অশ্রুজলে বোনা বিয়ে সিজন ৩ পর্ব ৭৪
ইয়াসমিন খন্দকার
আরহা হতবাক চোখে নিজের বাবার দিকে তাকিয়ে। মাশরাফিও আরহার দিকে তাকিয়ে ছিল। এমন সময় আরুশি চলে আসেন। তিনি এসেই বলেন,”কি বলেছিলাম তো এখানে এসে কোন লাভ নেই৷ এত অপমান সহ্য করতে হলো শুধু শুধু।”
আরহা আরুশিকে দেখেই তাকে গিয়ে জড়িয়ে ধরে। আরুশি নিজের মেয়েকে আগলে নিয়ে বলে,”তোমাকে আগেই বলেছি যাদের কাছে তোমার কোন মূল্য নেই সেখানে এসে কোন লাভ নেই৷ কিন্তু তুমি আমার কথা শুনলে না৷ এখন দেখলে তো এর ফল।”
আরহাম বলে ওঠেন,”নিজের মেয়েকে এখানে কেন পাঠিয়েছ তুমি? খুব তো ভাব দেখিয়ে বেরিয়ে গেলে। তাহলে এখন আবার এসব নাটকের মানে কি?”
“আমি ওদের বারণ করেছিলাম। কিন্তু ওদের বিবেকের জন্য ওরা ছুটে এসেছিল। তার ফল তো ওরা পেল।”
আরুশি আরহা ও মাশরাফিকে নিয়ে বেরিয়ে আসে। আর বলে,”আমার মেয়ের বিয়েতে তোমায়া আসতে হবে না আরহাম।”
এমন সময় জাঈদ বলে ওঠে,”আর কেউ না গেলেও আমি নিজের সিসের বিয়েতে যাব। আমাকে কেউ আটকাতে পারবে না।”
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
আফিফা খানও বলেন,”আমিও নিজের নাতনীর বিয়েতে যাব।”
সায়রা খান বলেন,”আমিও যাব আরহার বিয়েতে।”
আমিনা হতাশ স্বরে বলে,”আম্মু, তুমিও!”
“তোদের মতো আমি কাণ্ডজ্ঞানহীন হতে পারব না। আরহার বিয়েতে আমি যাবোই। আমাকে তোরা আটকাতে পারবি না।”
আকাশ বলে,”যার যাবার যাও আমরা আটকাবো না। মায়ের থেকে মাসির দরদ বেশি হলে তো কিছু করার নেই।”
আরুশি বলেন,”তোমাদের যার যার আসতে মন চায় তোমরা আসিও। আমি এখন নিজের মেয়েকে নিয়ে যাচ্ছি।”
বলেই তিনি আরহা ও মাশরাফিকে নিয়ে রওনা দেন।
কিছুদিন পর,
মাশরাফি ও আরহার বিয়ের আয়োজন পুরোদমে শুরু হয়েছে। আজকে রাতে তাদের বিয়ে। এখন বর্তমানে গায়ে হলুদের প্রস্তুতি চলছে। আরহা গায়ে হলুদের সাজে সেজে উঠেছে। তাকে দেখতে ভীষণ সুন্দর লাগছে। তবে আরহার মনে মোটেই আনন্দ নেই। কারণ তার এই খুশির দিনে তার পরিবারের সিংহভাগ মানুষ উপস্থিত নেই। আরুশি সবকিছু তদারকি করছেন। রিয়াশা এসে দাঁড়ায় আরহার পাশে৷ আরহার মন খারাপ টের পেয়ে তাকে জড়িয়ে ধরে বলে,”গায়ে হলুদের দিন এরকম মন খারাপ করে থাকিস না তো! একটা ছবিও ভালো আসবে না।”
আরহা অশ্রুসিক্ত নয়নে বলে,”তুই তো বলেছিলি রিয়ু..আমি মেডিকেলে চান্স পেলে আবার আমার পরিবার আমায় কাছে টেনে নেবে। সেটা কোথায় হলো? তারা তো আমায় এখনো পর করে রেখেছে। আর হয়তো কখনো আমায় কাছে টানবে না। ”
আরহার কন্ঠ ফোপাঁতে থাকে। একটু পর আরুশি এসে বলেন,”শোন, আরহা। যত কাঁদার এখন কেঁদে নাও। অনুষ্ঠানে তোমার কোন কান্না আমি দেখতে চাই না। যারা তোমার কথা ভাবে না, তাদের জন্য তুমি কেন কাঁদছ? কই আমিও তো পরিবার ছেড়ে এসেছি তোমার জন্য। আমি কি কাঁদছি?”
আরহা দীর্ঘ শ্বাস ফেলে বলে,”কিন্তু মাম্মা..”
“কোন কিন্তু নয়। গায়ে হলুদের প্রস্তুতি নাও। রিয়াশা, তুমি ওকে এই গাদা ফুলগুলো দিয়ে সাজিয়ে দাও তো। আর এই হলুদ শাড়িটাও পড়িয়ে দিও।”
রিয়াশা আরহাকে খুব সুন্দর করে সাজিয়ে দেয়। গায়ে হলুদের সাজে তাকে অনেক সুন্দর লাগছিল৷ আরহা নিজের মায়ের কথায় বুকে পাথর চাপা দিয়ে কান্না বন্ধ করে। এরপর অনুষ্ঠানস্থলে যায়। আরহার গায়ে হলুদের অনুষ্ঠান শুরু হয়। আরহা একটা মেকি হাসি মুখে আনে। হঠাৎ করে জাঈদ, আফিফা খান, সায়রা ও নির্ঝর খান সবাই চলে আসে। তাদের দেখে আরহা খুশি হয়ে বলে,”তোমরা এসেছ!”
আফিফা খান এগিয়ে এসে আরহার গালে হলুদ দিয়ে বলেন,”আজ আমার নাতনীর জীবনে এত স্পেশাল একটা দিন আর আমি না এসে পারি?”
নির্ঝর খানও এসেছেন। আফিফা খান হুইলচেয়ারে করে তাকে নিয়ে এসেছেন৷ তিনি বলেন,”আমিও এসেছি দিদিভাই। তোমাদের সবার সাথে আনন্দ করবো বলো।”
জাঈদ বলে,”আমার সিসের গায়ে হলুদে কোন ত্রুটি থাকতে দেব না। আমরা সবাই ভীষণ আনন্দ করব।”
সায়রা খান এগিয়ে এসে বলেন,”তোমার চাচ্চুর মৃত্যুর জন্য যে তুমি দায়ী নও এটা আমি মনেপ্রাণে বিশ্বাস করি। যা হয়েছে সেটা নিছকই একটা দূর্ঘটনা এটা যে কারো সাথে ঘটতে পারে। কিন্তু তোমার পাপা আর আমার ছেলে-মেয়ে তারা যেন এটা মানতেই চাইছে না। তারা নিজের জেদে অটল। যাইহোক, আজকে খুশির দিনে আমি আর এসব মনে করাতে চাই না৷ তুমি আনন্দ করো। আমরা সবাই তোমার এই আনন্দে অংশীদার হবো।”
একে একে সবাই আরহার গায়ে হলুদ মাখায়। আরহার জীবনে যে অতৃপ্তি ছিল তা যেন কিছুটা হলেও পূর্ণতা পায়।
মাশরাফির গায়ে হলুদের অনুষ্ঠানও চলমান ছিল। জাঈদ সেখানে উপস্থিত হয়। মাশরাফি জাঈদকে দেখে অবাক হয়। জাঈদ এগিয়ে এসে বলে,”আমি জানি, তুই আমাকে এখানে দেখে অবাক হচ্ছিস। কিন্তু সত্যি বলতে, আজ আমায় এখানে আসতেই হতো। ছোটবেলা থেকে আমি তোকে অকারণে হিংসা করেছি। তোর প্রতি ক্ষোভ প্রকাশ করেছি। অথচ সেই তুই আমার বোনকে বাঁচানোর জন্য নিজের জীবন, ক্যারিয়ার সব বাজি রাখলি। তোকে কৃতজ্ঞতা জানানো কিংবা ক্ষমা চাওয়ার কোন মুখ আমার নেই। শুধু তোর কাছে এটুকুই চাওয়া, এভাবেই আমার বোনকে আগলে রাখিস। আমি জানি, আমি ভাই হিসেবে, একজন ছেলে হিসেবে ব্যর্থ। না আমি নিজের বোনকে আগলে রাখতে পেরেছি না তো নিজের মাকে। তুই সব দায়িত্ব পালন করছিস। তোর কাছে ক্ষমা চাওয়ার মুখও আমার নেই। ক্ষমার যোগ্যও আমি না। তবুও আমি সব কিছুর জন্য তোর কাছে ক্ষমা চাইছি।”
মাশরাফি জাঈদের কাধে হাত রেখে বলে,”এতোটা অপরাধবোধ রাখিস না মনে। আমি তোর ব্যবহারে সেরকম কিছু মনে করি নি। তবে এতদিন যা করার করেছিস, এখন এর পুনরাবৃত্তি যেন না ঘটে। আমার জন্য আর নিজের বোনের জন্য দোয়া করিস। আর পারলে নিজের বাবা, স্ত্রীকে একটু বোঝাস, আরহার পরিস্থিতিটা। সবাইকে হারিয়ে ও এখন বড্ড অসহায়। এই মুহুর্তে ওকে তোদের অনেক বেশি দরকার।”
“আচ্ছা, আমি চেষ্টা করবো।”
এরপর জাঈদ মাশরাফির গায়ে হলুদ ছোয়ায়। এতে তাদের মধ্যে এতদিন ধরে জমা শত্রুতার বরফ যেন গলতে শুরু করে।
আরহাকে ঘিরে বসে আছে আফিফা খান, সায়রা ও আরুশি। তাদের সাথে সায়রাও আছে। সবাই মিলে গায়ে হলুদ সম্পন্ন করার পর একসাথে বসে গল্প করছে। আজকের দিনে নিজের অতীতের কথাগুলো মনে করলেন আফিফা খান। নিজের সাথে নির্ঝর খানের সংসার, নিজের বোন আরিশার কথা খুব মনে পড়ছে তার। আফিফা খান দীর্ঘ শ্বাস ফেলে বলেন,”আজ আমার বোনুটা বেঁচে থাকলে যে কি খুশি হতো! ওর নাতনীর বিয়ে আজ।”
নিজের মায়ের কথা শুনে আরুশিও আবেগপ্রবণ হয়ে পড়ে। চোখের জল মুছে বলেন,”আমিও আম্মুকে খুব মিস করছি বড় খালামনি। সাথে পাপাকেও।”
অশ্রুজলে বোনা বিয়ে সিজন ৩ পর্ব ৭৩
আরহা তার মাকে এভাবে আবেগপ্রবণ হতে দেখে নিজের অনুভূতি লুকায়। প্রত্যেক মেয়ের কাছে তার বাবা এক মস্ত আবেগের নাম। আরহার কাছেও তার বাবা আরহাম খান আবেগের নাম। অথচ বিয়ের মতো জীবনের এত বড় একটা অধ্যায়ে তার বাবা তার পাশে নেই। নিজের মনের দুঃখ আরহা কোনভাবেই প্রকাশ করতে পারছিল না। জাঈদ এলো একটু পর। সে এসেই বলল,”আমি জানি আরহা, তুমি হয়তো পাপাকে মিস করছ। কোন ব্যাপার না, আমি তোমার ব্রো তো আছি। আমি সবসময় তোমার পাশে থাকব। আমি থাকতে কোন কষ্ট তোমায় স্পর্শ করতে পারবে না।”
আরহা কিছুটা স্বস্তি পায় নিজের ভাইয়ের কথায়। জাঈদ আরো বলে,”এবার এই গোমড়া মুখ দূর হয় একটু হাসো। বিয়ের কনের মুখ গোমড়া মানায় না। আনন্দ করো, খুব আনন্দ করো।”