অশ্রুজলে বোনা বিয়ে সিজন ৩ পর্ব ৫০
ইয়াসমিন খন্দকার
আরুশি সহ বাসে উপস্থিত সবাই হতবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। সবার চোখে ভয় টের পাওয়া যাচ্ছে। বাসের সামনের দিকের অর্ধেক অংশ খাদে ঝুলে আছে এবং বাকি অর্ধেক অংশ কোনরকমে মাটির সাথে আটকে আছে।
ভেতরে থাকা সবার মধ্যে আতংক ও ভয় টের পাওয়া যাচ্ছে। আরুশি আরহামকে বলে,”আরহাম, বাচ্চাদের সামলাও..”
আফিফা খান, নির্ঝর খান দুজন পাশাপাশি শেষের দিকে বসে ছিল। তারা একে অপরের হাত ধরে আছে শক্ত করে। এদিকে আমান সায়রাকে শক্ত করে ধরে আছে। এমন একটা মুহুর্তে তাদের অনাগত সন্তানের জন্য ভীষণ চিন্তা হচ্ছে। সায়রা আমানকে বলে,”আমান..আজ কি সব শেষ হয়ে যাবে?”
“কিছু হবে না সায়রা। তুমি চিন্তা করো না।”
সায়রার আমিনার কথা মনে পড়তেই সে বলে,”আমাদের মেয়ে..আমিনা..ও কোথায়?”
আরহাম ও রাজীব মিলে ততক্ষণে জাঈদ, মাশরাফি, আমিনা সবাইকে সামলে নিয়েছে। জাঈদ ও আমিনা ভীষণ ঘাবড়ে গেছিল। মাশরাফি অবশ্য স্থির হয়ে আছে। রাজীব তাদের সবার উদ্দ্যেশ্যে বলে,”ভয় পেও না বাচ্চারা৷ সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে।”
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
এরমধ্যে বাসের ড্রাইভার বলে ওঠেন,”যা করার তাড়াতাড়ি করতে হবে। বাসের সামনের অংশ হাওয়ায় ঝুলছে..যেকোন সময় দমকা হাওয়ায় পড়ে যেতে পারে। দ্রুত বাস থেকে নামতে হবে যদি বাঁচতে চান।”
আরুশি যে একদম সামনের দিকে বসেছিল সে বলে ওঠে,”কিন্তু বাসের গেইট তো হাওয়ায় ভাসছে..আমরা সবাই বাস থেকে বের হবো কিভাবে?”
মারিয়াও বলে,”হ্যাঁ, তাই তো আমাদের অন্য কোন উপায়ে বাস থেকে বের হতে হবে।”
আরহাম ও রাজীব তখন পিছনের দিকে তাকিয়ে বলে,”বাসের পেছনের কাচ ভেঙে আমাদের সবাইকে এখান থেকে বের হতে হবে। সবাই পেছনের দিকে চলে এসো যাতে ভড় এদিকে বেশি হয় এবং বাস সহজে পড়ে না যায় খাদে।”
ভয়ে ভয়ে সবাই পিছনের দিকে যেতে থাকে। রাজীব ও আরহাম দুজনে মিলে একটা শক্ত কাঠ তুলে নিয়ে বাসের পেছনের দিকের কাচ ভেঙে ফেলে। অতঃপর আরহাম আমানকে উদ্দ্যেশ্য করে বলে,”আমান তুই সায়রাকে নিয়ে তাড়াতাড়ি নিচে নেমে যা..”
আমান বলে ওঠে,”না ভাইয়া..তোদের এই অবস্থায় রেখে আমি যেতে পারবো না।”
“বোঝার চেষ্টা কর ভাই পরিস্থিতি কতটা নাজুক। সায়রা এখন প্রেগ্ন্যান্ট বেশিক্ষণ এই অবস্থায় থাকলে ওর উপর খারাপ প্রভাব পড়বে..তুই ওকে নিয়ে বাইরে যা জলদি।”
সায়রা বলে ওঠে,”আমিনা..আমার মেয়েকে না নিয়ে আমি যাব না।”
আরুশি বলে,”তুমি আমানের সাথে যাও, আমরা এরপর ছোট বাচ্চাদের পাঠানোর ব্যবস্থা করছি।”
এরমধ্যে বাস দুলে ওঠায় সবাই ভয় পেয়ে যায়। আরহাম বলে,”জলদি যা তোরা..”
আমান সায়রাকে নিয়ে কোনরকমে বের হবার চেষ্টা করে। এরমধ্যে সায়রা পেটে হাত দিয়ে আহ করে ওঠায় আফিফা খান বলে ওঠেন,”সাবধানে..”
আমান ও সায়রা সাবধানে বাস থেকে নামে। এরপর আরহাম ও রাজীব মিলে ধরাধরি করে নির্ঝর খানকে বের করতে চান। নির্ঝর খান বলেন,”আমার চিন্তা না করে বাচ্চাদের বের কর..”
তখন আফিফা খান আমিনাকে কোলে তুলে নেন। আরহাম বলে,”মম তুমি আমিনাকে নিয়ে সাবধানে বাইরে যাও।”
আফিফা খান বলেন,”কিন্তু তোদের সবাইকে এভাবে ফেলে..”
“মম, বেশি সময় নেই যাও প্লিজ।”
আফিফা খান আর সময় নষ্ট না করে আমিনাকে নিয়ে নিচে নামে। এরপর বাস ড্রাইভার দ্রুত বাস থেকে নামতে চাইলে আরহাম জাঈদকে তার কোলে তুলে দিয়ে বলে,”আপনি আমার ছেলেকে নিয়ে বের হন।”
কিন্তু জাঈদ বলে ওঠে,”না, মাম্মা পাপা আমি তোমাদের ছেড়ে যাব না।”
আরুশি জাঈদের মাথায় হাত বুলিয়ে বলে,”তুমি না আমার গুড বয়। গুড বয়দের সবার কথা শুনতে হয়। তুমি এই আঙ্কেলের সাথে যাও।”
জাঈদ কাঁদতে থাকে যার ফলে বাসচালক মাশরাফিকে কোলে তুলে নিয়ে বলে,”আমি এই বাচ্চাটাকে নিয়ে যাচ্ছি আপনারা কেউ ঐ বাচ্চাকে নিয়ে আসুন।”
বলেই তিনি ভাঙা অংশ দিয়ে বাস থেকে লাফিয়ে পড়েন। রাজীব ও আরহাম এরপর নির্ঝর খানকে ধরাধরি করে বাস থেকে নামিয়ে দেয়। বিপরীত দিক থেকে আমান ও বাস চালক তাদের সাহায্য করে। বাসে তখন অবশিষ্ট ছিল আরহাম, আরুশি, রাজীব, মারিয়া ও জাঈদ। এদিকে বাসের ওজন কমে যাওয়ায় বাস কিছুটা সামনের দিকে হেলে যায়। যার ফলে সবাই আতকে ওঠে৷ আরহাম বলে ওঠে,”আরুশি আর সময় নেই তুমি জলদি জাঈদকে নিয়ে বের হও।”
আরুশি বলে,”কি বলছ কি তুমি? তোমাদের সবাইকে এভাবে বিপদের মুখে রেখে আমি যেতে পারবো না।”
রাজীব বলে ওঠে,”আরহাম ঠিক বলছে আরু। এই মুহুর্তে তর্ক করো না..নিজের ছেলের কথা ভাবো।”
আরুশি বুকে পাথর চাপা দিয়ে আরহামকে জড়িয়ে ধরে। আরহাম বলে,”আমার কিছু হয়ে গেলে জাঈদকে তুমি একা সামলে নিও।”
এই কথা যেন আরুশিকে আরো ভেঙে দেয়। আরুশি জাঈদকে নিয়ে বের হতে যাবে এমন সময় হঠাৎ করে পা ফসকে পড়ে গিয়ে আরুশি ও জাঈদ দুজনেই তীব্র আঘাত পায়। আরহাম বলে ওঠে,”আরু..”
মারিয়া ও রাজীব এসে আরুশিকে আগলে নেয়। আরহাম বলে,”আরু তুমি ঠিক আছ তো?”
এদিকে বাস আরো সামনের দিকে এগোতে থাকে। জাঈদও পড়ে গিয়ে অনেক আঘাত পেয়েছিল। আরুশি বলে ওঠে,”আহ, আমার পা..পা নাড়াতে পারছি না।”
আরহাম বলে,”একটু চেষ্টা করো আরুশি..তুমি পারবে।”
মারিয়াও বলে,”হ্যাঁ, আরু তুই চেষ্টা কর এভাবে হাল ছাড়িস না।”
আরুশি জাঈদের দিকে তাকিয়ে বলে,”আরহাম তুমি জাঈদকে নিয়ে বাস থেকে বের হও প্লিজ। আমাদের ছেলেটাকে বাঁচাও।”
আরহাম বলে,”নাহ, আমি তোমাকে এই অবস্থায় ফেলে কোথাও যাব না।”
“জেদ করো না আরহাম। আমাদের ছেলেকে বাচাতে হবে তোমায়।”
“আমি যাব না মানে যাব না..রাজীব ভাই..আপনি জাঈদকে আর মারিয়াকে নিয়ে বাইরে যান। আমি আরুশিকে নিয়ে আসছি।”
রাজীব শুরুতে রাজি ছিল না কিন্তু আরহামের জোরাজুরিতে সে জাঈদকে নিয়ে বাইরে আসে। মারিয়াকে দেখে আরুশি বলে,”মারিয়া..তুই এখনো আছিস কেন? তুই বাইরে যা।”
মারিয়া বলে,”নাহ, আরু আগেরবার আমি বন্ধুত্বের মর্যাদা রাখিনি তবে এবার রাখবো। তোকে এই অবস্থায় আমি কিছুতেই একা ফেলে যাব না। আরহাম ভাই আপনি আর আমি মিলে আরুকে তুলি চলুন।”
দুজনে মিলে আরুশিকে তোলার চেষ্টা করে কিন্তু আরুশি পায়ে এত বেশি আঘাত পায় যে উঠতেই পারে না। আরহাম বলে,”একটু চেষ্টা করো আরুশি..তুমি পারবে ”
“হ্যাঁ, আরু। তুই চেষ্টা কর।”
“পারছি না আমি পারছি না..”
এরমধ্যে হঠাৎ করে বাস একেবারে কিনারায় চলে আসে। আরহাম ও মারিয়া মিলে অনেক কষ্টে আরুশিকে তুলে এবং বাস থেকে বের হতে যায় এমন সময় বাস সম্পূর্ণ খাদ থেকে পড়ে যায়। আরুশি, আরহাম বাইরে আসতে সক্ষম হলেও মারিয়া পা ফসকে পড়ে যায় এবং বাসের সাথে সাথে খাদ থেকে পড়ে যায়। আরুশি চিৎকার করে বলে ওঠে,”মারিয়া..”
অশ্রুজলে বোনা বিয়ে সিজন ৩ পর্ব ৪৯
মাশরাফিও কান্নারত স্বরে বলে,”আম্মু..”
কিন্তু বিপরীত দিক থেকে আর কোন সাড়া আসে না। মারিয়া বাসের সাথে সাথে খাদ থেকে পড়ে গিয়ে চিরকালের মতো হারিয়ে যায়। আরুশি মাটিতে লুটিয়ে পড়ে কাঁদতে থাকে। আজ আবারো সে আবার প্রিয় বান্ধবীকে হারালো! আগেরবার তাকে হারিয়েছিল তার করা অন্যায়ের জন্য কিন্তু এবার..এবার ভাগ্যই চিরতরে কেড়ে নিলো মারিয়াকে।