অশ্রুজলে বোনা বিয়ে সিজন ৩ পর্ব ৬২
ইয়াসমিন খন্দকার
আমিনার কথাটা শুনে জাঈদ অবাক চোখে তার দিকে তাকায়। আমিনাকে দেখে মনে হচ্ছে তার মনে কোন সংশয় নেই। সে শুধু নিজের বাবার শেষ ইচ্ছা পূরণ করতে চায়। সায়রা নিজের মেয়ের সম্মতিতে খুশি হয়ে বলেন,”যাক, অনেকটাই নিশ্চিত হলাম। জাঈদ, তোমার কোন সমস্যা নেই তো?”
জাঈদ কোন ভনিতা ছাড়াই বলল,”নাহ, আমারো আমিনাকে বিয়ে করতে কোন অসুবিধা নেই।”
আফিফা খান স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বললেন,”যেহেতু পাত্র-পাত্রী দুজনেই এই বিয়েতে রাজি তাহলে আমাদেরও আপত্তির অবকাশ নেই। আশা করি, এই বিয়ের মাধ্যমে আমরা নিজেদের শোক কাটিয়ে উঠতে অনেক অংশে সফল হবো।”
সবাই একইসাথে স্বস্তি পায়। আরহাম এগিয়ে এসে জাঈদের কাধে হাত বুলিয়ে বলেন,”আশা করি, তুমি সবদিক ভেবেই এই বিয়েতে রাজি হয়েছ। আমিনা এই কয়েক দিনে অনেক গুটিয়ে গেছে। ওকে আবার স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনতে হবে তোমায়। এই দায়িত্ব আমি তোমার কাধে তুলে দিচ্ছি।”
জাঈদ নিজের বাবাকে আশ্বাস দিয়ে বলে,”তুমি কিছু চিন্তা করো না পাপা। আমিনাকে আমি আবার আগের মতো চঞ্চল ও হাসিখুশি জীবনে ফিরিয়ে আনবো।”
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
বলেই সে আমিনার দিকে তাকায়। আমিনাও তখন জাঈদের দিকে তাকায়। দুজনের চোখাচোখি হয়।
এদিকে আকাশ এই ব্যাপারটা নিয়ে কিছুটা আগ্রহ দেখায়। তার বাবার মৃত্যুর শোক এখনো বজায় থাকলেও নিজের বোনের বিয়ের কথা তার মনে আশার সঞ্চার করে। আকাশ বলে ওঠে,”আপু, আমার বিশ্বাস এই বিয়েতে তুমি আর জাঈদ ভাই অনেক খুশি হবে।”
আমিনা নিজের ভাইকে উদ্দ্যেশ্য করে বলে,”তাই যেন হয় ভাইয়ু!”
আরহা তখনো আত্মগ্লানিতে ভুগছিল। তবে এসব কথায় সে কিছুটা স্বস্তি খুঁজে পায় এটা ভেবে যে, বিয়ের পর হয়তো বাড়ির পরিস্থিতি আবার স্বাভাবিক হবে৷ তখন সে ধীরে সুস্থে সবাইকে সমস্ত সত্যটা বুঝিয়ে বলতে পারবে।
কয়েক দিন পর,
পুরো বাড়ি আজ সেজে উঠেছে বিয়ের সাজে। আজ জাঈদ ও আমিনার বিয়ে। বেশ ধুমধাম ভাবেই বিয়ে অনুষ্ঠিত হচ্ছে। বর্তমানে চলছে গায়ে হলুদের প্রস্তুতি। মাশরাফি ও রিয়াশাও এসেছে এই অনুষ্ঠানে। মাশরাফি এসেই আরহার সাথে কথা বলার সুযোগ খুঁজে বেড়াচ্ছে। আরহা আজও অন্যান্য দিনের মতো চুপচাপ সময় কাটাচ্ছে। এককোণে মলিন মুখে দাঁড়িয়ে সে। মাশরাফি আরহার পাশে এসে বলে,”তোমাকে এভাবে দেখতেই একদম ভালো লাগছে না আরহা। আজ তোমার বড় ভাইয়ের বিয়ে। তোমার তো আনন্দ করার কথা।”
আরহা মলিন স্বরে বলে,”সবার দুঃখের কারণ হয়ে আমি কিভাবে আনন্দ করি মাশরাফি ভাইয়া?”
“তুমি কেন এখনো ঐ ঘটনা থেকে বেরিয়ে আসতে পারছ না আরহা? যা হয়েছে তা কেবল একটা দূর্ঘটনা।”
“আমার পক্ষে এটা এত সহজ নয়। আমার প্রতিনিয়ত নিজেকে একজন..একজন খু*নি মনে হয়।”
মাশরাফি দীর্ঘ শ্বাস ফেলে বলে,”এসব ভাবনা আর নিজের মনে আসতে দিও না। স্বাভাবিক হবার চেষ্টা করো। আমি চাই, তুমি এই গিলটিনেস থেকে বেরিয়ে এসে একটা নতুন জীবন শুরু করো। সামনে তোমার এইচএসসি পরীক্ষা এখন যদি তুমি এই শোক থেকে বেরিয়ে না আসো তাহলে তোমার পড়ালেখার উপর খারাপ প্রভাব পড়বে। তোমার ডাক্তার হবার স্বপ্ন তো পূরণ করতে হবে তাইনা? মনে করো, তোমার চাচ্চুও চাইত তুমি একজন ভালো ডাক্তার হও।”
আরহা মনে করে আমান খান কিভাবে তাকে সবসময় অনুপ্রাণিত করত ডাক্তার হতে। সে নিজের চোখের জল মুছে বলে,”আপনি ঠিক বলেছেন। আমাকে এই শোক কাটিয়ে উঠতে হবে।”
অতঃপর সে এগিয়ে গিয়ে আমিনার গায়ে হলুদ মাখায়। আমিনার মুখটা এখনো গম্ভীর। আরহা তার গায়ে হলুদ দিয়ে বলে,”আশা করি, আমার ব্রো তোমার এই কষ্টগুলোর উপশম হতে পারবে।”
এদিকে রিয়াশার সাথে হঠাৎ করে আকাশের মুখোমুখি দেখা হয়ে যায়। আকাশ রিয়াশাকে দেখেই তাকে পাশ কাটিয়ে যেতে চায় এমন সময় রিয়াশা বলে ওঠে,”আকাশ..আমি দুঃখিত।”
আকাশ থেমে গিয়ে বলে,”কিসের জন্য? ”
“সেদিন আমায় তোমার ওসব কথা বলা ঠিক হয় নি। আমি বুঝতেও পারিনি যে আঙ্কেল..পরবর্তীতে সবটা জানার পর ভীষণ গিলটি ফিল হয়েছে।”
“যা হবার হয়ে গেছে। এখন এসব কথা বলে কি হবে?”
“আমি জানি, এখন এসব কথা বলার কোন মানে হয় না কিন্তু তবুও…নিজের মনের কোণে জমে থাকা অপরাধবোধ দূর করতেই আমি এসব বলছি। যাইহোক, তুমি পারলে আমায় ক্ষমা করে দিও।”
“মিমের ব্যাপারে কিছু জানো তুমি রিয়াশা? ও এখন কেমন আছে?”
রিয়াশা দীর্ঘ শ্বাস ফেলে বলে,”মিমের বিয়ে হয়ে গেছে ওর থেকে দ্বিগুণ বয়সী এক ব্যক্তির স্বামী। বিয়ের পর আর ওর সাথে আমার কোন যোগাযোগ হয় নি। জানি না ও কেমন আছে। আন্টির কাছে যতটা শুনেছি খুব একটা ভালো হয় তো নেই।”
আকাশের মনটা বিষাদময় হয়ে যায়। সে বলে,”হয়তো মিম এবং আমার একসাথে পথচলাটা ভাগ্যে ছিল না। আমি চাইবো, মিম ওর জীবনের সব কালো মেঘ কাটিয়ে উঠে সুখের দেখা পাক।”
রিয়াশা বলে,”তুমিও জীবনে মুভ অন করো আকাশ। তোমার বাবার স্বপ্নগুলো পূরণ করো। এসব রঙিন নেশায় আর নিজের সময় নষ্ট করো না।”
“তোমার পরামর্শের জন্য ধন্যবাদ।”
বলেই আকাশ চলে যায়।
আমিনা ও জাঈদের বিয়ে সম্পন্ন হলো। কবুল বলার সময় যদিও আমিনা নিজের বাবার কথা ভেবে কান্না করে দিয়েছিল। আমিনার মনে হয়েছিল আজ তার বাবা এখানে থাকলে তাকে সঙ্গ দিতে পারত৷ কিন্তু ভাগ্যের নির্মম পরিহাসে আজ তার বাবা তার পাশে নেই। আরহাম এগিয়ে এসে আমিনার মাথায় হাত বুলিয়ে বলে,”চিন্তা করো না আমিনা। আমি তো আছি। এখন থেকে আমিই তোমার অভিভাবক। ~~~~~~~~~ের যায়গা হয়তো আমি কখনো নিতে পারব না কিন্তু চেষ্টা করব একজন ভালো বাবা হবার।”
সায়রাও জাঈদের হাত ধরে কান্না করে বলে,”আমার আমিনাকে তুমি দেখে রেখো জাঈদ। আমার হাসিখুশি মেয়েটা হঠাৎ যেন কোথায় হারিয়ে গেল। তুমি ওকে আবার আগের হাসিখুশি জীবনে ফিরিয়ে এনো। এটাই অনুরোধ থাকবে।”
কিছু সময় পর তাদের বাসর ঘরে পাঠানো হয়। আমিনা তখনো কাঁদছিল। জাঈদ এসে আমিনার পাশে তার চোখের জল মুছে দিয়ে বলে,”অনেক কেঁদে নিয়েছ পাকা বুড়ি আর না..আমি তোমার মুখের সেই হারানো চঞ্চলতা ও খুশি দেখতে চাই।”
আমিনা জাঈদের দিকে তাকায়। জাঈদ হেসে বলে,”আবারো আমাকে জেদি ছেলে বলে ডাকো তো।”
আমিনা চুপ ছিল।
“কি হলো?”
“জে…জেদি ছেলে..”
“গুড। এবার একটু হাসো।”
আমিনা হাসার চেষ্টা করো। জাঈদ সহসা আমিনাকে নিজের বুকে জড়িয়ে নিয়ে বলল,”তোমাকে খুশি রাখার দায়িত্ব আমি নিয়েছিলাম আমিনা। আর সেই দায়িত্ব আমি যেকোন মূল্যেই পূরণ করব। আজ থেকে তোমার সুখের দিন শুরু।”
আমিনা বলে,”আর কখনো আমায় অপমান করবে না তো? কখনো বলবে না তো যে আমি তোমার বউ হিসেবে যোগ্য নই? তুমি বুয়েটিয়ান আর আমি..”
অশ্রুজলে বোনা বিয়ে সিজন ৩ পর্ব ৬১
“আমার মতো জেদি ছেলের ভাগ্যে তোমার থেকে ভালো কেউ জুটত না। অন্য কেউ হলে বাসর রাতেই তালাক দিয়ে ভাগত।”
আমিনা ফিক করে হাসে।
“এই হাসিটাই সবসময় দেখতে চাই তোমার মুখে।”
বলেই আমিনাকে কাছে টেনে তার কপালে কিস করে জাঈদ। এরপর ভালোবাসার স্পর্শে ভরিয়ে দেয় তাকে।