত্যিই কোথাও হারিয়ে যাবে। এই কারণে আমিও আর এই বিষয়টা নিয়ে কোন জোরাজোরি করি নি। কারণ আমি চাই নি নিঝুমের কোন ক্ষতি হোক।”
“কিন্তু নিঝুমেরও তো বোঝা উচিত, যে তুমি সজ্ঞানে সেদিন কিছুই বলো নি। যা বলেছ নেশাগ্রস্ত অবস্থায় বলেছ।”
“সেটা ঠিক কিন্তু তবুও জ্ঞানে হোক বা অজ্ঞানে আমার জন্যই তো নিঝুমের মা মারা গেছেন। এই দায় তো আমি অস্বীকার করতে পারি না।”

“তাহলে এখন কি করবে ভাবছ?”
“আমি ভাবছি খুব শীঘ্রই দেশে ফিরব। এতদিন ধরে আমি নিজেকে এটার জন্যই প্রস্তুত করছিলাম। দেশে ফিরে এবার আমি নিঝুমের সাথে দেখা করব। নিজে বসে ওর সাথে কথা বলব। আমাদের এই সম্পর্কটা যদি ও মেনে নিতে না পারে তাহলে ওকে ডিভোর্স দিয়ে মুক্তি দিয়ে আসব যাতে অন্তত ও নতুন ভাবে জীবন টা শুরু করতে পারে। এতে আমি অন্তত কিছু টা দায়মুক্ত হবো।”

এলিনা বলে,”ম্যাক্সের মৃত্যুর পর আমি জীবন টাকে নতুন ভাবে অনুধাবন করতে পারছি আবরাজ। কাউকে ভালোবাসলে কতটা আত্মত্যাগ করা যায়, কতোটা নিজের কথা ভুলে তার চিন্তায় মগ্ন থাকা যায় সেটা আমি জানি। এই যে আমাকেই দেখো, ম্যাক্সের মৃত্যুর পর কম বিয়ের প্রস্তাব তো পেলাম না, আমার শ্বশুর বাড়ির লোকেরাও চায় আমি বিয়ে করে নিজের জীবন আবার শুরু করি। প্রয়োজনে এলেক্সের দায়িত্বও তারা নিতে রাজি কিন্তু আমি পারলাম কৈ তা? ম্যাক্সকে আমি এতোটাই ভালোবাসি যে ওর মৃত্যুর পরেও ওর স্থান কাউকে দিতে পারছি না সেখানে তুমি কি পারবে নিঝুমের যায়গাটা অন্য কাউকে দিতে?”

আবরাজ একটা দীর্ঘ শ্বাস ফেলে বলে,”এটা সম্ভব নয় এলিনা। তুমি তো জানো, আমি জীবনে কখনোই কাউকে ভালোবাসিনি। আমার জীবনে প্রথম ভালোবাসা ছিল নিঝুম। যদিও ওকে আমি অন্য কারো সাথে….তবে আজ কেন জানি আমার মনে হয়, ওদের মধ্যে আসলে কিছু ছিল না। যদি থাকত তাহলে ইমরান আর নিঝুম নিশ্চয়ই এত গুলো বছরে বিয়ের সিদ্ধান্ত নিতো। হয়তো পুরোটা আমার ভুল ধারণা ছিল যার জন্য নিঝুমের মায়ের জীবন শেষ হয়ে গেছে। এর জন্য আমি অনুতপ্ত। আর সেজন্যই আমি নিঝুমকে মুক্তি দিতে চাই। কিন্তু আমি…আমি হয়তোবা নিঝুমের ভালোবাসা থেকে কখনো মুক্তি পাবো না। তবে আমি নিজের এই একতরফা অনুভূতির জালে ওকে আটকে রাখতে চাই না। আমি ওকে মুক্ত করে দিয়ে বাকি জীবনটা একাই কাটিয়ে দেব।”
এলিনা বুঝতে পারে আবরাজ আর সে একই পথের পথিক। ভালোবাসাকে হারিয়ে সারাজীবন একা থাকার প্রতিজ্ঞা তাদের দুজনেরই!

নিঝুম তার ছেলে নির্ঝরকে খাইয়ে দিয়ে অতঃপর নিজেও একটু খেয়ে নিলো। এরমধ্যে সে নির্ঝরকে ঘুম পারিয়ে দিয়ে তার মাথায় হাত বোলাতে লাগল। এমন সময় ছবি বেগম তার কাছে এলো। নিঝুম ছবি বেগম কে দেখে বলল,”চাচি, কিছু বলবেন?”
“নির্ঝর ঘুমিয়ে পড়েছে?”
“জ্বি।”
“ছেলেটা বড্ড জেদি হয়েছে জানো।”
‘হুম, তা একটু জেদি।’
“ওর মধ্যে যেন তোমার আর আবরাজের প্রতিচ্ছবি লক্ষ্য করা যায়। একই জেদ, রাগ তবে একটা ব্যাপারে ও এগিয়ে আছে। সেটা হলো ও কিছুটা হলেও বুঝদার। যদি তোমরাও ওর মতো একটু বুঝদার হতে তাহলে..”
“এই বিষয় নিয়ে কথা বলতে চাই না চাচি।”

ছবি বেগম দীর্ঘ শ্বাস ফেলেন। নিঝুম বরাবরই বিষয়টা এভাবেই এড়িয়ে যায়। এরইমধ্যে হঠাৎ সেখানে চলে আসে মেডিকেল পড়ুয়া আনিকা। যে নিঝুমের মেডিকেল কলেজের একজন ঘনিষ্ঠ বন্ধু যদিও তার থেকে দুই ব্যাচের ছোট। পরিচয়টা হয়েছিল আনিকার একটি এসাইনমেন্টে নিঝুমের সাহায্য নেয়ার মাধ্যমে। প্রথমে সিনিয়র-জিনিয়র সম্পর্ক থাকলেও একসময় তা বন্ধুত্বে রূপ নেয়। তবে তার আরও একটা পরিচয় আছে। সে আবিরের প্রেমিকা এবং হবু স্ত্রী। কিছু দিনের মধ্যেই তাদের বিয়ে। আনিকার সাথে আবিরের পরিচয় মূলত নিঝুমের মাঝেই। চলাফেরা করতে অক্ষম আবিরের সাথে দেখা করেই তার প্রতি কিছুটা করুণা তৈরি হয়েছিল আনিকার মনে। সেই করুণাই যে কখন ভালোবাসায় রূপ নেয় সেটা সে নিজেও জানে না। এক সময় তারা দুজন একে অপরের গভীর প্রেমে পড়ে। তাদের ভালোবাসার পথটা মসৃণ ছিল না। আবিরের এই অক্ষমতার জন্য আনিকার পরিবার তাদের এই সম্পর্কটা শুরু তে একদমই মেনে নেয়নি কিন্তু আনিকা নিজের জেদে অটল থেকে তাদের রাজি করিয়েছে। যার ফলস্বরূপ এখন তাদের ভালোবাসা পূর্ণতা পাবার পথে।

আনিকা এসেই সবার উদ্দ্যেশ্যে বলল,”কেমন আছ তোমরা সবাই?”
আনিকাকে দেখেই নিঝুম খুশি হয়ে বলে,”তুমি। কখন এলে/”
“এই তো এখন। আচ্ছা আমার নির্ঝর বাবু কোথায়? ঘুমিয়ে পড়েছে নাকি?”
‘হ্যাঁ, একটু আগেই ঘুমালো।’
“ওহ, ওর জন্য এই চকলেট গুলো এনেছি। রেখে দে তো।”
এমন সময় কেউ পেছন থেকে বলে উঠল,”তোমায় না কতবার বারণ করেছি নির্ঝরের জন্য এমন আনহেলদি খাবার আনবে না। ক্যাবেটি হবে তো?!”
আনিকা পিছন ফিরে তাকিয়ে দেখে হুইল চেয়ারে করে এগিয়ে আসছে আবির। তাকে দেখেই সে মুখ বাকিয়ে বলে,”আহ আসছেন আমার মিস্টার খারুশ। আমি একজন মেডিকেল স্টুডেন্ট বুঝলে? আমায় তোমার জ্ঞান দিতে হবে না।”

অশ্রুজলে বোনা বিয়ে পর্ব ৩০

“তুমি মেডিকেল স্টুডেন্ট হতে পারো তবে আমাদের বাডিতে একজন ডাক্তার আছে। তাই আমারও এই বিষয়ে জানা আছে।”
এই নিয়ে তাদের দুজনের মাঝে ছোটখাটো একটা তর্ক লেগে যায় এবং ছবি বেগম ও নিঝুম এসব দেখে হেসে ফেলেন। ছবি বেগম বলেন,”যাক,আমার ছেলেটাকে সামলানোর জন্য কেউ তো এলো!”

অশ্রুজলে বোনা বিয়ে পর্ব ৩২