অশ্রুজলে বোনা বিয়ে সিজন ৩ পর্ব ৬১

অশ্রুজলে বোনা বিয়ে সিজন ৩ পর্ব ৬১
ইয়াসমিন খন্দকার

আরহা বসে আছে নিজের ঘরে। কোন ভালো খবরের আশা করছে। তাই তো চোখ বন্ধ করে আল্লাহকে স্মরণ করে বলছে,”আল্লাহ, তুমি দেখো। আমার চাচ্চু যেন একদম ঠিক হয়ে যায়। ওনার যেন কোন ক্ষতি না হয়।”
আরহার ভাবনার মাঝেই মাশরাফি তার রুমে আসে৷ মাশরাফির চোখে হতাশা। আরহা মাশরাফিকে দেখেই এগিয়ে এসে বলে,”কি হয়েছে মাশরাফি ভাইয়া? আপনি কোন খবর পেলেন? চাচ্চু এখন ঠিক আছেন তো?”
“তুমি নিজের মনকে শক্ত করো আরহা।”
“মন শক্ত কেন করতে হবে?”
মাশরাফি কোন উত্তর দেয় না। আরহা ব্যতিব্যস্ত স্বরে বলে,”চুপ করে আছেন কেন? বলুন না আমার চাচ্চু এখন কেমন আছেন?”

“তোমার চাচ্চু আর নেই আরহা..উনি মারা গেছেন।”
কথাটা যেন আরহার মাথার উপর বজ্রপাতের মতো শোনায়৷ সে দু পা পিছিয়ে যায়। অতঃপর দুই পা গুটিয়ে ফ্লোরে বসে পড়ে। হাটুতে মুখ গুজে কান্না করতে শুরু করে। মাশরাফি বুঝতে পারে না কিভাবে এই মুহুর্তে আরহাকে সামলাবে। আরহা অপরাধবোধ ও শোকে একদম পাগল হয়ে যায়। সে বিড়বিড় করে বলে,”আমার..আমার জন্য চাচ্চু মারা গেছেন। আমি আমার চাচ্চুকে মেরে ফেলেছি..আমি খু**নি..”
মাশরাফি আরহার পাশে বসে। তার হাত দুটো শক্ত করে ধরে বলে,”নিজেকে সামলাও আরহা। যা হয়েছে তা কেবলই একটা এক্সিডেন্ট।”
“কিন্তু আমার জন্য..শুধুমাত্র আমার জন্য আমার চাচ্চু মারা গেছেন। আমিই এর জন্য দায়ী। আমার তো শাস্তি হওয়া উচিৎ। আচ্ছা, ভাইয়া সবাই যখন সবটা জানবে তখন নিশ্চয়ই আমায় খুব ঘৃণা করবে তাই না? আমাকে সবাই দূরে ঠেলে দেবে?”

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

“কেউ তোমায় ঘৃণা করবে না আরহা। আমি আছি তোমার পাশে।”
“নাহ, আমি সবাইকে সব সত্যটা বলে দেবো। তারপর যা হবার হোক।”
“না, আরহা। এরকম পাগলামি করো না৷ এতোটা আবেগপ্রবণ হয়ে পড়ো না বাস্তবতাটা বোঝার চেষ্টা করো। সত্যটা জানলে এই মুহুর্তে সবাই অকারণে তোমায় দোষারোপ করবে। তাই নিজের ভালোর জন্যই এখন তোমায় সত্যটা লুকিয়ে রাখতে হবে।”
“কিন্তু..চাচ্চু..ওনার আত্মা কখনো আমায় ক্ষমা করবে না তাইনা?”
“তোমার চাচ্চু জানেন, যা হয়েছে তা একটা দূর্ঘটনা ছাড়া কিছু নয়। উনিও যদি বেঁচে থাকতেন তাহলে নিশ্চয়ই সত্যটা কখনো কাউকে বলতেন না এবং তোমাকেও বলতে দিতেন না। তাই তুমি নিজের চাচ্চুর জন্য হলেও এই কথাটা গোপন রাখো।”
আরহা আর কিছু বলবে এরমধ্যে নিচ থেকে কান্নার আওয়াজ শুনতে পায়। সে ছুটে নিচে নেমে আসে। মাশরাফিও আসে তার পিছন পিছন।

আমান খানের লাশটা বাড়িতে আনা হয়েছে। সায়রা নিজের স্বামীর লাশের সামনে বসে আর্তনাদ করে কাঁদছেন। আকাশ, আমিনা দুজনেও কাঁদতে কাঁদতে পাগলপ্রায়। নির্ঝর খান এবং আফিফা খানও নিজেদের ছেলের দূর্ঘটনার খবর শুনে ছুটে এসেছেন সিলেট থেকে। হুইলচেয়ারে বসে কান্নায় ভেঙে পড়েছেন নির্ঝর খান। আফিফা খানও এই বয়সে নিজের প্রিয় ছেলেকে হারিয়ে ভেঙে পড়ে আহাজারি করে বলছেন,”তুমি আমার ছেলেকে কেন কেড়ে নিলে আল্লাহ? আমার জীবনটাই নিয়ে নিতে।”
আরহাম ও আরুশি তাদের সামলানোর চেষ্টা করছে। জাঈদও এককোণায় অশ্রুসিক্ত দাঁড়িয়ে আছে। তার কঠিন মনেও আজ কান্নার রোল উঠেছে। আরহা এসব দেখে মাশরাফিকে বলে,”এই সবকিছুর জন্য আমি দায়ী তাই না মাশরাফি ভাইয়া? সবার এত কষ্টের কারণ আমি। আমি এখনই সবাইকে সব সত্যটা বলে দেব। তারপর আমায় ওরা যা শাস্তি দেবে তাই আমি মাথা পেতে মেনে নেব।”

“নাহ, আরহা। আবেগের বশে এমন বোকামো করো না।”
সায়রা কাঁদতে কাঁদতে পাগলপ্রায়। আরহা মাশরাফির থেকে হাত ছাড়িয়ে তার পাশে গিয়ে বসে বলে,”চাচি..”
সায়রা আরহাকে জড়িয়ে ধরে বলেন,”তোমার চাচ্চুকে উঠতে বলো না আরহা! জানো, ও আমায় কথা দিয়েছিল যে আজ সন্ধ্যায় একসাথে মিলে আমাদের বিবাহবার্ষিকী উদযাপন করবো। তাহলে ও কেন এভাবে আমায় ছেড়ে চলে গেল? আমাকে দেয়া কথা কেন রাখল না।”
এগুলো বলতে বলতে সায়রা জ্ঞান হারালেন। আরহা তাকে সামলাতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। এসবের মাঝে সে আর কাউকে কিছু জানাতে পারল না।

১ সপ্তাহ পর,
খান পরিবারে শোকের আমেজ এখনো কাটেনি। বরং পুরো খান পরিবার যেন শোকে ডুবে আছে। পুরো বাড়িজুড়ে এক অবাক নিস্তব্ধতা। সায়রা পুরোপুরি শয্যাশায়ী হয়ে পড়েছেন। নির্ঝর খান এবং আফিফা খানও পুত্রশোকে পাগল। আমিনা ও আকাশের মুখের দিকে তো তাকানোও যাচ্ছে না। আরহামও নিজের ভাইয়ের জন্য শোক পালন করছে। চোখের সামনে নিজের পরিবারকে এভাবে ভেঙে পড়তে দেখে আরুশি দীর্ঘ শ্বাস ফেলে।
জাঈদকে ডেকে তিনি বলেন,”এভাবে শোকে ডুবে থাকলে আমাদের চলবে না জাঈদ। এই শোক থেকে আমাদের বেরিয়ে আসতেই হবে।”

“কিন্তু আমরা কিভাবে এই শোক থেকে বের হবো মাম্মা?”
আরুশি বলেন,”জানি না..কিন্তু কোন একটা উপায় বের করতেই হবে।”
আরহা চুপচাপ নিজের ঘরে বসে আছে। বিগত এক সপ্তাহ থেকে সে আত্মগ্লানি থেকে নিজেকে ঘরের চার দেয়ালে বন্দি করে রেখেছে। এক মুহুর্তের জন্যেও বাইরে যায় নি। আরুশি এসে তাকে তিন বেলার খাবার দিয়ে যায়। আরহার সামনে বারবার ঐ দৃশ্যটা ভেসে ওঠে। সে এক দণ্ডও শান্তি পায় না। এরমধ্যে রিয়াশা আরহার রুমে প্রবেশ করে বলে,”আরহা..”

আরহা বলে,”আমাকে একা থাকতে দে। চলে যা প্লিজ..”
রিয়াশা এগিয়ে এসে বলে,”আর কতদিন এভাবে একা থাকবি আরহা? এবার তো একটু স্বাভাবিক হ। আমি বুঝতে পারছি তোর চাচ্চুর মৃত্যুর শোকটা হয়তো একটু বেশিই কিন্তু..”
এরমাঝে রিয়াশার ফোন বেজে ওঠে। মাশরাফি কল দিয়েছে। রিয়াশা ফোনটা রিসিভ করে কিছুক্ষণ কথা বলার পর আরহার দিকে ফোনটা বাড়িয়ে দিয়ে বলে,”এই নে, ভাইয়া তোর সাথে কথা বলবে।”
আরহাকে ফোনটা দিয়েই রিয়াশা বাইরে বেরিয়ে যায়। কারণ মাশরাফি একান্তে আরহার সাথে কথা বলতে চেয়েছে। রিয়াশা এতদিনে আরহার প্রতি মাশরাফির অনুভূতি কিছুটা উপলব্ধি করেছে। তাই সেও বেশি ভাবলো না।
এদিকে মাশরাফি আরহাকে বলে,”তুমি কেন এখনো স্বাভাবিক জীবনে ফিরছ না আরহা?”

“স্বাভাবিক জীবনে ফেরা কি এতটাই সহজ?”
“কঠিনও নয়। তুমি নিজেই ব্যাপারটাকে কঠিন করছ।”
“আমি নিজের কাছে অপরাধী হয়ে গেছি। প্রতি মুহুর্তে এই গিল্ট আমায় ধুকে ধুকে খাচ্ছে।”
“নিজেকে বোঝাও যে তুমি কোন অপরাধ করো নি। এটা একটা দূর্ঘটনা যা যেকারো ক্ষেত্রে ঘটতে পারে।”
“কিন্তু?”
“কোন কিন্তু নয়। আমি তোমাকে আগের মতো স্বাভাবিক দেখতে চাই আরহা।”
মাশরাফির কথায় যেন আরহা আরো একটু ভরসা পায়।

আরো ১ সপ্তাহ পর,
নির্ঝর খান এবং আফিফা খান বাড়ির সবাইকে আজ একসাথে ডেকে পাঠিয়েছেন। সবাই একসাথে জড়ো হয়ে বসে আছে। আরহা সবার মাঝে থেকেও চোখ নামিয়ে বসে আছে। যদিও সত্যটা এখনো কেউ জানে না কিন্তু তবুও আরহা আজকাল কারো সাথে নজর মেলাতে পারে না।
নির্ঝর খান হঠাৎ গলা খাকারি দিয়ে বলেন,”আমি জানি এখন এসব কথা বলার সময় নয়৷ আমি তোমাদের শোকটা বুঝি। আমিও নিজের ছেলেকে হারিয়েছি। তবে..নিজের ছেলের শেষ ইচ্ছার কথা জানানোর জন্যই তোমাদের এখানে ডাকা।”

আরহাম জিজ্ঞেস করে,”কি শেষ ইচ্ছা ড্যাড?”
সায়রা বলে ওঠে,”আমি বলি..এই বিষয়টা নিয়ে আমান নিজের শেষ দিনগুলোয় আমাকে বলছিল। আমান নিজের মৃত্যুর আগের দিন রাতেও আমায় বলেছিল ও চায় জাঈদ ও আমিনার বিয়ে দিতে। গতকাল রাতে আমার স্বপ্নে এসেও ও এই কথা বলেছে। তাই আমি আর সময় নষ্ট না করে মামা-মামিকে সবটা জানালাম। তাই ওনারা সবাইকে এখানে ডেকে পাঠিয়েছেন।”

অশ্রুজলে বোনা বিয়ে সিজন ৩ পর্ব ৬০

আফিফা খান কান্নারত স্বরে বলেন,”আমার ছেলেকে তো আমি হারিয়েছি কিন্তু তার শেষ ইচ্ছাকে অপূর্ণ থাকতে দিতে চাই না। আশা করি, এই সিদ্ধান্তে তোমাদের কারো কোন আপত্তি নেই।”
জাঈদ আমিনার দিকে তাকায়। চঞ্চল মেয়েট বাবাকে হারানোর পর থেকে শান্ত। অথচ মেয়েটার চঞ্চলতাকে মিস করছে সে। সায়রা নিজের মেয়েকে বলেন,”আশা করি তুমি নিজের বাবার শেষ ইচ্ছাকে সম্মান করবে।”
আমিনা বলে,”আমার এই সিদ্ধান্তে কো আপত্তি নেই!”

অশ্রুজলে বোনা বিয়ে সিজন ৩ পর্ব ৬২