অশ্রুজলে বোনা বিয়ে পর্ব ৩৫

অশ্রুজলে বোনা বিয়ে পর্ব ৩৫
ইয়াসমিন খন্দকার

নির্ঝরের কথামতো পিছন ফিরে তাকাতেই অবাক হয়ে যায় আবরাজ। বলে ওঠে,”কই এখানে তো কেউ নেই?”
নির্ঝর মাথা চুলকে বলে,”কিন্তু আমি তো একটু আগে আম্মুকে এখানেই দেখলাম।”
এমন সময় ছবি বেগম সেখানে এসে নির্ঝরকে উদ্দ্যেশ্য করে বললেন,”কি হয়েছে নির্ঝর? তুমি এখানে কি করছ?”
“আমি তো এই সুপারহিরোর সাথে কথা বলছিলাম।”
“ওহ, আচ্ছা। তা বুঝি? বেশ, তাহলে তো ভালোই। তবে শুধু গল্প করলেই তো হবে না, খেতেও হবে৷ তুমি ওদিকে যাও তোমার আম্মু তোমার জন্য অপেক্ষা করছে। সকাল থেকে তো তেমন কিছু খাও নি। কিছু খেয়ে এসো।”
“আচ্ছা। সুপারহিরো তুমি থাকো, তোমার সাথে আবার পরে কথা হবে।”
বলেই নির্ঝর ছুটে চলে যায়৷ নির্ঝরকে ছুটে যেতে দেখে আবরাজ বলে,”বাচ্চাটা ভীষণ মিষ্টি! কেন জানি ওকে আমার ভীষণ আপন লাগছে।”

ছবি বেগম হেসে বলেন,”ও তো তোমার আপনই!”
আবরাজ অবাক হয়ে জানতে চায়,”মানে? ও আমার আপন বলতে?”
ছবি বেগম বলেন,”না মানে, বাচ্চারা তো সবাইকেই আপন করে নেয় সেটাই বলছিলাম আরকি।”
“ও আচ্ছা৷ বুঝলাম। আপনি আমাকে একটা প্রশ্নের উত্তর দিতে পারবেন?”
“হুম, বলো৷ আমি উত্তর দেয়ার চেষ্টা করব।”
“নিঝুম এতদিন কোথায় ছিল আর আজ এখানে এলোই বা কখন?”
“তোমাকে বলেছিলাম না ও এতদিন ঢাকায় ছিল। সেখানেই তো একটা মেডিকেলে ও এখন ডাক্তার হিসেবে আছে। আমি ওকে আবিরের বিয়ে উপলক্ষে দাওয়াত দিয়েছিলেন সেজন্যই ও এই বাড়িতে ফিরে এসেছে।”
“সত্যিই কি তাই?”

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

“হ্যাঁ, তা নয়তো কি?! যাইহোক, তুমি আনন্দ করো। আমি আসছি। অনেক কাজ পড়ে আছে তো।”
বলতে বলতেই তিনি সামনের দিকে এগিয়ে চলেন এবং মনে মনে বলেন,”আমাকে তুমি ক্ষমা করে দিও আবরাজ। তোমাকে অনেক মিথ্যা বলতে হচ্ছে। কি করবো বলো? আমার যে হাত-পা বাঁধা৷ তবে আর বেশিদিন এই মিথ্যা চলবে না। আমি খুব শীঘ্রই তোমার সামনে সব সত্য নিয়ে আসব। আমার উপর একটু ভরসা রাখো। আশা করি, নিরাশ হবে না।”
এদিকে আবরাজ ছবি বেগম এর যাওয়ার পানে তাকিয়ে ভাবতে থাকে,”ওনার ব্যবহার কেমন জানি সন্দেহ জনক লাগছে। উনি কি আমার থেকে কিছু লুকানোর চেষ্টা করছেন? আমার কেন জানি তেমন টাই মনে হচ্ছে।”

নির্ঝরকে নিজের হাতে খাইয়ে দিচ্ছে নিঝুম৷ আজ বিয়ে উপলক্ষে বেশ ভালো ভালো পদ রান্না হয়েছে। পোলাও, কোরমা, চিকেন, গরুর কালো ভুনা আরো কত কি। এসব তো নির্ঝর এর ভীষণ পছন্দের খাবার। তাই সে এক প্রকার চেটেপুটে খাচ্ছে। খেতে খেতেই সে নিঝুমকে বলে,”আম্মু, জানো আজ না আমি একজন সুপারহিরোর দেখা পেয়েছি। ঐ সুপারহিরো আমার পড়ে যাওয়ার হাত থেকে রক্ষা করেছে যেমন মুভিতে করে।”
নিঝুম নিজের ছেলের এই বাচ্চামো দেখে বলে,”ওহ আচ্ছা, তাই বুঝি। ভালো তো।”
“এরপর আমার সাথে ঐ সুপারহিরোর দেখা হলে এখন আমি ওনার সাথে তোমার পরিচয় করিয়ে দেব।”
‘আচ্ছা, দিও। এখন ভালো ছেলের মতো সবটুকু ভাত খেয়ে নাও।’
এভাবে নির্ঝর সব খাবার খেয়ে নেয়।

এদিকে গায়ে হলুদের আয়োজন শুরু হয়৷ আবিরের গায়ে হলুদ মাখানো হচ্ছিল এবং নিঝুমও একটি হলুদ শাড়ি পড়ে আজ সেখানে উপস্থিত হয়। আবরাজও একটু দূরেই দাঁড়িয়ে ছিল হলুদ পাঞ্জাবি পড়ে। তার নজর যায় নিঝুমের দিকে। নিঝুমের দিকে চোখ পড়তেই মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে থাকে। এই পাঁচ বছরে যেন নিঝুমের সৌন্দর্য আরো কয়েক গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। এসব ভেবেই হালকা হাসে আবরাজ। নিঝুমেরও চোখ যায় আবরাজ এর দিকে কিন্তু সে নিজের চোখ ফিরিয়ে নেয়। এরইমধ্যে নিঝুম আবিরের গায়ে হলুদ মাখিয়ে দূরে সরে আসে। আবির হুইলচেয়ারে বসে ভাবছিল কিভাবে তার ভাই ও নিঝুমকে আবার কাছাকাছি আনা যায়। আর এই নিয়ে ভাবতেই তার মাথায় একটা দুষ্টু বুদ্ধি এলো। আবরাজ সকলকে উদ্দ্যেশ্য করে বলল,”আমার গায়ে হলুদ মাখানো শেষ হলে এবার আপনারাও একটু একে অপরকে হলুদ মাখিয়ে মজা করুন।”

আবিরের কথা শুনে সবাই একে অপরকে হলুদ লাগাতে শুরু করে। এসব দেখে আবরাজেরও ভীষণ ইচ্ছা করছিল নিঝুমের গায়ে হলুদ মাখিয়ে দিতে কিন্তু কোথাও একটা গিয়ে সে বাঁধা পাচ্ছিল। এমন সময় হঠাৎ করেই কিছু ছেলে দৌড়ে এসে তার গায়ে ধাক্কা খায় যার ফলে সে কিছুটা দূরে গিয়ে কারো একটা গায়ে পড়ে যায় এবং সেই ছেলেদের হাতে থাকা হলুদের বাটি থেকে সমস্ত হলুদ পড়ে যায় আবরাজের গায়ে। আবরাজের মুখে হলুদ লেপ্টে থাকায় সে চোখ খুলতে না পারায় কিছু দেখতে পারছিল না। সে নিজের চোখ মুছতেই দেখতে পায় সে আরো অন্য কারো উপর নয়, নিঝুমের উপর পড়ে আছে। দুজনের মধ্যে বিন্দুমাত্র দূরত্ব নেই। আবরাজ আবেগের বশে নিজের হাতে লেপ্টে থাকা হলুদ মাখিয়ে দেয় নিঝুমের গালে। নিঝুম হতবাক হয়ে যায়। তার হৃদস্পন্দন যেন একেবারে থেমে গেছে।
হঠাৎ করে নিজের হুশ ফিরে পেয়ে সে আবরাজকে রেগে বলে,”কি করছেন টা কি? সরে যান আমার উপর থেকে।”
আবরাজ দ্রুত সরে গিয়ে অনুতপ্ত গলায় বলে, “আমি… আমি আসলে ইচ্ছা করে করিনি। পা ফসকে পড়ে গিয়েছিলাম।”

নিঝুম বিরক্ত চোখে তার দিকে তাকিয়ে বলল, “তা বলে আপনি আমাকে এভাবে বিব্রত করবেন? এই হলুদ মাখার খেলায় অংশ না নিলেই পারতেন। দেখছেন কিভাবে আমার গায়ে হলুদ মাখিয়ে দিলেন।”
আবরাজ কিছু বলার আগেই তাদের কথোপকথন থামিয়ে ছবি বেগম এগিয়ে এসে বলে উঠলেন, “কিরে, এখানে এত হৈ চৈ হচ্ছে কেন? সবাই কি ঠিক আছে?”
নিঝুম কিছু বলার আগেই আবরাজ পরিস্থিতি সামাল দিয়ে বলল, “না, কিছু হয়নি। আমি আসলে পা ফসকে পড়ে গিয়েছিলাম, তাই এমনটা হলো।”
ছবি বেগম সন্দেহের দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ আবরাজের দিকে তাকিয়ে থেকে বললেন,“ঠিক আছে। একটু দেখে শুনে চলাফেরা করো। এমন দূর্ঘটনা ঘটেই যায় মাঝে মাঝে।”
তবে ভেতরে ভেতরে তিনি সবকিছু বুঝে নিলেন। আবরাজের নিঝুমের প্রতি আকর্ষণ যে এখনো গভীর আছে, সেটা তিনি অনুভব করলেন।

গায়ে হলুদের পর আয়োজন মিটে গেলে সবাই একে একে যার যার রুমে চলে যায়। আবরাজ তখনও তার রুমে যায়নি। বাড়ির বাগানে এক কোণে বসে নির্লিপ্ত দৃষ্টিতে আকাশের দিকে তাকিয়ে ছিল। তার মনে হাজারটা প্রশ্ন। নিঝুম, ছবি বেগম সবার ব্যবহার যেন হাজার প্রশ্ন ছুড়ে দিচ্ছে।
এসব ভেবেই সে মনে মনে বলে উঠল, “আমি কিছুতেই আর অন্ধকারে থাকতে চাই না। এবার আমাকে সমস্ত সত্যিটা খুযে বের করতেই হবে।”

আনিকা কবুল বলার মধ্য দিয়েই তাদের বিয়েটা সম্পন্ন হয়ে গেল। সবাই খুশি হল৷ অবশেষে ও আবির ও আনিকার ভালোবাসা পূর্ণতা পেল। নিঝুম নির্ঝরকে নিয়ে খুব সাবধানে দূরে সরে আছে যাতে তাকে আর আবরাজের মুখোমুখি না হতে হয়। বর্তমানে তারা আনিকাদের বাড়িতেই অবস্থান করছে। নিঝুমের এখানে আসার একদম কোন ইচ্ছা ছিল না কিন্তু ছবি বেগম এর জোরাজুরিতে তাকে এখানে আসতে হলো। তবে এখন আবরাজের নজর বাঁচিয়ে চলতে হচ্ছে কারণ সে তাকে আর নির্ঝরকে দেখলেই হাজারটা প্রশ্ন করবে। কিন্তু এরইমধ্যে হঠাৎ করে নির্ঝর ছুটে কোথাও একটা হারিয়ে গেল। আসলে একটু দূরেই সে আবরাজকে দেখতে পেল। তাই ছুটে গিয়ে আবরাজ এর হাত ধরে বলল,”সুপারহিরো, এসো। আমি তোমাকে আমার আম্মু সাথে দেখা করাবো।”

অশ্রুজলে বোনা বিয়ে পর্ব ৩৪

বলেই তাকে টানতে টানতে নিঝুমের সামনে নিয়ে এলো। নিঝুম তখন অন্যমনস্ক ছিল তাই খেয়াল করে নি কিছুই। নির্ঝর আবরাজকে নিয়ে নিঝুমের সামনে এসে বলল,”সুপারহিরো, এই হলো আমার আম্মু। আর আম্মু এই হলো আমার সুপারহিরো।”
আবরাজ ও নিঝুম একে অপরের সাথে চোখাচোখি করেই স্তব্ধ হয়ে যায়। আবরাজ বিস্ফোরিত চোখে তাকায় নিঝুমের দিকে!

অশ্রুজলে বোনা বিয়ে পর্ব ৩৬