অশ্রুজলে বোনা বিয়ে সিজন ৩ পর্ব ৭৯
ইয়াসমিন খন্দকার
আমিনা জাঈদের কোল থেকে নিজের ছেলেকে নিয়ে তাকে বুকের সাথে জড়িয়ে ধরে। জাঈদ বিরক্তির চোখে তাকায়। আমিনা স্পষ্ট করে বলে দেয়,”আমি থাকতে আমার বাবুর দেখ ভালের জন্য কোন আয়া লাগবে না৷ তুমি ওকে চলে যেতে বলো।”
জাঈদ বলে,”আমি যা করছি আমার ছেলের ভালোর জন্য করছি। তোমার কথা আমি মানব না।”
“তোমায় আমার কথা মানতে হবে। কারণ আমি আমার বাবুর মা। আর একজন সন্তানের উপর সবথেকে বেশি অধিকার তার মায়ের।”
জাঈদ দীর্ঘ শ্বাস ফেলে বলে,”তার মানে এই বিষয়েও তুমি নিজের জেদ বজায় রাখবে তাই তো? সবকিছুতে তোমার এত জেদ! তোমার এই জেদের জন্য আমার মা-বোন আজ এ বাড়িতে নেই। এখন তুমি আবারো সেই জেদ দেখাচ্ছ। ঠিক আছে কিন্তু একটা কথা মনে রেখো, তোমার এই জেদের জন্য যদি আমার ছেলের কোন ক্ষতি হয়, তাহলে আমার থেকে খারাপ আর কেউ হবে না। তোমার আমার সম্পর্ক শুধু আমাদের সন্তানের কারণেই কিন্তু টিকে আছে।”
বলেই জাঈদ চলে যায়। আমিনা জাঈদের পিছন পিছন রুমে যায়। তার কোলে তাদের ছেলে। আমিনা জাঈদের উদ্দ্যেশ্যে বলে,”আমার সাথে এমন করছ কেন জাঈদ? তুমি তো আমায় ভালোবাসতে, কত যত্ন করতে আমার। আমি আমার আগের জেদি ছেলেটাকে খুব মিস করছি। তুমি আবার আগের মতো হয়ে যাও না।”
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
জাঈদ রাগী স্বরে বলে,”তোমার এসব ন্যাকামো আমার একদম ভালো লাগছে না। এত কিছুর পরেও তুমি চাইছ আমি তোমার সাথে স্বাভাবিক হই! আচ্ছা, হবো। তার আগে তুমি আমার মা-বোনকে আবার ফিরিয়ে আনো। আমাদের পরিবারটকে আবার আগের মতো করে দাও।”
“বড় আম্মুকে নিয়ে আমার কোন সমস্যা নেই। আমি ওনাকে ফিরতেও বলেছি কিন্তু..”
“কিন্তু কি? তোমার সমস্যা আরহাকে নিয়ে তাই তো? তুমি কেন বুঝতে চাইছ না যে একটা এক্সিডেন্ট।”
“আমি জানি এটা একটা এক্সিডেন্ট। কিন্তু এক্সিডেন্ট হলেও এটা তো অস্বীকার করতে পারবে না যে, আরহার জন্য আমার আব্বু মারা গেছে। তার থেকে বড় কথা আরহা দিনের পর দিন আমাদের থেকে এই সত্যটা আড়াল করেছে। আমার যায়গায় একবার নিজেকে বসিয়ে দেখো তো আপনার কেমন লাগতো। খুব সহজে কি সবটা মানতে পারতে তুমি?”
“তোমার সাথে কথা বলাই বেকার। এখন আমার ছেলেকে আমাকে দিয়ে চলে যাও। তোমার এসব ফালতু কথা শুনে ছেলে ভয় পাচ্ছে।”
বলেই জাঈদ তাদের ছেলেকে কোলে নেয়।
আরহা, মাশরাফি আজ একসাথে ঘুরেছে, একসাথে খেয়েছে। সারাটা দিন আনন্দের সহিত কাটিয়ে এখন তারা বাড়িতে ফিরল। তাদের ফিরতে দেখেই রিয়াশা আনন্দের সহিত এগিয়ে এসে বলল,”ভাইয়া, কাল আমার এক্সাম, তুমি আমায় নিয়ে যাবে তো? আর আরহা তোকেও কিন্তু আমার পাশে থাকতে হবে। তাহলে আমি ভরসা পাবো।”
আরহা বলে,”অবশ্যই থাকব।”
তবে আরহার মুখটা মলিন ছিল। মাশরাফি সেটা বুঝতে পেরে ফোন বের করে জাঈদকে কল দেয়। কিছুক্ষণ পর জাঈদ ফোনটা রিসিভ করলে আড়ালে গিয়ে তার সাথে কিছু কথা বলে। কথা শেষ হতেই ফোনটা আরহার হাতে দিয়ে বলে,”নাও, তোমার ব্রো কথা বলবে।”
আরহা ফোনটা হাতে নিয়ে বলে,”হ্যালো ব্রো..তুমি কেমন আছ? আর আমাদের পুচকে সোনা কেমন আছে? আমিনা আপু ভালো আছে তো?”
“সবাই খুব ভালো আছি আমরা। তুমি তোমার খবর বলো সিস, নতুন সংসার কেমন কাটছে?”
“খুব ভালো।”
“যাক, নিশ্চিত হলাম। তুমি আমার ছেলের সাথে দেখা করতে চাও?”
আরহা মাথা নাড়ায়।
“বেশ, কাল চলে এসো মাশরাফির সাথে। আমি তোমাদের দেখা করার ব্যবস্থা করে দেব।”
“ধন্যবাদ ব্রো।”
“আরে ধন্যবাদের কি আছে? তুমি ওর ফুফুমনি হও তোমার অধিকার আছে ওর উপর।”
আরহা খুব খুশি হয়। তার মন প্রফুল্ল চিত্তে নেচে ওঠে।
আমিনা তার ছেলেকে কোলে নিয়ে বুকের সাথে জড়িয়ে রেখেছিল। ছেলেটার শরীর ভালো নেই৷ কাল ওকে আবার টিকা দিতে নিয়ে যেতে হবে। এমন সময় জাঈদ ফিরলো অফিস থেকে। সে এসেই আমিনাকে দেখে বললো,”বাবু কেমন আছে..দেখি ওকে আমার কোলে দাও তো।”
জাঈদ তাদের ছেলেকে কোলে নিতেই বুঝতে পায় ছেলের জ্বর এসেছে। সে দ্রুত ছেলেকে কোলে নিয়ে বলে,”বাবুর শরীর তো জ্বরে পুড়ে যাচ্ছে,,,তুমি আমাকে জানাও নি কেন?”
আমিনা বলে,”আম্মু বলল যে ছোট বাচ্চার এমন জ্বর আসা স্বাভাবিক। আমি ঘরোয়া কিছু টোটকা চেষ্টা করেছি।”
“চুপ! একদম চুপ! তোমার ভরসায় ছেলেকে রেখে অফিস যাওয়াই আমার উচিৎ হয় নি। তোমার জন্যই আমার ছেলে অসুস্থ হয়েছে।”
“এসব তুমি কি বলছ জাঈদ? আমার জন্য..”
“তুমি একটা অপয়া। তোমার সংস্পর্শে যা থাকবে তাই এমন হবে। তোমার সাথে বিয়ের পর যেভাবে তুমি আমার জীবনটা নষ্ট করছ সেভাবেই আমার ছেলের জীবনটা নষ্ট করতে উঠেপড়ে লেগেছ।”
এদের মধ্যে বাবু কাঁদতে শুরু করতেই জাঈদ বলে,”কাঁদে না বাবু..পাপা এসে গেছে। পাপা তোমায় ডাক্তারের কাছে যাবে।”
বলেই সে ছেলেকে আগলে নেয়। আমিনা বসে বসে অশ্রুপাত করতে থাকে।
আরহা এসে দাঁড়িয়েছে তাদের বাড়ি থেকে কিছুটা দূরে। মাশরাফিও আছে তার সাথে। একটু পর জাঈদ তার ছেলেকে নিয়ে সেখানে চলে এলো। জাঈদকে দেখেই আরহা এগিয়ে এলো। জাঈদ তার ছেলেকে আরহার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বললো,”এই দেখো বাবু..তোমার ফুফুমনি তোমার সাথে দেখা করতে এসেছে।”
আরহা তার ভাইপোকে কোলে নিয়ে বলে,”বাহ, আমার ভাইপো কি সুন্দর দেখতে হয়েছে। একদম ভাইয়ার কার্বন কপি। কারো নজর না লাগুক।”
আরহা বাচ্চাটার শরীর গরম দেখে বলে,”ভাইয়া, ওকে তো অসুস্থ মনে হচ্ছে। গা ভীষণ গরম।”
জাঈদ বিরক্তির স্বরে বলে,”আর বলিস না! এই আমিনা এতো বেশি কেয়ারলেস যে কি বলব। বাচ্চার জ্বর হয়েছে আমাকে বলেও নি।”
আরহা বলে,”ব্রো তুমি আবার এটা নিয়ে আপুর সাথে বেশি রাগারাগি করছ নাকি? আপুর কিন্তু এতে দোষ নেই। ছোট বাচ্চাদের এমন জ্বর আসা স্বাভাবিক।”
“তুই আর আমিনার হয়ে তর্ক করিস না। ওর সাথে সংসার করারই আমার কোন ইচ্ছা নেই। শুধু বাচ্চাটার মুখের দিকে তাকিয়ে…”
“ব্রো! এরকম কথা বলবে না। একজন বাচ্চার জন্য মা-বাবা দুজনেরই প্রয়োজন। আমি জানি, আমিনা আপুর উপর তোমার রাগ হওয়াটা স্বাভাবিক। আমি নিজেও আমিনা আপুর ব্যবহারে অনেক কষ্টে পেয়েছি। কিন্তু আপুর দিক থেকেও ও একদম ঠিক।”
“আচ্ছা, আমি তাহলে বাবুকে ডাক্তার দেখিয়ে আনি।”
“হুম যাও। আর আমিনা আপুর উপর বেশি রাগারাগি করবে না। সম্পর্কটা শুধু শুধু খারাপ করে লাভ নেই৷ আমি তো আশা করি একদিন আমাদের সবার সম্পর্ক আবার আগের মতো স্বাভাবিক হবে।”
পরের দিন,
আমিনা সায়রা খানকে সাথে নিয়ে হাসপাতালে এসেছে তার ছেলেকে টিকা দেওয়ানোর জন্য। সায়রা খান আমিনাকে বলে,”ভয় পাস না আমিনা।”
আমিনা বলে,”আমার সত্যি ভীষণ ভয় লাগছে আম্মু। ওতটুকু বাচ্চা কিভাবে কষ্ট সহ্য করবে? ওকে কাঁদতে দেখলে তো আমারই অসহায় লাগে। তার উপর ওর শরীরে জ্বর, আমি শুনেছি টিকা দিলে নাকি শরীর আরো বেশি অসুস্থ হয়ে পড়ে।”
“কিন্তু টিকা দেয়া তো জরুরি।”
“হুম। জানি না, জাঈদ আজকাল এভাবে রিয়্যাক্ট করে তাই আমার খুব ভয় করে।”
“কিছু হবে না একটু সময় দে সব ঠিক হয়ে যাবে।”
আমিনা সায়রা বেগমের সাথে হাসপাতালের দুই তলায় ওঠে। অতঃপর সায়রা বেগম কিছুটা অসুস্থ বোধ করায় বাইরেই বসে পড়েন। আমিনা তার ছেলেকে নিয়ে ভেতরে টিকা দিতে নিয়ে যায়। নিজের ছেলেকে ভরসা দিতে বলে,”ভয় পেও না বাবু। বেশি লাগবে না।”
অশ্রুজলে বোনা বিয়ে সিজন ৩ পর্ব ৭৮
তবুও টিকা দেওয়ার সময় বাচ্চাটা কেদে ওঠে। আমিনার চোখেও জল চলে আসে। টিকা দেয়া শেষ হতেই হঠাৎ আমিনা বাইরে থেকে চিৎকার শুনতে পায়,”আগুন! আগুন!”
ভয়ে ছেলেকে বুকে জড়িয়ে ধরে সে।