অশ্রুজলে বোনা বিয়ে সিজন ৩ পর্ব ৫৭

অশ্রুজলে বোনা বিয়ে সিজন ৩ পর্ব ৫৭
ইয়াসমিন খন্দকার

আরহা নিজের ঘরে মন খারাপ করে বসে আছে। সেদিনের ঘটনার পর থেকে সে নিজেকে অনেকটাই গুটিয়ে নিয়েছে৷ আগে থেকেই আরহা শান্ত স্বভাবের এখন যেন আরো শান্ত হয়ে গেছে। জাঈদ এখন এক মুহুর্তের জন্যেও তাকে একা বাইরে যেতে দেয় না। নিজে সবখানে সাথে করে নিয়ে যায়। এসব ঘটনায় আরহা এখন অভ্যস্ত হয়ে গেছে। রিয়াশার সাথেও তাকে মিশতে বারণ করেছে জাঈদ। এই কারণেই রিয়াশা কয়েকবার আরহার সাথে কথা বলতে এলেও আরহা তাকে এগিয়ে যায়। কিন্তু এসব করতে গিয়ে আরহা নিজেই অনেক ভেঙে পড়েছে। কেননা রিয়াশা ছিল তার প্রিয় বান্ধবী৷ রিয়াশা ছাড়া অন্য কারো সাথে তার তেমন সম্পর্ক নেই৷ সেজন্য আরহা যেন এখন আরো একা হয়ে গেছে। রিয়াশার অবস্থাও এক। নিজের ভুলের জন্য আজো সে আত্মগ্লানিতে ভুগছে। এই ঘটনা যেন তাদের বন্ধুত্বে এক বিশাল দেয়াল হয়ে দাঁড়িয়ে গেছে।

আমিনা ভার্সিটি যাওয়ার জন্য বের হচ্ছিল। এমন সময় জাঈদ তার সামনে এসে দাঁড়ায়। আমিনা জাঈদকে পাশ কাটিয়ে যেতে নেয় এমন সময় জাঈদ বলে ওঠে,”তুমি ভার্সিটি যাবে তো? আমিও ঐদিকে যাচ্ছি। আমার সাথে চলো, আমি তোমাকে পৌঁছে দিচ্ছি।”
আমিনা গম্ভীর স্বরে বলে,”তার কোন প্রয়োজন নেই। আমি একা চলে যেতে পারব।”
জাঈদ বলে,”এটা কিন্তু ঠিক হচ্ছে না আমিনা। তুমি নিজেই আমাকে জেদি ছেলে বলো আর এখন তুমি জেদ দেখাচ্ছ!”

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

আমিনা হঠাৎ করে চেচিয়ে বলে ওঠে,”কেন? আমার মতো সামান্য একজন ভার্সিটি পড়ুয়া মেয়েকে নিয়ে গেলে দা গ্রেইট বুয়েটিয়ান জাঈদ খানের প্রেস্টিজে লাগবে না? নিজেকে ছোট মনে হবে না? এর তো কোন প্রয়োজন নেই। আমি চাই না, কেউ আমার জন্য নিজের প্রেস্টিজ লো করুক।”
জাঈদ হতাশ স্বরে বলে,”তুমি এখনো সেদিনের ঘটনা নিয়ে পড়ে আছো আমিনা? আমি তো নিজের ভুলটা স্বীকার করেছি। আমি মানছি, ঐসব কথা বলে তোমায় হার্ট করা ঠিক হয় নি। তবুও কেন তুমি বুঝতে চাইছ না?”
আমিনা চোখ পাকিয়ে বলে,”কেন? রাগ, জেদ করার অধিকার কি শুধু তোমার একার আছে মিস্টার জাঈদ খান? তোমার শুধু একারই ইগো থাকতে পারে আর কারো থাকবে না? যদি এমনটা ভেবে থাক তাহলে তুমি ভুল ভেবেছ। হতে পারে, আমি হয়তো তোমার মতো এত মেধাবী নই কিন্তু আমারও আত্মসম্মান আছে। যারা আমাকে নিচু দেখায় তাদেরকে আমি পরোয়া করি না। কারণ আমার কাছে আমি যেমন, তেমনই বেস্ট।”

বলেই সে রওনা দেয়। জাঈদ পেছন থেকে কয়েকবার ডাকলেও কোন সাড়া দেয় না। জাঈদ দীর্ঘ শ্বাস ফেলে৷ সবার উপর নিজের জেদ খাটানো জাঈদ আজ আমিনার জেদ ও আত্মসম্মানের কাছে নাকানিচুবানি খাচ্ছে।
এদিকে আমিনা একা একা বাইরে বের হয়ে বলে,”নিজেকে কি মনে করেছে ঐ জেদি ছেলেটা? যখন ইচ্ছা হবে আমায় সবার সামনে অপমান করবে তারপর ক্ষমা চেয়েই সব মিটিয়ে নেবে! আমি কি এতোটাই সস্তা নাকি? হতে পারি আমি চঞ্চল, সহজেই সবার সাথে মিশে যাই। কিন্তু তার মানে এই নয় যে, আমি নিজের অপমানগুলো সহজে ভুলে যাব। একদিন আমি নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে ঐ জেদি ছেলেকে দেখিয়ে দেব যে আমিও কম কিছু নই।”

কয়েক দিন পর,
আরহা এখনো নিয়মিত কলেজে আছে। তাদের ইন্টার ফাইনাল ইয়ার এক্সাম শুরু হতে চলেছে খুব শীঘ্রই। এজন্য আপাতত পড়াশোনা চাপ বেড়েছে। রিয়াশা রোজই আরহার সাথে কথা বলার চেষ্টা করে, আরহারও ইচ্ছা করে তার সাথে কথা বলার কিন্তু নিজের ভাইয়ের বারণের জন্য সে চাইলেও পারে না রিয়াশার সাথে কথা বলতে। এজন্য রিয়াশাও এখন নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছে।
এসবের মধ্যে রিয়াশা মিমের সাথে বেশি ঘনিষ্ঠ হয়৷ তবে মিমও আজকাল কেমন জানি অন্যমনস্ক থাকে। মিমের অনেক চালচলন রিয়াশার কাছে অদ্ভুত লাগে।
আজকেও যথারীতি কলেজ ছুটির পর জাঈদ নিজের বাইকে করে এসে আরহাকে নিয়ে চলে গেল। রিয়াশা একটা দীর্ঘ শ্বাস ফেলে মিমের সাথে বাড়ির দিকে রওনা দিলো। তবে সে খেয়াল করল মিমের অদ্ভুত আচরণ। রিয়াশার পাশাপাশি একসাথে হাটলেও সে কোন কথা বলছিল না বরং নিজের ফোনে কারো সাথে চ্যাটিং এ ব্যস্ত ছিল ও মুচকি মুচকি হাসছিল। মিমের হাতে স্মার্টফোন দেখে রিয়াশা যারপরনাই অবাক হয়। কেননা, মিমের বাবা ভীষণই রাগী ও বদমেজাজি একজন ব্যক্তি যিনি মিমকে অনেক শাসনে রাখেন। মিমের কাছে আগে একটা বাটন ফোনও ছিল না সেখানে স্মার্টফোন!
রিয়াশা মিমকে হঠাৎ করে জিজ্ঞেস করে,”তুই এই ফোনটা কোথায় পেলি মিম? আর কার সাথেই বা চ্যাটিং করছিস?”

মিম বলে,”এটা আমি কিনেছি। আদ আমার এক বন্ধুর সাথে চ্যাটিং করছি। কেন কোন সমস্যা?”
“না, কিন্তু তোর আব্বু তো এসবের..”
“বাদ দে তো এসব। আচ্ছা, থাক। আমি একটু আসছি।”
“আসছিস মানে? কোথায় যাচ্ছিস তুই? আমাদের তো একসাথে বাসায় ফেরার কথা।”
মিম বিরক্ত স্বরে বলে,”আমি একটা জরুরি কাজ আছে। আমায় যেতে হবে। তুই একাই বাসা চলে যা।”
রিয়াশাকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে মিম নিজের মতো চলে যায়। মিমের এমন আচরণে রিয়াশার ভীষণ খটকা লাগে। তাই সে মিমের পিছু নিতে থাকে। কিছুক্ষণ চুপি চুপি মিমের পিছু নিয়ে রিয়াশা দেখতে পায় মিম একটা ফুচকার দোকানের সামনে গিয়ে দাঁড়িয়েছে৷ রিয়াশাও দূর থেকে তার উপর নজর রাখতে থাকে। কিছুক্ষণ পর সেখানে একটি ছেলে এসে মিমকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে। এতে রিয়াশা ভীষণ অবাক হয়৷ তবে আরো বেশি অবাক হয় যখন ছেলেটির চেহারা দেখে। কারণ ছেলেটি ছিল আকাশ!

আকাশ ও মিম একসাথে ফুচকা নিয়ে ভাগ করে খেতে থাকে। রিয়াশা চরম অবাক হয়ে বলে,”এটা কি করে সম্ভব?”
সে দূর থেকেই তাদের দেখতে থাকে। ফুচকা খাওয়ার পর তারা দুজনে কিছুটা দূরে গিয়ে পার্কের মধ্যে একে অপরের হাত ধরে বসে গল্প করতে থাকে। তারপর কিছু সময় পর আকাশ উঠে বিদায় নেয় ও মিমও নিজের মতো চলে আসতে নেয় এমন সময় রিয়াশা এসে মিমের সামনে দাঁড়ায়। রিয়াশাকে দেখেই মিম ঘাবড়ে যায়। আমতাআমতা করে বলে,”রিয়ু..তুই?”
“এসব হচ্ছেটা কি মিম? তুই ঐ আকাশের সাথে..তোরা প্রেম করছিস?”
মিম বলে,”তুই ভুল ভাবছিস৷ আমরা তো শুধু..”

“একদম মিথ্যা বলার চেষ্টা করবি না মিম। আমি নিজের চোখে তোদের একসাথে ঘনিষ্ঠ অবস্থায় দেখেছি। তোকে নতুন ফোনও নিশ্চয়ই ঐ আকাশ কিনে দিয়েছে তাই না?”
মিম এবার কিছুটা রাগী সুরে বলে,”আমার ব্যাপারে তুই এত নাক গলাচ্ছিস কেন?”
“মিম, আমার কথা শোন। আমি তোর ভালোর জন্য বলছি এসব করিস না। ভেবে দেখ, আঙ্কেল কিন্তু এসএসসি পাস করার পরই তোর বিয়ে দিতে চেয়েছিলেন। শুধুমাত্র আন্টির অনুরোধের জন্য তুই এতদূর পড়াশোনা করতে পারছিস। আন্টির চোখে কত স্বপ্ন তুই জীবনে নিজের পায়ে দাঁড়াবি। তাই এই স্বপ্নকে এভাবে গলাটিপে হ*ত্যা করিস না মিম। আঙ্কেল যদি এসবের ব্যাপারে জানতে পারে তাহলে কেলেঙ্কারি হয়ে যাবে। এর আগের দিন আঙ্কেল ছিল না জন্য তোকে নিয়ে কনসার্টে যেতে পেরেছিলাম। সেই ঘটনাতেও তুই কত ভয়ে ছিলি যে আঙ্কেল সব জানলে কি হবে৷ আর আজ যদি তোর এই রিলেশনের কথা আঙ্কেল জানে তাহলে কি হবে ভাবতে পারছিস? আঙ্কেল তো প্রেম-ভালোবাসা এসব সহ্যই করতে পারেন না। সব জানাজানি হলে উনি নিশ্চয়ই তোর বিয়ে দিয়ে দেবেন। তাই বলছি মিম, তুই এই সম্পর্ক থেকে সরে আয়।”

অশ্রুজলে বোনা বিয়ে সিজন ৩ পর্ব ৫৬

মিম এবার একপ্রকার চিৎকার করে বলে ওঠে,”তোর সমস্যাটা কি রিয়ু? হিংসা হচ্ছে আমাকে নিয়ে যে, আমার বয়ফ্রেন্ড আমাকে এত গিফট দেয়, এত ভালোবাসে।”
“তুই ভুল ভাবছিস মিম। আমি তো তোর ভালোর জন্যই..”
“আমার ভালো তোকে ভাবতে হবে না। তুই নিজের চরকায় তেল দে।”
বলেই মিম দ্রুত পায়ে হেটে চলে যায়।

অশ্রুজলে বোনা বিয়ে সিজন ৩ পর্ব ৫৮