অশ্রুজলে বোনা বিয়ে সিজন ৩ পর্ব ৫৯
ইয়াসমিন খন্দকার
আরহা নিজের রুমে এসে বসে মাশরাফির বলা কথাগুলোই ভাবছিল। এই কথাগুলো সে কিছুতেই নিজের মন থেকে বের করতে পারছিল না। মাশরাফিকে সবসময় নিজের বান্ধবীর ভাই হিসেবে দেখে এসেছে আরহা। এর থেকে বেশি কিছু সে কখনো ভাবে নি। কিন্তু এখন হঠাৎ এভাবে মাশরাফির প্রপোজাল তার মনে হাজারো প্রশ্ন তৈরি করছে৷ আরহা বিছানায় শুয়ে শুয়ে ভাবছিল,”মাশরাফি ভাই কি বললেন এটা? উনি আমায় পছন্দ করেন…আমাকে..”
আরহার মনে কেন জানি একটু ভালো লাগাও কাজ করছিল৷ এর কারণ সে জানে না৷ কিন্তু ভালো লাগার পাশাপাশি তার মনে সংশয় ছিল৷ কারণ তার নিজের মনের অনুভূতি সে জানে না। তার উপর মাশরাফি আর জাঈদের মধ্যে যা তিক্ত সম্পর্ক তাতে জাঈদ এই বিষয়টা কিভাবে নেবে? এসব কথাই ঘোরপাক খাচ্ছিল আরহার মনে। আরহা নিজের দুচোখ বন্ধ করে বলে,”আল্লাহ, তুমি এবার আমাকে কোন উপায় দেখাও। কি করা উচিৎ আমার এই রকম একটা পরিস্থিতিতে? আমার কি আরো সময় নিয়ে ভাবা উচিৎ। তাই ঠিক হবে৷ এখন তাড়াহুড়ো করে কোন সিদ্ধান্ত নেয়া যাবে না। যাই করতে হবে খুব বুঝে শুনে আর সাবধানে করতে হবে। তাহলে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারব।”
নিজের স্বভাবচরিত শান্ত ব্যবহারে ফিরে গেলো আরহা।
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
মাশরাফি মাঠে ক্রিকেট খেলছিল। তার সম্পূর্ণ মনোযোগ ছিল খেলার মাঝে। এমন সময় হঠাৎ করে মাশরাফির প্রিয় বন্ধু আবির মাশরাফির হাত থেকে এসে ব্যাটটা কেড়ে নিয়ে বলে,”খেলা বাদ দিয়ে আপাতত এদিকে একটু আয় তো। তোর সাথে অনেক জরুরি কথা আছে।”
মাশরাফি বলে,”ঠিক আছে, চল।”
মাশরাফি আবিরের সাথে চলে যায়৷ একটু দূরে যেতেই আবির বলে ওঠে,”কি রে, তুই আরহাকে নিজের মনের কথা জানিয়েছিস?”
মাশরাফি মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ-বোধক ইশারা করে। আবির খুশি হয়ে বলে,”সাব্বাস! এই নাহলে আসল পুরুষ। একদম ঠিক করেছিস তুই। তো আরহা কি জবাব দিল?”
“এখনো কিছু জানায় নি৷ আমি ওকে সময় দিয়েছি ভাবার জন্য।”
“শুধু সময় দিয়ে এভাবে বসে থাকলেই তো হবে না। কাজের কাজও কিছু করতে হবে।”
“মানে?”
“দেখ, আমি তোর বন্ধু সেজন্য তোর ভালোই চাইব। তাই বলছি এই সময়ের মধ্যে এমন কিছু কর যাতে আরহা তোর উপর ইমপ্রেস হয়।”
“ওহ।”
“হুম, আরহাকে ওর পছন্দের কোন জিনিস উপহার দে। উপহার পেলে তো সব মেয়েরাই খুশি হয়৷ আরহাও নিশ্চয়ই অনেক খুশি হবে।”
“রিয়াশার কাছে শুনেছিলাম, আরহা গাছপালা অনেক পছন্দ করে।”
“তাহলে ওকে এরকম একটা টব সহ গাছই উপহার দে। তুই শুধু আরহার মন জয় করে নে। তারপর ওর ঐ জাদরেল ভাই জাঈদকে সামলানোর দায়িত্ব আমাদের।”
নিজের বন্ধুর কথায় মাশরাফি সাহস পেল।
আরহা চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে কলেজের বাইরে। জাঈদ এখনো তাকে নিতে আসে নি৷ এমন সময় হঠাৎ করে মাশরাফি আরহার সামনে এসে দাঁড়ালো। তাকে দেখে আরহা ভয়ে জমে গেল৷ মাশরাফি আরহার দিকে তাকিয়ে মৃদু হেসে এগিয়ে এলো। আরহা কিছুটা বিব্রত বোধ করলে মাশরাফি বললো,”ভয় পাবার কিছু নেই। আমি এখানে উত্তর শুনতে আসি নি। এর জন্য তুমি আরো সময় নাও। আমি এখানে তোমায় কিছু দিতে এসেছি?”
“কি?”
জানতে চায় আরহা৷ মাশরাফি আরহার দিকে একটা ব্যাগ বাড়িয়ে দেয়। আরহা জানতে চায়,”কি আছে এই ব্যাগে?”
“এই ব্যাগে একটা খুব সুন্দর গোলাপ গাছের টব আছে।”
“গোলাপ গাছের টব!”
“হ্যাঁ, দেখো পছন্দ হয় কি না।”
আরহা খুলে দেখে বলে,”জ্বি, ভালো হয়েছে।”
“তোমার পছন্দ হয়েছে এতেই আমি খুশি।”
বলেই মাশরাফি বলে,”তাহলে থাকো। আমি এখন যাই। তোমার ভাই চলে আসার আগেই বিদায় নিতে হবে। ও এসে আমায় দেখলে আবার কাহিনি করবে।”
“ঠিক আছে। সাবধানে যাবেন।”
নিজের জন্য আরহাকে চিন্তা করতে দেখে মাশরাফির ভীষণ ভালো লাগল। খুশি মনে সে বাইক স্টার্ট দিয়ে এগিয়ে গেলো। মাশরাফি যাবার কিছু সময় পর জাঈদ এসে আরহাকে বাসায় নিয়ে গেলো।
বাড়িতে ফিরেই আমান খান দেখলেন সায়রা ভীষণ সুন্দর ভাবে তৈরিতে হয়ে আসেন। এটা দেখে তিনি এগিয়ে গিয়ে বললেন,”কি হয়েছে সায়রা? তুমি আজ হঠাৎ এভাবে সেজেছ কেন?”
সায়রা বলেন,”কোর্টে কেস লড়তে লড়তে তো দেখছি তোমার আর কিছু মনেই থাকে না। আজ যে আমাদের বিবাহবার্ষিকী সেটা কি তোমার মনে নেই?”
“দীর্ঘ ২৫ বছর হয়ে গেল!”
অবাক স্বরে বলল আমান।
এমন সময় আমিনা ও আকাশ এসে সমস্বরে এসে বলল,”হ্যাপি এনিভারসিরি আম্মু আব্বু।”
দুজনেই ভীষণ খুশি হলো। সায়রা আমানের দিকে তাকালো আবেগঘন চোখে।
সায়রার চোখ দুটো ছলছল করে উঠলো। আমান খান স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে একটু হাসলেন। পঁচিশটা বছর কেটে গেল, অথচ মনে হয় এই তো সেদিনের কথা। সায়রাকে প্রথম যখন দেখেছিলেন, তখনো তার চোখ দুটো এমনই মায়াভরা ছিল। আমান তখনো তরুণ আইনজীবী, আর সায়রা সদ্য কলেজ পাশ করা উচ্ছল তরুণী যে বয়সে তার থেকে বড় ছিল। সেদিন কি আর ভেবেছিলেন, এই মেয়েটা তার জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে যাবে?
আমান সায়রার দিকে তাকিয়ে উজ্জ্বল হেসে বললেন,”মনে থাকবে না মানে? পঁচিশ বছর যে এভাবে চোখের পলকে পার হয়ে যাবে, সেটা ভাবিনি।”
সায়রা আলতো করে আমানের কাঁধে মাথা রাখলো। আমিনা আর আকাশ তখনো তাদের দিকে মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে। এই দৃশ্যটা তাদের কাছে খুবই প্রিয়। বাবা-মায়ের ভালোবাসা দেখতে দেখতেই তারা বড় হয়েছে। আমিনা বলে উঠলো “আব্বু, আম্মুর জন্য কিছু করো না?”
আমান খান চোখ টিপে বললেন,”সেটা তো সারপ্রাইজ। তোমাদের আগে বললে তো আর সারপ্রাইজ থাকবে না।”
সায়রা মুচকি হাসলেন। তার স্বামীর এই দিকটা তিনি খুব ভালো করেই জানেন। কাজের বাইরে আমান একজন অন্য মানুষ। ভালোবাসার মানুষগুলোর জন্য সে যেকোনো কিছু করতে পারে। আজকের দিনটা যে শুধু বিবাহবার্ষিকী নয়, বরং তাদের ভালোবাসার আরও পঁচিশ বছর পূর্ণ হওয়ার উৎসব, সেটা যেন তার প্রতিটি আচরণে স্পষ্ট। তারা চারজন মিলে ড্রইংরুমে বসলো। আমিনা আর আকাশ বাবার জন্য কিছু স্ন্যাকস আর চা নিয়ে এলো। এই সময়টুকু তাদের কাছে অমূল্য। যৌথ পরিবারের এই ছোট ছোট মুহূর্তগুলোই জীবনের আসল আনন্দ।
হঠাৎ করে আমান খানের ফোনে একটা কল আসলে তিনি বললেন,”আমাকে এখন একটা জরুরি কাজে যেতে হবে। রাতে ফিরে সবাই একসাথে আনন্দ করবো।”
সায়রা বললেন,”জলদি এসো।”
সন্ধ্যার দিকে নিজের রুমে বসেছিল আরহা। হঠাৎ করে তার মনে হলো গাছটা ছাদে রেখে আসার কথা। সে আর দেরি না করে গোলাপের টব গাছটা নিয়ে ছাদে উঠলো। ছাদে উঠতেই সে অবাক হলো কারণ তাদের ঠিক পাশের বাসার ছাদেই ছিল মাশরাফি। মাশরাফি আরহাকে দেখে একটুও অবাক হয় না। সে বলে,”এই বাসা আমার বন্ধু আবিরের এক আত্নীয়র। ওর সাথেই ঘুরতে এসেছিলাম। কিন্তু এভাবে যে তোমার সাথে দেখা হবে ভাবি নি।”
আরহা লাজুক ভঙ্গিতে এগিয়ে এসে টবসহ গাছটা ছাদের কিনারায় রেখে দিলো। অতঃপর মাশরাফির দিকে তাকিয়ে বললো,”গাছটা দেয়ার জন্য ধন্যবাদ।”
অশ্রুজলে বোনা বিয়ে সিজন ৩ পর্ব ৫৮
“আচ্ছা, তোমার উত্তরের আশায় রইলাম।”
বলেই মাশরাফি যেতে নেয় এমন সময় আরহা হঠাৎ করে টবটা হাতে নিয়ে গাছটা আরেকটু সরাতে যায় কিন্তু ভুল করে তার হাত ফসকে যেতে নেয়। ঠিক সেই সময় আমান খান রাস্তা দিয়ে হেটে আসছিলেন। আরহা চিৎকার করে বলে ওঠে,”চাচ্চু..সরে যাও…”
আমান খান বা আরহা দুজনেই কিছু বুঝে ওঠার আগেই আরহার হাত লেগে টবটা গিয়ে পড়ে একদম আমান খানের মাথার উপর। আমান খান আর্তনাদ করে ওঠেন। আরহা আকস্মিক এই ঘটনায় আতকে উঠে এবং কোন প্রতিক্রিয়া করারও সুযোগ পায় না।