অশ্রুজলে বোনা বিয়ে সিজন ৩ পর্ব ৬৩

অশ্রুজলে বোনা বিয়ে সিজন ৩ পর্ব ৬৩
ইয়াসমিন খন্দকার

আমিনা ও জাঈদের বিয়ের পর দিন গুলো স্বাভাবিক ভাবে কেটে যায়। তাদের বিয়ের পর তাদের মধ্যকার দূরত্ব অনেকটাই ঘুচে যায়। আমিনাও বাবার মৃত্যুর শোক থেকে বেরিয়ে কিছুটা স্বাভাবিক হয়।
সবার জীবনে অনেক পরিবর্তন আসে। কিন্তু আরহা যেন তখনো অপরাধবোধ থেকে বেরিয়ে আসতে পারে না। তার এখনো মনে হয় যে, তার জন্যই তার চাচ্চু মারা গেছেন। এই জিনিসটা তাকে বিন্দুমাত্র শান্তিতে থাকতে দেয় না। এর মাঝে পেরিয়ে যায় এক মাস। এই এক মাসে পরিস্থিতি আরো অনেক বদল হয়।

আমানের মৃত্যুর শোক এখন অনেকটাই কাটিয়ে উঠেছে সবাই। শুধুমাত্র আরহা ছাড়া সবাই এখন স্বাভাবিক পরিস্থিতিতে আছে। আরহা আজ রিয়াশার সাথে স্কুল থেকে ফিরছিল। রিয়াশা যদিও কিছুই জানে না, আমানের মৃত্যুর ব্যাপারে, বলতে গেলে মাশরাফি ও আরহা ছাড়া এই ব্যাপারে আর কেউই কিছু জানে না। রিয়াশা আরহাকে অমনোযোগী দেখে বলে,”কি রে আরহা? তোকে এমন অন্যমনস্ক লাগছে কেন? কিছু দিন থেকেই দেখছি তোর অবস্থা এরকম। আমাকে সবটা খুলে বল তো।”

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

আরহা আমতাআমতা করে বলে,”কই তেমন কিছু না।”
“আমার কেন জানি মনে হচ্ছে, তুই কিছু একটা তো লুকাচ্ছিস৷ আমি তো তোর বান্ধবী। আমার থেকে কিছু লুকাস না। মন খুলে তোর সব কথা আমাকে জানাতে পারিস।”
“তেমন কিছু নেই।”
আলতো স্বরে বলে আরহা। এমন সময় হঠাৎ করে মাশরাফি তাদের সামনে বাইক এনে থামায়। মাশরাফিকে দেখেই রিয়াশা বলে ওঠে,”ভাইয়া তুমি!”
মাশরাফি আদেশের সুরে বলে,”তুই বাসা যা রিয়াশা। আমার আরহার সাথে কিছু জরুরি কথা আছে।”
রিয়াশা এখন মাশরাফি ও আরহার ব্যাপারটা নিয়ে অনেকটাই নিশ্চিত। তাই সে কোন প্রশ্ন না করে চুপচাপ চলে যায়। অতঃপর মাশরাফি নিজের বাইকে উঠে আরহাকে বলে,”বাইকে ওঠো।”
আরহা বলে,”আমায় বাসা যেতে হবে..”
“উঠো।”

অধিকারবোধ নিয়ে বলে মাশরাফি। তার আদেশের সুর শুনে আরহা একটু ইতস্তত করে। কিন্তু মাশরাফির চোখের দিকে তাকিয়ে সে আর না করতে পারে না। বাইকে উঠে বসে। মাশরাফি বাইক স্টার্ট করে কিছুক্ষণের মধ্যেই আরহাকে নিয়ে এক নিরিবিলি পার্কে এসে পৌঁছায়। আরহা কিছুটা অবাক হয়। মাশরাফি বাইক থামিয়ে আরহার দিকে তাকিয়ে মৃদু হেসে বলে,”চলো।”
পার্কের ভেতরে ঢুকে একটা ফাঁকা বেঞ্চে বসে মাশরাফি। আরহা কিছুটা দূরে দাঁড়িয়ে থাকে। মাশরাফি তাকে কাছে ইশারা করে। আরহা ধীরে ধীরে এগিয়ে এসে মাশরাফির পাশে বসে। কিছুক্ষণ নীরবতা বিরাজ করে। মাশরাফি আকাশের দিকে তাকিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে। তারপর আরহার দিকে তাকিয়ে নরম গলায় বলে,”আরহা, কেমন আছ তুমি?”

আরহা নিচু স্বরে জবাব দেয়,”ভালো।”
“মিথ্যে বলো না, আরহা। আমি জানি তুমি ভালো নেই। তোমার চোখ দেখে বোঝা যায়, তোমার মনে এখনো অনেক কষ্ট জমে আছে।”
মাশরাফির কথায় আরহা চুপ করে থাকে। সে মুখ তুলে তাকাতে পারে না। মাশরাফি তার হাতটা আলতো করে ধরে। আরহা চমকে ওঠে, কিন্তু হাতটা সরিয়ে নেয় না।
মাশরাফি বলে ওঠে,”আরহা, আর কতদিন এভাবে নিজেকে কষ্ট দিবে? আমান চাচ্চুর মৃত্যুটা একটা দুর্ঘটনা ছিল। তুমি এর জন্য কোনোভাবেই দায়ী নও। বিশ্বাস কর, চাচ্চুও হয়তো চাইতেন না তুমি এভাবে সারাজীবন কষ্ট পাও।”
মাশরাফির কথাগুলো আরহার কানে বাজতে থাকে। তার চোখ ছলছল করে ওঠে,”কিন্তু আমার জন্যই তো…”
আরহা বলতে গিয়ে থেমে যায়। তার গলা ধরে আসে।

মাশরাফি আরহার হাতটা আরও শক্ত করে ধরে বলে,”না আরহা, তোমার জন্য নয়। ওই টবটা যে তোমার হাতে লেগে পড়বে, সেটা তো তুমি জানতে না। এটা একটা দুর্ভাগ্যজনক ঘটনা। তুমি সেদিন চেষ্টা করেছিলি চাচ্চুকে বাঁচাতে। তোমার চেষ্টার কোনো ত্রুটি ছিল না। তুমি তো তাকে সরে যেতে বলেছিলে আমি শুনেছি। কিন্তু সবকিছু এত দ্রুত ঘটে গেছে যে কিছুই করার ছিল না.. তাহলে কেন নিজেকে দোষ দিচ্ছ?”
আরহা নিজেকে সামলাতে পারে না। তার চোখ থেকে জল গড়িয়ে পড়ে। সে বল,”আমার নিজেকে খুব অপরাধী মনে হয়, মাশরাফি ভাইয়া। আমি কিছুতেই এই অনুভূতিটা থেকে বের হতে পারছি না।”
মাশরাফি এবার আরহাকে কাছে টেনে নেয়। আরহার মাথাটা তার কাঁধে রেখে বলে,”আমি জানি, খুব কঠিন। কিন্তু তোমাকে এই কষ্ট থেকে বেরিয়ে আসতেই হবে। তুমি যদি এভাবে নিজেকে গুটিয়ে রাখো, তাহলে চাচ্চুর আত্মাও শান্তি পাবে না। তিনি তোমাকে হাসিখুশি দেখতে চাইতেন।”

আরহা চুপ করে মাশরাফির কাঁধে মাথা রেখে কাঁদতে থাকে। মাশরাফি তার মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়। কিছুক্ষণ পর আরহা কিছুটা শান্ত হয়। সে মাথা তুলে তাকায়। মাশরাফির চোখে স্নেহ আর ভালোবাসার মিশ্রণ দেখে আরহা অবাক হয়।
মাশরাফি আলতো করে আরহার মুখটা নিজের দিকে ঘুরিয়ে বলে,”আরহা, আমি তোমাকে অনেক ভালোবাসি। তোমার এই কষ্ট দেখে আমারও খুব কষ্ট হয়। আমি চাই তুমি সব ভুলে আবার আগের মতো হয়ে যাও। আমি তোমার পাশে আছি, সবসময় থাকব। তুমি একা নও।”

মাশরাফির কথাগুলো আরহার মনে এক অন্যরকম শান্তি এনে দেয়। এই প্রথম কেউ তাকে এত আপন করে, এত গভীর ভালোবাসা দিয়ে কথা বলল। তার বুকের ভেতরের ভারটা কিছুটা যেন হালকা হয়ে যায়। মাশরাফির চোখের দিকে তাকিয়ে আরহা প্রশান্তি অনুভব করে। এই মুহূর্তে তার মনে হয়, সত্যিই সে একা নয়। মাশরাফি তার পাশে আছে। আরহা মাশরাফির কাধে মাথা রাখে।
আরহা কিছু বলতে যাবে এমন সময় হঠাৎ করে হঠাৎ করে জাঈদ চিৎকার করে বলে ওঠে,”মাশরাফি!”

আরহা ও মাশরাফি দুজন দূরে সরে যায়। দুজনেই উঠে দাঁড়ায়। জাঈদের চোখে যেন আগুন জ্বলছে। আরহা তাকে কিছু বোঝাতে যাবে এমন সময় জাঈদ এগিয়ে এসে মাশরফিকে এলোপাতাড়ি ঘুষি মারতে শুরু করে। আরহা বাধা দিতে চায়। জাঈদ বলে,”তোর সাহস কিভাবে হলো আমার বোনের দিকে চোখ তুলে তাকানোর?”
আরহা বলে ওঠে,”ব্রো ছেড়ে যাও মাশরাফি ভাইয়াকে!”
জাঈদ আরহাকে ধাক্কা দিয়ে দূরে সরায়। এই ঘটনায় মাশরাফি রেগে গিয়ে মাশরাফির কলার ধরে বলে,”আমাকে যা করার কর কিন্তু আরহার সাথে এমন ব্যবহার আমি বরদাস্ত করব না।”

“আমার বোনের প্রতি তোর এত দরদ কেন?”
“কারণ আমি ভালোবাসি আরহাকে।”
“তোর সাহস কি করে হলো..”
“আমার সাহসের কিছু এখনো তুই দেখিস নি। আমি ও আরহা একে অপরকে ভালোবাসি৷ তাহলে তুই কেন কাবাবমে হাড্ডি হতে চাস? ”
জাঈদ বলে,”আমার বোন যদি রাস্তার একটি ভিখারিকেও ভালোবাসত তাও আমি মেনে নিতাম কিন্তু তোকে কখনোই না। আজ এটার একটা ফয়সালা হবে।”
মাশরাফি বলে,”বেশ আমিও দেখি কি করিস তুই।”

দুই বাড়ির মানুষের সামনে উপস্থিত আরহা, মাশরাফি ও জাঈদ। আরহাম বলে ওঠে,”কি হয়েছে জাঈদ? তুমি আমাদের সবাইকে আবার রাজীব ভাইদেরও ডেকে পাঠালে কেন এভাবে?”
জাঈদ মাশরাফির দিকে তাকিয়ে বলে,”তুই বলবি না আমি?”
রাজীব হাসান বলে ওঠেন,”কি হয়েছে জাঈদ? মাশরাফি কি কিছু করেছে?”
“অনেক বড় ভুল করেছে ও ভালো আঙ্কেল। ও আমার বোনের দিকে চোখ তুলে তাকানোর দুঃসাহস দেখিয়েছে।”
আরুশি বলে ওঠেন,”মানে?”

“ও আরহার সাথে প্রেম করছে মাম্মা।”
মাশরাফি এবার আরুশি ও আরহামের সামনে গিয়ে বলে,”আমি আপনাদের মেয়েকে ভালোবাসি, এটা যদি আমার দোষ হয় তাহলে আমাকে শাস্তি দিন।”
জাঈদ চিৎকার করে বলে ওঠে,”এটা অবশ্যই তোর দোষ। আমরা তোর ইতিহাস ভুলি নি, তোর মা মারিয়ার জন্য একসময় আমার মাকে কত কষ্ট, অপমান সহ্য করতে হয়েছে। ভালো আঙ্কেলকেও উনি ফাসিয়েছিল। এমন এক চরিত্রহীন মহিলার ছেলে কত ভালো হবে জানা আছে।”

অশ্রুজলে বোনা বিয়ে সিজন ৩ পর্ব ৬২

কথাটা শোনামাত্রই আরুশি এগিয়ে এসে ঠাস করে থাপ্পড় বসিয়ে দেয় জাঈদের গালে। জাঈদ অবাক স্বরে বলে,”মাম্মা! তুমি আমায় মারলে?”

অশ্রুজলে বোনা বিয়ে সিজন ৩ পর্ব ৬৪