অশ্রুজলে বোনা বিয়ে সিজন ৩ পর্ব ৭৫

অশ্রুজলে বোনা বিয়ে সিজন ৩ পর্ব ৭৫
ইয়াসমিন খন্দকার

আরহা ও মাশরাফির বিয়ের আয়োজনে সেজে উঠেছে চারিদিক। উৎসবের আমেজ ছড়িয়ে যাচ্ছে সবার মনে। আরহাকে ঘিরে ধরেছে আরুশি, রিয়াশা, সায়রারা। এছাড়া তার আরো কিছু বান্ধবী। আরহা বিয়ে উপলক্ষে অনেক সুন্দর একটা লাল বেনারসি পড়েছে। তার রূপের জৌলুস যেন কয়েক গুণ বাড়িয়ে দিয়েছে এই বেনারসি। আরহাকে দেখে রিয়াশা প্রশংসা করে বলে,”তোকে আজ যা সুন্দর লাগছে না। আমি নিজে মেয়ে হয়ে তোর উপর ক্রাশ খেয়ে যাচ্ছি। ভাইয়ার যে কি হবে!”

তার কথা শুনে সবাই হেসে ফেলে। আরুশি মেয়ের কপালে চুমু দিয়ে বলেন,”আমার ছোট্ট মেয়েটা কখন এত বড় হয়ে গেল আমি বুঝতেও পারলাম না। সে এখন মেডিকেল স্টুডেন্ট। আজ থেকে একজন স্ত্রীও হয়ে যাবে! আজো আমার সেই দিনগুলো মনে পড়ে যখন তুমি হামাগুড়ি দিয়ে বেড়াতে। আমার শান্তশিষ্ট, লাজুক মেয়েটার আজ বিয়ে।”
“আমার জন্য দোয়া করো মাম্মা। পাপা তো নেই..এখন তুমিই আমার..”
“আজকের এই খুশির দিনে ঐ লোকটার কথা বলার দরকার নেই। তুমি নিজের বিয়েতে মন দাও।”
সায়রা দীর্ঘ শ্বাস ফেলে। তাদের সংসার এক মুহুর্তেই কেমন মলিন হয়ে গেল। সায়রা হারালেন তার স্বামী আমানকে। এদিকে আরহাম ও আরুশিও একে অপরের থেকে দূরে চলে গেলো। সায়রার চোখে জল চলে আসে এসব ভেবে৷ তবুও তিনি আরহার খুশির দিনে কাঁদতে চান না জন্য অনেক কষ্টে চোখের জল আড়াল করলেন।
কিছু সময় পর জাঈদ আসে। জাঈদ এসেই বলে,”বাহ, সিস বিয়ের সাজে প্রস্তুত?”

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

আরুশি মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ-বোধক ইশারা করে। জাঈদ বলে,”আমি এই মুহুর্তে দেখে আসলাম মাশরাফিও প্র‍স্তুত সাদা রঙের কারুকাজ করা শেরওয়ানি পড়ে। দুজনকে সত্যি অনেক সুন্দর মানাবে!”
আরহা লাজুক হাসে। জাঈদ সবার উদ্দ্যেশ্যে বলে,”আমি আমার সিসের সাথে একান্তে কিছু কথা বলতে চাই। খুব ভালো হয় যদি তোমরা আমাদের একটু স্পেস দাও।”
জাঈদকে আরহার সাথে কথা বলতে দেয়ার জন্য সবাই বেরিয়ে গেল। জাঈদ আরহার সামনে এসে বললো,”আমায় ক্ষমা করে দিও সিস। আমি তোমাকে দেয়া কথা রাখতে পারি নি। অনেক চেষ্টা করেও পাপাকে এখানে আসতে রাজি করাতে পারি নি।”

আরহা দীর্ঘ শ্বাস ফেলে। সেই জাঈদকে বলেছিল কোনভাবে আরহামকে রাজি করাতে যেন সে তার বিয়েতে আসে। আরহা তবুও হার মানতে রাজি না। সে বলে,”তুমি পাপার সাথে আমার একবার কথা বলার ব্যবস্থা করে দাও ব্রো। আমার বিশ্বাস, আমার সাথে কথা বললে পাপার মন গলবে।”
“এসবের কোন প্রয়োজন নেই আরহা। পাপা যদি আবার তোমাকে কথা শোনায় তাহলে বিয়ের দিন তোমার মন খারাপ হয়ে যাবে। আমি সেটা চাই না।”
“তুমি একবার কল করো প্লিজ। এটা আমার রিকোয়েস্ট।”
অগত্যা জাঈদ ফোন করে। আরহাম ফোনটা রিসিভ করে বলে,”কেন ফোন করেছ জাঈদ? আমি তো বলেই দিয়েছি, তোমাদের যার যার বিয়েতে যাবার যাও, আমাকে জোর করো না।”
ফোনটা স্পিকারে ছিল৷ তাই আরহা বলে ওঠে,”পাপা..”

আরহাম কোন প্রতিত্তোর করে না। আরহা বলে,”তুমি আমার উপর যতোই রাগ করে থাকো তুমি আমার পাপা। আমার বিয়েতে তুমি থাকবে না সেটা কি করে হতে পারে?”
“জাঈদ, ঐ মেয়েটাকে বলে দাও, আমি ওকে আর নিজের মেয়ে ভাবি না। তাই ওর বিয়ে হোক বা ও যাইহোক আমার কিছু যায় না। এমনকি ও যদি মরেও যায় তবুও আমি ওকে দেখতে যাব না।”
“পাপা!”
আরহার গলা ধরে আসে। জাঈদ ফোনটা রেখে দেয়। আরহা ফ্লোরে বসে হাটুতে মুখ ঠেকিয়ে ফুপিয়ে কাঁদতে থাকে। জাঈদ আরহার পাশে বসে তাকে সান্ত্বনা দিয়ে বলে,”এভাবে কেঁদো না সিস। সব মেকআপ নষ্ট হয়ে যাবে। আজ তোমার খুশির দিন। এভাবে কাঁদলে লোকে কি বলবে?”
কিন্তু আরহা নিজের কান্না থামাতে পারে না।

“পাপা এটা কি বলল ব্রো? উনি কিভাবে আমার মৃত্যুকামনা করতে পারলেন? পাপারা কি এমন হয়?”
এমন সময় মাশরাফি সেখানে চলে এলো। আরহাকে এভাবে কাঁদতে দেখে তার আর কিছু বুঝতে বাকি থাকল না। মাশরাফির চোয়াল শক্ত হলো। সে হাত মুষ্টিবদ্ধ করে সামনে এগিয়ে এসে জাঈদকে বলল,”তোর বাবাকে ফোন কর, ওনার সাথে আমি কথা বলব।”
জাঈদ বলে,”শুধু শুধু ঝামেলা বাড়িয়ে কি লাভ?”
“যা বলছি তাই কর।”

জাঈদ আবার আরহামকে ফোন করে। মাশরাফি ফোনটা নেয়। আরহাম ফোন রিসিভ করে বলে,”আবার কেন ফোন করেছ? ঐ মেয়েকে বলে দাও, আমি যাব না।”
মাশরাফি বলে,”আপনাকে আসতেও হবে না। যেই বাবার জন্য তার মেয়েকে নিজের বিয়ের দিন কাঁদতে হয় তার তো বাবা হবারই কোন যোগ্যতা নেই। এমন বাবাকে বিয়েতেও থাকতে হবে না। আর একটা কথা সবসময় মনে রাখবেন, আজ নিজের মেয়েকে আপনি যতটা কষ্ট দিচ্ছেন এর থেকে কয়েক গুণ বেশি কষ্ট আপনি ফিরে পাবেন। একসময় নিজের স্ত্রী-সন্তানকে কাছে পাওয়ার জন্য আপনাকে আফসোস করতে হবে। কিন্তু তাদের সান্নিধ্য আপনি পাবেন না।”

বলেই আরহামকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে সে ফোন রেখে দেয়। এরপর আরহাকে টেনে তুলে তার দিকে টিস্যু বাড়িয়ে দিয়ে বলে,”নিজের চোখের জল মুছে নাও, আরহা। তোমার এই চোখের জল অনেক দামি। যার তার জন্য এটা নষ্ট করো না। আজকের এই কান্নাই যেন তোমার শেষ কান্না হয়। আজকের পর, আমি তোমায় আর কখনো কাঁদতে দেখতে চাই না।”
আরহা কাপা কাপা হাতে টিস্যু নিয়ে চোখের জল মুছে। মাশরাফি বলে,”গুড গার্ল।”
জাঈদ মাশরাফিকে তার বোনের জন্য এত যত্নশীল হতে দেখে খুব খুশি হয়। সে নিশ্চিত হয় যে তার বোন অনেক সুখী হবে। তাই তো মাশরাফির হাত ধরে বলে,”আমার বোনটাকে এভাবেই সবসময় আগলে রাখিস। কোন কষ্ট যেন ওকে কখনো স্পর্শ করতে না পারে।”

মাশরাফি ও আরহা দুজনেই বিয়ের আসরে উপস্থিত। দুজনের দৃষ্টি একে অপরের দিকে নিবদ্ধ। কাজি সাহেব বিয়ের সমস্ত কার্যক্রম শুরু করেন। মাশরাফি ও আরহা দুজনেই হাসিমুখে ছিল। আরহা মাশরাফির কথাই মেনেছে। নিজের কষ্ট লুকিয়ে হাসছে সে। একটু পর কাজি সাহেবের আদেশে আলতো স্বরে, “কবুল” বলার মাধ্যমে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হলো দুজন মানুষ। তাদের ভালোবাসা যেন পূর্ণতা পেল। পূর্ণতার আনন্দ যেন আরো বেশি। সেই আনন্দই ছেয়ে গেল আরহা ও মাশরাফিকে।
বিয়ে সম্পন্ন হতেই রাজীব, মিসেস রুমি, আরুশি সবাই মিষ্টিমুখ করলেন। আরহা ও মাশরাফি বাড়ির সব বড়দের কাছে দোয়া নিতে গেল।
প্রথমেই তারা গেল নির্ঝর খানের কাছে। নির্ঝর খান হুইলচেয়ারে বসে ছিলেন। তিনি প্রাণভরে দোয়া করে বলেন,”খুশি হও, সবসময় একে অপরের সাথে থেকো।”

এরপর একে একে আফিফা খান, সায়রা, আরুশি, রাজীব হাসান, রুমি সবাই তাদের দোয়া করেন। নির্ঝর খান আফিফা খানের কাছে নিজের দুঃখ প্রকাশ করে বলেন,”আমার ছেলেটা একদম আমার মতোই হয়েছে তাই না, আফিফা? কিন্তু আমার ভুলের পুনরাবৃত্তি ও কিভাবে করতে পারল? ও কি দেখে নি কিভাবে আমার ভুলের জন্য ওর আর আরুশির জীবনটা এলোমেলো হয়ে গেছিল। আজ আবার ও একই ভুল করে আরহা দিদিভাই আর আরুশিকে এভাবে দূরে সরিয়ে দিল। আরহা দিদিভাই এর বিয়েতেও এলো না। এতটা দম্ভ ওর।”

অশ্রুজলে বোনা বিয়ে সিজন ৩ পর্ব ৭৪

আফিফা খানও দীর্ঘ শ্বাস ফেলে বলেন,”তুমি নিজের নাতনী আরহার কথা ভাবছ। আরহাকে সামলানোর জন্য মাশরাফি, আরুশি সহ আমরা সবাই আছি। কিন্তু আমার তো আরুর জন্য ভীষণ খারাপ লাগে। মেয়েটা জীবনের সেই শুরু থেকে শুধু কষ্টই পেয়ে যাচ্ছে। নিজের মা-বাবাকে হারানো, প্রথম প্রেগ্যান্সির সময় একা কষ্ট পাওয়া আর আজ এই মধ্যবয়সে এসেও কষ্ট ওর পিছু ছাড়ছে না। মেয়েটা জনমদুখিনীই থেকে গেল। আমার এখন মনে হয়, আরুর সাথে আরহামের বিয়েটা মেনে নেয়া আমার ঠিক হয়নি। ওদের আলাদা থাকাই উচিৎ ছিল৷ তাহলে মেয়েটা একটু সুখী হতে পারব। জানিনা, মৃত্যুর পর আমি বোনুকে কিভাবে নিজের মুখ দেখাব।”

অশ্রুজলে বোনা বিয়ে সিজন ৩ পর্ব ৭৬